নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবতে ভালবাসি, সেই ভাবনা যদি কোনো ঘটনায় মিলে যায় তবে তাকে লিখতে ভালবাসি! সেই লেখায় যদি কেউ বিন্দুমাত্র উপকৃত হয় তবে তাতেই আমার খুশি, আমি লেখাকে ভালবাসি।

দর্পণের প্রতিবিম্ব

প্রেমিকার চিরশত্রু

দর্পণের প্রতিবিম্ব › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভীড়ের মাঝে ভালোলাগা

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৯

সেই রাত তিনটা থেকে কমলাপুর স্টেশনে টিকেট নামক সোনার হরিণের জন্য সিরিয়াল দিয়ে আছি! আগে আগে সেহেরি খেয়ে মেস থেকে বের হয়েছিলাম। ভাবলাম হয়তো কাউন্টার অনেক সামনে থাকবো কিন্তু স্টেশনে পৌছে দেখি আরও শত শত মানুষ ভীড় করে এদিক সেদিক বসে আছে! এরপর আমিও সিরিয়াল অনুযায়ী লাইন দারালাম। সকাল নয়টার সময় ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু হল! ভাগ্যটা এতই খারাপ যে আমি টিকেট পেলাম না! কিছু করার নাই। কাউন্টার থেকে বললো, "যেদিন যাবেন সেদিন টিকেট নিন।" অর্থাৎ দাঁড়ানো টিকেট! এত কষ্ট করে লাইনে দারিয়ে যদি টিকেট না পাওয়া যায় তাহলে যে কারও রাগ হওয়ার কথা! উদাস মন নিয়ে মেসে ফিরলাম। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে! মেসে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। এমন সময় নিজাম চিল্লাতে চিল্লাতে আমার রুমে এসে বললো,

"দোস্ত, টিকিট পাইছি রে! ১৭তারিখ যাইতেছি!"

"ভাল হইছে, ভ্যাবাস না। দুরে যা!"

"ও টিকেট পাস নি?"
.
"না। কাউন্টার থেকে বললো যাওয়ার দিন টিকেট নিতে!"

"তাহলে আমার একটা কথা শোন। তুই ১৭তারিখ আমার সাথে বের হবি। স্টেশনে যাবো। তোকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি সায়দাবাদ থেকেই বাসে উঠবো।"

"ওরে গরু রে! জানিস না আমি টিকেট পায় নি?"

"তো কি হইছে? টিটির অত টাইম আছে নাকি টিকেট চেক করার?"


নিজামের কথাটা একটু ভেবে দেখলাম! টিভিতে ট্রেনের চেহারা দেখলেই তো চিন্তায় পরে যাই ভিতরের অবস্থার কথা ভেবে! তাহলে কি বিনা টিকেটেই যাবো! কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে না! নিজের কাছে ছোট লাগছে! আচ্ছা আগে যাই তারপর দেখা যাবে! শেষমেশ নিজামের কথাটাই মানতে হচ্ছে!


পরেরদিন,

নিজাম বললো, দোস্ত, চল একটু মার্কেট করে আসি।" "কি মার্কেট?" "বাড়ির সবার জন্য কিছু কিনে না নিয়ে গেল কেমন হয়? খারাপ হয়ে যায় না?" আমিও কথাটা ভেবে দেখলাম। আমারও কিছু নিয়ে যাওয়া উচিৎ। তাই আমিও রাজি হয়ে যাই। বেরিয়ে পরলাম দুই বন্ধু মার্কেটের উদ্দেশ্যে! মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমরা! বসুন্ধরা সিটি, নিউ মার্কেট বা অন্যান্য বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়! তাই ফুটপাত বা গুলিস্তান থেকেই কিনতে হবে!


মোটামুটি কেনাকাটা করলাম। এবার ফেরার পালা। এমন সময় নিজাম বললো, "দোস্ত, আমার প্রেয়সীর জন্য কিছু কিনলাম না তো!" আমার মাথা মুহূর্তেই গরম হয়ে গেল! এমনিতেই রোজার দিন তারসাথে তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে! অনেক মানা করলাম! তারপর বললাম, "তোর খাতিরে তারাবীর নামাজের পরে যাবো!" তবুও নিজাম মানছে না! তারপর অনেক জোড়াজুড়ির পর নিজাম মানলো!


