নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রেমিকার চিরশত্রু
যেখানে বসে আছি সেখানেই আমি সবসময় বসি। আজও বসে আছি শুধু সামনের চেয়ারটা একজন ছিল সে নেই। নেই বলতে যে পৃথিবীতে নেই সেটা না, পৃথিবীতেই আছে তবে এতদিন আমার সাথে ছিল কিন্তু দুই মাস হল আমার সাথে নেই। আছে অন্য কারও সাথে। অন্য কারও হাতে হাত রেখে চলাচল করছে! ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ সবারই আছে কিন্তু কাপড় বদলানোর মত পছন্দ করা মানুষ আমার একদমই পছন্দ না। এইতো সেদিনের কথা, আমি আর রিফাত বসে ছিলাম এই রেস্টুরেন্টে। হাতে হাত রেখে কথা বার্তা বলছিলাম। তবে রিফাতের মাঝে একপ্রকারের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। আমিও আন্দাজ করতে পেরেছি যা হওয়ার তাই হয়েছে। দিনের পর দিন পেরিয়ে যায়, রিফাত একটু একটু করে দুরে সরে যাচ্ছিল। কল দিলে তেমন রিসিভ করে না, অল্প স্বল্প কথা বলতো আর মাঝে মাঝে ওয়েটিং! আমার প্রেমকে আমি নিজ ইচ্ছায় ডাকি নি বা প্রেম নিজ ইচ্ছায় আমার কাছে ধরা দেয় নি। কখনও ভাবী নি রিফাত আমার সাথে অমনভাবে কথা বলবে! শেষ যেদিন সামনাসামনি কথা হয়েছিল সেদিন রিফাত হুট করে একটা মেয়েকে আমার সামনে নিয়ে এল! আসলে নিয়ে আসে নি, আমার সামনে পরেছে। নীলক্ষেত গিয়েছিলাম কিছু বই কিনতে। এমন সময় দেখি রিফাত একটা মেয়ের সাথে হাটছে। কাজিন বলে পরিচয় করে দিয়েছিল। রিফাতের একেকটা মিথ্যা কথায় আমার বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছিল। সেদিনের সেই মেয়েটাকে দেখে বুঝে নিয়েছিলাম রিফাত আমাকে কখনই ভালবাসে নি।
- এত বিলাসবহুল নামীদামী রেস্টুরেন্টের খাবার আমার পেটে ঢুকবে না। ও আচ্ছা ভাবিস না আমি এখানে খেতে বা খাওয়াতে এসছি বা তোকে ক্ষসাতে এসছি। এসব রেস্টুরেন্টে ঢোকার সাহস নেই কিন্তু তোকে দেখেই ঢুকলাম। অনেকক্ষণ হল দেখছি তুই সামনের চেয়ারের দিকে ছিলি!
তাকিয়ে দেখি আমার সামনে আরাফাত বসে আছে! এই অবস্থায় ওর আগমণ আমার মোটেও পছন্দ হয় নি। আমিও রাশ রাশ বিরক্তভরা কণ্ঠে বললাম,
- আমার সম্পর্কে মনে কিছুই জানিস না তুই?
আমার কথা শুনে আরাফাত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো,
দেখ আমি সব জানি। তুই রিফাত ভাইকে কতটা ভালবাসতি সেটা জানি কিন্তু তারমানে এই না যে তোকে সবসময় এই রেস্টুরেন্টে বসে থাকতে হবে।
আমি বললাম যা তো জালাস না।
প্রতিউত্তরে সে বললো, আংকেল আন্টি তোকে নিয়ে খুব চিন্তিত আছে। প্রতি মুহূর্ত তোকে নিয়ে ভয় হয় তাদের।
- আব্বু আম্মুর চেয়ে দেখছি তোর চিন্তা বেশি!!!
