নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সন্ধ্যা প্রদীপ

আমার সমস্ত চেতনা যদি শব্দে তুলে ধরতে পারতাম

সন্ধ্যা প্রদীপ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ অদিতির পূর্নিমা ভাল লাগেনা

২৩ শে আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৯



ফারিহা হুড়মুড় করে দরজা খুলে ঢুকে উচ্চ কণ্ঠে ডেকে বলে -সবাই নিচে চলে গেছে তোরা যাবি না?
মিম অদিতির দিকে তাকায় তারপর বলে নিচে কি?
ফারিয়া বলে দেখছিস না কি ঝকঝকে চাঁদের আলো!জ্যোৎস্না উৎসবের হবে আজ।হল সুপার ম্যামের কাছে পারমিশন নেয়া হয়েছে।একটু পরে বারোটা বেজে যাবে।তখন শুরু হবে গান।হারমনিয়ম,তবলা নামানো হয়েছে।তুলি ওর ভায়োলিন নিয়ে এসেছে।সবাই নিচের লনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবে।সারা রাত গান হবে।
মিথিলা চোখ কপালে তুলে বললো সারা রাত?
ফারিহা- হ্যাঁ চাঁদ ডুবে যাওয়া পর্যন্ত।
আজকের পূর্নিমায় চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে এসেছে।দেখছিস না জ্যোৎস্নার কেমন তেজ।এত কাছে আবার কতশ বছর পর আসবে জানিস?জনম জনম কেটে যাবে এর মাঝে।

মিম- কারো পরীক্ষা নেই? তারা কমপ্লেইন করবে না?

ফারিহা-এটাই হচ্চে মজার ব্যাপার। আগামীকাল কারোই পরীক্ষা নেই। তিনদিন পর ইকোনমিকস এর মেয়েদের ক্লাস টেস্ট আছে।ডলি একটু ঝামেলা করছিল, জানিসই তো কেমন মেয়ে ও।সবাই তাকে বলেছে এক্সটেনশন ব্লকে ওর বান্ধবীর রুমে গিয়ে পড়তে।প্রোগ্রামটা ছাদে করতে পারলে ভাল হতো কিন্ত মেয়েদের হলের ছাদে যাওয়া নিষেধ। সুপার ম্যাম তাই সাফ মানা করে দিয়েছেন।তবে তার কাছে অন্য সুবিধা আদায় করে নেয়া হয়েছে।যতক্ষন প্রোগ্রাম চলবে সারা হলের সব আলো বন্ধ থাকবে।একেবারে ব্লাক আউট!

মিম- বলিস কি!

ফারিহা- হ্যাঁ তাছাড়া চানাচুর মুড়ি,চিপস আর মশলা দেয়া রঙ চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।শেষ রাতে একটা বড়সড় কেক কেটে অনুষ্ঠান শেষ হবে।তোরা দুজন জলদি কর।অনেকে শাড়ি পড়েছে।ফুল দিয়ে সেজেছে।
একনাগাড়ে এসব বলে ফারিহা যেমন এসেছিল তেমনি হুড়মুড় করে চলে গেল।

এবার অদিতির দিকে তাকায় মিম।অদিতি বলে তুই যা,আমি একটু পড়ে আসছি।

মিম মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চুল আঁচড়ে,আলনা থেকে ওড়নাটা টেনে নেয় গায়ে।কি ভেবে কপালে ছোট্ট টিপ,আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙ ছোয়ায়।তারপর বলে গেলাম আমি।লাইট অফ করে দিচ্ছি।
মিম জানে অদিতি এখন সবগুলো পর্দা টেনে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকবে।

এমনিতে অদিতি চমৎকার মেয়ে।রুমমেট হিসেবেও দারুন।দুজনেই অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। কিন্ত এই এক অদ্ভুত স্বভাব এই মেয়েটির।রাত হলে জানালার পর্দা টেনে রাখে।যেদিন আকাশে বড় চাঁদ ওঠে, আলোয় ভেসে যায় চারিদিক তখন ইলেক্ট্রিক বালব নিভিয়ে দিলে ঘরের মধ্যে আলো এসে পড়ে। তখন সে তার দিকের জানালা বন্ধ করে রাখে।মিম যদি নিজের দিকের পর্দা সরিয়ে রাখে তখন সে কিছু বলে না কিন্ত গুটিশুটি মেরে আপাদমস্তক কাঁথায় ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ে।পূর্নিমার আলোয় তার কি সমস্যা কে জানে?


