নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নূর মোহাম্মদ নূরু (পেশাঃ সংবাদ কর্মী), জন্ম ২৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রামে

নূর মোহাম্মদ নূরু

দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন

নূর মোহাম্মদ নূরু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা সঙ্গীত জগতের অন্যতম গীতিকার, সুর স্রষ্টা আবদুল আহাদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৫ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৪৮


বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের কিংবদন্তি সঙ্গীত সাধক, সুরকার, রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষক সংগঠক, গায়ক,পরিচালক আবদুল আহাদ। বাংলা গানের ইতিহসে আবদুল আহাদ এক বিরল প্রতিভা। শুধু তাই নয়, তিনি এদেশের আধুনিক ও দেশাত্মবোধক সংগীতের প্রধান পথিকৃৎ, রবীন্দ্র সংগীত চর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। এদেশে রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার ও চর্চায় তিনিই প্রথম উদ্যোগী হন। আমি সাগরের নীল, আমার দেশেরও মাটির গন্ধে, ভ্রমরের পাখনা যতদূর যাক না, অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে অথবা শিল্পী আমি তাই কবিতা ভালোলাগে, তার সুর করা অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কয়েকটি মাত্র। এ ধরনের কয়েক হাজার গানের সুর করেছেন তিনি। বাংলা সঙ্গীত জগতের অন্যতম গীতিকার, সুরকার, কন্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক আব্দুল আহাদ ১৯৯৪ সালের আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। সুর স্রষ্টা আবদুল আহাদের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

১৯১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল আহাদ। তাঁর পিতা আবদুস সামাদ স্কুল পরিদর্শক এবং মা হাসিনা খাতুন প্রগতিশীল ও উদারমনা মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাদের আদি নিবাস ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার ফুকুরহাটি গ্রামে হলেও তাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন পাবনায়। তাঁর পরিবারটি ছিল সে যুগের অত্যন্ত শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা মুসলমান পরিবার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আবদুল আহাদ সবার বড়। আবদুল আহাদের শৈশব কেটেছে নানাবাড়িতে। তাঁর নানা খান বাহাদুর মোহাম্মদ সোলয়মনের চাকুরিটি ছিল বদলীর চাকুরি। তাই নানার এই চাকুরির সুবাদে ছেলেবেলাতেই নানার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন স্থানে; কখনো হুগলী জেলার চূঁচূড়া, কখনো জলপাইগুড়ি, কখনোবা দার্জিলিং। বিভিন্ন সময়ে শৈশবের স্মৃতিচারণে এইসব জায়গার স্মৃতিগুলিই তাই বার বার ফিরে এসেছে। চূঁচুড়াতে বাড়ির পাশে পর্তুগীজদের গীর্জা আর অতি পুরানো কবরস্থান, জলপাইগুড়িতে ছোটবোন মোহসেনা আলিকে সাথে নিয়ে ভরা বর্ষায় বাড়ির সামনের ড্রেন থেকে গামছা দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে মাছের বদলে ব্যাঙাচি ধরা কিংবা ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তেতো কুইনিন গলধকরণ, দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সেখানে প্রতি রবিবারের হাটে শালপাতায় মোড়া মাখন নিয়ে বসে থাকা নেপালী মেয়েদের কথা তাঁর স্মৃতিতে ছিল চির জাগরুক।