দেখলাম আরাফাত আর কিছু বলল না। তবে আর কিছু না বলে চলে এলাম সেখান থেকে। গাড়ি থেকে নেমেই কারও সাথে কথা বা দেখা না করেই সোজা রুম যেয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। শুনেছিলাম ছোট চাচা আর তার পরিবারের আসার কথা ছিল। বাহিরে যেহেতু একটু শোরগোল শোনা গেল তাতে বুঝে নিয়েছি তারা এসেছে। এরমধ্যে মা দরজায় নক দিলেন। মনে মনে অতি বিরক্ত হয়ে লক্ষী মেয়ের রুপে দরজা খুলে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম, "কি চাই?"
আম্মুও হাসি মুখে বললেন, "নিচে আসুন, আপনার চাচা চাচী আপনাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে!"
আমিও নিচে নামার সম্মতি জানিয়ে আবারও দরজা লাগিয়ে দিলাম। ভালই লাগে ভাল থাকার অভিনয় করে যেতে। মাঝে মাঝে নিজেকে মাল্টিপল ডিজঅর্ডারের রোগী মনে হয়! সময় ভাল সময় খারাপ!
চাচা চাচীর সাথে দেখা করে ছাদে চলে এলাম। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বইছে। ছাদের এক কোণায় দারিয়ে আকাশ দেখছিলাম এমন সময় রাফির আগমণ!
- তো দিনকাল কেমন যাচ্ছে মিস প্রিন্সেস?
রাফির প্রশ্নে অজস্র বিরক্তি নিয়ে শুধু বললাম ভাল চলছে। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলাম না সে কেমন আছে। যখনই আর যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। রিফাত আর ও ফ্রেন্ড। রিফাতের সাথে সম্পর্ক চলাকালীন সময়েও সে বিভিন্ন ভাবে বুঝাতে চেয়েছে রিফাতের চেয়ে সে হাজার গুণ ভাল! জীবন এখন এতটাই তিক্ত অনুভূতি আর বাস্তবতা দেখিয়েছে যার সুবাদে এখন মানুষ চিনতে ভুল হয় না। রাফি কতটা ভাল হবে সেটাও দুর থেকেই আন্দাজ করা যায়। রিফাত আর রাফি, ক্লাসমেট, বন্ধু!!
বাসার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটায় ফুল ফুটেছে! আবছা আবছা লাল রঙের ফুলে পুরো গাছটার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে! কোনদিন এই কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখে নদীর পাড়ের রাস্তার কৃষ্ণচূড়া গাছের কথা মনে হয় নি! কিন্তু আজ মনে হচ্ছে। আব্বুকে বললাম ঘুরতে যাওয়ার কথা। একা যাব, কাউকে সাথে নিয়ে নয় এবং কারো সাথেও যাবো না। ভোরের আলো যখন অলসভাবে আকাশ ছেয়ে ছড়িয়ে পরে ঠিক সেসময় আমি সেই স্থানে গেলাম। একাই গেলাম! স্থানটা কুসুম বিকালের দিকে ভীড় হতে শুরু করে। রোজকার মতই এখানের ল্যাম্পপোস্টের নিচে যিনি ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন তিনিও এখানে আছেন! কোনো একদিন সকালে রিফাতের সাথে এখানে এসেছিলাম। রাস্তার পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। খুব সকালে আসার দরুন এখানে ব্রেকফাস্ট করার মত কিছু ছিল না। রিফাত হাটতে খুব অপছন্দ করতো! সবসময় বাইকের সাহায্য লাগতো। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো যতটুকু সম্ভব হেটে যাই ওর সাথে। একদিন জোর করেই হাটিয়েছিলাম ওকে যার ফলে দুই দিন পায়ের ব্যথায় উঠে দারাতে পারে নি!
- ছোট ম্যাম, চলুন এবার, লোকসমাগম আস্তে আস্তে বাড়তেছে!
অনুনয়ের সুরে জামাল চাচা বললেন। উনি আমাদের ড্রাইভার। ছোট থেকেই আমাকে বেশ আদর করেন।
- আরেকটু থাকি।
আমি হাটছি আর উনি আমার হাটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ি নিয়ে আগাতে লাগলেন!
