নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবতে ভালবাসি, সেই ভাবনা যদি কোনো ঘটনায় মিলে যায় তবে তাকে লিখতে ভালবাসি! সেই লেখায় যদি কেউ বিন্দুমাত্র উপকৃত হয় তবে তাতেই আমার খুশি, আমি লেখাকে ভালবাসি।

দর্পণের প্রতিবিম্ব

প্রেমিকার চিরশত্রু

দর্পণের প্রতিবিম্ব › বিস্তারিত পোস্টঃ

Heart & Soul

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:১০




শেষ পর্ব,


আমি আবারও আকিব কে কল দিলাম। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগতেছিল তখন। আকিবকে বললাম, "দোস্ত কেমন যেন কোনোকিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না! সুমিকে নিয়ে কোনদিনও আমি প্রেম ভালবাসার কিছু ভাবি নি!"
সে হেসে বললো, "হ ভাই, নতুন নতুন প্রেমে পরলে এমন আরও অনেক কিছু হবে সামনে!"
"তুই এখন আমার মজা নিবি? নে তোর তো সময় এখন!"
- আরে আমরা যা কল্পনা করি না সেটাই তো হয় বেশি!
- ঠিক আছে, ফ্রি হয়ে দেখা করিস অনেক কথা আছে।
কল কেটে আরও কিছুক্ষন বসে রইলাম। এরমধ্যে সুমির কল! আমি রিসিভ করে চুপ করে থাকলাম! সে বললো,
- কথা বের হচ্ছে না কেন তোর মুখ দিয়ে?

সত্যিই সেদিন কথা বের হয় নি! অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললাম, "তুই বলতে থাক, আমি শুনতে থাকি।" সুমি হেসে দিল! অল্প আওয়াজে বললো, "গাধা কোথাকার!"

আমি শুধু সিনেমাতেই দেখতাম প্রেম কত সহজে হয়ে যায় আর কত সহজে কিছু কত চেঞ্জ হয়ে যায়! আমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছিল আস্তে আস্তে। এরপর থেকে প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়ার আগে মুখ ভাল করে ধুয়ে যেতাম, খুব সাদামাটা আমি আমার চুলগুলো আঁচড়ে যেতাম। কাপড় চোপড় চয়েসে হালকা পরিবর্তন করতে শুরু করলাম। কোন কালার সুমির পছন্দ হবে কিংবা দেখতে সুন্দর লাগবে আরও নানান ভাবনা! একদিন বিকালে সুমির সাথে হাটতে বের হইছি। এর আগে সুমির সাথে কথা বলতে কোনো সমস্যা হতো না কিন্তু ইদানিং বেশ সমস্যা হচ্ছে। ও পাশে থাকলেই আমার কথা আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে যায়! বিষয়টা সুমি বেশ ভাল করে খেয়াল করে। এমনই একদিন সুমি বললো, "কি ব্যাপার আরাফ? তোর মধ্যে দেখি ব্যাপক চেঞ্জ এসে গেছে? কিভাবে রে? তোরে এখন দেখে তো মনে হচ্ছে দশ বছরের চ্যালেঞ্জ ইজিলি পোস্ট করা যাবে!"
- আরে কি বলিস এসব? এমনি হয়তো এমন লাগতেছে তোর কাছে! তোর চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, ডাক্তার দেখা।
সে বললো, "হুম তাহলে ডাক্তারকে বলতে হবে ডাক্তার আমি একটা ছেলেকে দেখতে দেখতে চোখ নষ্ট করে ফেলেছি! কি করা যায়?"
আমি বললাম, "আমি যদি সেই ডাক্তার হই তাহলে বলতাম চোখ বন্ধ করে রাখুন!"
এটা বলেই হাসতে শুরু করলাম। আর সুমি সেদিন কি রাগ! ওইদিন আর কথা বলে নি, ফোন দিলেও রিসিভ করে নি, ম্যাসেজ ব্লক করে রেখেছিল! হয়তো ইচ্ছা করেই, রাগ সে করতে পারে না, অভিনয় করে রাগ করার।
.
একদিন দুপুরে কল দিয়ে বললো মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ তার! আমি কারণ জিজ্ঞেস করার পর বললো, "হলের ছাদ, বারান্দা সবখানেই দেখি অনেকেই যাস্টফ্রেন্ড, বেস্টফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড বা যেকোনো টাইপ ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতেছে! আর আমার মেটরা তো সারাদিন তাদের শত শত বয়ফ্রেন্ডকে প্রেমের লাইনে দাড় করিয়ে রেখে কথা বলতেছে!"
আমি বললাম, "আরে মাত্র মিনিট পাঁচের দুরত্ব আমাদের দুইজনের মাঝে যদি একে অপরের দিকে আগাতে থাকি। এই পাঁচ মিনিটের দুরত্বে আমরা ফেস টু ফেস কথা বলতে পারি? কেন শুধু শুধু মোবাইল কোম্পানির পকেটে টাকা ভরে কথা বলতে যাবো? সেটাও আবার এই ইন্টারনেটের যুগে?"

আমরা কথা শোনার পর অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, "ভুলই হয়ে গেছে তোরে কল করা, রাখ ফোন, বলদ কোথাকার!!"

