নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুরুব্বীতন্ত্র অগ্রহণযোগ্য এবং কৃতিত্ব নিয়ে বড়াই-লড়াই লজ্জাজনক

২৮ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৪৫

সংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত হয়েছে আত্মসমালোচনা, আত্মসংস্কার এবং আত্মশুদ্ধি। জুলাই অভুত্থ্যানের মর্যাদাকে খাটো করার প্রক্রিয়া চলছেই।সাথে কম বয়েসী এই নতুন নেতৃত্বের উপর নানা মুরুব্বীগিরি। কিভাবে দেশ উদ্ধার করা যায়, চোখের সামনে যারা আমাদের করে দেখিয়ে দিয়েছে, তারা জাতির নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতার সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ! তারাই এখন জাতির নেতৃত্ব দেবে! রিকশাওয়ালা ভাইয়ের অবিস্মরণীয় স্যালুট মনে রাইখেন। তারা এই অরুণ-প্রাতের তরুণের দলকেই স্যালুট দিয়ে জনগণের আস্থা জানিয়ে দিয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক, অপদার্থ, বাতিল টেপ রেকর্ডার বুইড়া ব্যাটাদের ঘণ্টা বাজায়ে দেয়া হয়েছে।

একটি অনির্বাচিত সরকার কর্পোরেটদের সাথে অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বুদ্ধিজীবী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আমলাতন্ত্র, পার্লামেন্ট, বিচারবিভাগ, মিডিয়াসহ রাষ্ট্রের সকলযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে গত ১৫ বছর ধরে সর্বসাধারণকে যে এক দানবিক শাসনের অধীনস্ত করে রেখেছিল, তা থেকে কবে কিভাবে মানুষ মুক্ত হবে, কোন পথ যখন স্পষ্ট ছিল না, তখনই ঘটেছে অবিশ্বাস্য জুলাই অভ্যুত্থান। অগাস্টের ৪ তারিখ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও আমরা জানতাম না যে, রাজপথে সংগ্রামরত এই কিশোর-তরুণেরা কি আরও দীর্ঘায়িত কোন গণহত্যার মিছিলের মধ্যে ঢুকছে? আরও গুম-খুন-নির্যাতন-গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে যাবে? ঘরে ঘরে আরও আরও কান্নার রোল উঠতে থাকবে? আরও গণকবর খোঁড়া চলবে? নাকি সত্যিই আমরা এই অভিযাত্রায়ই এক নারকীয় রাষ্ট্র থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারব? যখনই সেই সময়টা মনে হয়, তখন আজকের এই সময়টার জন্যে খোদাতালার কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।যে পনের শতাধিক থেকে দুই হাজার বাচ্চা-কিশোর-তরুণকে প্রকাশ্য রাজপথে সরকারী গুলি খরচ করে হত্যা করা হল, দেশের যে কুড়ি হাজার আহত সন্তান হাসপাতালে, ঘরে ঘরে এখনও কাতরাচ্ছে, তাদের প্রতি আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস কৃতজ্ঞ।

আমার পড়তে লজ্জা লাগে যে, সামান্য কয়েকটা শব্দের ব্যবহার, কার কৃতিত্ব কমবেশি এই রকম পেটি, হীন ধরণের বিতণ্ডা চলছেই।প্রধান উপদেষ্টা কবে কোথায় এক উচ্ছ্বাসে কাকে একবার মাস্টারমাইন্ড বলে ফেলেছিলেন, ৩৬ দিনের অবিস্মরণীয় এই সংগ্রামকে তাদের মিটিকুলাস প্ল্যান বলেছেন, তা নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে ইনফ্লুএন্সারদের মধ্যে আজ অব্দি গুরুত্ব, কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব, নিয়ে হরেক রকম ইন্সিকিউরিটি বেরিয়ে আসছে। কি লজ্জা!

