নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগের পর্ব
সাত
দীর্ঘ দুই মাস সাত দিন পর শ্রাবণী আবার ক্যাম্পাসে ফিরে আসল।এই দুটি মাসে কত কিই না ঘটে গেছে তার জীবনে।টানা বাইশ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে।এর মাঝে দুই তিন দিন আইসিইউ তেও ভর্তি ছিল সে।অসহ্য যন্ত্রণা, ঔষধ ইঞ্জেকশন আর ডাক্তারের ছুরিকাঁচির নিচে কাটাতে হয়ে অনেকগুলো সময়।একহাতে স্যালাইন আর অন্য হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে এতটাই অসহায় অবস্থা ছিল শুরুর দিকে যে ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য আয়ার হাতে নিজেকে শিশুর মত সমর্পণ করতে হয়েছে।শ্রাবণী মনে মনে বেশ শক্ত মেয়ে তাই এতকিছুতেও ভেঙে পরেনি।
হাসপাতাল, সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ছয় ছিটের ছোট্ট ওয়ার্ডের রোগীদের একেকজনের একেক রকম জীবনের গল্প।কত বিচিত্র মানুষই না আছে পৃথিবীতে!পরিবারের সদস্যরা পালা করে শ্রাবণীর কাছে থাকে।মাঝে মাঝে কাছের বন্ধুদের দু একজন তাকে দেখতে আসে,কিছুক্ষণ থেকে তাকে সাহস দিয়ে যায়।এরই মাঝে একদিন তুষার তাকে দেখতে গেল। তুষারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল,ভাইভা দিয়েই সেই পোষাকে চলে এসেছে।বেশ স্মার্ট লাগছিল তাকে।অনেকদিন পর দেখা তাই শ্রাবণী অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তাকে।তার আত্মীয়রা কাছেই ছিল।তারাও দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দুজনকে নিরীক্ষণ করে চলছিল।হয়ত কিছু আঁচ করতে পেরেছিল!কে জানে?ফোনে কথা বা মেসেজ দিয়ে যোগাযোগ তাদের প্রায়ই হয় তাছাড়া এতগুলো চোখের সামনে ইচ্ছা মত কথা বলা যায় না তাই কিছু সময় কাটিয়েই তুষার উঠে গিয়েছিল।যাওয়ার আগে নানা রকমের চকলেটে ভর্তি একটা প্যাকেট শ্রাবণীর হাতে দিতে ভোলেনি।
রাত্রি গভীর হলে যখন ওয়ার্ডের সবাই ঘুমিয়ে যেত তখন মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে শ্রাবনী চিন্তা করত।এই এক্সিডেন্ট তার জীবন থেকে অনেক কিছুই নিয়ে গেল।তার হলুদাভ মস্রিন ত্বকের সৌন্দর্য হারিয়ে গেল চিরতরে! ডান হাতের চামড়ায় কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত যে দাগ হয়েছে তা নাকি কমে যাবে ধীরে ধীরে কিন্ত মিলিয়ে যাবে কি?কাঁচের চুড়ি বা মেহেদীর রং কি আগের মত ফুটে উঠবে এই হাতে?হাতের কথা নাহয় বাদ গেল পেটের ডান পাশে যে গভীর ক্ষত হয়েছিল সেখানে সেলায়ের দাগ।দাগ হয়েছে বুকের এক পাশেও।ডাক্তাররা প্লাস্টিক সার্জারি করে ক্ষতের গভীরতা ভরাট করার চেষ্টা করেছেন।তাতে তাঁরা সফল হলেও নানা আকার প্রকারের দাগে দাগে ভরে আছে ক্ষতগুলো।মাখনের মত নরম চামড়া মোড়ানো পেট ছিল শ্রাবণীর।শাড়ি পড়াতে গিয়ে একবার তার এক বান্ধবী তাকে বলেছিল তোর এই অংশটা এত সুন্দর যে চোখ ঝলসে যায়!সেই সুন্দর শরীরটি আজ জোড়াতালি কাটাকুটিতে ভরা।ডাক্তাররা শ্রাবণীর পা থেকে কিছু চামড়া নিয়ে ক্ষত ভরাটের কাজ করেছেন।দুই মাস কেটে যাওয়ার পর মূল ড্যামেজ অংশের চেয়েও পায়ের চেহারা হয়েছে ভয়াবহ।সিনেমায় না হয় গাঁজাখুরি জিনিস দেখায়,শাবনুর প্লাস্টিক সার্জারি করে মৌসুমী হয়ে যায়।কিন্ত তাই বলে বাস্তবে ব্যাপারটা কি এত খারাপ হবে?বাইরের দেশগুলোতে তো সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এধরণের অপারেশন করে,তাদের তো এমন বিচিত্র দাগ হয়না!