শৈশবেই পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার মধ্যে লালিত পালিত হবার কারণে ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্য ও সংগীতের অনুরাগী ছিলেন। প্রায় দিনই ভোরে আধো ঘুমে আর আধো জাগরণে শুনতে পেতেন খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার গলায় কান্তিচন্দ্র ঘোষের লেখা ওমর খৈয়ামের কবিতা ‘রাত পোহালো শুনেছ সখী/ দীপ্ত ঊষার মাঙ্গলিক/লাজুক তারা তাই শুনে কী/ পালিয়ে গেল দিক-বিদিক?’ ক্লাস এইটের পরীক্ষা শেষে আবদুল আহাদ রাজশাহী কলিজিয়েট স্কুলে এসে ভর্তি হন। এখানে এসে সহপাঠী হিসাবে পান হীরেন ভাদুড়ী ও রাধিকামোহনকে। হীরেন ভাদুড়ী চমত্‍কার উর্দু গজল গাইতে পারতেন। প্রতিদিন টিফিনের সময় আবদুল আহাদ বন্ধুদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। এই গানের আসরে তিনি আর হীরেন ভাদুড়ী গান গাইতেন আর রাধিকামোহন বেঞ্চের ওপরে বসে তবলা বাজাতেন। ধীরে ধীরে স্কুলে তাঁদের গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁদের হেড মাষ্টারের নির্দেশে স্কুলের মৌলভী সাহেবের নির্বাচন করা হাফিজের একটি ফার্সী গজল ‘দোশ দিদামকে মালায়ে দাও মায়ে খাজা জাদানদ’ গাইলেন আবদুল আহাদ ও হীরেন ভাদুড়ী। গানের সুর দু’বন্ধু মিলে প্রচলিত গজলের সুরে ঠিক করে নিয়েছিলেন। তাঁদের পরিবেশিত এই গজল ঐ অনুষ্ঠানে সমঝদার সংগীত অনুরাগীদের বিপুল প্রশংসা লাভ করে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এস.এসসি. পাশ করেন

এস.এসসি. পাশ করার পর থেকে আবদুল আহাদের ইচ্ছা ছিল কলকাতায় পড়তে যাবেন এবং সেখানে পড়াশুনার পাশাপাশি ভালো করে গান শিখবেন। তাঁর বাবার অমত থাকলেও মায়ের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। বিশাল কলকাতা নগরীতে এসে প্রথম দিকে কার কাছে গান শিখবেন, সেটাই স্থির করে উঠতে পারছিলেন না। শেষপর্যন্ত জমির উদ্দীন খাঁ সাহেবের পুত্র বালির কাছে গান শিখবেন স্থির করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারেন যে বালির কাছ থেকে সময় পাওয়া কঠিন। তখন শুভার্থীদের পরামর্শে ওস্তাদ মঞ্জুর কাছে কিছুদিন তালিম নেন। ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় অবস্থান কালে তিনি সংগীত জগতের বড় বড় দিকপাল সুবল দাশগুপ্ত, সুধীরলাল চক্রবর্তী, আব্বাস উদ্দীন প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন। ইতিমধ্যে আই.এ. ক্লাসের শেষ দিকে তাঁকে আবার পাবনা চলে আসতে হয়। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তিনি আই.এ. পাশ করেন। এসময় তাঁর নানা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে নিয়ে অন্ধ্র প্রদেশের ওয়ারটেয়ারে যান আবদুল আহাদ। ১৯৩৮ সালে ওয়াল টেয়ারে থাকতেই একদিন কাগজে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসংগীত শেখার জন্য সরকারী বৃত্তি প্রদানের বিজ্ঞপ্তি তাঁর চোখে পড়ে। শান্তিনিকেতন সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলেও কোন কিছু না ভেবেই বৃত্তির জন্য আবেদন করেন তিনি এবং মনোনীত হন। শান্তিনিকেতনে তিনি শান্তি দেব ঘোষ, শৈলজা রঞ্জন মজুমদারের কাছে গান শেখার এবং স্বয়ং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কাছে যাবার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতনের শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি বোম্বেতে কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৪১ সালে বোম্বেতে গিয়ে তিনি কর্মজীবনের শুরুতে বোম্বাই রেডিওতে প্রোগ্রাম করতেন এবং একটি স্কুলে রবীন্দ্র সংগীত শেখাতেন। কৃষ্ণচন্দ্রদের সাথে তিনি ‘তামান্না’ নামে একটি সিনেমাতেও অভিনয় করেন। বোম্বাই জীবন তাঁর ভালো লাগেনি। ২২ শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকীতে বাঙ্গালী ও গুজরাটী মেয়েদের নিয়ে বোম্বাই রেডিওতে একটি প্রোগ্রাম করার পরই তিনি বোম্বাই ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। বোম্বাই ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে বন্ধু সুহাসের বাড়িতে ওঠেন। তখন গান্ধীজীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী সুলেখিকা রানী চন্দের ডাকে তিনি তাঁদের সাথে আন্দোলনে একাত্ম হয়ে কাজ করার জন্য আশ্রম ছেড়ে গ্রামে গ্রামে ‘বন্দে মাতরম’ গান গেয়ে বেড়াতে শুরু করেন। বন্ধু সুহাস গ্রেফতার হবার পর তাঁরা বোলপুরে ফিরে আসেন। তাঁদের প্রতি গোয়েন্দা বিভাগের সজাগ দৃষ্টি থাকায় একদিন অনিলচন্দ্র তাঁকে কলকাতা ফিরে যাবার পরামর্শ দেন। আবদুল আহাদ কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে আসার পর কিছুদিন তিনি বেকার জীবন যাপন করেন