এভাবে হাটতে আর ভাল লাগছে না। সময় কাটানোর চেষ্টায় এখানে হাটতে এলাম কিন্তু সময় যাচ্ছে না বরং আমার মেজাজ বড্ড খারাপ হতে লাগলো! শেষে না পেরে আমি গাড়িতে উঠলাম। যাওয়ার সময় দেখি আরাফাত এই রাস্তায় হাটছে! মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হল সে আমাকে ফলো করছে কিনা।
কোনো এক প্রখর দুপুরে আমি ছাদে বসে আশেপাশের গাছের পাতা বাতাসে নড়ে কিনা দেখছিলাম। বাতাসহীন এই দুপুরে আমি কখনও ছাদে আসতাম না। এসির বাতাসে নিজেকে জুড়িয়ে নেয়ার জন্য রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম! সেই আমি আজ এই ভরদুপুরে রোদের মাঝে বসে আছি! শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর মত লেখার ক্ষমতা আর ধৈর্য্য থাকলে আজ হয়তো আমি নিজের কাহিনী নিয়ে দেবদাসের ২য় পর্ব বের করতাম! ভাবতে ভাবতে দেখি ফোনে আরাফাতের কল। রিসিভ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তাই রিসিভ করলাম না। কিন্তু নাছোড়বান্দা সে বারবার কল দিতে থাকে! বিরক্তভাব এখন কপালের ভাজে আর চোখের ভ্রু তে অবস্থান নিয়ে রেগে বললাম এতবার কল দিস কেন?
জবাবে আরাফাত বললো এমনি!!
- এমনিই মানে? এমনি মানে কি? রাগে দাত কটমট করছে আমার।
- না মানে সময় যাচ্ছিল না ভাবলাম তোকে কল দিই, একটু ভালমন্দ জিজ্ঞেস করি।
- টাইম পাসের জন্য সবসময় আমাকেই পাস? আমি কথা একটু জোর দিয়ে রেগে বললাম।
কল রাখ, একদমই কল দিবি না বলে দিচ্ছি! কল কেটে দিলাম। ইচ্ছা হচ্ছে চিৎকার দিয়ে কাঁদি! এতটা চিৎকার দিই যাতে মনের সকল দুঃখ কষ্ট চিৎকারের কম্পাঙ্কে ভেঙে চুরচুর হয় যাক।
ক্লাসে চুপচাপ এক কোণার বেঞ্চে বসে থাকি। স্যার কিসের কি ছাইপাঁশ পড়িয়ে যায় বুঝি না শুধু বাম কান দিয়ে ঢুকে ডান কান দিয়ে বের হয়ে যায়!
- তুই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলেই পারিস। সবকিছু তোর হাতে রে!
আমি আরাফাতের কথায় কান দিলাম না।
- শোন তোকে একটা কথা বলি। রিফাত ভাই নিজেকে অন্য কারও জন্য ব্যস্ত করে তুলেছে। তুইও নিজেকে ব্যস্ত করে নিলেই পারিস! নিজেকে ব্যস্ত রাখ, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
আমি আবারও ওর কথায় কান দিলাম না। স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যাগ নিয়ে সোজা বের হয়ে গেলাম ক্লাস থেকে! ৫তলা থেকে নামছিলাম এমন সময় দেখি নিচে মাঠে রিফাত আর নিশি বসে গল্প করছে! বেশ ভাল, কিছুক্ষণ দারিয়ে তাদের দেখে নিলাম। নিজের অজান্তেই চোখ ভারি হয়ে আসছিল। এভাবেও মানুষ বদলাতে পারে ভাবি নি!
