নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবতে ভালবাসি, সেই ভাবনা যদি কোনো ঘটনায় মিলে যায় তবে তাকে লিখতে ভালবাসি! সেই লেখায় যদি কেউ বিন্দুমাত্র উপকৃত হয় তবে তাতেই আমার খুশি, আমি লেখাকে ভালবাসি।

দর্পণের প্রতিবিম্ব

প্রেমিকার চিরশত্রু

দর্পণের প্রতিবিম্ব › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: শেষ লোভ

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১:০৯




সুমি আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। ইদানিং তাকে খুব চিন্তিত দেখছি আমি। অনেকবার জানার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আমাকে কিছুই জানাচ্ছে না! আমিও জোর করি নি। কিন্তু আজ তাকে বেশিই উদ্বিগ্ন লাগছে। আমিও চুপ করে বসে আছি, অপেক্ষা করছি সুমি নিজ থেকে কিছু বলে কিনা। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, বিশ মিনিট অতিবাহিত হল কিন্তু কিছুই বলছে না! থাক, দেখি কতক্ষণ চুপ করে থাকে!
অনেক সময় পার হল কিন্তু কিছু বলছে না সুমি। আমিই হার মানলাম, অতি বিরক্ত হয় বললাম,
- কিছু বলবি নাকি মূর্তি হয়ে থাকবি?
কথাটা শুনে সুমি তাকালো আমার দিকে, এই প্রথম সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো! সেই চাহানির দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি তার চোখে কি লেখা আছে! কি এমন লেখা আছে যা আমি পড়তে পারছি না! অবাক হয়ে গেলাম ওর চাহনীতে!
- সুমি...! বিস্ময় সুরে বললাম আমি।
তবুও ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।
- কোনো সমস্যা? বল আমাকে...
আর দেরি হল না, সাথে সাথে সেই চাহনী বিশাদের রুপে পরিণত হয়ে গেল! সুন্দর সেই চোখে মুহূর্তেই অশ্রু জমে গাল বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো! কেন হঠাৎ এই কান্না তার এর অর্থ আমি বুঝতে পারছি না।
- কি হয়েছে বল, এমনভাবে কাদিস না, মানুষজন কি বলবে?
ইচ্ছা হচ্ছে চোখের পানি মুছে দেয়ার ছলে ওর গালে আলত করে ছুয়ে নিই! হাতটা কোনমতে উঠলেও আঙুল কোনভাবেই গালের কাছে নিতে পারছি না। কি যেন এক ভয় কাজ করে মনের মাঝে! ওর কান্নায় আমার বুকের ধুকপুকানি বেরে যাচ্ছে। কোনমতে চোখ মুছে বললো,
- আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, ছেলে কোটিপতি, অনেক সম্পত্তি আছে..
ওর কথা শুনে আমিই চুপ হয়ে গেলাম। কষ্টের এক বিশাল সাগরের টন টন ওজনের জলরাশির ঢেউ আছড়ে পরছে আমার বুকে! আমি চুপচাপ বসে বসে আছি, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
- ভাল সম্বন্ধ এসছে তোর, বিয়ে করে ফেল।
অনেকটা চাপা কণ্ঠে বললাম।
- আমি রাজি না, অর্থ দেখলেই আমার ভয় হয়। তারা তাদের লেভেলের কোন ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক না করে এদিকে কেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে?
মেয়েদের ক্ষেত্রে এটাকে ভাগ্য বলে এবং এটা তাদের প্রাপ্য। আমি জানি এই বিয়েটা হয়েই যাবে। এর আগে যেসব প্রস্তাব এসেছিল সেগুলা সুমি নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু এটা সে পারবে না। পরিবার এবং ওর আত্মীয় স্বজন সবাই রাজি এই প্রস্তাবে!
- কিন্তু আমি যে অন্য একজনকে ভালবাসি!!
- কে সে?
খুব শান্ত স্বরে বললাম।
- তাহসিন নাম ওর। সে খুব ভাল ছেলে। আব্বু আম্মুকে জানিয়েছি কিন্তু রাজি হয় নি! কারণ ওর বের হতে এক বছর লাগবে। আর চাকরি তো পরের কথা..
আমি যা ভেবেছিলাম তার কান ঘেঁষেও ফলাফল পেলাম না। ভাবছিলাম আমার কথা হয়তো বলবে কিন্তু বললো তাহসিন নামের একটা ছেলের! এই হয় আমার মত ছেলের কপালে। মনের ভিতরে হাহাকারের ঝড় চলছে।
- একটা হেল্প করবি?
আমি জানি সুমি কি বলবে। বললাম,
- তোকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে হবে এই তো?
সুমি অবাক হয়ে বললো, তুই জানলি কিভাবে?
আমার মন বলছে, "আরে পাগলী আমি ছাড়া তোর কথা কে বুঝে রে, তোর সবকিছু আমি বুঝি কিন্তু আমার মন তুই বুঝিস না।"
- আমি ছাড়া আর কে বুঝবে বল?
সুমি ওর সকল প্ল্যান আমাকে জানালো। ওর বয়ফ্রেন্ডের নাম্বারও আমাকে দিল। আমার সাথে তাহসিনকে ফোনে পরিচয় করিয়ে দিল সুমি।
সকল আয়োজন আমাকে জানিয়ে দিল। কোথায় সে থাকবে, কখন আমি সুমি নিয়ে বের হব, কোথায় থাকবে তারা ইত্যাদি ইত্যাদি!!
- আমার আরেকটা উপকার করবি?
- বল।
- কাল সারাদিন আমার সাথে থাকবি। ছেলেটা আসবে দেখা করার জন্য। আর বিয়ের শপিং করবে..
আমি নীরব সম্মতি জানিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে। সুমির বিয়ের কথা শুনে আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। আমি ভেবেছি সুমি হয়তো একদিন আমাকে বুঝবে যে আড়ালে আরেকটা ছেলেও তাকে ভালবেসেছিল। ছায়ার মত পাশে থেকেছে ছেলেটা। সেসব এখন শুন্য মিলিয়ে গেল। সুমির পরিবার আমাকে খুব করে চেনে। আমার গ্রাম, আমার পরিবার সবকিছু তাদের জানা। সুমির সাথে ওর বাসায় আমি অনেকবার গিয়েছি। আমি ভাবছি ওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা ঠিক হবে কি হবে না। তাহসিন ওকে ভালবাসে কিন্তু সে কি আমার চেয়ে বেশি ভালবাসে সুমিকে? আমি বাজি ধরে বলতে পারি তাহসিন পারবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তার ভালবাসার পরীক্ষা নেব। দেখি কতটা ভালবাসে সে।


