নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সন্ধ্যা প্রদীপ

আমার সমস্ত চেতনা যদি শব্দে তুলে ধরতে পারতাম

সন্ধ্যা প্রদীপ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ শোধ

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১:০৮

কুসুম পারলো না। সে থেমে গেল। তার উপর তোলা হাতদুটো ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসলো। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে আস্তে করে ঘাসের উপর বসে পড়লো। শরৎএর ঝকঝকে আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। পুকুরের পানিতে সেই পূর্ণচাঁদের প্রতিফলন অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, ফটফটে জোসনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। কুসুম সেই পুকুর পাড়ে গাছের নিচে আলো আঁধারীর ছাপ গায়ে নিয়ে ভাবনার জগতে তলিয়ে গেল।





কুসুম ১৫ বছরের একজন কিশোরী। মাঝারি গড়নের শ্যামলা শ্যামলা একটা মেয়ে। বড় বড় চোখের দীর্ঘ পল্লব আর লাবণ্য তার চেহারায় ভারী মিষ্টি একটা ছায়া ফেলেছে। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনটা ভরে যায়। এই চাঁদ আজ তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে বাধা দিয়েছে। আজ এই নিঝুম রাতে এই ঝিঁঝিঁ ডাকা পুকুর পাড়ে সে একা এসেছে আত্মহত্যা করতে। সে অনেক ভেবেছে, তার মনেহয়েছে এটাই একমাত্র পথ। সে সম্পূর্ণ ভাবে মন স্থির করে এসেছিল। অনেক যত্ন করে পুকুর পাড়ের কাঁঠাল গাছটির একটা ডাল বেছে সেখানে তার ওড়না দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করেছিল। এই ডালটি পুকুরের দিকে অনেক খানি ঝুঁকে পড়েছে। কিছুদিন আগেও তারা দোলনা বেঁধে দোল খেত। একটা লম্বা দড়ি একমাথা একটা ডালে বেধেঁ অন্য মাথায় একটা কাঠ বা মোটা ডাল এর মাঝখানে বাঁধার পর তারা সেই দড়ি বাঁধা অংশের দুই পাশে দুই পা দিয়ে চড়েবসে পুকুর পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। আর দড়িটা দোল খেয়ে পুকুরের মাঝ পর্যন্ত যেত। তার দুই পা পানি স্পর্শ করতো। এভাবে দোল খাওয়া যে কি আনন্দের তা শুধুমাত্র তারাই জানে যারা এটা করেছে। সেই আনন্দের কথা ভেবে তার মলিন মুখে একটু হাঁসি ফুটে ওঠে। কিন্ত মূহুর্তেই সেটা নিভে যায় যখন মনে পড়ে যে আর একটু পরেই তার প্রাণহীন দেহ এই ডাল থেকে ঝুলবে। সবই ঠিক ছিল, সে প্রস্তুত ছিল কিন্তু গোলমাল করে দিল ঐ পূর্ণচাঁদ। একেবারে শেষ মূহুর্তে তার চোখ পুকুরের পানিতে পড়ে। চাঁদের ছায়া পড়ে পুকুরের পানি যেন তরল রূপাতে পরিণত হয়েছে। আর তার মাঝে ভেসে থাকা রূপালী চাঁদ তার সব মনোযোগ কেড়ে নেয়, সেই সাথে সমস্ত মানসিক বল। সে ধীরে ধীরে ঘাসের উপর বসে পড়ে। সেই সাথে তার সব সুখের স্মৃতি আর প্রিয়মুখ গুলো ভেসে ওঠে। সে আবার সবকিছু নতুন করে ভাবতে থাকে। রাতজাগা পাখিরা ডেকে যায়, জোনাকিরা আলো জ্বালায় আর সেই একাকি চাঁদ বোধহয় মনে মনে প্রশ্ন করে কি কষ্ট এই মেয়েটির? কেন সে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইছে?





কিছু দিন আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল কিন্তু সমস্যা শুরু হয় অনেকটা হঠাৎ করেই। কুসুমদের পরিবারটিকে মধ্যবিত্তই বলা যায়। কুসুমের বাবা একজন ব্যবসায়ী। বসত বাড়ির সামনে তার একটা মুদির দোকান আছে আর গ্রামের বাজারের আছে আর একটা মুদির দোকান সাথে চায়ের দোকান। দু্ই দোকানের আয়ে তাদের ছোট সংসার ভালোই চলে যায়। তদের বেশ সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি।উপরে টিন দেয়া ইটের বাড়ির সাথে, ,মাঝারি উঠানে আর বড় একটা পুকুর। বাড়ি বাবা, মা, দাদি আর ছোট বোন পারুলের সাথে কুসুম থাকে। বাড়ির দোকান বেশির ভাগ সময় মা আর দাদিই চালায়। মাঝে মাঝে কুসুম ও তাদের সাহায্য করে। বাবা চালায় বাজারের দোকান। কুসুমের বড় বোন পরীর বিয়ে হয়ে গেছে অন্য গ্রামে। সে তার দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে সুখেই আছে।



এই নিঝুম গ্রামে কুসুমের দিন কাটে অনেক আনন্দে। সে ক্লাস নাইনে পড়ে। তার গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তার হাইস্কুল। সে প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যায় আসে। সে এবং আশেপাশের বিভিন্ন ক্লাসের মেয়েরা দলবেধে স্কুলে যায়। স্কুল তার খুব প্রিয়। পড়ালেখা করতেও সে খুব ভালোবাসে। কুসুম তার ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্রী। সমস্ত স্যার আপা তাকে খুব ভালোবাসে। কুসুম এমনিতেই খুবই প্রাণবন্ত একটা মেয়ে। তার সাহসও অনেক বেশি। স্কুল থেকে ফিরেই সে তার বান্ধবীদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে তারপর পুকুরে ঝাপিয়ে গোসল করে। কুসুম সন্ধ্যায় নিয়মিত পড়তে বসে ছোট বোনকেও পড়তে সাহায্য করে। কুসুম কখনোই পড়ালোখাতে ফাঁকি দেয়না। কারণ দাদি আগের দিনের মানুষ হলেও সে এব্যাপারে খুবই সচেতন। কারণটা কুসুম দাদির মুখেই শুনেছে।



