নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বেলীকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি।সেই যে যখন সে একটা ছোট প্যান্ট পড়ে খালি গায়ে সারা পাড়া গুটি গুটি করে হেটে বেড়াত তখন থেকে।সেই যখন সে আমাদের বাসার শিউলী গাছের নিচে ফুল কুড়াত আর সর্বাঙ্গে ধুলো মেখে খেলা করতো তখনও তাকে আমি দেখেছি।হ্যাঁ, আমি ইয়াসমিন বেলীর কথা বলছি।যাকে নিয়ে আজকাল পত্রিকায় এত লেখালেখি,সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এত আলোচনার ঝড়।আমি তখনকার কথা বলছি যখন সে আজকের বিস্ময়কন্যা ইয়াসমিন বেলী ছিলনা বরং ছিল নিতান্তই গ্রাম্য বালিকা মোসাম্মত বেলী খাতুন।
তখন আমার নতুন বিয়ে হয়েছে।শশুড়বাড়ির আধাপাকা বিল্ডিং এর এক কোনের ঘরে আমার ঠাঁই হয়েছে।বিয়ের পর থেকেই দেখতাম খালি গা,খালি পা,এক মাথা রুক্ষ্ম চুল আর পড়নে রঙ্গিন ছিটের প্যান্ট পড়া ৬-৭ বছরের এক মেয়ে দরজা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।সে কিছু বলতো না ঘরে ঢুকত না শুধু বিস্ময় মাখা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত।আমি ভাবতাম,আশ্চর্য তো!কি দেখে সে এইভাবে?ঘর মুছতে মুছতে একদিন ওর মা একগাল হেসে বলেছিল,আমার মাইয়া নয়া বউ দেখে গো নয়া ভাবি।তোমারে দেইখা দেইখা তার হাউস মেটে না।তোমারে দেইখা তারও বউ সাজনের শখ হইছে।আমি ভাবলাম দেখবেই বা না কেন?শাশুড়ির কড়া নির্দেষ নতুন বউকে সবসময় সেজেগুজে থাকতে হবে।অনেক খুজে তার বড় ছেলের জন্য তিনি কনে পছন্দ করেছেন।তাই বিয়ের সাত আট মাস কোনকিছুই করতে দিতেন না আমাকে শুধু পুতুলের মত সেজেগুজে বেড়াতে হতো।আজকালের বউরা তো বিয়ের পরের দিনই কামিজ ধরে।আমাদের সে উপায় ছিল না।লাল তাঁতের শাড়ি,হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি,কানে নাকে আর গলায় হালকা সোনার গহনা আর পায়ে রূপার নূপুর।আমার সাহেবের আবার কাজল টানা চোখের শখ তাই কাজলও দিতে হতো প্রতিদিন।কতদিন চুড়িতে হাত কেটে গেছে তাও একটা টুঁ শব্দ করিনি এই ভয়ে যে শাশুড়ি পাছে বেয়াদবী নেন।আমার ফর্সা গায়ের রঙের সাথেও এই সাজ মানাতো খুব।সেকারনেই বোধ হয় সেই গ্রাম্য বালিকার মুগ্ধ দৃষ্টি অর্জন করতে পেরেছিলাম।
বেলীর মা ছিল আমার শাশুড়ির উঠা কাজের লোক।গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে কাজও ছিল অনেক।বাঁধা লোক থাকলেও যখন কাজের চাপ বেশি পড়ত তখনই বেলীর মাকে ডাকা হতো।শাশুড়ি তাকে বেশ মায়াই করতেন।আমরাও আমটা,বড়ইটা, পেয়ারাটা খেতে হলে বেলীর হাতে না দিয়ে খেতাম না।শাশুড়ির মুখেই শুনেছিলাম মহিলা বেশ হতভাগ্য।স্বামী ছিল এই গ্রামেরই ছেলে,পেশায় ভ্যান চালক।বসত বাড়ি,দুটি ছেলে মেয়ে আর এক টুকরো ধানী জমি।