মেসে ফিরে দিলাম এক ঘুম! এক ঘুমেই ৬.১৫তে উঠলাম! তারপরের সময় আর যেতে চায় না। মনে মনে ভাবছিলাম মুয়াজ্জিন তাড়াতাড়ি আযান দিলেই পারে। এদিকে আমার সময় যাচ্ছে না আর নিজাম যে কখন থেকে ফোনের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে কে জানে! এখন সময় পার করার জন্য কিছু করা দরকার। তার আগে বাইরে থেকে ইফতারি কিনে নিয়ে আসি। রোজ রোজ মসজিদে ইফতার করতে ভাল লাগে না। নিজামকে বললাম, "ইফতারি কিনতে যাচ্ছি, টাকা দে।"


মহাশয় তখনও প্রেমেলাপে ব্যস্ত! তাই আবারও বললাম, "টাকা দে!"


উনি ভাব নিয়ে বললো, "আরে কানের কাছে ভ্যা ভ্যা করিস না তো! মানিব্যাগে যা আছে নিয়া যা!"


ওর এই কথা শুনে আমার মনও বাংলা ছবির চৌধুরী সাহেবের মত বলে উঠল, "কি! এতবড় অপমান?" ভাবলাম এর একটা বিহিত করতেই হবে না! ওর মানিব্যাগে একশ টাকার একটা নোট আছে! এই সুযোগে আমি মানিব্যাগ নিয়ে নিজামের সামনে দারিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, "হালা ফয়িন্নির ঘরের ফয়িন্নি! মানিব্যাগে দুইটাকা নিয়া গার্লফ্রেণ্ডের সামনে ভাব মারস? ওই তুই এখনই আমার টাকা ফেরত দে! আমার টাকায় ঈদের বাজার করছোস না? ফেরত দে টাকা!"


নিজাম কোনরকমে ওকে বাই বলে আমার সাথে তর্ক করা শুরু করলো! আমি ছোট্ট করে বললাম, প্রতিশোধ নিলাম মুমুর গানু..." এই বলে একশ টাকা নিয়ে মানিব্যাগ ওর লুঙ্গির মধ্য ঢুকিয়ে দিয়ে আসলাম! সাথে সাথে নিজাম লাফিয়ে উঠলো আর আমি তখনই দরজা খুলে দৌড়!


ইফতারি কিনে মেসে আসলাম, দেখি নিজাম আবার প্রেমালাপ শুরু করছে! আযান হতে আর বিশ মিনিট আছে। আমি ওজু করে ইফতারি মাখানো শুরু করলাম।


ইফতার করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আর সাথে সাথেই নিজাম এসে আমার শার্ট প্যান্ট আমার উপর ছুড়ে দিয়ে বললো, "ওঠ, মার্কেটে যাবো!"


আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম ওর কথায়! বললাম, "ভাই এইমাত্র ইফতার করে নামাজ পড়লাম! একটু রেস্ট নিতে দে, বললাম তো যাবো।" ঘড়ি ধরে ঠিক দশ মিনিটের এক সেকেন্ডও বেশি সময় না দিয়ে টেনে তুললো আমাকে!


"নে দশ মিনিট টাইম দিছি এবার চল!" নিজামের জোড়াজুড়িতে আবার মার্কেটে গেলাম! ওকে মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার মত বিরক্তিকর কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই! পুরো মার্কেট ঘুরে মাত্র একটা ড্রেস চয়েস করে! এখন যেহেতু মেয়েদের ড্রেস কিনবে আল্লাহ জানে কয়টা মার্কেট আজ ঘুরতে হবে!



