কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ঘুরবো। যেই কথা সেই কাজ। চেয়ার কোচ বাস ভাড়া করা হয়ে গেলো। ফরিদপুর থেকে সোজা রাঙ্গামাটি তারপর অন্যান্য। লাখ টাকার উপরে গাড়িভাড়া গুনে আমরা সবাই বাসে উঠলাম। বিকাল ৫ টায় রওনা দিয়ে সারারাত চলে জ্যামে ফেঁসে বেলা ১১ টা নাগাদ পৌঁছালাম রাঙ্গামাটি। গোসল খাওয়া সেরে বেরিয়ে পরলাম কাপ্তাই লেকে। ভাই কি বলবো... পানির রং যে আকাশের মতো হয় এটা না দেখলে বোঝা সম্ভব না। পথের সকল ক্লান্তি এক নিমিশেই কোথায় যে দূর হয়ে গেলো! লেকে ভ্রমন করতে করতে চলে গেলোম সুভলং ঝর্নায়। আমরা গিয়েছি ডিসেম্বরে তাই ঝর্না দেখতে পেলাম না। কিন্তু পাথুরে পাহারের গায়ে প্রাকৃতিক করুকাজ চোখ ঠান্ডা করে দিচ্ছিলো। চারিপাশে পাহার গোটা লেকটাকে ঘিরে রেখেছে। মাঝে মাঝে কিছু পাহারও আছে। নাম না জানা পাহারি গাছে পাহারগুলো আবৃত
বেশ ক্ষানিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে চলে গেলোম পেদা টিং টিং রেস্তুুরেন্ট এ। রেস্টুরেন্ট এ তেমন কিছু পাওয়া গেলো না। দ্বিগুন দামে পানি কেনা গেলো। তাই দিয়েই তৃষ্ণা মেটালাম।
অনেকে লেকের জলই খেয়েছে। আমাদের ট্রলার এইবার চললো ঝুলন্ত সেতুর দিকে। ঝুলন্ত সেতু পৃথিবীতে অনেক আছে কিন্তু এমন মনোমুগ্ধকর সেতু বুঝি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। দুই পাহারের পাদদেশে সেতু অবস্থিত। এলাকার উপজাতিরা পাহারি কলা, আখ জাম্বুরা ইত্যাদির পশরা সাজিয়ে বসেছে। কিনলাম কলা। প্রতি পিস ১ টাকা। আমি বললাম যদি ২০ টা নেই কিছু কম হবে না। দোকানী বলেলো কম হবে না। কিনলাম কলা। কলা যে এত মিষ্টি হয় আগে বুঝিনি। আসলে পাহারী বাসিন্দারা ছলচাতুরি বোঝে না। তাইতো তাদের ফল এত মিষ্টি। সন্ধ্যার সৌন্দর্য উপভোগ করে সেখান থেকে ফিরে এলাম পুরাতন বাসস্টান্ড এলাকায় আমাদের হোটেলে । হোটেল গ্রিন হিল। বেশ ভালই। হোটেলের বাবুর্চির সাথে কথা বলে জানতে পারলোম তার বাড়ি ফরিদপুরের টেপাখেলায়। দেশী হওয়ায় খাওয়ালোও বেশ। কাপ্তাই লেকের তেলাপিয়া মাছ। আহ্। সেকি স্বাদ। ডিসেম্বর এর শীতের ভয় ছিলো বেশ কিন্তু একি! সারারাত ফ্যান চালিয়ে ঘুমাতে হলো। সাথে বউ বাচ্চা ছিলো। শীতের দিনে ফ্যান চালিয়ে আমরা সবাই মিলে হাসলাম ক্ষাণিকক্ষণ। বন্ধুদের সাথে রাতে আড্ডা মেরে সকাল ৬ টায় বান্দরবান যাবো সিদ্ধান্ত হলো। রাতে আরামের ঘুম শেষে সকালে তরিঘরি উঠে প্রস্তুতি নিয়ে ৬ টা ৩০ শে আমাদের গাড়ি বান্দরবান এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পাহারি আকাঁবাঁকা পথ। কোথাও কোথাও বেশ উঁচু। ড্রাইভারকে ১ নম্বর গিয়ারে ফেলে উপরে উঠতে হচ্ছিলো। আকাঁবাঁকা পথে ভ্রমন যেমন ছিলো কষ্টকর তেমন আনন্দ দায়ক। মহিলারা বমি করে ফেলছিলো। হঠাৎ দেখি আমার কেমন যেন বমি বমি লাগছে। ব্যাপার কি? ফরিদপুর