somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোয়ান্টাম কালচার এবং বিজ্ঞান ও ইসলাম ‌॥ পর্ব ৪

০৪ ঠা জুন, ২০১৩ সকাল ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোয়ান্টাম কালচার এবং বিজ্ঞান ও ইসলাম ‌॥ পর্ব ১
কোয়ান্টাম কালচার এবং বিজ্ঞান ও ইসলাম ‌॥ পর্ব ২
কোয়ান্টাম কালচার এবং বিজ্ঞান ও ইসলাম ‌॥ পর্ব ৩



ইসলাম ধর্ম

শুরুতেই বলে নেই, যারা মনে করেন যে বিজ্ঞান মানেই নাস্তিকতা, আমি তাদের দলে নই। আমি বিশ্বাস করি আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বে যা যা ঘটছে বিজ্ঞান সেসবের নিয়মগুলো বের করে চলেছে। ঘটনাগুলো বিজ্ঞান ঘটাচ্ছেনা, নেপথ্যে অন্য কেউ রয়েছে। বিজ্ঞানী নিউটন বলের তিনটি সূত্র বের করে অমর হয়ে আছেন, কিন্তু সেই সূত্রগুলো কে তৈরি করেছে? বিজ্ঞানী ওহম একটা ইলেক্ট্রিক সার্কিটের মধ্যে কারেন্ট ও ভোল্টেজের মধ্যকার সম্পর্কটি বের করেছিলেন, কিন্তু সেই সম্পর্কটি তৈরি করেছিলই বা কে? এই মহাবিশ্বের সবকিছু যে নিয়ম মেনে ঠিকঠাকমত চলছে সেই নিয়মকানুনগুলো কে তৈরি করেছে? এভাবে চিন্তা করলে সবকিছু একজন সৃষ্টিকর্তাকেই স্মরণ করিয়ে। যে কারণে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন -

"আমি নাস্তিক নই এবং আমি নিজেকে সর্বেশ্বরবাদেবিশ্বাসীও বলি না। আমরা আসলে ছোট্ট একটা শিশুর জায়গায় আছি যাকে বিশাল একটা লাইব্রেরিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ভাষায় রচিত বহু বই সাজিয়ে রাখা আছে। শিশুটি জানে যে এই বইগুলো অবশ্যই কেউ একজন লিখেছে। সে জানেনা যে কিভাবে লেখা হয়েছে। সে বইগুলোতে ব্যবহৃত ভাষাগুলোও জানেনা। শিশুটি অনুমান করছে যে বইগুলোকে সাজিয়ে রাখার ব্যপারে একটা রহস্যময় ব্যাপার আছে কিন্তু জানেনা যে সেটা কি। এটাই হচ্ছে আমার মতে স্রষ্টার প্রতি সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটির আচরণ। আমরা একটা অসাধারণভাবে সাজানো গুছানো মহাবিশ্ব দেখি যা বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলে, কিন্তু সেসব নিয়মকানুনের খুব নগন্য অংশই আমাদের বোধগম্য। আমাদের সীমিত জ্ঞান এই মহাবিশ্বের পেছনের চালিকাশক্তিকে পুরোপুরি বুঝতে পারেনা।"

সেজন্য আমি নিজেকে আস্তিক বলেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ধর্মবিশ্বাসে আমি একজন মুসলিম। আমি বিশ্বাস করি আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতা'লা। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স) তাঁর প্রেরিত প্রতিনিধি। বিশ্বের সিংহভাগ মুসলিমের মত আমিও একজন সুন্নি[৩৫]। সুন্নিদের মূল বৈশিষ্ট্য হল তারা জীবনের সবক্ষেত্রে রাসুল (স) এর জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করেন। সকল সুন্নিদের মত তাই আমিও বিশ্বাস করি আমাদেরকে কিভাবে চলতে হবে বা জীবন যাপন করতে হবে তার সবকিছুই কুরআন ও হাদীসে বলে দেয়া আছে।

