নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পড়তে ও চিন্তা করতে ভালবাসি। ছোট গল্পের সাথে সাথে ব্লগ লিখি।
২৩
চা-নাশতা করতে দিপু বলল, ‘আমার কবিতার উত্তর দিলে না?’
‘উত্তর? সে আবার কী?’ বিস্ফারিত চোখে জানতে চায় নীলা।
‘কবিতার উত্তর দিতে হয় কবিতা দিয়েই।’
‘ওরে বাবা! আমাকে কবি বানানোর চেষ্টা?’
‘শুধু আমার জন্য, একজন পাঠক মাত্র।’
‘দেখি পারি কি না? কাজের কথায় আসি— কাকে কাকে আসতে বলবে?’
‘তেমন কেউ নয়, তোমাদের আর আমার প্রতিবেশী তো একই, কাছের দু-চারজন, এই তো...’
নীলা কাপে চুমুক দিয়ে ফোনটা দিপুর দিকে এগিয়ে বলল, ‘এখুনি দাওয়াত দিয়ে দাও, আর দেখো কয়জন হবে— সেভাবেই আবার আমাকে প্রস্তুতি নিতে হবে।’
কথাটা শুনে দিপুর খুব ভাল লাগল। প্রথম দিনেই নতুন সংসারের দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারটা দেখে দিপু যেন শক্ত মাটি খুঁজে পেল।
কিছুদিন কেবলই মনে হত— কী দরকার বেঁচে থেকে, কী মূল্য আছে, এই জীবনের। এখন যেন মনে হচ্ছে— ‘এই-তো জীবন, যেখানে মায়া সেখানেই আশ্রয়, সেখানেই বেঁচে থাকা। নাঃ আর নয়, যেভাবেই হোক আমাকে সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে।’
২৪
রাতে খাবার শেষে, ওষুধ খাইয়ে দিপুকে বিছানা করে শুইয়ে, মশারি গুঁজে, নীলা গেল গিন্নিপনা করতে। কোথায় কোন কাজ পড়ে আছে, দরজা–জানালা ঠিক মতো বন্ধ করা হয়েছে কি না দেখতে। আড়াল থেকে মঙ্গল নীলার এসব দেখতে পেয়ে মুখ টিপে হাসল। বলল, ‘অত দেখাদেখি করে লাভ নেই, রাত তিনটে নাগাদ সব এলোমেলো হয়ে যাবে। বাড়িতে ভূত আছে, রোজ ঐ সময় ময়দা আর নারকেলতেল খেতে আসে। খবরদার মাথায় কিন্তু নারকেলতেল দিও না।’
মঙ্গল তাকে লক্ষ করছে দেখে লজ্জা পেয়ে বলল, ‘তাহলে জলদি ভাগি।’
দিপুকে রোজ ঘুমের ওষুধ খেতে হয়— গতরাতে ভাল ঘুমোতে পারেনি। নীলা যখন ঘরে ঢুকল, দিপু কাত হয়ে ধনুকের মতো বেঁকে দু-হাত পায়ের ফাঁকে গুঁজে ঘুমিয়ে। নীলা একটু ভ্যাসলিন নিয়ে দিপুর ঠোঁটে লাগিয়ে, নিজেও বাকিটা লাগিয়ে নিল। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে বসে এটাসেটা গোছাল কিছুক্ষণ। চুলে চিরুনি করে মোটা একটা বেণি করল, মনে হল সহজে একটা জাহাজ বেঁধে রাখা যায়, সেই চেষ্টা করছে। এক টুকরো কাগজ আর কলম নিয়ে চার্জার-লাইটটা সঙ্গে করে বিছানায় উঠল নীলা, যা-তে দিপুর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। দিপুর পাশে বসল, ছোট বেলায় বাচ্চারা বিছানায় বসে যেভাবে অ আ শেখে। একটা কবিতা লিখল, প্রায় একঘণ্টা ধরে। সকালে সেটি পড়ে শোনাবে। খুশি-মনে বালিশের নিচে রেখে, লাইট নিভিয়ে বাইরে রেখে দিল। কিছু সময় দিপুর গালের সঙ্গে নিজের গাল ঠেকিয়ে রাখল, হামাগুড়ি দিয়ে, অথবা ভালবাসাকে প্রণাম করল। তারপর চোরের মতো, দিপুর ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে শুয়ে পড়ল।
২৫
