নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই। ভবিষ্যৎকে জানার জন্য আমাদের অতীত জানা উচিতঃ জন ল্যাক হনঃ ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সামুর পাঠকদের জন্য আমার নিয়মিত আয়োজন ‘ইতিহাসের এই দিনে’। জন্ম-মৃত্যু, বিশেষ দিন, সাথে বিশ্ব সেরা গুণীজন, এ্ই নিয়ে আমার ক্ষুদ্র আয়োজন
আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের একটি অবিস্মরনীয় নাম টি.এস.এলিয়ট। পুরো নাম টমাস র্স্টানস এলিয়ট। তিনি ছিলেন আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান লেখকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার এবং শক্তিমান সমালোচক। কবি হিসেবে সারাবিশ্বে এক নামে পরিচিত টি,এস, এলিয়ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফাটল ধরা সমাজের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে তার কবিতায়। এলিয়ট ছিলেন মূলতঃ নগরজীবনের কবি। নগরজীবনের নেতিবাচক বিষয়কেই তিনি অপূর্ব শিল্পকুশলতায় তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে। জীবনের যন্ত্রনা, নগরজীবনের হতাশা,দূনীতির কর্দযময়তা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। কবিতায় তৎকালীন মানুষ ও সমাজের বাস্তবচিত্র পূর্ণাঙ্গরূপে তুলে ধরতে পেরেছিলেন বলেই তার নাম একটি যুগের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজী সাহিত্যের এই মহান কবি ১৯৬৫ সালের আজকের দিনে তিনি লন্ডনের কেনসিংটনে মৃত্যুবরণ করেন। আজ কবির ৫০তম মৃত্যুবাষিীকী। বহুমুখী প্রতিভাধর ইংরেজ সাহিত্যিক টি,এস,এলিয়টের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বহুমুখী প্রতিভাধর কবি এলিয়ট ১৮৮৮ সালের ২৬ আগস্ট যুক্তরাস্ট্রের শিল্পনগরী মিসৌরীর সেন্ট লুইসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত দর্শন নিয়ে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে পড়া লেখা করে চার বছরের বদলে তিন বছরে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যচেলর ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯০৯ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত তিনি ফিলোসফি অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করেন। এরপর ১৯১০ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত প্যারিসের সারর্বোনে দর্শন নিয়ে পড়েন। এ সময় দার্শনিক হেনরি বাগসোঁর ক্লাস করেন। পরে হার্ভাডে ফিরে এসে ১৯১১ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃত নিয়ে পড়েন। ১৯১৪ সালে বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডের মের্টন কলেজে পড়তে যান। অক্সফোর্ড তার খুব একটা পছন্দ না হলেও ১৯২৭ সালে ৩৯ বছর বয়সে বৃটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে বাকি জীবন কাটান। এই সময় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, সেটা হলো তাঁর ক্যাথলিসিজমে ধর্মান্তর। এরও একটা বিশেষ প্রভাব পড়েছে তাঁর কবিতায়। ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতায় এলিয়টকে দেখা যায় তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু ওই এলিয়টই তাঁর আরেকটি দীর্ঘ কবিতা ‘ফোর কোয়ারটেটস্’-এ এসে সেই পথটাই যেন খুঁজে পেলেন ধর্মে ও আধ্যাত্মিকতায়। কিন্তু সে পথ কতটা মুক্তির আর কতটা পিছিয়ে যাওয়ার, সে প্রশ্নটা অবশ্য থেকেই যায়। এলিয়টের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের কাছে।