নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বল বীর – বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
সাক্ষাৎকার: মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ ( আজকের প্রথম আলো থেকে হুবহু)
‘এ রকম অবস্থায় সেনাপ্রধান কী করতে পারেন’
মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধু–সরকার নিয়োজিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার সময়কালে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেই দিনের ঘটনার পূর্বাপর নিয়ে মতিউর রহমান তাঁর এ সাক্ষাৎকার নেন। সম্পাদক হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৩ সালের ১৫ ও ১৬ আগস্ট দুই কিস্তিতে সাক্ষাৎকারটি ভোরের কাগজ-এ ছাপা হয়।
মতিউর রহমান: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হওয়ার পর ১৮ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। সে সময় আপনি চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন। সেই ঘটনাবলির কথা মনে হলে আপনার কী প্রতিক্রিয়া হয়?
কে এম সফিউল্লাহ: দেখুন, বলতে গেলে ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির পর থেকে গত ১৭ বছর আমি দেশের বাইরে ছিলাম। এই পুরো সময়ে বিদেশের মাটিতে এই দিনটি আমাকে একভাবে নাড়া দিত। তখন একাই ভেবেছি। দেশে ফিরে আসার পর এই দিনটি আরেকভাবে আমাকে নাড়া দেয়। দেখি, মানুষ যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে, অতীত নিয়ে যেভাবে ভাবে, তাতে অনেক কিছু মনে পড়ে। আমি ভাবি, সেদিন যদি একটি সৈন্য দল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম, তাহলে কী হতো? তাহলে হয়তো বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো যেত। সব ভেবে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
’৭১ সাল থেকেই আমি অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েছি। স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় দুবার শত্রুর মুখোমুখি হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি। তখন থেকেই আমি ভাবি, যা ঘটার তা ঘটবেই। তবু সতর্ক হওয়া উচিত। সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, ১৫ আগস্টে কী করা যেত, কিছু করা সম্ভব ছিল কি না—এসব ভেবে মন খারাপ হয়।
মতিউর রহমান: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনকে কি আপনি সামরিক অভ্যুত্থান বলবেন?
কে এম সফিউল্লাহ: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলিকে আমি সামরিক অভ্যুত্থান বলে উল্লেখ করতে চাই না। যদিও পরবর্তী সময়ে এটি সামরিক অভ্যুত্থান বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আসলে সামরিক অফিসারদের একটি ছোট গ্রুপ, সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে যাদের অবস্থান ছিল, তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সে সময় এমন একটা পরিস্থিতি ছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ ছিল মানুষের মধ্যে। আবার সামরিক বাহিনীর মধ্যেও তা ছিল। ওই পটভূমিতে এই যে একটি ঘটনা, পরবর্তী সময়ে মস্ত বড় বিপদ ডেকে নিয়ে আসে, সেটা ঘটিয়েছিল একটি ছোট গ্রুপ। এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়। এটা একটা সন্ত্রাসী কাজ, একটা ছোট গ্রুপের কাজ।
মতিউর রহমান: সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে কেন এ ঘটনা ঘটতে পারল?
কে এম সফিউল্লাহ: তখন সরকারের কিছু কার্যকলাপ জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। আবার সেনাবাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ ছিল। সরকারবিরোধী কিছু রাজনৈতিক শক্তি এই অবস্থায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। তারা কিছু অফিসার ও জওয়ানকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল। এদের অবস্থান সরকারের ভেতরেও ছিল এবং বাইরে তো ছিলই। এই শক্তিটা সক্রিয় ছিল। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে গ্রুপটি ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনা ঘটায়।
কে এম সফিউল্লাহ
কে এম সফিউল্লাহ
মতিউর রহমান: এ রকম ঘটনার সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন?
কে এম সফিউল্লাহ: সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে একটা অসন্তুষ্টির মনোভাব ছিল, সেটা কিছুটা টের পেয়েছিলাম। এই অসন্তুষ্টির কারণে কিছু ‘পকেটে’ (গ্যারিসন) সরকার সম্পর্কে সমালোচনা দেখা দিচ্ছিল। আর এ ঘটনার মাস পাঁচ-ছয় আগে আমাদের হাতে একটি লিফলেট আসে; কিছু সিপাই, এনসিও পর্যায়ের লোক সরকারের কার্যকলাপে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এটি বের করেছিল। সেটাসহ একজন এনসিওকে ধরা হয়েছিল। এটা যখন ধরা পড়ে, তখন আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা ভালোভাবে সংগঠিত ছিল না। কার্যত পুরো সামরিক বাহিনীই তখন অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করছিল। আমরা পুরো বাহিনীকে সংগঠিত করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। সেটা সরকারের কাছে ছিল অনুমোদনের জন্য। যেহেতু এটা বিলম্বিত হচ্ছিল, সে জন্য প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করি। বিষয়টি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে জন্য আমি প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের পুরো পরিকল্পনার মধ্য থেকে অন্ততপক্ষে গোয়েন্দা বিভাগকে সংগঠিত করার সম্মতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো। কারণ, এটা ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম। যেটা আমার সামনে আসে, লিফলেট নিয়ে ধরা পড়ার ঘটনা, সেটা পেয়েছিলাম একটি ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে।
আমি বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করার পরও ওই অনুমোদন পাইনি। তিনি তখন বলছিলেন, ‘কেন, রউফ তোমাকে সব খবর দেয় না?’ ব্রিগেডিয়ার রউফ তখন ডিজিএফআইয়ের প্রধান ছিলেন। আমার মনে হলো, আমি যে খবরটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, সেটা তিনি জানেন। যেহেতু এটা সামরিক বাহিনীর ভেতরের ঘটনা, সেটা ডিজিএফআইয়ের জানার কথা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেন রউফ তোমাকে বলেনি?’ আমার বিশ্বাস হয়েছিল, ডিজিএফআই এ খবর বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল। আমি বলি, রউফ আমাকে এ খবর দেয়নি। আমি পেয়েছি একটি ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে। এই যে কিছু জানতাম, কিছু জানতাম না—এ নিয়ে বলা যায় কিছুটা আঁচ পেয়েছিলাম। কিন্তু এটা যে এ রকম রূপ নেবে, সেটা চিন্তা করিনি। আমরা ভেবেছিলাম, যেটা হতে পারে, সেটা সিপাই এনসিওদের মধ্য থেকে হতে পারে। অফিসাররাই এমন কিছু একটা করছে, সেটা ধারণার বাইরে ছিল।
মতিউর রহমান: সেই সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন কি?
