জিনগুলোতে আমাদের শরীরের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় সুত্র আছে, সমস্যা হচ্ছে মিউটেশনের কারনে এসব সুত্র অদল বদল হয়ে নানা রকম সমস্যা তেরী হয় (ক্যান্সার থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস ইত্যাদি)। কিন্তু মিউটেশনের সবটাই খারাপ নয়। এটা বোঝার জন্য AIDS resistant কিছু ভাগ্যবানের আলোচনায় আসা যাক। AIDS রোগ বা HIV ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনও কোন সার্বজনীন ঔষধ আবিষ্কার না হলেও কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস কোন ভাবেই রোগ তৈরী করতে পারে না। ইউরোপিয়ানদের মোটামুটি 1% HIV resistant। কিন্তু তারা এই গুন পেলো কোথা থেকে? উত্তরের জন্য দেখা যাক HIV আমাদেরকে কিভাবে আক্রমন করে। আর দশটা ভাইরাসের মতো HIVও সংখ্যা বাড়াবো জন্য আমাদের কোষের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, কিন্তু চাইলেই তো আর কোষের ভেতরে ঢোকা যায় না, কোষপ্রাচীরের কিছু রাসায়নিক পদার্থ (এক্ষে ত্রে protein) প্রহরী বা তালা হিসেবে কাজ করে। অন্য যে সব রাসায়নিক পদার্থ এই তালার সাথে সঠিক ভাবে বিক্রিয়া করতে পারে (বা বন্ড তৈরী করে) তারাই ঢোকার অনুমতি পায়। এরকম দুটো প্রেটিন (রাসায়নিক পদার্থ বা তালা এক্ষেত্রে) হলো CD4 এবং CCR5, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে HIV-এর কাছে একধরনের glycoprotein (gp120) আছে যা ঊপরোক্ত প্রোটিনের জন্য চাবি (ধরে নিন নকল চাবি ) হিসেবে কাজ করে, এবং ভাইরাসের জিনগুলোকে কোষের ভিতরে ঢুকতে দেয় (ছবি-2)। ইউরোপিয়ানদের কারও কারও CCR5 তৈরীর সুত্রে ভুল আছে, আরও ভাল ভাবে বললে, ওদের সুত্রে প্রায় 32টি বর্ন কোন ভাবে মুছে গিয়েছে, ফলাফল CCR5-delta32 এবং ভাইরাসের চাবি এই নতুন তালা খুলতে পারে না, যে কারনে যাদের শরীরে এই মিউটেশন আছে তারা AIDS প্রতিরোধ করতে পারে (সরলীকৃত)।একই জিন প্লেগ, গুটি বসন্তের হাত থেকেও রক্ষা করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত ইউরোপিয়ান এই পরিবর্তিত জিন পেল কোথায়। মিউটেশন না হয় ভাগ্যক্রমে একজনের শরীরে ঘটেছে, কিন্তু বাকীরা পেল কিভাবে?
সমাধানের জন্য কয়েকশ বছর পেছনে চলে যাই। ধরা যাক নরওয়ের কোন এক গ্রামে একটি শিশু (A) প্রথম এই জিন নিয়ে জন্মগ্রহন করল। গ্রামের জনসংখ্যা 100। ঐ বছর গ্রামে প্লেগের খুব প্রাদুর্ভাব হলো, অর্ধেক লোক মরে গিয়ে জনসংখ্যা হলো 50 (শিশুটি মরেনি)। 20 বছর পর গ্রামের জনসংখ্যা বেড়ে আবার 100 হলো, A এর মধ্যে এক সন্তানের(A1) জনক (A1 বাবার কাছ থেকে একই জিন উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছে)। আবার প্লেগের আক্রমন হলে জনসংখ্যা এবারও 50-এ কমে গেল, তবে A,A1 উভয়েই CCR5delta32 থাকায় আক্রান্ত হয় নি। আরও 20 বছর পরের ঘটনা, ইতোমধ্যে A থেকে A2 জন্মেছে, এবং A1 থেকে A1-2 জন্মেছে, গ্রামের জনসংখ্যা আবারও 100, যথারীতি প্লেগও আক্রমন করে বসল, জনসংখ্যা 50 এ নেমে গেল তবে যাদের ঐ বিশেষ জিন আছে তারা এবারও বেচে গেল। এখন আমরা একটা হিসাব করি, প্রথম আক্রমনের সময় এই জিন বিশিষ্ট লোক ছিল 1%, দ্্বিতীয় আক্রমনে হলো 2%, তৃতীয় আক্রমনের পরে 4%, এভাবে যদি আরও কয়েক প্রজন্ম চলতে দেই(প্লেগ নিয়মিত আক্রমন করে) তাহলে একসময় গ্রামের সবাই ঐ জিন বিশিষ্ট হবে। ডারউইন হলে বলতেন Survival of the fittest, অথবা ন্যাচারাল সিলেকশন, কারন এখানে যাদের ঐ জিন আছে তারা একটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।
এরকম অনেক উদাহরণ আছে যেখানে বিশেষ জিন (মিউটেশনের কারনে) সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার জন্য কয়েক প্রজন্ম পরে অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। উদাহরন আমাদের চামড়া, চোখ বা চুলের রঙের জন্য দায়ী জিন গুলো। যেসব স্থানে সুর্যের আলো প্রখর সেখানে কালো চামড়া সুর্যেরঅতি বেগুনী আলো থেকে রক্ষা করে, আবার যেখানে সুর্যের আলো কম সাদা চামড়া ভিটামিন ডি তৈরীতে সাহায্য করে। ঠিক এ কারনেই গরমের দেশগুলোতে কালো চামড়ার জিন প্রাধান্য বিস্তার করে, শীতের দেশে সাদা চামড়ার।