বেশ সুখের সংসারই ছিল তাদের।কিন্ত মিনষের হঠাত কি ভিমরতি হলো এক বেদেনীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে রাতারাতি জমি বেচে দিয়ে ঘর ছাড়ল।সে বেটা তো গোল্লায় গেলই,সাথে ছেলেটাকেও নিয়ে গেল।হয়ত সময়ের অভাবে বসতবাড়িটা বেচতে পারেনি তাই এটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে শুধু নিজের সাহস আর শারিরীক শক্তিকে সম্বল করে বেলীর মা নিজেদের পেট চালাচ্ছে।এসব শুনে আমি ভেবেছিলাম বাহরে পুরুষের ভাবনা! ছেলে সন্তানও তাদের কাছে জমির মত সম্পদ কিন্ত মেয়ে সন্তান শুধুই আবর্জনা।
বেলী দেখতে ছিল আর দশটা সাধারন গ্রাম্য বালিকার মতই।শ্যামলা গায়ের রং,চাপা নাক,হালকা কিন্ত শক্ত দেহের গড়ন আর নাকে মসুরের ডালের মত একটা সোনার নাক ফুলে তাকে গ্রামের আর মেয়েদের থেকে কোনোভাবেই আলাদা করা যেত না।তবে তার একটা জিনিস আলাদা ছিল বটে।সেটা হচ্ছে তার চোখ।না,প্রতিমার মত টানা টানা চোখ তার ছিলনা কিন্ত মাঝারি সাইজের ঘন পল্লবে ঘেরা তার চোখ দুটিতে ফুটে থাকত যেন রাজ্যের বিস্ময়।সেই সাথে কেমন যেন একটা তেজে চোখ দুটি তার ঝকমক করত।তার আর একটা জিনিস বর্ননা না করলেই নয় সেটা হচ্ছে তার চুল।কুচকুচে কালো এক বোঝা চুল ছিল তার।এত সুন্দর লম্বা কালো চুল আমি আর দেখিনি।বালিকা বয়েসে রুক্ষ চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার চুল যখন বড় হল সেটাই যেন হলো তার সবচেয়ে বড় সম্পদ।তার মা ভাল কাপড় পড়াতে না পারুক মেয়ের মাথার তেল কিনতে কার্পন্য করতো না কখনো।
আমার মনে পড়ে,শশুরবাড়িতে প্রথম ঈদে সবাই যখন ফেরীওয়ালার কাছে থেকে চুড়িমালা কিনছিল তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে আমার চোখ গেল।আমি সেদিন তাকে লাল কাঁচের চুড়ি,পুঁতির মালা ,চুলের ফিতা আর সস্তা লিপিস্টিক কিনে দিয়েছিলাম।সেই অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে ছোট্ট মেয়েটির মুখে যে খুশি ফুটে উঠেছিল তা আমার চোখে এখনো ভাসে।তার চোখ দুটি আনন্দে ঝকমক করছিল আর মুখে ছিল লাজুক হাসি।আমার মনেহয় সেই গ্রাম্য মেয়েটির সেই মুখ আর দৃষ্টি তথাকথিত ভদ্রলোকদের মুখে বলা একশটা ধন্যবাদের চেয়েও বেশি।
বেলীর মা প্রায়ই আমার কাছে বসে গল্প করতো।কাজ করে হয়রান হয়ে ফ্যানের বাতাস খেতে আসত সে আমার ঘরে আর মনের সুখ দুঃখের কথা অবলীলায় বলে যেত একে একে।একদিন ঢেঁকিঘরে পিঠার জন্য চালের গুড়া করতে করতে হঠাত কাজ থামিয়ে ব্লাউজের মধ্যে থেকে একটা হলুদ খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেছিল,ভাবি এইডা আমার সই এর চিঠি।এখন তো কেউ নাই,তুমি একটু তারাতারি পইড়া বলো সে কি লিখছে।আমি বেশ অবাক হয়েই চিঠি নিলাম।