কে এম সফিউল্লাহ: তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার পর গ্যারিসন কমান্ডারদেরও এ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা হয়। তবে এটাকে এত বড় কিছু মনে করে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরে ব্রিগেডিয়ার রউফের সঙ্গে এ নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি। হতে পারে সে ইচ্ছে করে আমাকে পুরো জানতে দেয়নি। এ অভিযোগ আমি বঙ্গবন্ধুর কাছেও করেছিলাম।
আমি সে সময় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গেও কথা বলেছি বারবার। তিনি আমাদের পরিকল্পনা অনুমোদন করবেন করবেন করেও করতে পারেননি। এ কাজে সে সময় কিছুটা স্যাবোটাজও হয়েছিল বলে মনে হয়।
মতিউর রহমান: তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটিকে বঙ্গবন্ধু কি হালকাভাবে নিয়েছিলেন?
কে এম সফিউল্লাহ: আমার মনে হয় তিনি ব্যাপারটিকে এত গুরুত্ব দেননি। আমি যখন বলি, ‘আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে’, তখন তিনি বলেন, ‘তুমি খবর চাও? আমি তোমাকে খবর দেব।’ আমি কিছুটা হতাশ হই। কারণ, আমি যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছিলাম, সেটা তিনি দেননি। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরীও বলেছিলেন। আমরা তখনো ভাবিনি, এ থেকে এত বড় ঘটনা ঘটে যেতে পারে, এতে অফিসাররাও যুক্ত থাকতে পারে।
মতিউর রহমান: ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে আপনি কখন জানতে পারলেন?
কে এম সফিউল্লাহ: ১৫ আগস্ট ভোরে ফজরের নামাজের পর আমি এ সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। ১৪ তারিখ সারা দিনই কিছু ঘটনা ঘটে। সেদিন চট্টগ্রামে একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের একটি হেলিকপ্টার সেদিন কলকাতা যাচ্ছিল। সেটা যখন ফেনীর ওপর, তখন দুর্ঘটনা ঘটে। হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। আরোহীরা সবাই মারা যায়। এ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সারা দিন।
পরের দিন (১৫ আগস্ট) বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। সেদিন (১৪ আগস্ট) বিকেলে ওই মঞ্চে এবং এর আশপাশে কিছু বিস্ফোরণ ঘটে। আরও বিস্ফোরক আছে কি না, সেটা দেখার জন্য পুলিশের আইজি নূরুল ইসলাম আমাকে ওই এলাকাকে বিপদ-মুক্ত করার অনুরোধ জানান। সে জন্য বিস্ফোরক উদ্ধার বিশেষজ্ঞদের কয়েকটি দল পাঠাই। এসব নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত থাকি। এই সবকিছু শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সেদিন খুব সকালে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. ক. সালাহউদ্দিন এসে আমাকে খবর দেয়, ‘স্যার’—তখন হতে পারে ভোর সাড়ে পাঁচটা কি তারপর—‘আপনি কি আর্মার্ড ও আর্টিলারি রেজিমেন্টকে শহরে পাঠিয়েছেন? তারা তো শহরে যাচ্ছে। তারা রেডিও অফিস দখল করেছে। তারা গণভবন, ধানমন্ডির দিকে যাচ্ছে।’
এ কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার মধ্যে বিদ্যুতের মতো প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার জানেন?’ এরপর আমি তাকে বলি, ‘যদি তারা এভাবে গিয়ে থাকে, তাহলে তুমি তাড়াতাড়ি ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের কাছে যাও, ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়নকে প্রস্তুত করে প্রতিরোধ করতে বলো।’
মতিউর রহমান: এ ঘটনা জানার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কি আপনার কোনো যোগাযোগ হয়েছিল?
কে এম সফিউল্লাহ: লে. ক. সালাহউদ্দিনকে এই নির্দেশ দিয়ে ঘরে গিয়ে লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। দেখি, তার টেলিফোন ব্যস্ত। তখন আমার স্ত্রীকে লাল টেলিফোন ঘোরাতে বলি, আর আমি অন্য টেলিফোনে চেষ্টা করি। এই সময়ের মধ্যে যদি বঙ্গবন্ধুও আমাকে চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তিনি আমাকে পাননি। আমি জানার পর যদি তিনি চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তো পাওয়ার কথা নয়; কারণ আমার টেলিফোন তো তখন ব্যস্ত।
কয়েকটি টেলিফোন করার পর আমি আবার টেলিফোন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। ছয়টা বাজার তিন-চার মিনিট আগে আমি টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে যাই। আমার সঙ্গে শুধু কয়েকটি কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মাইরা ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ আমি বলি, ‘স্যার, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউজ?’ আমি এ কথা বলার পর তাঁর গলা আমি আর শুনতে পাইনি। মনে হলো, টেলিফোনটি টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছেন। আমি হ্যালো হ্যালো করছি। সে সময়ই আমি টেলিফোনের মধ্য দিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এরপরই টেলিফোনটা অকেজো হয়ে যায়।
মতিউর রহমান: আপনি কি কিছু করতে পেরেছিলেন? আপনার চেষ্টার ফল কী হলো?
