নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রেমিকার চিরশত্রু
১ম পর্ব,
"আসসালামু আ'লাইকুম স্যার, আমি নেওয়াজ রহমান, আপনাকে রিসিভ করতে এসেছি।"
বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত ড্রাইভার নেওয়াজ বললেন কলেজের নতুন লেকচারার আলাউদ্দিন নুর ইসলাম। আলাউদ্দিন নুর ইসলাম হলেন সদ্য চাকরিপ্রাপ্ত নামকরা কলেজের সহকারী লেকচারার। নেওয়াজ রহমানকে দেখে তিনি বললেন, "আসলে সরি আমি চাই নি আপনি এই ছুটির দিনেও ডিউটি করেন!"
উত্তরে তিনি বললেন, "কি যে বলেন না স্যার! বাসায় বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না। রিটায়ারমেন্ট তো খুব কাছে চলে আসছে, এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকি, কিছুদিন পর তো ছুটি হবেই!"
রেস্ট হাউজে যাওয়ার রাস্তায় আলাউদ্দিন এবং নেওয়াজ বেশ খানিকক্ষণ কথাবার্তা বললেন। শহর, এলাকা, পরিবেশ সম্পর্ক অল্পস্বল্প ধারণা নিয়ে নিলেন। আলাউদ্দিনকে নেওয়াজ বললেন, "আপনারদের মত বড় বড় লোকের তো স্যার আইনি কোনো সমস্যা নাই, তুড়ি মারতেই পুলিশ হাজির! যত ঝামেলা সব আমাদের মত ছোট কর্মের মানুষের!" আলাউদ্দিন হেসে বললেন, "কি যে বলেন না নেওয়াজ চাচা! সবই নিজের ওপর ডিপেন্ড করে।" ফিরতি প্রশ্নে বলেন, "না স্যার, সম্পূর্ণ ভুল এটা। আমার জমির মামলা নিয়ে এপর্যন্ত পুলিশকে, এলাকার নেতাকর্মীকে যত টাকা দেয়া লাগছে তাতে আমার আরও দুইটা জমি কেনা যাইতো! এরপর আশা ছেরে দিছি স্যার। তারা আমার কাছে জবাব না দিল! ওই আল্লাহর কাছে জবাব দেয়া লাগবে আর আল্লাহই বিচার করবে।" আলাউদ্দিন বললো, "আমিও দোয়া করি যেন দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়।"
"পয়সাওয়ালা আর ক্ষমতাবান, এই দুই শ্রেণিই শুধু বিচার পায় স্যার।" নেওয়াজ বড্ড আফসোসের সাথে বললেন। একটু আবারও বললেন, "স্যার একটা কথা বলি যদি মনে কিছু না নেন?" "জ্বি অবশ্যই!"
"স্যার, আমার এই কর্মজীবনের ৩০বছরে অনেক কিছু দেখছি আর শিখছি, আপনার কাছেও একটাই অনুরোধ, জীবনে অনেক লোভনীয় অফার আসবে কিন্তু কখনই ফাদে পা দিবেন না স্যার। টাকার ব্যাগ, বস্তাও আসবে, ক্ষমতাও কিন্তু স্যার লোভে পইরেন না প্লিজ!"
নেওয়াজ এর এই কথাটায় মনে মনে বেশ বিরক্ত হল আলাউদ্দিন! একটু ঝেরে কেষে বললো, "দোয়া করবেন যেন এমন কোন পরিস্থিতিতে না পরি।"
সকাল ৯টা, হাইওয়ের রুটিন পেট্রোলিং শেষে থানায় ফিরছেন সিনিয়র ইন্সপেক্টর মকবুল। একটা ট্রাক যব্দ করেছেন তিনি। ট্রাকের ড্রাইভারের গালে কষে এক চড় মেরে বললেন, "নে এবার তোর মালিকরে ফোন করে বল ট্রাক থানায় আর পুলিশ জরিমানা করছে, এসে টাকা দিয়ে ট্রাক নিয়ে যেতে।"
ইন্সপেক্টর মকবুল, ছোট বেলায় একবার গ্রাম্য পঞ্চায়েত প্রভাবশালীর পক্ষে যাওয়ায় তিনি তখন থেকেই লক্ষ্য সেট করে ফেলেছিলেন যে করেই হোক তাকে পুলিশ হতেই হবে। যেন তার দিকে কেউ আঙুল বা চোখ তো পরের কথা কেউ যেন কেউ খেয়ালেও তাকে নিয়ে কটু কথা বলতে না পারে! তার এই স্বভাব এবং লোভ তাকে আজ ক্ষমতার এমন স্থানে নিয়ে এসেছে যেখানে সে একাই রাজা!
