নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিজের পরিচয় লেখার মত বিখ্যাত বা বিশেষ কেউ নই। অতি সাধারণের একজন আমি। লিখতে ভাল লাগে। কিন্তু লেখক হয়ে উঠতে পারি নি। তবে এই ব্লগে আসা সে চেষ্টাটা অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য নয়। মনে হল ভাবনাগুলো একটু সশব্দে ভাবি।
শান্তার আব্বা শিশুদের মতো হয়ে গেছেন। সত্তুর উর্ধ্ব বছরের মানুষটা হঠাৎ করেই যেন একেবারেই ছোট্ট একটা শিশুতে বিবর্তিত হয়ে গেছেন।
কাল বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে আইসিইউর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মিলেছিল। একটা পুরো রাত আর দিন অপেক্ষায় প্রতিক্ষায় শান্তা বাবাকে দেখতে চেয়ে প্রচণ্ড অস্থিরতায় ছটফট করেছে। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতেই ছটফট করতে থাকা শান্তা সঙ্গে সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই ছুটে গেছে বাবাকে দেখতে।
শান্তার বাবা আইসিইউর বিছানায় শুয়ে আছেন। সংজ্ঞাহীন নন। উল্টো বরং সংজ্ঞা খুব বেশি টনটনে তাঁর। হাত দুটা বিছানার দু পাশে ব্যান্ডেজ পাকিয়ে দড়ির মতো বানিয়ে সেটা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
জানা গেল, শুয়ে থাকতে তাঁর প্রবল অনীহা। একটু পরপরই বিছানা থেকে উঠে বসেন। তারপর নাকের তরল খাদ্যর পাইপ, কব্জির স্যালাইন, মূত্রথলির ক্যাথেটার- সকলই খুলে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চান। তখন ছুটে আসেন নার্সেরা। কি হয়েছে জানতে চান। শান্তার বাবা খুব নির্বিকার আর আলাপী ভঙ্গীতে নিতান্ত পরিচিতের মতো বলেন, ‘এগুলা খুলে দেন তো।’
‘কেন!’ বিস্মিত নার্সেরা বলেন।
‘দোকানে যামু। চা খামু।’ ভাবলেশহীন বলেন তিনি।
তাঁর চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তাঁর পান খাওয়া অভ্যাস। তাঁকে পান খেতে হবে। পান না খেলে তাঁর নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসে। সে কারণেই তিনি ঝামেলা ছিঁড়েখুলে ফেলে দোকানে রওনা করেছেন।
এখন আইসিইউর রোগী যদি স্যালাইন-ট্যালাইন টেনে খুলে ফেলে দোকানে গিয়ে সুরুত সুরুত করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে, তর্জনীর ডগায় চুন নিয়ে যদি আয়েশ করে পান চিবাতে থাকে, তাহলে নার্সদের চাকরি থাকার কথা না। চাকরি তো হারাবেই, সেইসঙ্গে নার্সদের অস্তিত্বও সংকটের মুখে পড়বে। এদেশে রোগীর স্বজনদের রোষ তো বেশ জনপ্রিয়। ফলে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নার্সেরা শান্তার বাবার হাত দুটা বিছানার দুপাশে ব্যান্ডেজ পাকিয়ে সেটা দিয়ে বেঁধে রেখেছেন।
শান্তা দ্রুত এগিয়ে বাবার বিছানার পাশে দাঁড়ায়। এরপর কাঁদতে শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতেই বাবার সারা গায়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে। আর কাঁদে। আর কথা বলে। বাবার খোঁজখবর জানতে চায়।
কান্না করতে ব্যস্ত কন্ঠকে সংবরণ করার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘আব্বা কেমন আছেন?’
সে প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারও বলে, ‘আব্বা আপনের ব্যথা আছে?’
‘আব্বা ডাক্তার বলছে আপনে সুস্থ হয়ে যাবেন।’
‘আব্বা আপনে একটু ভালো হইলেই আপনেরে আমরা বাড়ি নিয়া যাব।’
কথা বলতে বলতে শান্তার কন্ঠ বুঁজে আসে। নিঃশব্দ কান্নায় শান্তার চোখ দুটা বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। খুব ঘনঘন চোখ মুছতে মুছতে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুদের পুরো মুখটায় লেপ্টে দেয় শান্তা। আর কথা বলতে থাকে বাবার সঙ্গে। কথা শান্তা একাই বলে না, ওর বাবাও বলেন। বলতেই থাকেন অনবরত।
‘ফোরকানের দোকান থেকে আমারে একটা পান আইনা দিবি?’