বসুন্ধরা শপিং মলে ঢুকেছি। আমি, সুমি আর সুমির হবু হাসবেন্ড। ছেলেটা দেখতে খুবই হ্যান্ডসাম এবং অনেক ধনী! একটা সুন্দর ঝকঝকে কাল রঙের প্রাডো গাড়িতে আমরা এখানে এলাম। সুমি ছিল বিধায় আমি এই বিলাসবহুল গাড়িতে উঠতে পেরেছি। আমার ঘর্মক্লান্ত শরীর গাড়িতে উঠে বসার পাচ মিনিটের মধ্যেই শুকিয়ে গেল। গাড়ি যখন যানজটে দারালো তখন আমি বাইরের মানুষদের দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। দুপুর রোদে পুরে কিভাবে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা বাসের জন্য দারিয়ে থাকে। আমিও তাদের কাতারের লোক কিন্তু ক্ষণকালীন এক টিকেট পেয়ে এই গাড়িতে উঠতে পেরেছি! সুমি উনার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সালাম দিব এমন সময় তিনি হাই বললেন! আমি সালাম আমার গলা দিয়ে বের হল না। উনার নাম বাকের। নিজেদের একটা গার্মেন্টস আছে। কথা বার্তায় আলাদা অহংকারের প্রভাব আছে। উনি এমন এমন সব ব্র‍্যান্ডের পোশাকআশাক কিনছেন যা আমার স্বপ্নের বাইরে ছিল। সুমির দিকে তাকিয়ে দেখি এদিক সেদিক তাকাচ্ছে! আমিও ওর চোখের গতিবিধির উপর নজর রাখলাম। খুঁজতে চেষ্টা করলাম সে কি খুঁজছে। হঠাৎ দেখি তাহসিনকে!! আমি ওর ছবি দেখছি কিন্তু আজ নিজ চোখে দেখলাম। সারাটা সময় দেখলাম তাহসিন একটু দুরত্ব বজায় রেখে ক্রেতার সাজে আমাদের চারদিকে হেটে বেড়াচ্ছে। বাকের যখন ফোনে কথা বলছিল তখন সুমিকে বললাম, "এত বারবার তাহসিনের দিকে তাকালে বাকের সন্দেহ করবে, যদিও তাহসিনকে উনি চিনে না কিন্তু তোর হাবভাবে যেকোনো সময় চিনে যাবে!"
- তুই কিভাবে দেখলি?? এবারও সেই প্রশ্ন!
- আমি তোর চোখে তাকিয়েই বলে দিতে পারি।।
আর বেশি কিছু বললাম না। আমি কেমন হয়ে গেলাম এই দুই দিনে! আমি বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র প্রেমিক যে নিজের প্রেমিকার বিয়ে উপলক্ষে তারই হবু স্বামীর সাথে প্রেমিকার বিয়ের আয়োজন করতে ব্যস্ত! বুকের মাঝে হাহাকার আর কষ্ট তো হচ্ছে যা কাউকে বুঝানো সম্ভব নয়। আর বুঝাতে গেলেই করুণার পাত্র হয়ে যাব।।


