নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রেমিকার চিরশত্রু
মেয়েটার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পরীর মত মেয়েটা এখানে কি করে এল বুঝতে পারছি না। একাজ শুধুমাত্র একজন চরিত্রহীন মনের দ্বারাই সম্ভব। ছোট্ট একটা রুম আর এলোমেলো চাদরের বিছানায় আমি বসে আছি! মেয়েটাকে বললাম, "আপনি এদিকে আসুন।" শুদ্ধ আর ভদ্র ভাষার কথা শুনে সে চমকে গেল! হয়তো এর আগে যারা এসেছিল তারা কেউ এই মেয়েটার সাথে ভাল করে কথা বলে নি! এরপর ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখলাম ওর হাত পা কাপছে! কপাল আর গলা দিয়ে ঘাম জমেছে! বুঝলাম আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না! বিশ্বাস না করারই কথা। কারণ এখানে সবাই অবিশ্বাসই উপহার দিয়ে যায়! তারপর তার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আপনি ঘাবড়াবেন না, আমি কিছুই করবো না, শুধু আপনার জীবনের গল্পটা শুনে এখান থেকে আপনাকে নিয়ে যাবো।" কথাটা শুনে মেয়েটা কেঁদে উঠলো! "আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন আর আমি এমন জঘন্য কাজ কখনও করি না। তবে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ একজন খুব বিপদে আছে। তাই ভিতরে আসলাম, ভাবিনি যে আমার মনের সন্দেহ সত্য হবে!" এরপর মেয়েটা ধীর পায়ে আমার সামনে আসলো। আমি তাকে বসতে বললাম আর আমি একটু দুরে সরে গেলাম।
-আপনার নাম কি?
-রাহা
মেয়েটার কণ্ঠ খুব সুন্দর! একবার শুনলে বারবার শুনতে ইচ্ছা হয়!
-আপনার বাসা কোথায়?
-খুলনায়।
-তো এখানে কি করে এলেন? কে নিয়ে এসেছে?
রাহার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হচ্ছে না! আবারও মেয়েটার চোখ পানিতে ভরে যাচ্ছে! কিছু বলার আগেই রাহা কেঁদে ফেললো!
-প্লিজ, কাঁদবেন না, আপনি ঘটনা না বললে এখান থেকে বের হতে পারবো না।
-রিয়াজ নামের এক ছেলেকে আমি ভালবাসতাম, আমার জীবনের চেয়েও বেশি! অনেক বিশ্বাস ছিল ওর উপর। আমাদের পরিচয় হয় ফেসবুকে। প্রথমে অল্প অল্প চ্যাট করতাম। তারপর ধীরে ধীরে চ্যাটিং এর মাত্রা বেড়ে যায়! আর আমি পড়ালেখা করতাম খুলনার এক সরকারি কলেজে। ইন্টার পড়ার সময় ফেসবুকের মাধ্যমে রিয়াজের সাথে পরিচয় হয়। সে আমাকে তার সম্পর্কে জানালো। কি করে, কোথায় থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও তাকে আমার সম্পর্কে জানাই। সে বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে পরে। যখন যা চাইতো তাই পেতো! বাবার শাসনবিহীন আদরে সে নষ্ট হয়ে গিয়েছে! আর আমি এক মধ্যবিত্ত সুখি পরিবারের বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আর ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন! যার জীবনে কোন চাহিদা ছিল না, দুঃখ ছিল না! শুধু লক্ষ্য ছিল সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করা। তাই আমি চেষ্টা করতাম যাতে রিয়াজ যেন ভাল মানুষের মত চলে। কিন্তু আমার কোন চেষ্টাই সফল হয় নি! এরকম করতে করতে দেড় বছর পার হয়ে গেল। এরপর