শ্রাবনী জানে মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্যের মূল্য সমাজে কত।সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য লোকে কি না করে।আর খোদা প্রদত্ত সৌন্দর্য এভাবে নষ্ট হয়ে গেলে তার জীবনে এর গভীর প্রভাব পড়বে।বেশির ভাগ ছেলেই মেয়েদের মনের সৌন্দর্যটা কেন যেন দেখতে পায় না। তাদের কাছে শরীরটাই আসল।শরীরে এমন খুঁত থাকলে এরেঞ্জ ম্যারেজ হতে সমস্যা হবে।যদিও এখন তার এরেঞ্জ ম্যারেজের ইচ্ছা নেই।দেখা যাক তুষার কি করে।সে তো সব জানে।সে কি এই জন্য শ্রাবনীকে ছেড়ে যাবে? তার ভাব দেখে এতদিনে তো এটা মনে হয়নি।তবে যাই ঘটুক শ্রাবণী তা মেনে নেবে।এক্সিডেন্টের পরপরই যখন সবাই তাকে টেনে তুলছিল,জ্ঞান হারানোর আগে সে মনে মনে বলেছিল- 'হে খোদা তুমি আমাকে এক কঠিন অবস্থার মধ্যে ফেলেছ কিন্ত আমি এ নিয়ে কোনো আফসোস করবো না।আমি সবকিছুই মেনে নিলাম'
বাস্তবে শ্রাবণী করেছেও তাই। ব্যাথার কারণে লুকিয়ে যা একটু কেঁদেছে,মনের কষ্টে সে কাদেনি।রাত গভীর হলে প্রার্থনায় বার বার বলেছে- 'হে খোদা তুমি আমাকে ধৈর্য্য দাও,সহ্যশক্তি দাও'।
শ্রাবণী তার মায়ের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে সাহস দিয়েছে।সবাই জানে সে তো অল্পের জন্য মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচেছে।একটুখানি এদিক ওদিক হলে তাকে মাটির নিচে চির নিদ্রায় শায়িত হতে হতো!কিংবা যদি মূল আঘাতটা তার চেহারা উপর দিয়ে যেত তাহলে কি হতো?শ্রাবণী শিউরে ওঠে!চেহারা সে যেমনি হোক সেটা একটা মানুষের আইডেনটিটি,চেহারা হারানো টা তার কাছে খুবই ভয়ের।এসিড সারভাইভার মেয়েগুলো কি প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকে!প্রতিবার আয়না দেখে সে নিজেকে চিনতে পারেনা।প্রতিবার সেই জঘন্য অন্যায় ঘটনার মুহূর্তটা মনে পড়ে যায়।ইশ!কি কষ্ট! কয়েক বছরের জেল বা ফাঁসি কি এই প্রচন্ড অবিচারের সত্যিকার প্রতিদান দিতে পারে?সে হিসাবে শ্রাবণীকে ভাগ্যবতীই বলতে হয়।
দুইমাস পর হলে ফিরে শ্রাবণী লক্ষ্য করল অনেককিছুই যেন বদলে গেছে।হল সুপার তাকে দেখে প্রায় দৌড়ে এসে বলল-' শ্রাবণী তুমি যে এতটা অসুস্থ ছিলে তা তো আমি জানতাম না।তোমার ক্লাসমেটদের জিগাসা করেছিলাম তারা বলল তেমন বড় কিছু হয়নি।এক্সিডেন্টের পর হলেও নিয়ে আসেনি তোমাকে তাই আমরা বুঝতে পারিনি।আগে জানলে খোঁজ খবর নিতাম'। হল সুপারের কথা শুনে শ্রাবনী খুব অবাক হলেও স্মিত হেসে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে।এই জন্যেই হয়ত তার ভাল বান্ধবীরাও তেমন করে তার খোঁজ নেয়নি।