এই বলেই কেটে দিল! আমি একটুপর আমিরকে ফেসবুকে কল করলাম। জিজ্ঞেস করলাম সুমির এমন করার কাহিনী কি? সেও একইভাবে আমাকে "বলদ" এবং সাথে আরও অনেক কিছু আখ্যায়িত করে বললো, "সুমি চাচ্ছিল তার বাকি ফ্রেন্ডদের মতও তোর সাথে কথা বলতে অন্তত যেন তাদের থেকে মুডটা সরে আসে ওর! আর তুই বলদ ইন্টারনেটের যুগ, দুরত্ব কয় মিটার এসব বলিস ওরে? মানুষ হবি কবে তুই?"
এসব শুনে বললাম, "আচ্ছা ঠিক আছে তোরে কল দিয়ে আমি মানুষ হয়ে গেছি, এবার রাখি না হলে তার মেজাজ আরও খারাপ হবে!"
তখন ভাবলাম আসলেই আমিরের কথা ঠিক! সুমি তো কারণ বলছিল কেন কল দিছে। আমি আবারও কল করলাম সুমিকে কিন্তু বরাবরের মতই রিসিভ করলো না! আমি মেসেজ করলাম, "আমি জানি তোর দ্বারা রাগ করে থাকা সম্ভব না"
এরপরই কল করল সুমি, "কেমনে আর রাগ করে থাকবো? সবসময় তো তোর চেহারাটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে!"

হেসে খেলেই দিনগুলো যাচ্ছিল আমাদের। সপ্তাহে একদিন আকিব ক্যাম্পাসে আসতো, আড্ডা দিতাম আর পুরানা যত কেচ্ছাকাহিনী আছে যা বলে আমাকে পচানো যায় সেটাই সুমিকে বলতো আকিব। এভাবে দেখতে দেখতে আমার ভার্সিটি জীবনের এক অংশের ইতি ঘটল এবং সেই সাথে সুমিরল দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলো। রেজাল্টে দেখলাম আমার সিজিপিএ ৩! আর সুমির ৩.৮৭! এ এক আকাশ পাতাল তফাৎ! কয়েকদিন পর সুমি বললো, "আরাফ তুই ও বিদেশের জন্য প্রিপারেশন নেয়া শুরু কর? আমরা একসাথে পড়ি? চিন্তা কর ভাল কত ভাল হবে?"
আমি বললাম, "বিদেশ? আমার দেশ থাকতে বিদেশে যাওয়া আমার পছন্দ নারে। তাছাড়া তুই যে দেশে এপ্লাই করবি সেখানে আমার আব্বুর সামর্থ্য হবে না। বরং তুই যাচ্ছিস যা, যা যা শিখবি আমাকেও হালকা পাতলা শিখাস। এটাই অনেক আমার জন্য!"
সে আবারও বললো, "একটু ভেবে দেখ? আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কর?"
"আমার ভবিষ্যৎ তুই, তোকে ভাল দেখতে চাই এবং যতটা পারি ভালবাসতে চাই। তোর ফিরে আসতে আসতে ইনশাআল্লাহ আমাকেও ভাল পজিশনে দেখবি। আর আমার প্রত্যেকটা দোয়ায় তুই থাকবি। ফিআমানিল্লাহ।"


শীতের রাত, চারপাশে কুয়াশায় ঢেকে গেছে। শরীরটা গরম করার জন্য চায়ের খোঁজে বের হলাম। ভাবতে ভাবতে থাকলাম সুমিকে কিছু উপহার দিব কিনা। আর দিলেও কি দেয়া যায়? সাজেশন নেয়ার জন্য কল করলাম আকিবকে,
"দোস্ত, সুমিকে কিছু গিফট দেয়া জরুরী না?"
সে বললো, "যদি জরুরী মনে করিস তাহলে জরুরী! আর বাকিটা তোদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর উপর নির্ভর করে।"
- আমি তো কিছু দিতে চাচ্ছি, কি দেয়া যায়?
- দোস্ত, আমার এসব সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নাই! তোর যা মন চায় দিয়ে দিস, বাকিটা কপাল...
আমি বললাম, "কাল তোর ডিউটি সন্ধ্যায় শেষ না? তাহলে বের হয়ে কল দিস, দেখি কি কেনা যায়।"
আমিরের কাছ থেকেও সাজেশন নেয়া দরকার কিন্তু এই টাইমে বান্দা কঠিন ঘুমে আছে।
পরেরদিন, পাক্কা এক ঘন্টা বিভিন্ন দোকানে চক্কর দেয়ার পর একটা জিনিস ব্যাপক পছন্দ হল, চাবি রিং! হাজারটা রিং থেকে একটা বেছে নিলাম। আশাকরি ওর ভালই লাগবে। আকিব বললো, "একটা চাবি রিং কিনতে তোর এক ঘন্টা ভাবতে লাগলো আর এক ঘন্টা খুঁজতে লাগলো! আমার আবার মনে হচ্ছে আমি অসময়ে ট্রেনিং এ এসে পরছি!"
আমি বললাম, "এখনও একটা জিনিস বাকি আছে মনু।" "আবার কি?"
"ঘড়ি!"
.
সেদিন আর হলে ফিরলাম না, বৃহস্পতিবার ছিল বিধায় আকিবের বাসায় চলে গেলাম। নতুন বাসা নিছে সে। বললো সামনের মাসেই সে মা বাবা কে নিয়ে আসবে! আমি আকিব কে বললাম, "কি মনে হয় তোর? আমি কি সুমির যোগ্য হতে পারবো?"
"না বলতে কোন শব্দ নাই আর যদি কখনও না শব্দ চলে আসে তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করে নিবি না শব্দকে হ্যা তে পাল্টে দিতে!"
আমি বললাম, "একটু ভাব তো, সুমির পরিবার আমাকে চেনে, সুমি বলে দিল আমার কথা! তারপর যদি তারা না করে দেয়?"
আকিব বললো, "এমন কিছুই হবে না, শুধু শুধু বাজে চিন্তা করিস না।" সে আবার বললো, "তোর যদি মনে হয় তুই তার অযোগ্য তাহলে এখন থেকেই নিজেকে যোগ্য বানানো শুরু কর। যেন ভবিষ্যতে কেউ বলতে না পারে তুই তার যোগ্য না!" "দেখ, সুমি বিদেশ যাবে, ভাল একটা ডিগ্রি থাকবে, সমাজের মানুষ তো কত কথায় না বলবে? এরকম চলতে চলতে একসময় অশান্তি শুরু হবে!"
"তুই এখন চুপ কর, তোর কথাবার্তা আর চিন্তা ভাবনা আমাকে অশান্তির মুখে ফেলে দিচ্ছে!" আকিব বললো।