দেখা করার জন্য বলে! প্রথমে আমি রাজি হই নি। পরে বান্ধবীদের জোরে আর রিয়াজের কথায় রাজি হয়ে যাই। এরপর দেখা করি! ততদিন পর্যন্ত বাসার কেউ জানতো না রিয়াজের সম্পর্কে! আমি রিয়াজকে বন্ধু ছাড়া বেশি কিছু ভাবতাম না। তাই বাসায় বলার প্রয়োজন মনে করি নি! এরপর ফোন নাম্বার আদান প্রদান হয়। টুকটাক কথা চলতো প্রথমে। তারপর সময়ের সাথে সাথে সেটা বেড়ে যায়। একদিন পার্কে দেখা করতে বললো! আমিও গেলাম দেখা করতে। ইনিয়ে বিনিয়ে আমতা আমতা করে কথা বলতে লাগলো! আমি বুঝতে পারলাম ও কি বলতে চায় কিন্তু এটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরপর ভালবাসার কথা বললো! কিন্তু আমি না করে দেই। এতে রিয়াজ রেগে যায়! বিভিন্নভাবে আবেগের কথা বললো! কিন্তু কোনকিছুতেই আমার ওর প্রতি ভালবাসা জন্মালো না! এরপর রোজ আমি যে রাস্তা দিয়ে প্রাইভেট বা কলেজে যেতাম সেখানেই রিয়াজ দারিয়ে থাকতো! রোজ আমার পিছু নিত! বারবার ভালবাসার কথা বলতো, হাত ধরার চেষ্টা করতো! এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে যাই ওর এসব আচরণে! যার ফলে একদিন সমস্ত শক্তি দিয়ে ওর গালে চড় দেই! চড় দেয়ার পর আমার হাতটা কাঁপতে লাগলো! হয়তো এটা করা উচিৎ ছিল না। রিয়াজ একটু সময়ের জন্য আমার সামনে আর দারায় নি! কোন কথা না বলে চলে গেল! এরপরের দিনগুলোতে ওকে আর দেখতে পাই নি। ওকে চড় মারার পর থেকে আমি রাতে আর ঘুমাতে পারি নি! বারবার ওর কথা মনে পরেছিল! এমনটা না করলেই পারতাম আমি কিন্তু খুব বিরক্তবোধ করছিলাম আমি। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমি ওকে আর দেখতে পাই নি! খুব মিস করতে থাকি রিয়াজকে! সেই কয়েকদিন আমাকে আর কলও দেয় নি! মনে মনে খুব ভয় পেয়ে যাই! রিয়াজ নিজের কোনো ক্ষতি করে বসলো নাতো! এসব কথা ভাবতে মনে হল হয়তো রিয়াজকে ভালবেসে ফেলেছি! তারপর চোখ বন্ধ করলাম। সাথে সাথেই রিয়াজের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো! বুঝতে পারলাম রিয়াজকে ভালবেসেছি! তারপর রিয়াজকে কল করলাম। তিনবার কল করার পর সে রিসিভ করলো! ওর মুখ থেকে হ্যালো শব্দটা শোনার পর মনে কেমন যেন একপ্রকার প্রশান্তি ফিরে পেলাম! তারপর সরি বললাম। ঘন্টার চেয়ে বেশি কথা বলার পর কল কেটে দেয়ার আগে আমি ওকে ভালবাসি শব্দটা বলে দেই আর সাথে সাথে কল রেখে দেই! তারপর সেই রাতে অনেকবার কল করলো কিন্তু আমি ধরি নি!
-বাহ! বেশ চমৎকার প্রেমকাহিনী আপনাদের! তারপর?
-আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ওকে ভালবাসা।
-কেন?
-কারণ রিয়াজ ভালবাসা অপবিত্র করা শুরু করে। এমন কোন রাত নেই যে রিয়াজ আমাকে কল দিয়ে কুপ্রস্তাব দিত না! কিন্তু আমি কোন কথা বলতাম না। সবসময় বলতাম যদি আমাদের বিয়ে হয় তাহলে এসব হবে তাছাড়া না। এরপর রিয়াজের ফোন তেমন রিসিভ করতাম না। এতে রিয়াজ আরও রেগে যায়! এরপর আমার ইন্টার পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা গুলা মোটামুটি ভালোই চলছিল। ফিজিক্স পরীক্ষা থেকে বিপদ শুরু হতে লাগলো!