মিম চলে গেলে অদিতি কিছুক্ষন আনমনে বসে থাকে। হলের মেয়েরা একসপ্তাহ ধরে এই জ্যোৎস্না উৎসবের আয়োজন করেছে।তিনতলার এই রুম থেকেও নিচে তাদের উত্তেজিত হৈ হল্লা শোনা যাচ্ছে।চাঁদের তীব্র আলো তার ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে যেন দিনের মত।সে দ্রুত হাতে জানালা বন্ধ করে দেয়।ব্রাশ পেস্ট লাগিয়ে বের হয় ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে।হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে হতেই শোনের নিচের হইচই হঠাৎ থেমে গিয়েছে। তুলির ভরাট কণ্ঠ ভেসে ওঠে।সে গাইছে রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন - 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে'
আশ্চর্য! জ্যোৎস্না রাতে বনে যেতে হবে কেন?

অদিতি বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে।একটা চৌকির উপর মাদুর বিছিয়ে স্টেজের মত করা হয়েছে।সেখানে ধবধবে সাদা শাড়ি পড়ে তুলি চোখ বুঁজে গান গাইছে।তার মাথায় কি যেন সাদা ফুলের মালা মুকুটের মত করে জড়ানো। পাশেই শিউলি গাছে তারার মত ফুল ফুটেছে। শরতের হাওয়ায় কিছু কিছু ফুল ঝরে পড়ছে।মিস্টি গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করছে।তুলিকে দেখাচ্ছে অপ্সরার মত।মনে হচ্ছে এ দৃশ্য এই নশ্বর পৃথিবীর নয়।তার মায়াবী কন্ঠে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত চুপ হয়ে গেছে।চাঁদটাও মনে হয় মোহিত হয়ে শুনছে, নইলে এত কাছে নেমে আসবে কেন?তাকাবে না তাকাবে না করেও অদিতি চাঁদের দিকে তাকালো।তাতেই তার আবেশ ভঙ্গ হয়ে গেল।সে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিজের রুমে ফিরে গেল।দরজা জানালা বন্ধ করে সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।


সেই রাতেও এমন চাঁদ উঠেছিল।
মেজ চাচ্চুর বিয়ের জন্য দাদুবাড়ি গিয়েছিল ওরা।
ওর দাদুবাড়ি মফস্বল শহরে। সাবেকি আমলের বিশাল দোতলা বাড়ি দেখায় ঠিক তিনতলার মতই উঁচু।এল প্যাটার্নের বাড়িতে অগনিত ঘর।সামনে বিশাল উঠান।পুরো বাড়ি আর উঠান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের চারিদিকে ফুলের বাগান,ফল ফলাদির গাছ।

অদিতির বয়স তখন সাত কিংবা আট।বয়েসের তুলনায় উচ্চতায় কিছুটা বড়,মাখনের মত গায়ের রঙ,গোলগাল পুতুলের মত চেহারার অদিতি দাদুবাড়িতে সবার চোখের মনি।সাদা,গোলাপি, লাল-নীল ফ্রক পড়ে সারা বাড়ি দৌড়ে বেরিয়েছে সে কয়দিন ধরে ।বিয়ে জিনিসটা কি সে ঠিক বোঝে না।তবে বিয়েতে যে অনেক মজা হয় সেটা সে দাদুবাড়ি এসেই বুঝতে পেরেছে।চারিদিকে কত লোক!কত আলো! কত মজার মজার খাবার!সারাদিন সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে, রোদে পুড়ে পানিতে ভিজে যা হবার তাই হলো।বিয়ের দিন সকাল থেকেই তার গা গরম।বরযাত্রী বের হওয়ার গোলমালে মা তার দিকে নজর দিয়ে উঠতে পারেননি। খেয়াল করলেন বিকেলে। ততক্ষণে বউ নিয়ে ফিরতি যাত্রা করা হয়েছে।সন্ধ্যার মধ্যের অদিতির জ্বর হু হু করে বেড়ে গেল।তাকে মাথায় পানি ঢেলে ঔষধ খাইয়ে দোতালার একটি ঘরে শুইয়ে দেয়া হলো।