থেকে এতটা পথ আসলাম কোন সমস্যা হলো না। হঠাৎ একি? চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে বাস থামতেই হর হর করে বমি করে ফেললাম। লজ্জা লাগছিলো খুব। ভাবলাম একটু অপেক্ষা করো তোমাদেরও হবে। ফেরিঘাটে বেশ ক্ষানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো। আমাদের বাস বড় জোয়ার না পেলে ফেরির তলা বালিতে আটকে যায়। তাই সেখানে ঘন্টাখানিক দেরি হয়ে গেলো। হঠাৎ দেখি কর্ণফুলী নদীতে সামপান নৌকা। মাঝিকে বললাম ওপার যাওয়ার ভাড়া কতো, বললো, ৫ টাকা। ঝটপট উঠে পড়লাম কয়েকজন। কর্নফুলী নদীতে একটা রা্ইড হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে বাস ফেরিতে পার হয়ে আসলো। আবার বাসে রওনা। পথিমধ্যে মাঝে মাঝ্ই সেনাদের চেকপোষ্ট। এসএমজি অস্ত্র হাতে তারা বাস চেকিং করছিলো। আমার ছেলে ভয় পেয়ে গেলে তাকে অভয় দিয়ে বললাম,এনারা আমাদের রক্ষক, কোনো ভয় নেই। আর্মি লোকটিও ছিলো ভালো আমার ছেলেকে বললো, ভয় নেই বাবা। আবার আমাদের গাড়ি চলতে শুরু কররো। হঠাৎ গুলির শব্দ পেলাম। ব্যাপার কি? অনেকে ভয় পেলো। ড্রাইভার বললো, আর্মিদের ফায়ারিং টেনিং হচ্ছে। দূর থেকে দেখলাম। সত্যিই ফায়ারিং হচ্ছে। আঁকাবাঁকা পথ এবার যেন একটু বাড়লো। দেখি ড্রাইভার ছাড়া প্রায় সকলেই একটু আধটু ওয়াক ওয়াক করছে। আমি হেসে বললাম, কি কেমন লাগে। আসলে সমতলে অভ্যস্ত লোকেদের পক্ষে এটা একটা নতুন মাত্রা। যাহোক। হঠাৎ একটা পাহারের কাছে এসে আমাদের গাড়ি থেমে গেলো। পিয়াল ভাই মানে আমাদের বড় ভাই বললেন, আমরা এসে গেছি স্বর্ণ মন্দির।
সময় ৩০ মিনিট। বাস থেকে নেমে আমরা ছুটলাম স্বর্ণ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। প্রায় ২ থেকে ৩ শত ফুট পাহার বেয়ে উঠে হাপাতে হাপাতে অবস্থা খারাপ। টিকিট মাত্র ৩০ টাকা ঝটপট টিকিট নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ওহ্ মন ভরে গেলো। পাহারের চুড়ায় সোনা রঙ্গের স্বর্ণ মন্দির। সমস্তটা্ই সোনালী রঙ্গের। সোনালী ড্রাগন, মূর্তি প্রভৃতি নিচে চরাচর। অনেক ছবি তুললাম। ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম আমরা। প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ডাব ছিলো। কিনলাম দুটো। খেলাম পেট পুরে। আহ্ কি শান্তি। গাড়ি আমাদের চললো বান্দরবান শহরের দিকে। মিনিট দশের চলার পরে গাড়ি বান্দরবান শহরে পৌঁছে গেলো। গাড়ি থেকে নেমে এবার চাঁদের গাড়ির খোঁজ শুরু হলো। আরে আমরা যাবো নীলগিরী প্রায় ৩ হাজার ফুট উপরে সেখানে তো আমাদের এই বড় বাস যেতে পারবে না। নীলগিরী যাবার জন্য চাঁদের গাড়িতে চেপে যেত হয়। প্রতি গাড়ির ভাড়া মিটলো ৪২০০ টাকায়। প্রতি গাড়িতে চড়তে পারবে ১৪ জন। দুই গাড়ি নিলাম আমরা। দুপুর সারে বারোটায় আমাদের চাঁদের গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমি সকাল থেকেই না খেয়ে ছিলাম। বমির হবার ভয় ছিলো। চাঁদের গাড়ির রাইড ছিলো রোমাঞ্চকর। অনেকটা রোলার কোষ্টারে চড়ার মতো। ডানে বামে অসংখ্য পাহাড় আর ঘন ঘন বাঁক। আমরা উঠছি তো উঠছিই। অন্যান্য পাহারগুলো এবার উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বাড়িঘর মানুষজন তো দূরের কথা পাহারগুলোই ছোট ছোট দেখাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে পাহারের মাঝে নীল রঙ্গের নদী দেখতে পাচ্ছিলাম। চোখ সরাতে পারছিলাম না। কি দেখছি ! পৃথিবী কতো সুন্দর। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে এমন সুন্দর একটা যায়গায় জন্ম দিয়েছেন বলে মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। ঘন্টা দেড়েক পরে গাড়ি থামলো। আমরা এসে গেছি চিম্বুক পাহারে। রাস্তা এমনিতেই পাহারের উপরে ছিলো তার পরেও চিম্বুকের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে চাইলাম। আমাদের কয়েকটি ছোট ভাই রাস্তা ছাড়াই পাহারের গা বেয়ে উঠতে শুরু করলো। আমরা রাস্তা বেয়ে উঠেছি। চুড়ায় যেয়ে দেখি সবকটা হাপাচ্ছে। নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম কারণটা কি? নিচ থেকে চুড়াটা খুব বেশি উঁচু দেখায়নি। কিন্তু উপর থেকে বুঝলাম বেশ উঁচু প্রায় ২ শত ফুট হবে। ওদের দেখে এক বড় ভাইও ঐ পথে উঠেছে। আমাকে দেখে বললো, ভাই খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। মধ্য পাহারে উঠে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। না পারি উঠতে না পারি নামতে। কিযে অবস্থা। আমি তাকে বারণ করে বললাম, পাগল হয়েছেন? সাথে সাথে থাকুন। বেশি উত্তেজিত হয়ে শেষে আনন্দটা্ই মাটি করবেন দেখছি। তিনি বুঝলেন আর সেই যে আমার সঙ্গ নিলেন আর সঙ্গ ছাড়া হননি। চিম্বুকের চুড়ায় দেখলাম বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের একটা স্টেশন রয়েছে। সেখানে কিছু বাঙ্গালী অফিসার বাস করেন। আমাদের দেখে তারা জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে এসেছি। আমরা বললাম ফরিদপুর থেকে। আমাদেরকে খুব সাদরে তারা আমন্ত্রন জানালেন। চিম্বুকের চুড়ায় জলাপাই বাগান থেকে পাহারি জলপাই খাওয়ালেন। পাহারের জলপাই পাহারের মতোই বড় বড় আর কেমন যেন বুনো। খেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না মুখে নিয়ে দেখলাম চমৎকার।জলপাই খেয়ে বেশ শক্তি ফিরে পেলাম শরীরে।