সকাল সকাল নাস্তা সেরে নাস্তা সেরে কলেজের দিকে রওনা হলেন আলাউদ্দিন। ড্রাইভার নেওয়াজ তাকে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্য রওনা হলেন। যাত্রাপথে বললেন, "নেওয়াজ চাচা, আপনার আর কষ্ট করে আমাকে কলেজে পৌঁছে দিতে হবে না, অনেক অনেক শুকরিয়া আপনার। শুধু একটা উপকার করেন, সেটা হল আমি বাসা নিব এখানে। তো কোথায় ভাল হবে যেমন এলাকা, পরিবেশ এগুলা একটু জানাবেন কষ্ট করে।" নেওয়াজ হেসে বললেন, "স্যার আপনার পরের কাজটা আমিই আজই করে দিব কিন্তু ১ম কথাটা না! অন্তত স্যার যে কয়েকদিন আপনি রেস্ট হাউজে আছেন ততদিনই আমি আপনার ডিউটি করতে চাই! মানা করবেন না স্যার!"
আলাউদ্দিন রাজি হয়ে গেলেন। কলেজে সবার প্রথমে প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে গেলেন। দেখা সাক্ষাৎ শেষ করে হাটা দিলেন ইংরেজি বিভাগের দিকে। ডিপার্টমেন্ট হেড স্যারের সাথে কথাবার্তা শেষ করে ক্লাসে ঢুকলেন তিনি। মোটামুটি বড় এক ক্লাস রুম এবং অঢেল শিক্ষার্থী দেখে তিনি ভড়কে গেলেন। স্বাভাবিক হয়ে বললেন, "ক্লাস, আমার নাম আলাউদ্দিন নুর ইসলাম, আমি আপনাদের ইংলিশ টিচার এবং আজই আমার ১ম দিন আপনাদের সাথে। ইনশাআল্লাহ আমি আপনাদের আমার সর্বোচ্চ শ্রম দিতে চাই আশাকরি আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। তো আমি আমার পরিচয় দিলাম এবার আপনাদের পরিচয়টা আমাকে এক এক করে দিন এবং আজ ১ম ক্লাস তাই আজ কোনো পড়ালেখা আমরা করবো না। আজ আমরা একে অপরকে জানবো।"
এরপর ক্লাসের এক এক করে ছাত্রছাত্রী তাদের পরিচয় দেয়া শুরু করলো। কোনরকম প্রথম দিনের ক্লাস শেষ করলেন আলাউদ্দিন।
বিকেল বেলা, আলাউদ্দিনের কাছে কল আসলো নেওয়াজ চাচার। রিসিভ করতেই বললেন, "আসসালামু আ'লাইকুম স্যার, স্যার আপনার জন্য যাবতীয় তথ্য জোগাড় করছি স্যার, যদি সময় থাকে তাহলে স্যার আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাই?" আলাউদ্দিন ঘড়িতে সময় দেখে ভাবলেন এখন তার কোনো কিছু করার নেই তারচেয়ে বরং বাসা দেখে আসুক কেননা সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাসা দেখে লাভ নেই! তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং নেওয়াজ চাচাকে আসতে বললেন।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে কয়েকটা বাসা দেখলেন আরও শিক্ষক বলে কেউ আর ব্যাচেলর বলেও নাক সিটকায় নি।
এরমধ্যে একটা বাসা তার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। তিনতলা বিল্ডিং এর ছাদে দুই রুমের চিলেকোঠা! আলাউদ্দিন আপাতত চিন্তামুক্ত! বড় ফ্ল্যাট না নিয়ে ছোট আর নিরিবিলি বাসাই তার দরকার।
পরেরদিন ক্লাসে,
সিলেবাস দেখে নিয়ে ইংরেজি ১ম পত্র পড়াতে শুরু করলেন। এমন সময় পিছনে বসা কিছু ছাত্রের হৈচৈ কানে এল। প্রথমবার সতর্ক করে দিলেন কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই আবার ক্লাসের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করে দিল! পিছনে বসা কয়েকজন ছাত্রকে সামনের কয়েকজন ছাত্রের সাথে আসন পরিবর্তন করে দিয়ে বললেন, "ক্লাস, আমার কাছে আপনাদের জন্য দুইটা অপশন, প্রথম চুপচাপ থাকা। দ্বিতীয়ত, ক্লাস ভাল না লাগলে দয়া করে ক্লাস ত্যাগ করবেন, রোল কল নিয়ে টেনশন করবেন না কারণ আমি হাজিরা খাতা সাথে নিয়ে আসি না। এবং সেই সাথে আপনারা যারা ব্যাকবেঞ্চার, আমি আপনাদের বেশি নজরে রাখি তাই কেউ ভাববেন না পিছনে বসেছেন বলে ছাড় পেয়ে যাবেন!"