পাক্কা তিন ঘন্টা এদিক থেকে সেদিক, এ দোকান থেকে সে দোকানে ঘুরাচ্ছে নিজাম! এপর্যন্ত একটা ড্রেসও চয়েস করতে পারে নি! এদিকে আমার পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে! নিজামকে বললাম, "তুই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন একটা দোকানে ঢুকতে পারবি! চয়েস হলে ভাল, না হলে চল...!" নিজাম এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষ দোকানটায় ঢুকলো! কালো রঙের একটা ড্রেস নিজাম চয়েস করলো! আমাকে বললো, "দোস্ত, দেখতো ড্রেসটা কেমন?" দোকানদার বললেন, "ভাইয়া, কার জন্য কিনবেন? গার্লফ্রেণ্ড?" দোকানদারের কথায় আমি আর নিজাম শকড হয়ে গেলাম! দোকানদারকে বললাম, "বাহ ভাই, আপনি তো ভালই ধরতে পারলেন!" উনি বললেন, "ওই ভাই যেভাবে কাপড় দেখছেন তাতেই বুঝতে পারলাম উনি নিশ্চয়ই উনার গার্লফ্রেণ্ডের জন্য কিনবেন!" নিজাম বললো, "হুম ভাই ঠিক বলছেন।" এরপর ড্রেসটা কিনে সেখান থেকে বের হলাম! নিজাম ফুটপাতের দোকান থেকে আমাকে দুইটা হালকা রেক্সিন কিনে দিল! আমি জিজ্ঞেস করলাম রেক্সিন দিয়ে কি করবো! তাও আবার দুই পিস! নিজাম বললো, "কি কাজে লাগবে সেটা ট্রেনেই বুঝবি!"


মেসে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল! অনেকটা ক্লান্ত এখন আমরা! ক্ষুধায় অবস্থা খারাপ! মেসে মাত্র দুইজন আছি! দুঃখিত, আসলে মেস না, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১০-১২ জন মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকি। এর এখন দুইজনের জন্য বুয়া আসতে চায় না! তাই যেদিন বুয়া না আসে সেদিন সময় পেলে খাওয়া দাওয়া নিজেরা রান্না করি না হয় বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি। এক্ষেত্রে আজ খাওয়া হয় নি তাই সেহেরি হোটেল থেকে করবো। ক্ষুধা থেকে বাঁচতে ঘুমিয়ে পড়লাম!


তিনটার সময় ঘুম থেকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে হোটেলে চলে গেলাম। সেহেরি খেয়ে নামাজ পরে আবার ফ্ল্যাটে আসলাম। আজ ভোরে ৬টায় ট্রেন, এখন ঘড়ির কাটা ৫টা ছুই ছুই! হাতে এক ঘন্টা সময় আছে! তাড়াতাড়ি ঈদের কাপড়গুলো আগে ব্যাগে ঢুকালাম। আমার সুবিধা হল সাথে কোন লাগেজ নেই! একটা ক্যাম্পিং ব্যাগ আছে যেটায় অনায়াসে সব কাপড় এটে যায়! তারপর ময়লা জামা কাপড় গুলো ঢুকালাম। ক্যামেরাটা অন্য একটা ছোট ব্যাগে রাখলাম। ইয়ারফোন আর মোবাইলটা সযত্নে পকেটে নিলাম। এই তিনটা বস্তু ব্যতীত আমি ভ্রমণ উপভোগ করতে পারি না! শেষ বারের মত রুমটা ঘুরে দেখলাম কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা! না, প্রয়োজনীয় সবই নিলাম! নিজামেরও সব গোছানো শেষ! তারপর জানালা বন্ধ করে দরজায় তালা লাগিয়ে বের হয়ে গেলাম!


স্টেশনে পৌছে দেখি হাজার হাজার মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে! নিজাম আমার সাথেই আছে। "দোস্ত, কাউন্টারে যা, টিকিট নিয়ে আয়।" নিজামকে অপেক্ষা করতে বলে আমি টিকেটের জন্য গেলাম কিন্তু দীর্ঘলাইন দেখে আর যেতে ইচ্ছা হল না। তাই ফিরে এলাম! নিজাম বললো, "টিকেট নিয়েছিস?" "না, যে লাইন লেগে আছে তাতে টিকেট পেতে আমার বাড়ি পৌঁছানো হবে!"