তার দাদি ছিল ভাল গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে। একজন শিক্ষিত ছেলের সাথেই তার বিয়ে হয়েছিল। দাদা চা বাগানে চাকরি করতো। দাদিকেও সেখানে নিয়ে যায়। দুই ছেলে তার তিন মেয়ে নিয়ে তার দিনগুলো ভালোই কাটছিল কিন্তু হঠাৎ করেই দাদার মৃত্যু হয়। তখন দাদি শশুরবাড়িতে ফিরে আসে। কুসুমের বাবার বয়ষ তখন ১৩-১৪,সে সবচেয়ে বড় সন্তান আর নাবালক তাই তার তেমন মূল্য ছিল না। দাদার ভাই গুলো ছিল চরম লোভী আর স্বার্থপর। তাদের দূর্ব্যবহারে দাদি অতিষ্ট হয়ে ওঠে কিন্তু তারপরও কোনমতে দিন কাটাতে থাকে। বাবার পড়ালেখা যাতে বন্ধ না হয় তাই স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দেয়। কিন্তু একদিন তারা দাদিকে মিথ্যা কথা বলে সম্পত্তির দলিলে টিপসই দিতে বলে। দাদির সামান্যতম অক্ষর জ্ঞান ছিল না তাই তিনি দেবরদের চালাকি বুঝতে পারেন নি। এভাবেই সব সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়। দাদিকে এত ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে একদম পথে নামতে হয়। দাদি ছোট থেকেই ছিলেন এতিম। মামার সংসারে বড় হয়েছিলেন। মামার মৃত্যুর পর সেখানেও দাঁড়ানোর স্থান নেই। তাই অনেক ভেবেচিন্তে তার ছেলেবেলার সখির শশুরবাড়িতে যেয়ে হাজির হন। দাদির কাছে সেই ছিল তখন সবচেয়ে আপন মানুষ। সে বাড়ির মানুষের মন আসলেই অনেক বড় ছিল কারণ তারা এই অসহায় পরিবারটিকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। দাদির হাতে তখন দাদার চাকরীসূত্রে পাওয়া কিছু টাকা আর বিয়ের গহনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি সেই গহনা বেচে আর কিছু টাকা জোগাড় করে এই বাড়ির ভিটা আর একটুকরো ধানী জমি বেশ কম দামে কিনে নেন। তখন থেকেই তিনি এই গ্রামে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে শুরু করেন। কত উপায়ে কত কষ্ট করে যে তিনি এক হাতে সংসার চালিয়েছেন তার কোন হিসাব নেই। তিনি ভাল সেলাই জানতেন তাই দর্জির কাজ করেছেন, ছাগল, গরু, মুরগী, পুষেছেন বাড়ি চারপাশে শাকসবজি চাষ করেছেন কিন্তু বাবার লেখাপড়া বন্ধ হতে দেন নি। অনেক সময় ঠিকমত খাবার জুটতো না তাও তিনি হাল ছাড়েন নি। তার স্বপ্ন যে বাবা শিক্ষিত হবে বড় চাকুরি করবে তখন তার কষ্ট দূর হবে। বহু কষ্টে বাবা মেট্রিক পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন। তারপর আর সম্ভব হয়নি। দাদি তাই মাঝে মাঝেই আফসোস করেন, বলেন যে তিনি যদি একম অকাটমূর্খ না হতেন তবে বাবা আরও লেখাপড়া করতে পারতেন। তার অন্য ছেলেমেয়েরাও পড়তে পারতো। শুধুমাত্র তার ভুলেই এমন সর্বনাশ হলো, নইরে সবাইকে এত কষ্ট করতে হতো না। তারা যখন পড়তে বসে দাদি খুবই খুশি হন। মাথায় হাত বুঝিয়ে বলেন, পড়, ভাল করে পড়। যদি মূর্খ হয়ে থাক তো দুনিয়ার লোকে আমার মত করে ঠকায়ে নিবে। সারা জীবন কাইন্দা মরবা কিন্তু কোন লাভ হইবো না।





আসলেই তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। কুসুম ভাবে হয়তো আল্লাহ্ এখন তাদেরকে ধৈর্য্য আর কষ্টের পুরষ্কার দিয়েছেন। সে মায়ের কাছে শুনেছে বাবা মায়ের বিয়ে হয় বাবার মেট্রিক পরীক্ষার কিছুদিন পর, বাবা তারপর শহরে চলে যায়। সেখানে সে ছোটখাট কাজ আর চাকরী করে যা পেত তার বেশির ভাগই জমাতে থাকে। মা ছিল গরীব ঘরের মেয়ে। এবাড়িতে এসে দাদির সাথে তিনিও অনেক কষ্ট করে সংসার চালানো শুরু করেন। দুই এক বছর এভাবে চলার পর বাবাকে একলোক বুদ্ধি দেয় একটা দোকান খোলার । বুদ্ধিটা খুবই ভাল ছিলো কিন্তু পুঁজি কোথায়? সেই সমাধানও সেই লোক করে দেয় বাবাকে বলে ব্যাংক থেকে কিছু লোন নিতে। সেই লোকের সাহায্যে বাবা কিছু লোন পেয়ে যান ব্যাংক থেকে সেই সাথে তার জামানো টাকা আর দাদি ও মায়ের জমানো টাকা মিলিয়ে গ্রামের বাজারে এই মুদির দোকান দেয়। দোকান খুবই ভাল চলতে শুরু করে কারন আশেপাশের সাত দশ গ্রামের মানুষ এই বাজারে কেনাকাটা করে আর বাবার দোকানই ছিল প্রথম স্থায়ী মুদি দোকান। মানুষকে আর প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য সাপ্তাহিক হাটের অপেক্ষা করতে হয় না। বাবা তার দোকানে কিছু মনোহরী জিনিসও রাখা শুরু করেন। দোকান এত ভাল চলে যে এক বছরের মধ্যেই ব্যাংকের ঋণ শোধ করে ফেলেন। তারপর ধীরে ধীরে বসতবাড়ি সংলগ্ন কিছু জমি কিনে ফেলা হয় সেখানে আধাপাকা এই বাড়ি ওঠে, বাড়ির সামনে আর একটা দোকান হয়, চাচা ফুফুদের বিয়ে হয়। এতসব ঝামেলার মধ্যে ইচ্ছা থাকলেও বাড়ির অন্যারা বেশি পড়ালেখা করতে পারেনি। তাই সকলের ইচ্ছা বাচ্চারা ভাল করে পড়ালেখা করুক।



কুসুমের পড়ালেখা খুব ভাল লাগে। তার ইচ্ছা সে অনেক পড়বে তারপর স্কুলের বড় আপার মত একজন শিক্ষিকা হবে। বড় আপা যে কি সুন্দর করে কথা বলে। কুসুমের খুবই ভাল লাগে সে হা করে আপার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শোনে। তাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে।

প্রতিদিন তারা পায়ে হেটে স্কুলে যায়। বাড়ি থেকে অনেকখানি পথ যেতে হয়। যখন গ্রামের প্রাইমারী স্কুল ছেড়ে প্রথম হাইস্কুলে গেল তখন থেকেই দেখে এসেছে কিছু ছেলে রাস্তার পাশে বসে থাকে। মেয়েদের দেখলেই গান গেয়ে ওঠে বা হাসাহাসি করে। তারা তখন বেশ ছোট ছিল তাই বুঝত না কিছু কিন্তু দেখতো বড় মেয়েরা মুখ নিচু করে তাদের হাত চেপে ধরে দ্রুত পায়ে স্থানটা পাড় হয়ে যেত। আগে এমনটা হতো মাঝে মাঝে। কিন্তু সে লক্ষ্য করেছে বেশ কয়েক মাস ধরেই ব্যাপারটা বেশি বেশি ঘটছে। প্রায় ছয় সাত মাস আগে এক লোক এই স্কুলে যাওয়ার রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান দিয়েছে। আর শয়তান লোকগুলো সেখানে আড্ডা গেড়েছে। প্রায় সারা দিনই দোকানে বসে টিভিতে হিন্দী গান আর বাংলা সিনেমা দেখে। যখনই এ পথ দিয়ে স্কুলের মেয়েরা যায় তখনই টিটকারী মারে শিষ দিয়ে গান গায়। মাঝে মাঝে আবার এটা সেটা ছুড়ে মারে। তাদের অত্যাচারে বড় ক্লাসের মেয়েরা স্কুলে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। এই তো সেদিন লোকগুলো পলি বুবুর গায়ে ঢিল ছুড়ে মারলো। পলিবুবু ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ছুটে গেল। তারপর থেকে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। এক সপ্তাহের মাঝেই বাবা মা তাকে বিয়ে দিয়ে শশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সে ক্লাস টেনে পড়তো। তার ক্লাসের আরও তিনজন মেয়ে ছিল যাদের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। এখন তারা বাড়িতে বসে পড়ার চেষ্টা করে। এভাবেই হয়তো পরীক্ষাটা দেবে। কে জানে হয়তো এর মাঝেই অনেকের বিয়ে হয়ে যাবে। এধরণের সমস্য এ এলাকায় অনেক দিন ধরেই চলে আসছে কিন্তু আগে এত বেশি প্রকট ছিলনা। এই ছেলেগুলো এলাকাতে খুবই প্রভাবশালী। তাদের কেউ কিছু বলতেও পারে না কিছু করেতও পারে না। সবাই তাদের কিছুটা ভয় পায় এবং যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে।