বর্তমানে কলেজে তার শিক্ষকতার বয়স ৬ মাস। এটুকু সময়ের মধ্যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন! অনেক ছাত্রছাত্রী আলাদা ভাবে প্রাইভেট পড়ানোর কথাও বলল আলাউদ্দিনকে স্যার কে কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। সহজ কথায় বললেন ক্লাসে যাই পড়াই এটাই মনোযোগ দিয়ে পড়েন সবাই। এরমধ্যে কিছু কিছু ছাত্রী এমন থাকে যে স্যারদের প্রেমে পরে যায়! আলাউদ্দিনের ক্লাসেও এমন কয়েকজন আছে। এবং এরাই প্রাইভেট পড়ানোর কথা প্রথম বলেছিল! আলাউদ্দিন সহজ সরল মনের মানুষ যার ফলে এতকিছু ভাবার সময় নেই তার।
অনেকক্ষণ হল টেলিফোন বাজছে। দ্বিতীয়বার ফোন বাজতেই রিসিভ করে বললেন, "ইন্সপেক্টর মকবুল বলছি, আপনি কে বলছেন?"
ফোন রেখেই ডাকলেন কনস্টেবল হারুন এবং একজন মহিলা পুলিশ দিলরুবা কে। এদের নিয়েই চলে গেলেন স্পটে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন গ্রামের মানুষজন একজন ছেলেকে ঘিরে রেখেছে এবং হালকা মারধর করেছে। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেটাকে গাড়িতে তুলে নিল এবং দিলরুবাকে বললেন মেয়েটাকে নিয়ে আসতে!
গাড়িতে ছেলেটাকে প্রশ্ন করল, "বাবা কি করে?"
- স্যার, ব্যবসায়ী।
- তোর বাপের নাম্বার দে। জানানো উচিৎ তোর কার্যকালাপ!
ছেলেটা অনেক আকুতি মিনতি করে বললো, "প্লিজ স্যার আব্বুকে জানাবেন না।"
কনস্টেবল হারুন বললো, "তোরে জেলে নিয়ে যাবো নাকি ছেড়ে দিব?"
- স্যার, ছেড়ে দেন স্যার আর কখনও এমন করব না।
- আচ্ছা? তাহলে বাইর কর যা যা আছে!
ইনস্পেক্টর বললেন, "এবারের মত ছেড়ে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আবার দেখা হলে গুম হয়ে যাবি।" তারপর ড্রাইভারকে বললেন বাজারের একটু আগে ওকে ছেড়ে দিতে যেন কেউ না দেখে।
ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে হারুনকে জিজ্ঞেস করলেন, "কত রে হারুন?"
হারুন হাসতে হাসতে টাকা গুনে বললো, "স্যার ১৫হাজার!" গাড়িতে বসা সবাই হাসতে শুরু করল! ড্রাইভার হাসতে হাসতে বললো, "স্যার এরা আরও ধরা খাক, আমরা আরও পেতে থাকি।"
"স্যার, আসতে পারি?" দরজার সামনে দারিয়ে অনুমতি চাইলো নিঝুম।
"হ্যা, এসো।", আলাউদ্দিন বললেন।
- স্যার একটা হেল্পের জন্যে আসছি স্যার, আপনি ইউনিট ১ এর সি৪ এর প্রব্লেমগুলো গতক্লাসে সলভ করেন নি!