দুইদিন পর, বিকালে সুমির কল আসলো, আপাতত শেষ দেখা করার জন্য এসেছে। ওর জন্য কেনা উপহার গুলো নিয়ে বের হলাম। অনেক কথাবার্তার পর সুমি বললো, "তোর জন্য কিছু জিনিস আনছি। এগুলা নে, রুমে গিয়ে দেখিস। আশা করি তোর ভাল লাগবে।"
আমি বললাম, "আর এই দুইটা আমার তরফ থেকে তোর জন্য। চাইলে এখানেই দেখতে পারিস।"
"তুই আবার এসব কেন করতে গেলি?"
সুমি প্যাকেটগুলো খুলে চাবি রিং আর ঘড়ি পেয়ে বেশ খুশি হল। চাবি রিংটা ব্যাগের চেইনে বেধে নিল আর ঘড়িটা হাতে। সে বললো, "বাহ তোর চয়েস তো মাশাআল্লাহ সুন্দর! অস্থির লাগছে দুইটাই!"

রাস্তা পার হয়ে বাসের জন্য দারিয়ে আছি। সুমি বললো, "তাহলে আসি আমি, দোয়া করিস আমার জন্য। আর সাবধানে থাকিস।" একটুপর আবারও বললো, "আর আরেকটা কথা, যদি অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলিস তাহলে খবর আছে তোর!"
আমি হেসে দিলাম ওর কথা শুনে। এরপর সুমিকে বাসে উঠিয়ে দিলাম। অনেকদিন পর সে একা জার্নি করছে। জানি না ওর সময়টা কিভাবে কাটবে। আমিরকে কল করে বললাম সব। সে বললো, "তুই ওই জার্নির কথা ভাবছিস? ফ্লাইট তো বাকিই আছে! আল্লাহ ভরসা, চিন্তা করিস না।"
রুমে এসে প্যাকেট গুলো খুললাম। দুইটা শার্ট, ঘড়ি, মানিব্যাগ কয়েকটা ছবি আর একটা চিঠি! সবার আগে চিঠিটা পড়া শুরু করলাম,
"জানি তুই আগে চিঠিই পড়া শুরু করবি! হয়তো আমার আন্দাজ সঠিক হয়েছে। আশাকরি ছোট্ট এই সামগ্রীগুলো তোর পছন্দ হবে।
সাবধানে থাকিস, দোয়া করিস জন্য।"
এই একটা চিঠিই আমার কাছে এতদিন পর্যন্ত যত্ন করে রেখেছি। নিধি হয়তো পড়ে দেখেছে। এখনও মনে আছে সুমির দেয়া শার্ট গুলো টাইট হচ্ছিল আমার গায়ে! আকিবকে কল করে বললাম, "এই অবস্থা! কি করি এখন?"
সে হাসতে হাসতে বললো, "ডায়েট করা শুরু কর!"
"ধুর শালা, ফোন রাখ!"

সুমির অনুপস্থিতি আমার মনের মাঝে এক প্রকার হাহাকার তৈরী করে ফেলেছে। যেখানে যাই শুধু সুমির কথাটা বেশি মনে হয়। পড়ালেখা বা অন্য কোনো কোনোরকম মন বসাতে পারছিলাম না। কিছুই কেমন যেন ভাল লাগতো না। ওর ব্যস্ততার জন্য নিয়মিত কথাও হতো না। আকিবকে কল করে বললাম আমারও মনে হয় যাওয়া উচিৎ ছিল। সে ধমক দিয়ে বললো, "তুই তোর প্রিপারেশন নিতে থাক, না হলে তুই যা ভাবতিস সেটাই হবে।" কোনো কারণ ছাড়াই আমি ডিপ্রেশনের মধ্যে পরে গেলাম!
এরমধ্যে আমিরের দেশে ফেরার সময় হল। দেশে এসে আবারও আমরা ক্যাম্পাসে একত্রিত হলাম। আকিব জিজ্ঞেস করলো, "চাকরি বাকরি খবর কি রে?" আমির বললো, "আপাতত নাই আর দেশে চাকরির যে অবস্থা! ভাল হতো তোর মত আর্মিতে জয়েন দিতে পারলে এতদিনে আমি আরও ফিট হতাম। কিন্তু ডিফেন্সের তো আর নিয়োগ নাই!" আমি বললাম, "এখন ডিফেন্সে আবার কিসের নিয়োগ?"
"এই তোরা দুইটা থাম! আমি এইখানে আছি তো? মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বেশিই জানিস তোরা?"
আমির আর আমি একত্রে বললাম, "ওহ সরি ক্যাপ্টেন!"
আকিব বললো, "ডিফেন্সে শুধু সৈনিক/অফিসারই নিয়োগ হয় না, ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার সহ আরও নানান পদের নিয়োগ হয় প্রতি বছর। পরবর্তী নিয়োগে এপ্লাই করিস। তোরে ফিট বানানোর দায়িত্ব আমার।", আকিবের পরামর্শ!
একথা শুনে আমির বললো, "না ভাই আমার এই জীবন নিয়ে আমি বেশ সুখি, আর্মির নাম শুনলেই আমার কলিজা শুকিয়ে যায়।"
আকিব বিরক্ত গলায় বললো, "ধুর শালা, তোর সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই।"