এইবার নিশ্চয়ই ভাবছেন যে এত কিছু থাকতে কোয়ান্টাম মেথডের ভেতর ইসলাম ধর্ম কেন টেনে আনলাম? আসলে আমি টেনে আনিনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নিজেরাই কোয়ান্টাম মেথডের মাঝে ইসলামকে টেনে এনেছেন[৩৬]। কারণ “বৈজ্ঞানিক” শব্দটির মতই আমাদের দেশের আরেকটি জনপ্রিয় শব্দ হল “ইসলাম”। মুসলিম ধর্মালম্বীর সংখ্যাগরিষ্ঠতার এ দেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই ধর্মভীরু। এই ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই যেকোন কিছুর গায়ে “ইসলামিক” বা “হালাল” - এইসব শব্দ চাপিয়ে দিয়ে নিজের কাজ সেরে নিচ্ছে। এজন্য বাজারে “হালাল সাবান” কিংবা “ইসলামিক ফোন” দেখা যায়। মুদরাবার সব নিয়ম না মেনে চলা “ইসলামিক ব্যাংকিং” দেখা যায়। এসবের পাশাপাশি দেখা যায় “ইসলাম” লেবেল চাপানো বিভিন্ন পীরদের অবাধ ব্যবসার দৌরত্ম্য। নিজে জেনে-বুঝে ইসলাম পালন করার চেষ্টা এখন নিতান্তই ক্ষুদ্র ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাঝে সীমাবদ্ধ। তাই যেকোন মতবাদ, তা ইসলামের সাথে যতই সাংঘর্ষিকই হোক না কেন “ইসলামিকভাবে” প্যাকেট করে ধর্মভীরুদের সামনে তুলে ধরা হলে তা কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহনযোগ্য হয়ে পড়ে। এভাবে ধর্মভীরু মানুষদের ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে বিভ্রান্ত করার কৌশল অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।

আগেই বলেছি আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। আমার এই সীমিত জ্ঞানে বিদা'ত, কুফর ও শিরক নিয়ে যা বুঝি তাতে ইসলামের মূলনীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এমন অনেক কিছুই কোয়ান্টাম মেথডে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। তবে তার আগে আমরা ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ের পর্যালোচনা করি। বিষয়গুলো পরিস্কার না হলে বক্তব্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়বে।

ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়

বিদআত

বিদআত প্রসঙ্গে আল্লামা ইব্রাহীম ইবন মুসা আল-শাতিবী বলেন:
"বিদআত বলতে বুঝায় দ্বীনের মধ্যে শরীয়াতের পদ্ধতির তূল্য কোন নব-আবিষ্কৃত উদ্ভাবিত তরীকা বা পদ্ধতি, মহান আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদাতের আশায় যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়।" [৩৭]
অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা অনুমোদন দিয়েছেন তা ব্যতীত নতুন কোন কিছু যোগ করাটাই হচ্ছে বিদআত। তারমানে এমন কোন ইবাদত না করা যা আল্লাহতা'লার রাসুল নিজেও করেননি এবং আমাদের করতে বলেননি। বিদআত অবশ্যই বর্জনীয়। বিদ’আত মূলত বর্জনের সুন্নাতের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইবাদতের উদ্দীপনাতেই এর সৃষ্টি।

অনেকেই এক্ষেত্রে প্রশ্ন করে থাকেন যে আল্লাহর রাসূল এরোপ্লেনে চড়েননি, তাহলে কি প্লেনে চড়া বিদআত? আমাদের দেখতে হবে আল্লাহর রাসূলের এই বর্জন কি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত? এবং এটি ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট কীনা? বিদ’আত সবসময় ইচ্ছাকৃত বর্জন এবং অবশ্যই ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। রাসুল (স) এর সময় এরোপ্লেন ছিলনা - তাই এটা অনিচ্ছাকৃত বর্জন এবং এরোপ্লেনে চড়া ইবাদত নয়। তাই এটা বিদআত নয়।