পাহার থেকে নেমে আবার গাড়িতে উঠলাম। পথি মধ্যে আবার একবার থেমে পাহারি পেপে খেলাম। পাহারী পেপে বেশ মিষ্টি। যতই সামনে আগাচ্ছি ঠান্ডাটা যেন হিম হতে শুরু করেছে। বান্দবানে শহরে থাকতে বেশ গরম লেগেছিলো ছোট ভাইরা তাই গরম পোশাক আনেনি। আমাদেরকে ড্রাইভার বলে দিয়েছিলো গরম পোশাক নিতে। তাই সঙ্গে এনেছিলাম। ড্রাইভারকে মনে মনে একটা ধন্যবাদ জানালাম। গরম পোশাকটা পড়ে নিলাম। বেলা সারে চারটার দিকে বিশাল উচ্চতার সেই নীলগিরীতে পৌছালাম। ওহহো! কি দৃশ্য! মনে হচ্ছে একটা উপগ্রহ থেকে বুঝি পৃথিবীকে দেখছি ! এখানে আর্মি ক্যাম্প করেছে। তারা জায়গাটাকে খুব সুন্দর করে পরিস্কার করে কতোগুলো কটেজ তৈরি করেছে। সুন্দর সুন্দর স্পট গুলোতে স্টিলের রেলিং দিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন ফুলের বাগান করেছে। চমৎকার জায়গা। একবার মনে হলো জান্নাত কি এমন সুন্দর হবে। হে আল্লাহ জান্নাত যেন এমন সুন্দর হয়। দূরে মেঘ দেখা যাচ্ছে যা আমাদের থেকে নিচে মানে আমরা মেঘের উপরে চলে এসেছি। সাদা মেঘের গুচ্ছ দেখার জন্য উপরে তাকতে হয় না, নিচের দিকে তাকাতে হয়। ছবি তুললাম পটাপট।
সারাদিন না খেয়ে আছি অথচ খুধা পাচ্ছে না। যা দেখছি তাতে খুধা থাকেনা। সারে পাঁচটা নাগাদ আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলো আমরা গাড়িতে চলছিলাম। বিকেলের সোনালী সূর্য মেঘের উপরে দিয়ে লুকোচুড়ি করে পাহারে এসে পড়েছে। এ যে কি অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না। গাড়ি চলছিলো এবার নিচের দিকে তাই ড্রাইভারকে বেশি বেগ পেতে হলো না। পাহারি কলাগাছ আর কাশফুল ছেয়ে আছে পাহারগুলোকে। আমরা গাড়িতে খুব আনন্দ করছিলাম। পাহারে সন্ধ্যাটা ঝুপ কিরেই নেমে পড়ে। আমাদের পৌঁছানোর আধাঘন্টা পূর্বেই সন্ধ্যা নেমে এলো। পাহারের পথে রাতের অভিজ্ঞতাও মন্দ না। বান্দরবান শহরটি কিন্তু বলতে গেলে গর্তের মধ্যে মানে চারিপাশে পাহার তার মধ্যে বান্দরবান। বাসে উঠার আগে কিছু খাওয়া দাওয়া করলাম। বাসে উঠে দেখলাম বেশ ঘুম পাচ্ছে। বাস চলেছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার বললো, ঘন্টা তিনেক লাগবে। ভাবলাম একটা ঘুম দেই। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেলো। কক্সবাজার আসার একটু আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হোটেল বিচ হলিডেতে আমাদের রুম বুক করা ছিলো উঠে পড়লাম রুমে। বাথরুমে ঢুকে সময় নিয়ে ফেশ হয়ে নিলাম। সমুদ্রের এত কাছে এসেছি আর রাতের সমুদ্র দেখবো না? একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত এগারোটার দিকে বিচের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের হোটেল থেকে হেঁটে বিচে যেতে সময় লাগলো ৫ মিনিট। ভাবলাম মন্দ না। এখানকার ভাবই আলাদা। দেখলাম ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সায় মনিটর লাগিয়ে ধুমধাম গান বাজাচ্ছে। দেখে হাসি পেলো। ড্রাইভার ব্যাটা সামনে না দেখে যদি মনিটরে চলা ভিডিও দেখে তাহলে পোয়া বারো। সুগন্ধা বিচের সামনে আসতেই সমুদ্রের ডাক শুনতে পেলাম। আহ্। ডাকছে। সমুদ্র আমাকে ডাকছে। ছুটে গেলাম আমরা। রাতের সমুদ্র। দেখে মন ভরেনা। প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়ালাম ওখানে। ঢেউগুলো সাদা ঘোড়ার বেশে কুলে আছড়ে পড়ছিলো।