একদিন কাক ডাকা ভোরে মোবাইলে কল আসলো। কয়েকবার বাজতে থাকার পর হালকা চোখ খুলে দেখি সুমির কল! রিসিভ করতেই বললাম, "ওই তোর কি জ্ঞান বুদ্ধি নাই? এখন বাজে ভোর ৬.১০ মিনিট, এই সময় কল দেয় কেউ?"
সে বললো, "ওহ হো! আমি আসলেই দুঃখিত নই কারণ আমি তোর ঘুম ভাঙিয়ে বেশ সোয়াবের কাজই করছি!" আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কেমন সোয়াব?" উত্তরে বললো, "আমি নিশ্চিত তুমি ফজর না পড়েই ঘুম দিছো! এক্টিভ দেখাচ্ছে ৩ ঘন্টা আগে, বল আমার আন্দাজ ঠিক কিনা?"
আমার মনে পরলো আজ কয়েকদিন নামাজ ঠিকমত হচ্ছে না! কি হয়ে গেছে আমার নিজেই বুঝতে পারছি না। পরে বললাম, "ঠিক, আমি পড়তে পারি নাই। আসলে তোর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছিলাম!" সে বললো, "ওহ আচ্ছা তাই? ঠিক আছে তাহলে, আমি যখন সকালে ক্লাসে যাই তখন দেশের টাইম সম্ভবত ভোর রাত, কাল থেকে তোমার মোবাইলে কল আসতে থাকবে প্রতিনিয়ত। খবরদার ডাটা/ওয়াইফাই/মোবাইল কোনটাই বন্ধ রাখবি না!"
আমি হাসতে থাকলাম, বললাম, "ঠিক আছে, তাই হবে।"
আমার সময়গুলোতে কেমন যেন রুক্ষ রুক্ষ ভাব চলে এসেছিল। কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো, ভবিষ্যৎ কি আমার? ইত্যাদি ইত্যাদি! এরমধ্যে আমিরের চাকরি হয়ে গেল আর্মিতে! আমার দুই বন্ধু ভাল অবস্থানে, সুমি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গেছে আর আমি শুধু তাদের উন্নতি দেখে যাচ্ছি! নিজের কথার উপর আমল করতে পারছিলাম না! আব্বুর চাকরি আছে আর আড়াই বছর।

আমি তিনজন স্টুডেন্ট পড়াই, এরমধ্যে দুই মেয়ে একজন ছেলে। বোর্ড পরীক্ষার সপ্তাহ দুয়েক আগে আমি তাদের কিছু উপহার, উপদেশ এবং আমার তরফ থেকে ট্রিট দেয়ার জন্য এক রেস্টুরেন্টে দাওয়াত করলাম এবং সাথে আমার বাকি দুই বন্ধু আকিব এবং আমির আছে। আজ আমার তাদের এখানে ডাকার উদ্দেশ্য হল তাদের জীবনের বিভিন্ন কঠিন সময় পার করার কথা গুলো স্টুডেন্টদের বলে তাদের আত্মবিশ্বাসী বানানো। যেন জীবনের যেকোনো সিচুয়েশনে হার না মেনে শক্ত ও দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে বাঁচতে পারে। এই বয়সে তাদের মধ্যে আবেগ সবচেয়ে বেশি কাজ করে। আমিও চাচ্ছিলাম এই আবেগকে টার্গেট করে তাদের উৎসাহিত করি যেন তাদের ভবিষ্যৎ আরও ভাল হয়। অনেক কথাবার্তার পর বিদায়ী ভাষণে শেষ কথা বলে দিলাম, "কখনও চলার পথে কাউকে ছোট করে দেখবে না। সে হতে পারে তোমার চেয়ে যোগ্যতায় কম বা দুর্বল। কখনও কারও দুর্বলতাকে অস্ত্র বানিয়ে তাকে আঘাত করো না। একটা কথা ফিজিক্সের একটা সুত্রে বলা আছে, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে! আজ তুমি একজন ছোট করলে, পরেরদিন তুমিও অন্য কারও কাছে ছোট হতে পারো। হিংসা, অহংকার এসব থেকে সবসময় নিজেকে ১০০হাত দুরে রাখবে।"
স্টুডেন্টদের বিদায় দিয়ে আকিব ও আমিরকে বললাম, "আমি আর টিউশনি করাবো না! নিজেকে পরিবর্তন করবো, যোগ্য করে তুলবো অন্য আরেকজনের জন্য, যে আমার সব হবে!" আমির বললো, "সাফল্য রাতারাতি আসে না, ধৈর্য্য ধর, তোর এখনও আরও অনেক কিছু জানা আর শেখার বাকি আছে। হতাশ হওয়া যাবে না।"