খুলে দেখি অপটু কাঁচা হাতের গোটা গোটা লেখা।চিঠি পড়ে দেওয়ার পর সে বললো,ভাবি সে আমার সই না সে মায়ের পেটের বইনের চাইতেও বেশি।এই গ্রামেরই মাইয়া।এক লগেই বড় হইছি,খেলছি।তারপর তার বিয়া হইলো শহরের এক মেকানিকের লগে।বেটা বড় বজ্জাত ছিল।নেশা ভাং কইরা বউরে পিডাইত।ঠিকমত ভাত কাপড় ও দিত না।তাও আমার সই চাইরডা বছর বেডার সংসার করছে।মাইরের চোটে যখন প্যাটের ছাওয়াল নষ্ট হইয়া গেল তখন সে গলায় কলসি দিয়া মরতেও নাকি গেছিল কিন্ত পারে নাই।তারপর একদিন আর সইবার না পাইরা বাইর হইয়া গেছে।এখন সে খারাপ পাড়ায় থাকে ঢাহা শহরে।অকাজ কুকাজ করতে হয় কিন্ত নিজে স্বাধীন মত থাকতে তো পারে।প্যাট পুইরা খাইতেও তো পারে আর লাথিগুতাও খাইতে হয় না।দেখ ভাবি আমার সই আমার মাইয়ার লাইগা কয়ডা টাকা পাঠাইছে।ভাবতাছি এইডা দিয়া একডা লাগল কিইনা পুষবো।
সেদিন আমি হতবাক হয়ে ভাবছিলাম কি আশ্চর্য এই স্বাধীনতা জিনিসটা!হোক তা অসন্মানের জীবন তবুও অন্যের অধীনে নির্যাতিত হওয়ার চেয়ে তা ভাল বলে মনে হচ্ছে এই গ্রাম্য রমনীরও।সেদিন কিছুক্ষন চুপ থেকে বেলীর মা বলেছিল,ভাবি কতবার আমারো মনে চাইছে সব ভাসাইয়া দি।ভাসাইয়া দিয়া আমিও সই এর মত হইয়া যায়।কিন্ত খালি এই মাইয়াডার মুখের দিকে তাকাইয়া কিছু করি না।তুমিই কউ দেখি মিনষেগুলার কেমন বিচার?যাওনের সময় পুলাডারে নিয়া গেল কিন্ত একবার বিচার করল না মাইয়াডা কি খাইয়া বাঁচবো।পুলাডা খালি সে জন্মাইছে আর মাইয়াডা জন্মাইছি আমি।নাকি?বাপের কি কুনো ঠেকা নাই?এই যে আমি মাইয়াডার মুখে ভাত দেওনের লাইগা লোকের বাড়ি কাম করি তাতে কি সন্মান বাড়ছে?লোকে কি গায়ে হাত দেয় না,অগো লগে কুকাজ করনের কথা কয় না?বেলীর মার কথা শুইনা রাখ ভাবি,সব মিনষেগুলাই হারামখোর বজ্জাত।মাইয়া মানুষগুলারে কুনোদিন ভাল থাকতে দিবনা এরা।হয় স্বামী হইয়া জ্বালাইব, নাইলে আমারে যেমন করে তেমন বাইরে থাইকা জ্বালাইব আর নাইলে সই এর কাছে যে মিনষেগুলা যায় তাগো মত জ্বালাইব।আমি খালি মাইয়াডা মানুষ করনের লাইগা চুপ কইরা গেরামে পইড়া রইছি নাইলে কবে গেরামের মুখে লাথি দিয়া যাইতাম গা।তাও দেখ মাইয়াডাও হইছে বজ্জাত,স্কুলে দিছি কিন্ত পড়ায় মন নাই।সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুইরা বেড়ায়।বুঝলা ভাবি সবই আমার পুড়া কপাল।সেদিন বেলীর মার কথায় আমি এক আশ্চর্য রকমের সত্য আর সরল জীবনবোধের সন্ধান পেয়েছিলাম।মনের কোনে এই সংগ্রামী মহিলার প্রতি কেমন একটা শ্রদ্ধাবোধ জমা হয়েছিল।