এসময় তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু সন্তোষ সেনগুপ্তের সহায়তায় হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্মকর্তা হেম সোমকে গান শোনাবার সুযোগ পান। হেম সোম তাঁর গান শুনে তাঁকে শুধু শিল্পী নয়, রবীন্দ্র সংগীতের প্রশিক্ষক হিসাবেও তাঁর কোম্পানীতে নিয়োগ দেন। আবদুল আহাদ প্রশিক্ষক জীবনের সূত্রপাত করেন সুধা মুখার্জীকে দিয়ে ‘বাদল ধারা হলো সারা’ ও গহন রাতে শ্রাবণ ধারা’ এই গানদুটি রেকর্ড করার মধ্যে দিয়ে। তাঁর পরিচালনায় সুচিত্রা মিত্রের ‘মরণ রে তুহূ মম শ্যাম সমান’ এবং ‘হৃদয়ের একূল ওকূল’ এই দুটি রবীন্দ্র সংগীত বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত গায়ক পংকজ কুমার মল্লিকের সাথে রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে বিশ্বভারতীর মনোমালিন্য হওয়ার কারণে প্রায় দীর্ঘ ছয় বছর তিনি রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ডিং করা থেকে বিরত ছিলেন। হেম সোম আবদুল আহাদকে দায়িত্ব দেন পংকজ কুমার মল্লিককে দিয়ে তাঁদের কোম্পানী থেকে রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড বের করার ব্যবস্থা করার। আবদুল আহাদ অসাধ্য সাধন করেন। তিনি পংকজ কুমার মল্লিককে রাজি করিয়ে ‘সঘন গহন রাত্রি’ ও ‘তুমি কি কেবলি ছবি’ গান দুটি রেকর্ড করান এবং বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড থেকে পাস করিয়ে আনেন।

(কলকাতায় আবদুল আহাদের সংবর্ধনা। পাশে দাঁড়ানো বাঁয়ে কণিকা বন্দোপাধ্যায় ও ডানে দেবব্রত বিশ্বাস)
আবদুল আহাদ তাঁর সংগীত গুরু শান্তি দেব ঘোষকে দিয়ে ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ‘ এবং ‘বসন্ত কি শুধু ফুল ফোটার মেলা’ রবীন্দ্র সংগীত দুটি রেকর্ড করান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটি ছিল শান্তি দেব ঘোষের জীবনের প্রকাশিত প্রথম রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড। এছাড়াও এসময় সুচিত্রা মিত্রের অনুরোধে আবদুল আহাদ তাঁর বাবা খ্যাতনামা লেখক সৌরেন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়ের গানে সুর দেন ও রেকর্ডিং- এর ব্যবস্থা করেন। বন্ধু সন্তোষ সেনগুপ্তকে দিয়ে আবদুল আহাদ তাঁর নিজের সুরারোপিত প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড এইচ. এম.ভি. থেকে প্রকাশ করেন। গান দুইটি ছিল ‘তুমি আমি দুই তীর সুগভীর তটিনী’ এবং ‘সে পথ ধরে আসনি তুমি’।

কলকাতার কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে আবদুল আহাদ আড্ডা জমাতেন বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। সেখানে সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে দেবব্রত বিশ্বাস কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেবার জন্য গানের রিহার্সেল দিতেন। উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৯৪২-৪৩ সালের ঐ সময়টা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, গান্ধীজী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, কলকাতায় বোমা পড়ছে আর এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পিটিআই এর কর্মী হিসাবে দেবব্রত বিশ্বাস সদলবলে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করে বেড়াতেন পথে প্রান্তরে। তাঁর বাড়িতেই আবদুল আহাদ তখনকার আলোড়ন সৃষ্টিকারী জ্যোতিরিন্দ্র নাথ মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’ বিশেষ করে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে ‘ফ্যান দে ‘ শুনে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হন।

