নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(৪৪)
সিয়াহ তখন বাক্স,ঝুড়ি,এমন কি ময়লা কাপড়ের ঝুড়িও খুঁজে খুঁজে দেখছিল,জেইতিনের তোয়ালে,কালো চিরুনী,ময়লা হাত মোছার তোয়ালে,কোনটা বাদ পড়েনি।গোলাপ জলের বোতল,শীতের জ্যাকেট,মেয়েদের ময়লা কাপড়,তামার বাসন কোনটাই আমার চোখ এড়ায়নি।দেখে মনে হচ্ছিল জেইতিন হয় খুব কৃপন,না হয় তার টাকা পয়সা নষ্ট করছে অন্য কোন ভাবে।
‘দেখেই মনে হচ্ছে একটা খুনীর বাড়ী যেন’,আমি বললাম,‘নামাজ পড়ার একটা জায়নামাজ দেখলাম না কোথাও’।
নিঃসন্দেহে একজন অসুখী মানুষের বাড়ী,তবে আমার মনের এক কোনে একটা কথাই ভাসছিল,কত যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একজন শিল্পীকে।
‘যা আছে তা নিয়ে তা নিয়ে তৃপ্ত থাকা যদিও সহজ,তবে কেন জানি মানুষ সহজেই ছুটে অতৃপ্তি,অসুখের রাজ্যে,চাওয়াটা হয়ে যায় আকাশচুম্বী’,সিয়াহ বললো।
সিয়াহ ভেতরের এক বাক্স থেকে সমরখন্দের মোটা কাগজে আঁকা কয়েকটা ছবি বের করে আমার সামনে রাখলো।আমরা ছবিগুলো পরখ করে দেখছিলাম,খোরাসান থেকে আসা হাসিমুখের শয়তান,গাছ,কুকুর আর যমদূতের মাঝখানে,সবুজ ঘাসের অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে।ছবিগুলো সামনে রেখে খুন হওয়া গল্পকথক লোকটা গল্প বলতো,সিয়াহর প্রশ্নে আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম আমার আঁকা আজরাইলের ছবি।
‘এই ছবিগুলোই এনিষ্টের বই এ আছে’,সিয়াহ বললো।
‘কফির দোকানের মালিক আর গল্পকথক দুজনেই জানতো প্রতি রাতের গল্পের সাথে ছবির দেয়ার প্রয়োজনীয়তা,গল্পকথক ছুটে ছুটে আসতো,মোটা কাগজে এই সব ছবি একে নেয়ার জন্যে,সাথে জেনে নিত গল্পটা,সাথে কৌতুক আর নিজের কিছু অংশ যোগ দিয়ে তারা গল্প সাজাতো’।
‘তুমি এনিষ্টের বই এর জন্যে যে ছবিটা আঁকলে,সেই ছবিটাই তুমি আবার গল্পকথকের জন্যে আঁকলে’?সিয়াহ প্রশ্ন করলো।
‘গল্পকথকের অনুরোধে আঁকা এই একটাই ছবি ওটাতে আছে তুলির ছোঁয়া শুধু,তবে এনিষ্টের বই এর জন্যে আঁকা ছবিতে ছড়ানো আমার মন,প্রান।তুলি,আবেগ,হাত এনিষ্টের ছবি আঁকার জন্যে একসাথে প্রস্তত হয়ে ছিল।আমার মনে হয় অন্যান্য শিল্পীদের ক্ষেত্রে একই কথা বলা যায়,কফির দোকানের ছবিগুলোতে তুলি আছে তবে আন্তরিকতা নেই’।
‘ঘোড়া,আর বিশেষ ভাবে আঁকা নাকের ছবিটা কার’?সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো।