নলখাগড়ার ঝোপে দাঁড়িয়ে বিল হতে যেভাবে জেলে তার ঝাঁকিজাল টেনে তোলে, আকাশ সমস্ত অন্ধকার টেনে তুলতে লাগল, ফেলে-রাখা তার পৃথিবী থেকে। জাল সরে যেতেই উঁকি দিল, ঝকঝকে ঠাণ্ডা আকাশ। বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে একে একে আকাশ থেকে নেমে আসছে, টলমলে নীল সমীরের দল। এই হাঁটতে শিখেছে— গুটিগুটি পায়ে, উদয়পুরের সবগুলো জানালায় এসে থাবা বসাল। কেঁপে উঠল তারা, ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে। লাফিয়ে বেড়াল মগডাল থেকে দূর্বাডগায়। ভুল করে যে শিশিররাজি বাসা বেঁধেছিল ঘাসেদের কোলে, ঝরে গেল তারা একে একে।
ঘুম ভেঙ্গেছে মৌ-কৃষকের— ভাওয়াইয়া সুর তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে নামল লিচু-ডালে— আম্রমুকুল-চুড়ো হেলে গেল বারবার, লাজুক কিশোরীর মতো। যেন কিশোরী মুখ লুকল ভয়ে। বেপরোয়া মৌমাছি নাছোড়-বান্দার মতো, ঠোঁট ডোবাল তার টসটসে রসালো ঠোঁটে। ... মধু হয়ে গেল, এত সুস্বাদু আর পুষ্টিকর, লক্ষ অধর-সুধায়।
হাত-মুখ ধুয়ে দরজা বন্ধ করতেই দিপু চোখ মেলল, কিন্তু আলসেমি করে চোখ মুদে রইল।
‘একেবারে শিশির ভেজা গোলাপ যে ...’
নীলাকে মুখ মুছতে দেখে বলল। নীলা খাটে বসে দিপুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘সন্দেহ রেখো না— সব থেকে সুন্দর হয়েই আসতে চেয়েছিলাম— যদি অপূর্ণতা কিছু থাকে— বাকিটুকু তুমি কল্পনা করে নিয়ো। ... আরও দেরি?...’
‘হু, একটু থাকি, তুমি বসে থাকো, ভোরের লাবণ্য দেখি...’
‘তাহলে পর্দা সরিয়ে দেই?’
‘কক্ষনও না, সূর্য কেন জানালায় উঁকি দেবে? শুধু আমি দেখব, আমি ... দেখতে দেখতে মরে যাব।’
নীলা দিপুর ঠোঁটে আঙ্গুল রাখল— ‘মরে যাবে বলে কি তোমার কাছে এসেছি!’
‘তোমার সামনে যে নিজেকে কেবলই পতঙ্গ মনে হয়। মনে হয় জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাই।’
‘আর তুমি তো আমার ভোরের দোয়েল— শিস দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালে না?’
‘ঠিক আছে মনে থাকবে।
‘এখন উঠে পড়ো লক্ষ্মীটি— আজ অনেক কাজ...’
নাশতা শেষে চা-পানের সময় নীলা হাতে করে রাতে লেখা কবিতাখানি এনে দিপুর হাতে দিল। দিপু পড়তে লাগল—
‘একটি ঠিকানার খোঁজ ছিল খুব
ক্লান্ত শরীর, বিশ্রামে দিতাম ডুব।
মোড়ের ছেলেরা কেউ কেউ বলে
ঠিকানা বলুন— দেখি খোঁজ যদি মেলে
একজন বলে, হারিয়েছে সে তার ঠিকানা
চুলগুলো কেমন এলোমেলো দেখছিস না?
হয়ত ভবঘুরে, উন্মাদ কোনও
চলে যাক কিছু বলিসনে যেন।
মনে হল এক চিৎকারে
বলি তারে
যার ঠিকানাই নেই
তার হারাবারও ভয় নেই।
তবু কেন বারেবার
মন চায় হারাবার
অজানা ঠিকানায়
দুরুদুরু পায়—
কী অবাক কাণ্ড দেখো।
একটি মেয়ে আর একটি যুবক হাত ধরলেই
ঠিকানাটা জুটে যায়, খুব সহজেই।’
‘দারুণ লিখেছ। হাত ধরলেই সমস্ত পৃথিবী বশীভূত হয়ে যায়, ঠিকানা হয়ে যায়। তবে আমার ধারণা তুমি গানেই সফল। তুমি কি সব গানই করো, না রবীন্দ্র সঙ্গীতই?’
