নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পড়তে ও চিন্তা করতে ভালবাসি। ছোট গল্পের সাথে সাথে ব্লগ লিখি।
সলিম ভ্যান ঘোরায় পুরো জেলা। সমগ্র জেলা—আট মণ। বিশ থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত, সবার যখন মুখ আমশি—পকেটের অবস্থা বিয়ানো ছাগির পেটের মতো। সলিমের বউ তখন ফসফস করে ইলিশ ভাজে। এই সময়টায় সলিম থাকে বাসা বদলের কাজে। হাতে মজুর থাকায়, তার ডাক পড়ে বেশি। মাসের অন্য সময় স-মিলে কাঠ টানে, বা বাজারে ঘুরঘুর করে, কিছু একটা জুটিয়ে নেয়।
কাল সলিম বাড়ি বদলানোর একটা কাজ পেয়েছে। আবু আর মণিকে রাতেই ঠিক করে রেখেছে। নতুন বাড়ি খুব একটা দূরে নয়—দোতলায় ওঠাতে হবে। ভাড়া মিটমাট করে, চা-এর দোকানে বসে। কিছু সময় টি.ভি.তে নাচানাচি দেখে, শিস দিতে দিতে ঘরে ফেরে।
সকাল-সকাল এসে উপস্থিত হয় তারা। মাল-পত্র নামিয়ে ভ্যানে করে নতুন বাড়ির সামনে জরো করে। কিন্তু গোল বাঁধে সেগুলো ওঠানোর সময়—দোতলা নয় চারতলায় ওঠাতে হবে। ভাড়াটে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘ভাই আমার ছেলে ভুল বলেছে। আসলে ও ঠিক জানে না তো…’
‘জানে না তাকে দায়িত্ব দিলেন কেন? এই টাকায় হবে না।’ ‘ঠিক আছে দুইশো বেশি দেব।’
‘সাহেব কি মস্করা করলেন…’
‘তাহলে কত চাও?’
‘পুরা এক হাজার বেশি দেবেন।’
‘ঠিক আছে কিছু কম নিও।’
‘না স্যার কমে পারব না।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা হাত লাগাও।’
এর মধ্যে ভাড়াটের ছেলে স্টিল-আলমিরা নিয়ে এসেছে, ভ্যানে করে। ‘আব্বা ঝামেলাটা এই সুযোগেই…’
‘ঠিক করেছিস পরে আবার এই জন্য… ভাল করেছিস।’ এটি আনার সময় সলিমরা ছিল চা-দোকানে।
মাল-পত্র ওঠানোর সময় প্রচণ্ড হইচই।
‘খাতায় টোকা আছে, এই দেখেন—আলমারি একটা লেখা। এটা আইল কোথা থেকে, তোরা দেখলি না? ছাগল কোনহানকার!’
সাহেবের সাথে বচসা শেষে, কিছু বাড়তি পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে রাজি হয় ওরা। ঠেলাঠেলি করে আলমিরা বসাতে, সলিমের পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের খানিকটা কেটে গেল। রক্ত গড়ায়—পায়ের আঠালো তলা মেঝের সাথে আটকে গেল বারবার।
গোছানো শেষে, কোমর থেকে গামছা খুলে মুখ মোছে আর বলে, ‘নেন স্যার, এবার আমাদের বিদায় করেন।’
‘এই তো ছেলেটা আসুক।’
সাহেবের ছেলের কাছ থেকে পাওনা বুঝে নেয়ার সময়, তুমুল ঝগড়া, মোটের ওপর পাঁচশত বেশি দেবে। বলে কিনা তার আব্বাকে বোকা বানিয়ে রাজি করানো হয়েছে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সলিম হাতের টাকা ছুড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।
‘লাগবে না আপনার টাকা।’
গালের ওপর ঠাসঠাস কটা থাপ্পড় এসে পড়ে। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, ‘তোদের হিসাব বুঝে নে, আমার লাগবে না।’ কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে নিচে নেমে এল সলিম।
ঘরে ফিরে দেখে তখনও রান্না শেষ হয়নি।
‘কি রে? এহনো ভাত রাঁধস খামু কহন?’
‘ভাত হইল বইলা—তোমার-না বাজার আননের কথা।’
‘তুই কিছু করস নাই?’
‘কিছু আছে-নি ঘরে, যে করমু?’