তাই কোন কিছু বিদআত নাকি বিদআত নয় তা জানতে হলে আমাদের অবশ্যই নিচের কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে -

১। প্রথমেই দেখতে হবে তা ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা। হতে পারে তা কোন কথা, কাজ বা বিশ্বাস।
২। ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে দেখতে হবে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা এই পদ্ধতিটি সম্পর্কে জানতেন কিনা।
৩। যদি না জেনে থাকেন, তবে তাঁর উৎস ওহী নয়। আর ইসলামে সকল ইবাদতের উৎস একমাত্র ওহী।
৪। যদি জেনে থাকেন, তবে তাঁরা তার উপর আমল করেছিলেন কিনা।

আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা যদি এমন কিছুর আমল না করে থাকেন, তবে আমাদেরও উচিত তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করে এমন কিছুর উপর আমল না করা, কারণ তাঁরাই ইসলামের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম এবং আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ।

ইসলাম একটি পূর্ণাংগ এবং ত্রুটিমুক্ত জীবনব্যবস্থা, এতে নতুন কিছু সংযোজন বা পুরনো কিছু বিয়োজনের কোন অবকাশ নেই। রাসূল (সা) বলেন -

"সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল নতুন উদ্ভাবিত বিষয় (বিদআত) আর প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।"[৩৮]

তাই কেউ যদি দাবি করেন যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এমন কোন কাজ বা পন্থা বা ইবাদত রয়েছে যা ইসলামে উল্লেখ করা নেই, তবে তিনি প্রকারান্তরে দাবী করছেন যে -

আল্লাহর ওহী অসম্পূর্ণ, রাসূল (সা) আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, তার চেয়ে উত্তম কিছু তিনি আবিষ্কার করেছেন।
রাসূল (সা) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেননি, ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আরো উত্তম পন্থা তিনি আমাদের দিয়ে যাননি।

একজন মুসলিম হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে, উপরোক্ত দুটি চিন্তার উভয়টি বা যে কোন একটি আমাদেরকে ইসলামের বাইরে নিয়ে যায়। কারণ কুরআন ও হাদীস দিয়ে আমাদের স্পষ্টভাবে কি করতে হবে বা না করতে হবে তা বলে দেয়া আছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স) বলেন-

"যা কিছু কাউকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে অথবা আগুন থেকে দূরবর্তী করে তার এমন কিছুই নেই যা কিনা তোমাদের জন্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি।" [৩৯]

কুফর

কুফরীর আভিধানিক অর্থ আবৃত করা ও গোপন করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় ঈমানের বিপরীত অবস্থানকে কুফরী বলা হয়। কেননা কুফরী হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান না রাখা, চাই তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক কিংবা না হোক। কুফর সম্পর্কে আল্লাহতা'লা বলেন-

"নিশ্চয় যারা কুফরী করে, তাদের না ধন-সম্পদ এবং না তাদের সন্তানাদি আল্লাহর বিপক্ষে কোন কাজে আসবে। আর তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।"[৪০]

ইসলামই যে একমাত্র জীবনব্যবস্থা তা জানাবার জন্য আল্লাহতা'লা বিদায় হজ্জ্বের মাঠে নিচের দুটি আয়াত নাযিল করেন-

"আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।" [৪১]
"আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।" [৪২]

আয়াত দুটি নাযিল হবার পর পৃথিবীতে কেবল দু'টি দ্বীন রয়েছে, “দ্বীন আল-ইসলাম” আর “দ্বীন আল-কুফর” – সুতরাং একজন মানুষ হয় “মুসলিম” নয় “কাফির”! ইসলাম ছাড়া আর সকল দ্বীন এবং সেগুলোর ধর্মগ্রন্থ ও নিয়মকানুন – সব বাতিল হয়ে গেছে। এই কথারই প্রতিফলন নীচের কথাগুলোতে -