আলাউদ্দিন ওর কথা শুনে কিছুটা বিচলিত হলেন। তিনি এক সিরিয়ালে সব করিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কিছু মিস দিয়েছেন বলে তার মনে হচ্ছে না। তিনি বললেন, "আমার যতদুর মনে আছে আমি সলভ করিয়েছি এবং আমার মনে হচ্ছে আপনি হয়তো সেদিন আসেন নি!"
- না স্যার আমি প্রত্যেকদিনই আপনার ক্লাস করি স্যার, বিশ্বাস না হলে এটেন্ডেন্স এর খাতা দেখে নিন?"
একথা শুনে আলাউদ্দিন হেসে বললেন, "আমি এটেন্ডেন্স খাতা নিয়ে ক্লাসে যাই না এবং আমি শিওর আপনি ক্লাসে আসেন নি সেদিন! ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আপনি যদি সলভ চান তাহলে ক্লাসের গ্যাপ টাইমে এসে সলভ করে নিয়েন অথবা আপনার ফ্রেন্ডদের সাহায্য নিতে পারেন। কেউ একজনের কাছে তো সলভ আছেই!"
স্যারের কথা শুনে নিঝুমের কপাল বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে তার এই ট্রিক কাজ করে নি! একটা বাহানা নিয়ে এসেছিল কথা বলতে কিন্তু বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হল না।
বিকেল বেলা পার্কে হাটছিলেন আলাউদ্দিন। আজকের পরিবেশটা মোটামুটি নিরব। ক্লান্ত হয়ে একটা বেঞ্চে বসে পরলেন তিনি। মোবাইলটা বের করতেই দেখে নেওয়াজ চাচার কল! রিসিভ করতেই বললো, "আসসালামু আ'লাইকুম স্যার, কেমন আছেন?"
- আলহামদুলিল্লাহ ভাল, আপনার কি অবস্থা চাচা?
নেওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "আজ আমি রিটায়ার হলাম স্যার। একটা অনুরোধের জন্য কল দিলাম আপনাকে স্যার।"
"জ্বি বলেন কিভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?"
নেওয়াজ উত্তরে বললেন, "স্যার কখনও যদি গাড়ি কেনা হয় আপনার, আমাকে আপনার ড্রাইভার হিসাবে নিয়োগ দিয়েন স্যার। স্টেয়ারিং এ হাত ছাড়া নিজেকে কেমন যেন লাগে স্যার।"
নেওয়াজ চাচার কথায় আলাউদ্দিন বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন। পরে বললেন, "অবশ্যই চাচা, এই অচেনা শহরে আপনি আমার অনেক অনেক সাহায্য করে গেছেন।"
এমন সময় আলাউদ্দিন দেখতে পেল কিছু ছেলে একটা মেয়েকে টিজ করছে। ফোন রেখে আগাতে থাকলো সে। কাছাকাছি এসে বেশ রেগে গিয়ে বললেন, "এই ছেলেরা!!! কি করছো তোমরা?" মেয়েটা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে আলাউদ্দিনের পিছনে দারালো! আলাউদ্দিন বারবার বুঝাচ্ছে ছেলেগুলোকে এসব করা ঠিক না/তোমরা তোমাদের বোনদের কথা চিন্তা কর, ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু ছেলেগুলোকে দেখে মনে হল তারা নেশাগ্রস্থ। রাগের মাথায় আলাউদ্দিন দুইজনের গালে চড় বসিয়ে দেয়! এতে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে! চিল্লাচিল্লিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আশেপাশে লোকজন জড় হয়ে গেল এবং আলাউদ্দিন পুলিশকে কল করে ঘটনা বলে দিলেন। কয়েক মিনিটের ভিতরে পুলিশ এসে তাদের সবাইকে আটক করে নিয়ে যায়। পরিবেশ শান্ত হলে মেয়েটাকে বললো, "আপনার বাসা কোথায়? আমি রিক্সা ডেকে দিচ্ছি।"
"স্যার আমি আপনার স্টুডেন্ট, নিঝুম!"