বাড়িতে নতুন বউ এসেছে। বাড়ির সমস্ত লোক জড় হয়েছে নিচতলার বৈঠকখানায়।সেখানে শতরঞ্জি পাতা মেঝেতে বউকে ঘিরে চলছে আমোদ ফুর্তি, আড্ডা।গানবাজনার আয়োজন করা হয়েছে।উঠোনের এক কোনে বিরাট ডেকচিতে রাতের রান্না চেপেছে।আগামীকালের বউভাতের অনুষ্ঠানের জন্য নতুন উনুন তৈরি হচ্ছে,প্যাণ্ডেল টাঙ্গানো হচ্ছে।অদিতির দাদু আর বয়সের বড়রা বাইরে উঠোনে সেইসব কাজের তদারকি করছেন আর কাপের পর কাপ চা খাচ্ছেন।মরিচবাতি দিয়ে সাজানো আলো ঝলমলে বাড়ির এসব কিছুই অদিতির দেখা হয়নি।সে জ্বরে অচেতন হয়ে ঘুমাচ্ছে।

হঠাৎ অদিতির ঘুম ভেঙে গেল।ঘর অন্ধকার। ঘড়ি দেখতে শিখেছে সে তবে আলো নেই বলে বুঝতে পারছে না কয়টা বাজে। নিচ থেকে বিয়ে বাড়ির হইচই ভেসে আসছে।নাহ! সেজন্য ঘুম ভাঙেনি তার।হয়ত জ্বরটা কমেছে।জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার বিছানায়।কি সুন্দর মায়াবী আলো!ঢাকা শহরে যে বিল্ডিংয়ে তারা থাকে তার চারপাশে তাকালে আরো বিল্ডিং,নিচে তাকালে দেখা যায় ময়লা ডাস্টবিন। ইশ! দাদুবাড়ির চারপাশ কত সুন্দর! সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়।কি সুন্দর আলো হয়ে আছে চারিদিক, অথচ এখন রাত!

সে ভাল করে দেখবে বলে জানালার দিকে এগিয়ে যায়।কি বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে।অদিতি পায়ে পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।দোতলার টানা বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে একবার উঠোনে তাকায়।সেখানে মানুষের জটলা,কর্ম ব্যস্ততা। গানের আর হাসির সুর ভেসে আসছে বৈঠকখানা থেকে।সেসব আকর্ষণ ছাপিয়ে যে জিনিসটা তাকে আকর্ষণ করছে সেটা হলো ঐ পূর্নিমার চাঁদ।সে গুটিগুটি পায়ে ছাদে উঠে যায়।

অদিতির গায়ে হাতাকাটা পাতলা কাপড়ের ফ্রক,পায়ে স্যান্ডেল দিতেও ভুলে গেছে সে।ছাদে এসে সে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে।কি সুন্দর! কি মায়াবী! চাঁদটা সাদা না রূপালী না নীলচে তা বুঝে ওঠা যায় না।সে আরেকটু লম্বা হলেই বুঝি ছুঁতে পারবে চাঁদটাকে তার এমন মনে হয়।সে নকশাকাটা ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। নিচে বিয়ে বাড়ির আলো কিন্ত আসেপাশে সমস্ত জায়গায় তরল রূপার মত জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে চাঁদটা। বাড়ির অদূরে পুকুরের পানিতে পড়েছে চাঁদের প্রতিবিম্ব। ঝোপঝাড়ে জোনাকির আলোও যেন ফিঁকে হয়ে গেছে।এত উপর থেকে মরিচবাতির আলোটুকুও অনেক ম্লান লাগছে।চন্দ্রাহত হয়ে অদিতি দাঁড়িয়েই থাকে।কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো বলা যায় না।যদি না---


