নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগের পর্ব
ষোল
রাত গভীর হয়েছে অনেক আগেই। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে শ্রাবনী চিন্তা করছে গলায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে এখান থেকে ঝুলে পড়লে কি খুব কষ্ট হবে?এখন যে কষ্টটা সে ভোগ করছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট নিশ্চয় লাগবে না।মৃত্যু হলে এই পার্থিব জীবন থেকে মুক্তি।এই মুক্তিতেও প্রশান্তি আছে।কয়েকটি ঘুমের ঔষধ জোগাড় করলে কি ব্যাপারটা সহজ হবে?নিজের জীবন নিলে নাকি পরকালে শাস্তি পেতে হয়।হোক!পার্থিব বা অপার্থিব কোনো জীবনই তাকে আর আকৃষ্ট করেনা।সে শুধু মুক্তি পেতে চায়।
এই পৃথিবী আর তার সকল মানুষ থেকে সে দূরে যেতে চায়।তার জীবনের গতিপথ যত কঠিনই হোক সে বার বার উঠে দাঁড়িয়েছে।কিন্ত মানুষের কারনে সে পদে পদে যত কষ্ট পেয়েছে তা আর কিছুতেই পায়নি।সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে তার আপন মানুষগুলোর কাছে।কেমন একটা অশুভ চক্রের মধ্যে যেন পড়ে গেছে সে।শত চেষ্টা করেও যেখান থেকে সে বের হতে পারছে না।
মাঝে মাঝে মনে হয় চারিদিকের পৃথিবী দেয়ালের মত তার দিকে চেপে আসছে।এতটা একা হয়ে পড়েছে সে যে মনেহয় অথৈ সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপে সে একা দাঁড়িয়ে আছে।কোথাও কেও নেই, কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।এতটা অসহায় শ্রাবণীর আগে কখনো লাগেনি।
তার স্বাভাবিক জীবনের গতি রূদ্ধ হয়ে আছে।না সে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। না সে বর্তমান অবস্থা মেনে নিতে পারে।সিদ্ধান্তহীনতার দোদুল্যমান অবস্থা,একাকি এ জীবনে আরো বেশি একা হয়ে যাওয়ার ভয়, সবার শেষে উচ্ছিষ্টের মত পড়ে থাকার ভয় থেকে থেকে তাকে পাগল করে দেয়।ভরসা করার মত একটি হাত,আর দুঃখ উজাড় করে কাঁদবার জন্য একটি কাঁধ তার খুবই দরকার।মায়ের কাছে যে পরম আশ্রয় আছে তার ছায়াতলে যেতে সে দ্বিধা করেনা।তবুও এমন অনেক কথা থাকে যা মাকে বলা যায় না।কিছুকিছু আশ্রয় শুধুমাত্র সঙ্গীই দিতে পারে।শ্রাবণীর সঙ্গী আছে কিন্ত সেই আশ্রয় নেই।
আজকাল মনেহয় সবার কাছেই সে অপরাধী। নিজের জীবনের দূর্দশার জন্যও সে দায়ী। তার মায়ের বাড়ির আত্মীয়দের সেই আদর যত্ন আজ কোথায়?সে যে একাএকা প্রায় দুইটা বছর একটা বাসায় কাটিয়ে দিলো সে ব্যাপারে তাদের যেন খেয়ালই নেই।তার বাবার দিকের আত্মীয়রা তো চায়ই না শ্রাবণীর ভালো কিছু হোক।এত সংগ্রাম করে মেয়েকে যোগ্য করে গড়ার পরও তাকে সঠিক সঙ্গী জোগাড় করে দিতে না পারার কষ্টে তার মা ই খালি মনে মনে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন।নিষ্ঠুর সমাজ তাকে সাহায্য না করে বরং অত্যাচার করে।শ্রাবণীর মায়ের কষ্টও তার বুকে শেলের মত বেধে!সামনে যেন আর কিছুই দেখতে পায়না সে নিকশ কালো অন্ধকার ছাড়া।
