নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার কলেজ জীবনের বন্ধু আরিফের আজ বিয়ে।কনে সিলেটের এক স্থানীয় বিরাট বড়লোকের মেয়ে।বিয়ে সেখানেই হবে তাই ভোর থাকতেই আরিফের বাসায় রওনা দিলাম।সেখানে আরো অনেক পুরোনো বন্ধু জুটে গেল।ভরপেট নাস্তা করে বরযাত্রীর সাথে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম।বন্ধুদের সাথে আড্ডা গল্পে পথটা দেখতে দেখতেই কেটে গেল।কনের বাড়িতে পৌঁছে দেখি বিরাট আয়োজন।ধনী বাপের একমাত্র মেয়ের বিয়ে তাই বিয়ে উপলক্ষ্যে কনের বাবা হুলস্থুল ব্যাপার করেছেন।প্রবেশ মুখের আলীশান গেটের বাহার দেখেই আমি ভিমড়ি খেলাম।ভেতরে গিয়ে বসার পরে খাতির যত্নের বাহার দেখে আমার তাক লেগে গেল।বিয়ে হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে তাই সুদৃশ্য টেবিল চেয়ার সাজানো রয়েছে পরিপাটি করে।তাতে বেয়ারারা থরে থরে খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল।কি নেই সেখানে?দু তিন রকমের ঠান্ডা সরবত,হরেক রকম বরফি,সন্দেশ,কেক টিকিয়া,কাবাব আর চার পাঁচ পদের মিষ্টি।এসব ছাড়াও প্লেট ভর্তি কাটা ফল তো আছেই।সুস্বাদু খাবারগুলো গ্রোগ্রাসে গিলতে গিলতে ভাবছিলাম নাস্তা পানিরই যদি এমন অবস্থা হয় আসল খাবারের না জানি কি চেহারা হবে।আরিফ ভালই দাও মেরেছে বলতে হবে।
দুপুরে বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে বরের প্লেটে একবার হামলা চালিয়ে নিয়ে তাকে তার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধুদের জিম্মায় রেখে আমরা চার পাঁচজন মিলে পৃথক একটি টেবিলে বসেছি আসল খাওয়া সারতে।কনের বাবা আয়োজনের চুড়ান্ত করেছেন।কোর্মা-পোলাউ তো আছেই সে সাথে সবার জন্য আস্ত মুরগীর রোস্ট! মুখভর্তি খাবার নিয়ে চিবুতে চিবুতে মুনির বলল,শালা আরিফের তো ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়ে গেল রে।কি মাল পটিয়েছে দেখেছিস?শফিক বলল,তা আর বলতে।এমন শশুরের কাছ থেকে কত কিছু যৌতুক পাবে এটা ভেবেই আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।রঞ্জু বললো,ঢাকায় একটা ফ্লাট নাকি এর মধ্যেই সাজানো হয়ে গেছে।আজকালের মধ্যেই গাড়িটাও দিয়ে দেবে।সুজন বলল,বিয়ে করার সময় আমি এমন মাল দেখেই বিয়ে করবো।শফিক বলে উঠল,অমন মাল বুঝি আপনা আপনিই পটবে?তুই ব্যাটা কি ওর মত ইঞ্জিনিয়ার?সুজন বলল,তোর নিজের আর বিয়ে করার সুযোগ নেই বলে আমাদের তুই এসব বলছিস।সুজন আর শফিক এ নিয়ে বেশ একটা তর্ক করতে শুরু করল।রঞ্জু নতুন ব্যবসা শুরু করেছে,সে বলল,না রে দোস্ত এমন একটা শশুর থাকলে আমার আর ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করতে হতো না।
আমরা যে টেবিলে বসেছিলাম সে টেবিলে আর একজন ভদ্রলোক বসেছিলেন।আমি অনেকক্ষন থেকেই খেয়াল করছিলাম তিনি কোর্মা-পোলাউ গলাধকরন করতে করতে বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের কথা শুনছেন এবং মিটিমিটি হাসছেন। রঞ্জুর কথা শুনে তিনি নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন,কেন বাপু এত শশুরের সম্পত্তির দিকে চোখ?নিজের ক্ষমতায় যা আছে তা দিয়েই কিছু করোনা।আমরা সকলেই ঘুরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।বেশ মোটাসোটা মানুষ।গায়ের রঙ ফর্সা,মুখে চাপ দাড়ি তার কিছু পাকা আর কিছু কাঁচা।মাথার চুল বেশ পাতলা হয়ে টাক উঁকি দিচ্ছে।বিস্কিট কালারের একটা পাঞ্জাবি তার গায়ে,বয়স মনে হলো পঞ্চান্ন কিংবা ষাটের ভেতরে হতে পারে।তিনি অবশ্য আমাদের দৃষ্টিকে পুরো উপেক্ষা করে একমনে মুরগির রোস্ট চিবিয়ে যেতে লাগলেন।আমরাও আবার খাওয়ায় মন দিলাম।
