প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যা একটা শিশুর বা মানুষের জীবনে জীবনভর প্রভাব ফেলে থাকে তার উপর ভিত্তি করে আমি একটা সিরিজ শুরু করেছিলাম।
এ সিরিজের আগের পর্বগুলি
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
এ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আশা ব্যক্ত করেছিলাম যে আগামী পর্বে কোচিং বানিজ্য নিয়ে কিছু লিখবো। আমার এই পর্বটা কোচিং বানিজ্য কে ঘিরেই।
বাংলাদেশের স্কুল কলেজের শিক্ষা জগতে কোচিং শব্দ টা আজকাল আষ্টেপৃষ্টে জড়িত।
শুধু কোচিং নয়, প্রাইভেট টিউটর, গাইড বই বাংলাদেশের শিক্ষা জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দগুলোর অন্যতম।
ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে এস.এস.সি, এইচ.এস.সি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, এমনকি বিসিএস, ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট থেকে শুরু করে, প্রাইমারী স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পর্যন্ত রয়েছে কোচিং!
আপনার বাচ্চাকে আপনি চান সবার সেরা করে তুলতে। আপনার বাচ্চাকে আপনি চান ক্লাসের প্রথম ছাত্র হিসেবে দেখতে তার বিনিময়ে আপনি রাজী আছেন যেকোন পরিমান অর্থ খরচ করতে। আপনি রাজী আছেন যেকোন কিছু করতে।
কারন সবাই চায় নিজের বাচ্চাকে সেরা আসনে দেখতে। আপনিতো তার ব্যতিক্রম অবশ্যই হতে পারেন না।
আপনি চান ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আপনি চান ভালো একটি বিষয়ে পড়তে, কে না চায়?
আপনি ভালোভাবে পাস করে বের হয়েছেন কিন্তু আপনি আজ বেকার, অথবা প্রাইভেট চাকরির যাঁতাকলে পিষ্ট। আপনি কেনো চাইবেন না বিসিএস ক্যাডার বা ব্যাংকের কর্মকর্তা হতে?
আপনি মানুষ, আপনি চাইলেই নিয়মের বাইরে চলে যেতে পারেন না , কারন জীবন সেভাবে চলে না।
নিয়ম?
জি একটা রুটিন যখন যখন সমাজের ১০ টা মানুষ পালন করে তখন সেটাকে নিয়ম বলেই অভিহিত করা হয়।
আপনার বাচ্চাকে আপনি যখন চান দেশের সেরা ভালো স্কুলগুলোতে ভর্তি করাতে, আপনি দেখেন চারপাশে সব বাচ্চাই করছে ভর্তি কোচিং, নানারকম প্রশ্নপত্র প্রতিদিন তারা সলভ করছে, আপনার বাচ্চা সেইসব বাচ্চার ধারেকাছে দাড়াঁতে পারছেনা, এতগুলো প্রশ্নপত্র সলভ করে বাকি বাচ্চা গুলো হয়ে উঠেছে এক্সপার্ট, তাহলে মানুষ হিসেবে আপনি কোচিং কে যতই অপছন্দ করেন না কেনো আপনি আপনার বাচ্চাকে কোচিং এ দিবেন , কারন তার ভবিষ্যতের বারোটা আপনি বাজাতে পারেন না!
এভাবে দেখা যায় বাংলাদেশের একেকটা বাচ্চা তার স্কুল ভর্তি মিশন শুরু করে কোচিং দিয়ে।
এদেশের ভালো স্কুলের আসন সংখ্যা কম আর বাচ্চা অনেক বেশী। কোমল একটা শিশুমন তার জীবনের প্রথম যুদ্ধ শুরু করে স্কুলের ভর্তি ব্যাপারটি দিয়ে।
এ যুদ্ধ আমি নিজেও করেছি, কিছুই বুঝতাম না তখন, এখন বুঝি, আর মনে পোষন করি একরাশ ঘৃনা!
এ ধরনের যুদ্ধ শুধু ঢাকাতে নয়, দেশের মফস্বল শহর গুলোতে পর্যন্ত কতটা প্রকট তা অভাবনীয়!
কোনরকমে ভর্তিযুদ্ধ শেষ করলেন,কেউ চান্স পেলো কেউ হয়ত পেলো না। কেউ আবার হয়ত ( অবশ্যই!) পরের বছর ভর্তির জন্য চেষ্টা করবে।
ভর্তি নাহলে অন্য কোন স্কুলে চলে যাবে। তবে পিছু ছাড়বে না ভালো রেজাল্টের চিন্তা, প্রথম হওয়া, দ্বিতীয় হওয়া, ৮০% ৯০% ৯৫% নম্বর আপনার চাই ই চাই।
তাই আপনার পাশে রয়েছি ১০০ ভাগ গ্যারান্টি সহ নির্ভরযোগ্য কোচিং। আপনি মাসে ১০০০ থেকে শুরু করে ১০০০০/১৫০০০ টাকা পর্যন্ত কোচিং এ দিয়ে দিচ্ছেন নিজে প্রয়োজনে দুটো না খেয়ে হলেও।
হতে পারে কেউ গনিতে বা ইংরেজীতে বা রসায়নে বেশ দূর্বল, হতে পারে তার ঐ একটি বিষয়ে কারো সাহায্য দরকার।কিন্তু ক্লাসের ১০০ টা ছা্ত্রই সকল বিষয়ে খারাপ এমনটা হতে পারে কি?