নিজাম কিছুক্ষণ আমার সাথে ছিল। তারপর বললো, "দোস্ত আমার বাসের সময় হয়ে যাচ্ছে গেলাম, রাজশাহীর যে ট্রেন আগে আসবে তুই সেটাতেই উঠিস! আল্লাহ হাফেজ!" নিজামকে জোর করলাম না। তারপর ও চলে গেল! এখন একাই আছি। কোথাও তিল পরিমাণ বসার জায়গা নেই! এরমধ্যেই হাটাচলা শুরু করলাম! ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার জানামতে এখন ধূমকেতু এক্সপ্রেসের আসার কথা কিন্তু ট্রেনের নাম গন্ধও পাচ্ছি না! এত এত মানুষের মাঝেও আমার সময় যাচ্ছে না!


রাজশাহীর ট্রেনের খোজ নিলাম। ৬টার সময় ধূমকেতু এক্সপ্রেস আসার কথা কিন্তু ট্রেন ৫ঘন্টা লেট! নিজামকে কল করে বললাম, "তুই কি বাসে উঠছিস?" সে বললো, "বাস এখনও আসে নি!" ঘরমুখো সব মানুষই এখন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে! সময় যাচ্ছে না! তাই আমি মোবাইল বের করে ফেসবুকিং শুরু করলাম!


১১টার দিকে ট্রেনের আওয়াজ পেলাম! ফোন পকেটে রেখে প্লাটফর্মে আসলাম! দুর থেকে ট্রেন বুঝা মুশকিল! ট্রেন প্লাটফর্মে থাকা মাত্রই লোকজন হুমড়ি খেয়ে পরে! মুহূর্তেই ট্রেনের ভিতরে ভর্তি হয়ে গেল! আমি ট্রেনে ওঠার আগে ট্রেনের নামটা দেখে নিলাম! ঢাকা-রাজশাহী পদ্মা/সিল্কসিটি/ধূমকেতু! বুঝলাম আমি সঠিক ট্রেনই পেলাম! এবার ভিতরে ঢুকবো কিন্তু মানুষের ভিড় দেখে ভিতরে উঠতে চাচ্ছিলাম না। দেখলাম কিছু মানুষ মই নিয়ে যাত্রীদের ছাদে উঠাচ্ছে! বিনিময়ে দশটাকা করে নিচ্ছে! আমি দশটাকা ব্যয়ে ট্রেনের ছাদে উঠলাম! উপর থেকে দৃশ্যগুলো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে! তারপর দুই কোচের সংযোগস্থল থেকে কিছুটা দুরে বসলাম! এমন সময় দুইটা মেয়ের গলার আওয়াজ শুনলাম! তারা এই ট্রেনে যাবে না! কারণ ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড়! উনি বুঝতে পারছেন না সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষও বাড়বে! তারপর আমি একটু সাহস নিয়ে বললাম, "এক্সকিউজ মি প্লিজ! আপনি এখন না গেলে পরের ট্রেন গুলোতে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা পাবেন না!" মেয়েটা অনেকক্ষণ ভাবলো! অন্যজনকে বললো, "দোস্ত তুই এই ট্রেনেই যা। দেখ মানুষ জীবনের ঝুকি নিয়ে কেমন করে ট্রেনের ছাদে