পুরো স্কুল জুড়ে আলোচনার ঝড়। আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই- কে পাচ্ছে এক ভরি সোনা খঁচিত তিন হাজার গ্রামের পিতল পিন্ডটি। প্রধান শিক্ষকের এ ঘোষণায় আলোচনার ঝড় স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আভিভাবকদের মাঝেও বইছে। কেউ বলছে, তাদের সন্তানই পুরো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা জানা, তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শৃঙ্খলা, নৈতিক চরিত্র গঠন প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে থেকে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেউ কেউ বলছে তাদের সন্তান স্বর্ণ খঁচিত পিতল পিন্ডটি পাওয়ার যোগ্য হয়ে তা পেলেও তা তারা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাবে। কারণ এতে তাদের সন্তানের পড়ালেখার বারোটা বাজবে। আবার কেউ কেউ বলছে, কী এমন দরকার বিষয়টির। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত এই ঘোষণায় প্রধান শিক্ষক নিজেও যেন বেশ বিপদে পড়লেন। চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা। এরপর যাকে এই পিন্ডটি দেয়া হবে, পরবর্তীতে যদি দেখা যায় যে নেতৃত্ব দানের জন্য সে অযোগ্য, তাহলেতো আরো বিপদ। চিন্তায় প্রধান শিক্ষক অনেকটা অসহায় হয়ে পড়লেন। কিন্তু যুদ্ধে নেমে ময়দান ছেড়ে আসার মতো শিক্ষক তিনি নন। অবশেষে উপায় একটা তিনি ঠিকই বের করে নিলেন। যোগ্যদের তালিকায় তিনি তিন জনকে তুলে আনলেন। এই খবর জানাজানি হওয়ার পর আলোচনার ঝড় যেন নতুন মাত্রা পেল। এই তিন ভাগ্যবানের মধ্যে কে হবে সবচেয়ে ভাগ্যবান। এমনি করে আলোচনার ঝড়ে বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেল।
হঠাৎ একদিন ক্লাস শেষে প্রধান শিক্ষক পিয়ন দিয়ে আবীরকে ডাকলেন। আবীর প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করল। শিক্ষক তার হাতে বাক্সে ভরা একটি পিন্ড দিয়ে কিছু কথা বললেন। বেরিয়ে আসার সময় আবীর দেখলো বাইরে স্কুলের সকলে তাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য জড়ো হয়ে আছে। আবেগ মাখা হ্রদয়ে আবীর সেই অভিনন্দনের জবাব দিল। বাক্সে ভরা পিন্ডটি উন্মুক্ত করে সবার সামনে দু’হাতে উপরের দিকে তুলে ধরল। এরপর একটু হাসলো সমবেত ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে। সকলের হাততালি পেয়ে যেন জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়াটি পেল আবীর।
দিন চলতে লাগলো। ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আবীরের কাছে নিয়মিত আসছে। আবীর বিষয়গুলোর সমাধানও দিচ্ছে। কিন্তু সমাধানগুলো কতোটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে তা বিবেচনায় না নিয়ে আবীর তার নিজের সিদ্ধান্তটি সবাইকে মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। প্রথম দিকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী মানলেও এখন তারা আবীরের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত মানতে অনীহা প্রকাশ করছে। এইতো মাত্র চারদিন আগেও নবম ও দশম শ্রেণীর দু’টি ফুটবল টিম তৈরী নিয়েও একই অবস্থা হয়েছে। আবেদনকারী খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে দশম শ্রেণীর দু’জন ভালো খেলোয়াড়কে দলে অর্ন্তভূক্ত না করে তার সাথে সখ্যতা রয়েছে এমন দু’জনকে দলে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে ঐ দু’জন বৈঠক করে প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করারও চেষ্টা করেছিল। আবীর বিষয়টা জানতে পেরে তাদেরকে বেশ শাসিয়েছে। ফলে এ নিয়ে তারা আর কোন উচ্চ বাচ্য করেনি। আবীর নিজেও দশম শ্রেণীর ছাত্র। খেলোয়াড় হিসেবে সে-ও ভালো। কিন্তু তার দল গঠন প্রক্রিয়ায় ভুলের কারণে নবম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে তাদেরকে হারতে হয়েছে। এ নিয়ে দশম শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র মিলে প্রধান শিক্ষকের কাছে নালিশও করেছে। দিনে দিনে আবীরের গ্রহণ যোগ্যতা স্কুলের সবার কাছে হ্রাস পেতে লাগলো। একদিন প্রধান শিক্ষক আবীরকে ডেকে পিন্ডটি ফেরত দিয়ে তাকে নেতৃত্ব হস্তান্তর করার কথা বলেন। সে দিনই আবীর তা করতে বাধ্য হয়।