বদমাশ গুলোর যে নেতা তার নাম রবিন শেখ। সে এলাকার সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী মানুষ আলতাফ শেখের ছোট ছেলে। কুসুম বাবার মুখে শুনেছে আজ থেকে প্রায় ১৪-১৫ বছর আগের কথা যখন এই গ্রাম অঞ্চল ততটা উন্নত ছিল না তখন গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না, পাকা রাস্তা ছিল না সেই সময় আলতাফ শেখের পাটের ব্যবসা ছিল। সে তার বড় ছেলেকে কিভাবে কিভাবে যেন বিদেশে পাঠিয়ে দিল। সেই ছেলে ঐ দেশে কি জানি কি কাজ করে দেশে টাকা পাঠাতে শুরু করে। সেই কাঁচা টাকা হতে পেয়ে আলতাফ শেখের ব্যবহা ফুলে ফেঁপে উঠলো। ধন সম্পদের সাথে সাথে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করে সেই সাথে তার ক্ষমতা। সে সেই ক্ষমতা বলে এলাকার চেয়ারম্যান পদে বসে গেল যার ফলে তার যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ বেড়ে যায়। তবে আলতাফ শেখ এত বেশি নোংরা লোক ছিল না। তার নজর ছিল ব্যবসা, ক্ষমতা আর জমিজমার দিকে। গ্রাম জুরে দাপট দেখিয়ে বেড়াতো তার ছেলে আর আত্মীয় স্বজনরা । তবুও সে তার ছেলেদের কিছুটা শাষণে রাখতো। ছেলেরাও তাকে ভয় পেত খুব। তাই বেশি বাড়াবাড়ি করার সাহস পেত না। কেউ তাদের নামে নালিশ করলে সে প্রকাশ্যে ছেলেদের গালিগালাজ করতে দ্বিধা করতো না, সেই অপমানের ভয়টাও তাদের ছিল। কিন্তু আলতাফ শেখের মৃত্যুর পর তার মেঝ ছেলে সব দায়িদ্ব হাতে নেয়। সে এমনিতেই বেশি ভাল লোক না। তার ছোট ভাই বা অন্যরা কি কুকর্ম করছে তাতে তার কোনো নজর নেই। সে বরং তাদের অপরাধ গুলো ঢেকে রেখে পরোক্ষ সাহায্য করে সবসময়। এই সুযোগে ছোট ভাই রবিন চূড়ান্ত উৎশৃঙ্খল হয়ে উঠতে লাগল। সে পড়ালেখাতে একেবারেই খারাপ। চার পাঁচ বার মেট্রিক দিয়েও পাশ করতে পারে নি। এসময় মেজ ছেলে তার দুই ছোট শালাকে নিজের গ্রামে নিয়ে আসে। রবিনের থেকে দুই তিন বছরের বড়। উপযুক্ত সঙ্গী পেয়েই রবিন পড়ালেখার পাট একেবারেই শেষ করে দিল। সেটাও প্রায় ছয় বছর আগের কথা। এখন তারা মোটর সাইকেল নিয়ে সারা গ্রাম টহল দিয়ে বেড়ায়। যা ইচ্ছে তাই করে, মানুষের গাছের আম জাম রাখে না। ইচ্ছা হলেই মানুষের পুকুরের মাছ ধরে খায়, জুয়া খেলে, মদ গাঁজা খেয়ে নেশা করে আর স্কুলের পথে মেয়েদের জ্বালাতন করে। তার ভাইয়ের কাছে নালিশ করেও কোন লাভ হয়নি কারণ সে কোন কিছু কানে নেয় না।



কুসুমের মনে হয় ইদানিং এদের সাহস আরও বেড়ে গেছে। আসলে কয়েক মাস আগে তারা একটা বড় কাণ্ড করে ফেলেছে। তারাতো মানুষের এটা সেটা হাঁস-মুরগী এমনকি ছাগল পর্যন্ত ধরে নিয়েখেয়ে ফেলে মাঝে মাঝে। সবাই মুখ বুজে সহ্য করে কিছু বলার সাহস পায় না। তো তারা সেদিন মাঠ থেকে রতন মোল্লার দুধেল গরুটা ধরে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। আর সেই টাকা দিয়ে পোলাও বিরিয়ানী খেয়ে নেশা ভাং করে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। রতন মোল্লা গরিব লোক তার উপর সে ভীষণ রগচটা মানুষ। এই কাণ্ড ঘটার পর সে রেগেমেগে ২০ মাইল রাস্তা পার হয়ে জেলা শহরে গিয়ে থানায় রবিন শেখ আর সঙ্গ পাঙ্গদের নামে চুরির মামলা করে এসেছে। কিন্তু গরিব মানুষ ন্যায় বিচার খুব কমই পায়। পুলিশ তদন্ত করতে এসে আলতাফ শেখের বাড়ি ভরপেট ভাল-মন্দ খেয়ে পকেট বোঝাই টাকা নিয়ে হাসিমুখে ফিরে গেছে আর রতন মোল্লাকে বলেছে সব মিটমাট করে নিতে। রবিনের ভাই রতন মোল্লাকে তিন হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে রবিনের দলের সাহস আরও অনেক বেড়ে গেছে। তারা প্রথম দিকে ভয় পেয়েছিল কিন্তু এখন তারা জানে যে তাদের ভাই আছে, তাদের রক্ষা করতে আর থানা পুলিশ ভাইয়ের পকেটে তো কাউকে আর পরোয়া করা কেন? সেদিনের পর তারা রতন মোল্লাকে দেখলেই হাসাহাসি করে । আর সে বেচারা তার এত দামী গরুর বদলে মাত্র তিন হাজার টাকা আর এমন অদ্ভুত বিচার পেয়ে একদম চুপ হয়ে গেছে।



সেদিন সকালেও তারা স্কুলে যাচ্ছিল। তাদের গ্রামে তারা মোট বারো জন ছাত্রী। কুসুম সহ তিন জন ক্লাস নাইনে বাকিরা ছোট ক্লাসের। বড় মেয়েরা আর স্কুলে আসে না তাই মেয়ের সংখ্যা কমে গেছে। মেয়েদের মনেও আর আগের মতো আনন্দ নেই কেমন একটা থমথমে ভাব। তারা যখন চায়ের দোকানের সামনে আসলো প্রতিদিনের মতই গান আর হাসাহাসির হিড়িক পরে গেল। এই তিন জন শয়তানের সাথে আরও কিছু ছেলে থাকে। যদিও তারা বয়সে ছোট কিন্তু চা, সিগারেট আর সিনেমার লোভে এদের সাথে থাকে আর তাল মিলায়। যেন এদের কাছ থেকে বখাটেপনার ট্রেনিং নিচ্ছে। মেয়েরা প্রতিদিনের মতই দ্রুত হেঁটে জায়গাটা পার হয়ে গেল। অন্যরা বেশ সামনে এগিয়ে গেছে শুধু তারা তিন জন এক সাথে হাটছে। এমন সময় হঠাৎ ঐ তিনজন মোটরসাইকেলে চড়ে তাদের পিছু নিল। কুসুম শুনতে পেল ছেলেগুলো ছড়া কাটছে। তার সাথে পড়ে একটা মেয়ে যার নাম মালা। এরা মালার নামেই ছড়া কাটছে। কিভাবে তারা ওর নাম জানলো কে জানে? তারা বলছে মালারে মালা তুমি গলার মালা……… ইত্যাদি। মালা বড় নরম মনের একটা মেয়ে। কুসুম তার দিকে তাকিয়ে দেখল সে প্রানপনে কান্না চেপে যত জোরে পারা যায় হাটার চেষ্টা করছে। তার মুখ দেখে কুসুমের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। পলিবুবুর ঘটনার পর থেকেই তার মাথার মধ্যে চাপা ক্ষেভ টগবগ করে ফুটছে। সে দাতেঁ দাঁত চেপে রাগটা সমলে নেয়। তারাতারি হাটতে যেয়ে মালা হোচট খেল আর পেছনে হাসির হুল্লোর উঠল সঙ্গে সঙ্গে। এর পর রবিনের ভাইয়ের এক শালা ডেকে উঠল মালা…….. মাআআলা…. অন্য শালার বিকৃত উত্তর দিল…. আসছি খোকার বাবা। এরপর হো হো হাসি। মালা আর পেরে উঠলো না সে অপমানে লজ্জায় শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কুসুমের মনে হলো যেন তার মাথার মধ্যে একটা বিষ্ফোরণ হয়ে গেল সে তখন ঘুরে দাড়িয়েছে। ছেলেগুলো তখন মোটর সাইকেল থামিয়ে তাতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। কুসুম কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল। তার এই কাণ্ড দেখে তার সঙ্গীরাও থেমে দাড়িয়েছে। কুসুমকে আগাতে দেখে তারা হাসি থামিয়ে তার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আরও কয়েক পা এগিয়ে কুসুম স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলো- আপনারা প্রতিদিন আমাদের বিরক্ত করেন কেন? পেছনর সবাই এত অবাক হয়েছে ওর কাজ দেখে যে তাদের নিশ্বাস আটকে গেছে। মালা কাঁদতে ভুলে গেছে। ছেলেগুলোও মনে হয় কম অবাক হয় নি। চমক ভেঙ্গে রবিনই প্রথম জিজ্ঞাসা করলো এই ছেমড়ি কি বলে রে? কুসুম আবার বললো আপনারা কেন আমাদের বিরক্ত করেন? রবিন তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো এই ছেমড়ির তো দেখছি সাহস অনেক। এই তোর নাম কি ?কুসুম শান্ত গলায় বললো আমার নাম শুনে আপনার কোন কাজ নাই। আমার কথার উত্তর দেন? রবিন চোখ পাকিয়ে বললো মেয়ে লোক হয়ে রাস্তায় পড়তে বাইর হইছোস ক্যান? তোরা তো ঘরের কাজ করবি চাকরানীর মত? পড়ালেখা কইরে কি দেশের মিনিষ্টার হবি?এই কথা শুনে শালা দুইজন উচ্চ কণ্ঠে হসে উঠলো। কুসম মাথা ঠান্ড রেখে উত্তর দিল হ্যা, দরকার হলে মিনিষ্টারই হবো। আপনে চার পাঁচ বারেও পাশ করতে পারেন নাই বলে কি অন্যেরা পড়বো না? এই দেশের আইনের সবার পড়ালেখা করার অধিকার আছে। আপনারা আমাদের বাজে কথা বলা বন্ধ করেন। শান্তিতে থাকতে দেন।



