গণভবন চত্বরে সকাল থেকেই উৎসব উৎসব আমেজ চলছে।দেশ-বিদেশ থেকে আকাশপথে উড়ে এসেছেন নামী দামী ব্যক্তিবর্গগণ। এসেছেন আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেণ্ট বারাক ওবামা। সম্ভাব্য প্রেসিডেণ্ট ডোলান্ড ট্রাম্প এবং হিলারি ক্লিনটন।
পৃথিবীর আনাচে-কানাচে চিপায়-চাপায় যতো নাম জানা না জানা সেলেব্রেটিরা লুকিয়ে আছে, তাদের সকলেই নিজেদের প্রাইভেসি 'অনলি মি' থেকে 'পাবলিক' করে দিয়ে ভোরের ফ্লাইটেই ধরেছেন ঢাকার পথ।
পৃথিবীর তাবৎ মিডিয়া কর্মীরা তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ভোরেই।
কথা ছিলো সবার সামনে থাকবে বাংলাদেশি মিডিয়ার লোক। কিন্তু না। সেখানেও দাদাগিরি শুরু করেছে বন্ধুপ্রতীম দাদার দেশের মিডিয়া কর্মীরা। তারা বলছে,- 'ইয়ে বাঙলা হামারা আধীন মে। ইস ধারতি পে হামারা আধীকার জারা হ্যায়।'
ভারতের এক মিডিয়া কর্মীর মুখে এরকম কথা শুনে সাংবাদিক মুন্নী সাহা তার লম্বাটে মুখটাকে বাঙলা পাঁচের মতো করে বললো,- 'হুহ, ঢং দেখে বাঁচিনা। ভাবখানা এমন, যেন আমরা এখনই ভারতের অংশ হয়ে গেছি।'
এরচেয়ে বেশিকিছু উচ্চারণ করার সাহস মুন্নী সাহার নেই। সে জানে, সবার চোখ আর কানকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও, ভারতের গোয়েন্দা বাহিনী 'র' কে ফাঁকি দেওয়া যায়না।একবার যদি তারা জানতে পারে যে মুন্নী সাহা ভারতের মিডিয়া কর্মীদের দিকে মুখ ভেঙচিয়েছে, তাহলেই হবে। পৃথিবীর বুক থেকে সেদিনই ইলিয়াস আলির মতো তার নামটাও গুম হয়ে যাবে।
মুন্নী সাহার পাশে বসে আছে আরেক সাংবাদিকা নবনীতা চৌধুরি। মুন্নী সাহা মনে মনে বললো,- 'কি জানি বাপু! নবনীতা হয়তো 'র' এর কোন বিশেষ গোয়েন্দাও হয়ে যেতে পারে। রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না।'
ভারতের মিডিয়া কর্মীদের কাছে থ্রেট খেয়ে এই মূহুর্তে মুন্নী সাহার মন ভেঙে চুরমার। তার মনে পড়ছে একটি বাঙলা গান,- 'বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি.........'
হঠাৎ, নবনীতার স্পর্শে তার সম্বিৎ ফিরলো। সে দেখলো, নবনীতা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুন্নী সাহা বললো,- 'কি হয়েছে? বলদ গরুর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো এভাবে?'
নবনীতা হাসি হাসি মুখে শরীর নাড়তে নাড়তে বললো,- 'মুন্নী দি,দেখো তো, লাল টিপে আমাকে কেমন মানিয়েছে?'
এমনিতেই মুন্নী সাহা এই মূহুর্তে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারউপর নবনীতার এমন আদিখ্যেতা দেখে রাগে একেবারে তার গা জ্বলতে শুরু করলো। মুন্নী সাহা দেখলো, নবনীতা তার কপালে একটি বিশাল সাইজের লাল টিপ দিয়েছে। গায়ে পরেছে ভারতের পতাকার রঙের সাথে ম্যাচ করা শাড়ি।
মুন্নী সাহা জিজ্ঞেস করলো,- 'সাংবাদিকতা করতে এসেছিস নাকি ফটোসেশান করতে এসেছিস এখানে?'