রাস্তায় দারিয়ে আছি, সাথে সুমি। তাহসিনের জন্য অপেক্ষা করছি। সুমির মনটা খারাপ, খারাপ লাগছে বাসা থেকে পালিয়ে আসাটা! বাসায় এতক্ষণে হৈ চৈ শুরু হয়েছে সুমির অনুপস্থিতির কারণে! সুমি বারবার তাহসিনকে কল করছে কিন্তু অপরপ্রান্তে রিসিভ হচ্ছে না। একসময় কল ঢুকলো না! ফোন বন্ধ তাহসিনের! সুমির কান্না পাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেঁদে কেঁদে বললো,
- তাহসিন এমনটা করতে পারলো?
আমি কিছু বলছি না। চুপচাপ আছি। ইচ্ছা করছে ওকে বলি আমার চেয়ে কেউ তোকে বেশি ভালবাসতে পারবে না সুমি। তার প্রমাণ আবারও পেয়ে গেলাম। আমি বললাম,
- চল তোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।।
আমার কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকালো।
- সেখানে যাবো না, যাওয়ার মুখ নেই আমার।
যাত্রী ছাউনির নিচে শুধু আমরা দুইজন। এই গভীর রাতে এলাকাও আমার সুবিধার ঠেকছে না। সুমি বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। যেকোনো সময় র‍্যাব বা পুলিশের টহল ভ্যান এসে আমাদের দেখলে বিপদ হতে পারে। সুমির পাশে বসে বললাম,
- আচ্ছা সুমি, আঙ্কেল আন্টি তোকে ছোট থেকে আদর যত্নে মানুষ করছেন। অনেক কষ্ট করছেন তোকে নিয়ে। তোকে এতদুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তাদের চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করার জন্য। আজ যদি তুই পালিয়ে যাইতি তবে আঙ্কেল আন্টির কেমন হতো? তুই বলছিলি না তোর আব্বু তোর অসুস্থতার সময় সারাক্ষণ তোর পাশে ছিল। একটুও ঘুমাননি তারা! ক্লাস শেষে যখন তোর সাথে আড্ডা দিতে চাইতাম তখন তুই থাকতিস না কারণ তোর আব্বু আম্মু খাওয়ার টেবিলে বসে অপেক্ষা করে তোর জন্য? তুই যদি পালিয়ে যাস তবে তাদের মুখে খাওয়া ঢুকবে কিভাবে? হয়তো দেখা গেল নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল! তাদের ছেড়ে খেতে পারবি তুই? তুই পালিয়ে গেলে আংকেল আন্টি মুখ দেখাবে কিভাবে সমাজে? সমাজের মানুষের কাজই তো একটা, শুধু বদনাম করা। এসব ভাবছিলি কখনও? চল... বাসায় চল। স্বাভাবিক ভাবেই বলিস আঙ্কেল আন্টিকে যে তোর ভুল হইছে।