যাচ্ছে শুধু প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতে! তুই এটাতেই যা, আল্লাহ ভরসা।" মেয়েটা অনেকক্ষণ ভেবে এই ট্রেনেই যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়! তারপর দরজা দিয়ে ট্রেনে উঠল! কিছুক্ষণপর আবার নেমে গেল! তার বান্ধবী বললো, "কিরে তুই নামলি কেন?" "ভিতরের লোকগুলো................!" তার বান্ধবী বিরক্তের সুরে বললো, "তোকে নিয়ে আর পারা গেল না!" "এতে আমার কি দোষ?" "ট্রেনের ছাদে যেতে পারবি?" বান্ধবীর এমন কথায় সে চিৎকার দিয়ে উঠল আর আমি থমকে গেলাম! সে বললো, "ট্রেনের ছাদে যাবো? মাথা খারাপ? পরে গেল কি হবে?" আমি শুধু চাচ্ছিলাম সে যেন আমার পাশেই বসে! এদিকে দুই বান্ধবী তর্ক-বিতর্ক করেই যাচ্ছে! আমি বললাম, "এক্সকিউজ মি প্লিজ, এভাবে সিদ্ধান্ত নিতে থাকলে আপনার বাড়ি ফেরা হবে না, রাস্তায় ঈদ করতে হবে! আপনি ছাদেই উঠুন, দেখুন চারদিকে আপনার মত কত মেয়ে ট্রেনের ছাদে উঠেছে!" মেয়েটা আমার কথায় কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে! করারই কথা। অচেনা একটা ছেলে তাকে এভাবে ছাদে উঠতে বলবে কেন? তারপর দুইজন অনেক ভাবলো। অতঃপর মেয়েটা ছাদে যাওয়ার জন্য রাজি হল! আমি একজন মইওয়ালাকে ডাকলাম। মেয়েটি মই দিয়ে ট্রেনের ছাদে এমনভাবে উঠছে যেন এভারেস্টে উঠছে! ট্রেনের ছাদে উঠে দারানোর পর তার হাত পা কাঁপতে লাগলো! আমি তাকে সাবধানে বসতে বললাম। সে ভয়ে ভয়ে সিনেমার স্লো মোশন স্পিডে বসতে যাবে তখনই বললো, "ইয়াক! কি ময়লা! আমি এখানে বসবো না!" মেয়েটার কথা শুনে এত রাগ হচ্ছে যে ইচ্ছা করছিল ট্রেনের ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই! মেয়েটির বান্ধবী তখনও স্টেশনে ছিল। বান্ধবীকে বললো, "এখানে অনেক ময়লা! মুছতে হবে!" ওর কথায় আমি শুধু আমার কপাল টিপছিলাম! ওর বান্ধবী দেখি খুব বুদ্ধিমতী! একটা পত্রিকা আর ম্যাগাজিন কিনে তাকে দিল আর বললো, "পত্রিকা তুই পড়িস না আমি জানি। তাই পত্রিকা দিলাম। পৃষ্ঠা ছিড়ে বসে পর! আর ম্যাগাজিন পড়ে সময় পার কর!" মেয়েটা তাই করলো! পরে মইওয়ালাকে বললাম ব্যাগগুলো উপরে তুলে দেন। মইওয়ালা ব্যাগপত্র উপরে তুলে দিলেন। এরপর মেয়েটি ওর বান্ধবীকে বিদায় দিল।