বেলীর বয়স যখন এগারো কি বার তখন বেলীর মা প্রচন্ড রকম টাইফয়েডের শিকার হলো।শুনলাম তার অবস্থা নাকি খুব খারাপ তাই একদিন দেখতে গেলাম।মাটির ঘরের এককোনে বিছানায় রোগপান্ডুর চেহারা দেখে যেন চেনাই যায় না এমন হয়েছে অবস্থা।ঘরের ভেতর কেরোসিনের ল্যাম্প লালচে আলো আর ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।সেই আলোয় কার চেহারা বেশি মলিন ছিল মা না মেয়ের তা যেন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।আমাকে দেখে বেলীর মা কোন রকমে বলেছিল,ভাবি শিকায় ঝুলান ঐ হাঁডির মধ্যে একডা কৌটায় আমার সই এর ঠিকানা আছে।তুমি তারে চিঠি লিইখা আমার কথা জানাও।তারে বল আমার মাইয়াডারে যেন নিয়া যায়।আমার সাতকুলে কেউ নাই।আমি আর বেশি দিন নাই।আমার মাইয়াডারে সে ছাড়া দেখার মত আর কেউ নাই গো ভাবি,তারে একটু জানাও।
বাড়ি ফিরেই আমি ঐ ঠিকানায় চিঠি লিখেছিলাম।বেলীর মায়ের মৃত্যুর পর এক রাতে বেলী আমার জানালার কাছে এসে বলেছিল, নয়া বউ আমি চইলা যাচ্ছি।আমার মায়ের সই, শরীফা খালা আমারে নিতে লোক পাঠাইছে।সে জানালা দিয়ে একটা খাতা বের করে দিয়ে আমাকে বলেছিল,এইখানে তোমার ঠিকানা লিইখা দেও যাতে আমি তোমারে চিঠি লিখতে পারি।বেলী এইকয় বছরে আমার বেশ ন্যাওটা হয়েছিল।আমিও ওকে বেশ পছন্দ করতাম।মাঝে মাঝে পড়াতাম আবার যখন যা লাগে দেয়ার চেষ্টা করতাম।সে আমায় ডাকতো নয়া বউ বলে যদিও নতুন বউ এর খেতাব অনেক আগেই গা থেকে মুছে গেছে আমার।মেয়েটাকে বিদায় দিতে কষ্ট হচ্ছিল কিন্ত তাকে যে কাছে রাখব সে উপায়ও আমার ছিল না।তাই তারাতারি কিছু টাকা আর বিয়েতে পাওয়া একটা নতুন শাড়ি তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম,ভাল থাকিস বেলী।বুঝেশুনে চলিস আর অবশ্যই পড়ালেখা বাদ দিবি না।আমি তোর খালার ঠিকানায় চিঠি দিয়ে তোর খোঁজ নেব।তুইও গিয়ে আমায় চিঠি দিস।সেই যে মেয়েটা বিদায় নিয়ে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেল তার পরে আজ পর্যন্ত তার সাথে আমার দেখা হয়নি।
এরপর বেলীর সম্পর্কে যা কিছু জেনেছি তার সবই তার চিঠি থেকে।বেলীর শরীফা খালা তাকে নিজের কাছেই রেখে মানুষ করতে চেয়েছে।তার নিজের বাড়ি যেটা একাধারে তার বাসস্থান এবং ব্যাবসার জায়গা সেখানেই বেলীকে রাখা হয়েছিল।সেই অমানুষের বস্তিতে একটা মেয়েকে সকল অনিষ্ট থেকে দূরে রাখার সঙ্কল্প যে কতটা সাহসের কাজ তা আমি এখান থেকেই অনুমান করতে পারি।বেলীর খাওয়ার পড়ার কোনো কষ্ট সেখানে ছিলনা এটা সে বলেছে।কিন্ত তার পড়ালেখা যে মাথায় উঠেছে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।গ্রাম্য মেয়ে শহরে গিয়ে টিভি সিনেমা দেখে,ঘুরে বেড়িয়ে পড়ালেখা যে ভুলে যাবে তা খুবই স্বাভাবিক।সে অবশ্য আগে থেকেই বেশ ফাঁকিবাজ ছিল এব্যাপারে।আমি ধরেই নিলাম তার জীবনটা ওদের মতই গতানুগতিক হয়ে যাবে একদিন।কে জানে একসময় হয়ত সে ওদেরই একজন হবে।ভাবতে খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিলনা আমার।তখন আমি আমার সাহেবের সাথে সিলেটে চলে যাই তার ওপরে তখন আমার দ্বিতীয় সন্তানটির জন্ম হয় তাই বেশ কিছুদিন বেলীর খোঁজ নিতে পারিনি।