তরুণরাই সব সময় পৃথিবীকে বদলে দিলেও, দুনিয়ার নিকট কালের জানা ইতিহাসে জুলাই অভুত্থ্যানের মত এমন দীপ্ত, ক্ষিপ্র, দুর্ধর্ষ, চিন্তাশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক যৌথ সম্প্রদায়ের সংগ্রামের একটিও নজীর নাই।গভীর অন্ধকার থেকে জাতিকে তারা বিস্ময়করভাবে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।যা আগে কখনও হয় নাই, তা শেখাও সম্ভব নয়।তাই, এই জিনিস আগে থেকে শিখে, ট্রেনিং নিয়ে, প্র্যাকটিস করে করবার কোন সুযোগও থাকা সম্ভব নয়।বরং, স্কুলে-কলেজে তোতা পাখির মত যে শিখানো বুলি তাদের উপর জবরদস্তি করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো, সেই ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণযোগাযোগ, সমরকৌশল, গোয়েন্দাবিদ্যা, ভূ-রাজনীতি, সাহিত্য ও ভাষার রাজনীতি - সব ওরা লন্ড-ভণ্ড করে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন জ্ঞানকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে।আমরা সেটা এখনও শিখছি, বোঝার চেষ্টা করছি, আয়ত্ব করবার চেষ্টা করছি। কারো কাছে ওদের যোগ্যতায় পরীক্ষা দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই আর। ওরা জাতির সামনে অনন্ত সম্ভাবনার রুদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছে!

বিদেশে বসে যত ভিডিও পাওয়া যায়, দেখি। এই তাজা তরুণের হয়ত ঘরে বাজারও করতে শেখে নাই, সংসার কিভাবে চলে, কিভাবে আয়-রোজগার করতে হয়, বিল দেয়া হয়, জানে না।রাস্তায় যে বাচ্চারা যুদ্ধ করেছিলো, এরা নিজেরা নিজেরদের ভাত রান্না করে খেতে শেখেছিল কিনা সন্দেহ।এরা মায়ের হাতের ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো। অভূত্থ্যান শেখার সুযোগ তাদের কোথায় ছিল? কে তাদের গুলির সামনে মরতে শিখিয়েছিল? তারা কি এর আগে সরকার চালিয়েছে? ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে, ডাকাত পাহারা দিয়েছে? মসজিদ-মন্দির-মাজার পাহারা দিয়েছিল? স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ বন্যায় দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা করেছে? এই দুনিয়াদারি শেখে নাই বলেই হয়তো, মৃত্যুর মুখে এতো সহজে দাঁড়াতে পেরেছিল, ভাইয়ের লাশ, বোনেদের রক্তাক্ত ছবি দেখে আর ঘরে থাকতে পারে নাই, চিঠি লিখে বেরিয়ে গেছে।বন্দুকের গুলির সামনে তারা রাস্তায় ভাইয়ের লাশ ফেলে চলে যায় নাই! মানবিক মর্যাদার সাথে তারা আমাদের মত আপোষ করতে শিখে উঠে নাই। এই অপূর্ব সুন্দর মনুষ্যত্ব তাদের কোন স্কুলে, কে শিখিয়েছিল?

এখন যে দুইজন তরুণ উপদেষ্টা সরকারে আছেন, আর যারা সরকারের বাইরে থেকেও কাজ করছেন, তারা এই রাস্তার সংগ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন। আমি হলফ করে বলছি, জ্ঞানঅর্জনের জন্যে রাজপথের এই সংগ্রামের রাস্তার চাইতে শ্রেষ্ঠ কোন বিশ্ববিদ্যালয় দুনিয়াতে নাই!
তারা যখন লড়ছিলেন, দূর থেকে মায়ের উৎকণ্ঠা নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমরা দেখছিলাম ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত বাচ্চাদের ইস্পাত দৃঢ় সংকল্প, অক্লান্ত পরিশ্রম, অজেয় সাহস, ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে লড়াইয়ের দুঃস্বপ্নের দিনগুলো।তারা শুকনা বিস্কুট খেয়ে জালিমের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল।হারুনের হোটেলের ষড়যন্ত্র যেভাবে তাদের গেম প্ল্যানে পরাস্ত হল, তা অতুলনীয়, একটা দেশের জালেম গোয়েন্দা প্রধানকে দেশবাসীর সামনে তারা লিটারেলি ন্যাংটা করে দিয়েছিল।পলকে ঝলকে তারা গোটা শাসক গোষ্ঠীকে ন্যাশনাল কমেডি বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। যিনি প্রধান উপদেষ্টার সহকারী হয়েছেন, প্রায় অজ্ঞাত এক নবীন তরুণকে জানতে পারলাম। তার গভীর মৌলিক চিন্তার সাথে পরিচিত হয়ে, দেশের প্রতি অগাধ প্রেমের পরিচয় পেয়ে মনে গভীর প্রশান্তি লাভ করলাম, এই ভেবে যে, ইনার মত আর লক্ষ সন্তান দেশের কথা এমন করে ভাবছে। ভয় নাই! সমন্বয়কদের নেতৃত্বের ছকটাই এমন ছিল, যাতে সকলের চেনা কোন নেতাকে গ্রেফতার করেই আন্দোলনকে দমন করা না যায়।এমন বহু গোপন নেতৃত্ব একসাথে তাদের মাথাকে এক করেছে, যাদের কাউকে একক নেতা বলে চিহ্নিত করা না যায়, টার্গেট করা না যায়। ভাবতে পারেন, এমন কত মাস্টারমাইন্ড আমাদের ঘরে ঘরে আছে!