সুমি দেশে ফেরার পর আমি দেখা করি তার সাথে। বললাম, "কিরে তোর মাঝে দেখি সম্পূর্ণ চেঞ্জ চলে আসছে! কেমন আছিস তুই?"
আমরা একে অপরের ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করলাম। বেশ কথাবার্তা চললো আমাদের মাঝে। সে জানালো দেশের বেশ কয়েকটা ফার্মাসিউটিক্যালে জবের এপ্লাই করেছে। দুইটায় অবস্থান বেশ ভাল। চাকরি হয়ে যাওয়ারও সম্ভবনা আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার প্রোগ্রেস কতদুর এবং এর জবাবে আমি চুপ! সুমি আর কোনো কথা বললো না। শুধু বলে দিল, "তুই এখন মান সম্মান নিয়ে তামাশা করবি? তুইও আজও সেই পলিসি নিয়ে আছিস যে তোর এসব কথা গায়ে লাগে না?" আমি বললাম, "কি করবো এখন? মাথায় কিছুই আসছে না আমার! তোর কি মনে হয় আমার চিন্তা নাই? আব্বুর চাকরিও আর সাত মাস আছে!" সুমি নিচু শব্দে কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর বললো, "তোর প্রেস্টিজে লাগবে, খুব বেশি করে লাগবে! সময়ই তোকে বুঝিয়ে দিবে তুই সঠিক পথে ছিলি না।"

আষাঢ়ের মেঘ আকাশে জমা হয়েছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরবে। পার্কের ত্রিভুজ বেঞ্চে আমি বসে আছি। ভাবছি কি হয়ে গেল আজ! সুমির বলা কথা গুলো এত তাড়াতাড়ি খেটে গেল আমার কপালে! তার আত্মীয় স্বজন এভাবে না বললেও পারতো। চাকরি নাই, বেকার, বে রোজগার আরও নানা কথা! আমার মুড দেখে আব্বুও বললো, "আমি বুঝতে পেরেছি তারা কি বলতে পারে তোমাকে। তাদের দোষ দিও না। তারা সঠিক, সেই মেয়েটাও সঠিক। এই সমাজে কেউ চাইবে না ইনকামহীন কারও সাথে মেয়ে দিতে! এটা তো সবে মাত্র শুরু! আরও কত জীবনের পরীক্ষা দিতে হবে তার হিসাব নেই। এই পরীক্ষাগুলোয় প্রশ্ন, খাতা, কলম কিছুই থাকে না! তোমার কিছু উত্তরও করার সুযোগ হবে না। তুমি শুধু ফলাফল দেখতে পারবে।"

আমার সামনে বসা আকিব এবং ডানে বসা আমিরকে বললাম সমস্ত ঘটনা! কোন সময় যেন আমিও কেঁদে দিলাম! ধীরে ধীরে আকাশে আরও মেঘ জমা হতে লাগলো। একটু পর বৃষ্টিও শুরু হল। পার্কে আর কোনো মানুষ নেই শুধু আমরা তিনজন। আমি বললাম, "তোরা যা, বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হলে অফিস করতে পারবি না!" আমির বললো, "তোকে রেখে আমরা যাচ্ছি না।
"ওর রিলেটিভরা তোকে এসব বলছে না? তোকে যোগ্য বানাবো।" আকিব আমার হাতে শক্ত করে ওর হাত রেখে বললো, "তুই শুধু একবার আমাকে সুযোগ দে, আমার কথা মত চল! তোকে আমি, আমরা মিলে যেকোনো কিছুর যোগ্য বানাবো। কোনো অযোগ্যতার সুযোগ দিব না। আমরা একসাথে ছিলাম, এখনও আছি বাকি জীবনটাও একসাথেই কাটাবো!"
আমি বললাম, "আকিব, তুই এখনও ডিফেন্সের কথা বলছিস?"
সে বললো, "তুই আমাকে নিরাশ করাস না প্লিজ। তোর জীবনের এক বছর আমি চাই।" আমির বললো, "আমিও ওই একবছর চাই!" আমি আবারও কেঁদে ফেললাম! বললাম, "তোরা আছিস বলেই..." আর কিছু বললাম না। কাঁদতে থাকলাম।