কুসুম দেখলো এই কথা শুনে রবিন শেখের চোখ কি করে জ্বলে উঠলো। সে একটা চাপা গর্জন করে বলে উঠলো কি বললি? কি বললি ছেমড়ি ? তুই বলিস আমি ফেল করছি। তোর বিদ্ধান হওয়া আমি বাইর করছি দাড়া।ঠিক এসময় একটি ভ্যান গাড়ি কিছু যাত্রি নিয়ে দূর থেকে আসছিল। সেটা দেখে আর তারা দাড়াল না মোটরসাইকেলে উঠে চলে গেল। কুসুমরাও স্কুলের দিকে হাঁটা দিল। রবিন শেখ এত ক্ষেপেছিল সে এক মূহুর্তের জন্য কুসুমের মনে হয়েছিল সে বুঝি কুসুমকে মেরেই বসবে।

হাটতে হাটতে কুসুম আস্তে করে চেপে রাখা নিশ্বাসটা ছাড়ে। সে বুঝতে পারে সঙ্গের মেয়েরা তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। সে এসব পাত্তা দেয় না, ভাবতে চেষ্টা করে আব্বা আর মা এসব শুনে কি বলবে। সে স্কুলে শিখেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ কার মানুষের ধর্ম। অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করা উচিৎ নয়। সে এ বিষয়ে একটা ভাবসম্প্রসারণও পড়েছে। কুসুম নিজেকে প্রশ্ন করলো সে কি ভুল কিছু করেছে। সে এই গ্রামের অনেক দিনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। কেউ যদি শুধুই মজা করার জন্য এমন কিছু করে যাতে অন্যের জীবন নষ্ট হয় লেখাপড়া বন্ধ হয় তবে সেটা তো অন্যায়ই। তাই নয় কি? তবে কুসুম নিশ্চয়ই ঠিক কাজ করেছে।



কিছুদূর চুপচাপ হাটার পর একটা মেয়ে ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো। কুসুম বুবু, তোমার অনেক সাহস। তখন অন্যরাও বলে হ্যাঁ তার অনেক সাহস। এতদিন কোন মেয়ে যা বলতে পারেনি কুসুম তা বলে এসেছে। কুসুম তখন তাদের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলে কেন এতে সাহসের কি আছে। এতদিন ধরে এমন একটা অন্যায় চলে আসছে এই এলাকায় সেটা সবাই জানে কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে কোন প্রতিবাদ করে না। কেন তারা প্রতিবাদ করে নি? শুরু থেকে যদি এইসব মেয়েদের অভিবাবক এবং গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে প্রতিবাদ করতো এবং প্রতিকার করার চেষ্টা করতো তবে এরা এতটা বাড়তে পারতো না। মালা এতক্ষণ চুপ করেছিল সে বললো কিন্ত কুসুম, এরা খুবই খারাপ লোক যদি এরা তোর কোন ক্ষতি করে? তোকে এখন থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।



কুসুম বলে, দেখেছিস তোরা, আমি কোন অন্যায় করিনি কিন্তু আমাকে ভয়ে ভয়ে সাবধানে থাকতে হবে । কেন যে আরও আগে সবাই এদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়নি, এতগুলো মানুষ ক্ষেপলে এই কয়জন ছোকড়াই বা কি করতে পারতো? এই ছোকড়াদের বাপ ভাই ও তো কিছু করতে পারতো না।

স্কুল থেকে বাড়িতে যেয়ে খেতে বসেই কুসুম সকালের ঘটনাটা বর্ণনা করলো। সে জানে যে সেখানে উপস্থিত মেয়েদের মুখ থেকে খুবই দ্রুত এই ঘটনা পাড়াতে ছড়িয়ে পড়বে এবং সেখান থেকে পরিবারের সবার কানে আসবে। তার চেয়ে ভাল সে নিজে বলে দেয়। বকাবকি যা শুনতেহয় তা এখনি শুনে ফেলাই ভাল হবে। কুসুম আশা করেছিল তার মা অনেক বকবে কিন্তু সে লক্ষ্য করলো কথাগুলো শুনতে শুনতে তার মায়ের মুখ ধীরে ধীরে কালো হয়ে গেল, বাবাও বেশ গম্ভীর। তারা একে অন্যের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো। কুসুমের মনে হল সেই দৃষ্টিতে কিছু ভয়, কিছু হতাশা আর কিছু ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বাবা মার চেহারা আর তাদের সেই দৃষ্টি বিনিময় দেখে প্রথম বারের মত কুসুমের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো। সে প্রথম বারের মতো ভয় পেল। ঘুমানোর সময় সে দাদিকে জিজ্ঞাসা করলো, দাদি আমি কি ভুল কিছু করেছি? দাদি বললেন, নারে, ভুল না কিন্তু দিনদুনিয়া খারাপ। এখনতো ভাল কাজ কইরাও কোনো সুখ নাই বরং বিপদ আরো বাড়ে। এই সময় কুসুমের মা ঘরে ঢুকে তাদের কথা শুনে ফেলে এবং বলে, বহুত সাহসের কাম করছো তুমি কিন্তু এত সাহস দেখানো ভাল না। আর যেন না দেখি ঐ বেজন্মা পোলার সাথে কথা কইতে। দাদি বললেন, থাক ওরে আর বইকো না। তুমি যাই কউ পরীর মা কুসুম কামডা কিন্তু খুবই ভাল করছে। কত মাইয়া পড়া ছাইড়া দিল কিন্তু কুনোদিন কেউ প্রতিবাদ করবার পারে নাই। কুসুমের মায়ের চোখ হঠাৎ ছলছল করে উঠে তিনি বলেন, সবইতো বুঝি মা কিন্তু আপনি কি সবকথা ভুইলা গেছেন? কুসুমের দাদিও হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যান এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, না মা, ভুলি নাই কিছুই। কুসুম বুঝতে পারে না যে তারা কি নিয়ে কথা বলছে। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই কুসুমের মা তাকে বলেন, তোর আর কালকে থেকে স্কুল যাওনের কাম নাই। কয়দিন বাড়িতে থাইকা পড়। আগামী মাস থাইক্যা যাইস। কুসুম প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে কিন্তু তার দাদিও মাকে সমর্থন জানায়। এরপর আর তার কিছু করার থাকে না। একটা অক্ষম রাগে তার ভেতরটা পুড়ে যেতে চায় কিন্তু সেই রাগটা কার উপর সে ঠিক বুঝতে পারে না।