কে এম সফিউল্লাহ: সিকোয়েন্সটা হলো এ রকম। আমি প্রথমে কথা বলি শাফায়াত জামিলের সঙ্গে। আমার মনে হলো আমি তাঁকে ঘুম থেকে উঠিয়েছি। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি জানেন যে আর্মার্ড ও আর্টিলারি ইউনিট শহরের দিকে গেছে?’ তিনি বলেন, জানেন না। তখন আমি বললাম, ‘সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান এসে আমাকে এ খবর দিয়েছে। আমি তাঁকে তখন প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ওই গ্রুপটিকে প্রতিরোধ করার জন্য নির্দেশ দিই। এ কথা বলে আমি বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার এবং নৌবাহিনীর প্রধান এম এইচ খানকে ফোন করি। কথা বলি। আমি বুঝলাম, তাঁরাও কিছু জানেন না। এরপর আমি জেনারেল জিয়ার সঙ্গে কথা বলি। আমার মনে হলো তিনি আমার কাছ থেকেই ঘটনা সম্পর্কে প্রথম শুনলেন। আমি তাঁকে বলি, ‘আপনি দ্রুত আমার বাসায় চলে আসুন।’ এরপর ফোন করি খালেদ মোশাররফকে। তাঁকেও আমার বাসায় আসতে বলি।
এরপর ডিজিএফআইয়ের ব্রিগেডিয়ার রউফকে ফোন করি। তাঁর বাসায় কেউ ফোন ধরেননি। এরপর কর্নেল জামিলকে (নতুন ডিজি ডিজিএফআই) ফোন করি। তাঁকে আমি পাই। তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকেছেন। আমি তাঁর বাসায় যাচ্ছি।’ আমি বলি, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। তুমি যেহেতু বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছ, তাঁকে বলো, আমি কিছু করার চেষ্টা করছি। আর যদি পারো, তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেয়ো।’ এসব কিছুর পর আমি বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পাই এবং কথা বলি। সে কথা আগেই বলেছি।
এরপর আমি আবার ফোন করি কর্নেল শাফায়াত জামিলকে। কারণ, তখন পর্যন্ত কিছুটা সময় ছিল। ১৫-২০ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কোনো প্রতিক্রিয়া বা কোনো তৎপরতার খবর পাচ্ছিলাম না। এমনটা কেন হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি তাঁকে না পেয়ে এক্সচেঞ্জকে বললাম আমাকে ধরিয়ে দিতে। এক্সচেঞ্জ থেকে বলা হয়, মনে হয় টেলিফোনটা তুলে রাখা হয়েছে। আমি ভাবলাম, হয়তো উত্তেজনায় টেলিফোনটা তিনি ঠিক জায়গায় রাখতে পারেননি। অথবা যারা ক্যু করেছে, তারা তাঁকে আটকে রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে জেনারেল জিয়া চলে আসেন। খালেদও আসেন। এ সময় আমার বেটম্যান রেডিও খুলে দেয়। আমি ডালিমের গলা শুনতে পাই।
আমি তাঁদের বললাম, ‘শাফায়াত কী করছে?’ আমি বুঝতে পারছি না। আমি বাসায় বসে কিছু করতে পারছি না। আমি অফিসে যাব। আমি যখন কাপড় বদলাতে ভেতরে যাই, তখন দেখি রউফ আমার পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে এসে পড়েছে। সে তখন লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় ছিল। আমি ওকে বাসায় গিয়ে কাপড় বদলিয়ে আসতে বলি।
আমি প্রস্তুত হয়ে অফিশিয়াল গাড়িতে অফিসে যাই। জিয়া আমার পরপর আমার অফিসে আসেন। ইতিমধ্যে খালেদও চলে আসেন। আমি ওকে শাফায়াতের ব্রিগেডে যেতে বলি এবং কেন ওরা কিছু করছে না, সেটা জানাতে বলি। কোনো তৎপরতা দেখছি না কেন, ইতিমধ্যে তো দ্রুত তৎপরতা শুরু হওয়া উচিত ছিল।
মতিউর রহমান: আপনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর কখন জানলেন?
কে এম সফিউল্লাহ: এরপর আমার এডিসিকে খবর দিতে এবং আমাকে জানাতে বলি। তারপর আমি ঢাকার বাইরে অন্যান্য ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি। ইতিমধ্যে তারা রেডিও থেকে খবর জেনে গেছে। আমি তাদের বলি, যা ঘটেছে, সেটা আমার অজ্ঞাতে হয়েছে। আমি ঢাকার কমান্ডারকে প্রতিরোধের জন্য বলেছি। পরবর্তী নির্দেশের জন্য আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলি।
এরপর খালেদ মোশাররফ আমাকে টেলিফোন করে। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘কী হচ্ছে?’ সে তখন বলে, ‘স্যার, ওরা আপনাকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে চায়।’ আমি বলি, ‘ওরা কে?’ সে বলে, ‘আমাকে সব বলতে দিচ্ছে না।’ আমি বলি, ‘যাহোক তুমি আসো।’ সে বলে, ‘আমাকে ১৫ মিনিটের জন্য আসতে দিচ্ছে।’ আমি ওকে আসতে বলি।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এডিসি এসে বলে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এই প্রথম আমি শুনি এবং আমার মধ্যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয়। এ খবর আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। এডিসি চলে যাওয়ার পর খালেদ আসে। সে বলে, ‘বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। পুরো গ্যারিসন মনে করে আপনার নির্দেশে ক্যু হয়েছে।’ ওরা আনন্দ করছে। কেউ নড়ছে না। যখন খালেদ কথা বলছিল, তখন জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল নাসিম আমার অফিস কক্ষে ছিল।
মতিউর রহমান: আপনার কাছে ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ থেকে প্রথম কী প্রস্তাব এসেছিল সেদিন সকালে?