-আজকের জন্য এতটুকুই থাক। বাকিটা আগামীকাল রাতে এসে শুনবো।
-আপনার বাসা কোথায়?
-আমিও খুলনার।
রাহার কথা শুনে বুঝতে পারলাম রিয়াজের কারণে আজ সে এখানে। এখানের সর্দারনীকে তিন হাজার টাকা দিয়ে রাহাকে কাল পুরো দিনের জন্য আমার করে রেখেছি! সর্দারনীকে বললাম, "এতগুলা টাকা পেলে কিন্তু আমি বাদে নতুন মালডারে যদি অন্য কেউ পায় তাহলে তোমার এই ব্যবসা লাটে পাঠাবো!" সর্দারনীকে এভাবে না বললে সে হয়তো রাহাকে ব্যবহার করতো!
আমি কয়েকমাস আগে পত্রিকায় পরেছিলাম একটা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। আর সেই মেয়েটি হল রাহা! আসলে প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়ে যখন নিখোঁজ হয় তখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় এসব পল্লীতে। আর এখানে স্থান পাওয়ার মুল কারণই হল প্রেমিককে অন্ধ বিশ্বাস করে তার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া! পরে এরা যখন বড় শহর যেমন ঢাকা, চট্টগ্রামে যায় তখন প্রেমিক সেই মেয়েকে ফাঁদে ফেলে এসব পল্লীতে মোটা অংকের টাকা অর্জন করে বিক্রি করে দেয়। এবং পরবর্তীতে মেয়ের মা বাবাকে শুনতে হয় স্বপ্নে না শোনা সব কথা! এখন আমার মুল লক্ষ্য হল রাহাকে তার বাসায় পৌছে দেয়া।
রাতে রাহার চিন্তায় ঠিকমত ঘুমাতে পারি নি। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কিভাবে ওকে নিয়ে এ শহর ত্যাগ করব! মনে মনে অনেক প্লান তৈরি করলাম। পরিকল্পনার প্রথমে যে কাজ করবো সেটা হল কাল রাতের শেষ ট্রিপের বাসের টিকেট কাটতে হবে। ওখান থেকে ফেরার সময় বুথ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছি। আর কাল রাতের জন্য সতর্কতার খাতিরে সাধারণ বাসের টিকেট হলে চলবে না তাই সকালে আগে কল্যাণপুর গিয়ে গ্রীণ লাইন এর দুটো টিকেট নিলাম! এরপর বাজারে গেলাম। ট্রেইলার্সের দোকান থেকে একটা কালো কাপড়ের ওপর বিভিন্ন ডিজাইন দেয়া রেডিমেড বোরকা কিনে নিলাম! রাহার ফিট হবে কিনা জানি না তবে বোরকাটায় ওকে খুব সুন্দর মানাবে এবং আমি কল্পনায় ভেবে নিয়েছি কেমন লাগবে ওকে। তারপর একটা স্কার্ফ কিনলাম। এতকিছু করতে করতে বিকেল হয়ে গেল! তারপর মেসে গিয়ে সমস্ত আসবাবপত্র ভ্যান করে কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে পাঠিয়ে দিলাম! যেখানে চাকরি করতাম সেখান থেকে খুলনায় ট্রান্সফার করে দিয়েছে! হাতে দুইদিন আছে কিন্তু এটা আমি রাহার পিছনে ব্যয় করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি! সকাল থেকে এপর্যন্ত মুখে কিছুই যায় নি! তাই রাহার কাছে যাওয়ার আগে হোটেল থেকে খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম। এরপর বন্ধু শরীফকে ফোন দিয়ে বললাম সাড়ে দশটার ভিতরে ওদের বাসায় যাবো রাহাকে নিয়ে! শরীফ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। গতমাসে বিয়ে করেছে। ওকে আর ভাবীকে সবকিছু আগেই বলে রেখেছিলাম। তারপর গেলাম রাহার কাছে। মেয়েটা অনেকক্ষণ হল আমার অপেক্ষায় আছে। আমি দরজায় টোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। আমাকে দেখে রাহা চমকে উঠে বললো,
-আমি ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আসবেন না!
