নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের পরিচয় লেখার মত বিখ্যাত বা বিশেষ কেউ নই। অতি সাধারণের একজন আমি। লিখতে ভাল লাগে। কিন্তু লেখক হয়ে উঠতে পারি নি। তবে এই ব্লগে আসা সে চেষ্টাটা অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য নয়। মনে হল ভাবনাগুলো একটু সশব্দে ভাবি।
ভোর চারটা ঊনপঞ্চাশে ঢাকায় পৌঁছে দিল বাসটা। গুলিস্তান মোড়ে নেমেই দেখি সামনে এক মাঠাঅলা। দেখে খেতে ইচ্ছা করল। খেয়েও ফেললাম এক গ্লাস। দাম নিল দশ টাকা। আগে চিত্তদার কাছ থেকে খেতাম এক টাকায়। পরে দু টাকায়। চিত্তদা রোজ ভোরে মৌচাকের উল্টোপাশে, যেখানটাতে রামপুরা যাওয়ার মুড়ির টিন নামে পরিচিত বাসটি থামত, সেই গোসাইবাড়ির ফুটপাতটাতে বসত মাঠা বেচতে। এখন গোসাইবাড়ি নেই। গোসাইবাড়ি এখন ফরচুন শপিং মল। আর এখন দশ টাকায় যে মাঠা খেলাম, তাতে সে স্বাদও নেই। কেমন যেন পানসে।
মাঠা খেয়ে রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু পর বিভ্রান্তি লাগল। এগুচ্ছি তো কিন্তু কোন্ দিকে যাচ্ছি! তখনও পাঁচটা বাজে নি। অন্ধকার চারপাশ। ফুটপাতের দিকে এগিয়ে দোকানের সাইনবোর্ডে ঠিকানায় লেখা সিদ্দীক বাজার! হায় হায়! আমি সিদ্দীক বাজারে কি করছি! বোঝা গেল ঘুমঘোর কাটে নি তখনও। ঘুরে উল্টোদিকে আবার হাঁটা। এটাই সঠিক দিক আসলে। গুলিস্তান মোড়টা পেরুলাম আবার। সামনে কয়েকটা লোকাল বাস। হেল্পার গেটে দাঁড়িয়ে ‘শাহবাগ শাহবাগ’ বলে চেঁচাচ্ছে। মালিবাগেরও থেকে থাকবে। আমি বাস খুঁজতে গেলাম না। রিকশা নেওয়ারও ইচ্ছে নেই। হেঁটে ফিরব। নইলে এত ভোরে ফিরলে কে দরজা খুলে দেবে! হাঁটলে পৌছুতে দেরী হবে। আর দেরী করে পৌঁছুলে বাড়ির লোকেদের ঘুম থেকে জাগবার সম্ভাবনাও বাড়বে।
হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তান মাজারের কাছে এসে দেখি সেখানে ভন্ডামী চলছে। রাষ্ট্র এদের পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও প্রশ্রয় তো দিচ্ছে। তাহলে এরা ভন্ডামী করবে না কেন! সময় কাটাতে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভন্ডামী দেখতে লাগলাম। বিশাল এক মোমবাতি জ্বলছে। কজন নারীপুরুষ সেটা ঘিরে আছেন। ওর ঠিক পাশেই এক লোক মোমবাতি, আগরবাতি, মানত করে বাঁধবার বিশেষ সূতা ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। দেখা গেল বেচাবিক্রি খারাপ না। এত ভোরেও ক্রেতা আছে। সূতা কিনছে তারা। পাশে দাঁড়ানো এক নারীসূতা বাঁধবার দোয়া আর নিয়ম বলে দিচ্ছেন। আমি কৌতূহল নিয়ে দেখছি। ভন্ডলোকেরা তখন বারবার আমার জুতোর দিকে তাকাতে লাগল। কিন্তু কিছু বলল না। বললে অবশ্য জুতো খুলে বগলে নিয়ে ওদের পাশে বসে