খাওয়ার পরে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে আর নবদম্পতির সাথে ঠাট্টা-ফাজালামি করে বেশ ভাল একটা সময় কাটালাম।এরপরে ফেরার পালা।বর যাত্রীর সাথেই ফেরা যেত কিন্ত শুনলাম বাসর হবে মেয়ের বাড়িতে।কনের বাবা অন্যসব বরযাত্রীদের জন্যেও থাকার ব্যবস্থা করেছেন।এমন অদ্ভুত নিয়ম শুনে হতবাক হয়ে গেলেও উপায় নেই,রাতের মধ্যেই ঢাকায় ফিরতে হবে কারন আমাদের সকলকেই সকালে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে হবে।বিদায় নিয়ে যখন বাইরে বের হয়েছি তখন আকাশ কালো করে মেঘ জমেছে,মনে হচ্ছে যেন যখন তখন বৃষ্টি নামবে।বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত কোনোমতে পৌঁছাতে পারলাম তারপর আর শেষরক্ষা হলোনা অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল।মাথা বাঁচিয়ে কোনোমতে নড়বড়ে যাত্রীছাউনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।বাসস্ট্যান্ডটা একেবারেই যাচ্ছেতাই ধরনের।ছোট্ট একটা কাউন্টার,তার পাশে বাঁশের খুটিতে টিনের ছাউনি কোনোমতে টিকে আছে,তার নিচে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ যদিও বৃষ্টির ছাঁটে সেগুলো ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে।পাঞ্জাবি নষ্ট হওয়ার ভয়ে কেউ সেখানে বসলাম না কিন্ত বৃষ্টির থামার কোনো নামগন্ধই নেই বরং আরো চেপে আসছে। এদিকে ছাউনির শতছিদ্রযুক্ত টিনের চাল দিয়ে এমন হারে পানি পড়া শুরু হয়েছে যে এমনিতেও ভিজতে হচ্ছে তার উপর ভয় হচ্ছে পানির চাপ সহ্য করতে না পেরে গোটা চালটাই না আমাদের ঘাড়ে ভেঙ্গে পড়ে।কাউন্টারের লোকটাকে সেকথা জানালে সে পরামর্শ দিল বাসে গিয়ে বসার।অগত্যা তার ভাঙ্গা ছাতাটা ধার নিয়ে সবাই একে একে কাছেই দাঁড়ানো বাসটাতে গিয়ে উঠলাম।
বাসে উঠে রুমাল দিয়ে মাথা মুছে সবাই আধাভেজা পাঞ্জাবি খুলে মেলে দিয়ে বেশ আরাম করে বসলাম।বাস ছাড়তে দেরি হবে তবে সময়টা বন্ধুদের সাথে ভালই কাটবে বলে মনে হচ্ছিল।হঠাতই খেয়াল করলাম বাসের পেছনের দিকে একজন যাত্রী আছেন এবং তিনি আর কেউ নন বিয়ে বাড়ির সেই ভদ্রলোক।তিনি অবশ্য একমনে পান চিবুতে চিবুতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।আরাম করে বসে আমরা আবার আড্ডায় মেতে উঠলাম।প্রসঙ্গ সেই পুরোনো,আরিফ এবং তার শুশুর।সকলেই এবিষয়ে একমত যে শশুর এত ধনী হলে তার কথায় উঠতে বসতে হতে পারে, এটাকে একরকম বিপদই বলা যায়।আরিফ বউ নিয়ে নিজের বাড়িতেও ফিরতে পারলো না ইত্যাদি নিয়েই কথা হচ্ছিল।লোকটি আবার আগেরবারের মত বলে উঠলেন,তোমাদের বন্ধুর বিপদ কোনো বিপদই না,দিব্বিতো দেখলাম হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আর বিয়ের পরে মোটা অংকের যৌতুক নিলে নিজের ব্যক্তিত্ব কিছুটা হলেও শশুরের কাছে বন্ধক রাখতে হয়।তোমরা যুবক ছেলে নিজের চেষ্টা্য় কিছু করো তাহলেই ভাল থাকতে পারবে।কথাগুলো বলার সময় লোকটার চেহারায় কিছুটা যন্ত্রনার ছাপ দেখলাম।আমি তাকে জিগাসা করলাম,আপনার জীবনে কি এমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে যার কারনে আপনি এসব বলছেন?
আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষন চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে থাকলেন,যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেলেন।তারপর বলে উঠলেন অভিজ্ঞতা একটা আছে কিন্ত সেটা বড় অদ্ভুত,তোমরা চাইলে বলতে পারি কিন্ত শোনার পর তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যুক মনে করতে পারো।শফিক বলে উঠল,এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে অচেনা একজনের মুখে তার জীবনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা শোনার মাঝে একধরনের রোমাঞ্চ আছে,আমরা নাহয় গল্প মনে করেই আপনার কথা শুনব।আমরাও শফিক কে সমর্থন করলাম।পরিচয় পর্ব শেষ হতে জানতে পারলাম ভদ্রলোকের নাম মিজানুর রহমান।তিনি ঢাকায় থাকেন,ব্যবসা করেন।বরের বাবার বিশেষ বন্ধু হন তাই বিয়েতে এসেছিলেন।
গল্পের আকর্ষনে আমরা সবাই ভদ্রলোককে ঘিরে বসলাম।তিনি বলতে শুরু করলেন,আমার বয়স তখন তোমাদের মতই হবে কেবল কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেছি।বাবা অল্প বেতনের কেরানী ছিলেন তার বন্ধুর খবরের কাগজের অফিসে আমার একটা চাকরি হওয়ার কথা ছিল।কিন্ত আমার তখন রক্ত গরম,মাথায় নতুন কিছু করার ইচ্ছা।বাসায় সাফ জানিয়ে দিলাম আমি ব্যবসা করবো।কিন্ত সকলে জিগাসা করল পুঁজি পাব কোথায় কারন বাবার তো সামর্থ নেই একটাকা দিয়ে সাহায্য করার।এই সমস্যারও সমাধান করে ফেললাম এক বন্ধুকে দেখে।সে দিব্বি এক ব্যাবসায়ির একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে পুরো ব্যবসার মালিক হয়ে বসেছে।ঠিক করলাম আমিও বিয়ে করবো আর বিয়ের যৌতুক হবে আমার ব্যবসার পুঁজি।আমারা যেখানে থাকতাম তার পাশের বাড়িতেই একটা মেয়ে ছিল যাকে আমার মা মনে মনে পুত্রবধু ভেবে রেখেছিলেন কিন্ত তার বাবার অবস্থা আমাদের মতই তাই মানা করে দিলাম।আমার মা ভীষন মনক্ষুন্ন হলেন কিন্ত আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড়।অগত্যা কনের খোঁজ হতে লাগল।শর্ত একটাই মোটা অংকের যৌতুক দিতে হবে।অবশেষে দুরসম্পর্কের এক আত্মীয় খবর দিলেন এক মেয়ের কিন্ত সেই মেয়ের বাড়ি বরিশালের এক গহীন গ্রামে।আমার সেই আত্মীয় খুব আগ্রহ করে বললেন তিনি নিজে আমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে কনে দেখিয়ে সব কথা পাকা করে আসবেন এমনকি সুবিধামত বিয়েও পড়িয়ে দেবেন।তখনকার দিনে বরের কনে দেখতে যাওয়া বেপারটার প্রচলন ছিলনা।কিন্ত বাড়ির সবাই আমার উপর ক্ষেপে ছিল বলে তার কেউ সঙ্গে যেতে রাজি হলো না।অন্যকোনো আত্মীয়ও অতদুরে যেতে আগ্রহ দেখাল না।শেষে আমি বলেকয়ে এক বন্ধুকে সঙ্গে যেতে রাজি করালাম।বিয়ের কনের গ্রাম আমার সেই আত্মীয়ের শুশুরবাড়ি।তিনি আগেই চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে সেই গ্রামে যেতে হবে।তিনি সেখানেই থাকবেন,আমার শুধু পথ চিনে সেই পর্যন্ত যেতে হবে বাকি সবকিছুই তিনি করবেন।
নির্দিষ্ট দিনে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখি সে নেতিয়ে পড়ে আছে।আগের রাত থেকেই ডায়রিয়া আর বমিতে সে কাহিল হয়ে গেছে।তার অবস্থা দেখার পর আর কিছু করার ছিলনা অগত্যা আমি একাই রওনা দিলাম।দীর্ঘ লঞ্চ যাত্রা যখন শেষ হলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।সেখান থেকে ঘন্টাখানেক বাসে গিয়ে যেখানে নামলাম সেটা একটা গ্রাম্য বাজার।তখন প্রায় নয়টা বেজ়ে গেছে তাই চারিদিক এরই মধ্যে নিশুতি হয়ে গেছে।দোকানও সব বন্ধ শুধু এক কোনে একটা ছাপড়া দোকানে টিমটিম করে লালচে শিখার কুপিবাতি জ্বলছে।আমি সেই দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারলাম এটা আসলে স্থানীয় কবিরাজের দোকান।যদিও দোকানে তেল,নুন,মশলা সাজানো রয়েছে কিন্ত বেশির ভাগটা জুড়ে নানা আকৃতির বয়ামে হরেক রকম গাছ গাছড়া দোকানের আসল পরিচয় স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে।লালচে আলোয় কেরোসিনের গন্ধমাখা কালো ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে দেখলাম এক বাহাত্তুরে বুড়ো নড়বড় করতে করতে দোকান বন্ধ করা জোগাড় করছেন।আমি তাকে গিয়ে জিগাসা করলাম পরাগপুর গ্রামটা কোন দিকে।