দুঃখ টা এখানেই।
কোচিং কেনো শুধু কোচিং নয়, কেনো এটা বানিজ্য আর কতটা ভয়ঙ্কর এর দিকগুলো এবার আসবে সেই বিষয়ে খিব সামান্য কিছু সাধারন কথা।
প্রথমত, কোচিং আজকে বানিজ্য যার অন্যতম প্রমান, একজন ভালো ছাত্রও যখন ঘটা করে প্রতিটা বিষয় আলাদা করে কোচিং করে তখন অবশ্যই সেটা বানিজ্য।
এখন কেউ বলতে পারেন কেউতো আর জোর করে ধরে এদের নিয়ে যায়নি যে বানিজ্য হবে সেটা।
অবশ্যই শারিরীক জোর করে কেউ নিয়ে যায়নি, কিন্তু মানসিক একটা বিশাল জোর সেখানে ছিলো।
আমাদের চোখে আমাদের শিক্ষকরা প্রায়ই আইডল, সেই আইডল যখন ঘটা করে একখানা কোচিং খুলে বসে, স্কুলে, কলেজে, মাঠে ঘাটে লিফলেট বিলায়। আমার অবচেতন মন কি আমাকে বলবে না যে তুই সেখানে যা এবং ঐ বিষয়ে ভালো নম্বর পাওয়ার সেরা চাবিকাঠি নিয়ে আয়?
বাংলা তো আমার প্রানের ভাষা, বাংলা যখন আমি পড়বো,পড়বো আনন্দ নিয়ে এই বিষয়েরও কোচিং করতে হবে?
কোচিং করতে হবে সামাজিক বিজ্ঞান বা ধর্মের?
কোচিং লিফলেটের চটকদার কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা, বিভ্রান্ত হচ্ছেন অভিভাবকরা। প্রতিটি অভিভাবকের চাই গোল্ডেন এ+। বাচ্চা আসলে কতটুকু শিখছে বা জানছে এটা অভিভাবকদের কাছে এখন আর মূখ্য বিষয় নয়। অভিভাবকদের কাছে একটাই বিষয় মূখ্য সেটা হচ্ছে গ্যআরান্টিস হকারে গোল্ডেন এ ++
ছোট্ট একটা বাস্তব ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
আমাদের বাড়ীর পাশে একটা ফাঁকা প্লট রয়েছে, যিনি সম্পর্কে আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন। এবার বাড়ী গিয়ে হঠাৎ আম্মুর কাছে তাঁর খোঁজখবর করতে গিয়ে শুনি তার এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে মেয়েটি যে কিনা আমার ছোট বোনের সাথে এস.এস.সি পাস করেছিল সে আত্মহত্যা করেছে!!
কেনো করলো আত্মহত্যা?
মেয়েটি গোল্ডেন প্লাস পায়নি বলেই ৬ তলা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে!!
আমি শুনে মন্তব্যহীন হয়ে পড়ি।
কা কে দোষ দেবো এ ঘটনার জন্য?
আমি জানিনা, আমি আসলেই জানিনা।
তবে আমি এটুকি জানি যে শিক্ষা জ্ঞাননির্ভর নয়, বরং ফলাফল নির্ভর সে শিক্ষা প্রকৃত অর্থে শিক্ষা নয়।
যে ছাত্র নিজে তার মূল বইয়ের পাতা চিনে না, চিনে শুধু কোচিংয়ের সমাধান করে দেয়া প্রশ্নোত্তর পর্ব, সে ছাত্র গোল্ডেন ++ ধারী হলেও আমার কাছে প্রকৃত অর্থে সে কোন ছাত্র নয়।
মজার বিষয় হচ্ছে যেদিন আমি আমার এ সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব টা ব্লগে প্রকাশ করি, সেদিন রাতেই এক টিভি চ্যানেলে কোচিং নিয়ে একটা প্রোগ্রাম দেখি। যদিও ঐ প্রোগ্রামে যেসব বিষয় দেখায় আমি সেসব অনেক আগেই বিভিন্ন পেপারে পড়েছি।
বাংলা, ইংরেজী, সামাজিক বিজ্ঞান থেকে শুরু করে গনিত বা আরো বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকরা মাসে আয় করেন ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা কেউ কেউ ২০ লাখ পর্যন্ত!
টিভিতে এক স্কুল শিক্ষক কে হাতে নাতে কোচিং এ ধরা হলে উনি বলেন, আমার বেতন ১৯০০০ টাকা। আপনি এই এলাকায় একটা বাসা দেখান যার ভাড়া ২০০০০ এর নিচে? তাহলে আমি কি করবো? আমি কি শিক্ষামন্ত্রীর বাসার সামনে মাছ বেচবো?