বাতিটা নীচে করে আমরা ঘোড়ার ছবিটা দেখছি তখন,দেখছিলাম ছবিটার সাথে এনিষ্টের বই এর ঘোড়ার ছবির সাথে কোন সামঞ্জস্য আছে কি না?দেখে মনে হলো ছবিটা বেশ তাড়াহুড়া করে আঁকা,টাকাপয়সার সাথে হয়তো বলা ছিল ছবিটা এলোমেলো ভাবে আঁকার জন্যে,তবুও একটা সত্যিকারের ঘোড়ার ছবি মত দাঁড়িয়ে ছিল।
‘আমার মনে হয় লেইলেক বলতে পারবে ঘোড়াটা কার হাতে আকা’,আমি বললাম, ‘ঐ বোকা মানুষটা সবসময় কানাঘুষার গল্প শুনে বেড়ায়।এজন্যেই প্রতি রাতেই ওকে কফির দোকানে দেখা যেত।আমার মনে হয় ছবিটা লেইলেকের আঁকা’।
আমাকে সবাই লেইলেক বলে ডাকে
প্রায় মাঝরাত্রি,দেখলাম কেলেবেক আর সিয়াহ আমার বাড়ীতে ঢুকলো,কয়েকটা ছবি মেঝেতে রেখে আমাকে মন্তব্য করতে বললো,মনে পড়লো ছোটবেলার,‘কার পাগড়ী,কার পাগড়ী,খুঁজে দাও,না জানলে চিমটি খাও’,খেলার কথা।হোজাদের মাথার পাগড়ী,ঘোড়ায় চড়া সৈন্যের পাগড়ী,হাকিমের পাগড়ী,জল্লাদের পাগড়ী,খাজাঞ্চীর পাগড়ী,এক পাতায় পাগড়ী আরেক পাতায় সাজানো অনেকগুলো মুখ একটার সাথে আরেকটা মেলানোর খেলা।
বললাম,কুকুরের ছবিটা আমার আঁকা,গল্পকথকের জন্য গল্পটাও আমাদের সাজানো,শান্তশিষ্ট কেলেবেক,যে আমার গলায় চাকু ধরে ছিল,যমদূতের ছবিটা সম্ভবতঃতারই আঁকা,শয়তানের ছবিটা মনে হয় জেইতিনের,আর গল্পগুলো মৃত গল্পকথকের বলার কায়দায় জীবন্ত হয়ে উঠতো।গাছের ছবিটা যদিও আমিই আরম্ভ করি,তবে শেষ হয় কফির দোকানে্র শিল্পীদের হাতে,এক এক করে করে তাদের তুলির ছোঁয়ায় আঁকা,গল্পটাও সকলের সাজানো।
লাল কালিতে আঁকা ছবিটা,লাল কালি ছটা ছড়ানো ছিটানো ছিল কাগজে,আর কৃপন গল্পকার বললো,ছবিটা আমরা নতুন কিছু আঁকতে পারি কি না,যদিও তার পক্ষে আর খরচ করা সম্ভব না?তবুও লাল কালি দিয়ে সবাই এক এক করে নতুন কিছু এঁকে,ছবির গল্প সাজানো হলো।জেইতিনের হাতে আঁকা এই ঘোড়াটা-জেইতিনের প্রতিভার প্রশংসা না করে পারা যায় না,মনে হয় কেলেবেকের হাতে আঁকা এই দুঃখী মহিলার ছবি,সেই সময় কেলেবেক আমার গলা থেকে চাকুটা তুলে সিয়াহকে বললো মহিলার ছবিটা তার আঁকা।জেইতিনের গোত্রের মানুষদের অনেক অপকর্মের ইতিহাস আছে,তারা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের উপরে রীতিমত অত্যাচার করতো,এমন কি তাদের ভিক্ষা করাতেও বাধ্য করতো,তারই হাতে আঁকা দুই স্বর্গীয় চেহারার দরবেশের ছবি।প্রায় ২৫০ বছর আগে লেখা শেখ ইভহাদ-দীন-কিরমানীর বই ছন্দে ছন্দে লেখা আল্লাহকে তার অনুভুতির কথা কে না জানে।
সহকর্মী শিল্পীদের কাছে বাড়ীঘরের অগোছালো চেহারার জন্যে ক্ষমা চেয়ে,বললাম বৌ ঘুমিয়ে আছে,এক কাপ চা বা এক গ্লাস কমলালেবুর রস না দিতে পেরে,আমি বেশ লজ্জিত।
