নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পড়তে ও চিন্তা করতে ভালবাসি। ছোট গল্পের সাথে সাথে ব্লগ লিখি।
৪
চৈত্রের সন্ধ্যাগুলো খানিকটা নিঃসঙ্গ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া খোলা-ছাদে প্রাণ-খুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া, একাকী গায়কের মতো। হালকা গরমের মাঝে, হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস দক্ষিণ থেকে ছুটে আসে, বেশ-বসনের সাথে মনটাকেও আলুথালু করে বসে।
ঝরাপাতায় মচমচ শব্দ তুলে ধীরে এগুতে থাকেন, দিপুর বাড়ির দিকে। কলবেল টেপেন তারা।
‘দেখতে পাচ্ছ নীলার বাবা, বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে।
‘এলাম তো বাড়িতে থাকলেই হয়।’
‘তোমার যত কথা— অসুস্থ শরীরে আবার কোথায় যাবে।’
‘ডাক্তারের কাছেও তো যেতে পারে।’
শফিক সাহেব জবাব দেন। এমন সময় নেমে আসতে দেখা যায় মঙ্গলকে।
‘কে?’
‘মঙ্গল— আমি শফিক।’
‘ও, আসুন আসুন, খালাম্মাও আছেন— কেমন আছেন আপনি?’
‘ভাল, তুমি কেমন?’
‘ভাল আর কেমনে থাকি— ভাইয়ের এই অবস্থায়...’
মঙ্গলের পেছন পেছন ওপরে বসার ঘরে গিয়ে বসেন তারা।
ভাইকে ডেকে নিয়ে আসি, বলে মঙ্গল চলে যেতে উদ্যত হয়।
‘এটা ধরো মঙ্গল।’
‘কী খালাম্মা?’
‘আগে ধরো তো, দিপুর জন্য নিয়ে এলাম।’
লম্বা চার সিটের সোফা, পাশে দুই সিটের ডানে বামে আরও দুটো। সামনে ডান দিকে ৪৬" টেলিভিশন। বামে দৃষ্টিনন্দন নকশা বিহীন সেগুন-কাঠের শোকেস, ওপরে দুটো ফুলদানি— হাত মুঠো করা, কখনও মনে হয় ডাল, কখনও মনে হয় ফুলদানিকে ধরে আছে। একটায় গন্ধরাজ ফুলের ডাল পুরে দেয়া, অন্যটায় পাতা বাহারের ডাল ফুলে আছে ওমে-বসা মুরগির মতো।
পূর্ব-পাশের জানালায় চাঁদের আলো তেরচা এসে, কাচের ওপর জ্বলে উঠেছে। দক্ষিণ জানালা পূর্ব কোণে—খোলা। মাঝে মাঝে পর্দা ফুলে উঠছে হাওয়ায়, লুঙ্গি পরে নদীতে নামলে যেমন হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বিশাল একটা বইয়ের আলমারি, মাথায় পৃথিবী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের ল্যাম্প-স্ট্যান্ডে জ্বলতে থাকা ম্লান আলো ঘরটাকে মায়া আর রহস্যে ছেয়ে রেখেছে।
কুশল বিনিময় করতে যাবে, নীলার মা-বাবা অবাক হয়ে গেলেন। মঙ্গল হুইল চেয়ার ঠেলে এনেছে।
‘তোমার এমন অবস্থা!...’
‘না, তেমন কিছু নয়, বাতের ব্যথা; চলাচলে খুব অসুবিধা হচ্ছিল তাই ক-দিন হয় চেয়ারটা আনিয়েছি।’
শফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কতদিন ধরে ব্যথা আপনার?’
‘এই তো দিন দশেক হবে। আগেও হয়েছে, তবে এত বেশি হয়নি— কাকা, কাকি কিন্তু তুমি করে বলেন।’
হাসতে লাগল দিপু, কোলের মধ্যে দুই হাত রেখে।
‘তাহলে তো অফিস করতে পারছ না?’