নিধি, আরাফাত এসেছে! আম্মুর ডাক।
আরাফাত বুঝতে পেরেছে যে আমি তাকে দেখে খুশি হয় নি। আমি বুঝি না সে কেন বারবার আমার পিছে ঘুরঘুর করে।
ছাদে যা, আসছি। ধীরভাবে বলে রুমে চলে গেলাম। ভাবছি ছাদে গিয়েই আগে ভালমতো কথা শুনিয়ে দেব যাতে এদিকে আর না আসে।
ছাদে যাওয়ার সাথে সাথে আরাফাত বললো,
- জানি তুই আমাকে দেখতে পারিস না। তোর অপ্রিয় মুখ গুলোর মধ্যে একজন আমি।
- যদি জেনেই থাকিস তাহলে কেন আমার সামনে আসিস? আমি পাল্টা জবাব দিলাম
- দেখ নিধি, আমি শুধু চাই তুই হাসবি, যেমনটা আগে হাসতিস। ভূল আমার, কারণ তোকে প্রেম করতে আমি উৎসাহিত করছিলাম।
- তোর কোনো রকম করুণা আমার দরকার নেই! বরাবরের মতই গরম মেজাজে ঠাণ্ডাভাবে বললাম।
মাসের পর মাস পেরিয়ে বছরে রুপান্তর হয়েছে তবুও আমার উদাসীনতা কমছে না। আরাফাতকে দেখতাম একা একা, হয়তো মাঠে কখনও বা গোলপোস্টের লোহায় হেলান দিয়ে বসে থাকতো। দুটো ব্যক্তির মধ্যে খুব ভালভাবে একাকীত্বের ভাটা খেলে যাচ্ছে। একজন আমি অন্যজন আরাফাত! আরাফাতকে আমি কখনও এমন দেখি নি যেমনটা সেও আমাকে এত বিমর্ষ দেখি নি! রাফির নাম্বার ব্লাকলিস্টে দিয়ে রেখেছি। বারবার রিফাতের কথা বলে ইমোশনাল করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার মধ্যে আবেগ অনুভূতি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে তাকে আবেগ বুঝাতে আসে কিসের জন্য বুঝি না।
আরাফাত তবুও ভালমন্দ জিজ্ঞেস করা থেকে বিরত থাকে নি! স্বল্প খোঁজখবরেই সীমাবদ্ধ। এভাবে দিন কাটিয়ে আবিষ্কার করলাম আমি নিজেকে খুব একা করে দিয়েছি! প্রতিদিন ক্লাস করি, ক্লাসের এত এত বন্ধু বান্ধবীদের মাঝে নিজেকে খুব একাকীভাবে খুঁজে পাই। বাসায় আব্বু আম্মুর সাথেও তেমন কথা বলা হয় না। চারদিক থেকে একাকীত্ব ভীষণতে শক্তি চেপে ধরেছে যার চাপ সহ্য করার মত ক্ষমতা আমার নেই। জীবনের এত বিলাসিতা এখন তিক্ত মনে হয়। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে আবারও কেঁদে উঠলাম আমি! এ কান্না কোথায় শেষ হবে সেটা হিসেব করে মিলাতে পারছি না।
- আমি জানি তুই খুব কষ্টে আছিস।
আবারও আরাফাত এসে সামনে দারালো!
- না, হালকা ব্যথা পেয়েছি।
ঠোট কামড়ে শ্বাস টেনে বললাম।
- যদি সেটাই হতো তাহলে সেখানে তুই হাত রেখে চেপে ধরে রাখতি। অথবা হালকা চোখ লাল হতো।
আমার কান্না থামছেই না বরং কান্না আরও বেরেই চলেছে!
- নিধি, কথা বল। কথা বল সবার সাথে। তোর আব্বু আম্মুর সাথে। শেয়ার কর তোর মনের অবস্থা।
আমি চোখ মুছে ক্লাস থেকে বের হলাম। দরজায় দারিয়ে আরাফাত কে বললাম,
একটু যাবি আমার সাথে হাটতে?