ঠিক সেসময়ই শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেই অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আবদুল আহাদকে তাঁর শিল্পী বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যয় ঢাকা চলে যাবার পরামর্শ দেন। তা ছাড়া ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর সংগীতশিল্পীদের একটি বড় অংশ এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ফলে তখনকার পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকা ও তার বেতার কেন্দ্র প্রায় সংগীতশিল্পীশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাই জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর। সেই সময় পূর্ববাংলার পরিবেশ সংস্কৃতি, বিশেষত,সঙ্গীতের বিকাশের জন্য মোটেও অনুকূল ছিল না। এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে আবদুল আহাদ ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সাজানোর গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি ঢাকা বেতারে প্রযোজক হিসাবে যোগদান করেন। সেসময় রেডিওর অবস্থা ছিল বড় করুণ। শিল্পী সংখ্যা নগণ্য থাকায় একই শিল্পীকে দিয়ে সবধরনের গান গাওয়ানো হতো। সংগীত বিভাগে আরো তিনজন প্রযোজক থাকলেও মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় আবদুল আহাদের ওপর। আবদুল আহাদ কাজ করতে গিয়ে অনুভব করেন একক গানের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনার জন্য সমবেত গানও করা দরকার। আমরা অনেকেই জানি না, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৮ বছর পরও দেশটির সংবিধান এবং নির্দিষ্ট কোন জাতীয় সঙ্গীত ছিল না। তখন ১৯৪৭ সালে নাজির আহমেদ-এর লেখা ‘এই বাংলার সবুজ শ্যামলে’ গানটির সুরারোপ করলেন আবদুল আহাদ। ১৯৫৫ সালে ফার্সি ও উর্দুতে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত তৈরি হবার পূর্ব পর্যন্ত এই গানটি জাতীয় সঙ্গীতের অভাব পূরণ করেছিল। এই গানটি ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত এবং সুর ও মাধুর্যে অপূর্ব।

রবীন্দ্র সঙ্গীতচর্চারও প্রাণপুরুষ তিনি। তিনিই প্রথম রেডিওতে রবীন্দ্র - নজরুলের গান সমবেতভাবে প্রচারের পাশাপাশি অন্যান্য সমকালীন কবিদের দেশাত্মবোধক গান সমবেত কন্ঠে প্রচারের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৮ সালে তত্‍কালীন পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার পর তথ্য মন্ত্রী খাজা শাহবুদ্দীন এক আদেশ জারি করেন, টিভির পর্দায় কোন মেয়ে টিপ পড়তে পারবেনা এবং রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার করা যাবেনা। সরকারী চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও আবদুল আহাদ এর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সাথে একাত্ম ছিলেন। কঠিন আন্দোলন গড়ে ওঠার ফলে এ আদেশ পরে বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়। তিনিই প্রথম রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার আসর শুরু করেন। ২৫শে বৈশাখ ও ২২ শে শ্রবণ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করতেন। এভাবে আবদুল আহাদ এদেশের মুসলমান সমাজকে রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্র চর্চায় ঊদ্বুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভুমিকা পালন করেছিলেন।

১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন তার আগের দিন সরকার টেলিভিশনে ‘শহীদ দিবস’ উপলক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারের অনুমতি দেয়। তবে ‘শহীদ দিবস’ কথাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। আবদুল আহাদের সংগীত পরিচালনায় সেই প্রথম টেলিভিশন থেকে ‘শহীদ দিবস’ উপলক্ষে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর মন্ত্রীপরিষদের সচিব তৌফিক ইমামের নির্দেশে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির স্বরলিপি বিশ্বভারতী সংগীতবোর্ড কর্তৃক অনুমোদন করিয়ে আনতে যান। আবদুল আহাদ দুজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে সাথে নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান এবং তাঁর সংগীত শিক্ষাগুরু শান্তিদেব ঘোষের সহায়তায় গানটি বিশ্ব ভারতী সংগীতবোর্ড কর্তৃক অনুমোদন করিয়ে আনেন।