রুমে এসে প্রথম প্রথম শ্রাবণীর খুব কষ্ট হতে লাগল।এখানে সব কাজই তো নিজেকে করতে হয়।সে তো কেবল আশিভাগ সুস্থ হয়েছে।অনার্স ফাইনাল শুরু হবে কিছুদিন পর এজন্যেই সে হলে ফিরেছে।তার কথা মাথায় রেখেই স্যাররা পরীক্ষার ডেট দেরি করে ফেলেছেন।সে একটু একটু পড়াশোনার চেষ্টাও করতে লাগল কিন্ত কিছুতেই ঠিক মন বসেনা।প্রাত্যহিক প্রায় সব কাজ করতেই কষ্ট হয়।মনে হয় কাছের কেউ যদি একটু সাহায্য করত!মাঝেমাঝে রুমমেট আপুকে সে অনুরোধ করে কিছু একটা করে দেয়ার।তবুও সিনিয়র আপুকে আর কতটা বলা যায়?বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টের হয় পরীক্ষা চলছে নয়ত পরীক্ষা শেষ।শ্রাবণীর হলের বন্ধুরা বেশিরভাগই বাড়ি গিয়েছে পরীক্ষা শেষে।তাই কাছে সে কাওকেই পায় না।
শ্রাবণী হলে যাওয়ার পরপরই অনেকে তাকে দেখতে আসত।অনেকেরই মুখচেনা,কিন্ত কথা হয়নি আগে।তারাও কুশল জিজ্ঞাসা করত কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে শ্রাবনীর যে ছয়জন ক্লাসমেট তার সাথে একই হলে থাকত তারা কেউ তাকে দেখতে আসেনি,এমনকি এতদিনে একটা ফোনও দেয়নি।শ্রাবণীদের ক্লাসে ভাগাভাগি বা দ্বন্দ্ব আছে কিন্ত তার সাথে কারো শত্রুতা নেই,সে কোনো পক্ষেরই সাপোর্টার না।তবে এমনটা তারা কেন করছে শ্রাবণী বুঝতে পারেনা।
শ্রাবণী লোকমুখে শুনেছে এরাই সর্বত্র বলেছে যে তার তেমন সিরিয়াস কোনো সমস্যা হয়নি।পরিবারের লোকজন একটু বেশি বেশি পন্ডিত তাই প্রাইভেট হাসপাতালে এতদিন ভর্তি করে রেখেছে।ঘটনাস্থলের কাছে তার ক্লাসমেটরাই ছিল তাই সবাই তাদের কথা বিশ্বাস করেছে।আসলে ক্যাম্পাসের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার সময় অনভিজ্ঞ মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট বলেছিল আঘাত তেমন গুরুতর নয়।ঠিক হয়ে যাবে।এরা হয়ত সেই কথাই প্রচার করেছে।কিন্ত তা কিভাবে হয়!ভাল হাসপাতালে ভর্তির পর ডিপার্টমেন্টের স্যাররা তার ও বাড়ির সদস্যদের সাথে কথা বলেছেন।ক্লাসমেটরা ফোন করেছে,কেউ কেউ হাসপাতালে দেখতেও গিয়েছে।সবাই সবকিছু জানে তবে কেন এই নিদারুণ মিথ্যাচারিতা?