-সে কি করে হয়? কথা যখন দিয়েছি তখন সেটা রাখবোই।
-আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
-বলেন...
-আচ্ছা আমি আপনার পরিচিতা না, কখনও কেউ কাউকে দেখি নি! তবে একটা অপরিচিতা মেয়ের জন্য আপনি কেন এত কষ্ট করছেন?
রাহার এমন প্রশ্নে আমি একদমই চুপ হয়ে গেলাম! আসলেই তো কেন আমি এই অপরিচিতা মেয়ের জন্য এত কিছু করছি? মনে মনে বললাম, "এই যদি বুঝতেন তাহলে রিয়াজকে ভালবাসতেন না!!" তারপর বললাম,
-আচ্ছা আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
-জ্বী করুন...
-আপনিও আমাকে চেনেন না তবুও কেন আমার অপেক্ষায় ছিলেন?
রাহা মৃদু হেসে বললো, "আপনার ভিতরে একটা ভাল মানুষ দেখতে পেয়েছি যাকে আমি এখন বিশ্বাস করতে পেরেছি! তাই আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।"
ওর কথা শুনে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না! কারণ আমার মুখ থেকে ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল! তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, "আচ্ছা আপনি রিয়াজের কাহিনীটা শুরু করুন।"
-ফিজিক্স পরীক্ষার পর থেকে জীবনে নেমে আসে অন্ধকার! একেরপর এক খারাপ হতে থাকে পরীক্ষা! পরিবারকে এসব কিছুই জানাই নি! পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঢাকায় কোচিং করার জেদ করি। আব্বু আম্মু প্রথমে রাজি ছিলেন না। তারা বলেছিলেন যে পড়ালেখা নিজের মধ্যে, কোচিং করে কোন লাভ হবে না। আমি তাদের কথা শুনি নি। পরে আমাকে ঢাকার কোচিং এ আর হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দেয়! এরপর কোচিং করতে থাকি। কিন্তু এত ছাত্রছাত্রীর ভিরে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সেসময় রিয়াজ ঢাকায় থাকতো! যেদিন কোচিং থাকতো না সেদিন আমি ওর সাথে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দিতাম! এতে ভার্সিটি এক্সামের প্রস্তুতিও নষ্ট হয়ে যায়! তারপর মনের মধ্যে এক প্রকার অনুশোচনার সৃষ্টি হয়! মাঝে মাঝে ভাবতে থাকি আমি কেমন ছিলাম আর কেমন হয়ে গেলাম! এরপর ইন্টার পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়। রেজাল্ট খুব খারাপ আসে! বাসা থেকে অনেক কথা শোনা লাগে! মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পরি! এরপর ঢাবি ও জবি তে পরীক্ষা দেই। শেষ পরীক্ষার দিন ছিল আমার জন্মদিন। সেদিন রিয়াজকে আমি দেখা করতে বলি। তারপর সে আসে। আমাকে বলে আমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে কিন্তু আমাকে সেটা দেখতে তারসাথে যেতে হবে! প্রথমে না করি কিন্তু রিয়াজের জোড়াজুড়িতে যেতে বাধ্য হই! রিয়াজ তার বন্ধুর ফ্লাটে নিয়ে যায়! সেখানে গিয়ে আমি যে সারপ্রাইজটা দেখলাম সেটা আমি কখনও ভাবি নি।
বলতে বলতে রাহা আবারও কেঁদে উঠলো! আমি চুপ করে আছি। বুঝতে পেরেছি রিয়াজ কি করেছিল সেখানে! তাই আমি এর পরের ঘটনা জানতে চাই নি।
-আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আসলে আপনার পুরনো দিনের কষ্ট ফেরত দিতে চাই নি।
রাহা কেঁদে বললো, "আমারই সব ভুল ছিল! মা বাবার কথা শুনলে এইদিন হয়তো দেখতে হতো না।"
-আচ্ছা আপনি এখানে কি করে এলেন?