পড়বার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কিছুই বলল না ওরা। মাজারের পাশের রাস্তাটার ওমাথায় গুলিস্তান সিনেমা হল। এখন নেই। সিনেমা হল তুলে দেওয়ার সংস্কৃতির প্রথম দিককার শিকার গুলিস্তান সিনেমা। পৃথিবী জুড়ে সিনেমা হলকে অত্যাধুনিক করা হচ্ছে। আর আমাদের দেশে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ করে দেওয়ার কারণ হলো সিনেমা হলে দর্শক নেই। কেউ নাকি হলে যায় না সিনেমা দেখতে। আচ্ছা, চলচ্চিত্রে যদি শিল্পগুণ না থাকে তবে দর্শক পকেটের পয়সা খরচ করে সে চলচ্চিত্র দেখতে হলে কেন যাবে! আর চলচ্চিত্র নির্মাণের লোকগুলো যদি যতটা না শিল্পী, তারচেয়ে বেশী যদি ব্যবসায়ী হয়, যদি রাজনীতিক হয়ে উঠতে চায়, তাহলে চলচ্চিত্রে শিল্পগুণ আসবে কোত্থেকে? আসবে না তো। তাই সিনেমা হলগুলোতে দর্শক নেই। ফলে হল মালিকেরা সেখানে নতুন ভবন তুলে শপিং মল বানিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারও নিজের পথে।
একটু পর জিপিও জিরো পয়েন্ট। কৈশোরে এই জিপিওতে সপ্তাহে দু তিনবার আসতাম বাংলাদেশের স্ট্যাম্প নিতে। বাংলাদেশের স্ট্যাম্পগুলা কি যে সুন্দর ছিল! স্ট্যাম্প জমানোর একটা সংস্কৃতি যে ছিল সেটা কি এ প্রজন্ম জানে? আর ছিল বই। এখন যেটাকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ডাকা হয়, ওটার নাম ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম। ওর নীচতলাটায় ছিল ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জামের দোকান। আর দোতলায় ছিল বইয়ের দোকান। অনেক অনেক বইয়ের দোকান। আমাদের পাড়ার কিংবা শান্তিনগরের বইয়ের দোকানে যে বইগুলা পাওয়া যেত না, সেগুলোওই জাতীয় স্টেডিয়ামের দোতলার দোকানগুলোতে পাওয়া যেত। দামী দামী সব বই। আমাদের পাড়ার মেরাজ একবার ওখান থেকে শার্লক হোমস্ সমগ্র মূল ইংরেজিটা কিনেছিল। লন্ডন থেকে ছাপা। ব্যারোনেস প্রকাশনার। মেরাজ কিনবার পর আমি হাতে নিয়ে অনেকটা সময় ধরে উল্টে পাল্টে দেখেছিলাম। সে বই হাতে নিলেও প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। কিন্তু পড়ি নি। ও বই পড়বার মতো ইংরেজি বিদ্যে ছিল না তখন। এখনও কি আছে! অনুবাদ করতে বসলে কতশতবার যে অভিধান দেখতে হয়! ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা মেরাজের আবার উল্টোটা। বাংলা বুঝলেও, বললেও পড়ায় সমস্যা ছিল। জাতীয় স্টেডিয়ামের পাশে পরে আরেকটা স্টেডিয়াম হলো। আউটার স্টেডিয়াম। স্কাউট থেকে প্রায়ই ওখানে নিয়ে যেত। আমরাও যেতে চাইতাম। গেলেই পাঁচটাকা পাওয়া যেত। পরে জেনেছিলাম প্রত্যেক ছাত্রর জন্য দেওয়া হতো বিশটাকা। কিন্তু আমাদের স্পোর্টস স্যার দিতেন পাঁচটাকা। মজা না?