সেই ছাদে চিলেকোঠা মতো একটা ঘর আছে।সেখানে বাড়তি জিনিসপত্র রাখা হয়।প্রয়োজন হলে কাজের লোকরা যাতে থাকতে পারে তার জন্য একটা চৌকি পাতা আছে।নড়বড়ে, দরজা ভাঙা সেই ঘরের ছায়া থেকে কালো ছায়ায় মতই দুইটা হাত বেড়িয়ে এসে অদিতিকে ধরে ফেলে।হাতদুটো তাকে টেনে নেয় ঘরের ভেতরে।ঘটনার আকস্মিকতায় সে ভয় পেতেও ভুলে যায় চিৎকার তো দূরের কথা।

যখন চিৎকার করতে যাবে তখন বোঝে সে উপায় নেই।কারন মুখে হাত চাপা দেয়া।কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারে না।তবে একটা গন্ধ তার নাকে আসে।সস্তা সেন্ট এর সাথে সিগারেটে গন্ধ মেশানো এই গন্ধ সে গত সন্ধ্যায়ও পেয়েছে।পেয়েছে তার আগের দিনও।ফ্যাসফ্যাসে গলায় লোকটি বলে ওঠের ভয়ের কি আছে?ভয় পেও না।

লোকটি বলতে থাকে আমি তোমাকে খুব মজার একটা জিনিস দেখাবো।শিপু, মুনিয়া ওরা কেউ জানেনা এমন জিনিস।চেনা লোক দেখে অদিতি শান্ত হয়।নতুন জিনিস দেখার আগ্রহটাও তৈরি হয় তার মনে। কিন্তু অচিরেই গায়ে ব্যাথা লাগলে সে ছটফটিয়ে ওঠে।জোড়াজুড়িতে খুলে আসে জামার চেইন।লোকটি ফিসফিসিয়ে বলতেই থাকে ভয় কি?খুব ভাল লাগবে। কিন্ত অদিতির ভাল লাগেনা।লোকটি মুখ চেপে রেখেছে বলে কথাও বলতে পারছে না।লোকটির মুখও দেখা যাচ্ছে না।হঠাৎ করেই প্রচন্ড ব্যাথা লাগে তার।ব্যাথা বাড়তে থাকে।সে চিৎকার করার চেষ্টা করে কিন্ত ব্যার্থ হয়।যন্ত্রণায় চোখ ফেটে জল গড়াতে থাকে। তার মনে হয় সে বুঝি মরে যাচ্ছে।কান্নায় তার দম আঁটকে আসে।একটু নিশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে অদিতি বোধহয় অচেতন হয়ে যায়।

চেতনা ফিরলে দেখে সে একা পড়ে আছে চৌকির উপর।মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা। কোনোমতে হেঁটে বাইরে আসতে গিয়ে ব্যাথায় গুঙিয়ে ওঠে সে ।তার মনে হয় চটচটে কি যেন বেয়ে নামছে উরুর কাছে।অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে সে নামতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে।বিয়ে বাড়ির কোলাহলে তার ফুপিয়ে কান্না কারো কানে যায় না।বাইরে তখনও জ্যোৎস্নার বন্যা বয়ে যাচ্ছে।চাঁদটাই শুধু যেন পুরো ঘটনার সাক্ষী!

দোতলায় তখনও কেউ নেই,নিচে আগের মতই কোলাহল চলছে।অদিতি বাথরুমে ঢুকে আঁতকে ওঠে।পা বেয়ে নামছে তাজা রক্ত।গোলাপি রঙের প্যান্ট ভিজে সপসপে হয়ে গেছে।সে ছোট্ট হাতে যতদূর সম্ভব জামা কাপড় ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করে।জ্বর তপ্ত গায়ে পানি যেন ছ্যাঁকা দেয়।তাও সে পানি ঢালে।পানি লেগে প্রচন্ড জ্বালা করে ওঠে শরীরের কিছু কিছু অংশ।

তার ইচ্ছা হয় কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে ছুটে যেতে।কিন্ত ভয় হয়।মা নিশ্চয়ই তাকেই বকবে।খেলতে গিয়ে মারামারি করলে বা ব্যাথা পেলে মা তাকে বকা দেয়।বাবা হয়ত একা ছাদে যাওয়ার জন্য অনেক রাগ করবে।ঢাকার বাসায় তার ছাদে যাওয়া বারন।তবুও বাবা মা কে বলা যায় অথবা ছোট চাচ্চুকে অথবা শিপু মুনিয়াকে।কিন্ত এত ছোট্ট বয়েসেও তার মনের ভেতর থেকে কে বলে ওঠে এটা কাওকে বলার মত বিষয় না।এখানে কোথাও একটা লজ্জার ব্যাপার আছে। তাই সে প্রানপণে পানি ঢালতে থাকে নিজের পায়ে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষন আর পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামে না।