তারপর থেকে কয়েকদিন কুসুম বাড়িতেই কাটাচ্ছে। স্কুল প্রতিদিন তাকে হাতছানি দেয়। সামনে পরীক্ষা কতকিছু শেখা হত এই কয় দিন। কত যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তার পড়ালেখাতে তা শুধু সেই বুঝতে পারছে। তবুও ভাল যে মাকে বুঝিয়ে সে পরশু থেকে প্রাইভেট পড়তে যেতে পারছে। এই গ্রামেরই একলোকের বৈঠক ঘরে পাশের গ্রামের দুইজন অনার্স পাস বেকার ছেলে অংক আর ইংরেজী পড়ায়। তাদের গ্রামের প্রায় সব ছেলে মেয়ে সেখানে যায় পড়া শিখতে। সেদিন দুপুরের পর গোসল খাওয়া শেষে কুসুম বই খাতা নিয়ে বের হল। মালা না থাকায় সে আজকাল বেশ একা হয়ে গেছে। এখন তাকে একাই পড়তে যেতে হচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর শিপলু নামের ক্লাস থ্রিতে পড়া এক ছেলে তার সাথে যোগ দিল। এই ছেলেটাকে তার বেশ পছন্দ। দেখা হলেই কুসুম বুবু এটা কি? ওটা কেন? ইত্যাদি প্রশ্ন করে করে অস্থির করে তোলে। কুসুমও যথাসাধ্য চেষ্টা করে তার কৌতুহল মেটানোর আজও তারা কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। এই রাস্তা প্রাইভেট বাড়ির কিছু আগে একটা নির্জন বাঁক আছে। এদিকটাতে রাস্তার দুপাশে ঘন বাঁশ ঝাড় আছে। আশেপাশে বাড়িঘর নেই শুধু গাছপালা আর ঝোপঝাড় । শিপলু তখন আপন মনে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে, কিছুটা পেছনে কুসুম ঐ বাঁকটাতে আসতেই হঠাৎ বাঁশঝাড়ের মধ্যে থেকে তিন চার জন লোক বের হয়ে আসে এবং কুসুমের রাস্তা আটকিয়ে ধরে। শিপলু পেছনে তাকিয়ে দেখে বিপদ বুঝে দৌড় দেয়। কুসুম যেন আতঙ্কে পাথর হয়ে যায় যখন দেখে যে লোকগুলো আর কেউ নয় বরং রবিন শেখ এবং তার চ্যালাগুলো । কুসুম চেষ্টা করে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার কিন্তু একজন খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। কুসুম চেষ্টা করে হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালানোর তখন আর একজন তাকে জাপটে ধরে। সে তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু করে ফলে হাতের বইগুলো রাস্তার মাঝে ছড়িয়ে যায় এবং তার ওড়না খুলে পড়ে যায়। দুজন চেলা জোর করে তার দু হাত ধরে দাঁড় করিয়ে রাকে তখন রবিন শেখ এগিয়ে আসে এবং বলে, এই ছেমড়ি খুব সাহস তোর তাই না? খুব বড় বিদ্বান হতে চাস? আমারে ঠাট্টা করস ফেল করছি বইলা? আইজ তোরে বুঝায়া দিব মাইয়া মানুষ হইয়া বেশি ফাল পাড়লে কি হয়। কুসুমের বুকের মধ্যে ধরফর করতে থাকে। গলা শুকিয়ে আসে সে প্রাণপণে জোর লাগিয়ে হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিতে চেষ্টা করে, চেলারা চেষ্টা করে তাকে ধরে রাখার কিন্তু তার কিল, ঘুসি, আঁচড় আর ছটফটানির ফলে তা কষ্ট সাধ্য হয়ে যায়। তার পড়নের কাপড় কিছুটা ছিড়ে যায় এবং হাতের নখের দাগ বসে যায়। এই পর্যায়ে রবিন শেখ প্রচন্ড রেগে উঠে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় কুসুমের গালে। কুসুমের মাথাটা ঘুরে উঠে। এবার রবিন শেখ চ্যালাদের হাত থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার একটা চড় মারে। এবার কুসুম আর সহ্য করতে পারে না । চড়ের ধাক্কায় সে একদিকে কাত হয়ে হেলে পড়ে এবং একটা গাছে তার মাথা ঠুকে যায় প্রচন্ড জোরে। হঠাৎ কুসুমের চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায় এবং সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কুসুমের এই জ্ঞান হরিয়ে পড়ে যাওয়া বিশেষ করে তার মাথায় ক্ষত দিয়ে রক্ত বের হওয়া দেখে রবিন শেখ সহ সবাই ভড়কে যায়। তারা দ্রুত বাঁশঝাড় থেকে লুকিয়ে রাখা মোটরসাইকেল বের করে পালিয়ে যায়।





এদিকে শিপলু এক দৌড়ে প্রাইভেট পড়ার ঘরে হাজির হয় এবং সবাইকে জানায় কুসুম বুবু বিপদে পড়েছে। তার কথা শুনে বাড়ির ছাত্র ছাত্রী সহ অনেকেই এগিয়ে আসেএবং তারা কুসুমের জ্ঞানহীন দেহ আবিষ্কার করে।

কুসুমের জ্ঞান হওয়ার পর সে দেখে যে সে তার বিছানায় শুয়ে আছে। তারপাশে পরীবুবু আর দাদি চিন্তিত মুখে বসে আছে। কুসুমের হঠাৎই সব মনে পড়ে যায়। সে কেঁদে ফেলে আতঙ্কে। তার বুবু তাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দেয়। বাবা মা এসে তাকে শান্তনা দিতে গিয়ে কেঁদেই ফেলে। কুসুম বুঝতে পারে সময়টা রাত। তার মানে সে বেশ কয়েক ঘন্টা জ্ঞানহীন ছিল। কুসুমকে উদ্ধার করে দ্রুত গ্রামের ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার চিকিৎসা শেষে বলেছে বেশিকিছু হয়নি। শুধু কপালের ক্ষতটা ছাড়া। বেশ কিছু রক্ত গেছে তাই কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর ক্ষত সারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে কুসুম জানতো দেহের ক্ষত সারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। আসলে কোন কিছুই আর কখনো ঠিক হবে না।

সেদিন থেকেই কুসুম গৃহবন্দি। তার জীবনের সব হাসি আনন্দ সবই কোথায় যেন অদৃশ্য হয়েছে। কুসুমের সাথে হওয়া ঘটনার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেনি কেও। এ অঞ্চলে আসলে কারো এমন সাহস নেই যে শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ঘটনার পরদিন পরীবুবু বাবা মাকে বলেছিল কিছু একটা করার জন্য। বলেছিল বাবা আমার বেলায় মুখ বুজে থাকছো, আমারে পরের ঘরে দিয়া দিছ কিন্তু আমার ছোট বোনটারেও কি জীবনটা এমনে কইরাই নষ্ট করতে হইবো? বাবা ছল ছল চোখে উত্তর দিয়েছিল আল্লাহ তোর বাপরে বড়লোক বানায় নাই রে মা, তোর বাপের ক্ষমতা দেয় নাই। আমিই কি বাপ হইয়া সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারি? কিন্তু কি করবোরে মা, আমার কথা কে শুনবো? পুলিশও তো থাকে ওঁগো পকেটে। তোরা আমায় মাফ কর। এসময় মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছিল। বুবু আর দাদি দুজনের চোখেই ছিল পানি।