কে এম সফিউল্লাহ: খালেদ মোশাররফ কথা শেষ করার পরপরই আমার অফিসের সামনে দুটি গাড়ি বেশ আওয়াজ করে থামে। বাইরে কিছুটা হইচইয়ের শব্দ শোনা যায়। তারপরই সজোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলে ডালিম এবং তার সঙ্গে প্রায় ১০-১২ জন সশস্ত্র সৈনিক আমার অফিসঘরে ঢোকে এবং আমার দিকে অস্ত্র তাক করে ‘চিফ কোথায়, চিফ কোথায়’ বলে চিৎকার করতে থাকে। তখন কর্নেল নাসিম উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘দেখছ না, চিফ সামনেই।’ ডালিমের এই ঔদ্ধত্যপনা দেখে আমি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, বলি, ‘তুমি যে অস্ত্র আমার দিকে তাক করছ, আদৌ সেটা যদি ব্যবহার করতে চাও করো। আর যদি কথা বলতে এসে থাকো, তাহলে অস্ত্র বাইরে রেখে আসো।’ এ কথার পর ও অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বলে, ‘স্যার, প্রেসিডেন্ট আপনাকে রেডিও স্টেশনে যেতে বলেছেন।’
আমি বললাম, ‘আমি জানি প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন।’ তখন সে বলে, ‘স্যার, আপনার জানা উচিত, খন্দকার মোশতাক আহমদ এখন রাষ্ট্রপ্রধান।’ আমি বলি, ‘খন্দকার মোশতাক তোমার রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে, কিন্তু আমার নয়।’
নাতি জয় ও নাতনি পুতুলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে বঙ্গবন্ধু। বাঁয়ে কন্যা শেখ হাসিনা, ডানে বেগম মুজিব, পেছনে শেখ রাসেল
নাতি জয় ও নাতনি পুতুলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশে বঙ্গবন্ধু। বাঁয়ে কন্যা শেখ হাসিনা, ডানে বেগম মুজিব, পেছনে শেখ রাসেলছবি: জাতির জনক
এ কথার পর ডালিম বলে, ‘স্যার, আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না যেটা আমি চাই না।’ আমি বলি, ‘তুমি যা কিছু করতে চাও করতে পারো। আমি তোমার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছি না। আমি আমার সৈন্যদের কাছে যাচ্ছি।’ এ কথা বলে এডিসিকে গাড়ি আনতে বলে আমি উঠে দাঁড়াই। গাড়িতে উঠে সরাসরি ৪৬ ব্রিগেডে যাই। ওখানে গিয়ে দেখি সৈন্যরা সবাই আনন্দ করছে। এমনকি সেখানে বঙ্গবন্ধুর কিছু ছবিও ভাঙা হয়েছে। এসব দেখে তখন আমার মূক-বধির হওয়ার অবস্থা। তখন কয়েকজন অফিসার আমাকে পথনির্দেশ করে পাশের একটি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি মেজর হাফিজ ও মেজর রশিদ। ওরা এসে আমাকে অনুরোধ করে, ‘স্যার, আপনি রেডিও স্টেশনে যান।’ তখন আমি বললাম, ‘আমি তো একা যাব না। অন্য দুই চিফের সঙ্গে কথা বলব।’ ওরাই আমাকে দুই বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। দুই প্রধান বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, আমরা আসছি।’
মতিউর রহমান: আপনার সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের কখন কোথায় কথা হলো?
কে এম সফিউল্লাহ: আমি যখন ওদের জন্য অপেক্ষা করছি, সে সময় আমি ভাবছিলাম, আমার কী করা দরকার? আমার সামনে দুটি প্রশ্ন—এক. বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমার কোনো সংশয় থাকত না। আমি সরাসরি সংঘর্ষে যেতাম। দুই. যেহেতু বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই, তাই আমি সংঘর্ষে গিয়ে কী লাভ করতে পারব? পারি গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে। এতে আরও রক্তপাত হবে। এটা কি লাভজনক হবে? এ কথা ভাবতে ভাবতে ওরা চলে আসে। কিছু কথা হওয়ার পর সবাই আমরা রেডিও স্টেশনে চলে যাই।
সেখানে যাওয়ার পর খন্দকার মোশতাক যে ঘরে বসা ছিলেন, সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আমাকে বলেন, ‘অভিনন্দন সফিউল্লাহ, তোমার সৈন্যরা একটি বিরাট কাজ করেছে। এখন বাকিটা করো।’ আমি বললাম, ‘আর বাকি কী আছে?’ তিনি বলেন, ‘তোমারই সেটা জানার কথা।’ এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলি, ‘তাহলে সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দিন।’ এ কথা বলে চলে আসার সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খন্দকার মোশতাককে বলেন, ‘স্যার, ওনাকে থামতে বলুন। ওনাকে থাকতে হবে। রেডিওতে একটা ঘোষণা দিতে হবে।’ এবং আমাদের গতি রোধ করা হলো। সে সময় তাহের ঠাকুর একটা কাগজে ঘোষণা লিখে দিল। সেটা আমরা একে একে পড়ি। সেটাই পরে রেডিওতে ঘোষিত হয়।
এই সবকিছুর পর খন্দকার মোশতাক বলেন, ‘আমি এখনই বঙ্গভবনে যাচ্ছি। জুমার নামাজের আগেই সেখানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। আমি চাই, আমার সকল প্রধানেরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন।’ এরপর আমরা সবাই ক্যান্টনমেন্টে চলে আসি এবং সব অফিসারকে একত্র করে পুরো ঘটনা বর্ণনা করি। সবাইকে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বলি। তারপর বঙ্গভবনের দিকে চলে যাই। তখন প্রায় ১১টা বেজে গেছে। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। প্রধান বিচারপতি অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন।
মতিউর রহমান: শপথ গ্রহণের পর কী হলো? আপনি কী করলেন?