আরেকটু পর পুরানা পল্টন পেরুচ্ছি যখন ঘড়িতে তখন মোটে পাঁচটা বেজে ষোল! সময়ের গতি নাকি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল! এতক্ষণে কেটেছে সাকূল্যে ছাব্বিশ মিনিট! মেজাজ খারাপ হয় না? পুরানা পল্টনের সাহিত্য প্রকাশে পাওয়া যেত রাশিয়ার বই। আশাতীত কম দামে অসম্ভব ভালো বাঁধাইয়ের হতো সেসব বই। আমি শুধুমাত্র বাঁধাই আর কম দাম দেখে এখান থেকে এমন অনেক বই কিনেছি যে পাঠ করেআর সুখ মেলে নি। তবুও নিয়েছি। ওসব বইয়ের বাংলা ভাষাটা হতো অন্যরকম। আমাদের মতো নয়। নয় কোলকাতার মতোও। হয়ত সেকারণেই অনেক কালজয়ী বইয়ের গদ্যওটানত না। কিন্তু পাঠ শেষে ঠিকই মজাটা ছেঁকে তোলা যেত। আর পাওয়া যেত চৈনিক বই। সেগুলা আবার খুব রঙচঙে। রূপকথা। পাতায় পাতায় এত সুন্দর সুন্দর রঙিন ছবি থাকত যে ও বয়সেও ভাবনা হতো- 'এত কম দামে এমন বই দেয় কেমনে!'
হাঁটতে হাঁটতে বিজয়নগর পড়ল। ফুটপাতে দুজন গল্প করছিল। এরা নিরাপত্তা রক্ষী। পাশের ভবনেরই হবে। এদের পাশ কাটানোর সময় একজন আমার দিকে চেয়ে চোখ দিয়ে কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকতে লাগল। আমার হাসি পেল। হেসেও ফেললাম। বিজয়নগরের যে মূল অপ্রশস্ত রাস্তাটা, যেটা কাঁচা পথ ছিল, যে রাস্তাটা নয়াপল্টনের দিকে চলে গেছে,সেটি আর অপ্রশস্ত নেই। রাজপথ হয়ে দিব্যি রাজার ভঙ্গীতে ফকিরাপুলের রাস্তাটার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। আগেও যাওয়া যেত অবশ্য। নয়াপল্টনের শেষ প্রান্ত থেকে বাঁ দিকে একটা খুব সরু গলি দিয়ে কেবল হেঁটে যাওয়া যেত।
বিজয়নগরের পুরনো বইয়ের গলিটা পেরুলাম। এখানে বিদেশি পত্রিকা আর পেপারব্যাক পাওয়া যেত। ও গলির ভেতরে গিয়ে ডানে ঘুরে একটু এগুলেই সেবা প্রকাশনী। টিনশেডের একটা বাড়ি। আমরা অবশ্য কাকরাইল রাজমনি সিনেমার রাস্তা দিয়ে অবলীলায় মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে আপনজনের মতো ঢুকে যেতাম! ঢুকেই যে প্রথম ঘরটা, ওটা ছিল সার্কুলেশন ম্যানেজারের অফিস। ম্যানেজারের টেবিলটার পেছনে আরেকটা ঘর। দরজার কপাট নেই। সাদা পর্দা দিয়ে সীমানা আলাদা করা। ওটা কাজী আনোয়ার হোসেনের ঘর। চাইলেই দেখা করা যেত। এখন সেবার বিশাল ভবন তাকে পাড়ার উচ্চবিত্ত প্রতিবেশী করেছে। যেতে চাইলে দারোয়ান পথ আটকায়।
নাইটিংগেলের কাছে আসতে একটা পুলিশের গাড়ি নয়া পল্টনের দিক থেকে রংরোডে এগোচ্ছে। তারা ইসলামী হাসপাতাল পেরিয়ে ডান পাশের গলিতে ঢুকে গেল। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আঞ্জুমান মফিদুল এখন আর আগের মতো জীর্ণ নেই। বিশাল আকারের আধুনিক ভবন নিয়ে নিজের ঝকঝকে অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। কাকরাইল মোড়ে রাস্তা পেরুবার সময় এপাশ ওপাশ দেখবার সময় চোখে পড়ল ভুঁইয়া ম্যানশন। ওর উল্টো পাশেই রাজমনি সিনেমা হল। কদিন আগে রাজমনি সিনেমাও বন্ধ করে দিয়েছে। ভুঁইয়া ম্যানশনের আনন্দমেলা সিনেমার অফিস ছিল। পত্রিকায় লিখেছিল ওভবনটা নাকি যুবলীগের সম্রাট দখল করে রেখেছিল। সম্রাট তো এখন জেলে। কিন্তু সম্রাটের ছবিটা ওখানে এখনও রয়ে গেছে। নির্মল হাসি হাসছে সম্রাট। হাসি একটা অদ্ভুত ব্যাপার। হাসলে, হাসিটা সত্যিকার হলে, সকলকেই কি যে সুন্দর দেখায়! বিদেশে এক সহকর্মী ছিল। খুবই খারাপ একজন লোক। তার অধিনস্ত আর সহকর্মী যারা, তারা কেউই তাকে পছন্দ করত না। কিন্তু সে যখন হাসত, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তার হাসতে থাকা সময়টাতে তাকে মোটেও খারাপ লোক মনে হতো না।