"It is the final religion which abrogates all religions and laws that came before it There is no religion on earth according to which Allaah is to be worshipped apart from Islam." [৪৩]

মুসলমান ও কাফিরদের মাঝে পার্থক্যের রেখা হচ্ছে ঈমান। কেউ যদি ঈমান হারায় তবে সে সব কিছুই হারালো। আল্লাহতা'লার উপর ঈমান আনা মানে হচ্ছে তাঁর আদেশ নিষেধ সবকিছু মেনে চলা। তাঁর কথা অমান্য করার অর্থই হল মুসলিমদের কাতার থেকে নাম মুছে কাফিরদের কাতারে নাম লেখানো।

শিরক

শিরক শব্দের আভিধানিক অর্থ- অংশীদারিত্ব, অংশীবাদ, মিলানো, সমকক্ষ করা, অংশীস্থির করা, সমান করা, ভাগাভাগি, সম্পৃক্ত করা। ইংরেজীতে Polytheism (একাধিক উপাস্যে বিশ্বাস), Sharer, Partner, Associate। শরীয়তের পরিভাষায়, যেসব গুনাবলী কেবল আল্লাহর জন্য নির্ধারিত সেসব গুনে অন্য কাউকে গুনান্বিত ভাবা বা এতে অন্য কারো অংশ আছে বলে মনে করাই শিরক।

"শিরক হচ্ছে বান্দা আল্লাহর সাথে তাঁর রুবুবিয়্যাত সংক্রান্ত কর্ম কিংবা তাঁর জাত ও আসমা ওয়াস সিফাতে তথা নাম ও গুনাবলী অথবা উলুহিয়্যাতে (ইবাদতে) কাউকে শরীক করা।" [৪৪]

অর্থাৎ আল্লাহর সাথে এমন বিষয়ে সমকক্ষ স্থির করা যেটা আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যেমন- আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো নিকট আশা করা, আল্লাহর চাইতে অন্য কাউকে বেশী ভালবাসা, অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতের কোন একটি অন্যের জন্য করাকে শিরক বলে। শিরকের ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, এতে দু‘শরীকের অংশ সমান হওয়া আবশ্যক নয়। বরং সহস্রভাগের একভাগের অংশীদার হলেও তাকে অংশীদার বলা হয়। তাই আল্লাহতা‘লার হকের সামান্যতম অংশ অন্যকে দিলেই তা শিরকে পরিণত হবে, এতে আল্লাহর অংশটা যতই বড় রাখা হোক না কেন।

শিরক অবশ্যই পরিত্যাজ্য। এ ব্যপারে আল্লাহতা'লা বলেন -

"তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না।"[৪৫]
"হে বনী ইসরাইল! তোমরা আমার রব এবং তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর। কেউ আল্লাহর শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম।" [৪৬]
"আহলে কিতাব ও মুশরিক কাফেররা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম।" [৪৭]
"যদি তোমরা তাদের (মুশরিকদের) কথামত চল তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হবে।" [৪৮]

উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহতা'লা মুসলিমদেরকে শিরক থেকে সাবধান করে দিয়েছেন যে, যদি তারা মুশরিকদের আক্বীদা-বিশ্বাস, কাজ-কর্মে আনুগত্য করে তাহলে তারা মুশরিক হয়ে যাবে। শিরক মূলত এ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকেই অস্বীকার করে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য, এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন -

"আমি মানব এবং জ্বিন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।"[৪৯]

শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর মর্যাদা এবং নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করা হয়। আল্লাহ হচ্ছেন আমাদের রব এবং ইলাহ, আর আমরা হচ্ছি তার বান্দা বা দাস। যা কিছু আছে সবই আল্লাহর সৃষ্টি। প্রধান কয়েক ধরণের শিরকগুলো একটু আমরা দেখে নেই[৫০] -