শেষ রাতের দিকে ঘরে এসে অদিতির মা আবিষ্কার করেন মেয়ের গা জ্বরে কেঁপে কেঁপে উঠছে,সে বিরবির করে কি যেন বলছে।সকালের ডাক্তার ডেকে ভাল ঔষধ দেয়া হলো কিন্ত তার জ্বর কমতে কয়েকদিন সময় নিল।একয়দিন সে বিছানাতেই শুয়ে থাকলো। চাচুর বিয়ের আনন্দ উৎসবে তার জোগ দেয়া হলোনা। মাকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে চাইল না।অথচ বাড়িতে বড় বউয়ের অনেক দায়িত্ব। তাই অদিতির মা কাওকে না কাওকে রাখলেন তার সাথে।তার তিন চারদিন পরই তারা ঢাকা চলে আসে।

অদিতি পুরো ব্যাপারটা মা বাবার থেকে লুকিয়ে গেছে।বিয়ের অনুষ্ঠানে মনোযোগ থাকায় তারা তাকে ভাল করে খেয়াল করেন নি নইলে তার শারিরীক দূর্বলতাটকু চোখে পড়ত।জ্বর ছিল বলে ভেবেছেন সেই জন্যেই সে সারাদিন শুয়ে থাকে।
গত বছর থেকে মা তাকে একা একা গোসল করতে দেয় বলে বুকে,তলপেটে,উরুতে কাঁচা ক্ষতগুলোও কারও চোখে পড়েনি।কিছুই সে বুঝত না সেই সময়।কেন সেই আঙ্কেল তাকে এত ব্যাথা দিয়েছিল তা অদিতির ছোট্ট মস্তিষ্কে ধরেনি।

তখন না ধরলেও মস্তিষ্কে পরিস্কার ভাবে ধরেছিল আরো সাত আট বছর পর কিশোরী বয়েসে।শিশু অদিতি মাঝে হয়ত ভুলেই গিয়েছিল কথাগুলো।বড় হয়ে ওঠার স্রোতে কত স্মৃতিই তো তলিয়ে যায়!

সেসব কথা হঠাৎই মনে পড়েছিল চার বছর পরের এক পূর্নিমায়।তখন সে কেবল বারোতে পা দিয়েছে।পৃথিবীর কিছু কিছু রহস্যময়তা তার কাছে খুলতে শুরু করেছে।গভীর রাতে ঘুম ভেঙে জানালা দিয়ে পূর্ন চাঁদটা দেখামাত্রই মনের গহীন থেকে একরাশ স্মৃতি বের হয়ে আসলো।

সেই থেকে পূর্নিমা অদিতির সহ্য হয় না।পূর্নিমার চাঁদ দেখলেই একে একে সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলো বের হয়ে আসে।বের হয়ে আসে সেই ছোট্ট মনের ভয়।সে যেন আবার শৈশবের সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে যায়।আবার ব্যাথা পাওয়ার ভয়,কেউ জেনে ফেলার ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।কোনো কোনো পূর্নিমায় সে সস্তা সেন্টের সাথে সিগারেট মেশানো গন্ধটা পায়।তলপেটে তীব্র ব্যাথার অনুভূতিটাও জেগে ওঠে। সেই জ্বরের ঘোরে দেখা দুঃস্বপ্ন গুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এতগুলো বছর ধরে অদিতির মস্তিষ্ক বিশেষ দিনটিকে জ্যান্ত করে তুলতে থাকে প্রতি পূর্নিমায়।

সেদিন থেকেই তার চাঁদের উপর অভিমান!
সেদিন কেন অমন চাঁদ উঠলো। কেনই বা সে চাঁদ দেখতে ছাদে গেল?তারচেয়ে বরং যদি অমাবস্যা হতো তাহলে তাকে লোকটা দেখতে পেত না।সে হয়ত যেতই না ছাদে।

