স্টেডিয়ামের ধারে প্রায় নিরব একটি রাস্তার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ভ্রাম্যমান একটি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাম কাঁধে একটি হাতের স্পর্শে ঘূরে তাকালাম। আরে বাছের ভাই। আমি কাপ নামিয়ে বললাম, কেমন আছেন। নিয়মিত পান খাওয়া জড়ানো জিভে বাছের ভাই বললেন, ভাল আছি। দোকানে যে ছেলেটি চা পরিবেশন করছিলো তাকে ডেকে আরো এক কাপ চায়ের কথা বলতে যাব, সে দেখলাম আমার বলার আগেই চা হাতে হাজির হয়েছে। ছোট কাঁচের গ্লাসের মত কাপটি বাছের ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম নিন চা খান। সম্প্রতি সাহিত্য নিয়ে দু’একটু চর্চা করছি বলে জিভে দাঁত চেপে বললাম। দুঃখিত, নিন পান করুন। বাছের ভাই হাসি হসি মুখে অনেকটা গদো গদো ভাবের সাথে চায়ের কাপটি ধরে পায় এক চুমুকেই চা-টা শেষ করে আহ্ করে একটা শব্দ করে বললেন, আমরা বাঙালি। আমরা সবই খাই, এতে দোষের কিছু নাই। ক’জনকে বলতে শুনেছেন আমরা চা পান করছি। আমি আর কথা বাড়ালাম না। এটুকু জানি, কোন মানুষের স্বাসযন্ত্রে উচ্চারিত কোন শব্দের অর্থ অপর কোন ব্যক্তি যদি বুঝতে পারেন তাহলে ওটাকেই ভাষা বলে। বইয়ের ভাষায় ভাষার সংজ্ঞা অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেও বিষয়টা কিন্তু একই। বাছের ভাইয়ের বয়স পঁয়তাল্লিশের মত হবে। বোঝাপরার অনেকগুলো ভাঁচ তার কপালে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে। ফর্সা সুন্দর চেহারায় বলিরেখাগুলো বেশ স্পষ্ট। মাঝারি গড়নের শরীর। মাথাটা প্রায় চুলশূন্য। কানের দুই পাশদিয়ে যাকিছু আছে তাও আবার পেঁকেটেকে একেবারে একাকার অবস্থা। তার সাথে আমার পরিচয় বেশি দিনের নয়। আমার ভাগ্নে রাজুকে স্কুলে আনা নেওয়ার কাজটা আমিই করি। সেখানেই তার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর মাঝে মাঝেই গল্প আড্ডা হয়েছে। সকালে বিকালে যখনই তার সাথে আমার দেখা হয়েছে তখনই দেখেছি শার্ট প্যান্ট ইন করে জুতা টুতা পড়ে তিনি একেবারে সাহেব সেজে প্রস্তুত। সর্বক্ষণ এরকম বেল্ট আটা দেখে বোঝা যায় পূর্বে চাকরি বাকরি করতেন হয়তে। আর বেল্টের চামড়ায় বেহাল দশা দেখে এও বোঝা যায় চাকরিটা এখন আর নেই। তার সম্পর্কে যতদূর জেনেছি তাতে গ্রামের বাড়িতে জমাজমি যা আছে তা দিয়ে বেশ চলে যায়। দু’টি সন্তানের জনক, তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বাছের ভাই খুক করে একটু কেশে বেশ কায়দা করে বাঁচা মাছের মতো মুখ চোঁখা করে পিচিক শব্দ তুলে পানের রস ফেলে বললেন, দুনিয়া থেকে মায়া-মমতা, প্রেম-ভালবাসা এসব দিন দিন উঠে যাচ্ছে। আমি বললাম, কেন কী এমন হলো যে একথা বলছেন? বাছের ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে কথা বলে কী আর হবে বলেন। এই আমাকে দেখেন, আমি কিন্তু বলতে গেলে প্রায় বেকার একজন মানুষ। মাঠে কিছু জমিজমা আছে তা থেকে যা আসে তা দিয়ে মোটামুটি চলে যায়। ছেলে মেয়ে দুটোকে ভালো বিদ্যা দেব বলে শহরে ফ্যাট ভাড়া করলাম। দোতলার একটি ফ্যাট। তেমন কিছু না এই যাকে বলে কমার্শিয়াল কায়দায় তৈরি দুটো বেড রুম, মাঝখানে ড্রইং কাম ডাইনিং কাম লিভিং কাম গেস্ট যেটাই বলেন না কেন এই তিন রুমের ছোট্ট একটি ফ্যাট। ভেবেছিলাম শেষ বয়সটা র্নিঝঞ্ঝাটে পার করবো। কিন্তু ঝামেলাটা হয়েছে কি জানেন? শহরে বলেন, গ্রামে বলেন আর বাংলাদেশের চৌষট্টিটি জেলা যেখানেই বলেন, এমন কোন যায়গা নেই যে, সেখানে আমার আত্মীয়-স্বজন