এটা কেমন করে ভুলে যান যে, ভারতীয় বাহিনী কতটা বাংলাদেশের পানিতে নামবে সেটা পুরোপুরি বোঝাও যাচ্ছিল না ? জুলাই না হলে হয়তো ট্রানজিটের নামে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী দেশের বুকের ভেতর ঢুকে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিল।ভারতীয় বাহিনী আগেও যেমন প্রকাশ্য সামরিক উপস্থিতি রেখেছিল, জুলাইয়ে গোপনে বা প্রকাশ্যে কতখানি উপস্থিতির ঝুঁকি নেবে, সেসব আমাদের জানা ছিল না। আল্লাহ্‌র কাছে হাজার শোকর যে, এই গণহত্যা আরও দীর্ঘায়িত হয় নাই।আরও মায়ের কোল খালি হয় নাই।এক যুগের বেশী সময় ধরে যে প্রকল্পে, পরিকল্পনায় কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী কেউই সফল হল না, এই অকুতোভয় তাজা তরুণেরা সেটা করে দেখিয়েছে।আপনারা তো কেউ এই বিজয় এনে দিতে পারেন নাই! ওরা পেরেছে, ওরা বিজয়ী বীর সন্তান! এর চেয়ে বড় আর কোন পরীক্ষা দেয়ার প্রয়োজন তাদের নাই।

সরকার যেভাবে গঠন হয়েছে, যেভাবে চলছে, তা মোটেই পারফেক্ট না। তাই, কিভাবে কি করা যেতে পারে, সেসব পথ দেখান।আলোচনা-সমালোচনা জারী রাখেন।এখন প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য সংলাপ চলছে, আমরা সবই শুনছি।ফ্যাসিবাদী শক্তির পক্ষে প্রচারণা ছাড়া বাকি সবই আলোচনার পরিসর রয়েছে।কথা বলবার কোন বাঁধা আর নাই।দেশের শিশু-কিশোর-তরুণের তাজা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে যে কথা বলতে পারছেন, সেই সমীহটা রাখি।আজাইরা মুরুব্বীতন্ত্র যে চলবে না, যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।আপনাদের কারো কোন কৃতিত্বই আমাদের শহীদ সন্তানদের এক বিন্দু রক্তের সমান নয়।কুড়ি হাজার আহতদের গাজী লড়াকুদের কাতরানির কাছে তুচ্ছ! আমরা যেন এই আত্মত্যাগের সামনে সবসময় মাথা নত করে দেশ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারি।এই অভ্যুত্থানের খুলে দেয়া পথে দেশের সত্যিকার বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে পারি।এই অমূল্য দানের যোগ্য হতে পারি।

শনিবার, অক্টোবর ২৬, ২০২৪

#সায়েমারলেখা
#JulyMassacre
#secondindependencebangladesh

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৫৩

সোনাগাজী বলেছেন:



আপনার ছেলেমেয়ারা আপনাকে সন্মান কম করবে।

২| ২৮ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৫৫

আমি সাজিদ বলেছেন: ফ্যাসিবাদের পতনের আন্দোলনে কেউ একা ক্রেডিট নিতে চাইলে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই হবে। যে জন আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক সরকার, গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে বিপ্লবের উপর দেশ চালানো যায় না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের লোকেরা দেড় যুগে কথা বলেছে। মামলা খেয়েছে, জেল খেটেছেন। এটাও মনে রাখতে হবে। কেউই সমালোচনা বাইরে নয়। লাইসেন্স টু ডু এনিথিং জিকির না করে বরং সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশের জন্য আমরা প্রার্থনা করি। পাকনাতন্ত্র/ মাস্টারমাইন্ড তন্ত্র পরিহার করি।

৩| ২৮ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২৪

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: ওদের সেলুট। আর যাই হোক অংহকারীর পতন দেখতে পেরেছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.