বছরখানেক পরে একটা চিঠি পেয়ে আমি চমকে গেলাম পুরোপুরি।চিঠিতে বেলী যা লিখেছে তার সারমর্ম হলো এই যে,সে তার খালার বাড়িতে ভালই যত্নে ছিল।খালা তাকে সমস্ত পুরুষ মানুষ থেকে আপ্রান দূরে রেখে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছে।তার খালা সবসময় তাকে ভাল করে পড়তে উতসাহ দিত যাতে তাকে এদের মত কাজ করে পেট চালাতে না হয়।কিন্ত বেলী বরাবরের মতই অমনোযোগী থেকে গিয়েছে।এর মাঝেই বেশ কয়জন বেলীর সাথে সময় কাটাতে চেয়েছে কিন্ত খালা তাকে একদম পক্ষীছানার মত আগলে রাখায় কেউ তেমন ক্ষতি করতে পারেনি।এদের মধ্যে মাঝবয়েসি একটা লোক ছিল একদম নাছোড়বান্দা।মাস ছয়েক ধরেই সে বেলীকে নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে আসছিল।দিনদশেক আগে বাড়িতে বড় অনুষ্ঠান হচ্ছিল যাতে সবাই ছিল ভীষন ব্যাস্ত।এই সুযোগে লোকটা বেলীকে ছাদে একা পেয়ে মুখ বেঁধে জোর করে তার সর্বনাশ করেছে।সারারাত সেই লোকটা বারবার তাকে… বেলী ভীষন ভয় পেয়ে গেছে।সে জানতে চেয়েছে এখন সে কি করবে।
ওর চিঠি পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।কতই বা বয়স হবে মেয়েটির?এই তের কি চৌদ্দ।এতটুকু একটা মেয়েকে একটা পূর্নবয়ষ্ক একটা লোক সারাটা রাত কি অত্যাচারটাই না করেছে!না জানি কত কষ্ট হয়েছে মেয়েটার।এতটুকু বয়েসেই পৃথিবীর সবচেয়ে কদর্য রূপটা তাকে দেখতে হয়েছে।সেদিনই আমি বেলীকে চিঠি পাঠাই,সেই সাথে কিছু ভাল ভাল গল্পের বই।যদি বই পড়ে তার মন একটু ভাল হয়! তার খালাকেও একটা চিঠি দিয়েছিলাম।যদিও আমি বেলীকে শান্তনা দিয়ে,নানা আশার বানী দিয়ে চিঠি লিখেছিলাম তবুও আমি ওর ব্যাপারে তেমন আশাবাদী হতে পারছিলাম না।বুঝতে পারছিলামনা মেয়েটা কিভাবে নিজেকে সামলাবে।
তবে বেলী সামলে নিয়েছিল এবং সেটা করেছিল খুব ভাল ভাবেই।মাঝে মাঝে ও আর ওর খালার চিঠির মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম ঐ ঘটনার পর বেলী খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া লেখা শুরু করে।আজীবনের ফাঁকিবাজ ছাত্রী বেলী বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসাবে আঁকড়ে ধরে অধ্যায়নকে।তবে সেটা শুধু অধ্যায়ন ছিলনা,সেটা ছিল যেন তপস্যা।হয়ত আশেপাশের নোংরা পরিবেশ থেকে বাঁচতে,হয়ত নিজের কষ্টের স্মৃতি ভুলতে কিংবা হয়ত এই অন্ধকার গলি থেকে চিরতরে উড়াল দেওয়ার জন্যই সে দিন রাত খালি পড়ত।যখন পড়ার মতো কিছু থাকত না তখন গল্পের বই বা অন্য কিছুতে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকত।একবার সে চিঠিতে লিখেছিল,নয়া বউ আমি জানতাম না বইয়ের পাতায় এত শান্তনা আছে।যখন আমার মায়ের কথা মনেহয় তখন আমি বই পড়ি,যখন সেই লোকের নোংরা হাতের কথা মনে হয় তখনও বই পড়ি,যখন মাতাল হয়ে লোকে গলিতে চিল্লায় আর গালি দেয় তখনও বই পড়ি আবার যখন মনটা অনেক খুশি লাগে তখনও বই পড়ি।