আলাউদ্দিন মোটামুটি ধাক্কা খেয়ে গেলেন! হিজাব বোরকায় তাকে চিনতে পারে নি আলাউদ্দিন। জিজ্ঞেস করলেন, "এদিকে কিসের কাজ আপনার? কি জন্যে এসেছেন?"
"স্যার, জহুরা ম্যামের কাছ থেকে পড়ে ফিরছিলাম।"
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, "এরা কি প্রায়ই ডিস্টার্ব করে আপনাকে?"
নিঝুম বললো, "যখন যাকে পায়। এর আগেও ডিস্টার্ব করছে তবে আজ বেশিই করছে!"
"ঠিক আছে, বাসায় যান, সাবধানে থাকবেন আর পুলিশের নাম্বারটা নিয়ে নিন, কখনও এমন বিপদে পরলে সাথে সাথে কল দিবেন।" এই বলে রিক্সা ডেকে নিঝুমকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন।
আলাউদ্দিন ক্লাসে তেমন মনোযোগ দিতে পারছেন না। শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ করছে তার।
"ওকে ক্লাস, আমি আর বেশি সময় থাকতে পারছি না, শরীরটা খুব খারাপ। আজ যা পড়ালাম সামনের রবিবার আমাকে দেখাবেন।"
আলাউদ্দিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে পরল। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করে বাসায় চলে গেলেন। আলাউদ্দিনের অসুস্থ চেহারাটা দেখে নিঝুমের ভাল লাগলো না! কয়েকজন বান্ধবীকে বললো স্যারকে দেখতে যাওয়া দরকার। অনেকেই রাজি হল। কয়েকজন বললো, "ক্লাসে ছেলেদের কয়েকজনকে সাথে নিয়ে যাই। লোকজনের মন মানসিকতা কখন কি ভাববে বলা যায় না!"
সপ্তাহ দুই পর,
"ওকে ক্লাস, আজকের মত আপনাদের ফার্স্ট টার্ম মানে ইয়ার ফাইনালের জন্য শেষ ক্লাস এবং আশাকরি আপনাদের সকলের প্রিপারেশন ভাল। আমি আমার তরফ থেকে কোনরকম ঘাটতি রাখি নি এবং আপনাদেরও বলবো আপনারাও কোনো রকম ঘাটতি রাখবেন না পড়ায়। দেখবেন রেজাল্ট ভাল হলে আপনার নিজের কাছেই ভাল লাগবে। তো রুটিন পেয়ে গেছেন সবাই?"
আলাউদ্দিনের প্রশ্নে সবাই বলে উঠল, "জ্বি স্যার!"
"তো ঠিক আছে ক্লাস, আমি আপনাদের সবাইকে শুভ কামনা জানাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ, আসসালামু আ'লাইকুম।"
আলাউদ্দিন ক্লাস শেষ করে বের হলেন। রুমে বসতেই ছাত্রীদের এক গ্রুপ এল তার কাছে। বেশ বিনয়ী সুরে অনুরোধ করলো, "স্যার প্লিজ কিছু স্পেশাল সাজেশন দিন না!" বাইরে তাকিয়ে দেখে ছেলেরা হাসি তামাশাও করছে! ছাত্রীদের বিনয়ী সুরে আলাউদ্দিন আবার ফিরে এল ঘোর থেকে এবং বললো, "দেখেন আমি সাজেশন দেয়া পছন্দ করি না। আপনারা সকলেই ভাল স্টুডেন্ট এবং সাজেশন চাওয়া আপনাদের একদমই মানায় না।"
নিঝুম পিছনে দারিয়ে ছিল। কয়েকটা টপিক বুঝতে পারে নি সে এবং সেগুলা নিয়েই এসেছিল কিন্তু এই ভীরের জন্য বলতে পারছে না! ছাত্রীরা চলে গেলে নিঝুম তখনও দারিয়ে! তাকে দেখে আলাউদ্দিন বললো, "কিছু বলবেন?" নিঝুম টপিকগুলো নিয়ে স্যারের সাথে আলোচনা করতে থাকলো। অনেকক্ষণ পড়া বুঝিয়ে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ২য় বর্ষের ক্লাসের ২০মিনিট অতিক্রম হয়ে গেছে! তড়িঘড়ি তে ক্লাসের দিকে রওনা দিলেন আলাউদ্দিন।