রাতে খাওয়ার পর কুসুম বুবুকে জিজ্ঞাসা করে, বুবু তোমার কি হইছিল? বাবাকে যে কি বললা তখন আমাকেও এখন বল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরী তার ছোটবোনকে তার জীবনের দুঃখের কাহিনী বলে। পরী এই পরিবারের বড় সন্তান। চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়ে জন্মানোর কারণে তাকে দেখা মাত্র দাদি নাম রেখেছিলেন পরী। পড়ালেখাতেও পরী ছিল কুমুমের চেয়েও ভাল। অনেক আগের কথা, কুসুমের যখন সাত-আট বছর বয়স তখন পরী এস এস সি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। শেখ পরিবারের সেজ ছেলে মতিন শেখের বয়স তখন পরীর বয়সের চেয়ে একটু বেশি। রূপসী পরীকে মতিন শেখের খুব মনে ধরে। সে রবিনের মত এত না হলেও বেশ বখাটে ছিল । মতিন পরীকে প্রেম পস্তাব পাঠায়, রাস্তায় পথ আটকে কথা বলার চেষ্টা করে। বাধ্য হয়ে পরী স্কুল যাওয়া ছেড়ে দেয়। তখন বাড়ির সামনে তার আনাগোনা শুরু হয়। ঢিলের সাথে চিঠি ছুড়ে মারতে থাকে জানালা দিয়ে। বিপদ বুঝে বাবা-মা তারাতারি পরীর বিয়ে দিয়ে দেন। মনের মত পাত্র খোঁজার সময়ও ছিল না। তাই অল্প লেখাপড়া জানা এক গরীব ঘরের ছেলের সাথে তার বিয়ে দেন। এভাবেই পরীর পড়ালেখা এবং স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এরপর থেকে পরী তার সংসার নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পরে যে অন্য চিন্তা করার সময় পায় না। পরীর বাবা জানতেন যে অমন ক্ষমতাবান ধরীর ছেলেরা ভালবাসার নামে গরীবের মেয়েদের জীবন নষ্টই করে, স্ত্রীর সম্মান দেয় না। যদিও নিজের মেয়ের অনেক উজ্জ্বল জীবনের স্বপ্ন ছিল তা তবুও বাধ্য হয়ে এই পথ বেছে নেন। তাতে নিজ সন্তানকে সচ্ছল না হোক অন্তত স্বাভাবিক আর সম্মানের জীবন তো দিতে পেরেছেন।

কুসুম বুঝতে পারে তার বাবা মা কেন প্রথম থেকে এত চিন্তিত ছিল ।রবিনের সাথে কথা বলার কথা শুনে তাদের আশঙ্কা ছিল প্রথম সন্তানের মত দ্বিতীয় সন্তানের জীবনেরও না ঝড় উঠে। এত সবধানতার পরেও বিপদ ঠেকানো গেল না। তার বরং পরীর চেয়ে বড় বিপদ হয়েছে। কুসুমের দম আটকে আসে এটা ভাবলে যে তারও কি পরীবুবুর মত অবস্থা হবে?



কুসুমের মাথার ক্ষত দিন দিন সেরে উঠে কিন্তু তার দিন কাটতে থাকে বাড়ির ভেতর। আরো বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় মা তাকে একদম চোখের আড়াল করতে চান না। তারও বাইরে বের হতে ইচ্ছে হয় না। স্কুলের কথা খুব মনে হয়। মনে হয় স্কুলের বান্ধবীদের কথা। সে তার গ্রামের কোনো বান্ধবীর বাসাতেও যায় না। যদিও এই গ্রামে যে বাড়িতে মেয়ে আছে সবাই ছোট বড় খারাপ পরিস্থিতির শিকার তবুও তার মত মারাত্বক অবস্থা কারো হয় নি কখনো। তাই সে যেখানে যায়, মানুষ কিভাবে যেন তাকায়। কেউ কেউ সহানুভিত প্রকাশ করে আবার কটু কথা বলতেও ছাড়ে না অনেকে। কুসুমের সবকিছু অসহ্য লাগে। সে কি করেছে?কার ক্ষতি করেছে? তবে সে কেন এভাবে কষ্ট পাবে?



পাশের বাড়ির অপুর মা ভীষণ ঝগড়াটে মহিলা। আগে থেকেই এই বাড়ির মেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে কটু কথা বলতো। এখন প্রায় দিনই মায়ের কাছে এসে বলে, পড়ালেখা যা করানোর করাইছো, এবার বাড়ির কাম শিখায়া তারাতারি মাইয়াটারে বিয়া দাও। আগেই কইতাম মাইয়া মানুষের অত বাইরে বাইরে ঘুরনের কাম নাই। তোমার মাইয়াগো যেমন নাক নকশা সুন্দর পুরুষ মাইনষের কুদৃষ্টিতো পড়বোই। এমন মাইয়াগো কচি বয়সে ভাল ঘর দেইখা বিয়া দিবা। ডাগর হইয়া উঠতে উঠতেই ঘরভরা পুলাপান হইয়া যাইবো। মাইয়াও সুখে থাকবো বাপ মাও নিশ্চিন্তে থাকবো। মাইয়াগো স্কুল কলেজে পাঠায়া লাভ কি? তারা একদিন করবো তো স্বামীর গোলামী, নাকি?এই পর্যায়ে কুসুমের মা বলে, দেখেন, আপনারা যদি ভাল ঘর পান তো ওর বাপে কথা কইয়া দেখুক। মহিলা বলে ওঠে, ভাল ঘর কি এখন আর পাওয়া যাইবো?তোর মাইয়ারও যেমন পুড়া কপাল, এখন কি আর ওরে কোন ভাল পুলায় নিতে চাইবো? তাও দেখি খোঁজ কইরা। তয় পরীর মা, একটা কথা কই, আমাগো আমিনুলরে তো তুমি চেনই। সে একখান মাইয়া খোঁজে বিয়ার জন্য। আমি তারে বইলা দেখি।



আমিনুলের কথা শুনে মা বজ্রাহত হয়ে তাকিয়ে থাকেন । তখন কুসুমের দাদি ঘরথেকে বলে ওঠেন, তোর কি রকম আক্কেল বউ?ঐ রকম একটা ঘাটের মরার সাথে আমাগো কচি মাইয়ার সম্মন্ধ করার কথা ভাবতে লজ্জা লাগল না? মহিলা বিনয়ের অবতার হয়ে বলে, চাচী আপনি রাগ করেন ক্যান। ঘাটের মরা কই? এই মোটে পয়তাল্লিশ বছর হইবো তার বয়স। এখনও কেমন জোয়ান। পুরুষ মানুষের একটু বয়েস বেশি হওয়াই তো ভাল। তাছাড়া কত বড় বাড়ি, কত জমিজমা। চালের ব্যবসায় টাকাও তো কম কামায় করে না। দাদি বলে, ক্যান তার আবার বিয়া করার সখ হইলো?প্রথম বউ মরার পর আর একটা না বিয়া করল, এইডাও কি মরছে নাকি? মাহিলা এক গাল হেসে বলেন, পুরুষ মানুষের সখ হইছে। বাড়ি ভর্তি পুলাপান। ঐ বউ সারাদিন কাজ কামেই ব্যস্ত থাকে তারও তো কিছু সেবা যত্ন লাগে তাই না? তাছাড়া ঐ বাউটার প্যাটে যেন টিউমার না কিসের অসুখ। দুই দিন পর পরই বিছানায় পইড়া যায়, ব্যাথায় উঠতে পারে না। তাই কইছিলাম তোমাগো মাইয়া দাও। আমিনুল তারে মাথায় তুইলা রাখবো। এই বউডাও যদি মইরা যায় তো তোমাগো কুসুমই তো হইবো মালিকিন, থাকবো একদম রাজরানীর মত।



কুসুমের মা নির্বাক হয়ে খালি শোনেন তবে দাদি বলেন, না অপুর মা, তা হয় না। সেই দিন আর নাই যে বাপের বয়েসি লোকের সাথে মাইয়ার বিয়া দিব। এখন কেউ আর তা করে না। মাইয়ার বয়েসের সাথে মানানসই কাওরে যদি পাও তো বইলো। মহিলা রেগে উঠে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, কেডা নিব তোমাগো ওই মাইয়া যার গায়ে পু্রুষ মাইনষের হাত পড়ছে? এই খানে বিয়া দিলে মাইয়াডা খাইয়া পইড়া বাঁচতে তো পারবো । আইজ রাস্তা থেইকা আপমান করছে কাইল ঘর ভাইঙ্গা নিয়া যাইব ঘরে বসাইয়া রাখলে। শেখের পোলার চোখ পড়লে কি নিস্তার আছে?পরীর বেলায় বুঝ নাই? মতিন হারামজাদা তো ভাইয়ের কাছে বিদেশ গেছে, কিন্তু আরেক হারামজাদা লায়েক হইয়া সারাডা দেশ জ্বালায়া মারতেছে। আর সাথের ঐ মেজ শেখের শালা দুইডা তো কুত্তার জন্মা। পরে মাইয়ার কুনো ক্ষতি হইলে কিন্তু কাইন্দা কুল পাবা না। আমার পরস্তাবডা ভাল কইরা ভাইবা দেইখো। এই বলে অপুর মা বিদায় নেন। কুসুমের মা আর দাদি বড় চিন্তায় পরে যান। কথাগুলো শুনতে যত খারাপই হোক একেবারে মিথ্যা তো না। এরপরে কুসুমের যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায়। তবে এই বলে আমিনুলের মত লোকের হাতেও তো মেয় দেওয়ার কথা ভাবা যায় না।