তারিখটা এখনও মনে আছে আমার শুক্রবার, ১৭ই ডিসেম্বর! কনকনে শীতের সকাল, আকিব আর আমির ভোর ৬টায় ডেকে উঠালো আমাকে। মাঠে যাওয়ার পর বললো, "তোর একটা ছবি তুলে রাখি, ইনশাআল্লাহ আগামী বছরের এই দিনে তোর আরেকটা ছবি তুলবো যাতে তফাৎটা ঠিক মত বুঝতে পারিস।" প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে এই দুইটা আমাকে নিয়ে রীতিমত খেলা শুরু করে! আমির বললো, "মেডিকেল ফিটনেসের জন্য তোকে ফিট হতেই হবে, বাকিটা পরে।" এভাবে প্রতিদিন দৌড়ানো, বিভিন্ন রকম শারীরিক ব্যায়াম এবং সঠিক সময়ে খাওয়া আর ঘুম সবকিছু মিলে আকিব আর আমির আমার প্রতিদিনের রুটিন করে দিয়েছে। পড়ালেখা করতে বসলেই শুধু সুমির কথা মনে পরে! এভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। এরপর শুরু করলাম টিউশনি। আমার প্রথম স্টুডেন্ট হল নিধি। আব্বুর চাকরি শেষ কিন্তু আমার চাকরি এখনও হল না। পড়ানো এবং আব্বুর টুকটাক ব্যবসার মাধ্যমে চলছিল আমার দিনকাল। আমি ওই সময়টা থেকে এখন পর্যন্ত সুমির সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করি নি। আকিব এবং আমির আমাকে যেভাবে সাহায্য করে আসছে সেটা আমি ভাষায় উপস্থাপন করতে পারবো না।আমার সুখের সময় এরা ছিল এবং এই খারাপ সময়েও আমার সাথে আছে।
একদিন সকালে আমিরকে বললাম, "আমার প্রোগ্রেসে কি মনে হয় স্যার? আমি কি মোটামুটি যোগ্যতা অর্জন করতে পারছি?" আমির বললো, "মোটামুটি যোগ্যতা অর্জনের জন্য আমরা এত কষ্ট করে যাচ্ছি না। যেন কোনো ক্ষুত না ধরতে পারে। সে সাথে শরীরের ফ্যাট কমে গেলে নিজেকে দেখিস কেমন লাগে।"
আর মাত্র তিনমাস আছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম আমার সর্বোচ্চটা। আকিব বললো, "এবার ফর্ম ছাড়তে আরও দুই মাস লেট হতে পারে! চিন্তা করিস না, বাড়তি সময়টা আরও ভাল করে কাজে লাগাবো আমরা।" আমি বললাম, "আকিব সত্যি একটা কথা বলবি?"
- হুম বল।
- সুমির সাথে কি তোর কথা হয়?
- ওর বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোনো কল করি নি! এমনকি সেও না। আর আমি যোগাযোগ করবও না!
- চিন্তা হচ্ছিল খুব।
- ওর চিন্তা করার জন্য দুইটা বংশ আছে এবং সেখানে তুই একটা মশাও না! বুঝতে পারছিস আশাকরি?


অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন আজ। বহু বছর আগে একবার রিজেক্ট হয়েছিলাম। কিন্তু এবার হয় নি! আকিব এবং আমির দুইজনকেই স্যালুট করলাম এবং বললাম, "আজ আমরা সবাই খুশি! আব্বু-আম্মু, ভাই-বোন সব, সবাই। কি বলে যে তোদের দুইজনকে কৃতজ্ঞতা জানাবো তার কোনো ভাষা নাই আমার।" আকিব বললো, "এই ছবিটা দেখ। দেড় বছর আগের তুই আর এখনের তুই! দেখ কত পার্থক্য!"
আমিও দেখে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না! আব্বু তো আকিব আর আমিরকে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে! আমির বললো, "আরাফ, সামনের মাসেই তোর ট্রেনিং শুরু, ছয় মাসের। এরপর ইনশাআল্লাহ তুই তোর পদবীতে!"
আকিব বললো, "বলছিলাম না? আমরা ছিলাম, আমরা আছি এবং আমরা থাকবো। মিলিয়ে নিছিস না আমার কথা?"
আমি এখন কি নিয়ে আফসোস করবো সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না! আমি মহান আল্লাহ তায়ালা কাছে শুকরিয়া করে শেষ করতে পারবো না কারণ তিনি আমার চলার পথে আমার পরিবার এবং আকিব ও আমির নামের দুইজন দূত নসিবে রেখেছেন।

দেখতে দেখতে আমার ট্রেনিং শেষ! এবং আমি এখন লেফটেনেন্ট! কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। সকাল বেলা মেজর স্যারের রুমে ডাক পরলো আমার। আমি যেতেই উনি আমাকে ডিউটি চিঠি ধরিয়ে দিলেন। দেখলাম যশোর ক্যান্টনমেন্ট তিন মাসের ডিউটি! দেখে বেশ খুশি হলাম কারণ বাসায় যাতায়াতে কোনো সমস্যা হবে না। এরমধ্যে ক্যাম্পে শুরু হল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। আমিও একটা দলের অন্তর্ভুক্ত এবং উইকেট কিপার ছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিন ম্যাচের ১ম ম্যাচে ৮০ রান করে ভাল একটা ইমেজ তৈরী করেছিলাম কিন্তু পরের দুই ম্যাচে কোনো রানই করতে পারি নি! কোন এক সৈনিক আমার আউট হয়ে যাওয়ার ভিডিও করে আকিব আর আমিরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে আর এটা নিয়েই ওরা দুইজন যখন মনে হয় তখনই মজা নেয় আমার সাথে! তিন মাস পর যখন আবার শিফট হওয়ার চিঠি আসে তখনই এমন একজনের সাথে আমার দেখা হয়ে যায় যেটা আমি চিন্তাও করি নি! ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাস ছাড়ার পর হোটেল ব্রেকে কফিতে চুমুক দিতেই কে যেন আরাফ বলে ডাকলো! পিছনে ঘুরতেই দেখি এটা পিয়াল! এত বছর পর ওকে দেখে আমি মোটামুটি আশ্চর্য হয়েই গেলাম। বললাম, "পিয়াল, তুই এখানে? কোথায় আছিস এখন?"
ইত্যাদি নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। সে জানালো এখন সে ব্যবসা করছে এবং অনেক উত্থানপতনের পর ভাল অবস্থানেই আছে! সবশেষে বললো, "শুনলাম, সুমি তোর ক্লাসমেট ছিল ভার্সিটিতে। আমার হয়ে ওকে একটা কথা বলতে পারবি? আমি ওকে একটা সরি বলার জন্য এতগুলো বছর ধৈর্য্য ধরে আছি। কিন্তু সে আমার কোনো কথাই শুনতে চায় না! ভুল তো মানুষের দ্বারাই হয় আর মানুষেরই উচিৎ মানুষকে ক্ষমা করা"
সেদিনের ২০ মিনিটের হোটেল ব্রেকে পিয়াল যেভাবে কথাগুলো বললো এতে ওর ওপর আমার একটা নেগেটিভ ধারণা ছিল যা ওরপর থেকেই আর নেই। আমি ওর নাম্বার রেখে দিলাম এবং সুমির নাম্বার দিয়ে এলাম। আমির বা আকিব কাউকে জানালাম না। এটা আমার ভিতরেই থাক।