‘দু-চারটা শিখেছিলাম সবার দেখাদেখি, তবে ঝোঁক বুড়োর দিকেই।’
‘শেষ পর্যন্ত বুড়োর প্রেমে পড়লে?’
‘কী করব বলো— আমি যত বড় হচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ আরও বড় হয়ে সামনে আসছেন।’
একটু ভাবল নীলা। কাপের হ্যান্ডেল তর্জনী দিয়ে পিরিচের ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে বলতে লাগল, একটু গম্ভীর হয়ে। ‘মানুষ প্রথমে নিজেকে অজ্ঞ ভাবে, তাই সবাইকে সে অন্ধভাবে অনুকরণ করে। একটু জানার পর নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে শুরু করে, অহঙ্কারী হয়ে যায়। আরও জানার পরে, এক সময় সে আবিষ্কার করে তার অজ্ঞতাগুলোকে। এই আবিষ্কার, অবিরাম চলতেই থাকে।’
এক সময় নীলা সবার দেখাদেখি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু করেছিল। এখন ছুটে আসে, মনের টানে।
‘বুড়ো সম্পর্কে তোমার মূল্যায়নটা কী?’
‘একবার মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে কথা উঠলে, রসিকতা করে বলেছিলাম— “তোমাদের স্বর্গে আমার তেমন একটা আগ্রহ নেই, কেন-না ওখানে সর্ষেশাক আর রবীন্দ্রসঙ্গীত নেই।”
‘তুমি সর্ষেশাক এত পছন্দ করো!’
‘করি।’ হাসতে লাগল দিপু।
‘কীভাবে খেতে?’
‘শাক, ভর্তা, মুরগি দিয়ে, সব।’
‘মুরগি দিয়ে!?’
‘হ্যাঁ, টুকরো করা শাক, লবণ দিয়ে চটকে ফ্রিজে দু-দিন রেখে দাও। মুরগির মাংস চটকানো শাক দিয়ে মাখামাখা করে রাঁধতে হবে, সাথে ক-খানা গরম রুটি। স্বর্গ তোমার থালায় মধ্যে।’
দিপু বাতাস থেকে ঘ্রাণ নেবার ভান করে মুখ দিয়ে চপ করে শব্দ করল।
‘যতভাবে চাও আমি তোমাকে তৈরি করে খাওয়াব। এবার বাড়িতে সর্ষেশাকের চাষ করতে বলে দেই?’ নীলা চোখ টিপে দিল।
২৬
‘তোমাদের গ্রামের বাড়ি নেবে কবে? সেই জায়গাটা দেখার খুব শখ। যেখানে তোমার হাত ধরে, তোমায় কাত করলাম।’
‘শীতে চলো। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। আমাদের যে ঘরটা আছে, পাকা— ওপরে টিন। সব কিছুই ঘরের মধ্যে, তুমি বুঝতেই পারবে না, গ্রামে আছো। শুধু মাঝে-মধ্যে ঘুঘুর ডাক তোমায়, মনে করিয়ে দেবে। বারান্দায় দাঁড়ালে, বিশাল একটা মাঠ। ক্ষেতে যখন ধান থাকে কী-যে সুন্দর লাগে! আর যদি বর্ষাকালে যাও তো তুমি আর আসতেই চাইবে না। পানিতে থই থই, বেশি নয়, কোমরের একটু নিচেই থাকে। যখন নতুন পানি আসতে থাকে, ভরা জ্যোৎস্নায় ছোট ছোট ঢেউগুলো পাড়ে এসে ধাক্কা খায়, আর কুলকুল গান গায়। তখন ঢেউ এর ছোট্ট পিঠগুলোকে মনে হয়, নতুন খুচরো পয়সা স্তুপে কেউ হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দিচ্ছে। মাঠের মধ্যে দু-টো তালগাছ আছে। একটি আমাদের। রাতে যখন ঝপাৎ করে তাল পড়ে, ডিঙ্গি নিয়ে কুড়োতে যাওয়া সে-কী মজার, তুমি যদি দেখতে! আচ্ছা তালের-রস দিয়ে মুড়ি খেয়েছ কখনও? তোমাকে খাওয়াব।
‘মাঠের মাঝ থেকে আমাদের বাড়িকে মনে হয়, একটা বন্দর, আর ঘরটাকে মনে হয়, বেঁধে রাখা একটি স্টিমার ভাসছে। মাছ ধরা তখন একদম সোজা, বারান্দায় বসেও ধরা যায়। তোমাকে নিয়ে গেলে আমরা দু-জনে, বাড়ির পেছনে (পশ্চিম পাশে যেখানে স্বপ্নে প্রেম হয়েছিল।) ডুমুরগাছের শেকড়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরব। তুমি কেঁচো ধরতে পারো তো? আমার ভয় করে— আমাকে গেঁথে দেবে। তাজা টাকি-মাছের ভর্তা ধনেপাতাসহ, গরম ভাত— মনে হলেই জিভে জল চলে আসে।’
‘গাছ-পিঁপড়ের ডিম দিয়ে ধরো না?’