ওর খালা আমায় লিখেছিল এই মেয়ে সারাদিন এমনভাবে বই নিয়ে বসে থাকে যে আজকাল কেউ তাকে জ্বালাতে যায় না,এমনকি পুরুষরাও না।সবাই কেমন যেন একটু ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা করে তাকে।সে এস,এস,সি তে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে পাশ করলো একদিন।তারপরে সে মেয়েদের হোস্টেলে থেকে ঢাকার একটা ভাল কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পাশ করে। ততদিনে বেলী নামক মেয়েটির মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে।সেই গ্রাম্য লাজুকতা একদমই নেই।ততদিনে পরীক্ষার ফর্মে সে নিজের নাম নিজেই বদলে বসিয়েছে “ইয়াসমিন বেলী’ আমি পরীক্ষা পাশের খবর পেলেই ওর জন্য কিছুনা কিছু উপহার পাঠাতাম।কলেজের শিক্ষকরা ওর জ্ঞান,অধ্যাবসায় আর যোগ্যতা দেখে মুগ্ধ ছিলেন।আবারও খুব ভাল ফল নিয়ে কলেজ পাশ করে বের হওয়ার পর তাদেরই একজনের পরামর্শ নিয়ে সে আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে অনার্সের জন্য এপ্লাই করে।সেখানে সে এত ভাল ফল দেখায় যে ফুল স্কলারশিপ পেয়ে যায়।দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে সে আমার কাছে দোয়া চেয়ে চিঠি লিখেছিল।আজ দশ বছর হলো সে বাইরে।বছরে একটা হলেও চিঠি লিখে সে আমার সাথে যোগাযোগ রাখত আর আমার জন্য চকলেট পাঠাতো।চকলেটের বাক্সে লেখা থাকত ‘মিষ্টি নয়া বউয়ের জন্য মিষ্টি চকলেট’ ওর পাগলামি দেখে আমি হাসতাম আর ওর পাঠানো ছবি দেখে ভাবতাম কি মেয়ে আজ কি হয়েছে! তবে এটুকু তার নিজেরই অর্জন।নিজের চলার পথ সে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেই পুস্পশোভিত করে নিয়েছে।
আজ আমাদের গ্রামের সেই ছোট্ট বেলী পরিনত হয়েছে একজন স্বনামধন্য পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষক ইয়াসমিন বেলীতে।এত কম বয়েসে এতটা সফলতা আর খ্যাতি খুবই বিরল।আজ তার গবেষনা নিয়ে সারা দেশ জুড়ে কত চর্চা।তাকে নিয়ে কত লেখালেখি,সকলের কত আলোচনা।এত বছর পর সে দেশে আসবে বলে কত আয়োজন করে তাকে বরন করে নেয়া হচ্ছে ! সে আজ সারা দেশের গর্বে পরিনত হয়েছে।আপনারা হয়ত ভেবেছিলেন সে কোনো বড়লোকের আদরের দুলালী।কিন্ত তা নয়।সে জন্মেছিল এক জীর্ন কুটিরে এক লম্পট ভ্যানচালকের ঔরসে।মানুষ হয়েছে লোকের দয়ার দানে,দিন কাটিয়েছে এক বেশ্যালয়ে।