আমাকে এই কথা আকর্ষন করে খুব।
কোচিং বানিজ্য কে বন্ধ করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে ব্যক্তি একবার ১২০০০০০/১৫০০০০০ টাকা ইনকাম করে অভ্যস্ত হয়েছেন তিনি কি পারবেন আর ৫০০০০ টাকা দিয়ে মাস চালাতে?
আমার মা জাস্ট ২ দিন আগে আমাকে ফোন করে সিরিয়াসলি গালিগালাজ করেছে এই বলে যে তুই ইংলিশ থেকে পাস করে কি করেছিস?
নওগাঁ র মত মফস্বলে মানুষ ঘরে বসে দেড় দুই লাখ টাকা ইনকাম করছে এর তুই কি ঘোড়ার ডিম করছিস?ব্যংক জব আর কতই বা টাকা দিবে যে এটাই তোর টার্গেট হয়ে গেলো?
আমি আব্বুকে ফোন করে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, আমি চেয়েছি কিছু টাকা ইনকাম করতে চেয়েছি পাশাপাশি সম্মান, কিন্তু আমার পক্ষে ভন্ডামি করে, লোক ঠকিয়ে টাকা ইনকাম করা সম্ভব নয়।
আমার কাছে যেহেতু টাকাটা বেশী গুরুত্বপূর্ন টাকা তাই আমি বেছে নিয়েছি ব্যাংক।
আমি এরকম শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলবো, মানছি আপনাদের বেতন অনেক কম, অবশ্যই আপনাদের বেতন বাড়িয়ে ৫০০০০ এর মত না করা হলে কোনভাবেই সংসার চালানো সম্ভব নয়। কিন্তু জীবনে যদি টাকা, ৪/৫ টা ফ্ল্যাট,১০ টা প্লট এসবই লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে ভন্ডামী না করে ব্যবসা করুন। অন্য কোন কিছু করুন যার মূল লক্ষ্য টাকা। শিক্ষকতা কে টাকা কামানোর হাতিয়ার করবেন না।
এখনকার বাচ্চাদের শুধু স্কুল আর কোচিং এ দুয়ে যেনো জীবন আবদ্ধ।
খেলাধূলা বা স্কুল থেকে ফিরে কোন রিলাক্সের সুযোগ নেই।আর একটা জিনিসই আমার প্রায় প্রায় মনে হয়, আগেকার দিনে যখন কোচিং ছিলোনা, তখন কি কেউ লেখাপড়া করেনি নাকি মানুষ হয়নি?
নাকি এখনকার বাচ্চারাই বেশী ভালো লেখাপড়া শিখছে? কোনটা সঠিক?
যে কোন কোচিং ছাড়াই ভালো রেজাল্ট করছে, প্রতিবছরই কিছু না কিছু অভাবী ছেলেমেয়েকে ভালো ফল করতে দেখি তাহলে কি তারা কিভাবে ভালো করছে?
আসলে ভালো রেজাল্টের জন্য কি দরকার?
নিজের একান্ত ইচ্ছা?
নিয়মতাণ্ত্রিক পড়াশোনা?
নাকি ভালো স্কুলিং সিস্টেম?
নাকি কোচিং?
অভিভাবকরা এবং ছাত্ররা মতামত রাখবেন এ ব্যাপারে আশা করি।
পেপারে বিভিন্নসময় পড়েছি, সরকারী কর্মকর্তারা কিভাবে কোচিং ব্যবসার নেপথ্যে জড়িত, বিভিন্ন বিসিএস কোচিং বা ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্টের কোচিং এ জড়িত প্রশাসন বা পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা বা ব্যাংকাররা। বাগিয়ে নি্যেছেন গাড়ী, বাগিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
আপনাদের বলি, আপনারা তো সর্বোচ্চ সম্মানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এ পেশা, তাহলে আপানরা কেনো জড়িয়ে পড়লেন কোচিং ব্যবসার সাথে?
আপনারা কি এত বড় পদের সরকারী কর্মকর্তা হবার পরেও এটা জানেন না যে সরকারী কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন না এ ধরনের কোন ব্যবসায়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বিষয় আলোচনায় এনে পোস্টের পরিসমাপ্তি টানবো।
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজকাল নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশী পছন্দ করেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে।
কে না জানে এ বিষয়টা!
স্যার আমরা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা আপনাদের অপেক্ষায় ক্লাসে বসে থাকি আপনাদের পাইনা স্যার।
স্যার, আমরা বইমেলায় গেলে আগে আপনাদের লেখা বই খুঁজতাম, কারন আগে আপনারা অবসরে লিখতেন চমৎকার কিছু বই!
স্যার আপনারাও শেষপর্যন্ত বইমেলা ছেড়ে প্লট, আর ফ্ল্যাটের মেলায় অবস্হান নিয়ে নিলেন?
চলবে....