আমার আর কিছু বলতে হল না। আরাফাত ব্যাগ নিয়ে বের আমার সাথে।
পথচলার সাথী থাকলে দুই তিন ক্রোশ দুরের গন্তব্যও পাড়ি দেয়া যায় নির্ভয়ে। লুকানো যত কথা ছিল সেগুলা বলতে গিয়ে কণ্ঠ কেপে কেপে যাচ্ছিল। আরাফাত জানে আমি নার্ভাস বা আপসেট থাকলে কথা বলার সময় কেঁপে উঠি! একটু একটু করে অনেক কথাই শেয়ার করা হল আরাফাতের সাথে। প্রত্যেকটা কথাই অঢেল মনোযোগ মাখিয়ে শুনেছে সে। সেদিন বাসায় বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দিনের মতই বাসার পরিস্থিতি! মনে করতে লাগলাম ভার্সিটি থেকে বাসায় এসে জুতা দুইটা দুই দিকে ছুড়ে দিয়ে ব্যাগ সোফায় রেখে রান্নাঘরে গিয়ে দেখতাম কি রান্না হচ্ছে! আম্মু এদিকে আসার সময় বলতো, "এত বড় হয়ে গেলি তবুও তোর জ্ঞান হল না!" এসব বলতে বলতে আমি গিয়ে জড়িয়ে ধরতাম আম্মুকে! বলতাম, “ছোট থাকাই ভাল, বড় হলে অনেক কিছু ত্যাগ করা লাগে।” ভাবতে ভাবতে নিজ রুমে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে ঘুম আসবে! ঘুম.. অনেক বছরের জমানো ঘুম!
একাকী সময়টা অলসভাবে না কেটে ইদানিং খুব ভালভাবে যাচ্ছে। আয়নায় দাঁড়ালে নিজেকে আগের মত স্বাভাবিক লাগে। নিজের মধ্যে মাল্টিপল ডিজঅর্ডার খুঁজে পাই না! অবাক লাগে যে আমি নিজেকে ব্যস্ত করে তুলতে পেরেছি! আম্মু আব্বুর সাথে এখন ভালই সময় যাচ্ছে! ক্লাস, আড্ডা সবই ভাল লাগে! যেদিকে তাকাই সেদিকেই ভাল লাগা অনুভব করি! সবকিছুই সতেজ আর নতুন মনে হয়! আড্ডায় বসে যদি কখনও রিফাত আর নিশিকে বা বজ্জাৎ রাফিকে দেখি তখন রাগ হয় কিন্তু কষ্ট হয় না। আরাফাত আর আমি ক্লাসের ফাঁকে সারাক্ষণই গল্প করি। কথা বলার কিছু না পেলেও জোর করেই সে কিছু না কিছু বলবে! বসন্তের কোন এক বিকালে আমি আর আরাফাত যখন হাটতে বের হয়েছি তখন কথা বলার মত কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না! আমি ঠোট চেপে এদিক সেদিক তাকিয়ে ভাবছি কি কথা বলা যায়। আরাফাত নিচের দিকে তাকিয়ে হেলে দুলে হেটে যাচ্ছে। আশে পাশে মানুষের গড় গড় করলে দেখা যাবে ৯০ শতাংশই এখানে প্রেমিক প্রেমিকা! আমি তাদের মধ্যে গুটি কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে বিচার করতে শুরু করলাম কোন কাপল কতটুকু কিউট এবং মানানসই। আরাফাত তখন বললো,
- কিরে, মার্কিং দেয়া শুরু করলি নাকি?
আমি মাথা নেরে সম্মতি জানালাম।
আফসোসের গ্লানিমাখা কণ্ঠে বললাম কত্ত সুইট বয়ফ্রেন্ড আছে বান্ধবীদের!
আরাফাত মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
নিধি, বয়ফ্রেন্ডগুলো হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, গুড লুকিং, ড্যাশিং আরও নানান সৌন্দর্যে ভরপুর হয়! কিন্তু হাসবেন্ডরা বোকা, সহজ সরল, গেঁয়ো, আতেল টাইপ বা একটু চাপা স্বভাবের হয় যারা তাদের স্ত্রীকে কতটা ভালবাসে সেটা বুঝাতে পারে না! আড়ালে অনেক কঠিন অনুভবনীয় কষ্ট নিয়ে থাকতে ভালবাসে। জীবনে বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড অনেক আসে যায় কিন্তু স্বামী বা স্ত্রী সবসময় একটাই হয়। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড পাল্টে যায় কিন্তু স্বামী বা স্ত্রী পাল্টে যায় না..
আরাফাতের কথাটা আমার কানে নূপুরের ঝংকারের মত বাজতে থাকে! ওর কথাটা শুনে বয়ফ্রেন্ড নামের প্রতি এলার্জি আরও বেরে গেল। ঠাট্টার সুরে একটু বাকা করে বললাম,
তুই তো রোদে পোড়া কালো! তোর কপালে কোনো গার্লফ্রেন্ড জুটবে না লিখে রাখ...