সে মোটা চশমার মধ্যে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,এই রাস্তা ধরে মাইলতিনেক গিয়ে পশ্চিমে যে মাঠ পড়বে তা ধরে সোজা চলে গেলেই পড়বে পরাগপুর।তিনি বললেন,আমি নাকি আগেই বাস থেকে নেমে পড়েছি।বাসে করে পরাগপুর বাজারে নামলেই সুবিধা হতো।আমি ভাবলাম কি জানি তা হতেও পারে,কারন আমার আত্মীয় বলে দিয়েছে বাজারে নেমে ভ্যান ধরে কিছুদুর গিয়ে কিছুদুর হাটলেই আমি গ্রামে পৌঁছে যাব,তখন কাওকে জিগাসা করে বাড়ি চিনে নিতে কষ্ট হবে না।এতরাতে এখানে কিছু দেখছিও না কিন্ত কোনো উপায় নেই বলেই হাঁটা ধরলাম।বাজারে একটা কালো রঙের নেড়ী কুত্তা ছিল সেটা আমার পিছু নিল।রাস্তার দুধারে বাড়িঘর, গাছপালা কিন্ত সবই কিছুটা দূরে দুরে।কোনো কোনোটাতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে,কোনোটা একদম অন্ধকার।এর মাঝেই আমি গ্রাম্য পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম।আকাশে আধখানি চাঁদ কেমন একটা ধোঁয়াটে আলো ছড়াচ্ছে।সেই আলোতে দূরের বাড়িঘরগুলোকে কেমন যেন অন্ধকারের স্তুপ বলে মনে হচ্ছে।বেশ একটা ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া বইছে আর তাতে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে হাস্নাহেনা বা কাঁঠালীচাঁপার গন্ধ।এসবের মাঝে গ্রাম্য পথ ধরে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছিল।যাত্রার ক্লান্তিটাও যেন বেশ অনেকটা কমে গেল।আমার অবশ্য সন্ধ্যার আগেই এখানে পৌঁছানোর কথা ছিল।বাসে উঠতে দেরী হওয়ায় এভাবে রাত হয়ে গেছে।বোঝার চেষ্টা করলাম কয়টা বাজতে পারে।হাতে ঘড়ি ছিলনা তাই নিশ্চিতভাবে কিছু বুঝতে পারছিলাম না তবে মনে হচ্ছিল দশটা বেজে গেছে।
অনেক লম্বা পথ।মনে হচ্ছিল যেন আমার অনন্তকাল ধরে এই পথে চলতে হবে।নেড়ী কুত্তাটা বন্ধুর মত আমার সাথে সাথে আসছিল। সেই জনমানবহীন প্রান্তরে যা হোক এটুকু সঙ্গ পেয়েও বেশ ভরসা পাচ্ছিলাম।খেয়াল করলাম বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে সরে যাচ্ছে আর সে স্থান দখল করছে ফসলের মাঠ।হাঁটতে হাঁটতে একসময় নিজেকে আবিস্কার করলাম দুপাশে ধু ধু ফসলের মাঠ বেষ্টিত এক রাস্তায়।রাস্তার পাশ থেকে মানব বসতির শেষ বাড়িটা দূরে চলে যেতেই কুকুরটাও আমার পিছু ছেড়ে গ্রামের দিকে ফিরে গিয়েছে।অঘ্রাহণ মাস তাই মাঠের ফসল কাটা শেষ।চাঁদের ঘোলাটে আলোয় অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে কিন্ত মাঠের কিনারা খুঁজে পাওয়া গেলনা।আমি একটু হতভম্ব হয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম।হঠাত একটা রাতজাগা পাখি আমার মাথার উপর দিয়ে কর্কশ স্বরে ডেকে গেল।আমি ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম,শুধু আমিই না যে ঝিঁঝিঁগুলো অবিরত ডেকে চলছিল সেগুলোও যেন থমকে গেল তাই পরিবেশটা হঠা্তই ভয়ানক নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল।আমি কখনোই ভিতু ছিলাম না কিন্ত সেদিন কেন যেন আমার বেশ ভয় ভয় লাগতে লাগল।মনে হতে লাগল একা একা এভাবে অচেনা এলাকায় আসাটা বুদ্ধিমানের মত কাজ হয়নি।একবার মনে হলো ফিরে যাই কিন্ত ভাবে দেখলাম ফিরে যাবটা কোথায়?এখানে সবকিছুই তো আমার অচেনা তাছাড়া আমার আত্মীয় নিশ্চয় আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।একবার সেখানে পৌঁছাতে পারলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে গরম খাবার খেয়ে নরম বিছানায় শুয়ে ঘুম দেয়া যাবে।এসব ভেবেই আমার ভয় চলে গেল তাছাড়া ঝিঁঝিঁরাও এরই মধ্যে তারস্বরে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে তাই এই ক্ষণিকের থমথমে আবহাওয়া বিদায় নিয়েছে।