‘ধরি, সেটা যোগাড় করা কঠিন, শুধু কামড়ায়— আমরা ভাই-বোনেরা একসাথে হাতে-পায়ে, ছাই মেখে লাফাতাম, আর ডিম কুড়োতাম, ছাই মাখলে সহজে পা বেয়ে উঠতে পারে না। পিঁপড়ের ডিম দিয়ে বড় মাছ ধরা যায় না, এই ধরেন— পুঁটি, ট্যাংরা, চেলা এই সব। আচ্ছা, দিপু ভাই! আমি একটা জিনিস ভেবে পাই না— পিঁপড়ের চেয়ে ডিম বড় হয় কেমনে? আপনি জানেন?
‘সেই ছোট্টবেলার মতো, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, ধানক্ষেতের আল ধরে দৌড়োব আমরা।
বলে চলল নীলা, ‘ছোট্টবেলায় ভাই-বোনদের দাদার পেছনে নিয়ে প্রায়ই ছুটতেন নদী-ধারে। ওখানে আমাদের একটা বাগান আছে। এক সময় ধান ভাঙ্গানোর কল ছিল। এখন পুরোটাই বাগান— আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, একপাশে বাঁশঝাড় আছে। তখন স্কুল ছুটি হলেই... গ্রীষ্মের ছুটি তো বাদই যেত না। একসাথে সবাই বাড়ি যেতাম। আমাদের মধ্যে যারা বড়— খুন্তা, বালতি, বীজ হাতে দিতেন দাদা। ছোটদের কাজ ছিল, শুধু হৈচৈ করা। গর্ত খোঁড়া হলে আমাদের হাতে, ফুঁ দিয়ে বীজ তুলে দিতেন, আর বলতেন, “এটি তোর গাছ।” আমার হাতে লাগানো একটা জাম আর চালতাগাছ আছে। দাদার কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে। “বিয়ের পরে যখন প্রথমবার স্বামীকে নিয়ে আসবি, তোর গাছের ফল যেন খেতে পারে। সেভাবে খোঁজ নিয়ে বেড়াতে আসবি।” কথা শুনে আমি তো হেসেই কুটি-কুটি। বয়স তখন কত আর, নয় হবে। ছোট্ট নদীটায় নেমে পেটের নিচে হাত দিয়ে আমাদের সাঁতার শেখাতেন। দাদা বেঁচে থাকলে আমাদের একসাথে দেখে, কত যে খুশি হতেন। তুমি কি চালতার আচার পছন্দ করো?’
‘করি; চালতা-ডালও।’
‘বাঃ তাহলে তো মিলে গেল, আমিও।’
দিপু এতক্ষণ নীলাকে লক্ষ করছিল— একজন নারীর ভেতর থেকে, কীভাবে একটা শিশু লাফিয়ে বের হচ্ছে।
কিস্তি - ১০ম
কিস্তি - ১২তম
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:১১
আহা রুবন বলেছেন: ভাল থাকবেন।
২| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৩৫
প্রামানিক বলেছেন: খুব ভালো লাগল। ধন্যবাদ
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৩৯
আহা রুবন বলেছেন: প্রামানিক ভাইকে আমার উঠোনে দেখলে খুব ভাল লাগে। শুভ কমনা জানবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৯
শাহরিয়ার কবীর বলেছেন:
মনে হল এক চিৎকারে
বলি তারে
যার ঠিকানাই নেই
তার হারাবারও ভয় নেই।
তবু কেন বারেবার
মন চায় হারাবার
অজানা ঠিকানায়
দুরুদুরু পায়—
ভালো লাগা রইল ভাই।