আজকে একটা জীবনের গল্প বলবো ।
একজন "ডেট এক্সপায়ার্ড" মানুষের গল্প ।
"ডেট এক্সপায়ার্ড" মানে জানেন তো?
মানে হইল "ভাঙ্গা কুলা" । যার কোন মূল্য নাই ।
মেয়াদ শেষ , তো ওষুধের প্রয়োজনও শেষ ।
লোকটাও একসময় এমন পরিস্থিতিতে পরেছিলেন ।
পরেছিলেন বললাম কারন পরিস্থিতি আর তেমন নাই ।
কিছুদিন আগে শহরে যাচ্ছিলাম ।
অটোচালক একটু বৃদ্ধ ।
বয়স ৬৫-৭০ র মধ্যে হতে পারে ।
কিন্তু শরীর এখনও শক্তসমর্থ ।
কথায় কথায় জানতে চাইলাম এখনও কেন অটো চালান?
কিছু বললেন না ।
আমিও আর জোর করলাম না ।
একটু পর গন্তব্যে পৌছালাম ।
দোকানদার (যার দোকানে আড্ডা দেই) কে বললাম চা দিতে ।
সেই অটোওয়ালাও চা নিয়ে এলেন ।
তারপর নিজ থেকেই তার গল্প শুরু করলেন ।
জীবনের গল্প ।
কিছুটা তার মত করেই তুলে ধরছি । অনেকদিন আগের কথা তাই যেটুকু মনে আছে তা ই বলছি_
"আমি একটা দোকান করতাম । তিন ছেলেমেয়ে নিয়া সংসার । দিনকাল ভালোই চলতেছিল ।
বড় ছেলে অহন অটো চালায় । বছর চারেক আগে বিয়া করাইছি ।
বিয়া করনের কয়েক মাস পর থিকাই পোলা বদলে গেল ।
আগের মত আর নাই ।
বউটারে ভাল মনে করছিলাম , কিন্তু বউটা একটা শয়তান ।
আমার ছেলেটারে কি বুঝাইছে ।
একদিন শুনলাম ভিটামাটি সব নিজের নামে কইরা নিছে ।
কি আর করার আছে ।
ওয়ারিশ তো কিছু পাইতই , তাই আর কিছু কই নাই ।
আসলে অহন বুড়া হইছি ত , তাই আর দাম নাই ।
বাকিটা থিকা অন্য ছেলেমেয়ে দুইটারে দিমু ।
আমার নিজের কিছু কিনা জমি ছিল ।
ধার দেনা কইরা সেইখানে কোনরকম কইরা দুইটা ঘর তুললাম ।
ছেলেমেয়ে নিয়া সেইখানে উঠলাম ।
মাইয়াডা টেনে পড়ত , ছেলেডা এইটে ।
চিন্তা করলাম , লেখাপড়া যত করবার চায় করামু ।
এক বছরের মধ্যেই সব ঋণ শোধ করলাম ।
একটা রিক্সা কিনলাম ।
মাইয়াডা মেট্রিকে ভাল করছে ।
ভাল একটা কলেজে ভর্তি করলাম ।
শুক্রবারে ছেলর ইস্কুল বন্ধ থাকলে দোকানে বসে । আমি রিক্সা চালাই ।
আল্লাহর রহমতে আরও তিনটা রিক্সা কিনলাম দুই বছরে ।
ভাড়া দিয়া রাখলাম ।
দোকান বেইচা একটা অটো কিনলাম নিজের জন্য ।
ভালই উপার্জন হয় ।
মাইয়াডা ইন্টারেও ভাল করল ।
ভাল একটা ঘর দেইখা বিয়া দিলাম ।
ছেলে আর্মির চাকরি করে ।
পোলাডাও মেট্রিকে এ প্লাস পাইছে ।
কলেজে ভর্তি হইছে ।
মাস তিনেক আগে সব রিক্সা বেইচা দিছি ।
আরেকটা অটো কিনছি ।
ভাড়া দেওয়া ।
আল্লাহর রহমতে মাসে এখন বিশ-বাইশ হাজার টাকা আয় হয় ।
বাড়িঘর ঠিকঠাক করছি ।
আরেকটা অটো কিনমু সামনের মাসে ।
ভাড়া দিয়া রাখমু ।
আল্লাহ রাখছে ভালই ।
পোলার কাছে আর যাই না ।
মাঝে মাঝে নিয়া যাইতে চায় এখন ।
কেন যামু কুলাঙ্গার ছেলের কাছে?
আল্লাহর কাছেই ভাল আছি ।"
জানতে চাইলাম , "আপনি তাহলে আর অটো চালান কেন?"
বলেছিলেন , "বইসা থাকতে আর ভালো লাগে না তাই চালাই ।"
"মেয়ের শশুরবাড়ি থেকে কিছু বলে না?"
"আল্লাহ ভালোমানুষের ঘরে মেয়েরে পাঠাইছেন । কিছু মনে কইরেন না , একটা কথা বলি । আল্লাহ সবাইরে সবই দিতে পারেন । আপনার ইচ্ছা থাকলেই হয় । আর বিশ্বাস করবেন আমি পারুম । আল্লাহ নিশ্চয়ই দিবেন ।"
লোকটি উঠে পরল । আমি জোর করেও চায়ের দাম দিতে পারলাম না । অবাক হলাম তার আত্নসম্মানবোধ দেখে ।
লোকটা চলে গেল ।
আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি , আকাশছোঁয়া আত্নবিশ্বাস আর আল্লাহর প্রতি অগাধ ভক্তির নমুনা দেখে ।
তার চেয়েও কম বয়সী কত লোক দেখি ভিক্ষা করে । আর এই বয়সে এতবড় ধাক্কাও তার আত্নসম্মানবোধ টলাতে পারেনি ।
আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন , "ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় ।"
অদম্য ইচ্ছাশক্তি বলতে আসলে কি বোঝায় তা এই প্রথম বুঝলাম ।
এই ইচ্ছাশক্তি আজকালকার ছেলেমেয়েদের মাঝে নেই বললেই চলে ।
ইচ্ছাশক্তির মূল হচ্ছে আত্নবিশ্বাস ।
যখন আমি বিশ্বাস করব আমি পারব তখনই আমার ইচ্ছাশক্তি আসবে ।
কিন্তু আমাদের মধ্যে সেই আত্নবিশ্বাসটাই নেই ।
অল্পতেই আমাদের মনে হয় আমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না ।
এই ধারণাটা পরিবর্তন করা দরকার ।
আমাদের সামনে আছে অপার সম্ভাবনা ।
শুধু একটু ইচ্ছাশক্তির , একটু আত্নবিশ্বাস দরকার । আল্লাহ অবশ্যই দিবেন ।
লোকটা "ডেট এক্সপায়ার্ড না ।
ছেলের কাছে হয়তো তখন তার প্রয়োজন ফুরিয়েছিল । তাই তার কাছে আর কোন মূল্য ছিল না ।
কিন্তু মানুষ কখনও "ডেট এক্সপায়ার্ড" হয় না ।
আল্লাহ মানুষকে "ডেট এক্সপায়ার্ড" করেন না ।
এই মানুষটা আমাকে যে শিক্ষাটা দিয়েছিলেন , এত বছর স্কুল কলেজে পড়েও সেই শিক্ষা কখনও পাইনি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৩:১০