‘হ্যাঁ কাকি, ছুটিতে আছি কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানি, কতদিন যে আর থাকতে পারব, অনেক বছর ধরে আছি, তাই একটু ছাড় দিচ্ছে।’
‘কিন্তু সবার আগে শরীর-স্বাস্থ্য, সেটাই যদি ঠিক না থাকে...’
‘তা নীলা, পিন্টু কেমন আছে?’
‘আছে ওরা ভালই।’
শফিক সাহেব কথা বলার কোনও সুযোগ না পেয়ে, দু-জনের মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন, আর মুগ্ধ-শ্রোতার ভূমিকা পালন করছিলেন। এবার নীরবতা ভাঙ্গলেন— এক্স-রে করিয়েছে কি না, আর কোথায় কী টেস্ট করেছে, কোন ডাক্তার দেখিয়েছে, কী বলেছে তারা— এইসব। দিপু মন দিয়ে সব শুনছিল, আর জবাব দিচ্ছিল সেসবের।
‘ভাই, খালাম্মা আপনার জন্য এনেছেন।’
দিপু মঙ্গলের হাত থেকে বক্সটি নেবার সময় বক্স মালিকের দিকে তাকাল হাসিমুখে। তিনিও হাসির উত্তর দিলেন, বললেন, ‘খুলে দেখো।’
‘মঙ্গল ভাই বাল্বটা কেটে গেছে, যন্ত্রপাতির ড্রয়ারে দেখুন একটা বাল্ব আছে।’
বক্স খুলে বলল, ‘বাঃ সর্ষে-ইলিশ! আর এটায়?’
‘দেখো।’
রহস্যের হাসি দিলেন একটা। সেটা খুলে দিপুর চোখ-মুখ ঝলমল করে উঠল। মুহূর্তে চোখ ঝাপসা হয়ে এল দিপুর। অতিথিদ্বয়ের দৃষ্টি এড়ালো না। বক্সটা বন্ধ করে, মঙ্গলের হাতে দিয়ে দিপু বলল, ‘ইলিশের টুকরো কত হবে— তিন-শ আর শিং— এক-শ টাকা। মাত্র চার-শ টাকার জিনিস নিয়ে একজন রোগীকে দেখতে এসেছেন?’
হাসতে লাগল মিটিমিটি। শফিক দম্পতি হঠাৎ বোকা বনে গেলেন, অসহায়ের মতো পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
‘অথচ কষ্ট করে যে নিজ হাতে রান্না করে এনেছেন, সেই মমত্ববোধ, প্রতিবেশীর প্রতি আন্তরিকতা এর মূল্য কত? টাকা দিয়ে কি এসব কেনা যায়!’
এবার শফিক দম্পতির মুগ্ধ হবার পালা। একটু থেমেছিল দিপু, ফের শুরু করল— ‘অবশ্য কারও কারও ভদ্রতাকে, আমার কাছে মাঝে মাঝে তো মনে হয়— ভণ্ডামির কদাকার প্রতিযোগিতা। অহঙ্কার আর তাচ্ছিল্য সেখানে ঘাপটি মেরে থাকে, অতি চতুরভাবে। দাওয়াত করে কুড়িপদ হাজির করে— যেন তারা আগে কখনও খায়নি, তাই খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নাকি রাক্ষস ভাবে! সেখানে সবই থাকে আন্তরিকতা বাদে— অমন লোকের আতিথ্য এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি।’
দিপুর এমন সরল মন্তব্যে দু-জনেই অভিভূত হলেন। শফিক সাহেব চিন্তা করলেন— ‘আমরা তো বেশি কিছু আনিনি। নিশ্চয় আমরা সে-দলে পড়ব না।’