একটা প্রবল হর্ণ ছেড়ে ট্রেন চলা শুরু করলো! আস্তে আস্তে চলতে আরম্ভ করলো! হএলে দুলে আরামপ্রিয় মানুষের মত করে চলছে ট্রেন! তখন থেকে এপর্যন্ত মেয়েটার সাথে কথা বলি নি। তাকিয়ে দেখলাম উনি কানে ইয়ারফোন গুজে দিয়েছেন! আমিও ইয়ারফোন গুজে নিলাম! গান চলছে, "স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার....!" মনে কেমন যেন ঈদ ঈদ আমেজ চলে এসেছে! কত ঝুকির মাঝেও
মানুষ শুধু আপনজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য! এই ট্রেনের সকল মানুষ ঈদ অনুভব করছে! আপন মনে গান শুনছি, হঠাৎ মেয়েটি আমাকে ডাকলো!

"এক্সকিউজ মি!"

"জ্বি....."

"আপনি কি রাজশাহী যাবেন?"

"হুম..."

"আমিও যাবো, কতক্ষণ লাগতে পারে?"

"প্রায় ছয় সাত ঘন্টা লাগবে।"


কথা শেষ করে আবার কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম! ট্রেনের গতি এখন বেরেই চলছে! আমার একটা অভ্যাস আছে যে আমি যদি বাসে বা ট্রেনে জার্নি করি তবে তার গতি রেকর্ড করি! এখনও তাই করলাম! দেখলাম ট্রেনের গতি ৪০কি.মি! মাত্র চল্লিশ কিলো গতি নিমেষেই কেড়ে নিতে পারে শত শত প্রাণ! নাহ নেগেটিভ ভাবলে চলবে না! বি পজিটিভ! পাশের মেয়েটির দিকে তাকালাম! সে একনাগাড়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আছে! আর আমি তার চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম! অপূর্ব সুন্দর চোখ তার! দেখলাম তার চোখ কিছু একটা খুজছে! খুব জানতে ইচ্ছা করছে কি খুঁজছে তার চোখ! সংকোচ না করে বললাম, "আ... আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?" তিনি সরল মনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। "আচ্ছা আপনি এতদেরি করে গ্রামে যাচ্ছেন কেন? আপনি কি চাকরিজীবী?"


"না আমি স্টুডেন্ট।" তারপর বললাম, "কোথায় পড়ালেখা করেন আপনি?" "ব্যুয়েটে.......!"


মেয়েটির মুখ থেকে ব্যুয়েট নামটা শুনে আমার ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল! এখানে পড়তে পারিনি বলে আমার প্রেয়সী আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল! মামারা আব্বু আম্মুকে যা ইচ্ছা তাই বলেছিল! মানুষের জীবনে কি ব্যুয়েট মেডিকেলই সব?


"ব্যুয়েটে পড়ালেখা করছেন কিন্তু এত দেরিতে গ্রামে যাচ্ছেন কেন?"


"এমনি......!"

সে ছোট করে শব্দটা বললেও আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি কিছু একটা হয়েছে! জানার খুব আগ্রহ হল কিন্তু এটা অনধিকার চর্চা হবে তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। এরপর চুপ হয়ে গেলাম! তারপর মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কি করেন?" আমি সহজ উত্তর দিলাম চাকরি করি। " কত বছর হচ্ছে?" "বেশি না, দুই মাস।" উত্তর দেয়ার পর মেয়েটি আবারও চুপ হয়ে গেল! আমি আবারও বললাম, "আপনার নামটা জানতে পারি?" সে বললো, "মীম...। আপনার?" "আমি সাব্বির।" এরপর তার সাথে অনেকটা কথা হল! দেখতে দেখতে ট্রেন জয়দেবপুর পৌঁছালো! আমার পাশে এক দম্পতি উঠল এবং তাদের কোলে ছোট্ট সন্তানও রয়েছে! বয়স প্রায় চার পাঁচ মাস হবে! আমি তাদের সাহস দেখে হতবাক হয়ে গেলাম! তাদের দেখে ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে কিন্তু ছোট বাচ্চা নিয়ে এভাবে ঝুকি নিয়ে ট্রেনে উঠার কি দরকার? আমি মীমকে বললাম, "দেখেছেন ওই দম্পতিকে? কত ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠেছেন?" মীম এতক্ষণ খেয়াল করে নি! তাদের দেখে মহিলাটিকে বললো, "আচ্ছা আপনারা এই ছোট বাচ্চা নিয়ে কিভাবে ট্রেনের ছাদে উঠলেন?" উনি বললেন, "গ্রামে মা বাবা আছেন, তাদের সাথে ঈদ করতে যাচ্ছি। বাসের টিকেট ছিল কিন্তু রাস্তার জ্যামের কারণে ধরতে পারি নি! ঈদের সময় বলে কোন বাস এমনকি ট্রাকও ফাকা ছিল না! তাই এভাবে ঝুকি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!" আমি বললাম, "যদি আপনার বাচ্চার ক্ষুধা লাগে তখন আপনারা কি করবেন?" আমার এমন প্রশ্নে তারা বিচলিত হলেন! লোকটা বললেন, "ফিডার নিয়ে এসেছি!" এরপর আর কথা বাড়ালাম না। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি বিশাল এলাকা জুড়ে কালো মেঘের সৃষ্টি হয়েছে! আমি বৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরলাম! যদি আমি ভিজে গেলে কোন সমস্যা হবে না কিন্তু আমার ব্যাগের ক্ষতি হয়ে যাবে! ব্যাগের কথা মনে করতেই নিজামের কথা মনে পরলো! রেক্সিন........! নিজামের মাথায় আসলে অনেক বুদ্ধি! এপর্যন্ত নিজামের কোন খবর নেই নি! সাথে সাথে কল দিলাম! বললো সে বাসে উঠেছে এখন টাঙ্গাইলের প্রচণ্ড জ্যামে আছে!