সমবেত গানের জন্য তিনি হোসনা বানু, আঞ্জুমানারা বেগম প্রমুখকে নিয়ে একটি শিল্পী দলও তৈরি করেছিলেন। ঢাকাকে ঘিরে আবদুল আহাদ এক বিস্ময়কর যুগের প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। ঢাকায় চলে আসার আগে আবদুল আহাদের পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ৪টি রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ডিং করেন। আবদুল আহাদের পরিচালনায় হেমন্তের গাওয়া ‘প্রাঙ্গনে মোর শিরিষ শাখায়’ গানটি রবীন্দ্র সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৯৫৪ সালে ঢাকায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নৃত্য ও সংগীতের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বার্মা, পাকিস্তান , থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বিভিন্ন শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানোর লক্ষ্যে তাঁকে উল্লিখিত দেশসমুহ ভ্রমণ করতে হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি স্পেন সরকারের বৃত্তি নিয়ে একবছরের জন্য মাদ্রিদ যান স্প্যানিশ সংগীত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। স্পেন থেকে দেশে ফিরে তিনি দেশাত্মবোধক গানে সুরারোপে মনোযোগী হন। তাঁর সুরে আবু হেনা মোস্তাফা কামালের লেখা ‘কেন যে আমার কৃষ্ণচূড়ার বনে’ ‘আমি সাগরের নীল নয়নে মেখেছি’ ‘ভ্রমরের পাখনা যতদূর যাক না’ গানগুলি ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠে অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ঢাকা টেলিভিশনের সিগনেচার টিউন করেছিলেন তিনি। টেলিভিশনের প্রতিদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেটি বাজানো হতো। ১৯৬১ এর আন্দোলন মুখর উত্তাল রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সময়ে নতুন প্রেরণা ও চেতনা নিয়ে রবীন্দ্রজন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সহযোগিতায় আবদুল আহাদ টেলিভিশনে বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে হাজার বছরের বাংলা গানের এক অনবদ্য অনুষ্ঠান করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিয়ে গঠিত সাংস্কৃতিক দলের উপনেতা হয়ে গণচীন ভ্রমণ করেন। ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে লেখেন একটি অসাধারণ গ্রন্থ - ‘গণচীনে চব্বিশ দিন’। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সাংস্কৃতিক দলের উপনেতা হয়ে ইরানের ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভ্যালে যোগদান করেন। ষাটের দশকে এদেশে রবীন্দ্রচর্চার প্রচার ও প্রসারে তিনি প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। সরকার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক কারণে রবীন্দ্র সংগীতের ওপর বার বার যে আঘাত এসেছিল তা থেকে তিনি রেডিওকে সুকৌশলে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি রেডিওতে প্রযোজক-সুরকার হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং তাঁর চাকুরির বয়সসীমা পার হবার পরও সাতবার তা বাড়ানো হয়েছিল। রেডিওর কাজের বাইরে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে গান শেখাতেন এবং প্রচুর বই পড়তেন।

এদেশের দেশাত্মবোধক ও আধুনিক বাংলা গানের পথিকৃৎ আবদুল আহাদ তার বর্ণঢ্যময় কর্মজীবনের স্বীকৃতি সরূপ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। যার মধ্যে ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতার অল বেঙ্গল মিউজিক প্রতিযোগিতায় ঠুংরী ও গজলে ১ম পুরস্কার, ১৯৬২ সালে তত্‍কালীন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তামাঘা- ই - ইমতিয়াজ, ১৯৬৯ সালে তত্‍কালীন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার সিতারা - ই - ইমতিয়াজ, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৪ সালে কাজী মাহবুল্লাহ পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক উল্লেখযোগ্য।

অমর সুরস্রষ্টা, এদেশের বাংলা আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানের জনক আবদুল আহাদ ১৯৯৪ সালের ১৫ মে পরলোক গমন করেন। তাঁকে মিরপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তাঁর প্রয়াণের মধ্যে দিয়ে বাংলা গানের এক স্বর্ণযুগের অবসান ঘটে। তাঁর সৃষ্টিরা বেঁচে থাকলেও ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যান তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় এ কিংবদন্তি শিল্পী সুরকারকে ভুলে আছে আজকের প্রজন্ম। আজ তাঁর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। সুর স্রষ্টা আবদুল আহাদের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৫:২৩

আবুল খায়ের মোহাম্মদ রফিকুল হক বলেছেন: শ্রদ্ধা রইলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.