বিকাল বেলা, ফায়ারিং স্পটে দারিয়ে আছি, আকিব এসে একটা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, "দেখতো কিছু দেখতে পাচ্ছিস কিনা?" আমি বললাম, "এত নাম কিসের? আর এটা কিসের লিস্ট?"
সে বললো, "সাত দিনের মেডিকেল ক্যাম্প সামনের সপ্তাহে এবং আমরা যারা যাচ্ছি এই ক্যাম্পে তাদের নাম। আর এটা হল আরেকটা লিস্ট যেখানে আমি যাচ্ছি ইউ এন মিশনে। যদিও মেডিকেল ক্যাম্পে জন্য বোর্ড থেকে আমাকে নেয়ার কথা ছিল না তবুও অনেক চেষ্টা করে আমরা তিনজন একসাথ হচ্ছি আরও একবার! গোছগাছ শুরু কর। টানটান উত্তেজনা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য! আমরা তিনজন আবারও!"

ক্যাম্পেইন এর ২দিন আগেই রওনা দিলাম আমরা। আমার আওতায় ২০জনের একটা টিম দেয়া হয়েছে। আকিব হল আমাদের সবার লিডার। আমি আমার টিমের মধ্যে কাজ বন্টন করে দিলাম। নির্দিষ্ট দিনের আগেই আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। এরমধ্যে সেই গ্রামে প্রচার করা হল ফ্রি মেডিকেল চেকআপ এর কর্মসূচি। এখন শুধু মেডিকেল টিমের পৌঁছানোর পালা।

ঠিক সকাল ৮টায় ১৫জনের মেডিকেল টিম বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালেন। আমি আর আমির গেলাম তাদের রিসিভ করতে। পোশাকআশাকে চিন্তে বেশি কষ্ট হল না তাদের চিনতে। আমি এগিয়ে যেতেই দেখি শেষ লাইনে সুমি! ধীরে ধীরে পায়ের গতি কমতে থাকলো আমার। আমিরের দিকে তাকালাম, সেও আমার দিকে তাকালো। সুমিও তাকালো আমার দিকে। হয়তো সে ভাবে নি আমার উপস্থিতি সে এখানেও পাবে! এবং আমারও একই অবস্থা! কেমন যেন মনে হচ্ছিল এটা একটা দুঃস্বপ্ন! খুব কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলাম। তাদের সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম শুধু সুমি ছাড়া!
ক্যাম্পে এসেই আকিবকে বললাম, "মেডিকেল টিমের লিস্ট তোর কাছে থাকতেও আমাকে দেখালি না কেন?" এমন সময় সার্জেন্ট শরীফ এসে আমাকে বলল, "স্যার তাদের স্বাগতমের জন্য আপনাদের সকলের উপস্থিতি কাম্য।"
আকিব বললো, "লেফটেন্যান্ট আরাফ, খেয়াল রাখবে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে! এবং সার্জেন্ট শরীফ, বাকিদের নিয়ে স্পটে যাও আমি আসছি।"
সালাম দিয়ে সে চলে গেল। আকিব বললো, "ওই তোরে কতবার কইছি আশেপাশে মানুষ দেখে কথা বলবি! এত চেতস কেন? এত বছর পর দেখা হইছে গিয়ে কথা বল!"
আমি দাঁত কটমট করে বললাম, "তুই শুধু সিনিয়র আর ডিউটিতে আছিস বলে বেচে গেলি!" এরপর সালাম দিয়ে বের হয়ে গেলাম।
.
দেখতে দেখতে ক্যাম্পেইন এর দিনগুলো চলে যাচ্ছে। ৬ষ্ঠ দিনে সুমি এসে বললো, "বেশ! অনেক চেঞ্জ লাগছে তোমাকে! খুব সুন্দর মানিয়েছে!"
আমি বললাম, "সবই তোমাদের দোয়া!"
সাড়ে তিন বছরের একটা গ্যাপ আমাদের তুই সম্পর্কটাকে তুমি তে পরিণত করে দিয়েছে! একটু থেমে বললাম, "তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দিব তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না! তুমি আর তোমার রিলেটিভরা। সকলকে আমার সালাম জানিয়ে দিও।"
কেন যেন সুমির হাতের দিকে তাকালাম। দেখলাম আমার দেয়া সেই ঘড়ি আজও তার হাতে! বিভিন্ন যায়গা থেকে রং উঠে গেছে! আন্দাজ করলাম চাবির রিংটাও হয়তো যত্ন করে রেখেছে। আমার তাকিয়ে তাকিয়ে থাক দেখে সে বললো, "ঘড়িটা এখনও আমি লাইফ সাপোর্ট দিয়ে চালাচ্ছি। যতদিন যায় এভাবেই চলবে!"
আমি প্রশ্ন করলাম, "ওহ, শিওর হলাম এটা সেটাই কিনা।" সে বললো, "আমি শিওর মানিব্যাগটা সেদিনেরই এবং ছবি ও চিঠিটাও!"
আমি অবাক হয়ে গেলাম! নিজের ইমোশনকে ঠিক রেখে বললাম, "অযত্নের ফলেই যত্ন করা শিখেছি।"
একটু পর বললাম, "ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, আপনারা সব গোছগাছ করে নিন। কাল সকালেই আপনাদের ট্রেন!"
আর সুমির পাশে থাকা সম্ভব হচ্ছে না তাই চলে এলাম।