আকাশের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে! দুর সীমানার অনেকটা এলাকা জুড়ে ঘোলাটে হয়ে আছে! অর্থাৎ সেসব এলাকায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে! হাতে সর্বোচ্চ দুই মিনিট সময় আছে রেক্সিন বের করতে! মীমের দিকে তাকিয়ে দেখি সে ছাতা বের করছে! ট্রেনের দুরন্ত গতিতে যে বাতাস লাগবে সেটা ছাতা সহ্য করতে পারবে না! তাই তাকে ছাতা বের করতে মানা করলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকালে আমি ভয় পেয়ে যাই আর মীম ভয়ে আমার হাতটা শক্তি করে চেপে ধরে! ওর কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল! সে লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে নিল আর আমি লজ্জায় অন্যদিকে তাকালাম! সেই দম্পতির দিকে চোখ গেল! তারা খুব চিন্তিত হয়ে আছেন! বিশেষকরে তাদের সন্তানের জন্য! আমি একটা রেক্সিন আমার কাছে রেখে আরেকটা তাদের দিয়ে বললাম, "যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমার এই রেক্সিনটা নিন, আপনার সন্তান বৃষ্টি থেকে নিরাপদ থাকবে!" রেক্সিনটা পেয়ে তারা খুবই খুশি হল! সাথে সাথে রেক্সিনটা খুলে তারা গুটিসুটি মেরে রেক্সিনের সাথে এটে গেল! তাদের এই দৃশ্য আমাকে ভালবাসার আবেগে ভরে দিল! আমি রেক্সিন খুলে মীমের কাছে অর্ধেক দিলাম! ওর ব্যাগপত্র গুলা আমার পিছনে রাখলাম যাতে বৃষ্টি কম লাগে! এরপর অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হল! দেখলাম মীম ওর জুতা খুলে পা দুটো মেলে দিল! আমি অবাক হয়ে ওর নিষ্পাপ বৃষ্টিভেজা মুখ দেখছিলাম! তখন সে জানেন বললো, "জানেন আমার মনে হচ্ছে আমি সমুদ্রে বা পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছি!" ওর কথায় আমার জ্ঞান ফেরে! আমি শুধু মাথা নাড়াচ্ছিলাম! যমুনা সেতুর ওপরে ট্রেন যাওয়ার সময় মীমের সাথে অনেকবার চোখাচোখি হল! সেও লজ্জা পাচ্ছে আমিও লজ্জা পাচ্ছি!


সলপ স্টেশনে ট্রেন থামলো! সাধারণত ইন্টারসিটির কোন ট্রেন এই স্টেশনে ব্রেক দেয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে ক্রসিং এর ফলে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত স্টেশনে থাকতে হয়! এদিকে বৃষ্টি এখনও থামে নি! আশেপাশের লোকজন আমার ও মীম এবং ওই দম্পতিদের দিকে তাকিয়ে আছে! কিন্তু আমরা কেউ সেদিকে নজর দিলাম না! মীমকে বললাম, "আচ্ছা আপনার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?" মীম কিছুই বললো না। কারণ একথা গুলো খুবই পারসোনাল। খুব কম মানুষই তাদের বিএফ জিএফ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে চায় না। "হুম, আমি একজনকে ভালবাসতাম! ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরও তার জন্যেই আমি ঢাকা ছিলাম! দিনযত সামনে যায় ভালবাসা ততই পিছনে মুড়ে থাকে!" তাকিয়ে দেখি ওর মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে! তাই বললাম, "সরি আমি আসলে...... মানে সরি, আর বলতে হবে না!" কিন্তু সে আমার কথা জানতে চাইলো না! হয়তো ছেলেটির কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছে!