সবচেয়ে কষ্ট হয় তার কামরুনের কথা ভেবে। হলের ক্লাসমেটদের মধ্যে তার সাথেই শ্রাবণীর সবচেয়ে আন্তরিক সম্পর্ক। সে এমন একজন মানুষ যে সহজের যে কারো সাথে মিশতে পারে।তাকে দেখলেই কেন জানি স্নেহ করতে ইচ্ছা হয়।রাত বারোটা বা একটা যাই বাজুক মন খারাপ হলে কামরুন দোতলা থেকে তিনতলায় শ্রাবণীর রুমে চলে আসত।যত কাজই থাক বা যত ঘুমই পাক সে কামরুনকে সময় দিত।দুজন মিলে মাঝে মাঝে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো ছন্নছাড়ার মত।সেই কামরুন একবার তাকে দেখতেও এল না?প্রথম কিছুদিন বাথরুমে যেতে শ্রাবণীর খুব ভয় হতো,মনে হতো হয়ত উঠে দাঁড়াতে পারবে না।পেটের ক্ষত উপরে শুকিয়ে গেলেও ভেতরে তখনও কাঁচা।বেকায়দা লাগলে ব্যাথা হয়।ইশ!এইসময় কামরুন যদি ওকে একটু সাহায্য করত!কিন্ত যে তাকে একবার দেখতে আসেনি,কেমন আছে জিজ্ঞাসা করেনি তার কাছে কি সাহায্য চাওয়া যায়?
শ্রাবণী শুনেছে কামরুনের প্রেম হয়েছে।ছেলেটি শ্রাবনীদের ক্লাসমেট এবং বলা যায় শত্রুপক্ষের সদস্য।কয়েকটি ছেলে আর চারজন মেয়েই মূলত তাদের ক্লাসে গন্ডগোল পাকিয়ে তুলেছিল।এই সব ঝামেলায় কোনোপক্ষে না গিয়ে শ্রাবনীর মত কামরুনও নিরপেক্ষ ছিল।এইজন্যেই কি সে শ্রাবনীর সাথে এমন করছে?আচ্ছা প্রেম হয়েছে ভাল কথা,তাই বলে কি মানবতা ভুলে যেতে হবে?
হাসপাতালের দিনগুলো শ্রাবনীকে যতটা কাবু করতে পারেনি বন্ধু আর ক্লাসমেটদের নিষ্ঠুরতা তাকে তারচেয়ে অনেকবেশি কাবু করে ফেলল।সে ঠিক করল এদের নিয়ে আর ভাববে না।এইসময়ে তুষার তাকে খুব সাপোর্ট করে চলছিল।তাকে সঙ্গ দেয়া,তার জন্য বাজার করে দেয়া,মাঝেমাঝে বাইরে থেকে রাতের খাবার এনে দেয়া এইসবই খুব আগ্রহের সাথে করতে লাগলো তুষার।কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রাবনী তুষারের উপর আরও বেশি নির্ভর করতে শুরু করল।বন্ধুদের সাথে সময় না কাটিয়ে তুষারের সাথে কাটাতে লাগল।সে জানত এতটা নির্ভর করা ঠিক নয়।এর পরে ছেলেটি যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তবে তার জন্য বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।তবুও সে এই ঝুঁকিটা নিল।মনে মনে সে তুষারের উপর পুরোপুরি সমর্পিত হয়ে গেল।
চলবে--
০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৩
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: মাঝে মাঝে বড় করে লিখতেই ভাল লাগে।
২| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৯
রাজীব নুর বলেছেন: শ্রাবনী একজন আধুনিক মেয়ে।
০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৩
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: কেন?আধুনিক মেয়ে কেন?
৩| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১:৪৬
সামু পাগলা০০৭ বলেছেন: বিপদের সময়েই কে আপন কে পর বোঝা যায়। তবে শেষের লাইনটি পড়ে মনে হচ্ছে, শ্রাবণীর জন্যে বড়সর দুঃখ অপেক্ষা করে আছে।
অনেক সুন্দর লেখা, চলতে থাকুক.....
০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৪
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আসলেই বিপদে লোকের আসল রূপ চেনা যায়।
৪| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:০৮
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: তারপর?
০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৫
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: তারপর পর্ব সাত---
আমন্ত্রণ রইল
৫| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫১
নেওয়াজ আলি বলেছেন: লেখাটি বেশ ভালো লাগলো
০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৫
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ধন্যবাদ--
©somewhere in net ltd.
১| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৫৮
বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: লেখাটা বেশ ভাল।
আরো ছোট হলে আরো ভাল হতো!
ধন্যবাদ নিন।