তাহলে এখন প্রশ্ন যে সব কালো লোক গত কয়েক শতকে শীতের দেশে বসবাস শুরু করেছে তাদের মধ্যে কেন সাদা চামড়ার জিন তৈরী হয় না? উত্তরটা জানা খুব জরুরী কারণ বিবর্তনবাদকে প্রায়ই আমরা উলটো দিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি (বানর থেকে এখন কেন মানুষ জন্মায় না) । আমি অবশ্য আগের অনুচ্ছেদ এবং গত লেখায়ই এর উত্তর রেখেছি, তবুও সরাসরি বললে কারণটা এমনঃ ইউরোপিয়ানরা শ্বেতকায় কারন এই নয় যে তারা ইচ্ছে করে সাদা হয়েছে, অথবা তাদের শরীর অনুমান করেছে যে সাদা চামড়া হলে ভিটামিন ডি তৈরী করা যাবে তাও নয়। আমাদের শরীর বা জিন প্ল্যান করে কোন কাজ করে না। তাই সাদা চামড়া হলে সুবিধা হবে এটা বুঝে সাদা রঙের জিন তৈরী হয়েছে তা নয়। এরকম আরও অনেক সুবিধাজনক জিন সম্ভব যেগুলো প্রকৃতি কখনই বুদ্ধি করে বের করতে পারে নি। সাদা চামড়ার জন্য দায়ী জিন random মিউটেশনে কাকতালীয়ভাবে কারও না কারও শরীরে অতীতে তৈরী হয়েছিল, পরবর্তিতে এই জিন সুবিধাজনক হওয়ায় টিকে গিয়েছে আর অসুবিধাজনক বলে ইউরোপ থেকে কালো রঙের জিন বিলুপ্ত হয়েছে (CCR5delta32 এর সাথে তুলনা করুন। এখনকার কালো লোকেরা ইউরোপে গিয়ে সাদা হতে চাইলে এরকম অনেকগুলো random মিউটেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে (আনুমানিক 20 হাজার বছর দরকার এই সাদাকরণ প্রক্রিয়ার জন্য)।
যাহোক মোদ্দা কথা হচ্ছে মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে, আমাদের প্রত্যেকের জেনেটিক গ্রন্থ সামান্য হলেও ভিন্ন, প্রত্যেকটি শিশু নতুন কিছু জেনেটিক কম্বিনেশন নিয়ে জন্মগ্রহন করে, ভালো হোক আর মন্দ হোক। একই কথা অন্য জীবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হয়তো আমাদেরই কারো কাছে বার্ডফ্লু প্রতিরোধক জিন আছে, হয়তো ইবোলা ভাইরাসের প্রতিরোধক, অথবা হয়তো এমন জিন যা ভবিষ্যতে Ice Age এলে সাহায্য করবে, হয়তো একদিন তা মানুষের বিবর্তনের গতিপথ বদলে দেবে। যেটা মনে রাখা দরকার তা হলো বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া, সবসময়ই হচ্ছে, না চাইলেও হচ্ছে।
এবার লেখার শিরোনামের প্রসঙ্গে আসা যায়, প্রজাতির কি জন্ম হয়? ধরা যাক কোন প্রানীর ("ক") সুত্র 20,00,000 বর্ণ দিয়ে তৈরী, প্রতি প্রজন্মে বর্ণপরিবর্তন হয় 100 টি স্থানে, তাহলে 10000 প্রজন্মে ("খ")পরিবর্তন হবে 10,00,000 স্থানে, তার মানে দাড়াচ্ছে 50% বর্ণই বদলে যাবে, এটা যদি কোন বই হতো তাহলে মুল বইয়ের সাথে এর অর্থগত মিল পাওয়া দুস্কর হতো। জীব জগতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে, 10000 প্রজন্ম পরে "ক" এবং "খ" এতসব পরিবর্তনের হয়ে আলাদা প্রানীতে রূপান্তরিত হবে, পার্থক্য এতই বেশী যে এদের মিলন ঘটিয়ে পরবর্তি প্রজন্মও তৈরী সম্ভব নয় , জীববিজ্ঞানীরা তখন বলবেন "ক" এবং "খ" আলাদা প্রজাতি। উদাহরন স্বরুপ পোষা বিড়াল থেকে শুরু করে বাঘ, সিংহ, চিতা, জাগুয়ার সবাই একই পুর্বপুরুষ থেকে এসেছে, এই পুর্বপুরুষ 60-65 মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে ছিল, অথচ এখন এদের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। এদের DNA Analysis করলে 60 মিলিয়ন বছর আগের প্রাচীন পান্ডুলিপির অস্তিত্ব বোঝা যায়। কিভাবে বোঝা যায় পরের লেখায় লিখব। আরও উদাহরন আছে যেমন, পান্ডা এবং ভালুকের পুর্বপুরুষ একই, তিমি-ডলফিনের পুর্বপুরুষ স্থলচর মাংশাসী প্রানী ছিল ইত্যাদি।
সমস্যা হলো বড় বড় প্রানীদের এসব পরিবর্তন 50-100 বছরে দেখা সম্ভব নয়, এজন্য বহুযুগ অপেক্ষা করতে হবে, তবে তুলনা মুলক ভাবে সরল প্রানীর(যাদের জেনেটিক গ্রন্থ মাত্র কয়েক পাতার) জন্য কয়েকদিন থেকে কয়েক মাসই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০০৬ বিকাল ৩:৩৪