শূন্যের রয়েছে ইতিহাস। অনেকের কাছে শূন্যের তো বিন্দুমাত্রই মূল্য নেই। তারা বলে শূন্যের আবার ইতিহাস হয় নাকি? তারা শূন্যের মানে বোঝে পরীক্ষার খাতায় শূন্য পাওয়া। শূন্য তো শূন্যই, শূন্য কি ছোট বড় হয় নাকি? এরা তো শূন্য মানে পরীক্ষার খাতার শূন্য বোঝে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা মহাশূন্যের কথাও জানে। তারপরও তারা মনে করে মহাশূন্য নিয়ে গবেষণা করে এত অর্থ ব্যয় করা অর্থহীন। আসলে কি তাই?
শূন্যের মর্ম গণিতবিদেরা বোঝেন। আবার পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে শূন্যের মর্মতো হীরার থেকেও দামি। যারা মহাশূন্য মর্ম কি তা বোঝেন না কিংবা স্বীকার করতে চান না, তাদের জন্য বলছি, গোটা মহাবিশ^ই জড়িয়ে আছে শূন্যের চাদরে। তারা হেলাফেলা করতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানী ও গনিববিদদের কাছে এ এক মহিমান্বিত সংখ্যা।
সেদিন ফেসবুকে এক ইউজার লিখেছেন, “এই যে আমরা চাঁদে গেছি, মঙ্গলে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এর জন্য যে অঢেল অর্থ ও সময় ব্যয় করছি- এসবের দরকার কী? এই অর্থ আর সময় মহাশূন্যে না ঢেলে পৃথিবীতে ঢাললে তো আমরা পৃথিবীকে এতো দিনে স্বর্গ বানিয়ে ফেলতে পারতাম। পৃথিবীরই যেখানে অনেক কিছু উদঘাটন করা বাকী, সেখানে শত শত আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে আমরা কেন এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি?”
তার কাছে মঙ্গলগ্রহে পানি পাওয়ার ঘটনা নিতান্তই তুচ্ছ। এতো দূরের বসবাস অযোগ্য গ্রহে পানি থাকলেই কী আর না থাকলেই বা কী! হয়তো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মেশিনে চতুর্থ বারের মতো ধরতে পারার ঘটনাও তার কাছে অর্থহীন।
আমার মনে হয় মহাশূন্য গবেষণার দর্শন এবং মহাকাশ গবেষণায় মানবজাতির অর্জন নিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে কিছু সত্য তুলে ধরার এখনই সময়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেখানে প্রতিনিয়ত দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নিশ্চিতভাবেই মহাশূন্যে আমাদের বিভিন্ন অভিযান আমাদের কৌতূহল ও রোমাঞ্চপ্রিয়তার বহিঃপ্রকাশ। আর এর অন্যতম প্রয়োজনীয়তা হলো আমাদের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখা। যেকোনো সময় কোনো বড় গ্রহাণু পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে, কিংবা বড় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাতে আমাদের মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মোটেই অবাক ব্যাপার না। আপনি যে পৃথিবীর কথা ভাবছেন কেউ হয়তো আমাদের জন্য নিখুঁতভাবে গড়ে দিয়েছে, সেই পৃথিবীতে এই পর্যন্ত পাঁচটি গণ-বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯৯% প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। তার মধ্যে অনেক মানব প্রজাতিও আছে।
মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে নাসা(NASA) খুবই সুপরিচিত একটি সংস্থা। এটি যেখানে আমেরিকার গর্ব, সেই খোদ আমেরিকারই বহু লোক মনে করে নাসার ফান্ডিং বন্ধ হওয়া উচিৎ। কিন্তু নাসার অনেক কর্মকান্ডই কিন্তু মনুষ্যত্বের পক্ষে।
নাসার প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট পৃথিবীকে সর্বক্ষণ প্রদক্ষিণ করছে। নাসার গবেষকরা সেসব স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্য থেকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। সে সব তথ্য ব্যবহার করে জলবায়ু, আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে আরও ভাল ভবিষ্যতবাণী করার উপায় বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। নাসার পৃথিবী সংক্রান্ত গবেষণার একটি অংশ হল জলবায়ু পরিবর্তনের উপর নজর রাখা এবং আমাদের সতর্ক করে দেওয়া। অথচ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে যেসব কথা শোনা যায় তার জন্য কিন্তু নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব দাবী করা মানুষেরাই অনেকাংশে দায়ী।
এছাড়া বর্তমানে যোগাযোগ প্রযুক্তির যে অভাবনীয় উন্নতি তা অনেকটা সম্ভব হয়েছে মহাকাশ গবেষণার পথ ধরেই। বিমান উড়ার সময়ে নিখুঁতভাবে দিক নির্ণয় এবং সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর উপর অনেকখানি নির্ভর করে। মহাকাশ গবেষণা না থাকলে হয়তো আমরা এতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পেতাম না। ইন্টারনেট সুবিধার কথা না হয় বাদই দিলাম।
সেই সাথে পৃথিবীর কক্ষপথে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে থাকা গবেষকদের শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন, জিরো গ্রাভিটিতে শরীরের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি থেকে মানব দেহের জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে এবং তা চিকিৎসাবিজ্ঞানকেও অগ্রসর করছে। এছাড়া LED, Infrared Ear Thermometer, কৃত্রিম অঙ্গ, উন্নত সিমুলেশন, উন্নত খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রভৃতি এসেছে মহাকাশ গবেষণার পথ ধরে।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে আমাদের মহাশূন্যের দিকে যাত্রার শুভ সূচনা। তখন থেকে এ পর্যন্ত আমাদের প্রযুক্তি ব্যাপক উন্নত হয়েছে। আমাদের জ্ঞানের পরিসীমা আরও বৃস্তিত হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখছি কোনো এক সময়ে আমরা হয়তো আন্তঃনক্ষত্রিক ভ্রমণে বের হবো। আর এই যাত্রায় আমাদের পরবর্তী বড় পদক্ষেপ হলো মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পা রাখা। তাই বলা যায় মহাশূন্য ও মহাকাশ নিয়ে গবেষণা নিতান্তই অর্থহীন নয়।
তথ্যসূত্র:
1) Click This Link
2) Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:২৫