নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Stay Hungry. Stay Foolish.
কিছুদিন আগে ঢাকার রাস্তার যানজট নিয়ে আমি ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তাতে যানজট সহনীয় পর্যায়ে আনার ব্যাপারে যথেষ্ঠ কঠোর ভাষায় আমি দেশ পরিচালকদের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। এরই প্রতিউত্তরে কেউ কেউ তাঁদের ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন, যতটা না দেশ পরিচালকদের ভুমিকা নিয়ে আমার আশার ব্যাপারে, তার থেকে বেশি আমার বক্তব্যের কঠোরতার কারনে।
এখন কথা হলো, কেন আমি এরকম লিখলাম।
ঢাকার যানজট নতুন কোন বিষয় নয়। এ বিষয়ে হাজার হাজার বার লেখা হয়েছে। কিন্তু ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা যেভাবে সম্পুর্ণভাবে ভেংগে পড়েছে, তা তে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে আমার মতামতটা তুলে ধরার ইচ্ছা ছিলো অনেকদিন ধরেই। অনাকাংখিতভাবেই সেটা কঠোরভাবে সেদিন হয়েছে। যাই হোক, একজন 'প্রতিদিনকার যাত্রী' হিসেবে আমি কি দেখি প্রতিদিন?
১। সম্ভবত ঢাকাই পৃথিবীর একমাত্র শহর, যেখানে ট্রাফিক আইন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। ভি.আই.পি., মোটরসাইকেল চালক, গনপরিবহন চালক - এরা সবাই এর আওতামুক্ত।
আমার এই কথাটা একেবারেই বাস্তব।
ধরুন আপনি রাস্তার সঠিক দিকে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যামে। আপনার সাথে আছে একজন ফ্ল্যাগ আর বিশেষ হর্ণ লাগানো গাড়ি (ভি আই পি), একজন মটরসাইকেল চালক, এবং একজন মিনিবাস চালক। এবার প্রথমেই ভি আই পি গাড়িটা করবে কি রাস্তার উলটো দিক দিয়ে সোজা চালিয়ে দেবে কোনকিছুর তোয়াক্কা না করেই। কখনও আপনার গাড়িটাকে আটকে দিয়ে রাস্তার ডিভাইডার সরিয়ে তারপর উলটো দিকে যাবে। আপনি হতাশায় হাত কামড়াতে কামড়াতে দেখবেন যে, যে স্থানে আপনি গত ২ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, সেটা ওই ফ্ল্যাগওয়ালা পার হয়ে গেলেন ৫ মিনিটে। আর এই পুরো ঘটনাটা ঘটবে ট্রাফিক পুলিশের সযত্ন তত্তাবধানে।
এবার মটরসাইকেল চালক আপনার সহ অন্য গাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে সামনে আগানোর চেষ্টা করবে। এতে যদি গাড়িতে ঘষাও দিতে হয় বা সাইড মিরর উপড়ে ফেলতে হয়, কুছ পরোয়া নেই। আমি মাঝে মাঝেই বাম লেন ধরে গাড়ি চালানোর জন্য এইসব 'ভদ্র' মোটরসাইকেল চালকদের গালি শুনি। কারন ওনারা চান পুরো বাম সাইডটাই ওঁদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে যেন ওনারা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারেন। আমরা বসে থাকি অনন্তকাল, সমস্যা নেই।এরপর ওনারা যা করেন তা হলো, ফুটপাথ ধরে চালিয়ে দেয়া এবং অবধারিতভাবেই রাস্তার ভুল সাইড দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। এরা ভি আই পি দের থেকেও এককাঠি বাড়া। কারন ভি আই পি রা অন্তত ট্রাফিক সিগন্যালে থামেন কিন্তু মোটরসাইকেল চালকরা কখনই সেটা মানেন না। এবারও এই পুরো 'আইনভংগ'টা হয় ট্রাফিক পুলিশের প্রবল উপস্থিতির মধ্যেই।
ভি আই পি'র পর মোটসসাইকেল চালকও কিন্তু চলে গেল। আপনি 'গোবেচারা' ব্যাক্তিগত গাড়ি চালক কিন্তু জ্যামে ২ ঘন্টা পার করে দিয়েছেন।
এবার যখন চলা শুরু হবে, তখন বাসচালকদের বাস চালানো দেখে মনে হবে, ওরা যেন ক্রমাগত লেন পরিবর্তনের খেলায় নেমেছে। আর এই খেলায় ওর কোন দায়িত্ব নেই সিগন্যাল দেবার। যেহেতু এই নগন্য গাড়িচালকের মাছির মত মাথার চারপাশ জুড়ে চোখ নেই, কাজেই সে একই সাথে চারপাশ থেকে আসা গাড়ি আর মানুষের মিছিল লক্ষ্য করতে পারেনা। ফলে এক পর্যায়ে সে দেখবে যে পাশের বাসটা কখন যেন তার বাম বা ডান দিকটা উড়িয়ে দিয়েছে। কিচ্ছু করার নেই আপনার। প্রতিবাদ করলেই বিপদ।