তার মনের ভেতরের হাসি আনন্দের জায়গাটুকু ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে।হতাশা আর বিসন্নতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে সে।গভীর রাতে মাঝে মাঝে মনে হয় যদি একটা কবর খুঁড়ে তার ভেতরে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারত তাহলে হয়ত একটু প্রশান্তি পাওয়া যেত।
সত্যিকার অর্থেই মাঝে মাঝেই রাতে গভীর কষ্টে থাকলে সে কল্পনা করে যে কবরে শুয়ে আছে।পার্থিব জীবন শেষ করা নিয়ে যদি এত কঠিন নিষেধাজ্ঞা না থাকত তবে সে হয়ত এই মুহুর্তেই সেটা করে ফেলতো।তবে সেটা বড় কারন নয়।বড় কারন শ্রাবণীর মা। শ্রাবণী যদি হঠাৎ কোনো কারনে মারা যায়,শায়লা বেগম খুবই আঘাত পাবেন।তবে এক সময় হয়ত নিজেকে বুঝ দিতে পারবেন,শ্রাবনীর পরকালের জন্য দোয়া করে কষ্ট লাঘব করতে পারবেন।কিন্ত শ্রাবনী যদি আত্মহত্যা করে তবে তিনি কোনোমতেই তা মেনে নিতে পারবেন না। সন্তান হারানোর কষ্ট থেকেও বড় হয়ে উঠবে তার পরকাল হারানোর কষ্ট।এই কথাগুলো ভেবে ভেবেই শ্রাবণী বারবার পিছিয়ে এসেছে।
কিন্ত মাকে ভাল সে রাখতে পারছে কই? সে কি নিজেই ভাল থাকতে পারছে?শ্রাবণীর স্বাধীন জীবনের শুরুটা হয়েছে কেবল।এই মুহুর্তে তার জীবনের প্রতি এত বিকর্ষণ তৈরি হওয়ার কথা নয়।কিন্ত সেটাই হয়েছে।তার বুকের মধ্যের সুখ আর আনন্দের ঝর্ণাধারাটা শুকিয়ে যাচ্ছে।নাহ! শুধু তুষার নয়,তার বন্ধুরা নয়,সহকর্মীরা নয়,আসেপাশের নিষ্ঠুর মানুষ বা আত্মীয়রা নয়।এদের কারও জন্যেই জীবন শেষ করে দিতে হবে তা নয়।কিন্ত এরা সবাই মিলে শ্রাবণীর জীবনটা এতটা বিষিয়ে তুলেছে যে সবকিছু আজকাল অর্থহীন মনে হয়।শ্রাবণী ইচ্ছা করে নিজের জীবন থেকেই পালিয়ে যেতে।না, এটা টিনএজ ছেলেমেয়েদের ছোটখাটো অভিমানের মত কিছু নয়।এর ব্যাপ্তি এতটাই গভীর যে কেউ তার মনের গহীনে দৃষ্টিপাত করলে চমকে উঠবে।রাগ,ঘৃণা, অভিমান,কষ্ট, বিসন্নতা আর হতাশার মিশেলে তার বুকের মধ্যে সূর্যের মত জ্বলন্ত কিন্ত বরফের মত ঠান্ডা এক অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছে।যা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়না বরং বুকের ভেতরে চেপে বসে অনবরত পোড়াতে থাকে।শ্রাবণী মাঝেমধ্যে ভাবে এটাই কি জাহান্নাম? সে কি করেছে যে জীবিত থেকেই জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করছে?
একজনকে মন থেকে ভালোবাসার কি এই শাস্তি?
