তাহলে শুরুতেই যে বিষয়টি স্পষ্ট থাকা দরকার যে, কোনো আইনগত ত্রুটির জন্য আমার দেশ বন্ধ করা হয় নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা ও মহাজোট সরকারের ‘দুর্নীতি’, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমার দেশ-এর ভূমিকা বিশেষত মাহমুদুর রহমানের লেখালিখির কারণে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল অনেক আগেই। পহেলা জুন তারিখে পত্রিকাটি বন্ধ করা ও মাহমুদুর রহমানকে তাঁর অফিস থেকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী দিয়ে মধ্যরাতে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ ও বাধার মুখে তুলে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিরোধী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেবার রাজনীতি ভিন্ন একটি মাত্রা পেয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার যখন এই ধরনের আচরণ করে তাকে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র থেকে আলাদা করে বোঝাবার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে থাকেন। অর্থাৎ এই দমনপীড়নের পেছনে এক ধরনের উগ্র আবেগ ও প্রতিহিংসাজনিত রাজনৈতিক সমর্থন কাজ করে। একে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের জুলুম থেকে ভিন্ন ভাবে বিচার করাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের রেওয়াজ।
ডিজিটাল মহাজোট সরকার এর আগে ইউটিউব বন্ধ করে দিয়েছিল। সম্প্রতি ফেইসবুক ব্লক করে দিয়েছে। টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছে। এখন এই সরকারের দুর্নীতি ও দমন-পীড়ন নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আমার দেশ বন্ধ করা এবং মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ভাবে আরেক কদম অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে গেলো। এর পরিণতি, বলাবাহুল্য, কোনো ভাবেই ভাল হতে পারে না।
পহেলা জুন বিকেলে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, আমার দেশের প্রকাশক হাসমত আলীকে সকালে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়ে দুটি সাদা কাগজে তার স্বাক্ষর নিয়েছে। তিনি তখনি বলেছিলেন, সরকার আমার দেশ বন্ধের চক্রান্ত করছে।
চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে কোনো নাগরিকের অধিকার। প্রকাশক আলহাজ মোহাম্মদ হাসমত আলীর আবেদনে পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া নাগরিকদের এই সাংবিধানিক অধিকারের দিক থেকে সুস্পষ্ট লংঘন। মঙ্গলবার রাতে আলহাজ মোহাম্মদ হাসমত আলীর দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, তিনি পত্রিকাটির প্রকাশক নন, অবৈধভাবে তার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে পত্রিকার সব শেয়ার মাহমুদুর রহমানের কাছে বিক্রির পরও পত্রিকাটির প্রকাশক হিসেবে তার নাম ছাপা হচ্ছে। এ সময় প্রকাশক হিসেবে তার বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি মামলা হয়েছে। কিন্তু এই অপরাধ তো আমার দেশ বা মাহমুদুর রহমানের নয়, এর জন্য প্রশাসনই সম্পূর্ণ দায়ী। তাঁরা আমার দেশ পত্রিকার পরিচালকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাম বদলের জন্য আবেদন মঞ্জুর করতে দেরি করলেন কেন? এমনকি তদন্তকারী সংস্থার ”অনাপত্তি” সত্ত্বেও? প্রশাসন যদি এখন খারাপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিজেদের খাটায় তার খেসারত কি দিতে হবে না?
মামলায় মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর দায়্দায়িত্ব প্রশাসনের উপরেই পড়বে। কারণ হাসমত আলীর নাম বদলানোর ব্যাপারে আমার দেশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে আগেই। ঢাকার জেলা প্রশাসক মাত্র এক তারিখ রাতে আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করেছেন। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিলের আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজপত্র আমার দেশ পত্রিকাকে দেওয়া হয়নি মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত। যদিও জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ডিক্লারেশন বাতিলের কাগজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এই দিকগুলো স্পষ্ট করা জরুরি। কারণ সরকার দাবি করছে, হাসমত আলীর মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আইন ভঙ্গের জন্য আমার দেশ বন্ধ করা হয়েছে এবং মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই দাবি ভূয়া। ফ্যাসিবাদ আইন মানে না, কিন্তু আইনের যুক্তি দিয়ে নিজের ফ্যাসীবাদী কর্মকাণ্ডের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। খুবই আজব কারবার!
ফ্যসিবাদী শক্তির সমর্থকরা মাহমুদুর রহমানকে ঘৃণা করলেও পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়াতে খুব শরমিন্দা হয়েছে। গুজব রয়েছে ফ্যাসিবাদের সমর্থক কারো হাতে মালিকানা তুলে দেওয়া হবে। দরকার ছিল শুধু মাহমুদুর রহমানকে সরিয়ে দেওয়া। এখন পত্রিকার ডিক্লারেশান বাতিল করে দেওয়াতে বাড়া ভাতে খানিক ছাই পড়ে গেল।
উপ-পুলিশ কমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির গভীর রাতে সমকাল পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন, মাহমুদুর রহমানকে ‘গ্রেফতারের প্রস্তুতি চলছে। গ্রেফতার না করে আমরা ফিরব না।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, জোরজবরদস্তির প্রস্তুতি নিয়েই পুলিশ আমার দেশ পত্রিকাতে গিয়েছিল। অথচ এখন আমার দেশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হয়েছে। আতিশয় ন্যক্কারজনক ঘটনা। মূল কথা হচ্ছে, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের কোনো বৈধ ওয়ারেন্ট পুলিশ দেখাতে পারেনি। আমার দেশ পত্রিকায় পুলিশের প্রবেশ ও হামলাই বরং ছিল সংবিধান ও মানবিক অধিকারের লংঘন।
সকলেই বলছেন ফ্যাসিবাদের এই রূপ আমরা প্রথম দেখছি না। এর আগে বাকশালী আমলেও এটা আমরা দেখেছি। শেখ হাসিনা তাঁর নিজের জন্য এবং দেশের জন্য মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করছেন। যে দিকটা আমাদের সকলকেই বুঝতে হবে যে এই লড়াই নিছক চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, এই সংগ্রাম ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে লড়াই। এর চরিত্র ও অভিমুখ ভিন্ন। আমার দেশ বন্ধ করে দিয়ে শেখ হাসিনা প্রমাণ করলেন তাঁর ও তাঁর পুত্র জয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে এবং পত্রিকাটির সেই অভিযোগ তিনি নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে খণ্ডন না করে আমার দেশ পত্রিকাটি বন্ধ করে দিলেন। নইলে তিনি এত হিংস্র ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কেন? গণ সমর্থনের ওপর যে সরকার দাঁড়িয়ে আছে তাঁর এই আচরণ তাই সন্দেহের। অথচ বিরোধী মত মোকাবিলার জন্য প্রায় সব গণমাধ্যমই ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদের বেগার খাটতে রাজি! কী দুর্দশা এই জাতির। পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে যাবার আগে প্রধানমন্ত্রীর উচিত, অবিলম্বে (১) মাহমুদুর রহমানকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া, (২) আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করা, (৩) প্রশাসন ও আদালতকে নিজ স্বার্থে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা। আমাদের প্রত্যাশা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্যাসীবাদী জুলুম নির্যাতন পরিহার করে গণতান্ত্রিক তরিকার প্রতি সম্মান দেখাবেন।
(সূত্র, বিডিনিউজ, ০৩/০৬/১০)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:২৯