বাসার সবাই ভাবে সে পূর্নিমাতে ভুতের ভয় পায়।ভয় সে অবশ্যই পায় তবে তা ভুতের চেয়েও ভয়ানক কিছুর।
লোকটিকে পরেও দুই তিনবার দেখেছে অদিতি কিশোরী বয়েসে তবে দূর থেকে।বয়স বেড়েছে লোকটির, বিয়ে করেছে সে,দুটো বাচ্চাও নাকি হয়েছে শুনেছে সে ।একবার সামনে পড়ে গিয়েছিল সে তখন চোরা চোখে দেখছিল পঞ্চদশী অদিতিকে লোকটা।অদিতি হিসাব করে, সেই রাতে লোকটির বয়স অবশ্যই ত্রিশের কাছাকাছি ছিল।অলস বেকার যুবক।বিয়ে বাড়িতে এটা ওটা কাজ করে সামাজিক কাজে শরীক হতে এসেছিল।ছোটোদের সাথেও খুব ভাব ছিল তার। তাদেরকে নানা নতুন খেলা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিত।আগের বিকেলেও বাজার থেকে জিলিপি এনে খাইয়েছিল লোকটি তাদেরকে।

পৃথিবীটা অদ্ভুত! লোকটি চমৎকার সংসার জীবন পেয়েছে কিন্ত অদিতির ভাগে পড়েছে দুঃসহ স্মৃতি। জ্যোৎস্না আটকে সে স্মৃতিগুলোকে চেপে রাখতে চেষ্টা করে।সবাই জানে সে ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকে।তার কোনো বন্ধু নেই,কাওকেই সে কাছে ভিড়তে দেয় না।


অদিতির ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে এবার।এবারের পূর্নিমা বুঝি কোনো বাধা মানবে না।দরজা, জানালার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে আলো আসছে।অদিতি লুকাতে পারছে না জ্যোৎস্না থেকে।আজ সেই দুঃসহ স্মৃতি থেকে তার নিস্তার নেই।এমন সময় নিচ থেকে গান ভেসে আসে--

'অবাক চাঁদের আলোয় দেখ,
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিস্পাপ মুখখানি
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
ভাবিনি কভু সেই মায়া তো আমার তরে নয়--'

অদিতি কান পেতে গানটি শোনে।খুব ভাল লাগে তার।সমস্ত মনোযোগ তার গানের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়।মনের মধ্যে ধেয়ে আসা অন্ধকারটা থেমে যায়--

সত্যি কি পুরুষ মানুষ হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে পারে?যারা এমন দরদ দিয়ে গান বাঁধে তারা কি এই পৃথিবীর বাসিন্দা?
এতবছর পর হঠাৎ তার ইচ্ছা হয় অপার্থিব জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে।কিন্ত একরাশ ভয় তাকে আঁকড়ে ধরে।সে কি আর কখনো নিজে নিজে পূর্নিমা দেখতে পারবে?

অদিতির জীবনে কি এমন কেউ আসবে যে বন্ধ দরজা খুলে মাঝরাতে তাকে জ্যোৎস্না স্নানে নিয়ে যাবে।নীলচে পেলব আলোয় কালিমাহীন নয়নে তার দিকে তাকাবে,পরম মমতায় তাকে আগলে রাখবে সমস্ত ছায়া থেকে।


ছবিঃইন্টারনেট

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:০০

ফুয়াদের বাপ বলেছেন: কষ্টের কাব্য পড়লাম পুরো লেখা জুড়ে। সমাজের খুব কঠিন তিক্ত বাস্তবতা তুলে ধরেছেন ক্ষুরধার লেখনীতে। গল্পটা পড়তে পড়তে একপর্যায়ে এসে গলাটা কেমন যেনো জমাট বেঁধে যাচ্ছিল কষ্টে। এমন কিছু নরপশুদের জন্যই সমাজ এতো কুলশিত। অদিতিরা বুকে কষ্ট লালন করে আজীবন।

গোলাপতোড়া শুভেচ্ছা এমন সুন্দর গল্পের জন্য।

২৩ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:১১

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: হ্যাঁ এই সমাজে অদিতিদের সংখ্যাটা অসম্ভব বেশি।

সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

২| ২৩ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৯:৫৭

হাবিব বলেছেন: না পড়েই মন্তব্য করলাম

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.