কে এম সফিউল্লাহ: শপথ গ্রহণের পর খন্দকার মোশতাক বললেন, ‘আমার চিফদের দরকার।’ আমরা তিনজনই থেকে গেলাম আলোচনার জন্য। নামাজের পর বৈঠক শুরু হলো। খন্দকার মোশতাক, তিন বাহিনীর প্রধান, জিয়া এবং খালেদও ছিল। আলোচনার বিষয় ছিল মার্শাল ল দেওয়া হবে কি হবে না। অল্প কিছুক্ষণ বৈঠক হওয়ার পর স্থগিত হয়ে গেল। বিকেল-সন্ধ্যায় আবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সেটার পর আবার বৈঠক। তখন সবাই আর নেই।
দ্বিতীয়বারের শপথের পর কর্নেল মঞ্জুরকে বঙ্গভবনে দেখে আমি বিস্মিত হই। তখন সে দিল্লিতে কর্মরত ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কীভাবে এলে?’ সে বলে, ‘আমি খবর জেনে রাস্তা দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছি।’ এখনো আমার মনে প্রশ্ন, সে ঢাকায় কীভাবে এবং কেন এল।
একসময় যখন সবাই সম্মেলনকক্ষে, তখন রাষ্ট্রপতির ভারপ্রাপ্ত সামরিক সচিব এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার একটি টেলিফোন।’ অন্যদিক থেকে জে. ওসমানীর কণ্ঠস্বর শুনলাম। তিনি বললেন, ‘সফিউল্লাহ, অভিনন্দন নাও।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি কি মনে করেন এটা অভিনন্দনযোগ্য?’ তিনি বলেন, ‘তুমি কি জানো না যে তুমি দেশকে বাঁচিয়ে দিয়েছ?’
এরপর সম্মেলনকক্ষে ঢুকে দেখি এক কোনায় খন্দকার মোশতাক আর কর্নেল মঞ্জুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছেন। তখন আমি আরও ভাবলাম, কে তাকে আসতে বলেছে? আমি তাকে আসতে বলিনি। আমি সেনাপ্রধান। সে তখন দিল্লিতে মিলিটারি অ্যাটাশে। খন্দকার মোশতাক তো সেদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন না? তাহলে তাদের এই ঘনিষ্ঠতার মূলে কী ছিল?
বৈঠক আবার শুরু হলো। একপর্যায়ে কথা উঠল, মার্শাল ল দেওয়া হবে কি না? আমি বললাম, ‘এ নিয়ে আলোচনার কী আছে? এটা তো ঘোষিত হয়ে গেছে। এখন শুধু এটা আনুষ্ঠানিকতার প্রশ্ন।’ এতে খন্দকার মোশতাক বলেন, ‘কে এর দায়িত্ব নেবে?’ আমি বললাম, ‘রাষ্ট্রপতি।’ তিনি বলেন, ‘কেন রাষ্ট্রপতি? তোমার বাহিনী এটা করেছে। তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি বলি, ‘আমি দায়িত্ব নিতে ভীত নই। কিন্তু ওরা যদি আমার বাহিনী হতো তাহলে তো আমার নামে ঘোষণা দিত। তারা তো আপনার নামে ঘোষণা দিয়েছে।’ তখন তিনি কথা ঘুরিয়ে নেন। তিনি আমাকে বলেন, ‘আমরা আলোচনা করছি সামরিক আইন করা হবে কি না, তা নিয়ে।’ এ রকম আলোচনা আরও দুদিন চলল। এই তিন দিন পুরো সময়টা আমাকে ওরা বঙ্গভবনে ব্যস্ত রাখে। অন্য সামরিক কর্মকর্তারা যার যার বাসায় বা অফিসে ফিরে যাচ্ছিল। ওরা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিল।
মতিউর রহমান: তাহলে আপনাকে কি ওরা ভয় পাচ্ছিল?
কে এম সফিউল্লাহ: হতে পারে। সে জন্যই তো ২৪ আগস্ট আমাকে পদচ্যুত করে। এই তিন দিনের মধ্যে এক দিন আমাকে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে সাভার যেতে হয়। তখন তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল এবং একজন রক্ষী নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে। ওদের সামাল দেওয়ার জন্য আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এ রকম এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে আমি যখন বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলাম, তখন একদিন (১৭ আগস্ট) খালেদ মোশাররফ আমাকে এসে বলে, ‘স্যার, আপনি কি জানেন, ট্যাংকগুলো কোনো রকম গোলাবারুদ ছাড়াই অ্যাকশনে গিয়েছিল?’ তখনো আমি জানতাম না যে ওদের ট্যাংক-কামানে গোলা ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে তাহলে তো ওদের নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন কিছু ছিল না। এ কথা ভেবে আমি খালেদকে বলি, ‘এটা কি সত্যি?’ খালেদ বলে, ‘হ্যাঁ স্যার, আমি তো পরশুদিনই (১৫ আগস্ট) ওদের গোলাবারুদ দিয়েছি।’
আমি বললাম, ‘তুমি এ সময় ওদের গোলাবারুদ দিলে, আমাকে জিজ্ঞেস করলে না? ওরা এমন জঘন্য কাজ করেছে, এখন তো ওরা আমার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে।’ সে বলল, ‘আমি ভেবেছি সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।’ আমি বলি, ‘ওরা যদি গোলাবারুদ ছাড়া এমন কাণ্ড করতে পারে, তাহলে ওরা তো এখন আরও অনেক কিছু করতে পারে।’ খালেদ চলে যাওয়ার পর একসময় মেজর রশিদ এল আমার কাছে। আমি প্রশ্ন করি, ‘তোমরা কীভাবে এমন জঘন্য কাজ করতে পারলে?’ রশিদ বলল, ‘স্যার, এটা তো বেশ দীর্ঘ কথা।’ সে বলল, ‘রোজার ঈদের দিন আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। আমি সস্ত্রীক দেড় ঘণ্টা ছিলাম। সেদিন ইচ্ছে ছিল আপনাকে বলার।’ তখন আমি জিজ্ঞেস করি, ‘বললে না কেন?’ সে উত্তর দেয়, ‘সাহস পাইনি।’ আমি বলি, ‘সাহস না পেয়ে থাকলে তাহলে করতে গেলে কেন? অন্যরা কি জানত?’