বাজারের বুড়োটা বলে দিয়েছে রাস্তা ধরে মাইল তিনেক হাঁটার পর যে ঝাঁকড়া হিজল গাছ পড়বে সেখান থেকেই পশ্চিমে মাঠ ধরে হাঁটতে হবে।হিজল গাছ আমি চিনিনা কিন্ত আমার মনে হলো এরই মধ্যে তিন মাইল হাঁটা হয়ে গেছে।তাই রাস্তার ধারে ঝাঁকড়া মতো একটা গাছ দেখে সেখান থেকেই মাঠে নেমে পশ্চিমে হাঁটা শুরু করলাম।ফসল নেই শুধু তার শুকনো গোড়া গুলো পরে আছে।আমি কখনো মাঠ দিয়ে আবার কখনো আল ধরে হেঁটে চলছিলাম।মনে হচ্ছিল যেন তেপান্তরের মাঠে এসে পড়েছি এর যেন কোন শেষ নেই।একে ক্লান্ত তার উপর ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর।আমার মনে হচ্ছিল যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাব এমন সময় দূরে হাতের ডানে একরাশ অন্ধকার দেখতে পেলাম।বুঝলাম গ্রামের কাছে এসে পড়েছি।কাছে আসতেই বুঝতে পারলাম আমার অনুমান মিথ্যা নয়।বড় বড় গাছের ছায়ায় জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে,আধখানা চাঁদের আলো সে অন্ধকার ভেদ করতে পারছে না।কেন বুঝলাম না আমার সে গাছের জটলার দিকে পা বাড়াতে ইচ্ছা করছিল না।কেমন একটা দ্বিধা বোধ করছিলাম।ঝোপঝাড়ে ঝিকমিক করে জ্বলা জোনাকিদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম কি করবো এমন সময় জঙ্গলের ভেতরে দূরে একটা ক্ষীন আলোর রেখা লক্ষ্য করলাম।ভাবলাম যাক!এখানে তাহলে কাছেই বসত বাড়ি আছে।সব দ্বিধা দূর করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম আলো লক্ষ্য করে।
কাছে গিয়ে দেখি এক গ্রাম্য বসত বাড়ি।তারই উঠোনে মাঝারি আকারের বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো হারিকেনের আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে।আমি অবাক হলাম এ্টা দেখে যে বাড়ির সামনে কলাগাছে রঙ্গিন কাগজের ফুল লাগানো একটা গেট,এছাড়াও সারা বাড়ি সুতায় রঙ্গিন কাগজ লাগানো মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে।বুঝলাম আজ নিশ্চয় এবাড়ির কোনো মেয়ের বিয়ে ছিল।বাড়ির ভেতরে মানুষের সাড়াশব্দ পেয়ে বুঝলাম অনেকেই হয়তো জেগে আছে।আমি দরজার কাছে গিয়ে একটু কেশে শব্দ করতেই ভেতর থেকে একজন বৃদ্ধ বেড়িয়ে এল।তার পরনে একটা সাদা লুঙ্গি আর কাঁধে একটা গামছা ঝোলানো।লোকটির মুখ ভয়নক বেজার,চোখ লাল,মনে হচ্ছিল যেন সে অনেকক্ষন কান্নাকাটি করেছে।আমি তার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে যেই না জায়গার নাম জিগাসা করবো তখনই বৃদ্ধ আমাকে চমকে দিয়ে আমার দুহাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলতে লাগল,বাবা আমার মেয়েটাকে রক্ষা কর।আমার অভাগী মেয়েটাকে তুমি বিয়ে কর।যত টাকা যৌতুক লাগে আমি দেব,ঘরে গহনা যা আছে সব দেব,দেবীগড়ে আমার একটুকরো জমি আছে সেটাও তোমার নামে লিখে দেব।তবুও দয়া করে আমার মেয়েটাকে বাঁচাও।
বৃদ্ধের এই আকুতিতে আমি ভীষন হতভম্ব হয়ে গেলাম।অনুমান করলাম কোনো কারনে হয়ত মেয়েটির বিয়ে ভেঙ্গে গেছে,অসহায় পিতা হয়ত মেয়ের সন্মান বাঁচানোর জন্যে মরিয়া হয়ে এমন আচরন করছেন।নাহলে অচেনা কোনো লোককে রাত দুপুরে কোনো বাবাই মেয়ে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে না।আমি অনেক কষ্টে বৃদ্ধকে শান্ত করলাম।তবুও তার এক কথা যে তার মেয়েকে বিয়ে করতেই হবে।আমি ভাবতে লাগলাম প্রস্তাব তো খারাপ না।আমি তো বিয়ে করবো বলেই এসেছি।তাছাড়া পরিপাটি বাঁশের বেড়া দেয়া টিনের চালের ঘর দেখে তো মনে হচ্ছে মালিক বেশ অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ।তাছাড়া ইনি নিজে থেকেই যখন এতকিছু যৌতুক দিতে চাইছেন তখন আর দ্বিধা করবো কেন?একবার মনে হলো মেয়ে হয়ত দেখতে খুব কুচ্ছিত কিন্ত তখন আমাকে লোভ পুরোদমে পেয়ে বসেছে তাই হবু স্ত্রীর চেহারা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না,বৃদ্ধের কথায় রাজি হয়ে গেলাম।নিশ্চয় আমার মাথা তখন ঠিকমত কাজ করছিল না কারন আমি আমার আত্মীয়ের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম এমন কি আমি কোথায় রয়েছি এটাও জিগাসা করলাম না।আমাকে বাড়ির ভেতরে এনে বসান হলো।বৃদ্ধ জানালেন তিনি রাতেই বিয়ে পড়িয়ে দিতে চান।আমার মনেহয় আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম কারন এই অংশটুকু আমার কাছে পরিষ্কার না।শুধু মনে আছে আমি সব কথায় ইতিবাচক উত্তর দিয়েছিলাম এবং এমনই ঘোরের মাঝে পর্দার আড়ালে থাকা কারো সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
