নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বাংলাকে ভালবাসি
আজ থেকে ৪২ বছর আগে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। মুজিব ফিরে আসায় শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়নি, একটি মহাদুর্যোগের হাত থেকেও দেশটি সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। বিশ্ব ইতিহাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাকারী মিত্রবাহিনীর তিন মাসের মধ্যে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোন নজির নেই। শুধু শেখ মুজিব ফিরে এসেছিলেন বলেই ভারতীয় মিত্রবাহিনী তিন মাসের কম সময়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। একজন বিদেশি ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, 'ভারতীয় সৈন্যদের তিন মাসের মধ্যে বিদায় করে মুজিব বাংলাদেশকে দু'বার স্বাধীন করেছেন।' শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই অল্প সময়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
১৬ ডিসেম্বর '৭১ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাঙালি বিজয় অর্জন করে। কিন্তু বাঙালি জাতির নেতা নবজাত রাষ্ট্রের জনক তখনো পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী। তিনি জীবিত কি মৃত, কেমন আছেন শত্রুর কারাগারে_ এ ব্যাপারে তখনো কেউ কিছু জানতো না। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতির মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার করাচি বিমানবন্দরে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ করে '৭১-এর ২০ এপ্রিল। ২৭ মার্চ রেডিও ভাষণে পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান হুঙ্কার দিয়ে বলেন, 'শেখ মুজিব জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। এর জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে।'
১৬ এপ্রিল '৭১ পাকিস্তানের জং পত্রিকায় বলা হয়, 'পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে বন্দী করেছে। বিশেষ সামরিক আদালতে তার বিচার হবে। কারণ ভারত ও কতিপয় রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে জাতিবিরোধী কাজ করেছেন।' ১৮ এপ্রিল টোকিওর পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এমএম হোসেন জাপানের একটি পত্রিকাকে জানায়, 'পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিব পাকিস্তানি সরকারের হাতে বন্দী। ৫ মে পাকিস্তান বেতার থেকে আবার জানানো হলো, শেখ মুজিব জীবিত আছেন। শীঘ্রই তার বিচার হবে।'
এসব খবরের পর বিশ্ববাসী নিশ্চিত হলো, শেখ মুজিব জীবিত আছেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সমগ্র বিশ্বে জনমত গড়ে উঠল। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের মুক্তিদানের জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানানো হয়। ১৯ জুলাই ইয়াহিয়া খান লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, 'খুব শীঘ্রই সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। তিনি যে অপরাধ করেছেন_ এ জন্য তার মৃত্যুদ- হতে পারে।' ৫ আগস্ট পাকিস্তান সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর বিচারের কথা জানিয়ে দেয়। এর কিছুদিন পর তেহরান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেন, 'অক্টোবরের জাতীয় সংসদ অধিবেশন পর্যন্ত শেখ মুজিব বেঁচে থাকেন কিনা বলা কঠিন।'
'৭১-এর ৮ আগস্ট ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আবেদন জানান। এত কিছুর পরও ১১ আগস্ট '৭১ সেনানিবাসের গোপন আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয়। এ বিচার প্রহসন চলা অবস্থায় বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ, সংবাদপত্র ও সরকারগুলো বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এ অবস্থায় ৩ ডিসেম্বর '৭১ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে। ২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া ক্ষমতাচ্যুত এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। প্রেসিডেন্ট হয়ে ভুট্টো বিশ্ববাসী ও পাকিস্তানের জনগণের চাপ এবং অবশিষ্ট পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
৩ জানুয়ারি (১৯৭২) বিকেল বেলা করাচি শহরের নিস্তার পার্কে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মি. ভুট্টো ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদান করা হবে। বক্তৃতা প্রসঙ্গে মি. ভুট্টো বলেন, '২৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তার প্রথম প্রশ্ন ছিল 'আমি কি মুক্ত?' আমি তাকে বলেছি, 'আপনি স্বাধীন। আপনি যদি আমাকে কিছু সময় দেন, তাহলে এ ব্যাপারে আমার জনগণের মতামত যাচাই করতে পারব। তাদের সম্মতি ছাড়া আমি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাই না।... কেউ কেউ বলেন, শেখ মুজিব আমার 'তুরুপের তাস' এবং সুবিধা আদায়ের জন্য আমি তা ব্যবহার করতে পারি। অন্যরা বলেন, 'আমরা কেন সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করব?' আমি তাদের সঙ্গে একমত। শেখ মুজিবকে ব্যবহার করে আমি লাভজনক কিছু করতে চাই না। এ ব্যাপারে আপনারা একমত কিনা?'
