নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
বাংলা গানের অমর সুরস্রষ্টা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরসৈনিক ও উপমহাদেশের খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস। কালের ডামাডোলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তের দাগ মুছে গেছে, কিন্তু আজও তাঁর স্বাধীনতার গান আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ও জাজ্বল্যমান। এখনো রক্তে নাড়া দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ ছিলেন সমর দাস। ওই সময় অনেক গানে তিনি সুর করেন।তাঁর সৃষ্ট সুরে বহু গান জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সেসব গান গেয়ে অনেক শিল্পী সঙ্গীত জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তার সুর করা গান যুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করত। মুক্তিযুদ্ধে তার সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘চিরদিন আছে মিশে’ এবং ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা’ গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সুরবিন্যাস করে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ মূল গানটি বিবিসি লন্ডন থেকে সামরিক ব্রাশব্র্যান্ডে রেকর্ড করার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০১ সালের আজকের দিনে মৃত্যুৃবরণ করেন সমর দাস। আজ তাঁর ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিখ্যাত বাংলাদেশী যন্ত্রশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নবদ্বীপ বসাক লেনে এক সঙ্গীতশিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সমর দাস। তার পিতা পিতা জিতেন্দ্রনাথ দাস এবং মাতা কমলিনী দাস। পারিবারিকভাবে সঙ্গীতের আবহে বেড়ে ওঠেন সমর দাস। তিনি প্রথমে প্রথমে পিতার কাছে বেহালা বাদন শেখেন পরে নর্থ ফিল্ড নামক এক মিশনারীর কাছে শেখেন পিয়ানো, গিটার এবং বাঁশি। সেই সঙ্গে অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। অল্প বয়সেই গিটার ও পিয়ানো বাজানোর জন্য তার চারদিকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রে বংশীবাদক হিসেবে সংগীত জীবনের সূচনা করেন এবং কালকাতা বেতারসহ কলকাতা এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতেও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এ গ্রামোফোন কোম্পানিতে তিনি কমল দাসগুপ্ত, অনুপম ঘটক, কালিপদ বসু প্রমুখ সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পীর সান্নিধ্য লাভ করেন। এ প্রখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্য সমর দাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ঢাকা কেন্দ্রিক নাগরিক সঙ্গীত ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার সমরদাসের অবদানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বেতারে এবং ১৯৬১ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে রেডিওর নিজস্ব শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তিনি কিছুকাল করাচীতে পিআইএ সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠলে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এর সঙ্গে যুক্ত হন। এখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কাজ করেন। রেডিও-টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য তিনি অসংখ্য বাংলা গানের সংগীত পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুজিবনগর খেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান পরিচালক ছিলেন। এ সময় বহু গানে তিনি সুর দেন। তার সুর করা গান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও দেশবাসীকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রধান সঙ্গীত সংগঠক ও সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা ছিল সমর দাসের সঙ্গীতে বহুমুখী পারদর্শিতা অর্জনের এক উজ্জ্বল ভূমিকা। এছাড়ও শিল্পকলা একাডেমীসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমর দাস। শিল্পীদলের সদস্য ও দলনেতা হিসেবে তিনি নানা দেশে ভ্রমণ করেন।
সঙ্গীত পরিচালনায় সমর দাসের কৃতিত্বের কথা স্মরণীয় তেমনি বাংলা ছায়াছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও সমর দাসের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি মুখ ও মুখোশ, লটারী, মাটির পাহাড়, আসিয়া, গৌরী, ধীরে বহে মেঘনা, রাজা এলো শহরে প্রভৃতি ছবির সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। নদীর সন্তান, নবারুণ, বীরাঙ্গনা সখিনা, সোনার সবুজ গাঁয়ে ছবির নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। লাহোরে অনুষ্ঠিত আফ্রোএশিয় সঙ্গীত সম্মেলনে (১৯৬৪) উপস্থাপিত সোনার সবুজ গাঁয়ে নৃত্যনাট্যের প্রযোজনা ও সঙ্গীত পরিচালনা এবং লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ উৎসবে (১৯৬৬) সানস অব রিভার নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয় সমর দাসের পরিচালনায়। সমর দাসের মধ্যে মানবিক গুণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭০ সালে বঙ্গোপসাগরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হলে দুর্গত মানুষকে সহায়তা করার জন্য পল্টন ময়দানে কাঁদো বাঙালি কাঁদো নামে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সমর দাস ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা।
১৯৭২ সালে কলকাতার এইচ.এম.ভি কোম্পানি বাংলাদেশের ‘হূদয় হতে’ নামে একটি লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশ করে যাতে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ২৬টি গান। সমর দাস ছিলেন এ রেকর্ডের সঙ্গীত পরিচালক। তিনি ১৯৭২ সালে বিবিসিতে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের অক্রেস্ট্রেশন রেকর্ড করে আনেন। নবগঠিত বাংলাদেশ বেতারের সিগনেচার টিউন বা সূচনা সঙ্গীত সমর দাসের কম্পোজ করা। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ নামে দুটি এল.পি ডিস্ক প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলে একজন সংগঠক ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সমর দাস সেটাকে সফল করে তোলেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ গেমসের সূচনা ও সমাপনী সঙ্গীত তিনি রচনা করেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক এবং ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন।
২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পরলোক গমন করেন সমর দাস। মৃত্যুর পরে তাঁকে ঢাকার ওয়ারীস্থ খৃষ্টান গোরস্খানে সমাহিত করা হয়। সংঙ্গীত জীবনের সংগ্রামের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় তিনি সৃষ্টি করেছেন অজস্র গান। যতোদিন বাঙালি থাকবে, যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততোদিন স্বাধীনতার গান বেঁচে থাকবে আর পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠার মতোই সমর দাসও যুগ যুগ ধরে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। মুক্তিযোদ্ধা-শব্দসৈনিক সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
©somewhere in net ltd.