রবুবিয়াতের ক্ষেত্রে শিরক - এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ'র পাশাপাশি অন্য রব বা সৃষ্টিকর্তা আছে।
ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক - এটা হল আল্লাহ্’র সাথে অন্যের ইবাদত করা, যেমন নবীদের এবং নেককার বান্দাদের। যেমন অনেকেই বিপদে পড়ে নেককার বান্দাদের কাছে সাহায্য চায়, বেশিরভাগ সময়ই লোকজন মাজারে গিয়ে মৃত পীর-আউলিয়াদের কাছে সাহায্য চায়। এ জাতীয় কাজ শিরক।
আল্লাহতা'লার গুণের মধ্যে শিরক - আল্লাহর কোন সৃষ্টিকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট গুণে ভূষিত করা হলেও শিরক হবে। যেমন গায়েব (ভবিষ্যৎ) এর ইলম জানা। অর্থাৎ কেউ যদি দাবী করেন যে সে ভবিষ্যৎ জানে বা ভবিষ্যতে কি হবে তা দেখতে পায় তবে তা শিরকের পর্যায়ে পড়বে।

বিদাত ও কুফর


আমরা আগেই দেখেছি যে, বিদআত আমাদের ভাবতে শেখায়-

১। আল্লাহর ওহী অসম্পূর্ণ, রাসূল (সা) আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, তার চেয়ে উত্তম কিছু তিনি আবিষ্কার করেছেন।
২। রাসূল (সা) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেননি, ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আরো পন্থা তিনি আমাদের দিয়ে যাননি।

অন্যকথায় আমরা আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বাণী ও কাজে সন্দেহ প্রকাশ করছি যে তাঁরা যা বলেছেন তার চেয়েও উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে। এই ভাবনাটা কিন্তু আমাদের ঈমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মত একটা পদক্ষেপ। চিন্তা করুন – আপনার প্রতিপালক তাঁর রাসুলের মাধ্যমে আপনাকে ইবাদতের ব্যপারে যা শিখিয়েছেন, আপনি বিশ্বাস করছেন যে তার চেয়েও ভাল কোন নিয়ম আপনার কাছে রয়েছে। অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসুল (স) এর শেখানো পদ্ধতি আপনার কাছে অপ্রতুল মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ মানব রাসুল (স) নিজে যেভাবে ইবাদত করেছেন সেটা আপনার কাছে পর্যাপ্ত মনে হচ্ছেনা - কী ভয়ানক কথা! আর এই বিশ্বাসই আপানকে কুফরে নিমজ্জিত করে ফেলবে।

বিদাত ও শিরক

মূর্তিপূজা যে শিরকের সবচেয়ে প্রকাশ্য এবং জঘন্য রূপ এ ব্যাপারটি সর্বজনস্বীকৃত। আল্লাহ পাক আল কুর’আনে হয়রত নূহ (আ) এর জাতির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন-

"এবং বলেছিল, 'তোমরা কখনও পরিত্যাগ করো না তোমাদের দেব-দেবীকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুওয়া'আ, ইয়াগূস, ইয়া'ঊক ও নাসর-কে'।" [৫১]

এতে হয়রত নূহ (আ) এর জাতির যে উপাস্যগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তা ছিল তাদের পূর্ববর্তী যুগের সৎকর্মশীলদের নাম। কিন্তু তাদের পূজা কিভাবে শুরু হল সেটা আমরা জানতে পারি নিচের হাদীস থেকে -