-রিয়াজ সেদিন বলছিল, "তুই থাপ্পড় মারছিলি তাই না, আজ দেখবি তোর কি হাল করি!" প্রতিটা বাক্য শেষ হবার সাথে সাথে একটা চড় মারছিল রিয়াজ! আমি শুধু ভাবছিলাম কাকে ভালবেসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম! এরপর জোর করে আমার মুখটা একটা কালো ওড়না দিয়ে পেঁচানো হয়! শুধু চোখটা খোলা রাখা হয় যাতে কেউ সন্দেহ না করে! তারপর একটা কালো বোরকা পড়ানো হয়। ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার সময় আমি চিৎকার করার খুব চেষ্টা করি! কিন্তু আমার কোনো চেষ্টাই কাজে লাগলো না! এরপর একটা প্রাইভেট কারে নিয়ে আমাকে এখানে রেখে যায়! আমি যাতে পথ চিনতে না পারি সেজন্য গাড়িতে আমার চোখে কাপড় দিয়ে পেঁচানো হয়! আমি রিয়াজকে অনেক অনুরোধ করলাম, পায়ে ধরলাম তবুও ওর মনটা একটুও গললো না! আমার কাছে কিছু টাকা আর একটা মোবাইল, একটা স্বর্ণের চেন আর আম্মুর দেয়া একটা আঙটি ছিল, সেগুলা সব রিয়াজ নিয়েছে!
আমি চুপ করে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। তারপর তাকে বললাম,
-চলেন আজ আপনাকে নিয়ে এই শহর ত্যাগ করবো! আমি সর্দারনীর সাথে কথা বলে আসি।
সে মৃদু হেসে বললো, আপনি কেন আমার জন্য এত কিছু করছেন?"
"আপনি বুঝবেন না!"
সর্দারনীর সাথে কথা বলে রাহাকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আশেপাশের অনেকেই আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলো! আমি তাড়াতাড়ি একটা সি.এন.জি নিয়ে শরীফের বাসায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে রাহাকে ফ্রেস হতে বললাম। তারপর ভাবিকে রাহার জন্য কেনা বোরকাটা দিয়ে বললাম, "সে যেন জানে না যে এটা আমি কিনেছি।" ভাবি রাহাকে তার একটা থ্রি-পিস পরিয়ে একেবারে ফিটফাট করে দিল! বোরকাটা রাহার একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছে! তবুও রাহাকে দেখতে খুব ভাল লাগছে।
রাত সোয়া এগারোটার দিকে শরীফের বাসা থেকে বের হয়ে যাই। একটা রিক্সা নিয়ে গাবতলীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শরীফের বাসা থেকে গাবতলী বেশি দুরের রাস্তা না। রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছি আমরা। রাহার দিকে তাকিয়ে দেখি সে মাথা নিচু করে আছে!
-মাথা নিচু করে আছেন যে?
-আব্বু আম্মুকে দেখতে পাবো কিনা সেজন্য!!
-এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন নি?
-ঠিক তা না।
-তো?
-আচ্ছা আপনি আমাকে যে উপকার গুলো করেছেন সেগুলো আমি ফেরত দেব কিভাবে?