কিন্ত কই এই নক্ষত্রের উজ্জলতা তো কোনো কিছুই ঢেকে রাখতে পারেনি।কাল তার পাশে কেউ ছিল না কিন্ত আজ তার জন্য সবাই রয়েছে।তার পুরো ইতিহাস শুনলে আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত নাক কুঁচকাবেন।কিন্ত মনে মনে আশা করি তার সহপাঠি সেই এতিম ছেলেটি,যে পরম মমতায় এই একলা মেয়েটির হাত ধরেছে সে এই রত্নের মুল্য বুঝবে আর তাকে আগলে রাখবে পরম মমতায়।
ঐ যে কলিংবেল বাজছে।ওরা বোধহয় এসে গেল। কে?এই যে এতক্ষন যাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল।হ্যাঁ সেই বেলী।সে বারবার ফোন করে জিদ ধরেছে দেশে এসেই প্রথমে নয়া বউকে দেখবে,তার হাতের রান্না খাবে।তাই আজ আমার ঢাকার ফ্লাটে ওদের দুজনের দাওয়াত।আমার সাহেব ওদের পথ চিনিয়ে আনতে গেছেন।যাই এবার দরজা খুলি!
লেখকের কথাঃ একদিন একটা ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেলে একটা মেয়ের জীবন কাহিনী আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল।সেটা থেকে অনুপ্রানিত হয়েই এই গল্পটা লেখা।চ্যানেলটির দাবী ছিল অনুষ্ঠানটা বাস্তব ঘটনার রিমেক।তাদের দাবী ঠিক থাকলে আমার গল্পের মেয়েটির জীবনের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য অংশটুকুই বাস্তব।আর প্রথম দিকের অংশটা আমার কল্পনা।
২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩১
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: প্রথমেই আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দিচ্ছি।আর সুযোগ পেলে মুভিটা দেখব অবশ্যই।
আমি আপনার সাথে একমত গনিকা দের বিষয়ে।আসলে মেয়েরা নিতান্ত বাধ্য না হলে এ পথে যায় না।তবুও তো দেহপসারিনী হয়ে সেবা দান করে তার বদলে মেয়েগুলো খেতে পড়তে পায়।যদি তা না করত তবে হয়ত পুরুষদের হাতে বার বার ধর্ষিত হত কিন্ত বিনিময়ে কিছুই পেত না।
এ বিষয়ে আমার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ল।আমি তাকে জিগাসা করেছিলাম ,তোর কি মনে হয় পতিতাবৃত্তি বন্ধ করে দিলে সমাজ শুদ্ধ হয়ে যাবে?সে উত্তর দিয়েছিল,মোটেও না বরং নারী ধর্ষন বাড়বে।তবে সবচেয়ে বিপদে পড়বে মেয়েগুলো।একবার ভেবে দেখ যে একটা মেয়ে এতিম,আশ্রয়হীন,পেটে বিদ্যা নাই,সম্পদ নাই, তেমন কোনো কাজের যোগ্যতাও নাই,এই অবস্থায় তার বেঁচে থাকার উপায় কি হবে?সে যদি এই পেশায় না নামে তবে তাকে না খেয়ে মরতে হবে আর কপালে ফ্রী ফ্রী জুটবে কয়েক দফা রেপ আর লাঞ্ছনা।এই পেশা যত খারাপই হোক তাতে যুক্ত হয়ে মেয়েগুলো অন্তত একটা আশ্রয় পায়, পেটে ভাত জোটে।