সামনে চাটমোহর স্টেশন! এদিকে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে! ট্রেনের ছাদের যাত্রীর সংখ্যা কমে গিয়েছে! সেই লোকটি আমার রেক্সিন ফেরত দিয়ে বললো, "ভাই আজ অনেক বড় একটা উপকার করলেন! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। চিরকাল আপনার কথা মনে থাকবে, আর আপনাদের জীবন সুখি হোক!" লোকটির কথায় মীম লজ্জা পেল আর আমি একটু কেশে উঠলাম! "না ভাই আমরা অপরিচিত, এই ট্রেনেই পরিচয় হল!" "ওহ আচ্ছা, সেই একই কথা! যাই হোক সামনে চাটমোহর স্টেশন! চলুন স্টেশনে নেমে ট্রেনের ভিতরে বসি।" আমিও রাজি হলাম।


ট্রেনের ভিতরে বেশ কিছু সিট ফাকা আছে! আমরা দুইজন সামনাসামনি বসলাম আর উনারা দুইজন পাশাপাশি বসলো! মীম চুপ করে আছে! ভিতরে এসে কিছু বলছে না। একদমই চুপ মেরে আছে। আমি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম! কিছুক্ষণপর চোখ খুলে দেখি মীমও ঘুমিয়ে পরেছে! মুখটা খুব মায়াবী ওর! বাতাসে চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে! আমি ক্যামেরা বের করে খুব জলদি ওর ঘুমন্ত মায়াবী মুখের ছবি তুলে নিলাম! জানি কাজটা ভাল হবে না তবুও রাখলাম। এই পাঁচ ঘন্টার যাত্রায় আমি তাকে অল্প অল্প করে মনের ভিতরে স্থান দিয়ে আসছি! জানতাম না যে দ্বিতীয় কোন মেয়েকে আমি কখনও নিজের মনে ঠাই দিতে পারবো কিনা! তবে আজ মনে হচ্ছে পারবো! এরপরের দেড় ঘন্টা আমি শুধু ওর কথা ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিয়েছি! দেখতে দেখতে ট্রেন রাজশাহী স্টেশনের কাছাকাছি চলে এল। মীম এখনও ঘুমাচ্ছে! সেই দম্পতি আমার পাশেই ছিলেন! লোকটাকে বললাম, "ভাই ভাবীকে একটু বলেন মীমকে ডেকে দিতে। আমরা রাজশাহীর কাছাকাছি চলে এসেছি!" আমি তার সন্তানকে কোলে নিলাম আর তার স্ত্রী মীমকে ডেকে তুললেন।


ট্রেন থেকে নেমে মীমকে বললাম, "যদি কিছু মনে না করেন আমি কি আপনার ফেসবুক আইডির নামটা জানতে পারি?" মীম আমাকে আইডির নাম বললো, আমিও আমারটা বললাম। স্টেশন থেকে আলাদা হবার আগে তাকে বললাম, "আবেগে কোন কাজ করতে যাবেন না, যা করবেন বুঝে করবেন!" এরপর সে চলে গেল! আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই দম্পতিও চলে গেল! আমিও স্টেশন থেকে রিক্সায় উঠলাম! ক্যামেরার ব্যাগের চেনের সাথে একটা ছোট কাগজ! খুলে দেখি মীমের নাম্বার লেখা সাথে ওর সিগনেচার! মনটা হঠাৎই আরও খুশি হয়ে গেল! মনে মনে নিজাম আর সেই দম্পতিকে ধন্যবাদ জানালাম! ছোট পরিচয় থেকেই না হয় কাছে আসার গল্প শুরু হোক!


লেখা: দর্পণের প্রতিবিম্ব

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৩

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: নায়িকার কি আর নাম পাইলেন না? মিম কেন? আমার এক্সগার্লফ্রেন্ডের নাম| এবং কুরবানি ইদের পরদিন ব্রেকাপ হয়েছে| ছোঁ, মনে করায় দিলেন ওর কথা
যাই হোক, লেখাটা জমজমাট

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.