সুমিকে নিয়ে বাইরে দারিয়ে আছি। ওর ভিতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। তিন তলায় তাকিয়ে দেখি বাসার সব রুমের লাইট জ্বালানো! তারমানে বাসার সবাই জেনে গেছে। আমি একবার ঢোক গিল্লাম সুমির বাবার রাগী মুখটা কল্পনা করে। সুমি একটু একটু করে এগিয়ে কলিং বেল চাপলো। ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পরই আংকেল ধরফর করে গেটে এলেন! আমার হাতে ব্যাগ লাগেজ দেখে তেরে এসে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন! সুমি চমকে গেল ওর বাবার কাণ্ড দেখে!
- তোর সাহস তো কম না তুই আমাদের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলি?
আমি জানতাম এমনটাই হবে। উনাকে বুঝানোর মত ক্ষমতা আমার নেই। এমন সময় সুমির তিন ভাই এল! তারা টেনে হিচড়ে যেভাবে পারে আমাকে নিয়ে বাহিরে গেল। সুমি ঠায় দারিয়ে আছে, অবাক হয়ে দেখছে তার পরিবারের কর্মকাণ্ড। সুমি হয়তো মনে মনে বলছে, "দেখলি, বাসায় ফিরে আসার ফল? চলে যা এখান থেকে।।"


মেসের গেটে দারিয়ে আছি। এতটা রাস্তা হেটেই এলাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম ডিসপ্লে ভেঙে গেছে। রং বেরঙ এর আলো চারপাশে। গেটে এসে দেখি হাকিম চাচা নামাজ পরে উঠলেন। আমাকে দেখে বললেন,
- কি ব্যাপার? এত রাতে? আমি ভাবছি তুমি ভিতরে!! মুখে এত দাগ কিসের?
আমি গালে একটু আঙুল দিতেই খুব ব্যথা অনুভব করলাম। চাচার কাছে থেকে আয়না নিয়ে দেখলাম মুখের কিছু কিছু অংশ কেটে ছিড়ে গেছে! সবই সুমির ভাইদের কল্যাণে হয়েছে।।
- বস, চা খেয়ে রুমে চলে যাও। ওই সুরুজ.... দুইডা চা নিয়ায়।। হাকিম চাচা জোর গলায় রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বললেন।
তিনি আমার কাছে ফিরে এসে আমার এ অবস্থার কারণ জানতে চাইলেন। উত্তরে বললাম ছিনতাইকারী ধরছিল। মোবাইল, টাকা পয়সা সব নিয়ে গেছে। ছয়জন ছিল যার কারণে মারামারি করে টিকতে পারি নাই।
- আহহারে কি করছে দেখছো না, নেও চা খাও, খাইয়া রুমে গিয়া আরাম কর।

ড্রয়ার থেকে পুরানা মোবাইলটা বের করে সিম ঢুকালাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চিন্তা করতে থাকলাম সুমির কথা। একটুও কি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারে না সে? চোখটা বন্ধ করতেই ওর অসহায় মুখটা সামনে ভেসে উঠে! হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। না দেখেই রিসিভ করলাম,
- বল।। আমি জানি এটা সুমিই কল করেছে
ওপাশে কান্নার আওয়াজ! ওর কান্না শুনলেই আমার ভিতরটাও দুমড়ে মুচড়ে যায়।
-তুই ঠিকমত পৌছাইছিস?
- হুম, ঘুমানোর চেষ্টা করতেছি
- বলছিলাম না বাসায় যাওয়ার দরকার নাই, কথা শুনলি না।
- খেয়াল করছিস তোর বাড়ির সবাই তোকে কতটা ভালবাসে??
অপরপ্রান্ত চুপ হয়ে আছে। আমারও কথা বলতে ভাল লাগছে না। কল রেখে চোখ বন্ধ করে রইলাম। আজ চোখ বুজতে খুব ভাল লাগছে, ভীষণ ভাল লাগছে।