‘ওই শালি—কামের বেলায় নাই, খালি কথা?…’ চুল ধরে ধুমধাম কিছু পিটুনি দেয় সলিম। বউটি মা রে, বাবা রে, বলে চিৎকার করতে করতে হাত থেকে ছুটে পালায়।
পাশের ঘর থেকে, গুনগুন কান্না ভেসে আসে—মাঝেমাঝে ঝাঁজালো-কটু মন্তব্য, গানের মধ্যকার বাদ্য-বাজনার মতো।
দরজায় বসে আঙ্গুল পানিতে ধুয়ে, কাপড় পেঁচাতে থাকে সলিম। ভ্যান চালিয়ে আসার সময় চাপ লেগে ফের রক্ত পড়া শুরু হয়েছে।
পা কাটা, আর রক্তের কথা, কেউ একজন মালাকে বলায়, কান্না থামিয়ে জানালা দিয়ে স্বামীকে দেখতে থাকে। কান্নার কথা মনে পড়তেই আবার সুর ধরে।
পেটে ক্ষুধা, মেজাজ ঠিক নেই—স্ত্রী বসেছে সঙ্গীত সাধনায়। ভাতের ভরসা না করে, ভাবল চা-রুটি খেয়ে আসে। গায়ে সার্ট চাপিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়তে রাস্তায় চলে আসে সলিম। হঠাৎ হইচই—উত্তর দিক থেকে একটা মিছিল চলে আসে। পরিস্কার কিছু বুঝল না।
‘আমাদের দাবি মানতে হবে, মানতে হবে’
‘অত্যাচার বন্ধ করো’
‘অভিযুক্তদের শাস্তি চাই’ এই টুকু সলিমের মাথায় ঢুকল।
মিছিল আসতে দেখে, রাত-জাগা যে তিনটি পুলিশ চা-দোকানে বসে ঝিমুচ্ছিল, চোখ খুলে টুপির মধ্যে মাথা গলিয়ে দাঁড়াল, বুক টান করে। সামনে এসে পড়েছে মিছিল। সলিম কিছু চিন্তা না করে, মিছিলে ঢুকে পড়ে। বজ্রমুষ্ঠি—চোখে আগুনের ফুলকি—গলায় স্লোগান উঠে আসে, ‘চলবে না চলবে না…’ সবাই দৌড় দিতে পারলেও, সলিম খোড়া-পায়ে পিছিয়ে পড়তে থাকে। শরীরে একের পড় এক, পুলিশের লাঠি পড়তে থাকে। মাটিতে পড়ে যায় সে, কুণ্ডলী পাকায় শরীর—শীতের রাতের কুকুরের মতো। মার চলতেই থাকে…
ঘরে ফিরে স্ত্রীকে সামনে পায় না। বিছানায় উঠে ফোঁপাতে থাকে। দুএকজন উঁকি দিয়ে দেখে যায়।
‘ওই মাগি, ওদিকে তোর ভাতার মরতে আছে, আর তুই মনের সুখে উঁকুন মারিস…’
মালা অবাক হয়ে বলে, ‘আবার কী হইল?’
‘যা দেখ গিয়া—কারা যেন মাইরা এক্কেরে ফাটায়া দিছে…’
‘কী কও! কিছুক্ষণ আগেই-না একবার মাইর খাইয়া পা কাইটা আইল! আইজ কা কি উনার মাইরের সিডিউল আছে! এখন তো আবার আমারে ধোলাই দিব।’
‘না লো মাগি, হেই ক্ষ্যামতা নাই—দেখ গিয়া।’
‘আচ্ছা কিছুক্ষণ পরপর তুমি কই যাও, আর মাইর খাইয়া আসো?...’
‘চুপ কর শালি…উহু-হু…’
পিঠে লাঠির আঘাতের লম্বা লম্বা দাগ, মাঝে মাঝে চামড়া কেটে গেছে। মলম লাগায় আর আস্তে করে বলতে শুরু করে. ‘খালি খালি আমারে মারো… এর নাম আল্লার মাইর…’
‘চুপ কর শালি. শেরেক করিস না, দোজখে যাবি… পুলিশের মাইর, পুলিশের… আ-হা-হা শালা মনে হয়, হাড্ডি গুঁড়া কইরা দিছে…’
‘বিয়ের পর কত মিঠা কথা কইতা—দুঃখ-কষ্ট, সুখ-শান্তি সব ভাগ কইরা নেব—আর এহন খালি মারো।’
সলিম কোনও জবাব দেয় না। কিছু সময় চুপ করে থাকে, পরে মালা বলে, ‘ঠিক কথাই তো কইছিলা, সব কিছু ভাগ কইরাই তো দেও তুমি। কার কাছে মাইর খাইয়া আইসা, আমারে মাইরের স্বাদ বোঝাও—সমানে সমান, হি হি হি।’
মালা গড়িয়ে পড়তে চায় বিছানায়। হাসি থামাতে চায়, পারে না। ‘দুই জনের কপালেই মাইর হি হি হি।’
সলিম বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে, মুখে কথা যোগায় না। কার চুলোয় যেন চ্যাপা-শুঁটকির ভর্তা সাঁতলাতে থাকে। গন্ধে ভুরভুর করে— চারপাশ ভেসে যায়। মালার কুলকুল নদীর মতো হাসির ঝঙ্কার সেই গন্ধে চাপা পড়ে যায়।
আহা রুবন
০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:১৭
আহা রুবন বলেছেন: গল্পটি পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
২| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৯
খায়রুল আহসান বলেছেন: পায়ের আঠালো তলা মেঝের সাথে আটকে গেল বারবার - ভাল পর্যবেক্ষণ!
‘দুই জনের কপালেই মাইর হি হি হি।’ - চমৎকার!
বাংলা ব্লগের এ আসরে আপনাকে সুস্বাগতম জানাচ্ছি। এখানে আপনার বিচরণ স্বচ্ছন্দ হোক, আনন্দময় হোক, দীর্ঘস্থায়ী হোক, ফলপ্রসূ হোক!
এখানে প্রকাশিত আপনার প্রথম গল্পটি দিয়েই আপনার ব্লগ পড়ার যাত্রা শুরু করলাম। অবশ্য এর আগে শেষেরটাও পড়ে নিয়েছি। গল্পটি ভাল লেগেছে। + +
১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:০৫
আহা রুবন বলেছেন: সত্যিই অভিভূত শ্রদ্ধেয় লেখক! আপনি খুঁজে প্রথমে চলে এসেছেন। তখনও আমার লেখা প্রথম পাতায় আসত না। আপনার উৎসাহ-ব্যঞ্জক মন্তব্য আমাকে শক্তি যোগাচ্ছে।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০২
প্রামানিক বলেছেন: মাইর খাও্য়ার গল্প ভাল লাগল। ধন্যবাদ