নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ক্যাম্পাসে থাকাকালীন এক থার্টি ফার্স্টে ভাষা ইনস্টিটিউটের সামনের রাস্তায় দাড়িয়ে তারুণ্যের উৎসব দেখছি। বিপুল হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে জলন্ত একটা আগুনে ফানুস রাস্তায় পার্ক করা একটা ইয়ামাহা মোটরবাইক সোজা নেমে আসছে আর বাইকের মালিক বাইকটাকে সরাতে পড়ি মরি করে দৌঁড়াচ্ছে। মোটামুটি থ্রিলিং একটা দৃশ্য।
হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমাদের পাশেই বাইসাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে থাকা এক মধ্যবয়ষ্ক লোককে লক্ষ করে একটা টিভি ক্যামেরা এগিয়ে আসছে। ইনিই হুমায়ুন আজাদ। তিনি টিভি সাংবাদিকের সাথে কথা বলছেন, পাশে দাড়ানো আমি।
হুমায়ুন আজাদের সাথে ব্যক্তিগত সংস্পর্শতা এটুকুই। যদিও আমার একান্ত ব্যক্তিগত এক না পাওয়ার আক্ষেপের সাথে জড়িয়ে আছে হুমায়ুন আজাদের নাম। ২০০৪ সালে ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা একটা ট্যুরে গিয়েছিলাম ইন্ডিয়া এবং নেপালে। কাঁকড়ভিটা দিয়ে নেপাল ঢুকে আমরা কাঠমান্ডু গেলাম। ওখানে দুদিন থেকে তারপর যাবো পোখারা। এরপর আবারো ইন্ডিয়ায় ঢুকে দার্জিলিং তারপর কলকাতা হয়ে বেনাপোল দিয়ে ঢাকা ফেরার কথা।
কিন্তু ট্যুর চলাকালীন সময়ে আকস্মিকভাবে আমার একটা পরীক্ষার ডেট পড়ে যাওয়ায় আমি কাঠমান্ডু থেকে মন খারাপ করে সরাসরি ঢাকায় ফিরে আসলাম। কিন্তু যে দিন দুপুরে ঢাকা ফিরলাম, সেদিনই সন্ধ্যায় হুমায়ুন আজাদ বইমেলা প্রাঙ্গণে আক্রান্ত হলেন। এবং আমার পরীক্ষাটা ভন্ডুল হয়ে গেল! ট্যুরটাতো গেছেই।
যাই হোক, প্রসঙ্গ ওইটা না। আনিসা শার্লিন নামে আমাদের এক বন্ধু আবৃত্তি শিখতো কন্ঠশীলন বা স্বরশীলনে। শার্লিনের সম্মানে এই স্বরশীলন বা কন্ঠশীলনের এক আবৃত্তি অনুষ্ঠানে একদিন আমরা গিয়েছিলাম যাদুঘরের পেছন দিকটায় একটা অডিটোরিয়মে। এখন সম্ভবত ওখানে পাঠক সমাবেশ হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে শার্লিন অসম্ভব সুন্দর একটা কবিতা আবৃতি করল। হুমায়ুন আজাদের ‘আমাদের মা’।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মা এবং বাবা দুজনই অত্যন্ত কঠিন ধরণের মানুষ ছিলেন। কোনো ধরণের অন্যায় বা অনিয়মকে তাঁরা সামান্যতম প্রশ্রয়ও দেননি। বাড়িতে থাকতে এই দু’জনের হাতেই প্রচুর মার খেয়েছি। বলা চলে, এই মারের হাত থেকে বাচার জন্যই বেশ কম বয়সেই আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করার সুযোগ সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলাম। এ রকম একটা পরিপ্রেক্ষিতে বড় হওয়ায় বন্ধুবলয়ে আবেগহীন হিসেবে আমার একটা পরিচিতি ছিল। কিন্তু শার্লিনের সেদিনের আবৃত্তি শুনে আমার চোখে পানি চলে আসলো। অডিটোরিয়মে আলো নেভানো থাকাটাই নিয়ম, না হলে আমার আবেগহীনতার মুখোশটা ওইদিনই সবার সামনে খুলে যেত।
ছোট্টবেলা থেকেই ‘আউট বই পড়ার বদভ্যাস’ থাকায় হুমায়ুন আজাদের বইও পড়েছি। লাল নীল দীপাবলী, সব কিছু ভেঙে পড়ে, পাক সার জমিন সাদ বাদ, আমার অবিশ্বাসসহ আরো কয়েকটা। হুমায়ুন আজাদ নিসন্দেহে বড়মাপের লেখক, কিন্তু ওনার কন্টেন্ট আমার পছন্দ না। আমাদের সমাজ নেয় না, এরকম অশ্লীলতা আছে (কেউ আবার শ্লীল-অশ্লীল এর সংগা নিয়ে পইড়েন না)। প্রবচনগুচ্ছতে বিতর্কিত অনেক কিছুই বলেছেন, প্রবল বিতর্ক আছে তাঁর আধুনিক কবিতার সংকলন নিয়েও।