"বাবা, তোমাকে আমি আসতে বলেছি, তবুও যদি না আসো তবে খুব কষ্ট পাবো। কিছু কথা বলার আছে।"
- জ্বি আমি আসছি। বলেই কলটা রেখে দিলাম।
কন্যার বাবা বুঝতে পেরেছেন যে তার মেয়েকে এই ছেলেটা ভালবাসে। কিন্তু তিনি সামনাসামনি বলবেন। ফোনে সবকথা বলা যায় না। আমি তার কথা শুনতে যাচ্ছি না, যাচ্ছি শেষ বারের মত সুমিকে দেখতে।
বিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখি সুমির বাবা তিন চারজন লোকের সাথে দারিয়ে বকবক করছেন। আমাকে দেখার পর সামনে এগিয়ে এলেন। আমিও সালাম দিলাম। উনি আমাকে ছাদে নিয়ে তার ছেলেদের তত্ত্বাবধানে!
- এই শফিক, এদিকে আয় তো।।
সুমির মেজ ভাই চলে এল।
- কথা বল তো একটু আর বসিয়ে দিস।
এই বলে সুমির আব্বু চলে গেল। শফিক ভাই আমাকে নিয়ে ছাদের এক কোণায় গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
- তোমাকে চিনি অনেকদিন থেকেই। কিন্তু কখনও বাজে কিছু ভাবি নি। তবে সেদিন তোমার হাতে লাগেজ দেখে আমি জ্ঞানগরিমা হারিয়ে ফেলি।।
- কিন্তু শফিক ভাই আমি....
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-আমি জানি তুমি দোষী হয়েও নির্দোষী অন্নদিকে নির্দোষ হয়েও দোষী। বলেই একটু শ্বাস নিলেন তিনি। তারপর বললেন,
- গতকাল সুমিকে ঘরে না পাওয়ার ফলে আমরা সবাই টেনশনে পড়ে যাই। আম্মুতো নামাজে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি শুরু করে দিছে যেন তার মেয়েকে কেউ ছিনিতাই করে নিয়ে গেছে। লাগেজ দেখে ভেবে নিলাম তুমিই নিয়ে গেছিলে কিন্তু সুমি যখন আসল ঘটনা বললো তখন আমিই খুব লজ্জিত। আব্বুও খুব লজ্জিত যার জন্য কিভাবে তোমার সাথে কথা বলবে বুঝতে পারছিল না।
- আমিও বুঝতে পারছি।
এরপর আমাকে নিয়ে ভিতরে গেলেন। দেখলাম বাড়ি ভর্তি মেহমান আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করতেছে। সুমি বাদে বাসার সবার সাথেই কথাবার্তা হল। টুকটাক খাওয়া দাওয়া করার পর সুমির সাথে দেখা হল ছাদে। একের পর এক মহিলা বাচ্চাকাচ্চা এসে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমারও ইচ্ছা হচ্ছিল কিন্ত পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছি সুমির খুব কষ্ট হচ্ছে বিয়েতে! আমাকে দেখে অনেকখানি খুশি হল সুমি। চোখের ইশারায় পাশে থাকতে বললো। আমিও হ্যাবোধক সম্মতি জানালাম। আমি বসে বসে হলুদ রঙা সুমিকে দেখছি আর সে আমার শুকিয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। সময়ের ঘড়ি স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। কমিয়ে নিয়ে আসছে কবুল বলার সময়কে। সেদিনের মত শেষ বারের জন্য দেখা করে ফিরে এলাম। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুমি কাঁদে নি! মেয়েটা খুব শক্ত এবং নিজেকে সামলে নেয়ার অপূর্ব মানসিক ক্ষমতা আছে তার। রেলিং ঘেষে একে অপরের বিপরীতমুখী হয়ে যখন দারিয়ে ছিলাম তখন সে বললো, "যা হবার তা কি ভালর জন্য হয়?" আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম জানি না। সবই উপর থেকে পাকা হয়ে আছে। কারও কোনো হাত নেই সেটায়। সে বললো, "তুই যে আমাকে ভালবাসিস সেটা আগে বললেই পারতি!!"
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, "সেখানে তুই দায়িত্বটাই দেখছিলি, বিশ্বাসটা দেখলি না। তুই এত পরে দেখবি সেটাও জানা ছিল না।" আর কিছু না বলে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম। আসার সময় আঙ্কেলের সাথে দেখা হল। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "তোমাকে যা ভাবছি তার চেয়ে অনেক ভাল ছেলে তুমি, বিশ্বাস ভাঙো নি। আমার কলিজাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অনেক বড় ঋণী করে দিলে আমাকে।" এবারও চুপ করে হাসি মুখে কষ্ট ঢেকে চলে এলাম সেখান থেকে। রাতের রাস্তায় হাটতে কার না ভাল লাগে। আমার তো প্রিয় সময় এইরকম রাত্রে হাটা! আকাশে মেঘ করেছে কিন্তু সিনেমার মত বৃষ্টির দেখা নেই! ক্ষণে ক্ষণে দমকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে সাথে আকাশে আলো মেঘের খেলা।


