নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রোজনামচার লেখিকা অ্যানা ফ্রাঙ্ক
I don’t think of all the misery, but of the beauty that still remains…My advices is “Go outside, to the fields enjoy nature and the sunshine, go out and try to recapture happiness in yourself and in God. Think of all the beauty that’s still left in and around be happy!...Anne Frank
উপরের অংশটুকু নেওয়া হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ডায়েরীর লেখিকা অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী থেকে। কোন বিখ্যাত ব্যক্তির ডাইরীর কথা মনে হলে, সবার আগে যে নামটি মনে পড়ে, তাঁর নাম আনা ফ্রাংক বা আনা ফ্রাংকের ডাইরী। অ্যানা ফ্রাঙ্ক হলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিষীকাময় অধ্যায়ের অনেক বড় একজন সাক্ষী। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা ডায়েরীতে লিখেছিলেন নিয়মিতভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলো এই কিশোরীর কলমের আঁচড়ে ডাইরীর পাতায় যেমন ফুঁটে উঠেছে, তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের হৃদয়স্পর্শ করেছে। তার মৃত্যুর পর ডায়েরীটি প্রকাশিত হয়। সবাই জানতে পারে অ্যানা ফ্রাংকের নাম ,শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে এই নিষ্পাপ বালিকাটির কথা। এই নিষ্পাপ কিশোরী ১৯২৯ সালের ১২ জুন জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৯১তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে আমরা তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
২য় বিশ্ব যুদ্ধ শুরুর পর যখন জার্মান নাৎসীবাহিনী ইহুদী হননে মেতেছিল, তখন আনা ফ্রাংকের পরিবার আমস্টারডামের একটি মৃত্যুকুপে ২৫ মাস লুকিয়ে থেকেও নাৎসীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। ১৯৪৫ সালের মার্চে গ্রেফতারের পর অমানুষিক নিপীড়ন ও নির্যাতনে পরিবারের সদস্যরা একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সেই দিনগুলোর কথা ১৫ বছরের কিশোরী আনা ফ্রাংক তাঁর ডাইরীতে লিখে যান। মৃত্যুর পর ডাইরী প্রকাশ পেলে নাৎসীদের ভয়াবহ নিপীড়নের চিত্র আবারো বিশ্ববাসীর সামনে ফুঁটে উঠে।
জার্মানির ছোট্ট শহর বের্গেন। এখানেই রয়েছে ইতিহাসের ইতিহারেস দগদগে ক্ষত কুখ্যাত বের্গেন-রেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। নাৎসি অধিকৃত জার্মানিতে যুদ্ধবন্ধীদের মরণফাঁদ সৃষ্ট ও পরিচালিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর অন্যতম বের্গেন-রেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প । এই স্থানে অন্তত ৭০ হাজার তাজা প্রাণ ঝরে পড়েছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোতে। মানুষ মানুষকে যে কীভাবে পরিকল্পনা করে, ফ্যাক্টরিতে মুরগি প্রসেসিং-এর মতো ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টাইলে দলে দলে খুন করে সুখ পেতে পারে - তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি গণহত্যার নিদর্শন না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেলুলযেডের ফিতায় ২য় বিশ্বযুদ্ধেও গণহত্যা ও বন্দী শিবির নিয়ে তৈরী শিল্ডার্স লিস্ট, ডায়েরি অফ অ্যানা ফ্রাঙ্ক, বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামা, লাইফ ইজ বিউটিফুল, দ্য রিডার ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলোর দৃশ্যবিশেষর কথা। ছবির মতোই স্থাপনা তবে কাঁটাতারের বেড়ার স্থান দখল করে আছে কংক্রিটের সীমানা প্রাচীর।