নেই। ধুমায়িত কাপ থেকে মুখ ঊচিয়ে বললাম তাই নাকি। তাছাড়া আর কী? সেদিন তো ভোলা জেলার মনপুরা চর থেকে এক দল এসে হাজির। তাদের একজন নাকি আপনার ভাবির বোনের ননদের আপন খালা শাশুড়ীর জামাই। ব্যাপারটা বুঝুন। একদল যাওয়ার আগেই আরেক দল এসে হাজির। এদিকে বাজার করতে করতে আমার অবস্থা একেবারে নাকু-ছুকোছো। আমি বললাম, মানে? মানে আর কিছুই নয় ওটা কোরিয়ার একটা আঞ্চলিক ভাষা। ‘নাকু ছুকোছো‘ অর্থ হলো- আমার অবস্থা শেষ। যেমন, আরবী ভাষায় ‘আনা খালাছ’, ইংরেজীতে ‘আই এ্যাম ফিনিস্ড’। আমি হেসে ফেললাম। বাছের ভাই পিচিক করে আবার শব্দ তুলে পানের রস ফেলে বললেন, আরে বুঝলেন না, আমার অবস্থায় থাকলে বুঝতেন। মাসের পয়ত্রিশ দিন যার বাড়ি মেহমান এসে পড়ে থাকে তার কোথায় যন্ত্রণা হয় আপনি কীভাবে বুঝবেন। আসলেই তো এই দ্রবমূল্যের বাজারে নিজেদের বেঁচে থাকাই তো মুশকিল। উপরি যদি লাগাতার দল বেঁধে আত্মীয়-স্বজন এসে পড়ে থাকে একে বিপদই বলতে হবে। বাছের ভাই একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে বললেন, কীভাবে যে ম্যানেজ হয় বুঝিনা। সবই আল্লাহর তা’য়ালার ইচ্ছা বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আজ আসি, আমাকে আবার বাজারে যেতে হবে। আমি বললাম, এখন বাজারে কেন? এতণ কী বললাম আপনাকে। আমার তো প্রতিদিন দু’বেলা বাজার করতে হয়। আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, ও আচ্ছা। তা এখন ক’জন আছে? হাত উঁচিয়ে পাঁচটি আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন। আমার যা হিসাব তাতে আঙ্গুলগুলো আরো কিছু বেশি থাকলে ভালো হতো। আচ্ছা আসি, আবার দেখা হবে বলে, বাছের ভাই চলে গেলেন।
শরতের বিকালে ইচ্ছে হাঁটাটা আমার বেশ লাগে। সাদা মেঘের ফাঁক গলে উকি দেওয়া সূর্যের আলোটা স্নিগ্ধ ভাবে গায়ে এসে পড়ে। শরীর মনে কেমন একটা স্ফুর্তি ভাব জাগে। দেশটা যে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তা আসে পাশে চোখ মেললেই বোঝা যায়। আমার বাস বাংলাদেশের মধ্যভাগের একটা জেলা শহরে। ব্রিটিশ আমলের তৈরি সেই সরু রাস্তাগুলো এখন বেশ প্রশস্ত হয়েছে। প্রশস্ত রাস্তার মাঝে আইল্যান্ড জেগে উঠেছে। কালো পিচে সাদা আর হলুদ রঙের রোডমার্ক দেখতে ভালই লাগে। আইল্যান্ডের উপর সারিবাঁধা ঝাউগাছ। মাঝে মাঝে দু’চারটে ফুলগাছও আছে। বিদেশি লতাগুলো আইল্যান্ডের সীমানা বেয়ে প্রায় রাস্তায় নেমে পড়েছে। ভাল করে ল্য করতে দেখলাম গাছগুলোর মাঝে মাঝে কিছু সাইনবোর্ডও রয়েছে। ক্ষাণিক বাদে বুঝলাম সাইনবোর্ড এর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। বিভিন্ন কায়দায় লিখেছে, সোভা বর্ধনে ওমুক নেতা, তমুক নেতার ছোট ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি। জেলা শহরের অভ্যান্তরিন রাস্তায় তেমন যানজট থাকে না। রাস্তার ধারে পুটপাথে তেমন লোকজনও চলাচল করে না। শুধু বিকালে দেখা যায় আমার মতো কিছু লোক এই ফুটপাথ ধরে হাঁটে। আমি দেখেছি অনেকে দল বেঁধে হাঁটে। আমার কিন্তু একা হাঁটতেই বেশি ভাল লাগে। হাসপাতাল মোড়ের সামনে আসতেই একটা জটলা চোখে পড়লো। আমি দেখেছি, বাঙালির জটলা বিষয়ে বিরাট আকর্ষণ আছে। কোথাও পাঁচ সাতজন লোক মিলে একটু জটলা হলেই সঙ্গে সঙ্গে শত শহ¯্র লোক জুটে যায় কী হয়েছে জানবার জন্য। একবার আমাদের এলাকায় তিন-চার জন লোক এসে রাস্তার মধ্যে খোড়া খুড়ি শুরু করল, জিজ্ঞেস করতে বলল, তারা ওয়াটার সাপ্লায়ের লোক। পাইপে জ্যাম, তাই ঠিক করতে এসেছে। বিষয়টি জানা