মন চচ্ছিলো নামি কিন্তু নিজেকে সংবরন করালাম। নির্মল বাতাসে মন ভরে যাচ্ছিলো। আমাদের একজন বললো, ফিরে যেতে হবে। হোটেলে ফিরে গিয়ে ঘুম দিলাম বেশ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হেটেলে কিছু সমস্যা থাকায় সেটাকে চেঞ্জ করে পাশেই হোটেল সী কিং এ উঠলাম। হোটেলটা বেশ মনোরম। আমরা উঠলাম পাঁচ তলায়। লিফ্ট থাকাতে পাচ তলাকে পাঁচতলা মনে হলো না। মাল পত্তর রেখে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ের গেলাম সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রে পা ভেজালাম। বিশালাকায় ঢেউ আমার পা বেয়ে উপরে উঠে আসছিলো। সমস্ত শরীর শিরশির করছিলো। কি স্নিগ্ধ তার পরশ। সাদা ঠেউয়ে আমি হারিয়ে গেলাম, ভিজলাম। শেষে গোসল করলাম। ঝাপাঝাপিও করলাম বেশ। ওখানে খুব কম টাকায় ফটোগ্রাফার পাওয়া যায়। প্রতি ছবি ১৫ টাকা। বেশ কিছু ছবি তুললাম।
ঘোড়ায় চড়লাম। ঘোড়ায় চড়াটা ছিলো বেশ পরিশ্রম এর।ওয়েস্টার্ন মুভিতে দেখেছি নায়করা ঘোড়ায় চড়ে। তাই সাধ জাগলো। কিন্তু এটা যে এত পরিশ্রম এর কে জানতো। এর চেয়ে আমার বাইক অনেক আরাম দায়ক। গোসল সেরে হোটেলে ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া করে দিলাম ঘুম। বিকালে সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। সন্ধ্যার দিকে বার্মিস মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অটোওয়ালা আমাদেরকে একটা মার্কেটের সামনে এনে নামালো। ঢুকলাম মার্কেটে। বার্মা দেশের সব পন্য। যা দেখি তাই ভালো লাগে। কিনলাম পটাপট। বাড়ি ফিরলে ছোট বোন, শালিকা আর ভাবিরা ধরবে। বলবে, কি এনেছি তাদের জন্য। তা্ই বারো জোড়া বার্মিস স্যান্ডেল কিনলাম। সাথে আমারটাও। বউয়ের জন্য কিনলাম বার্মিস জুতা, থ্রিপিস, বাচ্চাদের জন্য পোশাক খেলনা, আমার জন্য শার্ট বাবার জন্য ফতুয়া। ঘরের জন্য কিনলাম একটা নকশি করা বিছানার চাদর। বার্মিস মেয়েরা হাতে বুনেছে দামের দিকে দেখলাম না কিনে ফেললাম। পকেটের টাকা হুর হুর করে গায়েব হচ্ছিলো। ভাবলাম ধুত ফরিদপুর গেলে কতো টাকা আসবে। খরচ করার আনন্দে মুখর ছিলাম। টাকা শেষ হলে ডেবিট কার্ড তো আছেই চিন্তা কি? প্রায় ৫ ঘন্টা এ মার্কেট ও মার্কেট ঘুরে যা কিনলাম তাতে বড় বড় চার ব্যাগ হয়ে গেলো। এবার ভাবছি, এতো ব্যাগ নিয়ে ফরিদপুর যাবো কিভাবে? বউ বলেলো এক কাজ করলে কেমন হয়। একটা চালের বস্তা কিনে তার মধ্যে ব্যাগগুলো ভরে ফেলি। এসব ব্যাপারে মেয়েদের বুদ্ধি যে মাৎ করে দেবার মতো তা অনেক আগেই বুঝেছি। আমার পা ব্যাথায় টনটন করছে। রুমে ফিরে এসে আজ আর বের হলাম না। রাতে বউকে জড়িয়ে ধরে দিলাম একটানা ঘুম। পরদিন সকালে আবার ফিলে গেলাম সমুদ্রের কাছে। ঝিনুক মার্কেট থেকে কেনাকাটা করলাম বেশ।