- হুম, জানি! রোদে পুরে কালো হয়েছি বলেই নূপুর আমার স্বাথে বন্ধুত্ব করে নি! ভাগ্যিস প্রেমের প্রস্তাব দেই নি! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসি মুখে বললো। তবে আমার কথায় ভিতরে কষ্ট পেয়েছে সেটা তখন বুঝতে পারি নি এবং সেও বুঝতে দেয় নি আমাকে! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার পর বুঝলাম আমার এটা বলা উচিৎ হয় নি! ওর ভয় হয় যদি আমার আর ওর বন্ধুত্বটা নূপুরের অপমান করার মত করে ভেঙে যায় তবে আবারও একা হয়ে যাবে ছেলেটা!
আরাফাত কখনই এমন করে কষ্ট রেখে কথা বলে নি আমার সাথে! ওর সেদিনের সেই কথা আর চাহনিতে কতটা কষ্ট ছিল সেটা দিনের পর দিন পার হওয়ার ফলে বুঝতে পারছি! আরফাত আমাকে আমাকে একটা আয়না দিয়ে বলেছিল,
- এই আয়নাটা নে। জানিস, এর সামনে দুই ধরনের মানুষ দাড়ায়। প্রথমজন তাকায় নিজেকে কেমন দেখা যায় সেজন্য। আর দ্বিতীয়জন তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার উপর অহেতুক নিজের রাগ অভিমান নিজের চোখে চোখ রেখে বিরবির করে বলে!
- তো এটা আমাকে দিলি যে?
- সৃষ্টিকর্তা সবার মধ্যে পরিমাণ মত রুপ লাবণ্য দিয়েছেন। কেউ তাতে সন্তুষ্ট আর কেউ সেই দ্বিতীয়জনের মতই!
আমি আয়না হাতে নিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম। ভাল করে দেখা শুরু করলাম।
- তুই প্রথমে ভেবেছিলি নিশি তোর চেয়ে সুন্দরী তাই রিফাত ভাই তোর সাথে ব্রেকআপ করেছে। তোর আঙুলগুলো দেখ, হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না। নিজেকে তুই ছোট ভাববি কেন?
আমি আয়নার সামনে একটু হাসলাম! বুঝলাম আরাফাত ঠিক বলেছে! শুধু শুধু সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করে কি লাভ! হাসলাম, একটু মুচকি হাসি! খারাপ না। ভাল, বেশ ভাল যা খুঁজে বের করতে পারি নি! হুম, তাই তো চাঁদের কলঙ্ক আছে।
আরাফাত একটু একটু করে আমাকে বুঝিয়েছে সন্তুষ্ট কিভাবে থাকতে হয়! গাড়ির পিছন সিটে বসে কখনও ভাবি নি জামাল চাচা কিভাবে হাসি মুখে থাকে? বা ভাবি নি বাড়ির তিনজন দারওয়ান দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় একসাথে গল্প করতে করতে খেয়ে কি আনন্দ পায়! আমি খাওয়ার টেবিলে বসে ডান হাতে ধরা চা চামচ দিয়ে বারবার টুংটাং শব্দ করে যাচ্ছি। একটু একটু করে খাচ্ছি। কি যেন ভাবনায় নিজেকে অন্যদিকে ডুবিয়ে দিয়েছি। চামচ রেখে হাত দিয়ে খেয়ে উঠে গেলাম! আম্মু ডাকছিল কিন্তু ক্ষুধা নেই বলে চলে এলাম। ছাদে এসে দেখি আকাশে মোটামুটি মেঘ জমতে শুরু করেছে। বর্ষাকালের বৃষ্টিতে বজ্রপাত হয় না তাই নির্দ্বিধায় বৃষ্টিতে ভিজা যায়! আমারও মন তখন খুব করে চাইছিল যে আষাঢ়ের বৃষ্টির ফোটায় অনুভূতিগুলো পরিষ্কার করে নিই। অপেক্ষা করে চললাম কখন বৃষ্টি আকাশ ঝেপে নেমে এই শহরকে ভিজিয়ে দেব। ধীরে ধীরে মেঘ জমাট বাধা শুরু হল। মেঘের ভেলা উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সরে গেল কিন্তু বৃষ্টি ঝরিয়ে গেল না। মন খারাপের প্রধান কারণ এই মেঘ এখন অজানা অচেনা শহরের দিকে ভেসে যাচ্ছে!