নবনীতার মুখাবয়বে এতক্ষণ টলোমলো করতে থাকা হাসিটা মূহুর্তেই ম্লান হয়ে গেলো।সে মুখ কালো করে বললো,- 'ইশ! ওপার বাঙলার কত্তো কিউট কিউট হ্যান্ডসাম সাংবাদিক দাদারা এসেছে আজকে। এমন দিনে একটু খাঁটি অসাম্প্রদায়িক সাজ না হলে কি হয়,বলো?' - এই বলে নবনীতা আবারো তার শরীরকে এপাশ-ওপাশ দুলাতে লাগলো।
মুন্নী সাহার ইচ্ছে করছে নবনীতাকে এক্ষুণি একটা রামচড় দিয়ে টিপের মতো তার গালটাকেও লাল করে দিতে। নেহাৎ সেও 'র' এর কোন বিশেষ সদস্য হয়ে যায় কিনা- এমন একটা ডাউট থেকেই নিজেকে এরকম কাজ থেকে সংবরণ করলো মুন্নী সাহা।
-
সভাস্থলে ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছেন বাংলার সকল মন্ত্রী,উপমন্ত্রী, আমলারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সভায় প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেছেন।তার ঠিক পাশের সিটেই আছেন মহামতি নরেন্দ্র মোদি। তিনি আজ সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধোঁয়া ধুতি পরে এসেছেন এখানে।ইতোমধ্যেই মোদি-হাসিনা একবার চোখাচোখি হয়ে গেছে।কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, সেই মূহুর্ত বেশিক্ষণ দীর্ঘ হোলো না।কারণ, ঠিক যেই মূহুর্তে তারা চোখাচোখি হয়েছে, সেই মূহুর্তেই পশ্চিমাকাশ থেকে বোঁ বোঁ শব্দ করতে করতে নেমে এলো একটি বিশাল সাইজের বিমান।বিমানটি ল্যান্ড করা মাত্রই একদল বিশেষ প্রশিক্ষিত সেনারা কমান্ড তুলে স্যালুট দিতে দিতে হেঁটে গিয়ে বিমানের দরজা উন্মুক্ত করে দিলো। তাবৎ পৃথিবী দেখলো, বিমানের ভেতর থেকে তিনজন মহাপুরুষ ধীর পায়ে নেমে এলেন।
এই দৃশ্য দেখে সভার এক কোণায় আর এফ এলের একটি ভাঙা চেয়ারে বসে থাকা বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ তার সেই বিখ্যাত কবিতা থেকে মনে মনে দু'টি লাইন আবৃত্তি করলেন। লাইনটি ছিলো,- 'রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবিরা এসে – জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।'
অবশেষে উপস্থিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য এত আয়োজন, এত কৌতূহল, এত অপেক্ষা।
সবাই দেখলো, এই তিনজন ব্যক্তি একটি ক্যামেরাকে খুব সযত্নে ধরে আছে।এমনভাবে ধরে আছে, যেন এটিকে ধরতে পারলেই জীবন ষোল আনায় পূর্ণ হয়ে যায়।
মিডিয়া কর্মীরা এই তিনজন লোক, এবং সেই ক্যামেরাটার ছবি তুলছে। কেউ কেউ এই ফাঁকে ক্যামেরাটিকে ফ্রন্টে রেখে সেলফিও তুলে নিচ্ছে।কারো কারো আপসোস!- ইশ! ক্যামেরাটা যদি অটোগ্রাফ দিতে পারতো!'
ফটোসেশান পর্ব শেষ। এবার জার্মানি থেকে উদ্ধার করে আনা সেই বিশেষ ক্যামেরা এবং সেই তিনজন জাতীয় বীর মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। তাদের মধ্যকার হ্যান্ডসাম, গুড লুক ওয়ালা বীরটা এগিয়ে এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন,- 'উপস্থিত জনতা! শান্ত হোন। মহামূল্যবাণ এই ক্যামেরাকে জার্মানি থেকে আমরা তিনজন গিয়ে উদ্ধার করে এনেছি। এটা আজ থেকে আমাদের জাতীয় সম্পদ।আমরা এক্ষুণি এই ক্যামেরার বিশেষ পার্টগুলোকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।'
বক্তার কথা শুনে সভাস্থলে তালির জোয়ার পড়ে গেলো। তিন মিনিট ধরে শুধু তালির মূহুর্মূহুর শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না।
এবার পেছন থেকে আরেকজন বীর সামনে এগিয়ে আসলেন। তিনি ক্যামেরাটি যেই মাত্র হাতে তুলে নিলেন, তৎক্ষণাৎ বিশাল জনতার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ক্যামেরাটির উপর।সবাই মনে মনে বলতে লাগলো,- ' আহা! এই সেই ক্যামেরা! এই টাই?'
মঞ্চে আসীন ব্যক্তি এবার আস্তে করে ক্যামেরাটির একটি পার্ট খুলে নিলেন। উপস্থিত জনতার মধ্যে তক্ষুণি কান্নার রোল পড়ে গেলো। সবাই সমস্বরে বলতে লাগলো,- 'না না না! এমন নিষ্ঠুর কাজ করবেন না,প্লিজ। ক্যামেরাটিকে এভাবে কষ্ট দিবেন না। '
কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। লোকটি ক্যামেরাটির একটি পার্ট খুলে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন- 'প্রাণ প্রিয় জনতা! এই যে, এইদিকে দেখুন।এইটা হচ্ছে এই ক্যামেরার CCD, মানে Charged-Coupled Device. এইটা দিয়ে ছবি রেকর্ড করা হয়।'
এই দৃশ্য যেন সবার মধ্যে একটা শিহরণ দিয়ে গেলো। সবাই জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে জানালো যে, তারা এটা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে।
এরপর তিনি বললেন,- 'এই যে দেখুন, এটা হচ্ছে এই ক্যামেরার লেন্স। এইটা দিয়ে ছবি তোলা হয়।'
সবাই আবার জোরে জোরে হাত তালি দিলো। আহা! এমন জিনিস পৃথিবীবাসী আগে কোনদিন দেখেছে কিনা নিশ্চই সন্দেহ আছে। নইলে, একটি ক্যামেরা আনতে তিনজন লোককে রাষ্ট্রীয় খরচায় জার্মানি কেউ পাঠায়?
মঞ্চের শেষ প্রান্তে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। বৃদ্ধের পাশেই ছিলো মুন্নী সাহা। বেচারি থ্রেট খেয়ে আর সামনে এগুবার সাহস করেনি। সে বৃদ্ধ লোকটির দিকে ক্যামেরা তাক করে বললো,- 'কাগু, এইরকম অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আপনার অনুভূতি কি?'
বৃদ্ধ হাসিমুখে মুন্নী সাহাকে সাকা চৌধুরির সেই বিখ্যাত বাণীটি শুনিয়ে দিলো....।
নোটঃ (জার্মানি থেকে একটি ক্যামেরা কিনে আনার জন্য আমাদের সরকার তিন তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে জার্মানি পাঠিয়েছেন। সেই খবরকে ভিত্তি করেই এই ছোট গল্পের অবতারনা)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১০:৩৬