‘দিব আব্বা।’
টকটকে লাল চোখে ফোঁপানো কান্নায় ভেজা শান্তার মুখটা হেসে ওঠে। ওর চোখে তখন প্রশ্রয় ঝিলিক মারে। ফোরকানের দোকান থেকে কত কত মাইল দূরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা বাবা সেটা বুঝতে পারেন না। শান্তাও সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে শিশুকে প্রবোধ দেওয়ার মতো করে কথা দেয়, ফোরকানের দোকান থেকেই পান এনে দেবে।
‘আমার শার্টের পকেটে পঞ্চাশ টেকা আছে, দেখ।’ বলেন বাবা পরম নির্ভরতায়।
‘আমার কাছে টাকা আছে আব্বা।’ আরও প্রবলভাবে বাবার নির্ভরতা হয়ে উঠতে চায় কন্যা।
একটু পরেই বলে, ‘ আব্বা, ডাক্তার পান আনতে দেয় না।’
মুহূর্তে রেগে ওঠেন পিতা। রাগ কন্যাকে পাশ কাটিয়ে চিকিৎসকের দিকে ধাবমান হয়। বলে ওঠেন, ‘শয়তান ডাক্তার।’
তারপর তাদের কথা চলতেই থাকে। ইস্! কতরকমের কথা যে বলতে থাকে তাঁরা! কথাদের সঙ্গে বিরামহীন কান্নায় ভেসে যেতে চায় শান্তার চোখ দুটো। কিন্তু ঠোঁটে মুখে থেকে থেকেই হাসি। উচ্চারণে ছেলেভোলানো কথারা ভীড় করে আসে শান্তার মুখে। তারপর আবারও কান্নারা এসে ভীড় করে। আমি বাধা দেই না কান্নায়। কাঁদতে দেই। বলি না, অসুস্থ পিতার সঙ্গে এত এত কথা বলতে নেই।
সামান্য ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আগলভাঙা প্রবল মুগ্ধতায় পুত্র আর মাতার কথোপকথন দেখতে থাকি। মা তার ছেলের বায়নার কোনকিছুইকেই ‘না’ বলেন না। কথা দেন, আকাশ থেকে শুকতারাটাও এনে দেবেন ছেলেকে। শুধু একটু সবুর করতে বলেন। পুত্র সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে তখন সকলই এনে দেবেন।
গোঁয়ার আর জেদী পুত্র শুনবে না সে কথা। তাঁর চাওয়াগুলো এক্ষুণি চাই। মা তখন খুব করে কৌতুক অনুভব করেন। কৌতুকে হাসেন। এ হাসির নাম প্রশ্রয়ের হাসি।
পিতা-কন্যার দৃশ্যপটের অবস্থান কখন উল্টেপাল্টে গেছে, আমি বুঝতে পারি না। শুধু দেখি প্রবল পুত্রস্নেহ উপচে পড়া মা কাঁদছেন। এ কান্না অসহায় মানুষের কান্না। এ কান্নাকে চেনাজানা মানুষেরা জানে- এ কান্না কাঁদতে পারা মানুষেরা কতটা ক্ষমতাহীন।
আমি এগিয়ে দিয়ে শান্তার পাশে দাঁড়াই। ওর পিঠে হাত রাখি। চুপ করে থাকি। কথা বলি না। এসময় এখানে কথাদের কোনও কাজ থাকে না। কথারা এখানে পঙ্গু, মূক ও বধির।
কথারা এখানে মাতা কিংবা কন্যার চেয়েও অসহায়।
১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:২০
মুবিন খান বলেছেন: পড়লেন বলে কৃতজ্ঞতা ভাই।
২| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২২
রাশিয়া বলেছেন: পিতা এবং কন্যা কিভাবে মাতা-পুত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেল - এই টুইস্টে আমি এখনও আচ্ছন্ন। সমরেশের একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম স্বর্গীয় পিতা কিভাবে নিজ কন্যার গর্ভে নিজেরই দৌহিত্র হিসেবে পুনর্জন্ম নেয় -অনেকটা সেই ধরণের থিম পেলাম।
১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০০
মুবিন খান বলেছেন: পিতা এবং কন্যা কিভাবে মাতা-পুত্রে রূপান্তরিত হয়ে উঠল তাতে আমি নিজেও এখনও আচ্ছন্ন।
চমৎকার মন্তব্যটির জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
৩| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩১
করুণাধারা বলেছেন: চমৎকার লেখনি আপনার!
১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০১
মুবিন খান বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
৪| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৬
মোহামমদ কামরুজজামান বলেছেন:
কন্যা এবং পিতার সম্পর্ক ব্যাখ্যাযোগ্য নয় ।
বিশ্বের সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে , এই সম্পর্কটি সেরা ।।
চমৎকার বিষয় সহ ভাল লেখা ।
১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:০৩
মুবিন খান বলেছেন: হ্যাঁ, পিতা এবং কন্যার সম্পর্কটি সেরা। মাতা এবং পুত্রর সম্পর্কটির মতোই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
৫| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪০
নীল আকাশ বলেছেন: এটা অবশ্যই গল্পর মতোঃ নয় পুরোপুরি গল্প। আমি, নীল আকাশ সার্টিফিকেট দিয়ে গেলাম।
মানবীয় অনুভূতি গুলি দারুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পিতা কন্যা কিংবা মাতা পুত্রের সর্ম্পক স্বর্গীয়।
ব্লগে খুব কম গল্পকারই আমাকে মুগ্ধ করতে পারে। আজকে আপনি করেছেন।
আরও লিখুন, অপেক্ষায় রইলাম।
১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৬
মুবিন খান বলেছেন: অনেক দামী একটা সার্টিফিকেট দিলেন। কৃতজ্ঞতা আপনাকে। সার্টিফিকেট মাথা নুইয়ে গ্রহণ করলাম। কৃতজ্ঞতা।
৬| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৪১
রাজীব নুর বলেছেন: দোকানে যামু চা খামু।
এখন আমারও দোকানে গিয়ে চা খেতে ইচ্ছা করছে।
২২ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৩০
মুবিন খান বলেছেন: খেয়ে নেন। ইচ্ছের মূল্যায়ন করা দরকার।
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৪:২৮
ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:
মুবিন খান ভাই,
আপনি কে ভাই? আপনার লেখা তো ভয়ঙ্কর লেখা। আমি আজ প্রথম আপনার লেখা পড়ে আশ্চর্য্য হচ্ছি আপনার লেখা আগে কখনো কেনো পড়া হয়নি! ভালো লিখেছেন। গুড জব।