সবাইকে খুশী করার জন্যে কিছু এটা ওটা বলতে হলো,যাতে তারা অযথা বাড়ীতে এটা ওটা না খুঁজে বেড়ায়।পারসী কায়দায় আঁকা বিভিন্ন বই এর জন্যে ছবিগুলো ছড়ানো ছিটানো ছিল ঝুড়িতে,কার্পেটের নীচে।
মজাই লাগছিল নিজের ভীতু চেহারাটা তুলে ধরতে,দেখাতে যে আমি ভঁয়ে ভঁয়ে অস্থির হয়ে আছি।শিল্পীর দক্ষতা তার বর্তমানকে উপলদ্ধি করার ক্ষমতায়,বিশাল এক বস্ত থেকে ছোট্ট একটা বালুকনা দেখার ক্ষমতায়।চারপাশের সাধারণ থেকে একপাশে সরে একটা আয়নায় সাজানো সেই সৌন্দর্যকে দেখে,মনের খাতা থেকে ছবির পাতায় তুলে ধরা।
কারও প্রশ্নে উত্তর দিলাম,এটা সত্যি কথা যখন ইরজুরুমিরা আক্রমণ করছিল,তখন আমি,
জেইতিন,বাচাল নাসের,কালিগ্রাফার জেমাল,ছিল দুইজন শিক্ষার্থী শিল্পীও।রাহিমি ও ছিল যার চেহারার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ,তার সাথে ছিল আরও ছয় সাতজন সুন্দর চেহারার নবীশ,কয়েকজন মাতাল,গাজাখোর,দরবেশের সাথে।বললাম,গন্ডগোল আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথে সবাই কেন যে হতবুদ্ধি হয়ে গেল জানিনা,ছোটাছুটি আরম্ভ করলো সবাই,কেউ একবারও চিন্তা করলো না প্রতিরক্ষার কথা,কেউ ভাবলো না মেয়েদের পোষাক পরা গল্পকথকের কথা।
কেন যে আবার ঐ দুঃখজনক ঘটনার কথা ভাবছিলাম?
‘ও,হ্যা!শিল্পী মুস্তফা যাকে সবাই লেইলেক বলে ডাকে’,সঙ্গী শিল্পীদের বসে গল্পগুজব,হাসিঠাট্টা,
কবিতা পড়ে সময় কাটাতে ভালবাসে,বোকা,মোটা কেলেবেকের ঈর্ষা ভরা চোখের দিকে দেখে সবকিছু বলে যাচ্ছিলাম।যদিও কেলেবেক একজন প্রবীণ শিল্পী,তবে তার চোখ,ত্বকের মসৃনতা একেবারেই বাচ্চা ছেলের মতো।
গোলমালের দ্বিতীয় দিনের কথা বলছি,ঐ গল্পকথক-আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করবেন,বেশ ব্যাস্ত থাকতো গল্প বলায়,শহরের বিভিন্ন এলাকার কফির দোকানে,অবশ্য ঐ দিন কেন জানি এক শিল্পী কফির আমেজেই হয়তো বা,দেয়ালে ঝোলানো তার আঁকা কুকুরের ছবি দেখে নিজেই কুকুর হয়ে গল্প বলা আরম্ভ করলো।জমাট হয়ে গেল অনুষ্ঠানটা,আরম্ভ হলো অন্যান্য শিল্পীদের আঁকা ছবি দেয়ালে দিয়ে গল্প বলার পর্ব।ইরজুরুমির ইমামদের কৌতুকে শিল্পীদের ছবি আঁকার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল,কফি হাউসে লোকজনের সংখ্যা দেখে,ইডিম থেকে আসা মালিকের উৎসাহও বেড়ে গেছে কয়েকগুন,ব্যাবসা একেবারে জমজমাট,গল্পকথকের কারনেই।
