নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি লেখালিখি করি, মনের মাধুরী মিশিয়ে
''এমনকি যদি শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবুও আত্মহত্যা করতে পারবে না তুমি। সে তিন বছর লাগুক কি পাঁচ বছর, যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা তোমার জন্যে ফিরে আসবোই। সেই পর্যন্ত, যতক্ষণ তোমার সাথে একজন হলেও সৈনিক আছে, তুমি তাকে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে।
তোমাকে হয়তো শুধু নারকেল খেয়ে বেঁচে থাকতে হতে পারে, যদি তা-ই, হয়, তোমাকে সেটা খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে। কোন পরিস্থিতিতেই তুমি নিজের প্রাণ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিতে পারবে না।''
এটাই ছিলো হিরু ওনোদা'র কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশ। আর এই নির্দেশ পালন করতে গিয়েই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণের ২৯ বছর পরেও তিনি যুদ্ধ করে গিয়েছেন ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপের গভীর অরণ্যে।
যখন ওনোদার ২০ বছর বয়স, হঠাৎ একদিন সেনাবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ আসে তার উপর। সে সময় তিনি একটি জাপানী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছিলেন। নির্দেশ পেয়েই তিনি চাকরী ছেড়ে দিলেন, এরপর যোগ দিলেন সামরিক প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণের সময় তার এক বিশেষ দক্ষতা চোখে পড়ে উপরমহলের, সেনাবাহিনী'র ইনফেন্ট্রি বিভাগ থেকে বদলি করে তাকে গোয়েন্দা বিভাগে পাঠানো হয়।
সেইখানেই তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিভাবে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে খবর সংগ্রহ করতে হয়। সেই সাথে প্রশিক্ষণ চলে গেরিলা যুদ্ধবিদ্যার। এর সাথে সাথে তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেন কিভাবে শত্রুবাহিনী'র পিছনে গিয়ে ছোট্ট একদল সৈন্যেদলের সাহায্যে শত্রুসেনাদের বিপর্যস্ত করে দিতে হয়।
যথাযথ প্রশিক্ষণ শেষে জাপানী রাজকীয় সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান ওনোদা। ১৯৪৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর, বিশেষ সেই দায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠানো হয় ফিলিপাইনের ঐ দ্বীপে।
ওনোদা দ্বীপে গিয়েই জাপানী সৈন্যদলের সাথে যোগাযোগ করে কাজ শুরু করে দেন। কিন্তু, বিধি বাম। তিনি দ্বীপে নামার কিছু দিন পরেই, মিত্রবাহিনী'র সৈন্যরা সেখানে আক্রমণ করে। পরাজয় মেনে নিয়ে বেশির ভাগ জাপানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে বসে। বাকিদের কিছু মারা পড়ে, আর কিছু ৩-৪ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গভীর অরণ্যে লুকিয়ে পড়ে।
এমনই এক দলের নেতৃত্ব দিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন ওনোদা। এই ছোট ছোট দলগুলো'র বেশির ভাগই শত্রুবাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু, ওনোদা আর তাঁর দলের তিনজনকে ধরতে ব্যর্থ হয় মিত্রবাহিনী। এই চারজনের দলটি শত্রুর ঘুম হারাম করে দিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৪৫ সালের অক্টোবার মাস,একটি ঐ দ্বীপের একটি ফার্মে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে অভিযান চালাতে গিয়ে একটি লিফলেট হাতে পায়। তাতে লেখা- ''যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে অগাস্টের ১৫ তারিখে। তোমরা পর্বত থেকে নেমে আসো।''