তো, এই দুস্তর মরূ পার হয়ে যখন আপনি অবশেষে সিগন্যাল পার হতে পারলেন, তখন মাকড়শার মত ওৎ পেতে থাকা একজন 'হলুদ সার্জেন্ট' আপনাকে আদর করে থামাবেন। এবং আপনাকে দেখিয়ে দেবেন যে আপনি একজন কালার ব্লাইন্ড। মানে আপনার গাড়ির জন্ম থেকে যে বেসিক সিলভার রঙ, সেটা উনি বলবেন সাদা বা কালো বা হলুদ - যা ইচ্ছা এবং সেটাই ফাইনাল। এই কথোপকথনের ফাঁকেই আপনার কাছে চলে আসবে একটা মামলা।
এই হলো আপনার পুরষ্কার - ট্রাফিক আইন মানার জন্য।
২। অবধারিতভাবেই সবসময় দেখা যায়, পুলিশের গাড়ি রঙ সাইড দিয়ে যাবে আর ট্রাফিক সার্জেন্টের বাইকও রঙ সাইড দিয়ে যাবে। মাথায় হেলমেট পরার আইনটা 'তাঁদের' জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আপনি যদি ব্যাক্তিগত গাড়িচালক হন আর এক মুহুর্তের জন্য রাস্তায় সিটবেল্টটা খোলেন (গড় গতিবেগ কোনভাবেই ২ কিমি/ঘন্টার বেশি নয়), তাহলে কিন্তু আপনি 'কবিরা গুনাহ' করে ফেললেন। সাথে সাথেই 'মুনকার-নাকির'-রূপী সার্জেন্ট তা লিপিবদ্ধ করে ফেলবে মামলার আকারে।
৩। এবার একটা তুলনামূলক ছবি।
আমি যখনই কোলকাতা যাই, আমাকে সবচেয়ে বিষ্মিত করে ওই সরু সরু রাস্তায় যানজট না থাকাটা। তো, প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম, এরা কি সুসভ্য। কি সুন্দর নিজে নিজেই ট্রাফিক আইন মেনে চলছে। পরে দেখলাম, ব্যাপারটা তা নয়। ওদের ওখানে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগটা প্রচন্ড রকম কড়াকড়ি। সিস্টেমটাই এমন যে, আইন না মানলে অটোম্যাটিকভাবে এক পর্যায়ে আপনার গাড়িটা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। আমাকে এক ট্যাক্সি চালক জানাল যা, আইন ভাংলে সার্জেন্ট 'হাত' চালাতেও দিধা করেননা বৃহত্তর সার্থে। আমি নিজে দেখেছি, ভুল রাস্তায় একটা রিক্সা ঢুকে পড়ার পর সার্জেন্ট তার বাইক দিয়ে পুরো রাস্তা ওই রিক্সাকে ধাক্কিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আর আমার ঢাকাতে? সার্জেন্টের ভূমিকাটা যেন কি ছিলো?
৪। দয়া করে বলবেন না যে ব্যক্তিগত গাড়ি নামে বলেই যানজট হচ্ছে। কোন চালকই চায় না ২০ মিনিটের রাস্তা ৩ ঘন্টা ধরে বসে তেল আর এনার্জি অপচয় করতে। গনপরিবহন বলে কি কিছু আছে ঢাকায়? রাস্তা থাকলে ব্যক্তিগত গাড়ি থাকবেই- পৃথিবীর সব শহরেই আছে। আমাকে আপনি অল্টারনেটিভ যাতায়াত ব্যবস্থা দিন, আমি গাড়ি বের করব না। সেটা তো দিতে পারবে না আমাদের মাননীয় 'দেশ পরিচালনাকারীরা'।
আমি বেশ অনেকদিন চেষ্টা করেছিলাম হেঁটে অফিস করার। হাঁটব কি, হাঁটার মত তো কোন জায়গা থাকলে তো। না আছে ফুটপাত, না হাঁটা যায় রাস্তা দিয়ে। তাও দাঁত কামড়ে কিছুদিন চালিয়ে ছিলাম। ক্ষ্যান্ত দিলাম কয়েকবার গর্তে পড়ে, ফুটপাতে ধরে চলার 'অপরাধে' মোটরসাইকেলের ধাক্কা খেয়ে আর বের হয়ে থাকা লোহার টুকরায় পা কেটে।
হায়রে....!
৫। মেট্রোরেল, সার্কুল্যার নৌপথ, সল্পপাল্লার ট্রেন - এই গল্পগুলো 'কুমিরের বাচ্চা দেখানোর' মত করে দেখিয়ে যাবে অনাদিকাল, আমি নিশ্চিত। আরে, মিরপুর থেকে আমি রেল বা নৌ পথে কিভাবে মতিঝিল যাবো? আমাকে তো এর সড়কপথেই যেতে হবে যেটা প্রতিনিয়ত আরো বেশি গাড়ির চাপে ভেংগে পড়ছে।
.........................
এতক্ষন যা বললাম, সেগুলো আমার প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা, কোন থিওরি নয়। আমার মত আরও লক্ষ লক্ষ লোকেরও অভিজ্ঞতা এটাই। আর এই পুরোটাই ঘটছে শুধুমাত্র টেকসই পরিকল্পনা আর আইনের বাস্তবায়নের অভাবে।
এবার আমাকে বলেন, এই টেকসই যানজট নিরসন পরিকল্পনা আর আইনের বাস্তবায়ন করা কার কাজ? আর আমি যে তাদের ব্যাপারে কঠোর ক্ষোভ জানালাম, তা কতটুকু অযৌক্তিক?
আর যদি কেউ অযৌক্তিক মনেও করেন, I don't care. কারন ট্যাক্সও দেই আমি আর প্রতিদিনকার ভুক্তভোগীও সেই আমিই।
©somewhere in net ltd.