-ফেরত দিতে হবে না, উপকারের কথা মনে রাখলেই চলবে। আমি এতেই খুশি থাকবো।
কাউন্টারে বসে আছি। বাস আসতে এখনও বিশ মিনিটের মত বাকি আছে। আজ যাত্রীও মোটামুটি ভাল আছে। কাউন্টার থেকে বাইরে বেরিয়ে রাহার দিকে তাকালাম। আমার কেনা বোরকা আর স্কার্ফে তাকে দারুণ মানিয়েছে! রাহাকে ইশারায় বাইরে ডাকলাম,
-কেমন ফিল করছেন? কাল সকালে আপনি আবার সবকিছু ফিরে পাবেন। আব্বু আম্মু, আপনার ছোট ভাই।
-হুম কিন্তু একটা জিনিস আর পাবো না...
-সেটা কি?
-ভালবাসা...
-অবশ্যই পাবেন! আল্লাহ আপনার জন্য নিশ্চয়ই সৎ কাউকে রেখেছেন।
-আপনার কথাই যেন ঠিক হয়...
-আচ্ছা আপনি যে হোস্টেলে ছিলেন সেখানে আপনার বইখাতা, কাপড় ইত্যাদি ইত্যাদি ছিল না? সেগুলা তো নেয়া হল না!
-থাক সেগুলো, এতদিনে আব্বু হয়তো সেগুলো নিয়ে গেছেন।
-ক্ষুধা লাগেনি?
-হুম
-কিছু খাবেন?
-যদি কিছু খেতেই হয় তাহলে বাসায় পৌছে আম্মুর রান্না করা খাবারই খাবো।
এরমধ্যে বাস এসে গেল! আমার একটা ব্যাগ বক্সে দিয়ে বাসে উঠলাম। রাহাকে জানালার পাশের সিটটা দিয়ে আমি তারপাশে বসলাম। তারপর বাস চলতে লাগলো। বিপরীত দিক দিয়ে আসা বাসগুলোর লাইটের আলো রাহার মায়াবী মুখটায় পরছে! তাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে হয়তো কোন একসময় আমি এমনই কোন মায়াবীর অপেক্ষায় ছিলাম! আমার ক্লান্ত শরীরটা কখন যে ঘুমিয়ে পরলো আমি খেয়াল করি নি! অনেকক্ষণ পর আমার ঘুম ভাঙলো! কাধটা কেমন যেন ভারি ভারি লাগছে! তাকিয়ে দেখি ঘুমন্ত রাহার মাথাটা আমার কাধে এসে ঠেকেছে! আমি কোন প্রকার নড়াচড়া করলাম না। আমি জানি অনেকদিন পর রাহা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে! তারপর আবারও ঘুমিয়ে পরলাম। ফেরি ঘাটে এসে ঘুম ভেঙে গেল! দেখি রাহা জাগ্রত আছে! বাস ফেরিতে উঠার পর রাহাকে নামতে বললাম। কিন্তু সে নামলো না! সে বললো, "ওই পল্লীর অনেক লোকই এখানে থাকে, তাদের কেউ আমাকে দেখলে সমস্যা আছে।" তারপর আমিই একাই বের হলাম। কেমন যেন এক অজানা কষ্ট বারবার বুকে আঘাত করছে। মনে হয় ভালবেসেছি রাহাকে! কিন্তু কিভাবে বলবো? জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছে মেয়ে! থাক আর দুঃখ দিতে হবে না। আমার ভালবাসা আমার মাঝেই থাক! ফেরি প্রায় ঘাটের কাছাকাছি এসেছে। তাই বাসে ফিরে গেলাম। এরপর আবারও ঘুম দিলাম। চোখ খুলেই দেখি আমরা বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এসে পরেছি। রাহার দিকে তাকিয়ে দেখি সে এখনও ঘুম!
-এক্সকিউজ মি রাহা..
ধীরে ধীরে চোখ খুললো রাহা! এরপর বাস থামলো। বাস থেকে নেমে রাহা চারপাশের প্রকৃতিটাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে! মনে হচ্ছিল যেন বহুবছর পর দেশের মাটিতে পা রাখছে!
-আপনার বাসা কোন জায়গায়?