কাকরাইল মোড় ডানে ঘুরে ফুটপাতে উঠতে উল্টো দিকে চোখ গেল। ও মার্কেটটাতে ছিল শীলামনি। কি দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল তখন শীলামনির! ঢাকার অনেক মধ্যবিত্তর কাছে ও দোকানের পোশাক তখন সামাজিক মর্যাদা প্রতীক হয়ে উঠেছিল। অথচ মাঝারি মাপের একটা দোকান ছিল। পরে পরিসর বাড়িয়ে আরেকটা দোকান জুড়ে নিয়েছিল। কাকরাইল মোড় পেরিয়ে আরেকটু এগুতেই যেখান থেকে ফ্লাইওভার উঠে গেল, তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি। আমাদের বালক বেলায় ছিল একটা বাড়ি। রাজপথের পাশে বাড়ির সীমানা প্রাচীরের মধ্যখানে একটা দরজা। সে দরজা বেশীরভাগ সময় খোলাই থাকত। দরজা পেরুলে বিশাল ঘাসে ঢাকা উঠান। সে উঠান পেরিয়ে বেশ অনেকটা হেঁটে তবে যাওয়া যেত মূল বাড়ি। বাড়ির মূল দরজা খুলতে ওই অতটা পথ হাঁটতে হতো বলেই বাড়ির লোকেরা দরজা খোলাই রাখত। কেবল রাষ্ট্রপতি এরশাদ যখন কারফিউ দিত কিংবা জনতা যখন হরতাল ডাকত, তখন বাড়ির লোকেরা দরজা খোলা রাখত না।
আমাদের সদ্য কৈশোরে ও বাড়িটা হয়ে গেল 'শামীমা বিবাহ ঘর।' উপহার মুড়তে গিফট্ র্যাপিং পেপারের চল তখনও শুরু হয় নি। রঙিন কাগজে মোড়ানো হতো। যে কাগজ দিয়ে বিয়ে বাড়ি সাজানো হতো, সে কাগজ। আমরা ঘুড্ডিও বানাতাম ও কাগজ দিয়েই। একবার কজন মিলেশান্তিনগর মোড়ের মধুমিতা মিষ্টি ঘরে খালি মিষ্টির বাক্সে কংক্রিট আর বালু ভরে লাল কাগজে মুড়ে নিয়ে বিয়ে খেতে শামীমা বিবাহ ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। বিয়ে বাড়ির বিরিয়ানি খাওয়ার চাইতে উপহারের নামে ঠকিয়ে আসাটাই তখন আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল।
শামীমা বিবাহ ঘর পেরুলেই সার্কিট হাউজের গলি। এ গলির শেষ মাথায় বেরুলে সার্কিট হাউজ ক্লাবটা ছিল। আমরা অবশ্য বেইলী রোডের ক্লাব ডাকতাম। সে ক্লাবে কত কত সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা আর রাত কেটেছে আমাদের! সে ক্লাবটা এখন আর নেই। সেখানেও বিশাল ভবন। মোস্তফা জব্বারের বাংলা কম্পিউটার আর শফিক রেহমানের ডেমোক্রেসি ওয়াচও ছিল এ গলিতেই। সার্কিট হাউজের ও গলিটা পেরুলেই হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ। কলেজটাও এখন বিশাল ভবন। আগে দু তলা ছিল। এর ভেতরে কাজল ভাই ঘুষাঘুষি আর লাত্থালাত্থি শেখাতেন। শেখানোর সময় একটু পরপর বুকের কাছটার জামার বোতাম খুলে পরীক্ষা করে দেখতেন কার শরীর ঘামে নি। শরীরে ঘাম না হলেই কংক্রিটের বাস্কেটবল কোর্টটা বিশেষ ভঙ্গীতে গড়িয়ে গড়িয়ে পেরুতে হতো। তাতে শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়া উঠে যেত। বাস্কেটবল কোর্টটার পাশেই বিশাল একটা পুকুর ছিল। কাজল ভাইয়ের কাছ থেকে নিস্তার পেয়ে প্রায়ই আমরা কজন ঝাঁপিয়ে পড়তাম সে পুকুরে। সন্ধ্যা পেরিয়ে অন্ধকার বসে না যাওয়া পর্যন্ত উঠতাম না পুকুর ছেড়ে। পুকুরটা কি আছে এখনও? নাকি সেখানেও দু তিনটা ভবন উঠে গেছে?