ক্লাস শেষ করে আরাফাত আর আমি হাটছি। হঠাৎ একটু ঠাণ্ডা আবহাওয়া অনুভব করলাম। আকাশের কোনো এক প্রান্তের সীমানা ঘেঁষে মেঘ জমাট বাধা শুরু হয়েছে! আমি জানি মেঘমালা এই শহরের উপর দিয়ে আশার আলো দেখিয়ে অন্যখানে চলে যাবে। বরাবরের মতই এবারও মন খারাপ। আরাফাত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম আকাশে কি দেখিস?
- কিছু না রে, ভাবছি বাসায় পৌঁছাতে পারবো কিনা বৃষ্টির আগমনের আগে।
- আরে বৃষ্টি আসবে না, তার আগেই পৌঁছে যাবি।
হাটতে হাটতে হঠাৎ বুঝলাম হাতে পানির ফোটা! বুঝতে বুঝতেই দেখি হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি! এমন বৃষ্টি যেন মনে হচ্ছে বৃষ্টির ফোটা রাস্তায় ছোট ছোট গর্ত করে দেব! ছাতা খুলতে খুলতে হালকা ভিজে গেলাম! একই ছাতার নিচে আমি আর আরাফাত! হয়তো আরাফাতের বাম কাধ অল্প অল্প করে অনেকখানি ভিজে যাচ্ছে বা বৃষ্টির ছিটা আমাদের পায়ে কাঁদা মাখাচ্ছে। বৃষ্টির বেগে রাস্তার মোড় জনমানব শূন্যে পরিণত হল। রিক্সাগুলো যে যার চাহিদা মত ভাড়া চেয়ে মোড় ত্যাগ করে গন্তব্য চলে গেল! এই রাস্তায় এখন আমি আর আরাফাত!
- তুই ছাতার নিচে থাক, আমি ভিজি। অল্পতেই তোর জ্বর চলে আসবে!
এতটুকু বলেই ব্যাগটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে সে ছাতার বাহিরে চলে গেল! আমি থামাতে গিয়েও পারলাম না। বারবার ছাতার নিচে আসতে বললাম কিন্তু আরাফাত শুনলো না। মুহূর্তেই কাক ভেজা হয়ে গেল সে। মনের আনন্দে রাস্তার এদিক সেদিক হেলে দুলে হেটে বেরাচ্ছে সে! ব্যাগটা ধরে ওর পিছু পিছু হাটা শুরু করলাম। মনের ইচ্ছেমত ভিজে চলেছে আরাফাত। "বিধাতা সবাইকে পরিমাণ মত রুপ লাবণ্য দিয়েছেন!" কথাটা মনে পরে গেল। আমি ভাবছি যদি নূপুর তার এই উন্মাদনা দেখতো তাহলে নিশ্চিত আমার মত একা হতে হত না আরাফাতকে! আর আমি জানি আরাফাত একা নয়, আমি সাথে আছি ওর! ওর পাগলামোকে উন্মাদ হয়ে দেখার জন্য এবং এটাও জানি যে আরাফাতও আমার সাথে আছে!! অল্পতেই খুশি হওয়া সেই ছেলেটা জানে না কেউ তার এই পাগলামো কে অঢেল ভালবেসেছে! জানে না সেই বন্ধুটিও তার বৃষ্টি ভেজা দিনের সাক্ষী!
হুম, সবাই সুন্দর। সবাই!
কুৎসিত তারা যারা রিফাত আর রাফির মত।
[ভূল ত্রুটি ক্ষমার যোগ্য]
©somewhere in net ltd.