বউ বাচ্চাকে একটা চারপায়া ভাড়া করে তাতে বসিয়ে রেখে কিছু খাবার কিনে দিয়ে আমি ঝিনুক কুড়াতে নামলাম। ঝিনুক কুড়াচ্ছি আর পকেটে রাখছি। দারুন লাগছে। হাঁটতে হাঁটকে এক সময় লাবনী বিচে চলে আসলাম। লাবণী বিচের সৌন্দর্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। এলাকায় অনেকে বলেছে, পানি দেখার মধ্যে এত আনন্দ কি আছে। তাদের জন্য বলি আরে ব্যাটা আনন্দ হচ্ছে মনে লালনের ব্যাপার। এই ব্যাটারা স্বর্গে গেলে মহান আল্লাহ কে হয়তো বলবে, স্বর্গে সুন্দরের কিছুতো দেখি না। যা হোক লাবনী বিচে ঢেউগুলো আড়া আড়ি ভাবে বিশাল বড় হয়ে আসে। থাকতে না পেরে নেমে পড়লাম। আহ কি আনন্দ।
ক্ষানিক মজা করে করে ফিরে আসতে হলো কারণ বাঁশি বাজানো হচ্ছে। এখন ভাঁটা হবে। তাই উঠে এলাম। আবার ঝিনুক কুড়ানোয় মন দিলাম। কি সুন্দর সুন্দর সব ঝিনুক। এক একটার এক এক রকম। আমায় দেখে আরো কিছু লোক ঝিনুক কুড়াতে শুরু করলো।
হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে এলাম সুগন্ধা বিচে। ক্ষানিক বাদে আবার জোয়ার এলো। ভাবলাম এইবার বহুদূর যাবো। আস্তে আস্তে নামলাম শাঁতরে বেশ দূরে চলে গেলাম। এখান থেকে লোকজন সব ছোট ছোট দেখাচ্ছে। ভাবলাম আর না। ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করলাম। এর মধ্যেই আবার বাঁশি শুনতে পেলাম। আমি আগাচ্ছি কিন্তু বেশ ক্ষানিক পরে বুঝলাম আমি আসলে আগাতে পারছি না। তবে কি সমুদ্র আমাকে নিয়ে যাবে তার গর্ভে? মাথায় বুদ্ধি এলো। ডুব দিয়ে দেখলাম ক্ষনিক নিচেই বালু। আমি ডুব দিয়ে বালুতে পায়ের চাপ দিয়ে সামনে আগাতে থাকলাম। দেখলাম এক সময় গলা পানি হয়েছে । তারপর ঐভাবেই বালুতে পায়ের চাপ দিয়ে সামনে এগিয়ে আসলাম। যখন কোমর পানিতে আসলাম তখন চিন্তা দূর হলো।
ধীরে ধীরে আমি উঠে এলাম। হালকা বাতাসে শীত করছিলো। বউয়ের কাছে টাউয়েল ছিলো তা দিয়ে ভালো করে গা মুছে নিলাম। শুকনো একটা গেঞ্জি পড়ে নিলাম। রুমে ফিরে মিঠা পানিতে গোসল সেরে একবারে প্রস্তুত হয়ে নিচে নামলাম। এবার আমরা যাবো হিমছড়ি আর ইনানীর পথে। দুপুরের লাঞ্চটা বাংলা রেস্তোরা নামে একটি রেস্তোরায় করলাম। গাড়িতে উঠলাম যখন তখন বিকাল ৩ টা বাজে। গাড়ি ছুটে চলেছে সমুদ্রের তীর ঘেসে। সমুদ্রের তীরে পাহারের দেয়াল। বুঝলাম আল্লাহই এই দেয়াল সৃষ্টি করেছেন যাতে উপকুলের মানুষ নিরপদে থাকতে পারে। গাড়ি থামলো হিমছড়িতে। ৩০ টাকা টিকিট কিনে ঢুকলাম ভিতরে। ঝর্না দেখলাম। কি স্নিগ্ধ তার জল। একটানা নিচের দিকে নামছে। ভাবলাম এই বুঝি সব। কিন্তু না দেখি আমাদের সাথের লোকজন পাহার থেকে নামছে। ভাবলাম চড়া যাক। কিন্তু কি সর্বনাশ উপরে উঠছি তো উঠছিই হাপাতে হাপাতে অবস্থা খারাপ। একবার মনে হলো ধুত ছাই নিচে নেমে যাই আবার ভাবলাম শেষ না দেখে ছাড়বো না। হাপাতে হাপাতে চুড়ায় যখন উঠলাম তখন আর দাঁড়িয়ে থাকা দায়। কতোগুলো ছবি তুলে আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলাম। ঘেমে সারা শরীর ভিজে গেছে। পরিশ্রম হয়েছে খুব। পাশেই বিচ। বিচে আর নামলাম না। তবে অদ্ভুত এক জিনিস দেখলাম। জিনিসগুলোকে দেখে মনে হয় মরা তিমি মাছ বুঝি ডাঙ্গায় পড়ে আছে। আসলে তা নয়। আর্মিরা কম্বল দিয়ে বিশালাকায় বস্তা বানিয়ে তাতে বালু ভরে তীরে রেখেছে যাতে জোয়ারের ঢেউয়ের আঘাতে রাস্তা ভেঙ্গে না পড়ে। আমাদের গাড়ি চলছে এবার ইনানীর উদ্দেশ্যে। গাড়ি যখন থামলো। তখন সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে। দিলাম সবাই দৌড়। দেখলাম সেই অপরুপ দৃশ্য। সমুদ্রের ওপারে সূর্য মহাশয় রাগে রাঙ্গা হয়ে ভুস করে একটা ডুব দিলেন। তার পরের দৃশ্য আরো সুন্দর। আকাশটা কেমন যেন একটা লালীমায় আবৃত হয়েছে। কি অপুরুপ দৃশ্য। এটা আসলে বলে বোঝানো মুশকলি। বেশ কিছু ছবি তুললাম।
সন্ধ্যা হলে আবার ফিরে এলাম। বাসে উঠে বসতে ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিলো। রাত আটটা নাগাদ রুমে ফিরলাম। ভাবলাম বাকী কেনাকাটা সারতে হবে। একটু জিড়িয়ে ছুটলাম বার্মিস মার্কেটের দিকে। এবার কিন্তু অনেকগুলো মার্কেট ঘুরলামেএকটা লা্ইটার কিনলাম। কিনলাম একটা সুইস আর্মি নাইফ। একটা দারুন ওয়ালেট কিনলাম। চরপটির দোকানে চটপটি খেলাম। আরো কিছু কেনাকাটা করে রাত ১১ টার দিকে সরাসরি বিচে গেলাম। ঝিনুক মার্কেট থেকে ঝিনুকের উপরে বন্ধুদের নাম লিখে দশটা ঝিনুক নিলাম।
বার্মিস এক ছেলে দোকানীর সাথে বেশ আড্ডা দিলাম। আড্ডা দিয়ে ফিরতে দেরি হয়ে গেলো। হোটেলের সামেনে যেয়ে দেখি গেট লক হয়ে গেছে। কি করি। শেষে রুমের চাবির ছড়ার উপরে থাকা নম্বরে ফোন করে গেট খোলা হলো। ফ্রেশ হয়ে দিলাম ঘুম। পরদিন সকালে আটটার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। কারণ এবার চট্টগ্রাম দেখতে হবে। আসলে একদিনে কি আর সব দেখা সম্ভব। তবুও যতোটা পার যায়। সকালের নাস্তা সেরে বাসে উঠলাম। বাস চলছে দূরন্ত গতিতে। ঘন্টা দুয়েক চলার পরে বাস থেমে পড়লো। আমরা নামলাম বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। ২০ টাকা টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকতেই কতোগুলো বানর হুম হুম শব্দে আমাদের স্বাগতম জানালো। সাফারি পার্কটা বিশাল। আমাদের হাতে সময় ছিলো মাত্র ১ ঘন্টা। যতটা পারা যায় দেখতে পা চালালাম। বানর দেখলাম বেশ কয়েক প্রজাতির। এক খাচায় লিখা আসামী বানর। আমার বউ জিজ্ঞেস করলো। সে কি অপরাধ করেছে। আমি হেসে বললাম, আসলে এ আসামী সে আসামী নয় এটা আসাম দেশের বানর তাই আসামী বানর। শিমপাঞ্জি , ময়ুর মদন টাক নামে এক প্রকার বক দেখলাম যার মাথায় কোন চুল নেই। একজন বললো কুমির আছে। ভাবলাম কুমির দেখবো। ডানের পথ ধরলাম। দূরে দেখলাম দুটো কুমির রোদ পোহাচ্ছে। কুমির দেখা শেষে এবার বন দেখার পালা।