এ ছাড়াও বাক্যতত্ত্ব, শিল্পকলার বিমানবিকরণ, নারী, নিবিড় নীলিমা, আমার অবিশ্বাস ইত্যাদি বইয়ের বিরুদ্ধে টুকলিফাইংয়ের অভিযোগ আছে। যদ্দুর মনে পড়ে এ ধরণের অভিযোগের ফলে কলকাতা থেকে উকিল নোটিশ পাওয়ার প্রেক্ষিতে বাক্যতত্ত্ব বইটির প্রকাশক বাংলা একাডেমী বাজার থেকে বইটি প্রত্যাহার করে নেয়।
এ সব বাদ দেন, আসেন ‘আমাদের মা’ কবিতাটা পড়ি।
আমাদের মা
হুমায়ুন আজাদ
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।
শিমুল মুস্তাফার ভরাট কন্ঠে আবৃত্তিও শুনতে পারেন। সবার মা-ই সবার কাছে সবচেয়ে আপন। তবুও আবৃত্তি শোনার পর নিশ্চিতভাবেই নিজের মাকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করার অনুভূতি জাগবে মনে।
, ।
দীর্ঘদিন পর ইউটিউবের কল্যাণে কবিতার আবৃত্তিটা সামনে আসলো। ধন্যবাদ হুমায়ুন আজাদ, ধন্যবাদ শার্লিন। তোমাদের দু'জনের জন্যই আমি এই কবিতাটা জানতে পেরেছিলাম।
ও একটা কথা, হুমায়ুন আজাদ এই কবিতাটা লিখেছিলেন মা দিবস টিবস আবিষ্কার হওয়ার আগেই।
ছবি এবং আবৃত্তি ইন্টারনেটের সৌজন্যে:
২| ২২ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:১৭
জাকির হোসেন গাজী বলেছেন: ভাল লাগল ।
৩| ২৩ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:০০
বজ্রকুমার বলেছেন: কবিতা আবৃতি আমি খুব একটা শুনিনা তবে আমাদের মা শুনে মনে হলো এত দিনের না শোনা বুঝি পুষিয়ে গেছে।
২৩ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:৫২
পদ্মপুকুর বলেছেন: আমি নিজেও কবিতা খুব একটা পড়ি না, বুঝতেই পারি না। কিন্তু এই কবিতাটা শুনে আপনার মতই মনে হয়েছিল। ধন্যবাদ আপনাকে।
৪| ২৪ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:১৯
মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: কবিতাটি ও লেখাটি পড়ে ভাল লাগলো। আমার কিছু ডিজাইন ব্লগে আছে, আপনার মূল্যবান মতামত ও মন্তব্য কামনা করছি। ভাল থাকবেন।
৫| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১:৫৪
সোহানী বলেছেন: আজাদ স্যারের অনেক বই ই আমার পড়া তবে উনি ব্যাকরন বা ভাষা নিয়ে কিছু বই লিখেছেন। আমি তাজ্জব হয়েছি কেন এগুলো পাঠ্য করে না। এতো অসাধারনভাবে কঠিন বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে এনেছেন..........
প্রিয় এ কবিতাটা অাগেই আবৃতি করেছিলাম ইউনিতে থাকার সময়ই। ++++++++++
১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:৪৫
পদ্মপুকুর বলেছেন: ঠিকই বলেছেন। তাঁর এই বইগুলো পাঠ্যতালিকায় থাকা উচিৎ ছিল। সুনীতি বাবুর মত উনারও একই কাতারে থাকার কথা ছিল। আবৃত্তিতে ছিলেন শুনে ভালো লাগলো। আপনি কি আমাদের ক্যাম্পাসের? কোন সময়কার বলেনতো, আমার ফার্স্ট ইয়ার সেশন ৯৭-৯৮।
৬| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:১০
মাঈনউদ্দিন মইনুল বলেছেন:
সুন্দর একটি লেখা। কবিতার সাথে দেখা হয়েছে অনেক আগেই, আবারও পড়লাম, এবং আবারও মুগ্ধ হলাম। হুমায়ন আজাদকে অন্তত এ দু'একটি কারণে সবারই শ্রদ্ধা করা উচিত - তিনি ছিলেন মানবতাবাদী, নারীর অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল, স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ একজন প্রাজ্ঞ ও সাহসী লেখক যিনি কাউকেই ছেড়ে কথা বলেন নি।
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৩৮
এস ওয়াই গ্লোবাল এলটিডি বলেছেন: হুমায়ুন আজাদ 'আমাদের মা' কবিতাটা পড়ে আনেক ভাল লাগল ।