মূহুর্তের অস্বস্তি উড়িয়ে দিল দিপু। চাকা ঘুরিয়ে একটু পিছিয়ে গেল, আনাড়ির মতো করল কাজটা; অতিথিদের অস্বস্তিতে ফেলে নিজেও বিব্রত, যেন চাকা ঘোরালে সেটা কমবে। ডান হাত মুঠি করে— মনে হতে পারে, অদৃশ্য মাইক্রোফোন হাতে বলল— ‘কাকি আমাদের সহজ-সরল ভনিতাবিহীন সেইসব দিনগুলো, কোথায় হারিয়ে গেল। কলেজ ছুটি হলে যখন বাড়িতে যেতাম, প্রতিবেশীরা ডাক দিয়ে ঘরে বসাত, যেন কত যুগ পরে দেখা। মনে পড়ে এক বাড়িতে সামান্য আতা খাওয়াতে কত কষ্ট করেই-না পেরেছিল গাছ থেকে। আর এখন! বাজার থেকে পিঠে কিনে অতিথি আপ্যায়ন করে— একটু লেবু-সরবত করতেও আলস্য— কোল্ড ড্রিংক্স কিনে আনে। আমার মনে হয় কি কাকি— এর চেয়ে বরং কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই হয়— যে কিছু কিনে খেয়ে নিয়ো।’
দিপুর গলা ধরে এসেছিল আগেই, দু-চোখ মুছল, ঠোঁট কামড়াল। কাকা ভাবলেন— ‘মানুষের মনটা বড়ই বিচিত্র, কে যে কোন বিষয়ে কখন আবেগ-প্রবণ হয়ে যায়, বলা মুশকিল। হয়ত সুস্থ থাকলে এমনটা হত না।’
গভীর মনোযোগ দিয়ে দিপুর কথা শুনছিলেন তারা, আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছিলেন সায় দিয়ে। দিপু বামে মাথা বাঁকিয়ে গমগমে কণ্ঠে বলল, ‘মঙ্গল ভা-ই-ই কিছু একটা খেতে দিন। আপনাদের চিংড়িতে আপত্তি নেই তো?’ মুখ ফিরে বলল।
বাধা দিয়ে উঠলেন একসাথে দুজন— ‘না না কোনও ঝামেলার দরকার নেই...’ কাকি বিব্রত হয়ে হাত কচলাতে লাগলেন— ‘শুধু চা...’
ঘোমটা টানতে একটু কাত হলেন।
‘একটু নুডুলস্ করুন, সাথে চিংড়ি আর কটা বরবটি দেবেন।’
স্ত্রীর কাঁধে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘তুমি একটু যাও-না?’
‘হ্যাঁ যাই...’
খুশি হয়ে দাঁড়ালেন, যেন এতক্ষণ কেন যে, কথাটা মনে পড়েনি।
‘আপনি বসুন তো কাকি, মঙ্গল ভাইয়ের অভ্যেস আছে। আমি ভাল থাকলে নিজেই করতাম। তা হলে অবশ্য আপনারা আসতেনই না।’ হাসতে লাগল দিপু।
‘লজ্জা দিচ্ছ?’
স্পষ্টতই লাল হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলেন। পঞ্চাশ ছুঁয়েছে মাত্র, মাঝারি উচ্চতার এই মানুষটির এখনও কোন রোগ বাসা বাঁধতে পারেনি শরীরে। হলদে চেহারার ছোট্ট মুখে কালো চশমা; ঘোমটা টানায় তাকে দেখাচ্ছিল, ঠুকরে গলা বের করা ডিমের মধ্যকার মুরগির বাচ্চার মতো।
‘কী করছ মঙ্গল?’