সবাই মিলে বন দেখতে দেখতে সাফারী পার্ক দেখা শেষ করলাম। দারুন লাগলো। বন দেখার অনুভূতিটি ছিলো দারুন। আবার বাসে চেপে বসলাম। এবার বায়েজিদ বোস্তামি রঃ এর মাজার। গাড়ি চললো একটানা। পথিমধ্যে কাঞ্চন ব্রিজ দেখলাম। বায়েজিদ বেস্তামির মাজারে এসে দুপুর একটা বেজে গেলো। অযু করে নামাজ পড়লাম। তারপর মাজার প্রাঙ্গনে যেয়ে মাজার জিয়ারত করলাম। চারিপাশটা দেখে তারপর নেমে এলাম। পাশেই একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেলাম। আবার বাসে চেপে এবার ফয়স লেক। ঘন্টা খানেক বাদে আমরা বিকাল সারে তিনটার দিকে ফয়স লেকে পৌঁছলাম। টিকিট কাটতে গিয়ে একি! বড়দের জন্য ৩০০ আর ছোটদের জন্য ২০০। একবার ভাবলাম ঢুকবো না। আবার ভাবলাম আর আসি কি না আসি ঢুকি। ঢুকলাম ভিতরে। ধুত পুরাটাই মাটি। কাপ্তাই লেক দেখার পরে ফয়স লেক পানসে লাগছিলো। তবে কয়েকটি রাইডে মন ভালো হয়ে গেলো। আমি আর মুকুল ভাই চরলাম স্লা্ইড রাইডে মুকুল ভাইয়ের হার্টে সমস্যা। সেটা জেনেছি রাইড শেষে। রাইডিটা চরম লেগেছিলো। এরপর রোলার কোষ্টার, কার ইত্যাদি শেষ করে ফয়স লেক দেখলাম।
সন্ধ্যার্ ফয়স লেক বেশ লাগলো। বের হয়ে এলাম ফয়স লেক থেকে। এবার ফেরার পালা। আমরা যখন রওনা হলাম তখন সন্ধ্যা ৭ টা। ভাবলাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন দুপুর ১২ টা বাজেবে। কিন্তু ড্রাইভার ছিলো পাংখা। ঢাকা চট্টগ্রামের কোন গাড়ি আমাদের গাড়ি ওভারটেক করতে পারেনি। ভয় হচ্ছিলো। কিন্তু ড্রাইভার অভয় দিয়ে বললেন, ভয় নেই। রাত বারোটা নাগাদ আমরা কুমিল্লার একটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্ট এ রাতের ডিনারের জন্য নামলাম। ভুনা খিচুরি খেয়ে বাসে উঠলাম। শরীর বেশ ক্লান্ত ছিলো দিলাম এক ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দেখি পাটুয়ারি ফেরি ঘাট। রাত তখন ৪ টা। আমার তো বিশ্বাস হয় না। এত তারাতারি এতটা পথ! আমিতো ঘুমিয়ে ছিলাম। যারা জেগে ছিলো তাদের কাছে শুনলাম। গাড়ির গতিবেগ গড়ে ১০০ কিঃমিঃ ছিলো। ভাবলাম ঘুমিয়ে বেশ কাজ হয়েছে। নয়তো ভয়ে অবস্থা টাইট হতো। ফেরি পার হয়ে আমাদের গাড়ি ফরিদপুর পোষ্ট অফিসের সামনে যখন থামলো তখনও ফজরের আযান হয়নি। আমি বাবাকে ফোন করলাম। তিনি আমাদের রিসিভ করার জন্য কমলাপুর মাটিয়া গোরস্থান মসজিদের সামনে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা একটা অটোরিক্সা যোগে কমলাপুর পৌঁছে গেলাম। বাড়ি যখন পৌঁছেছি তখন ভোরের আলো ফুটেছে। মা আগেই নাস্তা বানিয়ে রেখেছিলেন। নাস্তা করে আবার ঘুম। ঘুমের মধ্যে শপ্ন দেখলাম আমি তখনও বান্দবানের পথে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:০০