দলটি বনে ফিরে গিয়ে অন্যান্য দলের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌছালো যে, এটা নির্ঘাৎ শত্রুদের পাতা ফাঁদ। জাপান এতো তাড়াতাড়ি যুদ্ধে হেরে গিয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস হলো না। আসলে তাঁদের জানার কথা নয় যে, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আনবিক বোমা ফেলা হয়েছে। এছাড়াও, মাত্র কয়েক দিন আগেই তাদের একটি দলের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিলো।
সেই বছরের শেষের দিকে, গেরিলা বাহিনী'র অনবরত আক্রমনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠায় স্থানীয় অধিবাসীদের অনুরোধে একটি বি-১৭ বিমানে করে পুরো জঙ্গলে আবারো আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে লিফলেট ফেলা হয়। এবারে ঐ লিফলেটে স্বাক্ষর করেন জাপানী রাজকীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ইয়ামাশিটা। কিন্তু, এবারেও গেরিলা দলগুলো আত্মসমরপনে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, লিফলেটের ভাষানুযায়ী জাপানের পরাজয় সংবাদ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলো না। তাই তাদের মনে হলো, এটা শত্রুবাহিনী আরেকটি চাল।
তাদেরকে আত্মসমর্পণের চেষ্টা এবারেও ব্যর্থ হলে, জাপানের সংবাদপত্র, গেরিলা সৈন্যদলের পরিবারের ছবি ও চিঠি জঙ্গলে আবারো ফেলা হলো। উদ্দেশ্য তারা যেন জানতে পারে যে জাপান সত্যিই যুদ্ধে হেরে গিয়েছে। কিন্তু, প্রতিটি বারেই গেরিলা দল লিফলেটগুলোতে কিছু না কিছু খুঁত বের করে ধরে নিলো এগুলোও শত্রু বাহিনী তাদের ধরার জন্যে করেছে।
এমনকি যুদ্ধের অনেক বছর পরও যখন স্থানীয় কোন মানুষ জঙ্গলগুলোর কাছে আসতো, তখনো গেরিলা দল মনে করতো এটা এই মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদেরকে ধরতে আসার কোন চাল। তাই, তারা এই মানুষদের উপরও গুলি ছুড়তো।
এভাবেই একদিন, পাঁচ বছর পর, ওনোদার ছোট্ট গেরিলা দলের একজন আত্মসমর্পণ করলে ওনাদা আরো সাবধান হয়ে যান। তারা বনের আরো গহীনে নিজেদের লুকিয়ে ফেলেন।
তারও পাঁচ বছর পরে, ওনাদার আরেক সঙ্গী স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়ে মারা যান। এবারে, বাকি থাকলো মাত্র দুইজন- ওনাদা নিজে এবং কজুকা।
এরপর, ১৭ বছর ধরে এই দু'জন জঙ্গলের থেকে 'শত্রুবাহিনী'-র যথাসম্ভব ক্ষতিসাধন করে যেতে লাগলেন। সেই সাথে চললো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো যদিবা কখনো জাপানী সৈন্যদল ঐ দ্বীপে আসে, তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ করে তোলা। যেহেতু, ওনোদার কমান্ডিং অফিসার কথা দিয়েছিলেন, যে করেই হোক তারা ফিরে আসবেন তাদের জন্যে, গেরিলা দল তাই যুদ্ধ চালিয়ে যায় মাটি কামড়ে।
অক্টোবর, ১৯৭২ সাল। ২৭ বছর লুকিয়ে থাকার পর, কজুকা ফিলিপিনের এক পেট্রোল দলের সাথে লড়াই-এ নিহত হোন। কজুকার মৃতদেহ পেয়ে এবারে জাপান সরকারের টনক নড়ে। তাদের মনে পড়ে যায় ওনোদার কথা। হয়তো তিনি এখনো বেঁচে আছেন! যদিও, অনেক আগেই তাঁকে মৃত ঘোষনা করা হয়েছিলো। তাঁকে খোঁজার জন্যে একটি তল্লাসী দল পাঠানো হয় ঐ দ্বীপে। উদ্দেশ্য, যদিবা তাঁকে পাওয়া যায়। কিন্তু, ওনোদা ধরা দিলেন না। যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন এরপরও।
শেষ পর্যন্ত, নারিও সুজুকি নামের এক কলেজ ছাত্র, সিদ্ধান্ত নিলো সে নিজে একবার চেষ্টা করে দেখবে। ওনোদার খোঁজে সে বনে একা ঘুরতে লাগলো। এক পর্যায়ে, সে ওনোদার যে জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন, তা বের করে ফেললো। সেই সাথে দেখা পেলো ওনোদারও। সুজুকি তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, অনুরোধ করলো আত্মসমর্পণের। কিন্তু, ওনোদা এবারেও অস্বীকৃতি জানালেন।