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস (রহ.) বলেন যে, ঐ লোকগুলো ছিলেন আল্লাহর ইবাদাতকারী, দ্বীনদার,আল্লাহ ওয়ালা ও সৎ। তাঁরা হযরত আদম (আঃ) ও নূহ (আ) এর ছিলেন সত্য অনুসারী,যাদের অনুসরণ অন্য লোকেরাও করতো। যখন তারা মারা গেলেন। তখন তাদের অনুসারীরা পরস্পর বলাবলি করলোঃ ‘যদি আমরা এদের প্রতিমূর্তি তৈরী করে নেই, তবে ইবাদাতে আমাদের ভালভাবে মন বসবে এবং এদের প্রতিমূর্তি দেখে আমাদের ইবাদাতে আগ্রহ বাড়বে।’ সুতরাং তারা তাই করল। অতঃপর যখন এই লোকগুলোও মারা গেল এবং তাদের বংশধরদের আগমণ ঘটল, তখন শয়তান তাদের কাছে এসে বললোঃ ’তোমাদের পূর্বপুরুষরাতো ঐ বুযুর্গ ব্যক্তিদের পূজা করত এবং তাদের কাছে বৃষ্টি ইত্যাদির জন্য প্রার্থনা করত। সুতরাং তোমরাও তাই করো।’ তারা তখন নিয়মিতভাবে ঐ মহান ব্যক্তিদের পূজা শুরু করে দিল।[৫২]
উপরের কথাগুলো থেকে কয়েকটি বিষয় একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে-

- প্রথমে নূহের জাতির জন্য স্মারক বানানোর পুরো ব্যাপারটির উদ্দেশ্যই ছিল সৎ-আল্লাহর ইবাদাতে মনোযোগ বৃদ্ধি। কিন্তু এই পদ্ধতিটি ঐশী বাণী দ্বারা সমর্থিত ছিলনা। ইসলামী পরিভাষায় একে আমরা স্বচ্ছন্দে বিদ’আত হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
- বিদআত রাতারাতি শিরকে পরিণত হয়না (সাধারণত), কয়েক প্রজন্ম সময় লাগে।
- শয়তান আপাতদৃষ্টিতে ভাল পরামর্শই দিয়ে থাকে। ঐশী জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া তার কুটকৌশল বোঝা কঠিন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বিদআত আসলে কুফর ও শিরকের পথে আমাদের চালিত করে। যার ফলে বিদআত সম্পর্কে আমাদের শুরু থেকেই সতর্ক হতে হবে - না হলে এই বিদআতই আমাদেরকে কুফর ও শিরকের মাঝে নিয়ে ফেলে দিবে।

চলবে...

রেফারেন্সসমূহঃ
৩৫। Click This Link
৩৬। কোয়ান্টাম হাজারো প্রশ্নের জবাব - পর্ব ১ ।। মেডিটেশন - মহাজাতক; প্রথম প্রকাশ - ১৫ জুন, ২০১২। পৃষ্ঠা - ৪৮।
৩৭। শাতিবী, আল-ই’তিসাম ১/৫০
৩৮। সহিহ মুসলিম - ৮৬৭
৩৯। তাবারানীর আল মুজাম আল কাবীর। আলবানীর (র) এর মতে সহীহ।
৪০। সূরা আল ইমরান, আয়াত ১১৬
৪১। সূরা আল ইমরান, আয়াত ৮৫
৪২। সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৩
৪৩। Islam: Questions And Answers: Alliance And Amity, Disavowal And Enmity - Muhammad Abdul Rahman. Page-109.
৪৪। মিরাসিল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা- ৮
৪৫। সূরা নিসা, আয়াত ৩৬
৪৬। সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৭২
৪৭। সূরা আল বায়্যিনাহ, আয়াত ৬
৪৮। সূরা আল আনআম, আয়াত ১২১
৪৯। সূরা যারিয়াত, আয়াত ৫৬
৫০। Ash-Shirk, Al-Kufr, An-Nifaq by Dr. M. Taqi-ud-Din al-Hilali, Ph.D.Dr. Muhammad Muhsin Khan, Islamic University, Al-Madinah Al-Munawwara.
৫১। সূরা নূহ, আয়াত ২৩
৫২। বুখারী (৪৯২০) তাফসীর ইবনে কাসীর (১৮/১৪২-১৪৪)
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×