বাজার থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিলেন আলাউদ্দিন। এতটাই ক্লান্ত লাগছিল তার বিছানা ছেড়ে উঠার শক্তিও পাচ্ছিল না! ফ্যানের ঘুরতে থাকা দেখতে দেখতে কখন ঘুমে তলিয়ে গেলেন টের পেলেন না। ঘুমে বিভোর আলাউদ্দিন ভুলে গেলেন বাজারের ব্যাগে রাখা তরিতরকারি! অনেকখানি সময় এরমধ্যে পার হয়ে গেছে। এমন সময় কয়েকবার কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। মোবাইল বের করে সময় দেখে রাত ৯টা বাজে! তখন পর্যন্ত কলিং বেল বাজছে। দরজা খুলে দিতেই দেখে নিঝুম! তাকে দেখে আলাউদ্দিন বেশ ভরকে গেল! চুপচাপ থাকলো কিছুক্ষণ।
নিঝুম বললো, "স্যার, ভিতরে আসতে পারি?" আলাউদ্দিন বেশ চিন্তায় পরে গেলেন কি করবেন এটা ভেবে। একে তো এত রাতে এসেছে তারপর আবার রাস্তাঘাট সুনসান নিরব! ফেরত যেতে বলাও ঠিক ভাবছে না। শুধু প্রশ্ন করলো, "আপনি এত রাতে কেন?"
নিঝুম চুপচাপ রইলো। আলাউদ্দিন দেখলো নিঝুমের চেহারায় কেমন যেন শুকনো শুকনো ভাব! পরে বললো, "এক মিনিট অপেক্ষা করেন।"
যত দ্রুত সম্ভব কাপড় বদলে নিলেন এবং রুমের হাল হালকা পাতলা ঠিক করে নিলেন। নিঝুমকে ভিতরে নিয়ে আসলেন। এক গ্লাস পানি দিয়ে প্রশ্ন করলো, "এত রাতে আপনি একা বাইরে কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?"
নিঝুমের কপালে আবার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে! কিছু একটা বলতে যাবে কিন্তু বলতে পারছে না! একটুপর, কান্না শুরু করে দিল সে। আলাউদ্দিন বুঝতে পারছে না কি হয়েছে তার। আলাউদ্দিন আবারও বললো, "কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলেন, দেখি আমি কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা?"
নিঝুম তাও কিছু বলছে না! আলাউদ্দিন মনে মনে আন্দাজ করতে থাকলো কি হতে পারে ওর সাথে। অনেকক্ষণ ভাবার পর আবারও জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা সেদিন যে ছেলেগুলা ডিস্টার্ব করছিল তারাই কি আবার আপনাকে ডিস্টার্ব করছে?"
নিঝুম এবার তার দিকে তাকালো। অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া দেখে আলাউদ্দিন বুঝে নিল এমনই কিছু একটা হয়েছে নিঝুমের সাথে। আলাউদ্দিন কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে বললো, "আচ্ছা আজ আপনি আমার বাসায় থাকেন, আমি আপনার থাকার ব্যবস্থা করছি।" এই বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল সে। মনে মনে ভাবছে কি এক মসিবতের মধ্যে পরে গেল সে! বাজারের ব্যাগটা উঠাতেই খেয়াল করল কিসের যেন একটা আওয়াজ। ব্যাগের ভিতরে তরিতরকারি বের করে দেখে যে দুই হালি ডিম এনেছিল সবটাই ভেঙে মিশে একাকার হয়ে আছে! খুব কষ্টে দাত কটমট করে চেপে আফসোসটা দমিয়ে ফেললো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত ১১টা বাজে! নিঝুমকে ডেকে একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করলেন। সেদিন আর বাসায় কথা বললেন না আলাউদ্দিন। গেস্টরুমটা গোছগাছ করে নিঝুমকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিল। রুম গুছিয়ে নিঝুমকে ডেকে বললো, "আপাতত ঘুমান, ইনশাআল্লাহ সকালে আপনার সকল কথা শুনবো। আমি খাওয়ার পানি রেখে দিছি পাশেই। আর কিছু লাগলে অবশ্যই আওয়াজ দিবেন। শুভরাত্রি!"