ব্যর্থ হয়ে সুজুকি ফিরে গেলো জাপানে। গিয়ে জানালো ওনাদার সাথে সাক্ষাতের কথা। মেজর তানিগুচি, ওনোদার কমান্ডিং অফিসার তখন চাকরী থেকে অবসর নিয়ে একটি বইয়ের দোকানে কাজ করছেন। সব শুনে তিনি নিজে গেলেন সেই দ্বীপে ওনোদার সাথে সাক্ষাৎ করতে। গিয়ে নির্দেশ দিলেন আত্মসমর্পণের।
১৯৭৫ সালের মার্চের ১০ তারিখ। ওনোদার তখন ৫২ বছর বয়স। পুরো ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফারদিনান্ড মার্কোসের নিকট নিজের সামুরাই তলোয়ার জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট তাঁকে ক্ষমা করে দিয়ে জাপানে পাঠিয়ে দেন।
জাপান তাঁকে বীরের বেশে বরণ করে। কিন্তু, এ কোন জাপান! ওনোদা যে জাপানকে চিনতেন এতো সে জাপান নয়! সব কিছু বদলে গিয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে। বেশিদিন থাকতে পারলেন তাই। পাড়ি জমালেন ব্রাজিলে। সেখানেই, তিনি বিয়ে করলেন। সেখানেই থেকে তাঁর আত্মজীবনী No Surrender, My Thirty-Year War বেরোয়।
১৯৮০ সালের দিকে, যখন এক জাপানী তরুণের হাতে পিতা-মাতার মৃত্যু সংবাদ শুনলেন, ওনোদা বুঝলেন জাপানের অবস্থা ভালো নয়। তরুণ সমাজ বিপথে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, ১৯৮৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন, কিভাবে কঠিন পরিস্থিতেও বেঁচে থাকতে হয়, তার উপর একটি প্রশিক্ষণ স্কুল। সেখানেই জাপানের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে থাকেন তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি খালি করে।
১৬ জানুয়ারী, ২০১৪ সালে ৯২ বছর বয়সে মারা যান এ মহান সৈনিক।
====
২য় প্রকাশ
=======
২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:১৭
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
হা, হা, হা! বেচারাকে বেকুব বলছেন কেন!
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
২| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:২৮
সোনাগাজী বলেছেন:
জাপানে বেকুবের সংখ্যা খুবই কম; জাপানীরা যুদ্ধ শেষ করে, হিরোশিমায় নতুন নগর গড়েছে, নাগাসিকায় উন্নত শিল্প স্হাপন করে বিশ্বে বড় জাতি হয়েছে, আর বেচারা ফিলিপাইনের জংগলে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে!
২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:৩১
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
কমান্ডিং অফিসার তাঁর কথা ভুলে গিয়েছিলেন। এতে তাঁর দোষ কোথায়!
ধন্যবাদ নিরন্তর।
৩| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৯:০৫
জ্যাকেল বলেছেন: উনার ব্যাপারটা এই ব্লগেই কার ব্লগে যেন পড়েছিলাম। ভালই টাচ করেছিল মনে। এখনো টাচ করে। এইরকম লয়াল হওয়া-ই উচিত।
২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৯:২৯
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
সামুতে আমিই প্রথম তাঁকে নিয়ে লিখেছিলাম, মনে হয়। ১৯১৭ সালে।
ধন্যবাদ।
৪| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৯:৫১
হাসান কালবৈশাখী বলেছেন:
ঘটনাটা মনে পড়েছে।
অনিদার ছবি দিয়ে নিউজউইক প্রচ্ছদ করেছিল। সাপ্তাহিক বিচিত্রাতেও এ কাহিনী পড়েছিলাম।
২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৫৯
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
তাঁর কাহিনী জেনে আমি সত্যিই অভিভূত।
ধন্যবাদ নিরন্তর।
৫| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:২৩
জ্যাকেল বলেছেন: লেখক বলেছেন:
সামুতে আমিই প্রথম তাঁকে নিয়ে লিখেছিলাম, মনে হয়। ১৯১৭ সালে।
২০১৭?
২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১১:০০
সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন:
জী, ২০১৭ সালে। যত দূর মনে পড়ে।
ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:১০
সোনাগাজী বলেছেন:
জাপানেও বেকুব মানুষ ছিলো।