হার্ভাড গ্রাজুয়েট এলিয়টের পড়াশুণোর বিষয় ছিলো ভাষা ও সাহিত্য । তবে তিনি উৎসাহী ছিলেন তুলনামুলক ভাষা সাহিত্যের প্রতি । ১৯১৫ সালের দিকে তার কবিতা দি লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক এর মাধ্যমে সবার নজর কাড়েন। ১৯১৫ সালে ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ কবিতার মাধ্যমে সবার নজর কাড়েন। এরপরে একে একে প্রকাশিত হয় বিশ্ববিখ্যাত সব কবিতা। এদের মধ্যে আগে উল্লেখকৃত দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড (১৯২২), দ্য হলো মেন (১৯২৫), অ্যাশ ওয়েন্সডে (১৯৩০), জার্নি অব দ্য ম্যাগি (১৯২৭), আ সং ফর সিমিওন (১৯২৮), ওল্ড পোসম’স বুক অব প্রাকটিক্যাল ক্যাটস (১৯৩৯), লিটল গিডিং (১৯৪২)ও ফোর কোয়ার্টার্স (১৯৪৫) অন্যতম। তার নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথেড্রাল (১৯৩৫)। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ হলো‘ ট্রাডিশন এন্ড দি ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’।
এলিয়টকে বলা হয় কবিদের কবি। তার আগে বোদলেয়ার, মিল্টন এবং দান্তেকেও এই রকম বলা হতো। ইংরেজ সাহিত্যের সমালোচকগণ স্বীকার করেন যে,জন মিল্টন এবং ইয়েটস ছাড়া এলিয়টের মতো এমন শিক্ষিত কবির আগমন আর ঘটেনি। শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়- গোটা বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনেও তিনি ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জল। বাংলা কবিতা এলিয়টের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। বাংলা কবিতার পাঠকেরা জানেন, তিরিশের আধুনিক কবিরা কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন এলিয়টের কবিতা পড়ে। রবীন্দ্রনাথও এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছেন। এলিয়টের এই যে বৈশ্বিক প্রভাব, সেটি আসলে নিহিত তাঁর লেখনীর ভেতরেই। এলিয়ট বিংশ শতাব্দীর কবিতায় যে ধারাটির সংযোজন করেন তাতে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যটি ব্যাপক হয়ে পড়ে, যুক্তি আকর্ষণ প্রয়োজনীয়তা পায়। এলিয়টের আরো একটি বিশেষ অবদান এই যে, তিনি ইংরেজি কাব্যের ভাষাকে সংষ্কার করেছেন। এলিয়ট কবিতার ভাষাকে নিয়ে এসেছিলেন মুখের ভাষার কাছাকাছি। সাহিত্যে বিপ্লবের মানেটা আর কিছুই নয়, তা হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষার কাছে ফিরে আসা- এই উপলব্ধিটুকু এলিয়টই বারবার আমাদেরকে দিয়েছেন।
এলিয়টের কাব্যে, বিশেষ করে ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’কবিতায় আমরা দেখি আধুনিক মানুষের কোন পূর্ণাঙ্গ ভূখণ্ড নেই। যে জমিতে মানুষ পড়ে আছে সেখানে ফসল নেই, রস নেই, জল নেই, গাছপালা নেই, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো নির্মল বাতাস নেই, কথা বলার মানুষ নেই। কেননা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই পুড়ে গেছে। দগ্ধ জমিতে মানুষও অনুপস্থিত। যে সব চরিত্রকে এখানে দেখা যায় তাদের চেহারাটা অনেকটা ভুতের মতো। আর ভুতের মতো বলেই তাদের কোন নির্দিষ্ট আবাস নেই, বিনাশও নেই। এলিয়ট কবিতায় এ ইঙ্গিতটা দেন যে, মৃত্যুবরণ করার ক্ষমতাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে এবং এ কারণে বোতলের ভেতরের ভুত কেবল পুড়তে থাকবে। এর কোন পরিত্রাণ নেই, পথও নেই বেরিয়ে পড়বার।
(TS Eliot and his second wife Valerie)
‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ কবিতার দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই এলিয়ট একটি রমণীয় চেয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বর্ণনাতে মনে হয় যেন ওটি চেয়ার নয়, সিংহাসন। আর যিনি চেয়ারে বসে আছেন সেই মানুষটি মুখ্য নয়, এমনকি মুখ্য নয় তার বসে-থাকাটাও; বড়ো বিষয় হচ্ছে চেয়ারটি নিজেই। পণ্য বিকশিত হবে, পুঁজি ফুলেফেঁপে উঠবে; কিন্তু মানুষ সম্ভাবনাহীন থাকবে, আটকে থাকবে বোতলের ভেতরে অথবা কারাগারে অথবা বিস্তীর্ণ পতিত জমিতে – এই পুঁজিবাদী ধারণার উর্দ্ধে উঠতে পারেননি বলেই এলিয়ট চিহিৃত করতে পারেননি মানুষের মুক্তির পথটা। সংকটের চিত্র তিনি এঁকেছেন, কিন্তু সংকটের কারণগুলো তিনি গভীরভাবে নির্দেশ করতে পারেননি। আর কারণগুলো ধরতে পারেননি বলেই, তাঁর হাজারো ইতিবাচক ও মৌলিক অবদান স্বত্বেও, যখন মুক্তি খোঁজার তাগিদ এলো, তখন মুক্তির নামে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে, যেতে পারেননি সামনে।
এ রকমই আরেকটি মর্মন্তুদ কাহিনী আমরা দেখি এলিয়টের ‘প্রুফকের প্রেমসঙ্গীত’ নামের কবিতাটিতে। সেখানে ‘প্রুফক’ নামের একজন মানুষ এক অসহায় বৃত্তে আটকা পড়ে আছে। ও কথা বলতে চায়, কিন্তু তার পৃথিবীতে সংলাপ নেই। সেখানে গতি থাকলেও থাকতে পারে, তবে গন্তব্য অনুপস্থিত। এই বদ্ধ, অসহায়, সিদ্ধান্তহীন মানুষটার মর্মবেদনা এলিয়ট বুঝতে পারছেন, কিন্তু যেন মুক্ত করতে পারছেন না তাকে। প্রুফক আটকে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে এলিয়টও। আর এই সীমাবদ্ধতার কারণে বিচ্ছিন্নতাও বেড়েছে। বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করার জন্য সামনের দিকেই যে যেতে হবে, পেছনে নয়- এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাটা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে আসেনি বলেই শুধু এলিয়ট নন, তাঁর সমসাময়িক আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকেরাও মানুষের মুক্তির পথটা নির্দেশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এলিয়ট তাঁর বিভিন্ন কবিতায় একজন আধুনিক মানুষের যে সামগ্রিক সংকটের চিত্র তুলে ধরেছেন ওটি আসলে পুজিঁবাদেরই সংকটের চিত্র। তাঁর একটি ইতিবাচক অবদান এইখানেই যে, তিনি পুজিঁবাদের সংকটকে কাব্যিক অভিজ্ঞতায় ধারণ করেছেন। পণ্য ও পুঁজিকে মুখ্য করতে গিয়ে মানুষকে গুরুত্বহীন, পতিত করার পুজিঁবাদের যে স্বভাবজাত মানসিকতা, ওই প্রপঞ্চটিই ঘুরে ফিরে আসে তাঁর কবিতায়। সমস্ত ‘ওয়েইষ্ট ল্যান্ড’জুড়েই মানুষ বিরাজ করে পতিত প্রাণী হিসেবে। যন্ত্র সেখানে উঠে আসছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু মানুষ শুধুই পড়ে যাচ্ছে ও পিছিয়ে পড়ছে। এলিয়টের পৃথিবীতে পণ্যের চোখ-ঝলসানো চাকচিক্য আছে, যেটিকে আবরণ হিসেবে মেলে ধরে পুজিঁবাদ আড়াল করে রাখে তার অন্তর্গত সংকট ও প্রতারক চেহারাটি।
আধুনিক সাহিত্যে অভূতপূর্ব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৮ সালে এলিয়ট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এবং একই বছর অর্ডার অব মেরিট পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫১ সালে পান লিজিওন ডি’অনার এবং ১৯৬৪ সালে পান প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম। ১৯৬৫ সালের ৫ জানুয়ারী এই মহান কবি মৃত্যুবরণ করেন। আজ কবি এলিয়টের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। কবিদের কবি টি,এস,এলিয়টের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
©somewhere in net ltd.