ধন সম্পদ ওয়ালা বাকের সুমিকে নিয়ে সুখেই আছে। তাদের গাড়িবহর দেখে আমি থমকে গিয়েছিলাম। সেদিন ওর বাসার সামনের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। বিকালে বরযাত্রী এসে সুমিকে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম খুব কান্নায় বাসা ভারী হয়ে উঠেছে! ওর বিয়ের দিন আমি যাই নি। রাস্তার পাশের দোকানে দারিয়ে ছিলাম। এতদুর থেকে সুমি আমাকে দেখতে পাবে না। অবশেষে সুমির বরের গাড়িবহর তাকে নিয়ে চলে গেল। আমিও চোখটা মুছে চলে এলাম সেখান থেকে।
এখনের সময় যেন কাটতেই চায় না! একেকটা দিন বছরের মত লাগে। ক্লাসেও ভাল লাগে না। কারণ আমার পাশের বেঞ্চটা ফাঁকা! সেখানে সুমি বসতো, আমরা দুইজন হাসা হাসি করতাম, কত মধুর সময় এখানে কেটেছে! বিয়ের ব্যস্ততায় সপ্তাহের বেশি সে ক্লাসে আসে নি। তাহসিনকে দেখলাম নতুন মেয়ের সাথে রিক্সায় কোমড়ে হাত রেখে ঘুরে বেরাচ্ছে! সবাই তার সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে, কেউ কেউ পরিবর্তন করেও নিয়েছে অথচ আমি একলা রাস্তার এপারের যাত্রী ছাউনির নিচে অপেক্ষা করতে থাকি! একেকটা বাস আসে, যাত্রী নিয়ে যায় আর আমি বসে থাকি। কেউ জানে না আমার ভিতরে কি চলছে। একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মত আমি!


মোকসেদ সাহেবকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে মেয়ের বিয়ের পর থেকে! খুশি হওয়ার কারণ তো আছে, তারা যে বিরাট বড়লোক আত্মীয় পেয়েছেন! মোকসেদ সাহেবের পা মাটিতে নামতেই চায় না নাকি! এসব কথা শুনা যায় সুমির এলাকা দিয়ে যখন হেটে যাই। বিরাট ভাব হয়েছে তার। বিয়ের পর থেকে অনেকদিন সুমির বাবা মোকসেদ সাহেবের সাথে দেখা হয়েছে। কোন বারই আমার সাথে কথা বলেন নি! ভালভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন আমাকে। এদিকে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, বাসার অবস্থাও করুণ! টুকটাক চাকরি বাকরি খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, একটা পার্ট টাইম চাকরি পেলাম। বেতন ১১হাজার। উনার মানে আমার বস জনাব খোরশেদ আলম এর একাউন্টসের কাগজপত্র এবং ফাইল ইত্যাদির হিসাব নিকাশ রাখতে হবে। ভালই চলছে সেখানে, ৫ ঘন্টা তার কাজে থাকার বদলে ১১হাজার টাকা পাওয়া গেলে খুবই ভাল।