কুসুম ঘর থেকে সবই শুনতে পায়। তার কান্না পায় আবার রাগও হয় আবার জিদও হয় সেই সাথে হয় অভিমান। এই অভিমান কার উপর সে জানে না। এই অভিমান কি তার নিজের অসহায়ত্বের উপর, নাকি তার অক্ষম পরিবারের উপর,নাকি এই নিশ্চুপ সমাজের উপর, নাকি অভিমানটা সৃষ্টিকর্তার উপর কারন তিনি তাকে মেয়ে করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাকে সম্ভ্রম দিয়েছেন কিন্তু সেটা রক্ষা করার ক্ষমতা দেন নি। কুসুম পায়ে পায়ে পুকুর ঘটে এসে বসে। তাকে দেখে তার ছয় বছরের ছোট বোন পরুল দৌড়ে আছে। তার হাতে একরাশ কাদা, সে আবদার জোড়ে যে তাকে মাটি দিয়ে পুতুল আর খেলনা হাঁড়ি পাতিল বানিয়ে দিতে হবে।



পারুলের দিকে তাকিয়ে কুসুম ভাবে, এই যে ফুলের মত মেয়েটি পুতুল খেলায় মেতে আছে কিন্তু জানে না যে সে দিন দিন বড় হচ্ছে। এখন হাসি গানে ডুবে আছে বটে তবে সামনেই আছে কঠিন বাস্তব যেখানে সমাজ, নিয়তি এবং পুরুষ তাকেই পুতুল বানিয়ে খেলবে।



শেষ পর্যন্ত কুসুমের যেটা ভয় ছিল সেটাই হলো। বাবা মা মনে হয় শেষ পর্যন্ত তাকে আমিনুলের হাতে তুলে দেয়াই মনস্থির করেছে। আট দশ দিন ধরে অপুর মা প্রতিদিন বাড়িতে এসে বাবা মাকে বাজি করানোর চেষ্টা করে। প্রথমে অনড় অবস্থানে থাকলেও মনেহয় শেষ পর্যন্ত তাদের মনে ভয় আর সন্দেহ ঢুকেছে। আজ বিকেলে আমিনুলও এসেছিল তাদের বাড়িতে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে। কুসুম দেখেছে আসলেই সে কুসুমের বাবার বয়েসি। তার সাথে বিয়ের কথা ভাবলেই কুসুমের বমি উদ্রেককারী একটা অনুভুতি হয়। কুসুম তো এমন জীবন চায়নি। তবে সে কিভাবে মেনে নেবে অশিক্ষিত আধবুড়ো আমিনুলকে? এই গ্রামেরই সরকার বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই শিক্ষিত। গ্রামে এসে সরকার বাড়িতে দাদির সইয়ের কাছেই এই পরিবারটি আশ্রয় পেয়েছিল তাই তাদের সাথে খুবই ভাল সম্পর্ক কুসুমদের।

দাদির সইয়ের ছোট ছেলে আর ছেলের বউ দুজনই চাকরি করে। শহরে তাদের কি সুন্দর ছিমছাম গোছানো সংসার। দাদির চোখের অসুখ হলে ডাক্তার দেখাতে কুসুম দাদির সাথে বউটির বড়িতে তিন দিন ছিল। কি সুন্দরই না জীবন তাদের। তাদের মধ্যে কি সুন্দর সম্পর্ক আর দুজনের প্রতি দুজনের কি সম্মান এবং ভালবাসা। বউটি একদম পরীবুবুর বয়েসি আর কুসুমের সাথে তার কত ভাব। বউটি কুসুমকে বাজারে নিয়ে একটা জামা কিনে দিয়ে বলেছিল, দেখেছিস কুসুম আজ আমি চাকরি করি বলেই তোকে নিজের উপার্জনের টাকায় কিছু কিনে দিতে পারলাম। দুজনের আয় আছে বলেই এত সুন্দর করে সংসারটা গোছাতে পেরেছি। নিজের বাবা মাকে হাত খরচ দিতে পারি। ঈদের সময় নিজের টাকায় সাবার জন্য কাপড় কিনতে পারি আবার যখন যাকে যা ইচ্ছা হয় কিনে দিতে পারি। চাকুরি না করলে কি এতসব করতে পারতাম? তোকেও আমার মত হতে হবে তাহলে দেখবি জীবনটা কত সুন্দর।

হ্যাঁ কুসুমের স্বপ্ন ছিল এমনি একটা সংসারের। সে অনেক পড়ালেখা করে শিক্ষত হবে তারপর শিক্ষিত একটা ছেলের সাথে তার বিয়ে হবে। তারপর তারা দুজনে মিলে সুন্দর একটা জীবন গড়বে। কিন্তু ঐ আমিনুলকে বিয়ে করলে তার ইচ্ছার কিছুই পূর্ণ হবে না। আজ রাত খাওয়ার পর মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমিনুলের ব্যাপারে কি করবেন বইলা ঠিক করছেন? খুঁইজা তো দেখলেন ভাল পাত্র তো পাওয়া গেল না। এখন এরা রাজি আছে কিন্তু পরে যদি না থাকে? কুসুমের বাবা অসহায়ের মত বললেন, পরীর মা, কি কইরা আমি কুসুমরে ঐ ব্যাটার হাতে তুইলা দি। ওর বয়স তো আমার চাইতেও বেশি। কুসুমরে বয়সের তো ওর কয়ডা পোলাপাইনও আছে। এই বলে বাবা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন। মাও আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেন না। আড়াল থেকে কুসুম এই দৃশ্য দেখে। সে বুঝতে পারে তার বাবা মা ভীষণ দোটানায় পড়ে গেছে তাকে নিয়ে। হঠাৎ তার মনে হয় এই বিপদ থেকে বাবা মাকে সে মুক্তি দিতে পারে। সে নিজেকেও মুক্তি দিতে পারে।

হ্যাঁ, তাহলে কুসুম তাই করবে। তাহলে সমস্ত লজ্জা অপমান আর দুঃখ নিমেষেই গায়েব হয়ে যাবে। তাই যখন রাতে সবাই ঘুমে বিভোর তখন কুসুম সবার অলক্ষ্যে চুপিচুপি বাইরে বের হয়ে এসেছে। আসার আগে তার নিজের প্রিয় বাক্সটা পারুলের মাথার কাছে রেখে এসেছে। এই বাক্সে কুসুম রাখে তার ছোট বেলার পুতুল, রঙ্গীন পেনসিল, কাচেঁর চুড়ি আর পুতির মালা। পারুলের খুব লোভ ছিল বাক্সটার উপর, সে বলতো বুবু তোর যখন বিয়ে হবে তখন আমাকে এটা দিয়ে দিবি। তাই কুসুম একরাশ স্নেহ আর আর্শিবাদের সাথে বাক্সটা রেখে এসেছে ঘুমন্ত ছোট বোনটির শিয়রে। তারপর সবই ঠিক ছিল কিন্তু সবকিছু গোলমাল করে দিল ঐ পূর্ণ চাঁদ।