সে বলে, ‘হ্যাঁ স্যার, অনেকে জানত।’ সে আরও বলে, ‘আমাদের সাফল্য লাভ করার সম্ভাবনা ছিল মাত্র .০১%। তবু আমরা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলাম। যদি আমরা ব্যর্থ হতাম, তাহলে মরে যাওয়ার আগপর্যন্ত যদি কোনো সুযোগ পেতাম, তাহলে বলে যেতাম, অনেক সিনিয়র অফিসার এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’ তার এ কথাগুলো শুনে আমি বিমর্ষ হয়ে পড়ি।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনো আলোচনা চলছে। আমি বঙ্গভবনেই আছি। সে রাতেই শেষ কথা হলো, একটা খসড়া তৈরি করতে হবে। সে রাতে বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানসহ আমি এবং জেনারেল খলিল আর ঘুমাইনি। খুব সকালে খন্দকার মোশতাক আমাদের কাছে এসে একটি খসড়া দেন। সেটাই পরে ঘোষণা করা হয়। তারপর আমরা চা খেয়ে বঙ্গভবন থেকে চলে আসি। আমি অফিসে যাই এবং খালেদকে বলি, ‘আমাদের বৈঠক হওয়া দরকার। রাতেই সেটা হওয়া দরকার।’
সে রাতের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের আইজি, জেনারেল জিয়া, পিএসও, ব্রিগেডিয়ার রউফ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, ডিএমও কর্নেল মালেক, জিএসও ওয়ান লে. ক. নূরউদ্দীন আহমেদ। ওখানে যখন সম্মেলন করছি, সে রাতে রউফ বলে, ‘আমরা ওখানে যত কথাই বলি সব ফাঁস হয়ে যায়। সে জন্য গোপন কথা বলতে হলে আমাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।’ সেটা করা হলো। সভায় সবাই বলল, সেনাবাহিনীর কমান্ড ভেঙে গেছে। অভ্যুত্থানকারীদের শাস্তি হওয়া দরকার। এ রকমই সিদ্ধান্ত হলো যে যারা বঙ্গভবনে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে একই সঙ্গে ১৯ তারিখ সব ব্রিগেড কমান্ডারকে নিয়ে বৈঠক ডাকি। সেদিন সকালে বৈঠকের সময় ফারুক আর রশিদকেও হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
সকালে সম্মেলনে গিয়ে আমি সবাইকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাই। কী পরিস্থিতিতে পুরো দায়িত্ব নিতে হয়, তা ব্যাখ্যা করি। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলি।
মতিউর রহমান: ১৯ আগস্টের পর কী হলো?
কে এম সফিউল্লাহ: দেখলাম আমাদের সব কথা জানাজানি হয়ে গেছে। যেসব গোপন সিদ্ধান্ত নিই, সেগুলোও বঙ্গভবনে সবাই জানে। এ সময় আমি অপেক্ষা করছিলাম ফারুক-রশিদ ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসে কি না। আমি খন্দকার মোশতাকের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘ওরা ভীত। সময় দাও।’ এভাবে ২৪ তারিখ এসে যায়।
সেদিন দুপুর ১২টার রেডিওর খবরে জানানো হয়, জে. ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হয়েছে। এর পরপরই খন্দকার মোশতাক আমাকে টেলিফোন করে বলেন, ‘তুমি খবর শুনেছ?’ বললাম, ‘এটা ভালো খবর।’ তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবনে চাই।’ আমি বঙ্গভবনে যেতেই একজন অফিসার বললেন, জেনারেল ওসমানী আমাকে সালাম দিয়েছেন। আমি তাঁর ঘরে গেলাম। তিনি আমাকে বসতে বলে কিছু কথা বললেন। তিনি আমার প্রশংসা করলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘তুমি দেশের জন্য অনেক করেছ। দেশ তোমাকে চায়। এখন তোমার ভূমিকা বিদেশের মাটিতে দেখতে চাই। তোমাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হবে।’ এটা আমার জন্য বজ্রপাতের মতো শোনাল। আমি বললাম, ‘খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ আমরা গেলাম, তিনি অনেক কথা বললেন। বললেন, ‘এখন বিদেশে তোমার কাজ দেখতে চাই।’
আমি তাঁকে বলি, ‘আমাকে যখন সেনাবাহিনীর প্রধান করেন বঙ্গবন্ধু, তখন বলেছিলাম, বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাকে দায়িত্ব নিতে হলো। এখনো বলি, এবার আমি পরিস্থিতির শিকার হলাম।’ ২৪ আগস্টই আমার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে পাঠানো হয়।
মতিউর রহমান: ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারলেন না, এটা কি আপনার ব্যর্থতা বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ: প্রশ্ন হলো, এ রকম অবস্থায় একজন সেনাপ্রধান কী করতে পারেন? তিনি তো একজন একক ব্যক্তি। তিনি তার সহকর্মী, অধীন অফিসারদের দিয়ে কাজ পরিচালনা করেন। সে সময় যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তিনি ছিলেন ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার। তাকে নিষ্ক্রিয় দেখে চিফ অব জেনারেল স্টাফকে পাঠালাম। তিনিও উৎসাহব্যঞ্জক রিপোর্ট দিলেন না। তখন আমি নিজে যাই এবং ৪৬ নম্বর ব্রিগেডে গিয়ে যখন দেখি, আমি একা, তখন আমার কী করণীয় থাকে?
আমার মনে হয়, আমার যদি কোনো ব্যর্থতা থেকে থাকে, সেটা হলো আমার নিজের আত্মাহুতি প্রদান। এটাই যদি আমার কর্তব্য হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে আমি আমার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। সেটা করে যদি কোনো লাভ হতো, তাহলে সেটা আমার ব্যর্থতা।
মতিউর রহমান: কেন এই অভ্যুত্থান সফল হলো?