সেদিন কিছু খেয়েছিলাম কিনা মনে নেই শুধু মনে আছে আমাকে বিশ্রামের জন্য একটা ঘরে পাঠানো হলে সেখানে বিছানা দেখে তাতে শুয়ে গভির ঘুমে ঢলে পড়লাম।আমার ঘুম ভাঙ্গলো চুড়ি আর নুপুরের নিক্কনে।চোখ খুলতেই দেখলাম ঘোমটা ঢাকা একটি মেয়ে দাঁডিয়ে আছে।ঘরের কোনে একটা হারিকেন হালকা আলো বিলিয়ে দিচ্ছিল।সেই আলোতে ঐ রমনীয় মূর্তিটাকে খুব মোহনীয় লাগছিল।সারাঘরে ভাসছিল বেলী ফুলের হালকা সুবাস।আমি তাকে বিছানায় এসে বসতে বললাম।সে বসলো, বেলী ফুলের সুবাস আরো তীব্র হলো।ঘোমটা সড়িয়ে তার মুখ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।কোনো মানবী কি এত সুন্দর হতে পারে!!তীব্র এক ভাললাগার স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।জানতে পারলাম আমার নববধুর নাম কুসুম।লাল শাড়িতে লজ্জা অবনত মুখে সে আমার সামনে বসে রইল।তার সাথে অনেকক্ষন গল্প করলাম।ধীরে ধীরে যেন তার লজ্জা একটু ভাঙ্গল,সে আমার সাথে একটু সহজ হল।সে যখন তার মিষ্টি সুরেলা কন্ঠে আমাকে তার পছন্দের জিনিসগুলোর কথা বলছিল আমি তখন তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিলাম,এমন একটা সম্পদ যার জীবনে আছে তার আর অন্য কোনো সম্পদের দরকার নেই।এই প্রথম মনে হচ্ছিল যে শশুরের দেয়া যৌতুকের থেকেও বড় সম্পদ হচ্ছে শশুরের কন্যা।সময়ের সাথে সাথে যেন তীব্র আকর্ষনের জালে আমাকে জড়িয়ে ফেলছিল আমার নববধু।ক্লান্ত ছিলাম বলে মনে হয় আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
এবার আমার ঘুম ভাংলো কান্নার শব্দে।দেখলাম ঘর অন্ধকার আর খাটের একপ্রান্ত থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে।আমি তাকে নাম ধরে ডাকলাম কিন্ত তার কান্না থামল না।আমি উঠে বসে যেই না তাকে স্পর্শ করতে যাব তখনি হতভম্ব হয়ে দেখলাম তার কাপড়ে দপ করে আগুন ধরে গেল এবং সেই আগুন দাউ দাউ করে তার সমস্ত শরীরে জ্বলে উঠল।সে হাঁটুতে থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো,সেই অশ্রুভেজা চোখে কি ভায়ানক বিষাদ!আমি শিউরে উঠে চিতকার করতে চাইলাম কিন্ত গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না,এমনকি নড়তেও পারলাম না।এরই মধ্যে আগুন তাকে গ্রাস করে নিয়েছে,সেই আগুনে তার সোনার মত শরীর মোমের মত গলে গলে পড়তে দেখলাম।শুধু তার চোখ দুটি দুঃখ আর অভিযোগ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।ততক্ষনে সারাঘরে আগুন ধরে গেছে।আমি কোনো মতে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে অন্যদের পাগলের মত ডাকতে লাগলাম,কুসুমকে বাঁচানোর আকুতি জানাতে লাগলাম।হঠাত সারাটা বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল,আর তার সাথে একাধিক মেয়েলি কন্ঠের তীব্র যন্ত্রনা কাতর কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে গেল।মুহূর্তেই আমি আমার বুদ্ধি ফিরে পেলাম।বুঝলাম আমি যা দেখছি তা স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য নয়।এটা স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য হতে পারেনা।বুঝতে পারলাম যদি প্রান বাঁচাতে চাই তবে অবশ্যই এখান থেকে পালাতে হবে।আমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসছি এমন সময় একটা পুরুষ কন্ঠের অট্টহাসি রাতের নিঃস্তব্ধতাকে খান খান করে দিল।দেখলাম বাড়ির ভেতর থেকে একটা জ্বলন্ত শরীর বের হয়ে আসল।দূর থেকেও আমি চিনতে পারলাম সেই বৃদ্ধকে।তারপর এক এক করে আরো অনেকগুলো জ্বলন্ত মূর্তি এসে দাঁড়ালো।বৃদ্ধ আবার গায়ের লোম দাঁড়ানো অট্টহাসি দিয়ে আমার পিছু নিল।আমি প্রানপনে দৌড়াতে লাগলাম আমার পেছন পেছন তাড়া করতে লাগল সেই জ্বলন্ত মূর্তিগুলো এবং সে সাথে তাদের ভয়ানক হাসি আর ইনিয়েবিনিয়ে কান্না।বড় বড় গাছের সেই বাগানের যেন কোন শেষ নেই।গাঢ় অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না।আমি অন্ধের মত ছুটে চলছি তবে বুঝতে পারছি যেদিক দিয়ে এখানে ঢুকেছিলাম এখন ছুটছি তার বিপরীত দিকে।হঠাত এক গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম,প্রচন্ড ব্যাথা আমাকে প্রায় অবশ করে দিল।তবুও প্রান বাঁচানোর তাগিদে কোনো মতে উঠে দাঁড়ালাম।ততক্ষনে জ্বলন্ত বৃদ্ধ আমার খুব কাছে এসে পড়েছে।আমি আবার দৌড়ে পালানোর আগেই বৃদ্ধ খপ করে আমার হাত চেপে ধরলো।তার হাত যেন লোহার সাঁড়াশির মত শক্ত সেই সাথে গনগনে গরম।সাথে সাথেই আমার হাত পুড়ে গেল।আমি মরিয়া হয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে হ্যাঁচকা টানে হাত ছুটিয়ে নিয়ে পালালাম।দৌড়ে গাছের জঙ্গল পেড়িয়ে ফাঁকা মাঠে এসে পড়লাম।দেখলাম আকাশ একটু ফরসা হয়ে এসেছে হয়ত একটু পরেই আজান দেবে।পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না তবুও প্রানপনে সামনের দিকে দৌড়ে চললাম।মাইলখানেক সামনেই একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছিল।গ্রামের প্রান্তে পৌঁছানোর পরই আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসল।