-বেশি দুর না। এখান থেকে পাঁচ মিনিট লাগবে হেটে গেলে। চলুন হেটেই যাই, সাজসকালে রিক্সাকে বিরক্ত করার দরকার নেই।
চুপচাপ মেয়েটা নিজ এলাকায় এসে চঞ্চল হয়ে উঠেছে! চেহারায় সেই সজীবতা ফিরে এসেছে!
-ওহ সরি! আপনার ব্যাপারে কিছু জানাই হয় নি! আপনার নাম কি?
-আমি ফারুক।
-কি করেন? নিশ্চই চাকরি?
-জ্বী, ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার।
-চাকরি কোথায় করেন?
-ঢাকায় করতাম কিন্তু আগামীকাল থেকে এখানে করবো।
-মানে?
-আমার ট্রান্সফার হয়েছে এখানে।
-তাহলে তো আপনার সাথে রোজ দেখা করবো!
-ঠিক আছে।
-একটা কথা বলি?
-বলেন.....
-আমি আপনাকে কখনও ভুলতে পারবো না।
-কেন?
-বা রে? অচেনা একটা মেয়ের এত বড় উপহার করলেন আর সে কি করে আপনাকে ভুলে যাবে?
কথা বলতে বলতে রাহার বাড়ির সামনে চলে এলাম। রাহা দৌড়ে গিয়ে কলিং বেল চাপলো! তারপর একনাগাড়ে দরজায় কিল, ঘুষি, লাথি দিয়ে যাচ্ছিল! বুঝলাম বাসার সবার মুখ দেখতে ব্যাকুল হয়ে আছে! হঠাৎ এক মহিলা দরজা খুললো! আমি উনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি উনি নিশ্চয়ই রাহার আম্মু হবেন! মহিলা বলে উঠলো, "কে রে এত সকালে দরজা....." এরচেয়ে বেশি উনি বলতে পারলেন না! "রাহা মা আমার! তুই?" এই বলে মেয়েকে উনি জড়িয়ে ধরে হাউমাউ দিয়ে কেঁদে উঠলেন! রাহাও আম্মু বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো! রাহার গালে কপালে সমানে চুমো দিয়ে যাচ্ছেন উনি! মুহূর্তেই রাহার বাবা আর ছোট ভাই এসে গলাগলি দিয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছেন! রাহা ওর আব্বু আম্মুকে বললো, "এই ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে এসেছেন!" মেয়ের মা বাবা আমাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না! তাদের চোখের কান্না বলে দিচ্ছে তারা কতটা খুশি আর কৃতজ্ঞ আমার উপর! এরপর আমাকে বাসার ভিতরে নিয়ে গেলেন। রাহার মা বাবার যেকয়টি মোবাইল আছে সবগুলো নিয়ে আত্মীয়স্বজন সবাইকে কল করে জানালো! তারা চা নাস্তা খাওয়ালো সাথে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করতে খুব জোরাজুরি করলেন কিন্তু আমি খেলাম না! অন্যদিন খাবো বলে রাহার বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। রাহা দ্রুত পায়ে হেটে আমার সামনে দারিয়ে বললো,
-আপনি চলে যাবেন এটা আমার ভাল লাগছে না! আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু হারাচ্ছি! প্লিজ আপনি সপ্তাহে একদিন হলেও আমার সাথে একটু চোখের দেখা হলেও করে যেয়েন!
-আসবো যদি রিয়াজকে জেলে দিতে পারেন...।
অবশ্যই! তারপরও আপনি একবার হলেও আসবেন। প্লিজ!
-ইনশাআল্লাহ....
এই বলে চলে এলাম সেখান থেকে! পিছন ফিরে দেখলামও না রাহা সেখানে দারিয়ে আছে কিনা! নিঃশব্দে আমার চোখদুটো কেঁদে যাচ্ছিল! তাই চাই নি রাহা আমার এ অবস্থা দেখুক!
