নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা ভাষার সংবাদপত্রের জনক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং ইসলামী পণ্ডিত মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ এর ১৪৯তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা

০৭ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৭


বাঙালি মুসলিম জাগরণের এক অবিস্মরণীয় যুগপুরুষ, বাংলা সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ও প্রখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং ইসলামী পণ্ডিত। মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ছিলেন বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বাংলার ভাষা-সাহিত্যের গবেষণায় যেমন তিনি অবদান রেখেছেন, তেমনি সমকালীন রাজনীতিক আন্দোলন ও বঙ্গীয় মুসলমানের আধুনিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি এক বিশিষ্ট নাম। তাঁর রচিত মোস্তফা-চরিত যেমন মহানবী (সঃ)-এর বস্তুনিষ্ঠ জীবনী তেমনি তাঁর রচিত মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থটি আমাদের সামাজিক ইতিহাস প্রণয়নে একটি অন্যতম আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বাংলদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (মরনোত্তর) স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৮১ প্রদান করে। মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ-এর আজ জন্মদিন। ১৮৬৮ সালের আজকের দিনে তিনি পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনায় জন্ম গ্রহন করেন। বাংলা সংবাদপত্রের জনক মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ'এর ১৪৯তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।

সাহিত্যিক এবং ইসলামী পণ্ডিত মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ জুন পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার হাকিমপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আলহাজ গাজী মাওলানা আব্দুল বারী ও মাতা বেগম রাবেয়া খাতুন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলো ব্রাহ্মণ। পনের শতকে খুলনা-বাগেরহাটের শাসনকর্তা খানজাহান আলী খানের সময় ইসলামী শিক্ষা আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী এবং পিতামহ তোরাব আলী খাঁ শহীদে বালাকোট সাইয়েদ আহমদ শহীদের অনুসারী সৈয়দ হাজী নিসার আলী তিতুমীরের সহযোদ্ধা ছিলেন। আকরাম খাঁ এর এক বছর বয়সকালেই ১৮৬৯ সালে মাতা-পিতার ইন্তিকাল ঘটে। অতপর তিনি আত্মীয়-স্বজনের প্রচেষ্টায় লালিত পালিত হয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতালাভে লেখাপড়ায় মন দেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর খুব বেশি ছিল না। শৈশবে গ্রামের মক্তবে শিক্ষারম্ভ করেন। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আশৈশব অনুরাগ বশত ইংরেজি স্কুল ছেড়ে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসয় ভর্তি হন। তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জটিল পরিস্থিতিই ১৯০০ সালে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্ত্বের সঙ্গে এফএম পাস করার পর মওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ কর্মজীবনে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন।

খুব অল্প বয়সেই তাঁর সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি। আহলে হাদীস ও মোহাম্মদী আকবর পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ১৯০৮ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত আকরাম খাঁ দি মোহাম্মদী ও আল-ইহসান পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরই মাঝে ১৯১০ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, দৈনিক খাদেম এবং ১৯২১ সালে কলকাতা থেকে উর্দূ জামানা এবং ১৯২১ সালে বাংলা দৈনিক সেবক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তৎকালীন সময়ে তিনি সেবক পত্রিকার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন ও অনহযোগ আন্দোলন বেগবান হয়। একপর্যায়ে ১৯২৭ সালে বেনিয়া ব্রিটিশ সেবক পত্রিকা বন্ধ করেন দেয় এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মুক্ত হয়ে ১৯২৭ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদী প্রকাশ করেন। এ পত্রিকা ইসলামী মূল্যবোধের প্রকাশ ও মুসলিম জাগরণে বিরাট অবদান রাখে। তার সাপ্তাহিক মুহাম্মদীতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবুর রহমান খাঁ, মঈনুদ্দীন হোসাইন প্রমুখ কাজ করতেন। ১৯৩৬ সালের ২১ অক্টোবর মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। সেই সময় বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল এবং দৈনিক আজাদ ছিল বাংলাভাষার প্রথম সংবাদপত্র। মুসলিম লীগের সমর্থন যোগাতে এই বাংলা পত্রিকাটি সেই সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম দিকে এই পত্রিকাটি বঙ্গ এবং আসামের মুসলমানদের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। ১৯৪০ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে দৈনিক আজাদের সম্পাদক পদে নিযুক্ত করেন। এই আজাদ তার প্রকাশলগ্ন থেকে বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলন জোরদার করার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

মওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম লীগে যোগদান করে এর সাংগঠনিক কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। শিখ ও ইংরেজ বিরোধী জেহাদের মুজাহিদ পিতামহ সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের তোরাব আলী খাঁর রক্ত মওলানা আকরম খাঁর ধমনীতে ছিল বলেই তিনি অভিন্ন চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। জাতীয় পরিচয় বজায় রাখার অতন্দ্র প্রহরী মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁর রাজনৈতিক জীবন অবিভক্ত ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেস দিয়ে শুরু হলেও ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সদস্যপদ লাভ করেন। অতঃপর ১৯১৮-২৪ পর্যন্ত খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯২২ সালের ব্যাঙ্গল প্যাক্ট প্রণয়নে তিনি সহযোগী ছিলেন। ১৯২৬ সালে ব্যাঙ্গল প্যাক্ট প্রণয়নে সভাপতি মনোনীত হন। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অন্যান্য সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে আকরাম খাঁ ভারতীয় রাজনীতিতে তার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তিনি স্বরাজ পার্টি এবং কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯২৭ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি গ্রাম্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে তিনি গ্রাম্য রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে সক্রিয় ভাবে মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হন। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন সংস্কার আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ‘বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের' সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন অপরদিকে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ সময় তিনি মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় বিশেষ চেষ্টা করেন। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব নেয়ার সময় থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আযাদী সংগ্রামের এক নির্ভীক পিসাহ্সালার ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁ। আজাদীর পরও তিনি দীর্ঘদিন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মওলানা আকরাম খাঁ অবিভক্ত ‘পাকিস্তান গণপরিষদ' ও তালীমাতে ইসলামিয়া বোর্ডের' সদস্য ছিলেন '৬০-এর দশকে আইয়ুব সরকারের আমলে তিনি ‘ইসলামী উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে এই সংগ্রামী নেতা সক্রিয় রাজনীতি হতে দূরে সরে এলেও তাঁর কলমের সংগ্রাম আজাদ পত্রিকা মারফত অব্যাহত থাকে। বার্ধক্যের ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে তিনি রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। আইয়ুব আমলে সংবদাপত্রের কণ্ঠ রোধের প্রতিবাদে, পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ব্যথা বুকে নিয়ে তিনি জীবনের চরম অবস্থায় পৌঁছেন।

শুধু সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতেই দক্ষ নয়, তিনি এক ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও বাংলা ভাষায় একজন সুসাহিত্যিকও ছিলেন। তার রচিত অতি মূল্যবান গ্রন্থসমূহের মধ্যেঃ ১। মোস্তফা চরিত, ২। মুসলিম বাংলার সামাজিক ইতিহাস, ৩। বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খৃস্টান ধর্ম, ৪। মোস্তফা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, ৫। মুক্তি ও ইসলাম, ৬। তফসীরুল কুরআন সমস্যা ও সমাধান ৭। এসলামের রাজ্য শাসন বিধান, ৮। আমপারার বাংলা অনুবাদ, ৯। সমস্যা ও সমাধান, ১০। মুসলীম বাংলার সামাজিক ইতিহাস এবং ১১। তাফসীরুল কোরআন (১-৫ খন্ড) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, তিনি একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলন অপরদিকে কলমযুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের সার্বিক কল্যাণ চিন্তা ও দেশে ইসলামী জনকল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম।

বাংলার গৌরব মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ ১০১ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালের ১৮ আগষ্ট রাজধানীর বংশালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ১০১ বছর। সংবাদপত্রের জনক মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ'এর আজ ১৪৯তম জন্মবার্ষিকী। জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমাদের আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.