‘এই তো খালাম্মা একটু চা করি।’
‘দেখি তোমায় একটু সহায়তা করি।’
মঙ্গল হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনি দেখতে থাকুন ঠিক হয় কি না।’
ওখানটায় কিছু সময় দাঁড়িয়ে, পরে এঘর সেঘর করতে লাগলেন। মোট কামরা আছে ছয়টি। দুটো বেডরুম বেশ বড় করে করা, দক্ষিণেটির চেয়ে পূর্বেরটি বেশি পছন্দ হল। সবচেয়ে ছোট রুমটায় কাগজের কার্টন— একটির ওপর আরেকটি করে চারটি, একটা ফোল্ডিং খাট, মোড়ানো-পাটি, মেলে-রাখা ছাতি, এককোণে আইপিএস। মাঝারি রুমটায় একটা আলনা— কিছু জামা-কাপড় গোছানো, ব্যায়াম-সরঞ্জামাদি একখানে পাঁজা করে রাখা, একপাশে একটা চেয়ার— তার ওপর একটা পুতুল বসিয়ে রাখা হয়েছে— এই রুমটায় বারান্দা নেই। পুরো বাড়িটাই গোছানো, তবে ভাল করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, জিনিসগুলোয় বহুদিন হাত না পড়ায়— গ্রীষ্মের সকালে মাঠে যেমন কুয়াশা দলা পাকিয়ে থাকে, তেমনি একটা ধুলোর আস্তরণ জমে আছে। অর্থাৎ অনেকদিন ধরে ওগুলো গোছানো অবস্থায় পড়ে আছ। এটা নজরে আসায় মনটা খারাপ হয়ে গেল।
‘তোমাদের গল্প-তো বেশ জমে উঠেছে দেখছি।’
‘হ্যাঁ কাকি, আপনাদের ওখানে যেদিন গেলাম, কাকার সাথে সাক্ষাৎ হল একেবারে বিদায় মুহূর্তে। আজ নতুন করে আবার পরিচয় হল। বাড়ি করার সময় তো কাজের কথা ছাড়া, কথাই হত না। আর আপনারাও তখন আমায় মিস্ত্রির দালাল বলেই কেবল ভাবতেন।’ হাসল দিপু।
লজ্জা পেয়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘না না কী-যে বলো-না তুমি! তা হবে কেন? আমরা আসলে তখন আসতামই কম কম... সেই-যে গেলে আর তো গেলেও না? বউ নিয়ে মাঝে-মধ্যে তো যেতে পারো?’ দিপু কোনও জবাব না দিয়ে লাজুক হাসে।
‘আচ্ছা সুমি বাবার বাড়ি গেছে বেশ তো হল, না? এর মাঝে কি আর এসেছিল?’ দিপু মাথা নেড়ে জানায় আসেনি।
‘তা প্রায় মাস চারেক তো...?’ দিপুর উত্তরের অপেক্ষায় মুখের দিক তাকিয়ে থাকলেন।
‘তিন মাস ষোলো দিন।’
‘রাগারাগি করে যায়নি তো?... আমি আবার তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে?...’
‘তা একটু ওরকমই।’
‘কী নিয়ে ... আমি না হয়, একটু কথা বলে দেখি, অনেকদিন হল তো তাই যদি ...’
‘কী নিয়ে সুমি রাগ করেছিল, তা-তো মনে নেই কাকি।’
‘কী বলছ! তোমার সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেল, আর বলছ কারণ মনে নেই!’