কে এম সফিউল্লাহ: এ জন্য একটু পটভূমি ব্যাখ্যা করা দরকার। সেনাবাহিনীর সদস্যদের এ রকম মনোভাব ছিল যে তারা কিছুটা অবহেলিত। যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য ছিল না। তবে কতক গুলো কার্যকলাপ, যেমন রক্ষীবাহিনীর আবির্ভাবটা অসন্তোষের একটা বড় কারণ ছিল। বিরোধী পক্ষ এর পুরো সুযোগ নেয়। তারা এটা প্রচার করে অনেকের মধ্যে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় যে শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর জায়গা নিয়ে নেবে। আর এ জন্য কিছু ঘটনা কাজ করেছে। সেটা হলো সেনাবাহিনীর প্রায় সবকিছুই ছিল পুরোনো বা পূর্বব্যবহৃত। এটা নয় যে এগুলো তাদের দেওয়া হয়। এগুলো তাদেরই ছিল। দেশে যা ছিল, সেটা দিয়ে সেনাবাহিনীকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু রক্ষীবাহিনী যখন তৈরি করা হয়, তখন তাদের জন্য তো কিছু ছিল না। তাদের অস্ত্র, পোশাক, যানবাহন বা অন্য কোনো কিছুই ছিল না। সে জন্য সবকিছুই নতুন করতে হয়। তাই ওদের সবকিছু নতুন ছিল। পোশাক, অস্ত্র, যানবাহন, থাকার জায়গা—সবই নতুন ছিল। এই সবকিছুই সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। রক্ষীবাহিনীকে যখন দেখত, অন্যরা মনে করত আমরা অবহেলিত। এর ওপর আরেকটি বড় ব্যাপার ছিল। রক্ষীবাহিনীকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়, যা দিয়ে তারা যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারত। যার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল দুই বাহিনীর মধ্যে।
পিতা–কন্যার অমলিন হাসি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা
পিতা–কন্যার অমলিন হাসি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা
মতিউর রহমান: তাহলে তো দেখা যায়, এটাই আবার সত্য বলে প্রমাণিত হলো যে নিয়মিত সেনাবাহিনী কখনোই বিকল্প কোনো বাহিনীকে মেনে নিতে পারে না?
কে এম সফিউল্লাহ: এটা ঠিক, তারা ভাবে যে দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টি তো তাদের ওপর ন্যস্ত। যদি তা-ই হয়, তাহলে বিকল্পের কী প্রয়োজন?
মতিউর রহমান: কেন রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল?
কে এম সফিউল্লাহ: এটা করা হয়েছিল মূলত পুলিশকে সাহাঘ্য করার জন্য। পুলিশ তখন কার্যকর ছিল না। তাদের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার মতো অবস্থা ছিল না। এ অবস্থায় হয়তো রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়। পরে এমন প্রচারণা ছিল যে রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখের কাছে চলে গেছে। ১৫ আগস্টের পরে তো দেখা গেল তাদের সংখ্যা ছিল ১০-১২ হাজারের মতো। বলা হতো, ওদের কামান দেওয়া হয়েছে। পরে প্রমাণিত হলো, সেটা ছিল না। এসব অপপ্রচারও সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজ করেছে।
মতিউর রহমান: রক্ষীবাহিনী কি প্রতিরোধের কথা ভেবেছিল?
কে এম সফিউল্লাহ: এটা আমি বলতে পারব না। তবে মনে হয়, সমগ্র পরিস্থিতি তাদেরও অপ্রস্তুত করে ফেলে। তা ছাড়া ট্যাংকের উপস্থিতি তাদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তবে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল কি না, সে সম্পর্কে রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন সমরনায়কেরা বলতে পারবেন।
মতিউর রহমান: অভ্যুত্থান সম্পর্কে অনেকে বলেন, এটা হয়েছিল ব্যক্তি আক্রোশের কারণে?
কে এম সফিউল্লাহ: না, তবে কিছুসংখ্যক সামরিক অফিসার চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, সেগুলোতে কিছুটা অন্যায় হয়েছিল। তা নিয়ে কিছু বিক্ষোভ ছিল। এটা হলো একটি গ্রুপের ব্যাপার। অন্যরা, যেমন রশিদ, ফারুক; তারা তো সেনাবাহিনীতেই ছিল। তারা এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল বিশেষ রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে। তারা অন্যদের ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। তখন সরকারের মধ্যেও একটা অংশ বোধ হয় ওদের ইন্ধন জোগায়। আর সরকারের বাইরের কিছু শক্তি এর সঙ্গে যোগসাজশে ছিল।
মতিউর রহমান: এ ঘটনার পেছনে বিদেশিদের কোনো হাত ছিল বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ: এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপে বাইরের কোনো কোনো শক্তির হাত ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতনের পর যারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, স্বাগত জানায়; তাতে তো তাদের পরোক্ষ সমর্থন ছিল বলে মনে করার কারণ রয়েছে।
মতিউর রহমান: সেনাবাহিনীর ভেতরে তখন সামগ্রিক দেশের অবস্থার প্রতিফলন ছিল কী?
কে এম সফিউল্লাহ: দেশের তৎকালীন অবস্থায়, যেমন ‘বাকশাল’ গঠন ইত্যাদি নিয়েও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া ছিল। আমার মধ্যে কিছু প্রশ্ন ছিল। সেগুলো নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম।
এ ব্যাপারে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে প্রশ্ন করি, ‘স্যার, সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। হঠাৎ করে এক পার্টিতে কেন যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘সফিউল্লাহ, তুমি বুঝবে না, যে ব্যক্তি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, সে কি তা ভুলতে পারে? দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনি, আবার গণতন্ত্রে ফিরে আসব। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো।’ তখন বঙ্গবন্ধুর ওপর রাজনীতি নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা অন্তত আমার ছিল না। আমিও মেনে নিয়েছিলাম তাঁর ওই বক্তব্য। যদিও আমরা যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলাম, এ থেকে সরে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাখ্যা সে অবস্থায় মেনে নিয়েছিলাম। মনে হয়, এই সবকিছুর পরও যদি রক্ষীবাহিনী সামনে না আসত, তাহলে হয়তো সেনাবাহিনী সেগুলো মেনে নিত।
মতিউর রহমান: সেনাবাহিনীর ব্যাপারে কি বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই কোনো সন্দেহ বা অনাস্থা ছিল বলে মনে করেন?