এটুকু বলেই ভদ্রলোক থামলেন।তার কথা শুনতে শুনতে আমরাও যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।মুনির জিগাসা করল,তারপর কি হলো?ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি সেই গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে শুয়ে রয়েছি।জানতে পারলাম এই গ্রামের নাম পরানপুর।গ্রামটি আমার গন্তব্য থেকে যে শুধু বেশ দূরে তাইই নয় বরং একেবারেই উলটাদিকে।পরাগপুর স্থানীয়দের কাছে রাগপুর নামেই বেশি পরিচিত তাই হয়ত বাজারের বাহাত্তুরে বুড়ো কানে ভুল শুনে আমাকে এই দিকে পাঠিয়েছে।খবর পেয়ে পরাগপুর থেকে আমার আত্মীয় এসে পৌঁছালেন।আমি যে শুধু পুরো একদিন অজ্ঞান ছিলাম তাইই না বরং জ্বর নামল না সাত দিনের আগে।হাতের পোড়া ক্ষতের দগদগে ঘা সারতে আরো অনেকদিন লাগল।সেই আত্মীয়ের সাহায্য নিয়ে সাতদিন পর ঢাকায় এসে পৌঁছালাম।এরপরেও অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম।তবে সুস্থ হয়ে প্রথম যে কাজটা করলাম সেটা হচ্ছে বাবার পছন্দের চাকরিতে যোগ দেয়া।টানা পাঁচ বছর পরিশ্রম করে সেই টাকার পুঁজি দিয়ে আমি বর্তমান ব্যবসা শুরু করি।স্বাবলম্বী হয়ে আমি পাশের বাড়ির আমেনাকেই বিয়ে করি এবং আমি বিয়েতে কোনো যৌতুক নিইনি।এখন পাঁচ সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে আমার জীবনটা পরিপূর্নই বলা যায়।আমার তিন ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি কোনো যৌতুক ছাড়াই কিন্ত তাড়া সবাই চমতকার ভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত।একারনেই আসলে তোমাদের আলাপের মাঝে কথা বলেছি।
এবার আমি বলে উঠলাম কিন্ত সেদিন আসলে কি হয়েছিল?দূর্বলতার কারনে কোনো হ্যালুশিনিসন?কুসুম বলে কি আসলেই কেউ ছিল?ভদ্রলোক মাথা নিচু করে কিছুক্ষন ভাবলেন তারপর বললেন,পরানপুর গ্রামের মানুষের কাছে জানতে পারি মাঠের মাঝে ঐ স্থানে একসময় বসতি ছিল।সেটাকে গ্রাম না বলে বরং পাড়া বলাই ভাল।জমি আর ফসলের দেখভালের উদ্দেশ্যে একদুই ঘর মানুষ মাঠের মাঝে ঘর বেধেছিল।সময়ের সাথে সেখানে আরো পরিবার ঘর বাধে আর এলাকাটা একটা ছোট বসতিতে পরিনত হয়।এই এলাকার এক গৃহস্থের আদরের মেয়ে ছিল কুসুম।অসামান্য রূপবতী হওয়ার কারনে আসেপাশের দশ গ্রামে তার ভক্ত কম ছিলনা।সেই সাথে অবশ্য শ্ত্রুও জুটেছিল অনেক।মেয়ের বাবা আর মেয়েকে গ্রামের কোনো ছেলের সাথেই বিয়ে দিতে রাজি হলেন না তাই সম্মন্ধ পাকা হলো দূরের এক শহরবাসির সাথে।বিয়ের দিনে কুসুমের বাবা বিস্তর আয়জন করলেন,পাত্রের যৌতুকও ধার্য হলো অনেক টাকা।মেয়ের বাবা জমি বেচে সে টাকাও জোগাড় করলেন।এতকিছুর পরেও কিন্ত মেয়ের কপাল পুড়ল।হিংশুটে প্রতিবেশীরা হয়ত ছেলেপক্ষকে ফুঁসলিয়ে ছিল কারন বিয়ের আসরে ছেলেপক্ষ আরো যৌতুক দাবী করে বসল।মেয়ের বাবার সামর্থ্য ছিলনা দ্বিগুন যৌতুক দেয়ার,যা করা সম্ভব তার সবই তিনি মেয়ের জন্য করেছিলেন।দাবি না মেটায় বরপক্ষ বিয়ে না করেই বাড়ি ত্যাগ করে।তামাশা দেখতে সেদিন অনেকেই উপস্থিত হয়েছিল।মেয়ের অসহায় বাবা সেদিন নিরুপায় হয়ে উপস্থিত সকল অবিবাহিত যুবককে হাত জোড় করে আকুতি জানিয়েছিলেন তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য কিন্ত কেন যেন কেউই সেদিন তার কথায় সাড়া দেয়নি।সবাই শুধু মজা দেখছিল।মেয়ের বাবা সেদিন অনেকরাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সামনে দিয়ে যাওয়া মানুষকে আকুতি জানিয়েছিলেন কারন তিনি জানতেন রাতের মধ্যে যদি বিয়ে না হয় তবে সবাই তার মেয়েকে অপয়া বলবে,মেয়ের আর বিয়ে হবে না।তার সব চেষ্টাই অবশ্য বিফলে গিয়েছিল।