শান্তিনগর মোড় থেকে রাস্তার দুপাশটাতে ছিল বইয়ের দোকান। একটা দুটা নয়, অনেকগুলো। সবুজ লাইব্রেরি নাম নিয়েই রাস্তার দুপাশে ছিল চারটা বইয়ের দোকান। আজীজ মার্কেটের মতোই এখন সেগুলো পোশাক আর খাবারের দোকান। রেক্স নাম নিয়ে পোশাকের দোকান চারটা। যে ভবনটাকে এখন টুইন টাওয়ার ডাকা হয়, ও জায়গাতেই ছিল তিনটা বইয়ের দোকান। আর ছিল বাচ্চু ভাইয়ের ভিডিও গেমের দোকানটাও ওখানেই ছিল। ভিডিও গেম তখন সবে এসেছে। এক গেম খেলতে দিতে হতো তিন টাকা। তিন টাকায় তখন একজন মানুষের চা-নাস্তা হয়ে যেত। বাচ্চু ভাই চুটিয়ে ব্যবসা করে নব্বই দশকের আগেই গুটিয়ে ফেলেছেন। বইয়ের দোকানগুলোও নেই। না না আছে; টুইন টাওয়ারের উল্টোদিকে যে সরু গলিটা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে, সে গলির মুখে একটা লাইব্রেরি আছে। কিন্তু ওতে সব পাঠ্যবই আর খাতা-কলম। আছে সস্তামানের ছবি আঁকবার রঙ, কিন্তু দামে সস্তা নয় মোটেও। পাওয়া যায় বাচ্চাদের মনোহারিও। কজন রাশভারী সাহিত্যিকের বই অবশ্য দেখেছি। আছে ডেল কার্নেগি। নেই কেবল বই। পাঠ্যর সঙ্গে যেসব বই পড়তে পড়তে আমরা বেড়ে উঠেছি, যেসব বই পড়ে আমরা পাঠ্যবইয়ের তুলনায় অনেক বেশী জেনেছি পৃথিবীকে, সেসব বই।
শান্তিনগর পেরিয়ে যখন চামেলীবাগের গলিটা পেরুচ্ছি, খুব ক্ষুধা অনুভূত হলো। ইস্ এখন তো নাস্তা পাওয়া যাবে না। গুলিস্তানে ছিল। সেখান থেকে খেয়ে আসতে হতো। আগে এখানেও পাওয়া যেত। মালিবাগ মোড়ে এখন যেটা প্রাইম ব্যাংকের বিশাল ভবন আর শপিং মল, ওখানে আগে একটা কনফেকশনারি ছিল। পরে সে দোকানি পরোটা ভাজি বেচতে শুরু করল দোকানটাতে। সারারাত খোলা থাকত। তখন রাতবিরাতে যখন তখন চলে আসতাম। আমার নিজস্ব একটা মেন্যু ছিল। আলু কিংবা সবজি ভাজিতে ডিম ভেঙে ভালো করে ফেটতে হতো। তারপর কাঁচা ডিম মেশানো ভাজিটা আবার ভাজতে হতো। ভাজা হয়ে গেলে সদ্য সেঁকে তোলা ধোঁয়া ওঠা পরোটার সঙ্গে পরিবেশন করতে হতো। স্বাদ? ঠিক অমৃত। আমার সঙ্গে অনেকেই আসতো। একবার ইস্পাহানীর টিটু খাওয়ার পর নগদ টাকা ছিল না বলে চেক লিখে দিয়েছিল। বিশ টাকার চেক দেখে দোকানীর চোখ বড় বড় হয়েছিল। তারপর চেক গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অবশেষে আমার বাকির খাতায় বিশ টাকা তুলতে হয়েছিল।
এসব ভাবতে ভাবতে ডিবি অফিসের গেটের কাছে আসতেই দেখি ঠিক রাস্তার মাঝখানটাতে, ফ্লাইওভারের নিচে একটা ঠেলাভ্যান। এই ফ্লাইওভারটার ওপর আমার অনেক রাগ। আগের মতো আকাশ দেখতে দেয় না। রাজপথটারও দুপাশ থেকে অর্ধেক জায়গা হজম করে ফেলেছে। আর যে জন্যে করা, সে যানজট এখন শুরুই হয় গাড়ির দল যখন ফ্লাইওভার থেকে রাজপথে নেমে আসে। গেল বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির আয়োজন করেছিল। সে