বিস্ময় আর সন্দেহভরা চোখে তাকালেন। একবার ভাবলেন— ‘হয়ত বলতে চাচ্ছে না— আমার প্রশ্ন করাটাই ঠিক হয়নি।’
সেটাই বলবে বলবে করছিলেন, হঠাৎ দিপু বলল, ‘আসলে কাকি কারণটা খুব গুরুতর নয়, যা মনে রাখার মতো; আর কারণও একটা নয়, ছোট ছোট অনেক ... তাই রাগের কারণটাও মনে রাখবার মতো কিছু ছিল না। আপনি যদি ওকে জিজ্ঞেস করেন, ও-ও কিছু বলতে পারবে না, অথবা কারণের বস্তা খুলে বসবে। ওর সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে ওগুলোকেই দায়ী করবে।’
একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সত্যিকার অর্থে কি কাকি— বয়সের সাথে সাথে চাওয়া-পাওয়াও পরিবর্তিত হয়ে যায়। আমাদের যদি একটা সন্তান থাকত, হয়ত কোন সমস্যাই থাকত না। বিয়ে করেছি এগারো বছর— সন্তান দু-টি মানুষের মধ্যে যে চিরস্থায়ী একটা সম্পর্ক তৈরি করে, তা-তো আ-আ-র হল না! আমরা এক সময় খেয়াল করলাম, আমাদের মধ্যকার বন্ধনটি আলগা হয়ে গেছে, সেটা ঘটল এত ধীরে যে এতদিন বুঝিনি। কিন্তু একদিন, প্রথম জীবনের সাথে বর্তমানের তুলনা করে, হঠাৎ চমকে উঠলাম। ... অবচেতনভাবে আমরা আসল ব্যাপারটা এড়িয়ে নানা কারণ খাড়া করে সেটার যৌক্তিকতা খুঁজতে থাকি।’
একটু থামল দিপু, নিচ দিক তাকিয়ে ডান অনামিকা দিয়ে চেয়ারের হাতলে অবিরাম আঘাত করছিল। স্বামী-স্ত্রী উদগ্রীব হয়ে আছেন কথা শোনার, কিন্তু মুখে কিছু বলছেন না কেউ। বড় করে শ্বাস টেনে লম্বা করে ছাড়ল দিপু, কনুইতে গাল ভর দিয়ে অমনোযোগী-চোখে বলল, ‘যতক্ষণ একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল থাকে, ততক্ষণ সম্পর্কটা দৃঢ় থাকে। নির্ভরশীলতা ফুরিয়ে গেলে সম্পর্কের জোড়াগুলোও পটপট করে ছুটে যেতে থাকে। এই দেখুন-না, আমি রান্না-বান্না ভালই জানি, আমি খুব ভাল করেই জানি— সুমি না থাকলেও খাবারে কোনও সমস্যা হবে না। তাই সে না থাকলেই আমি কাতর হই না, অভাব বোধ করি না, বা সুমিও কোনও অপরাধবোধে ভোগে না— এই ভেবে যে, ও না থাকায় আমি খাওয়ায় কষ্ট করছি।’
বিব্রত অবস্থা কাটাতে দিপু এসব বলল, একটু সময় পর (কেন বললাম ভেবে।) আরও বিব্রত হয়ে গুটিয়ে রইল।
‘আচ্ছা দিপু তোমাদের মধ্যে সমস্যা কার?’
‘কাকি সেটাই-তো দুঃখজনক, অনেক টেস্ট করিয়েছি, ডাক্তার কোনও কিছুই পাননি, আশ্বাস দিয়ে বলেছেন— দেখবেন হঠাৎ করেই একদিন সুসংবাদ পেয়ে গেছেন। সেই দিনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এগারো বছর পেরিয়ে গেল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু-ঠোঁট কুঞ্চিত করে বাঁ পাশে তাকাল— ‘কত দূ-র?
মঙ্গল নাস্তা সাজিয়ে এনেছে। টি-টেবিলে নামিয়ে রাখল সব।
‘প্লিজ...’ হাতের ইশারা করল দিপু।
‘কোনটা দেব, সালাদ না, কেচাপ?’
‘দু-টোই খাব, যা এনেছ সব খাব। শফিক সাহেব বললেন।
মঙ্গল লজ্জা পেল, বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছে।
‘আপনারটা কোথায়?’ বাটি ধরতে নিয়ে দিপু জিজ্ঞেস করল।
‘আসছি, চা হয়ে গিয়েছে। দু-একটা বরবটি রয়ে গেছে, আবার খেয়ে ফেলবেন না।’
কাঁটা-চামচে নুডুলস্ পেঁচিয়ে বাটিতে রেখে দিপুকে উদ্দেশ করে কাকি বললেন, ‘সুমি কি তোমাকে অপছন্দ করে?’