স্টেশনে আমরা তিনজন দারিয়ে আছি। সৈনিক রা তাদের মালামাল এবং হিসাব নিকাশ বুঝিয়ে দিল। ট্রেনে উঠার আগে সুমি এসে বললো আকিব আমিরকে বললো, "তোদের ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করা যাবে না। দোয়া করি যেন এভাবেই থাকিস তোরা। ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য। দোয়া রাখিস।"
আকিব কিছু বললো না। আমি আকিবের দিকে তাকালাম আরেকবার আমিরের দিকে তাকালাম। ট্রেন চলতে শুরু করলো, যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ দেখতে থাকলাম একে অপরকে। চোখ সরিয়ে নিলেও আবার সেখানেই দৃষ্টি চলে যায়। আকিবকে বললাম, "কিসের ধন্যবাদ দিল সুমি তোকে?"
সে বললো, "এই মনে কর এত সুন্দর ক্যাম্পেইনের জন্য!"
আমি বললাম, "না! এটা, অন্য কিছুই!"
সে বললো, "চাবি রিং আর ঘড়িটা দেখছিস না? সেটাই মনে কর। আশাকরি তুই বুঝতে পারবি!"

"Soldiers!!! Back to work!" এই বলে আকিব আগাতে থাকলো। আর আমি ভাবতে থাকলাম সুমিকে নিয়ে আর তার দেয়া ধন্যবাদ নিয়ে! আমির আমার দুইকাধে হাত রেখে হালকা ঝাকিয়ে দিয়ে গাড়ির দিকে হাটা দিল! গাড়িতে উঠার পর আমির বললো, "তাহলে কিছুই চেঞ্জ হয় নি আরাফ! সবই ধৈর্য্যের পরীক্ষা! ঠিক কমান্ডর আকিব?"
"এতটা কষ্ট করলাম আর সে ধৈর্য্য ধরবে না, সেটা কি হয়?" এই বলে আকিব মুচকি হেসে দিল! আমি চিন্তা করতে থাকলাম এটা কি তাদের প্ল্যান ছিল নাকি সুমি শুরু থেকেই সবই জানে?


[সমাপ্ত এবং ভূল ত্রুটি ক্ষমার করবেন]

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:৩৩

মা.হাসান বলেছেন: বেশ গোছানো লেখা। প্রঠম দুই পর্বের মতোই উপভোগ্য। পাঠককে আটকে ধরে রাখতে পারার ক্ষমতা আপনার আছে।

আপনি কোন হলে থাকতেন? আমি তপন সারের প্রথম ব্যাচ, তবে অন্য ডিপার্টমেন্টের।

সুমি ভালো থাক, আপনি ভালো থাকেন, পিয়াল ভালো থাক, আকিব-আমির ভালো থাক।

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:১৫

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সম্পূর্ণ গল্প পড়ার জন্য।

আমি আসলে জাহাঙ্গীরনগরের স্টুডেন্ট নই, একবার ছোট ভাইয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় গিয়েছিলাম। ওর সিট পরেছিল রসায়ন বিভাগে। পরীক্ষার ওইটুকু সময় ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম এবং এখন প্রায়ই যাওয়া হয়। তবে আমার স্যার হলেন জাহাঙ্গীরনগর সিএসই বিভাগের ড. হানিফ।

২| ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:০৪

রাজীব নুর বলেছেন: গল্প ভালো হয়েছে।
জীবনের গল্প গুলো এরকমই। আকিব সুমি ভালো থাকুক।

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:১৪

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই গল্পটা পড়ার জন্য। এটার এন্ডিংটা যেদিকে ইচ্ছা নিতে পারেন.... :)

৩| ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:৩২

নেওয়াজ আলি বলেছেন:   পাঠে মুগ্ধ  হলাম। 

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ২:১৪

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে...

৪| ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:০৩

মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন: যখন "হৃদয় ও প্রাণ" গল্পটি পড়েছি,মনে হয়নি গল্প পড়েছি।মনে হয়েছে আপনার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই লেখার মাধ্যমে দেখতে পাচছি।

পাঠক যখন কোন গল্প বা উপন্যাস পড়েন ,তখন যদি তিনি অনুভব করেন যে হ্যাঁ গল্পটি আমার / আমাদের এই জীবনের
অংশ এবং তিনি এই গল্পের সাথে নিজেকে অনুভব করেন তখন লেখক সফল।

আপনাকে ধন্যবাদ ,একটি খুব হৃদয় ছোঁয়া, প্রেরণাদায়ী এবং বন্ধুত্বের শক্তি তুলে ধরা গল্প উপহার দেবার জন্য ।

"হৃদয় ও প্রাণ" গল্পের লেখক হিসাবে, আপনি ১০০ % সফল। +++

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:২১

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: এবং সেই সাথে যখন আপনারা পড়ে আপনাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন বিস্তারিত ভাবে তখন আর কিছু লাগে না আমার..

ধন্যবাদ ভাই, অনেক ধন্যবাদ :)

৫| ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:৩৩

সোহানী বলেছেন: চমৎকার লেখনি। এমন বন্ধু থাকলে এ জীবনে আর কি লাগে!!!

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:৪৭

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.