মোকসেদ সাহেবের কথা কয়েক সপ্তাহ হল শোনা যায় না! এখন নাকি তার পা মাটির নিচে থাকে! সুমির এলাকার সামনে গেলে একথা শোনা যায়!! ব্যাপারটা কি?
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মোবাইলের কন্টাক্ট নাম্বার গুলো দেখছি। সুমির নাম্বারটা মুছে দিছি মোবাইল থেকে কিন্তু এখনও মুখস্ত আছে। হঠাৎ মোবাইলে কল এল, নাম্বারটা অচেনা, আমার মনে হল সুমিই দিয়েছে!! রিসিভ করলাম,
- হ্যালো?
ওপাশের নিরবতা!!
- হ্যালো, কে বলছেন?
কিছুক্ষণ পর,
- কেমন আছো?
কণ্ঠটা চিনতে একদমই কষ্ট হল না। ফোনটা একটু দুরে রেখে বড় নিঃশ্বাস নিলাম,
- তুমি কেমন আছো?
- তুই থেকে তুমি হয়ে গেলাম আমরা???
আমি চুপ করে আছি, শত বছরের কান্না ভিতরে জমা রেখে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কেউই জানলাম না কে কেমন আছি!!
- হঠাৎ কল দিলে যে?
- এমনিই!! কণ্ঠটা শুনতে ইচ্ছা হচ্ছিল।।
আমি চুপচাপ আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। ওপাশ থেকে আবারও বললো,
- ঠিক আছে রাখি। আর কল করবো না। নিজেকে থামাতে পারি নি তাই কল করছিলাম। ভাল থাকিস....
মোবাইলটা বেখায়ালে ছুড়ে দিলাম কোনখানে নিজেও জানি না। বাঁধভাঙা কান্নার জোয়ার চোখ থেকে বের হচ্ছে! অভিমানী না হয়েও অভিমান দেখাতে হল। একবার জানতেও পারলাম না কেমন আছে সে!! মাথা ব্যথা করছে কাঁদতে কাঁদতে। খাওয়া দাওয়া ছাড়াই সেরাতে ঘুমিয়ে পরলাম।।