১৯৩৯ সালেই এক কুখ্যাত স্থাপনার যাত্রা শুরু হয় যুদ্ধবন্দীদের বন্দী শিবির হিসেবে, যেখানা আনা হয়েছিল ফ্রেঞ্চ, পোলিশ,রেলজিয়ান ও রাশান বন্দীদের। কিন্তু বন্দী শিবিরের যথাযথ সুবিধা ছিলোনা। অপ্রতুল খাবার, কনকনে ঠাণ্ডা, আদিকালের বাসস্থান ফলে ১৯৪১ সালের জুলাইতে পাঠানো ২০ হাজার রাশান বন্দীর ১৮ হাজারই মত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ১৯৪৩ সালে হিটলারের অন্যতম দোসর হাইনরিখ হিমলারের নির্দেশে এই বন্দীশালাকেই পরিণত করা হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, আনা হয় হাজার হাজার ইহুদী ও রাশান বন্দীদের। ১৯৪৫ সালের ১৫ এপ্রিল কানাডা-ব্রিটিশ যৌথবাহিনীর হাতে এই ক্যাম্পের পতন ঘটে। তখন যৌথ বাহিনী প্রায় ৬০ হাজার বন্দীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন যাদের অধিকাংশই ছিলো মারাত্মক অসুস্থ্য আর ১৩ হাজার শবদেহ ছিলো মাটি চাপা দেবার অপেক্ষায়। বের্গেন-বেলসেন ক্যাম্পে নিহত হয়েছিলো প্রায় ৭০ হাজার বন্দী যার মধ্যে ৩০ হাজার ইহুদি, প্রায় সমান সংখ্যক রাশান। সেই সাথে প্রচুর সমকামী, জিপসি আর নাৎসি বিরোধী স্বদেশপ্রেমী জার্মান। এই বধ্যভূমিতেই বলি হওয়া ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বন্দী ছিলেন জনপ্রিয়তম ও সর্বাধিক পঠিত রোজনামচা’র (অ্যানা ফ্রাঙ্ক ডায়েরী) লেখিকা ইহুদী জার্মান কিশোরী অ্যানা ফ্রাঙ্ক।
ছোট বেলায় আমার মাধ্যমিক শ্রেণির ইংরেজী পাঠ্য বইয়ে উল্লেখ ছিল তার ও তার বিখ্যাত ডায়েরী কিটির কথা। জন্মগত ভাবে জার্মান হলেও নাৎসি বাহিনী ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৪ সালে হল্যাণ্ডের রাজধানী আর্মস্টরডেমে চলে আসেন তার পরিবার। নিজে দেশ ছেড়ে আসার একটাই কারণ ”তারা ছিলো ইহুদী”। যদিও ইতিহাসের নথিপত্র ঘেটে দেখা যায় তাদেও পরিবার ছিলো অতি মুক্তমনা, কোনো ধর্মের সাথেই তাদেও নিবিড় বন্ধন ছিলানা বরং তাদের বন্ধুদের তালিকায় ছিলো নানা জাতির নানা ধর্মের মানুষ। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অ্যানা ফ্রঙ্ক ও তার পরিবার ১৯৪২ সালের পরপরই দখলদার নাৎসী বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে আত্মগোপন করেন। আত্মগোপনের সময় তার ১৩তম জন্মদিনে উপহার হিসেবে পওয়া ডায়েরীতে (যার নাম অ্যানা দিয়েছিলেন কিটি) তার জীবনের দিনলিপি লিখতে শুরু করেন। আত্মগোপন কালীন জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা, কৈশোরে ডানা মেলার উত্তাল রঙিন দিনের বদলে ভ্যাঁপসা আঁধারে ঘেরা গুমোট জীবন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলে যায় আপন ধীর অবশ্যম্ভাবি গতিতে গড়িয়ে। অ্যানার রোজনামচায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে তার চার পাশের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা। মাত্র ১৩ বছরের এক কিশোরী ধর্ম সম্পর্কে কতটুকুই বা জ্ঞান রাখে? মুসলমান,হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদীর সে বেঝেইবা কী? তবুও শুধুমাত্র ইহুদী ধর্মালম্বী পরিবারে জন্মের কারণেই যে তাদের উপর এই নিষ্ঠুর হেনস্তা এটা তাকে আরো দুঃখী ও সংকুচিত করে তোলে। বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের নানা ঘটনা, মাসের পর মাস একঘেয়ে ধুসর জীবনযাত্র, বনের পশুর মতো গুহার গভীরে লুকিয়ে কেবল ধুঁকেধুঁকে বাঁচার চেষ্টার মাঝেও হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত উকি দিয়ে যায় কৈশোর প্রেম। এভাবেই ১৯৪৪ সালের ১ আগষ্ট পর্যন্ত ছোট ছোট আবেগে মোড়া ঘটনায় ভরে ওঠে তার ডায়েরীর পাতা। এর পর পরই গুপ্তপুলিশ গেস্টাপের হাতে বন্দী হয় অ্যানা ফ্রাঙ্ক পরিবার, থেমে যায় তার ডায়েরী কিটির তরতর করে ছুটে চলা। এরপর নানা বন্দীশালা হয়ে অ্যানা ফ্রাঙ্ক, তার মা এডিথ ও বোন মার্গট ফ্রাঙ্কের আগমন ঘটে বের্গেন-বেলসেন বধ্যভূমিতে। সেখানে কোন ডায়েরী ছিলানা বিধায় সেই নিষ্ঠুর পঙ্কিল দিনগুলোর করুণঘন বর্ণনা জানতে পারেনি বিশ্ববাসী। কিন্তু একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে জানা যায় বের্গেন-বেলসেন বন্দী শিবিরের সব চেয়ে কমবয়সী বন্দী অ্যানা ফ্রাঙ্ক বিশেষ ব্যাথাতুর ছিলেন শিশুবন্দীদেও গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাবার ঘটনায়। চরম নিষ্ঠুরতায় প্রত্যেকেই নিয়োজিত ছিলেন পাথর ভাঙ্গা ও পরিবহনের অত্যন্ত ক্লান্তিকর কায়িকশ্রমের কাজে। কনসেণ্ট্রেশন ক্যাম্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকের মাথা কামানো থাকত আর বন্দী নম্বরটি হাতের এক জায়গায় ছিলো উল্কির মাধ্যমে খোঁদাই করা।
১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে টাইফাস রোগ এই শিবিরেও ছড়িয়ে পড়ে মহামারী আকারে। শেষ পর্যন্ত এই রোগই পৃথিবী থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রোজনামচার লেখিকা অ্যানা ফ্রাঙ্ককে যার বয়স হয়েছিলো মাত্র ১৫। তার সাথে তার বোন মার্গটও মৃত্যুবরণ করেন। মহাযুদ্ধের করালগ্রাস থেকে কেবল বেঁচে ফেরেন তার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। তিনিই আমস্টারডমের সেই বন্দীশালা থেকে উদ্ধার করেন মেয়ের ডায়েরী ও অন্যান্য স্মৃতিবহুল সংগ্রহ। তাঁর প্রচেষ্টাতেই দিনলিপিটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি মূল ওলন্দাজ ভাষা থেকে পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে প্রথম বারের মতো ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এর ইংরেজি নাম হয় দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল। এটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অ্যানা ফ্রাঙ্কের আমস্টারডামের সেই বাড়ী সেই আঙ্গিনা এখনো অভিশপ্ত বন্দী শিবিরের সেই কিশোরীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে তাদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে কালো রঙের এপিটাফ বসিয়েছেন ভক্তরা। কালো রঙের এই এপিটাপে সাদা হরফে খোদাই করা হয়েছে তাদের নাম গভীর মমতায়। ইতিহাস একটা সময় ঠিকই অত্যাচারিতের সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্বযুদ্ধেঘর নাৎসী বাহিনীর সেই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের হোতাদের নাম আজ বিস্মৃত প্রায়, নিজ দেশ জার্মানিতেও হিটলারের নাম বিস্মৃত প্রায়, কিন্তু ১৫ বছরের কিশোরী অ্যানা ফ্রাঙ্ক আজও রয়েগেছেন বিশ্বের সকল মানুষের হৃদয় জুড়ে। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত রোজনামচার লেখিকা অ্যানা ফ্রাঙ্কের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ। জন্মদিনে আমরা তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
২| ১৩ ই জুন, ২০২০ রাত ১২:২৫
সাহাদাত উদরাজী বলেছেন: কত অজানা। জেনে ভাল লাগলো। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মহামারীতে হারিয়ে যাওয়া, আহ!
©somewhere in net ltd.
১| ১২ ই জুন, ২০২০ রাত ১১:৫৮
রাজীব নুর বলেছেন: অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরীটা আমি পড়েছি।
বড় মর্মান্তিক।