বলাবাহুল্য, বিপুল জনতা শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের প্রশ্নে সম্মতিসূচক সাড়া দেয়।
উলি্লখিত রিপোর্টের শেষদিকে 'দি গার্ডিয়ান' পত্রিকার সংবাদদাতা বলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে শেখ মুজিবকে একটি বিশেষ বিমানযোগে পাকিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। (দি গার্ডিয়ান, ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২)
বঙ্গবন্ধুকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় : 'শেখ মুজিবই বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তার বিস্ময়কর বাগ্মিতার মাধ্যমে তিনি বাঙালিদের অসন্তোষকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে পরিণত করেন। তার বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভবিষ্যতে সুদিনের মুখ দেখার ভরসা পায়। তাকে যদি হত্যা করা হতো কিংবা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী হিসেবে রাখা হতো, তাহলে বাংলাদেশ সরকার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মারাত্মক নেতৃত্ব সংকটের মুখোমুখি হতো। তার মুক্তি বাংলাদেশকে বাঁচার একটি সুযোগ দিয়েছে।' (দি গার্ডিয়ান, ৪ জানুয়ারি ১৯৭২)
৮ জানুয়ারি '৭২ সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডন আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।' সকাল সাড়ে ৬টার সময় বঙ্গবন্ধু হিথরো বিমানবন্দরে পেঁৗছান।
'স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড' (মেট্রোপলিটান পুলিশের তৎকালীন হেডকোয়ার্টার্স) থেকে পুলিশ অফিসার পিটার ল্যাংলি টেলিফোনযোগে প্রবাসী বাঙালিদের নেতৃত্বদানকারী 'স্টিয়ারিং কমিটি'র ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নানকে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ জানান। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম থেকেই মি. ল্যাংলি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে সাহায্য ও পরামর্শ দিয়েছেন। রাষ্ট্রদূত রেজাউল করিম বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান।
সকাল ৮টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন 'অ্যাকশন কমিটি'র নেতৃবৃন্দ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খান, লন্ডন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট মিনহাজউদ্দিন এবং বিচারপতি চৌধুরীর বিশ্বস্ত সহযোগী শেখ আবদুল মান্নান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থও বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এসে হাজির হলেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে একটি অভিনন্দন বাণী পাঠান। এ বাণীতে তিনি বলেন : 'আপনি বন্দী ছিলেন কিন্তু আপনার চিন্তাশক্তি ও চেতনাকে কারারুদ্ধ করা সম্ভব নয়। আপনি নিপীড়িত জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।'
কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি 'গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট' বলে বঙ্গবন্ধুকে সম্ভাষণ করেন।
পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়, 'গত দশ-এগারো মাস ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকার ফলে পরিশ্রান্ত বাঙালিরা দলে দলে এসে হোটেল ঘিরে ফেলে। মুহুর্মুহু 'জয় বঙ্গবন্ধু' ও 'জয় বাংলা' সেস্নাগান দিয়ে তারা আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে। হোটেলের বাইরে যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই অগণিত লোক। বঙ্গবন্ধুর শরীর অত্যন্ত দুর্বল। তা সত্ত্বেও তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তার গায়ে শক্তি নেই; তিনি থর থর করে কাঁপছেন। তার সঙ্গীদের কেউ কেউ বললেন, আপনি তো পড়ে যাবেন। তিনি কারও কথা শুনলেন না। জানালা থেকে ফিরে এসে কয়েক মিনিট বসে আবার জানালায় ফিরে গিয়ে তিনি হাত তুলে সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন।'
৮ জানুয়ারি (১৯৭২) সন্ধ্যা বেলা বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। ঘরোয়া আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
মি. হিথ বঙ্গবন্ধুকে বলেন, স্বীকৃতিদানের আগে পররাষ্ট্র দফতরের কার্য পরিচালনা সম্পর্কিত আচরণবিধি (প্রটোকল) অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারকে দেখতে হবে, নতুন সরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের সমর্থনপুষ্ট এবং পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী কিনা।
'দি সানডে টাইমস'-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা উলি্লখিত তথ্য প্রকাশ করে বলেন, মি. হিথের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর শেখ মুজিবুর রহমান পরিষ্কার বুঝতে পারেন, ব্রিটেন বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন।
সংবাদদাতা আরও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে বলে ব্রিটিশ সরকারি মহল মনে করে। (দি সানডে টাইমস, ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২)
পরবর্তীকালে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনাকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী কখন প্রত্যাহার করা হবে। বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যখনই চাইবেন, তখনই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে।
বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে আরও বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে তিনি ভালো সম্পর্ক রাখতে চান, তবে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের প্রশ্নই ওঠে না।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়ির দরজা প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে খুলে দেন। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন ১৯৮০ সালে এক বক্তৃতায় বলেছেন, '১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন আসেন আমি বিদেশের হোটেলের টেলিভিশনের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখেছি। শেখ মুজিব তখন ঘোষিত রাষ্ট্রপতি হলেও সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি নন। শেখ মুজিবের গাড়ি যখন থামল, দেখা গেল ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দুয়ার খোলা হলো। একটা লোক বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুললেন। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন। ওই ব্যক্তি আর কেউ নন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। যে সাম্রাজ্যে কোনদিন সূর্য অস্ত যেত না সেই সাম্রাজ্যের মধ্যমণি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আমাদের পর্ণকুটির থেকে আগত একজন সাধারণ কর্মী যিনি দলপতি হতে রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি হতে রাষ্ট্রপিতা হয়েছিলেন, তাকে অভ্যর্থনার জন্য দুয়ারে দাঁড়িয়েছিলেন। এ দৃশ্য কোনদিন ভুলবো না।' (১৬ মার্চ ১৯৮০)
১০ জানুয়ারি (১৯৭২) দি ডেইলি টেলিগ্রাফ এবং দি গার্ডিয়ান বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করে। কারামুক্তির পর দেশে ফেরার আগে লন্ডনে এসে বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন বলে প্রথমোক্ত পত্রিকার সম্পদকীয় নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়। দ্বিতীয় পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'শেখ মুজিবের মুক্তিলাভ প্রধান এবং সর্বোত্তম ব্যাপার। এর ফলে বাংলাদেশের টিকে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শেখ মুজিবই জানেন কী করে বাঙালির আদর্শ বাস্তবায়িত করতে হবে। তিনি এখন বাঙালিদের কাছে ফিরে গিয়েছেন।' এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরও বলা হয়, 'লন্ডনে পেঁৗছানোর পর শেখ মুজিবকে শারীরিকভাবে সুস্থ এবং ধীর-গম্ভীর বলে মনে হয়েছে। তার চারদিকে ছিল কর্তৃত্বের আভা। তিনি কাউকে ভীতি প্রদর্শন করেননি, কোন আদর্শও তিনি বিসর্জন দেননি। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, 'ক্যারিসম্যাটিক', উদারপন্থি, বিচক্ষণ এবং কিছুতেই অন্যের হাতের পুতুলে পরিণত হবেন না ইত্যাদি গুণের অধিকারী যে ব্যক্তিকে ইয়াহিয়া খান কারারুদ্ধ করেছিলেন, সেই একই রাজনীতিবিদ ফিরে এসেছেন বলে মনে হয়েছে। শেখ মুজিবকে সাফল্য অর্জনের সুযোগ দিতেই হবে। মি. হিথ তাকে অন্যদের চেয়ে বেশি জানেন। বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য পেতেই হবে। রাষ্ট্র হিসেবে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বৈদেশিক সাহায্যের মতো অবশ্য প্রয়োজন। ব্রিটেন শীঘ্রই স্বীকৃতি দান করবে। কিন্তু পররাষ্ট্র দফতরের কার্য পরিচালনা সম্পর্কিত পুরনো আচরণবিধি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়। ঢাকা বিমানবন্দরে পেঁৗছানোর পর মাটিতে তার পা রাখা মাত্রই এই নতুন রাষ্ট্র একটি বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তখনই হবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের উপযুক্ত সময়।' (দি গার্ডিয়ান, ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২)
১৯৭২ সালের ১০ জানুযারি ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিমানযোগে লন্ডন থেকে দিলি্ল হয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন। বিমানবন্দরে তাকে যে অভ্যর্থনা জানানো হয় তা ছিল তুলনাবিহীন। বাংলাদেশের অন্যান্য নেতা এবং বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের পর মিছিল সহকারে তাকে শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তার দু'পাশে অবস্থান গ্রহণকারী লক্ষাধিক নাগরিক তাকে 'জয় বাংলা' ও 'জয় বঙ্গবন্ধু' সেস্নাগান দিয়ে স্বাগত জানায়।
১১ জানুয়ারি (১৯৭২) দি টাইমসের সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবের ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন। তার প্রত্যাবর্তন অখ- পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে_ এ কথা সম্ভবত বলা যাবে না। আইনগতভাবে উভয় অংশের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে অনেকগুলো জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য অপেক্ষা করা প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিভাজন, অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ এবং উভয় অংশ কর্তৃক পরস্পরকে স্বীকৃতি দান সম্পর্কিত প্রশ্ন। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের বিলুপ্তি ঘটেছে এবং পূর্ব বাংলা বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে এবং নির্মম ও দীর্ঘস্থায়ী উৎপীড়নের মাধ্যমে যারা জনগণকে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করেছে, তাদের কবল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে শেখ মুজিব যেদিন রেসকোর্স ময়দানে আবেগজড়িত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, সেদিনই বাংলাদেশের অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের অবসান হয়।' (দি টাইমস, ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২)