জীবনে এত কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয় নি আলাউদ্দিন! নিজের বাসায় নিজেকে তার প্রচুর আনকমফোর্টেবল মনে হচ্ছে। হাত পা মেলিয়ে ঘুমানো বা চিত কাত হয়ে কোনকিছুতেই তার অস্থিরতা কাটছে না! মনের মধ্যে অজানা এক ভয় কাজ করছে। মান সম্মানের ব্যাপার এটা, অন্তত ছাত্র হলেও কোনো সমস্যা ছিল না কিন্তু তাই বলে ছাত্রী!
ফজরের আজানে ঘুম ভাঙলো আলাউদ্দিনের। কোনদিনও এমন ফজরের আযানে ঘুম ভাঙে নি তার। নামাজ পড়ে আবারও শুয়ে পরল সে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না! এদিক সেদিক ফিরতে ফিরতে ঘুমিয়ে গেল আলাউদ্দিন। চোখ খুলে দেখে সকাল ৭টা! শুক্রবারের সকাল, আরও একটু বেশি সময় ঘুমানোর ইচ্ছা ছিল তার। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে নিল কি কি নেই। যাওয়ার সময় ভাবলো নিঝুমকে ডাকা দরকার কিন্তু যে চেহারায় সে এখানে এসেছিল সেটা চিন্তা করে আলাউদ্দিন আর ডাকে নি তাকে। দরজাটা বাহির থেকে আটকে বাজারের দিকে রওনা দিলেন।
মাছের বাজার ঘুরে ৪ কেজি ওজনের একটা বোয়ালমাছ পছন্দ হল আলাউদ্দিনের। শুক্রবারের কথা চিন্তা করে ভেবে নিলেন ভাল মন্দ কিছু খাওয়া দরকার। মাছ পিস করে কাটিয়ে নিয়ে কাচা বাজারের দিকে হাটা শুরু করল সে। আজকের বাজারটা তার কাছে বেশ রমরমা লাগছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় নয়টার কাছাকাছি বেজে গেছে! বাকি কিছু তরিতরকারি কিনে বাসার দিকে রওনা দিল আলাউদ্দিন। রিক্সায় উঠতেই বাসা থেকে কল এল তার। মনে পরল গতরাতে কথা হয় নি বাসায়। নিঝুমের উপস্থিতিতে মন খুলে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠে নি তার। রিক্সাও চলতে লাগলো সেই সাথে আলাউদ্দিনের কথাবার্তাও!
রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে কল রাখার জন্য বাসায় বললো, "আচ্ছা আম্মু আমি রুমের কাছাকাছি এসে গেছি, রেস্ট করে ফ্রি হয়ে কল করবো নে, রাখি এখন। আসসালামু আ'লাইকুম।" চাবি দিয়ে তালা খুলতেই বাসার ভেতর থেকে কেমন যেন একটা অচেনা গন্ধ নাকে লাগলো তার! ভাবছে গতকালের ডিমের গন্ধ না তো এটা! বাজারের ব্যাগ থেকে তরিতরকারি ফ্রিজে রেখে নিঝুমের রুমের দিকে আগালো। রুমের কাছে যেতেই দেখে দরজা হালকা করে খোলা! "নিঝুম", বলে দুইবার টোকা দিল দরজায় কিন্তু কোনো সারা শব্দ এল না! চিন্তা করছে এখনও সে ঘুম কিনা! আলাউদ্দিন কি করবে বুঝতে পারছে না। তাই উল্টো দিক হয়ে আগাতে শুরু করলো। দরজা খুলেই ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে যা দেখলো সেটার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না! নিঝুমকে দেখে ভয়ে সে জড়সড় হয়ে গেল! বিছানার অর্ধেকটা রক্তে লাল হয়ে আছে! আলাউদ্দিন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নাটক সিনেমায় সে অনেকবার দেখেছে গলার সাইড এবং হাতের কব্জির আশেপাশে পালস চেক করা হয়, সেও চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই বুঝতে পেল না! নাকের সামনে আঙুল রাখলো নিঃশ্বাস চলে কিনা দেখার জন্য কিন্তু নিঃশ্বাসও চলাচল করছে না! এদিকে কলিজা শুকিয়ে আসছে তার। শরীর ঘাম দিয়ে উঠেছে তার। দরজা খোলা দেখে বাড়িওয়ালা খোজ নেয়ার জন্যে ভিতরে এলেন। আলাউদ্দিনের রুমে এমন দৃশ্য দেখে বাড়িওয়ালা আর দেরি করলেন না ভাল কিছু ভাবার! মুহূর্তের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল আলাউদ্দিন স্যারের বাসায় এই ঘটনা হয়েছে! এই ঘটনা বাতাসের বেগে ছড়িয়ে গেল এলাকায় এবং মোড় নিল এক টাইটেলে, "ছাত্রীকে ড্যাস ড্যাস ড্যাস.....!"