তবে আজ যে ঘটনাটি ঘটলো তার পর থেকে তার কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছে যে তুষার সত্যিকার অর্থে তার কথা ভাবে না।সত্যিকারের ভালোবাসা বা দরদ শ্রাবণীর জন্য তার নেই।সে যে ঘুরেফিরে বারবার আসে এটা হয় তার স্বভাব নয়ত তার বহুদিনের অভ্যাস! ভালোবাসা নয়।
শান্তনা বা আশা দেখিয়ে কোনো কথা তুষার শ্রাবণীকে বলে না।মন খারাপ লাগলে যখন তার কাছে শ্রাবণী আশ্রয় নিতে চায় তখন আশ্রয় দেয়ার বদলে অবান্তর কথাই সে বলে বেশি।মানুষের মন বোঝা আর তার কদর করা বিষয়টা যেন তুষারের মধ্যেই নেই।
আজ রাতে শ্রাবণীর মনটা বেশিই খারাপ ছিল।স্কুল জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, যে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে।তার মা শ্রাবণীর মায়ের কাছে কথাটি বলতে এসে খুব গর্ব করে গেছে।যাদের সাথে সে ঘুরাফেরা করত তাদের প্রায় সকলেই বিয়েশাদি করে সংসারী হয়েছে আগেই।এই বান্ধবীটি বাকি ছিল।এখন শুধু বাকি থাকলো সে।আর তার কি হবে,কিভাবে হবে তার কোনো ঠিক নেই।সন্ধ্যা থেকে মনটা ভার হয়ে ছিল।মেসেঞ্জারে ক্যাম্পাস লাইফের এক বান্ধবী জানালো সে সন্তানসম্ভবা।
খবরগুলো খুশির এতে কোনো সন্দেহ নেই।শ্রাবনী খুশিও হয়েছে অনেক।কিন্ত জীবনের এই অধ্যায়ে অন্যদের জীবনপথে এগিয়ে যাওয়ার খবরটা নিজের অসম্পূর্ণতার কথাটি বারবার মনে করিয়ে দেয়।ক্যাম্পাসের বান্ধবীটির খুব আফসোস ছিল যে জীবনে কোনো ছেলে তাকে প্রেম নিবেদন করেনি।অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠে কিভাবে যেন একটি ছেলের সাথে তার পরিচয় হলো।দুই তিন বছর সম্পর্কের পর সেই ছেলেটিকেই সে বিয়ে করেছে।শুরুতে বাবা মা রাজি ছিলনা।দুজনে মিলে তাদের রাজি করিয়েছে।দুজনেই ভাল আয় করে।ঢাকা শহরে থাকে।যে বান্ধবীটি বাচ্চাকাচ্চা একদম পছন্দ করতো না সে আজ মা হতে যাচ্ছে!
আর শ্রাবনীর প্রায় পাঁচ বছরের চেনাজানার সম্পর্ক, কত ঝড়ঝাপটা পেড়িয়ে আজও টিকে আছে!কিন্ত তার কোনো ভবিষ্যৎ আছে কিনা শ্রাবণী তাও জানে না।আশা করে করে হতাশ হতে হতে সে আজ ভেঙে পড়েছে।হঠাৎ করেই তার মনে হলো অনেকে বলে বিয়েতে দেরি হলে মেয়েদের বাচ্চা হতে সমস্যা হয়!তার যদি বাচ্চা না হয়!অশুভ চিন্তায় তার বুকের মধ্যে যেন কেউ সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরল।ভয় আর কষ্টে শ্রাবণী একাএকাই ছটফট করতে থাকলো!
কিছু পরে তুষার তাকে ফোন দিলে একপর্যায়ে শ্রাবণী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি-তার আশংকার কথা বলতে বলতে কেঁদে আকুল হয়েছে।তুষার কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনে তাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠেছে- 'বয়ফ্রেন্ড ফোন দিলে অন্যদের গার্লফ্রেন্ড কি নিয়ে কথা বলে আর তুমি কি নিয়ে কথা বল কখনো ভেবে দেখেছ?'