সত্বেও স্বচে দেখবার জন্য মানুষ হুমরি খেয়ে পড়ছে। কী খুড়ছে, কেন খুড়ছে, কতটুকু খুড়েছে ইত্যাদি ইত্যদি। তাদের ভাব দেখে মনে হয় গর্ত খুরলেই বুঝি সোনার কলস বেড়িয়ে পড়বে। তাদের ধারনা কবিগুরু এমনি এমনি তো আর আমার সোনার বাংলা বলেন নি। বাংলাদেশে জটলা একটা বিরাট আকর্ষণিয় ব্যাপার। যাক সে কথা আমিও বাঙালি। রক্তে আমার ঐ একই টান। নিজেকে তাই থামাতে পারলাম না। ভীর ঠেলে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম জটলার প্রায় মধ্যেখানে একটি কুকুর শুয়ে আছে। ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম রক্তে একেবারে মাখামাখি অবস্থা। বুকের মৃদু ওঠানামায় দেহে প্রাণের সামান্য অস্তিত্ব বোঝা যায়। পেছনের পা দুটো একবারে থেঁতলে গেছে। কোনো যানবাহনে পিষ্ট হয়েছে নিশ্চই। নিথর পড়ে থাকা দেখে বোঝা যায় নরাচরা করবার কোন শক্তি তার আর নেই। ণি কন্ঠে শুধু কাতরতার প্রকাশ। উচ্চ স্বরে ডাকবার শক্তি সে ততক্ষণে ফুরিয়েছে। মিহি একটা শব্দে ডাকছে সে। মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কী বলছে সে? সেই ডাকের অর্থ কি মানুষের বোঝা সম্ভব। পশুপাখির স্বরযন্ত্রে যে শব্দ তৈরি হয় তার ঠিক অর্থ আজো মানুষ উদ্ধার করতে পারেনি। আজ এই কুকুরটির স্বরযন্ত্রে কিসের শব্দ। একি সাহায্য প্রার্থনার করুন কন্ঠস্বর। মৃদু গোঙ্গানীর সাথে অপলক চাহুনির মধ্যে মানুষের কাছে এ কিসের আর্তি। একবার মনে হলো অশ্রুসিক্ত চোখে সে যেন আমার দিকেই চেয়ে আছে। ঘন কালো লোমে ঘেরা চোখদুটো বেয়ে নেমে আসা অশ্র“র ধারা কালো দাগ ফেলেছে। সেই কালো রেখায় ফুটে উঠেছে যন্ত্র্রনার প্রতিটি রং। বুকের ভেতরটা আমার হু হু করে উঠলো। কেউ একজন বললো, আহারে! কেডায় এই কুত্তাডার এমন অবস্থা করলো। বুঝতে পারছি কুকুরটার গোঙ্গানী ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। কিছুণের মধ্যেই হয়তো সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করবে। মনের কোথা থেকে যেন বলে উঠল, এতগুলো লোক দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কেউ কিছু করছে না কেন? মনের অন্য কোণ থেকে উত্তর এলো, করবেই বা কী? এতো আর মানুষ না যে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কোথাকার কোন রাস্তার কুকুর পড়ে আছে। মৃদু আর্তনাদ এর সাথে অপলক দুটি চোখ কত কথাই না বলে যাচ্ছে। সে হয়তো ভাবছে, মানুষ এত মর্যাদাবান হলেও তার থেকে নিষ্ঠুর আর কী হতে পারে ! আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা মোচর দিয়ে উঠল। হঠাৎ ভীর ঠেলে একটি লোক এগিয়ে এলো। এক মুহুর্তে অবস্থাটা দেখে নিয়ে কুকুরটাকে কোলে তুলে নিল সে। লোকটির ধবধবে সাদা শাটর্টি এক মুহুর্তেই রক্তে একেবারে মাখামাখি হয়ে গেল। এই রিক্সা, বলে ডাকতেই কণ্ঠটা চেনা ঠেকলো। আরে বাছের ভাই না। বাছের ভাই বলে ডাকতেই তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমাকে দেখে বললেন, তাড়াতাড়ি একটা রিক্সা ডাকেন তো। রিক্সা ডেকে তাকে বললাম, কুকুরটাকে নিয়ে এখন কী করবেন? বাছের ভাই ব্যস্ত ভাবে বললেন, মাহিপুরে একটা পশু হাসপাতাল আছে। ওখানেই নিয়ে যাব। রিক্সাওয়ালা প্যাডেলে ভর দিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে রিক্সা ছেড়ে দিলো। আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের ফেলে যাওয়া পথের দিকে। দৃষ্টি আমার যতদূর যায় আমি তাকিয়ে রইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:২৫