ঘটনাস্থলে পুলিশের পৌঁছাতে দেরি হল না! ইন্সপেক্টর মকবুল এসে আলাউদ্দিনের বাসা সিল করে দিলেন। এম্বুলেন্স এসে নিঝুমকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এদিকে আলাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করলেন পুলিশ। আশপাশের ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে আলাউদ্দিনের ব্যাপারে প্রাথমিক জিজ্ঞেসবাদ চলতে থাকলো! এবং তারই এক ঘন্টার মধ্যে খবর এল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে নিঝুম! ঘটনা ধীরে ধীরে প্রচার হতে থাকে টেলিভিশনে এবং অন্য শহরে থাকা আলাউদ্দিনের পরিবারেরও জানতে দেরি হল না ছেলের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা! জেল হাজতে আলাউদ্দিনের সামনে বসে আছেন ইন্সপেক্টর মকবুল। আলাউদ্দিন বললো, "স্যার আমি কিছু করি নি, সে আমার স্টুডেন্ট। আমি এমনটা ভাবতেও পারি না স্যার!"
আলাউদ্দিনের কথা শুনে তিক্ত একটা হাসি দিয়ে মকবুল বললেন, "সিরিয়াসলি?"
- স্যার আমি ইয়ার্কি করছি না।
এটা শুনে মকবুল তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আলাউদ্দিনের গালে চড় বসিয়ে দিলেন এবং বললেন, "এক সপ্তাহের রিমান্ডে আছিস তুই, তিনদিন ধোলাই আর বাকি চারদিনে সুস্থ হয়ে যাবি! আর এরমধ্যে যা যা ভিতরে থাকে সব বের হয়ে আসবে।"
বেশ ব্যথা পেয়েছে আলাউদ্দিন! বাধা হাত জোড়া ঠোটে স্পর্শ করে ভেজা ভেজা অনুভব হল তার। দেখলো রক্ত বের হয়েছে। একটু হেসে বললো, "ইন্সপেক্টর, আপনি যাই বলেন যার যাই করেন, আমি আমার কথা থেকে এক চুলও নড়চড় হবো না। দেখা যাক শেষটা কি হয়.....!"
চলবে...
[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন]
২৮ শে মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩২
দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: একদমই ঠিক....
২| ২৮ শে মে, ২০২০ রাত ১০:১৪
নেওয়াজ আলি বলেছেন: অসাধারণ, ভালো লেগেছে
২৯ শে মে, ২০২০ রাত ১:১৪
দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই
৩| ৩০ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৮
মিরোরডডল বলেছেন:
প্রথম পর্ব পড়ে নেক্সট পর্ব পড়ার আগ্রহ হচ্ছে।
দেখা যাক কি হয়!
৩০ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১১:৫৬
দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: জ্বি অবশ্যই এবং আমি পর্বীয় গল্পগুলো একটু বিস্তারিত লেখি তাই আস্তে ধীরে পড়তে পারেন।
©somewhere in net ltd.
১| ২৮ শে মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১২
রাজীব নুর বলেছেন: পয়সাওয়ালা আর ক্ষমতা বানরাই সমস্ত অপকর্ম করে।