আসলে পেশার জন্য তাদের ঘৃনা করার কিছু নেই।তারা চুরি করছে না, লোক ঠকাচ্ছে না,ভিক্ষাও করছে না বরং অবিশ্বাস্য একটা সেবা দিয়ে (কারো প্রতি ভালবাসার অনুভুতি না থাকলেও তার সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া নিঃসন্ধেহে খুবই কষ্টের কাজ।মনের সাথে কতটা যুদ্ধ তাদের করতে হয় তা ভেবে আমি শিউরে উঠি) তার বদলে অর্থ উ্পার্জন করে জীবন চালাচ্ছে।
আসল কাহিনীতে মেয়েটি জন্মেছিল এক পতিতালয়ে।যদিও তার মা তাকে পতিতা বানাতে চায়নি।তার সাথে খারাপ ঘটনাটা ঘটার পর সত্যিই সে নিজের জীবনটা এভাবে বদলে দিয়েছিল।আমি পতিতালয় দেখিনি বলে সেখানের জীবনের বর্ননা ঠি্কমত করতে পারতাম না।এজন্য একজন লেখকের স্বাধীনতা ব্যাবহার করে কাহিনী নিজের মত করে লিখেছি।
২| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৮
আদনান শাহ্িরয়ার বলেছেন: যন্ত্রণা দেওয়া গল্প । কত বিচিত্রই না হয় মানুষের জীবন , আমরা তার কততুকুই বা অনুভব করি !
২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ২:২২
সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আসলেই মা্নুষের জীবন অনেক বিচিত্র হয়!!!!! অনেক সময় অনেক লেখকের গল্প পড়ে মনে হয় ব্যাটা গাঁজখুরি গল্প লিখেছে।কিন্ত মাঝে মাঝে লোকের বাস্তব জীবন দেখে হতবাক হয়ে যাই আর ভাবি এমনটাও কি সম্ভব জীবনে??এ জগতের শ্রেষ্ঠ গল্পকার আসলে সৃষ্টিকর্তা নিজেই।আর প্রতি্টা মানুষের জীবনই তার রচিত ভিন্ন ভিন্ন গল্প।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:১১
হু বলেছেন: সত্যি আপনার এই গল্পটিও অসাধারণ। আমি এটি কে গল্প না একটা জীবন বলতে পরি, কারণ আপনি গল্পের পটভূমি সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। আমি নিজে একবার বাংলাদেশের গণিকা নিয়ে নেটে পড়ছিলাম। সেখানেও একটা তথ্য পেয়ে ছিলাম। একটা মেয়ে গণিকালয়ে থেকে কি ভাবে এস এস সি পাস করেছে সে সম্পর্কে। হয়তো আপনার গল্পের চরিত্রটি অনেক বেশি উচ্চ শিক্ষিত এবং গণিকাও নয় সে অর্থে কিন্তু আমি যে সত্যি কাহিনীটি পড়েছিলাম সেই মেয়েটি গণিকা ছিল এবং তার তীব্র ইচ্ছার কারণে সে এস এস সি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছিল। এই কাহিনীটি পড়ার পরে আমার নিজেরই মনে হয়েছে একটা গল্প লিখে ফেলি। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না।
আপনার এই লেখা পড়ে আমার খুবই ভাল লেগেছে। কারণ আমি যেটি করতে পারি নি আপনি সেই সকল পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। গণিকাদের নয় এর খদ্দের ঘৃণা করা উচিত। এবং এদের প্রতি সদয় হওয়া উচিত কারণ তারা যে পরিবেশে বেড় উঠে সেই পরিবেশে আপনি বা আমি যদি বেড়ে উঠতাম তাহলে আমরা কি ধরণের মানসিকতা নিয়ে বড় হতাম এক বার ভাবুন।
আপনাকে আরেকটি ডকমেন্টরী ফিল্মের কথা বলতে পারি যেটি দেখতে পারে Born into Brothel