কর্মসূচিতে নাকি তিরিশ হাজার মানুষ জমেছিল। আয়োজকরা বলেছিল পরিচ্ছন্নতার এই কর্মসূচিতে ব্যাপক সংখ্যায় মানুষের অংশগ্রহণ নাকি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নেবে। অথচ বাস্তবতা হলো ঢাকা এখন পৃথিবীর তৃতীয় দূষিত শহর। ফ্লাইওভারটা নগরবাসীদের তেমন কাজে না লাগলেও আবর্জনাদের কাজে লেগেছে। ওর নীচটা এখন উদ্বাস্তুদের সঙ্গে সঙ্গে আবর্জনাদেরও নতুন আশ্রয় হয়ে উঠেছে। কদিন আগে মৌচাকে রাস্তা পেরুবার সময় দেখি ফ্লাইওভারের নীচে বসে নিবিষ্টচিত্তে এক যুবক হাতের তালুতে কিছু ফেলে ডলাডলি করছে। হাজারও পথচলতি মানুষ যে তাকে দেখছে, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
তো মালিবাগ ডিবি অফিসের সামনে ফ্লাইওভারের নীচে ঠেলাভ্যানটার কাছে গিয়ে দেখা গেল বনরুটি কলা চা এসব বেচা চলছে। আমি একটা বনরুটির প্যাকেট তুলে কাঁদি থেকে কলা ছিঁড়তেযেতেই প্যাকেট গলে বনরুটি রাস্তায় পড়ে গেল। মেজাজ খারাপ হয় না? প্লাস্টিক প্যাকেটের মুখটা উত্তাপ দিয়ে বন্ধ করতে হয়, এটাতে সেভাবে বন্ধ করা হয় নি। সেটা জানা ছিল না বলেই পড়ে গেল। রুটিটা রাস্তা থেকে তুলে বিক্রেতা ছেলেটাকে দিয়ে বলি, আরেকটা দিতে। তারপর কলা আর বনরুটি খেতে খেতে চা চাই।
আর তখুনি ঠিক মালিবাগ মোড়ের মসজিদের সামনের ফুটপাতে, ছোটবেলায় শবেবরাতের ভোরে বিরিয়ানির লোভে যে মসজিদটাতে আমরা দলবেঁধে ফজরের নামাজ পড়তে ছুটে আসতাম, এবার সংসদ সদস্য হওয়ার পর যে মসজিদটার সামনে রাশেদ খান মেননের নাম বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়ে জানাচ্ছে, এটার ভিত্তিপ্রস্তর তিনিই স্থাপন করেছেন, সে মসজিদটার সামনের ফুটপাতে আরেকটা ঠেলাভ্যানে, আমার ক্ষুধার্ত চোখ দূর থেকেও বুঝে ফেলে- পরোটা ভাজা চলছে।
বনরুটি আর কলা খেতে খেতে ছেলেটাকে বলি, চা ক্যানসেল। তারপর পড়ে যাওয়া আর খেয়ে ফেলা বনরুটি ও কলার দাম মিটিয়ে দ্রুত চলে এলাম পরোটার ঠেলাভ্যানে। সদ্য বনরুটি-কলা খেয়ে ওঠার পরেও তিন তিনটা পরোটা খেয়ে ফেলি সেই সবজি ভাজি আর ডিম দিয়ে। তারপর এক কাপ চা। চা শেষে একটা সিগারেট। আমি তখন তরতাজা। খাওয়া শেষে ওই বেঞ্চিতে বসেই লিখতে শুরু করে এখন যখন শেষ করলাম। ঘড়িতে ঠিক সকাল সাতটা। বাসার লোকেদের ঘুম কি ভেঙেছে? ভাঙার তো কথা। কি জানি! না ভেঙে থাকলে তাদের ঘুম ভাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫০
মুবিন খান বলেছেন:
ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৩৯
নুরহোসেন নুর বলেছেন: আপনি ঘুমের ঘোরে দেশের অনেক অরাজকতা দেখে ফেলেছেন,
যারা জেগে আছে তাদের উচিত এসবের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্হা নেওয়া।
যাইহোক, গিন্নি কি তখন ঘুম থেকে জেগে আপনাকে ঘরে বরন করেছিলো?