শ্রাবণী হতভম্ব হয়ে যায়।সে তুষারের বহু বহু নিষ্ঠুর কথা শুনেছে তবে আজ যা শুনলো তা যেন অন্যগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে! এত সেনসিটিভ ব্যাপার নিয়ে যখন একটা মেয়ে দুঃখ করে তখন তাকে শান্তনা দেয়ার কথা।দু একটা আশার কথা শোনানোর কথা।তার বদলে এ কি অপ্রাসঙ্গিক কথা বললো তুষার!আজকাল তো অভিমানে নিজের খারাপ অনুভূতির প্রায় কিছুই শেয়ার করেনা সে তুষারের সাথে।
শ্রাবণী কি তবে তুষারের জন্য এন্টারটেইনমেন্ট আইটেম?শুধু একটু কথা বলা আর সঙ্গ পাওয়ার উপকরণ?অনেক কষ্ট করেই তো শ্রাবণী নিজের জীবন গড়েছে।একটা শক্ত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে নিজের যোগ্যতায়।শুধু তুষারের জন্যেই তার জীবনের মুখ্য একটা অধ্যায়ের সূচনা হয়নি এখনো।তার ভালোবাসার আর অপেক্ষার বদলে মন খারাপের সময় যদি একটা কোমল কথা শুনতে না পায় তবে কিসের জন্য এই সম্পর্ক ধরে রাখা?তুষারের কারনে সে নিজে তো কষ্ট পাচ্ছেই তার মাও কষ্ট পাচ্ছে। এতকিছু কার জন্য?যার শ্রাবণীর প্রতি এতটুকু মায়া নেই তার জন্য?
যেটুকু বল দুই বছর আগে তুষারের বাবার কথা জানার পরে শ্রাবণী জোগাড় করতে পারেনি,তুষারের আজকের দুর্ব্যবহার তাকে সেই বলটুকু এনে দিল।তুষার সাথে যাপিত জীবনের সমস্ত স্মৃতি তার জন্য শ্রাবণীর বুকের ভেতরে জমানো সমস্ত মায়া ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেললো শেষ রাতের দিকে।সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর শ্রাবণীর একটা গভীর ঘুম হলো।এমন শান্তির ঘুম সে অনেকদিন ঘুমায়নি।
চলবে--
১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:০০
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আমন্ত্রণ রইলো --
২| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪১
রাজীব নুর বলেছেন: সব মানুষের জীবনের মৃত্যু চিন্তা আসে। আত্মহত্যার চিন্তা আসে।
শ্রাবনীর মধ্যেও এসেছে। এটা বয়সের দোষ।
১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৫৮
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: সবারই আসে?
৩| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৬
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন:
"দুষ্টু গরু থেকে শূণ্য গোয়াল অনেক ভাল" - অন্তত লাথি খাওয়ার ভয় থাকেনা।
আরও অনেক আগেই শ্রাবণীর তুষারকে ত্যাগ করা উচিত ছিল।এতে সে অন্য কাউকে,অন্যভাবে জীবনকে নিয়ে ভাবতে পারত ।সামনে এগোতে পারত।
আর একা একা একাকি জীবন আসলে একটা মাুনুষের পক্ষে একটা সময় কাটানো মুশকিল হয়ে যায় তা সে নারী-পুরুষ যেই হোকনা কেন।তবে পুরুষ থেকে নারীদের এক্ষেত্রে বেশী সমস্যা পোহাতে হয় ,এটা সত্য।
১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৩:৫৪
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: দারুন পর্যবেক্ষণ!!
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ! আগামী পর্বে আমন্ত্রণ রইল
৪| ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৪৫
মনিরা সুলতানা বলেছেন: আমন্ত্রণ গ্রহণ করে এ পর্যন্ত চলে আসলাম।
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:২১
মনিরা সুলতানা বলেছেন: এত সুন্দর একটা শিরোনাম !!
আশা করছি সময় নিয়ে পড়ে ফেলবো।