দিপু ঢোক গিলে একটু ঝুঁকল, টিস্যু-বক্সের দিকে। ঠোঁট মুছে, টিস্যু বাটির তলায় দিয়ে, বাম হাতের তালুতে নিল, পরে তাকাল কাকা-কাকির দিকে, মনে হতে পারে হাতে গরম লাগছে। কথা গোছাতে সময় ক্ষেপণ...
‘ঠিক তা নয়... ও একটু বেশি... কী বলব একে... এই যেমন আপনাদের সাথে চারশত টাকা নিয়ে রসিকতা করলাম। ওটাই আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এ জন্যেই লোকে আমাকে পছন্দ করে। হেসে যোগ করল— অধিকাংশ... ওরা বলে আমার এই আচরণে নাকি, প্রথমে বিব্রত হলেও, এখন মজা পায়। অথচ সুমি এরকম কোন কিছুকে মনে করবে, ওকে অপমান করছি। কোনটা অপমান আর কোনটা রসিকতা, বুঝতে চায় না। এই সব খুঁটিনাটি নিয়ে মন-মালিন্য, এ-ই-ই আর কী। তাই এক সময় নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। অনেকদিন এমনও হয়, দরকারি কথা ছাড়া আমাদের আর কোনও কথাই হয় না।’
একটু যেন আড়ষ্ট হল দিপু। দিপুর কথাগুলো অতিথিদ্বয়ের খুব একটা মনঃপুত হল না। দিপুও সেটা আন্দাজ করতে পেরে চুপচাপ হয়ে গেল।
ফেরার সময় হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে সিঁড়ির দরজা পর্যন্ত চলে এল দিপু— ‘আপনারা এসেছেন বলে, খুব খুশি হয়েছি। সারাদিন একা-একা সময় কাটতে চায় না। কিন্তু কী করব...? অনেকক্ষণ আটকে রাখলাম, তবু মনে হচ্ছে আরও কিছুক্ষণ আটকে রাখি, অথচ বাড়িতে ওরা আপনাদের অপেক্ষায়... সেদিকে খেয়াল নেই কোনও।’
কাকা ঝটপট বললেন, ‘না না ওরা তো আর বাচ্চা নয়...’
‘অসহায় মানুষ খুব স্বার্থপর হয়ে যায়। সে চায় সবাই তাকে গুরুত্ব দিক, যত্ন নিক, আর আমরা অসহায় মানুষদের সযত্নে অবহেলা করি— অনেক কথা বললাম— ভুল হলে ক্ষমা করবেন। দোয়া করবেন— যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে আপনাদের ওখানে লাউ-চিংড়ি খেতে পারি।’ মিটিমিটি হাসতে লাগল দিপু, তার চেয়েও শিশুর মতো হাসছে, ওর চোখ দুটো।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ দোয়া করি অবশ্যই... আর ভাল থেকো।’
কাকা পাশে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে তাতে সায় দিচ্ছিলেন। এত সময় বিব্রতভাবে দাঁড়িয়েছিলেন।
‘মাঝে মাঝে খবর নেব, একদম ঘাবড়াবে না, যে কোনও দরকারে সাথে সাথে জানাবে সংকোচ করবে না।'
কিস্তি - ৩য়
৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১:০৪
আহা রুবন বলেছেন: আপনার মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগছে। আশা করি সময় করে গল্পটি পড়ে ভাল-মন্দ, ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে মতামত দেবেন। ভাল থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:৩৮
ভ্রমরের ডানা বলেছেন:
ভালই চলছে সব। চমৎকার! দুর্দান্ত লেখনী। দিপুর মুখে কিছু সত্যবচন পেলুম-
যতক্ষণ একজন আরেকজনের ওপর নির্ভরশীল থাকে, ততক্ষণ সম্পর্কটা দৃঢ় থাকে। নির্ভরশীলতা ফুরিয়ে গেলে সম্পর্কের জোড়াগুলোও পটপট করে ছুটে যেতে থাকে।