নাকি আরো অনেকক্ষন ডাকাডাকি করেছেন?
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৩
মুবিন খান বলেছেন: ঘুমঘোরে যা দেখেছি একলা দেখতে চাই নি। এখন আপনিও দেখলেন
না, গিন্নি তখনও জাগেন নি। তাঁর জাগবার জন্যে অনেকটা সময় অপেক্ষার সঙ্গে কসরত করতে হয়েছিল।
আপনার মন্তব্যটি ভালো লেগেছে। অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
৩| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৭:১১
স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: গুলিস্তান মোড়ে নেমেই দেখি সামনে এক মাঠাঅলা।
দেখে খেতে ইচ্ছা করল। খেয়েও ফেললাম এক গ্লাস।
............................................................................
এভাবে গুলিস্তান মোড়ে খেতে গিয়ে অনেকেই বিপদে পড়েছে,
আমার অফিস পল্টনে কিন্ত কোন দিন সেদিকে ফিরে তাকাই না ।
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৩
মুবিন খান বলেছেন: আপনার আশঙ্কাটি অমূলক নয়। অনেকে ক্ষেত্রে সে আশঙ্কা সত্যও হয়ে ওঠে বটে। তবে বালক বয়স থাকতেই নানা দরকারে গুলিস্তান এলাকায় যাতায়াত করতে হয়েছে, নানান সময়ে পথে বেচা খাবার কত যে খেয়েছি! কখনও অমন আশঙ্কাজনক বিপদটা ঘটে নি।
৪| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:১৭
রাজীব নুর বলেছেন: প্রথম কথা হলো আপনি আমার প্রতিবেশী।
এই ছোট্র পোষ্টে খুটিনাটি কোনো কিছুই বাদ দেন নি।
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারটা উঠিয়ে দেওয়া দরকার। এখানে সব ভন্ডের দল এক হয়। ভন্ডামি করে।
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৪
মুবিন খান বলেছেন: না, অনেককিছুই বাদ পড়েছে। অনেক খুঁটিনাটি ছিল। সেসব লিখলে লেখাড় পরিসর আরও অনেক বাড়ত বলে সবটা লেখা হয় নি। তবে এই ধারাতে আরও লিখে ফেলবার ইচ্ছেটা রয়েছে। কোনদিন হয়ত লিখে ফেলতেও পারি। আপনি আমার প্রতিবেশী জেনে ভালো লাগছে। হয়ত দুজনে পাশাপাশি হেঁটেছি। চেনাজানা নেই বলে আলাপটা হয় নি। হয়ত কোনদিন সে আলাপটা হয়ে যাবে- সে আশায় রইলাম।
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারটা কেবল নয়, দেশের সকল মাজারগুলোই উঠিয়ে দেওয়া দরকার। একটা কুসংস্কারকে এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে পুষবার কোনও মানে হয় না। কদিন আগে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান ওরফে রাফি হত্যার ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছিলেন, 'ওই এলাকার লোক ধর্মান্ধ। কোনো হুজুরের বিরুদ্ধে কিছু বলার উপায় নেই।' এ মন্তব্য কি বাংলাদেশে সাড়ে নয়শ'র বেশী মাজারের জমকালো ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?