ঠিক সে দিনই প্রধান শিক্ষক নবম শ্রেণীর আরেকজন ছাত্রকে ডেকে পিন্ডটি তার কাছে হস্তান্তর করলেন। ওর নাম রাশেদ। প্রধান শিক্ষকের তৈরী করা তিন জনের তালিকার সেও একজন। রাশেদ প্রধান শিক্ষককে কথা দিয়েছে সে তার শিক্ষকের দেয়া দায়িত্ব পালন করবেই। কয়েক দিন যেতেই আবীর বেশ কিছু ছেলে নিয়ে রাশেদের বিরুদ্ধে একটি গ্র“প তৈরী করে ফেলল। স্কুল কিংবা স্কুলে আসার পথে ওরা রাশেদকে বিভিন্ন বিরক্তিকর কথা বলে। এ গ্র“প কিছু দিনের মধ্যেই রাশেদকে অস্থির করে তুলল।
একদিন ক্লাশের বিরতির এক ফাঁকে রাশেদ প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলো। স্যারকে বিনয়ের সাথে কিছু কথা বলে সোনা খঁচিত পিতল পিন্ডটি ফেরত দিয়ে দিল। স্যার তাকে বুঝালেন। বললেন, ঝড় আসবেই রাশেদ। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আমাদের দেশে যোগ্য নেতৃত্ব দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমি চাইছি তোমরা স্কুল লেভেল থেকেই নেতৃত্ব দেয়া শিখ।
প্রধান শিক্ষকের কথায় কোন কাজ হলো না। কিছুক্ষণ পর রাশেদ বেরিয়ে এলো।
চিন্তায় প্রধান শিক্ষকের এবার গালে হাত পড়লো। কিন্তু নুয়ে পড়ার মতো লোক তিনি নন। তালিকায়তো আরো এক জনের নাম রয়েছে। এখন চিন্তা, সে কি পারবে? রাশেদ একটি ছেলে হয়ে যখন ভেঙ্গে পড়লো, তখন সাবিহা কি সত্যিই পারবে? তিনি পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছেন না। আবার সাবিহার ওপর থেকে আস্থাও হারাতে পারছেন না।
এক দিন, দুই দিন, ...চার দিন। এভাবে সপ্তাহ পেরুলো। এবার প্রধান শিক্ষক সাবিহাকে ডাকলেন তার কক্ষে। সাবিহার বুঝতে বাকি রইলোনা স্যার তাকে কেন ডেকেছেন। সাবিহাকে বসতে বলে প্রধান শিক্ষক বললেন, আচ্ছা সাবিহা বলতে পারো নেতৃত্ব কাকে বলে?
-স্যার, নেতার গুণাবলীকে নেতৃত্ব বলে।
-নেতারা তাদের গুণাবলী নিয়েই কি জন্ম গ্রহণ করেন?
-জ্বী না স্যার। জন্ম নিয়েই অর্জন করেন।
-কি কি গুণাবলী একজন নেতাকে অর্জন করতে হয়?
সাবিহা বেশ কয়েকটি গুণাবলীর কথা বলল। প্রধান শিক্ষক বললেন, আর?
-আরো আছে। এ মুহূর্তে স্মরণ আসছে না স্যার।
-আমি তোমাকে কেন ডেকেছি তুমি বুঝতে পারছো?
-জ্বী স্যার। কিন্তু আমি কখনোই নেতা হতে চাই না।
প্রধান শিক্ষক কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
- কেন যেন আমার ইচ্ছে হয় না।
প্রধান শিক্ষক সাবিহাকে বেশ বুঝালেন। অনেক কথা হলো তাদের মধ্যে। অবশেষে তিনি পিতল পিন্ডটি বুঝিয়ে দিলেন সাবিহাকে।
কয়েক দিন যেতে না যেতেই সাবিহা বুঝতে পারলো কয়েকজন ছাত্র তার পিছে লেগেছে। এরা আবীরের নেতৃত্বাধীন ঐ ছেলেরাই যারা রাশেদেরও পিছু নিয়েছিল। সাবিহা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। সে ঠান্ডা মাথায় তার চলার পথের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছে আর সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়ে ভাবছে।
আবীরের গ্র“পটি কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না। তারা অন্যদের বলছে, আমরা ক্লাশ টেনের ছাত্র। ও হলো নাইনের। তাকে নেতা হিসেবে অন্যরা মেনে নিলেও আমরা তা পারি না। তার ওপর সে একটা মেয়ে। ওর কথা শুনবো আমরা? ও ব্যর্থ হওয়ার আর তেমন একটা সময় বাকি নাই। ও সবাইকে এক করতে পারছে না। এই যে গত সপ্তাহে শেষ হলো দাবা প্রতিযোগিতা। আমরাতো অংশ নেইনি- নিজের গ্র“পের ছেলেদের কাছে কথাগুলো বলছিল আবীর।
আবীর দাবা খেলায় বেশ পাকা। এটা সবার মতো সাবিহাও জানে। খেলায় অংশ নেয়ার জন্য সাবিহা অনুরোধও করেছিল তাকে। আবীর অংশ নেয়নি। কিন্তু সাবিহা এ আয়োজন বেশ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করায় আবীরসহ কয়েকজন বাদে বাকি সবাই তার নেতৃত্বের প্রশংসা করতে লাগলো।
নিজের ওপর আস্থা বেড়ে গেল সাবিহার। পড়াশোনার বিষয়ে অনেকেই তার কাছে সহযোগিতার জন্য আসছে। সে সহযোগিতা করছে তাদেরকে। রাশেদের পুরোপুরি সমর্থন রয়েছে সাবিহার প্রতি। দাবা প্রতিযোগিতার জন্য গঠিত কমিটির আহবায়ক করা হয়েছিল তাকে। সাবিহার ইচ্ছে ছিল আবীরকে আহবায়ক আর রাশেদকে যুগ্ম আহবায়ক করা। কিন্তু আবীরকে না পাওয়ায় এভাবেই গঠিত হয়েছিল কমিটি।
পূর্বে একটি ফুটবল টুর্ণামেন্ট হলেও সাবিহা দায়িত্ব পাওয়ার পর আরেকটি টুর্ণামেন্টের আয়োজন করল। উদ্দেশ্য ছিল অনেকগুলো দল তৈরী করে সকলকে টুর্ণামেন্টে অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া। কিন্তু আবীরসহ কয়েকজন সেই টুর্ণামেন্টে অংশতো নেয়ইনি বরং সাবিহার বিরুদ্ধে নানা কথা বলেছিল- ‘‘এবার তাহলে সে ও কি মাঠে নামবে? ...’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
যে দিন টুর্ণামেন্টের ফাইনাল খেলা, সেদিন স্কুলের মাঠে দর্শক শ্রেণী থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আবীর তার দলের পাঁচ জনসহ মাঠের একপাশে এসে হাজির হয়েছিল। ফাইনালে উঠেছে সপ্তম শ্রেণী এবং নবম শ্রেণী। খেলার এক পর্যায়ে একটি ফাউলকে কেন্দ্র করে মাঠে খেলোয়াড়দের মধ্যে কিছুটা কথা কাটাকাটি হলে সেই সুযোগে আবীর তার দলের অন্যদেরকে নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মাঠে প্রবেশের জন্য উঠে দাঁড়ালে পাশে বসে থাকা বারোজন ছাত্রের একজন দাঁড়িয়ে বলল, রেফারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আপনারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না। সাবিহা এমনটাই ধারণা করেছিল। তাই আমরা আপনাদের কাছেই বসেছি।
আবীর দাঁত কড়মড় করতে করতে বসে পড়ল। বসে পড়ল অন্যরাও। সে মনে মনে বলল, এ তো দেখছি সাংঘাতিক মেয়ে ...।
দিন যায়। সকল বাধা মাড়িয়ে এগিয়ে যায় সাবিহাও। সম্প্রতি সে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য কাগজ বের করার কাজে হাত দিয়েছে। লেখা আসছে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে। সাবিহা নিজে আবীরের কাছে গিয়ে একটি লেখা চাইলো। বলল, আমি চাই আপনি এমন একটি লেখা দিবেন যা সবারই ভালো লাগবে। আপনার কাছে এ আমার বিশেষ অনুরোধ।
সাবিহা এমন করে বলল যে আবীর না করতে পারলোনা। সে বেশ মেধা খাটিয়ে একটি ছড়া লিখলো। ম্যাগাজিন প্রকাশ হওয়ার পর পরবর্তী সংখ্যার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা এই সংখ্যাটির ওপর তাদের মতামত লিখতে শুরু করলো। দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য লেখা আসছে, আসছে প্রথম সংখ্যার ওপর মতামতও।
দিন গড়িয়ে মাস গড়িয়ে প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় সংখ্যাটিও। সাবিহা প্রকাশিত ম্যাগাজিনের কপি নিয়ে প্রথমেই আবীরের কাছে গেল। বলল, আবীর ভাই, আপনার জন্য একটা গ্রেট নিউজ আছে।
আবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি নিউজ শুনি।
-গত সংখ্যাটির ওপর আমরা তেরোটি প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। তার নয়টিই আপনার লেখা নিয়ে। সবাই আপনাকে এ্যাপ্রিশিয়েট করেছে।
আবীর একটু উৎফুল্ল হয়ে বলল, কই দেখি দেখি!
সাবিহা ম্যাগাজিনটি দিয়ে বলল, এই দেখেন।
আবীর মনযোগ দিয়েই দেখছে। তারপর পুরো ম্যাগাজিনটিতে উল্টে-পাল্টে চোখ বুলিয়ে বলল, বেশ হয়েছে তো! আচ্ছা সাবিহা, আমাকে রাখবে এই ম্যাগাজিনের কাজের সাথে?
- আমরাতো আপনাকে সব কাজের সাথেই রাখতে চাইছি। কিন্তু আপনিইতো থাকছেন না।
আবীর উঠে দাঁড়ালো। স্কুল কক্ষের জানালা দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার লেখক হওয়ার বড় শখ। আমি থাকবো সাবিহা। আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।
============= 0 ==============