ঐতিহাসিক দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জয় বাংলা।
[লেখক : মোহাম্মদ শাহজাহান, সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]
১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৯
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: আপনি লিখুন। আমি যোগ করে দেয়ার মত হলে যোগ করে দিব।
২| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫২
অজানাবন্ধু বলেছেন: ঐতিহাসিক এই দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জয় বাংলা।
ধন্যবাদ ভাইজান।
+++
১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২০
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: জয় বাংলা।
আপনার জন্য শুভকামনা।
৩| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৫৫
পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: এবং অশ্র জমা এবং সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন ।
১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২০
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: হুমম। করেছিলেন।
৪| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:১৪
কাজের কথা বলেছেন: এর বিপরীতে আরো একটি তিক্ত সত্য আছে, যা জাতি আজও জানে না"
আপনি জানলে তারাতারি জানান প্লিজ।
১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২১
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: উনাকে সেই কথা বলালাম। তিক্ত সত্যটা কি জানালে পাঠক খুশি হবে।
৫| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:২৮
জেনারেশন সুপারস্টার বলেছেন: সেদিন যে তরুণ তাবৎ দুনিয়ার দুর্ধর্ষ একটি সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হতে এবং মুক্ত হয়ে নিজ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে জাতিকে একতাবদ্ধ করার স্বপ্ন দেখাত সে স্বপ্নকে বাস্তবায়নের দ্বায়িত্ব আমাদের সকলের।তিনি আছেন বাংলার ঘরে ঘরে,বাঙ্গালীর অন্তরে।
১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৪
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী, অমর।
বাংগালী জানেনা কি হারিয়েছিল। কি নেই।
আজ বাংগালীকে হা হুতাশ করতে হতোনা যদি তিনি থাকতেন।
আজ আমরা একটা উন্নত জাতি হতাম যদি তিনি থাকতেন।
যারা বাকশালের বিরুদ্ধে বলে তারা ইতিহাস ঘেটে জানতে চায়নি কেন এই বাকশাল?
বাকশাল হলে আমাদের কি লাভ হত তা বাংগালী জানবেনা আর।
৬| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৩
াহো বলেছেন: গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর বিশ্বব্যাংকের পরিদর্শকদের একটি বিশেষ টিম কিছু শহর প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, ওগুলোকে দেখতে ভুতুড়ে নগরী মনে হয়। এরপর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এহেন ধ্বংসলীলার ক্ষান্তি নেই। ৬০ লাখ ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ২৪ লাখ কৃষক পরিবারের কাছে জমি চাষের মতো গরু বা উপকরণও নেই। পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুল-কালভার্টের চিহ্নও নেই এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগেও অনেক বাধাবিঘ্ন। এক মাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত দেশের ওপর নির্বিচার বলাৎকার চলেছে। যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (কার্যত প্রতিটি ব্যবসা ক্ষেত্রই পাকিস্তানিদের দখলে ছিল) তাদের সব অর্থ-সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। যুদ্ধ শেষে চট্টগ্রামে পাকিস্তান বিমানের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭ রুপি জমা পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকার প্রকট সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেটকারগুলো তুলে নেওয়া হয়, গাড়ির ডিলারদের কাছে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে নেওয়া হয় এবং এগুলো নৌবন্দর বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেওয়া হয়
Click This Link
১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৭
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: পাকিস্তান ভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তান ছিল একটা উষর মরু। আর আমরা ছিলাম সুজলা, সুফলা একটি দেশের মালিক। কৌশলে কলকাতা ও আসাম সহ বাংলার বিরাট একটা এরিয়া ভারতকে দিয়ে দেওয়া হয়। যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। কলকাতা ও আসাম যদি বাংলাদেশ অংশে থাকতো পাকিস্তানের রাজধানী হত কলকাতা। আর আমাদের থেকে এত সম্পদ লুটের সুযোগ তাদের হতনা।
বাংলাদেশের লুটকৃত অর্থদিয়েই সমৃদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান। আর তাদের রেখে যাওয়া জারজ সন্তানরা আজও পাকিস্তান পাকিস্তান বলে গলা ফাটায়।
৭| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:৫৪
মুফতি বাবা বলেছেন: তেলের দাম কেন ৯ বার বাড়ছে এখন বুজতে পারতেছি| আর হাসিনার এইবারের লুট-পাটের কিছু পয়সা যে নিম্ন লেভেলের আওয়ামী কর্মীদের পকেটেও এসেছে সেইটা ক্লীয়ার হইলো|
১১ ই জানুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:২১
জিয়া চৌধুরী বলেছেন: বুঝতে পারার জন্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ২:৩৭
বাংলার হাসান বলেছেন: মুজিব ফিরে আসায় শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়নি, একটি মহাদুর্যোগের হাত থেকেও দেশটি সেদিন রক্ষা পেয়েছিল[/sb
এর বিপরীতে আরো একটি তিক্ত সত্য আছে, যা জাতি আজও জানে না।
সে সব বিষয় নিয়ে কিছু লিখেন।