৫| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:২৮
কনফুসিয়াস বলেছেন: ঢাকা শহরেে তেমন কিছুই চিনি না ভাই। ঢাকায় গেলে গুগল ছাড়া আমি অসহায়।
আপনার লিখাটা অনেক ভাল লাগল। এমন ভাবেই বাংলাদেশের অনেক অন্ছলের অনেক স্বৃতি হারিয়ে যাচ্ছে যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় ছিল। এভাবেই সভ্যতা অসভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৪
মুবিন খান বলেছেন: উন্নয়নের নামে কেবল ঢাকা শহরটাকেই নয়, পুরো দেশটাকে যেভাবে বদলে দেওয়া হচ্ছে, সে পরিবর্তন মোটেই ইতিবাচক নয় ভাই। উন্নয়ন মানেই অপরিকল্পিতভাবে ইট আর কংক্রিটের স্থাপনা নয়। নয় যান্ত্রিকতা। আমাদের আকাশ থেকে কালো শকুন কখনও তার ছায়া সরায় নি। সে আমাদের আকাশ দেখতে দিতে চায় না।
আমার লেখাটি পড়লেন বলে ধন্যবাদ। এবং শুভেচ্ছা নিরন্তর...
৬| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:১৯
হাসান কালবৈশাখী বলেছেন:
সুন্দর লেখছেন।
লেখা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম কখন আপনারে হাইজ্যাকার থাবা দেয় ..
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৪
মুবিন খান বলেছেন: বালক বয়স থাকতেই নানা দরকারে গুলিস্তান এলাকায় যাতায়াত করতে হয়েছে, ফলে ভয়টা ভাবনায় আসে নি। ওই নিজের জায়গার ভাবনার ভরসাতেই ওসময় একলা হাঁটতে পা বাড়িয়েছি।
৭| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:২৯
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন:
গুলিস্তান থেকে মালিবাগ পর্যন্ত হাজারবার গিয়েছি ।কিন্তু এটা পড়ার পরে মনে আমার কেবল এই অনুভূতি যে আমি কখনই এই অঞ্চলটিতে যাই নাই ।
আমরা আসলে কতটা কম চিনি বা জানি -আপনার লেখা আবার তা মনে করিয়ে দিল ।
পড়তে পড়তে আনন্দিত হলেও মনে মনে ভয়ে ছিলাম এই বুঝি আক্রমন হল ছিনতাই কারীর বা টহল গাড়ীর সম্মানজনক সদস্যদের কতৃক মোস্ট ওয়ান্টেড হিসাবে ধরা পড়ে রাজকীয় অভ্যর্থনায় নিজ বাড়ীর বিকল্প হিসাবে শ্বশুর বাড়ির অসাধারন আপ্যায়নের ।
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৫
মুবিন খান বলেছেন: হাহাহা... ভালো বলেছেন। না ভাই, আক্রমণটা হয় নি। তবে ছিনতাইকারীর ভাবনা না থাকলেও টহল গাড়ির ভাবনাটা কিন্তু সত্যিই ছিল। তাই বাসের টিকেটটা না ফেলে দিয়ে সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। না, টহল গাড়িও আমাকে পাত্তা দেয় নি। ফলে রাজকীয় অভ্যর্থনায় নিজ বাড়ীর বিকল্প হিসাবে শ্বশুর বাড়ির অসাধারন আপ্যায়নে পাওয়া লাগল না।
৮| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৬
েবচস বলেছেন: কঠিন লেখছেন। ভালো লাগছে পড়ে। ছবির মত বরণনা। পিলাচ ++++++++++++
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৫
মুবিন খান বলেছেন: ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আপনার দেওয়া 'পিলাচ' যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রাখলাম ভাই।
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৩৭
:):):)(:(:(:হাসু মামা বলেছেন: ভালো লাগলো ।