সাত মাস পর,
এক অজানা নাম্বার থেকে কল আসলো! রিসিভ করতেই বললো,
-কেমন আছেন অপরিচিত?
কণ্ঠ চিনতে আমি কোন প্রকার ভুল করলাম না!
-ভাল আছি অপরিচিতা।
-বাহ! আমাকে কষ্টে রেখে আজ আপনি খুব ভাল আছেন?
-আমার নাম্বার পেলেন কিভাবে?
-ভুলে গেলেন? আপনি যখন মোবাইল চার্জ দেয়ার জন্য রেখেছিলেন তখনই আমি নাম্বার নিয়েছিলাম।
আমি চুপ করে আছি...
-আজ আমার বিয়ে! আমার একহাতে ফোন আর আরেক হাতে পয়জন! যদি আজ বাড়ি না আসেন তবে কাল পত্রিকার ভিতরের পৃষ্ঠায় আমার নিস্তব্ধ মুখটা দেখতে পাবেন!
-পাগলামি করবেন না প্লিজ!
-আমার কথা শুনেছেনই তো!
-আচ্ছা আমি আসছি!
দ্রুত চলে গেলাম রাহার বাসায়! দেখি সবাই নিরব! বিয়ে বাড়ির এলাকার মত কোন চিহ্ন নাই! বুঝলাম এটা রাহার প্লান ছিল! তারপর রাহা আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে বললো, I Love you...." যদিও আমি ভাবি নি যে রাহা আমাকে ভালবাসবে! তারপর রাহা বাহিরে এসে আমাকে বাসায় নিয়ে গেল। মেয়ের মা বাবা সম্মতি দিয়েছেন আমার সাথে রাহাকে বিয়ে দিতে! আমি তাদেরকে আমার বাসায় দাওয়াত করলাম। আমার আব্বু আম্মু রাহাকে বউমা হিসাবে আনন্দের সাথে পছন্দ ও গ্রহণ করেছেন! এর মাসখানেক পর পারিবারিকভাবে ধুমধাম করেই আজ আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হল! আর ওদিকে রিয়াজ এখন জেলে চারদেয়ালে কঠিন রুটি খাচ্ছে!
[কিছু কথা: যে ছেলে/মেয়ে ভালবাসা অপবিত্র করার চিন্তায় থাকে তাদের ভালবাসার কোনো দরকার নেই। আর যেসব প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী হারিয়ে যায়/প্রেমিকের হাত ধরে বের হয়ে যায় তারা বেশিরভাগই স্থান পায় বড় বড় শহরের এসব পতিতা পল্লীতে! এতে করে মা বাবার মুখটা কোথায় থেকে এটা কেউ বুঝতে চায় না। প্রেম ভালবাসাই যখন করবেন তখন ছেলে/মেয়ের যোগ্যতা দেখেই করেন। মন দেখে প্রেম করা এযুগে নেই। বাস্তবতার চরম চাপে যখন পরবেন তখন মনের ভালবাসা জানালা দিয়ে পালাবে। যাই হোক, ঘটনাটা সত্য। কোন এক বন্ধুর জবানে এই গল্পটা লিখেছি। কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
২| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৫
দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: বাস্তব যে এতো সুন্দর হয় জানা ছিল না। শুভ কামনা আপনার বন্ধুর জন্য।
৩| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১:২৫
দর্পণের প্রতিবিম্ব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ রাজপুত্র ও তানভীর ^_^
৪| ০১ লা মে, ২০১৫ রাত ৯:২৭
মোঃ মারুফ চৌধুরী বলেছেন: ঘটনাটা যদি সত্য হয়, তাহলে আপনার মহানুভবতার প্রশংসা ভাষাতীত।
৫| ১২ ই মে, ২০১৫ সকাল ৯:৫৬
নির্লিপ্ত আমি বলেছেন: ভালো লাগল।
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:৩১
তানভীরএফওয়ান বলেছেন: nice story....but hard to believe