জনাব খোরশেদ আলমের অফিসে যাচ্ছি। উনার তিনটা ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না। সুমির এলাকার সামনে দিয়েই যাচ্ছি। ওর বাসার সামনে পৌছাতেই দেখি মানুষের ঢল! কি হয়েছে জানা দরকার। শুনছিলাম মোকসেদ সাহেব অসুস্থ। মারা যান নি তো তিনি!! ধীরে ধীরে ভীড় ঠেলে ভিতরে যেতেই দেখি সাদা কাপড়ে মোকসেদ সাহেব শুয়ে আছেন! সুমির মা আর ভাইয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। একটু পর একজন হাউমাউ দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আসলো!! আমি তাকে দেখেই চমকে যাই! দেখলাম উনি মোকসেদ সাহেব! তাহলে যে শুয়ে আছে সে কে??? আমি আস্তে আস্তে সামনে আগালাম। একটুপর দেখলাম আমার বন্ধু-বান্ধব আর কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত সেখানে!! আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। একটুপর আমি মোকসেদ সাহেবের নজরে এলাম, উনি আমার দিকে তেড়ে এসে বললেন,
- দেখবে না বাবা? যাও ওদিকে দেখে আসো।
আমি উনার কথা বুঝলাম না! আস্তে আস্তে কাফনের কাপড় তুলে দেখলাম সুমি!!!!
চেহারাটা মলিন হয়ে আছে!! গলায় কয়েকটা গাঢ় দাগ এবং মাথার পাশে ক্ষত! পাশবিক অত্যাচারের নমুনা বানিয়ে রেখেছে আমার সুমিকে! মোকসেদ সাহেব বারবার বলতে শুরু করলেন, "ও আমাকে মানা করছিল, আমি শুনি নাই!! ধন দৌলত দেখে বিয়ে দিলাম ভাবলাম আমি সফল কিন্তু তা হল না!!! আমার একমাত্র মেয়ে, আমার কলিজাটা ওরা ছিড়ে নিল! এত ধন সম্পদের মালিক তারা, আমি আমার ২৩ বছরের সাধনা তাদের ঘরে দিলাম আর তারা কি করে দিল!!"
শফিক ভাই এসে বললেন, "আমরা আমাদের সবচেয়ে আদরের আর ভালবাসায় গড়া বোনটারে বিয়ে দিলাম আর তারা কি করে মেরে ফেললো!! গতকাল রাতে কল দিয়ে বলছিল বাসায় নিয়ে যেতে না হলে মেরে ফেলবে। আমরা সকালেই রওনা দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ওরা রাতটা পোহাতে দিল না!!!"
এই বলে উনি কেঁদে উঠলেন! আমি ঠায় বসেই রইলাম। একনজরে তাকিয়ে আছি সুমির দিকে! গতকাল রাতেই বলেছিল সে আর কল দিবে না! এত তাড়াতাড়ি কথা পূর্ণ করল সে! সুমির বাবা দুরে বসে প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। কারও সান্ত্বনাই তার কাজে আসছে না। ধীরে ধীরে জানাজার ব্যবস্থা করা হল। সুমির তিনভাই এবং ওর বাবা লাশটা বহন করে মসজিদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে! ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউই আসে নি!! গোটা পরিবারের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য এরা নরপিশাচ হতে পারে কিন্তু সামান্য টাকা এরা কাউকে দান করে না। ওরা শুধু একটা প্রাণ কেড়ে নেয় নি, কেড়ে নিয়েছে ছয়টি মানুষের হাসি। আমি কার জন্য কাঁদবো জানি না। এরপর থেকে সেই রাস্তায় আর হাটি না। মনে হয় সবখানেই সুমি রয়েছে। এখনও তার প্রত্যেকটা কথা আমার কানে ঝংকারের মত বাজে, সেই চাহনীটা আজও আমার চোখ থেকে সরে নি। ওর কথা ভাবতেই সেদিনের চেহারাটা ভেসে উঠে। ভাবি সেদিন যদি আমি আমার ভালবাসার কথা বলতাম বা ওকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম তবে আজ হয়তো সে আমার পাশে থাকতো।।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার জন্য)

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৪

রাতু০১ বলেছেন: সুন্দর ও পরিপূর্ন লেখা। শুভকামনা।

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৪

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই

২| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:১৯

মোঃ পারভেজ মোশারফ বলেছেন: undefined emotional lika vai....

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৪

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই

৩| ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১৪

আখেনাটেন বলেছেন: সুমির মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সমাজের একটি কুৎসিত দিক তুলে ধরেছেন। বেশ অাবেগ আছে লেখায়।

ভালো লেগেছে।++

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৩

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই

৪| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৩৪

শুজা উদ্দিন বলেছেন: হুলুস্থুল ফিলিংস।
কান্নাও আসতে চায়।
+++

মুসলিমদের বিয়েতে সমতা বিধান করার নির্দেশ আছে ইসলামে। পাত্র পাত্রী সমমানের হলেই উত্তম।
ভেবে কুল পাই না। মা বাবারাই মেয়েকে বেচে দেয় আর ভাবে মেয়ের বড্ড উপকার হয়েছে।

btw গল্পটা কি বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ?

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৩

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: শেষ পরিণতিটা বাস্তব, বাকিটা কাল্পনিক

৫| ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:০১

অপু তানভীর বলেছেন: সুন্দর লেখা

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:০২

দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.