কে এম সফিউল্লাহ: না, সেটা মনে করি না। তাহলে তো আনোয়ার সাদাতের কাছ থেকে ট্যাংক, মার্শাল টিটোর কাছ থেকে এক ডিভিশনের অস্ত্র আনাতেন না। ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সে সময় কিছু অসুবিধা ছিল। কোনো অবকাঠামো ছিল না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল না। যানবাহন বলতে কিছু ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। বৈদেশিক প্রকল্প চূড়ান্ত করা যাচ্ছিল না তাদের পুরোনো ঋণ মেনে না নেওয়া পর্যন্ত। এসব সমস্যা নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর উন্নয়ন চাইছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। কেননা তখন অগ্রাধিকার তো অন্যত্র ছিল। আমাদের পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না। সে জন্যও অর্থের প্রয়োজন ছিল।
মতিউর রহমান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন—আপনার মূল্যায়ন কী?
কে এম সফিউল্লাহ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন মহান দেশপ্রেমিক। ছাত্রজীবন থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলে এসেছেন। এ জন্য তাঁকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাঁর নিজের কর্মজীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে মিথ্যার কাছে তিনি কখনো মাথা নত করেননি। দেশের স্বার্থকেই সব সময় সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছেন। নিজের কী হবে না হবে, সেটা কখনো ভাবেননি। সে জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, সেটাও তিনি কখনো নেননি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধু মূলত বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেছেন। এ জন্য রাষ্ট্র পরিচালনায় যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল, তা হয়তো পুরোটা অর্জন করার সময় পাননি। তার অর্থ এই নয় যে তিনি তা জানতেন না বা তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সফল, এটাই বলব। ব্যর্থ বলব না। সামগ্রিক পরিস্থিতির পটভূমিসহ বলা যায়, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়ে তিনি সফল হয়েছিলেন। এমনকি বর্তমান সেনাবাহিনীর কাঠামোও তাঁর শাসনামলে তৈরি। ভিত্তি তো সেখান থেকেই। বলতে হবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে গড়ে তুলতে তিনি যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন।
আমি বঙ্গবন্ধুর কথা সব সময়ই স্মরণ করি। যত দিন পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি না পাবেন, তত দিন আমি মানসিকভাবে স্বস্তি পাব না। তাঁরই আহ্বানে আমি এবং আমার সহকর্মীরা জীবনের সব ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবেও আমি তাঁর স্নেহভাজন ছিলাম। এখনো বহু স্মৃতি ভিড় জমায় মনে। তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
সূত্র: ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: কে এম সফিউল্লাহ ও শাফায়াত বিতর্ক, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০২১
লিঙ্ক
১৬ ই আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৫:০৪
খাঁজা বাবা বলেছেন: ধন্যবাদ
২| ১৬ ই আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪১
কামাল৮০ বলেছেন: আগে ঘোষণা দিন কোন পক্ষ হয়ে লিখছেন।নিরপেক্ষ হয়ে লিখলে খালেদা জিয়ার কোটেশনটা মনে করুন।
১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ৯:২৩
খাঁজা বাবা বলেছেন: আমি কিছু লিখিনি। যা করার মতিউর রহমান ও সফিউল্লাহ করেছেন। আপনি পড়ে দেখুন কোন পক্ষে গেছে লেখা। তার পর মন্তব্যে আমাদের জানিয়ে দিন।
৩| ১৬ ই আগস্ট, ২০২২ রাত ৮:৪৯
ভুয়া মফিজ বলেছেন: আওয়ামী প্রচারণা আছে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে জেনারেল জিয়ার হাত আছে। কিন্তু তৎকালীন সেনা প্রধানের বক্তব্যে তো কিছুই পেলাম না। এই ব্যাপারে আপনার কাছে কোন গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে?
১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ৯:৩১
খাঁজা বাবা বলেছেন: ওনার কথা শুনে মনে হচ্ছে জিয়া আর খালেদ কিছু জানত না, ওসমানী, সকল সেনাসদস্য সহ বাকি সবাই খুব ই খুশি। শুধু উনি ওনার ব্যর্থতায় কষ্ট পেয়েছেন।
৪| ১৬ ই আগস্ট, ২০২২ রাত ৯:১৩
ককচক বলেছেন: বঙ্গবন্ধুকে দেশ গড়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়নি। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হুট করেই উন্নত হয়ে যায় না। সময় লাগে। তৎকালীন বিরোধীদলগুলো বঙ্গবন্ধুর সরকারকে সময় দেয়নি।
১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ৯:২১
খাঁজা বাবা বলেছেন: তৎকালীন বিরোধী দল বলতে ছিল জাসদ। আওয়ামীলিগ ২০ হাজার জাসল কর্মীকে হত্যা করেছে সাড়ে তিন বছরে। এই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য কি ছিল?
৫| ১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:২৯
মোগল বলেছেন: লেখক বলেছেন: তৎকালীন বিরোধী দল বলতে ছিল জাসদ। আওয়ামীলিগ ২০ হাজার জাসল কর্মীকে হত্যা করেছে সাড়ে তিন বছরে। এই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য কি ছিল?
সম্ভবত আওয়ামি লীগ জাসদকে নির্মূল করতে চেয়েছিল।
১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:১৩
খাঁজা বাবা বলেছেন: আওয়ামীলিগের রাজনীতি বরাবরই নির্মূল করার।
৬| ১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৬
কামাল৮০ বলেছেন: মেরুদন্ডহীন সেনা প্রথান।
১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৬
খাঁজা বাবা বলেছেন: এই লোক সেক্টর কমান্ডার থেকে কিভাবে যুদ্ধ করল, তাই ভাবি।
৭| ১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৫
কামাল৮০ বলেছেন: কমিশন গঠন হলে তার পর জানা যাবে হত্যার পেছনে কারা ছিল।হত্যায় অংশগ্রহণ যারা করেছে তাদের বিচার হয়েছে।কিন্তু হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে কারা জড়িত ছিল সেটা জানা যায়নি।
১৭ ই আগস্ট, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৫
খাঁজা বাবা বলেছেন: আর কবে করবে? ইস্যু জিয়িয়ে রাখলে হাসিনার ই লাভ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৪:৫৭
শাহ আজিজ বলেছেন: এর মধ্যে অল্প কিছু আমড়া জানতাম কিন্তু এত ডিটেইল না ।
ছেপে দিয়ে ভাল করেছেন , সবাই জানুক ।