সেইরাতেই অভিমানী মেয়েটি গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে।মেয়েতো পুড়ে মরলই কিন্ত তার গা থেকে আগুন সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল।গভীর ঘুমে অচেতন তার বাবা মা আর ভাই সে আগুনে পুড়ে মড়ল।কুসুমের বিয়ে পড়াতে অনেক দূর থেকে এসেছিলেন তার কাজি চাচা,তিনিও সপরিবারে পুড়ে মরলেন।সেই আগুনে বাড়ির আরো অনেকেই পুড়েছে,কেউ ভুগে ভুগে মরেছে কেউ হয়ত বেঁচেছে।যদিও বাড়িটা পরিত্যাক্ত হয়ে গেল কিন্ত এই ঘটনার পর থেকে গভির রাতে ঐ বাড়ি থেকে কান্না আর আর্তনাদ শুনতে পেত।কেউ কেউ রাতে দাউ দাউ করে আগুনও জ্বলতে দেখেছে।ভয়ে একে একে প্রতিবেশিরা এলাকা ছাড়তে শুরু করলো।একদিন সকালে ঐ বাড়ির ভিটায় এক যুবকের দগ্ধ লাশ পাওয়া গেল।তারপর আর সেখানে কেউ থাকার সাহস করল না।বিশঘর প্রতিবেশির সবাই এলাকা ত্যাগ করল।পরে অবশ্য জায়গাটাকে ফলের বাগানে পরিনত করা হয়েছে।এই বাগানে অনেকেরই অনেক ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়েছে তাই সন্ধ্যার পর আর কেউ সেই বাগানের ছায়াও মাড়ায় না।ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিলাম এটা ঠিক কিন্ত হ্যালুশিনিসন হলে নিশ্চয় অনেক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা হুবুহু এভাবে দেখতাম না।ভদ্রলোক পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দেখালেন,আমরা দেখলাম তার হাতে একটা অদ্ভুত পোড়া দাগ,অনেকটা পাঁচ আঙ্গুলের ছাপের মত।
আমরা কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।তিনি বললেন,এতগুলো বছর চলে গেছে কিন্ত সেই ঘটনা আমার পিছু ছাড়েনি,আমি এখনও সেই রাতের দুঃস্বপ্ন দেখি।তবে কুসুম নামের মেয়েটার জন্য আমার খুব মায়া লাগে।সারাটি জী্বন ধরে আমি সেরাতে শোনা ছোট ছোট সাধগুলো পুরন করতে চেয়েছি।মাঝে মাঝেই মনে হয় সে ট্রেনে চড়ে বেড়াতে চেয়েছিল,চিড়িয়াখানার হাতি দেখতে চেয়েছিল কিন্ত কিছুই পুরন হলোনা।যদিও আমি পরিপূর্নভাবে সুখি একটা মানুষ তবুও মনে হয় কি ভালই না হতো যদি সেরাতে ঘুম থেকে জেগে সেই অপার্থিব দৃশ্য না দেখতাম বরং দেখতাম অপ্সরার মতো সুন্দর এক রক্তমাংশের মানবী আমার পাশে শুয়ে আছে।
১১ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৫৯
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: তাই!!!!!!!!ধন্যবাদ।
২| ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:০৭
টিট ফর টেট বলেছেন: Story!!!
১২ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৫৭
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: কি???????
৩| ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:১৪
হু বলেছেন: যৌতুক নিজেই একটা ভুত। যেটা সমাজে কিছু কীট থেকে জন্ম নিয়েছে। সুন্দর গল্প। ভাল লাগলো।
১২ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৫৮
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: দারুন বলেছেন!!!!!
সুন্দর কমেন্টের জন্য কৃতজ্ঞতা!!
৪| ১২ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৫:৩৪
মামুন রশিদ বলেছেন: গল্পটা ভৌতিক হলেও দারুণ একটা ম্যাসেজ আছে । আর সিলেটের বিয়েতে খানাপিনার বর্ণনা বাস্তবিক হয়েছে ।
১৩ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৫৭
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: গল্পটা লিখে শেষ করার পর নিজেই একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে এটা আসলেই ভৌতিক হলো কিনা!!!
সিলেটের কোনো বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।ঢিলটা কিন্ত আন্দাজেই মেরেছিলাম।
৫| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৪৮
প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: বেশ ভাল গল্প।
প্রথম প্লাস।
১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:২০
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: ধন্যবাদ শঙ্কু ভাই।
৬| ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:১৪
রোদঁশী বলেছেন: ভাল লাগল
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:১৭
শাকিল ১৭০৫ বলেছেন: ইন্টারেস্টিং তো !!