কুসুমের মনে হাঠাৎ করে একটা প্রশ্ন জেগে উঠে। সে কেন ? তার কি অপরাধ? কেন সে এত মায়ায় ভরা পৃথিবী থেকে অকালে বিদায় নিবে? কেন তার বাবা মা এভাবে আকুল হয়ে কাঁদবে? কেন তারই স্বপ্ন ভাংবে? কেন সে মর্যাদা সম্পন্ন মানুষের জীবন অর্জনের চেষ্টাও করতে পারবে না? সে চলে গেলেও চাঁদ সূর্য উঠবে ,ঋতু বদলাবে। আর ঐ নরকের কীটরা ফুলের মত সুন্দর জীবন গুলোকে নষ্ট করতে থাকবে। কি দোষ ছিল মালার? আজ তার বিয়ে হয়ে গেল দূরের গ্রামে এক লোকের সাথে। অথচ তার কত ইচ্ছা ছিল বাবা মার কাছে থাকার। সে বলতো জানিস আমার মায়ের একটা ভাল শাড়ী নাই। যখন আমি উপার্জন করবো তখন মাকে অনেক নতুন নতুন ভাল শাড়ী কিনে দিব। কুসুমের মনে পড়ে পারুলের কথা। কাল মালার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য যখন কুসুম ওকে গাঁধা ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল এতগুলো ফুলের মাঝে পারুলও যেন একটা ফুল। কুসুম তো মরে যাবে কিন্তু পারুল একদিন বড় হবে। তখন ঐ শেখের ছেলেরা তারও জীবন নষ্ট করবে। যেমনটা পরীবুবুর বেলায় করেছে, যেমনটা তার বেলায় করছে। এই গ্রামে আরো কত মেয়ে আছে। কেউ কি নিরাপদ থাকবে এদের হাত থেকে?



কুসুমের মনে হয় মৃত্যু যদি হয় তবে এদের হওয়া উচিৎ। কুসুম যদি মরে তবে একা মরবে কেন? এদেরকে সে আগে শেষ করবে। তারপর এমনিতেও তার ফাঁসি হয়ে যাবে। তাতে অন্তত গ্রামটা মুক্ত হবে কিছু জঘন্য কীটের হাত থেকে। হ্যাঁ কুসুম তাই করবে এবার। সে তার আত্মদান বৃথা যেতে দিবে না। এটাকে অর্থহীন হাতে দেবে না। কুসুম আর আত্মোউৎসর্গ অর্থপূর্ণ করে যাবে।



কুসুম মনস্থির করে উঠে দাঁড়ায় এবং গ্রামের ফসলের মাঠের দিতে হাঁটতে থাকে। সেখানে শেখের ছেলেরা বাশেঁর বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা ঘর তুলেছে। সেটাই তাদের যত কুকর্মের আস্তানা। সেখানে তারা সারাদিন তাস আর জুয়া খেলে। রাতে মদ গিলে প্রায়ই সেখানে পড়ে পড়ে ঘুমায়। মাঝে মাঝে খারাপ মেয়ে মানুষও নিয়ে আসে বলে শোনা যায়।

নিশি পাওয়া মানুষের মত হাটতে হাটতে কুসুম সেখানে পৌছে যায়। ঘরের একমাত্র জানালা দিয়ে সে দেখে ঘরের মাঝে একটা চৌকিতে রবিন শেখ বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরের কোণে খড়ের বিছানা। সেখানে মেজ শেখের দুই শালা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুমে মগ্ন। একজনের হাতে তখনো ধরা আছে মদের বোতল। কুসুম বুঝতে পারে এরা মাতাল হয়ে প্রায় বেহুশের মত ঘুমাচ্ছে। সহজে এই ঘুম ভাঙবে না। সে ভাবে যদি সে ভেতরে যেয়ে রবিন শেখের গলা টিপে ধরে তাকে কি খুন করতে পারবে? কিন্তু এতবড় একটা পুরুষকে গলাটিপে মারা তার মত মেয়ের পক্ষে সম্ভব না। হঠাৎ তার নজর যায় ঘরের জ্বালিয়ে রাখা কেরোসিনের কুপির উপর। বড় একটা খোলা বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে খড়ের বিছানার কাছে। এক শালার হাত কুপির খুব কাছে এসে পড়েছে। এমনিতে বাঁশের বেড়ায় খড়ের চাল দেয়া ঘর তার উপর শুকনো খড়ের বিছানা। এরা এত অসাবধান যে এটা হারিকেনও রাখতে পারে নি। ঘুমের মধ্যে যদি এখন সে পাশ ফিরে তাহলেই কুপিটা উল্টে পড়ে আগুন ধরে যাবে।



হঠাৎই কুসুমের মনে হয় এটাই এখন একমাত্র পথ। সে খুব সাবধানে বাইরে থেকে দরজার শেকলটা তুলে দেয় যাতে কেউ বের হতে না পারে। এরপর একটা লম্বা লাঠি জোগার করে জানালা দিয়ে কুপিটা উল্টে দেয়। তেলগুলো ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে, সেই সাথে আগুনটাও। খুব দ্রুতই সেটা খড়ের বিছানা স্পর্শ করবে। কুসুমের মন এখন পাথরের মত শক্ত। সেখানে শুধু প্রতিশোধের জ্বালা, তার মনে একটুও অনুশোচনা নেই। এই তিন জনের মৃত্যুতে তার একটুও দুঃখ হবে না। কুসুম একবারও ভাববে না যে ঘরে আগুন ধরলেও এবং দরজা বন্ধ থাকলেও এরা বের হতে পারবে। কারণ শক্ত সমর্থ পুরুষের জন্য আধপোড়া বাশেঁর বেড়া কোনো বাধা নয়। গভীর ঘুমে থাকার ফলে হয়ত আগুন অনেকটা ধরে গেলেও তারা বুঝতে পারবে না। হয়তো তারা মারাত্বক আহত হবে। হয়ত কেউ পঙ্গু হয়ে এলাকা থেকে বিদায় নেবে। কিন্তু তাদের মৃত্যু হওয়াটা এত সহজ হবে না।



কুসুম যেন কেমন ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সে তার বাড়ির দিকে হাটতে থাকে। তার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। এই প্রশান্তিটা শোধের। তার পেছনে তখন আগুনের লেলিহান শিখা দাও দাও করে জ্বলে উঠেছে। আকাশের পূর্ণ চাঁদ তখনো আলোকিত করছে চরাচর ।পুকুর ধারে এসে কুসুম তার ওড়না বাঁধা গাছের দিকে তাকায়। ওড়নায় বাঁধা ফাঁসের দিকে তাকায়। কুসুমের মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠে। তার চোখর সামনে অন্ধকার হয়ে যায়, সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে আর সেই পূর্ণচাঁদ গভীর মমতায় মেয়েটিকে দেখতে থাকে। সে গভীর স্নেহে তাকে ঘিরে জোসনার ঝর্ণা বর্ষন করে। যেন এই জোসনার আলো দিয়েই সে মেয়েটির জীবনটা আবার আলোকিত করবে।



লেখকের কথাঃআজ থেকে দেড় দুই বছর আগে এদেশে খুব ইভটিজিং এর প্রকোপ বেড়েছিল।সারাদেশে বেশ কিছু কুসুমের বয়সি মেয়ে তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল।খবরগুলো শুনলে বুকের মধ্যে অক্ষম ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠত।এই লেখাটা তখনই শুরু করি।আমারও ঠিক তাদের বয়সের একটা বোন আছে।আমি তাকে ভা্লবাসি।চাইনা তার সাথেও এমন কিছু হোক।তার অমঙ্গল আশঙ্কায় আতংকের মাঝে থাকি।আমার এই লেখাটা উতসর্গ করছি অকালে চলে যাওয়া সেইসব অভিমানী মেয়েদের এবং সেইসব মেয়েদের যারা প্রতিনিয়ত ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১:৫৭

হু বলেছেন: একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির মতো হয়ে :D :D :D :D গেল না ?? আপনার আগের গল্প গুলো ভাল ছিল তাই সেই আশা নিয়ে পড়েছিলাম । কিন্তু এইবার আমি হতাশি

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ২:০৯

সন্ধ্যা প্রদীপ বলেছেন: আসলে ইভটিজিং নিয়ে কোনো বাংলা ছায়াছবি হয় না তো তাই একটা কাহিনী সাপ্লাই দিলাম।

মনের মাঝে আশা,যদি আমার গল্প নিয়ে কোনো ছায়াছবি তৈরী হয়ে যায়!!!!!!!!!!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।আশা করি পরে কিছু লিখলে এমন হ্তাশ হতে হবে না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.