জেইতিনের বাড়ী থেকে আনা ছবি দিয়ে সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো গল্পকথকের পেছনে কেন ছবিগুলো ঝোলানো থাকতো?বললাম বিশ্লেষণ করার তেমন কিছুই নাই,জেইতিন একজন ধান্দাবাজ লোক,চোর,জোচ্চর,ভিখারী,পয়সা ছাড়া কিছু বোঝে না,অথচ ঢং করে নিজেকে দরবেশ হিসাবে দেখাতে চায়।সরল মনের জারিফ এফেন্দী,হোজার কথাবার্তার বহরে ভঁয়ে তটস্থ হয়ে থাকতো,মনে হয় কোন এক জুম্মার খুতবায় হোজার হিংসার বিষে ভঁরা কথাবার্তা শুনে,জারিফ হয়তো ইরজুমিদের কাছে অভিযোগ করে।আর সম্ভবতঃ জারিফ যখন তাদেরকে ঐ সব আজেবাজে গল্প থামাতে বলে,জেইতিন কফির দোকানের মালিকের সাথে কারসাজিস করে জারিফকে খুন করে।তারপর ইরজুমিরা চক্রান্ত করে তাদের বিশ্বাসের বিপক্ষের মানুষ এনিষ্টেকে জেইতিনের খুনের জন্য দায়ী করে,তাকেও খুন করে।ইয়া ছাড়া জারিফের কাছ থেকে তাদের জানাই ছিল এনিষ্টের বই এর সব রহস্য,কফি হাউসের লুটপাট আক্রমণটাও ওদেরই অপকর্ম।
জানি না মোটা কেলেবেক আর ফ্যাকাসে সিয়াহ(যাকে দেখে মনে হয় ভুত)আমার কথা কতটুকু শুনছিল,ওরা ঘরের জিনিষপত্র নাড়াচড়া করে তন্ন তন্ন করে খোঁজায় ব্যাস্ত তখন।আমার কাঠের ট্রাঙ্কে জুতা,যুদ্ধের সরঞ্জাম দেখে কেলেবেকের মুখটা বাচ্চা ছেলের মুখের মত জ্বলজ্বল করছিল,তাদেরকে যা বললাম সেটাতো সবার জানা।আমিই প্রথম মুসলমান শিল্পী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে গিয়ে,সুলতানের যুদ্ধ জয়ের কাহিনী ছবিতে তুলে ধরে।কামান ছোঁড়ার দৃশ্য,শত্রুদের দূর্গের ছবি,কাফের সৈন্যদের পোষাক আষাকের ছবি,পড়ে থাকা লাশের স্তূপ,
নদীর ধারে পড়ে থাকা কাটা মাথা,জয়ের অভিযানের উৎফুল্ল সৈন্যদের মুখ,অনেক কিছুই এঁকে গেছি আমার তুলিতে।
কেলেবেক জানতে চাইলো যুদ্ধের বর্ম পরে থাকার নিয়মটা,কোন দ্বিধা না করে আমি কোট,সার্ট,গেঞ্জী,আন্ডারওয়ার সবকিছু খুলে ফেললাম।বেশ মজাই লাগছিল দেখে ওরা বাতির আলোতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,পরিষ্কার লম্বা একটা আন্ডারওয়ার বের করলাম,শীতে বর্মের নীচে পরার জন্য মোটা লাল সার্ট,উলের মোজা,হলদে চামড়ার বুট,তার উপরে পেতলের বেল্ট পরে কেলেবেকের দিকে ঘুরে দাড়ালাম,পেয়াদাকে বলার মত ভাবে তাকে বর্মের ফিতা বেঁধে দিতে বললাম।হাতের দস্তানা,উটের চুলের তৈরীর তলোয়ারের বেল্ট,
মাথায় সোনালী হেলমেট পরে বললাম,ও ভাবে যুদ্ধের ছবি আর কোনদিন আঁকা হবে না।এখন আর পুরোনো সময়ের মত বিপক্ষ দলের সৈন্যদের ছবি এঁকে উল্টোদিকে বিপক্ষ দলের সৈন্যদের ছবি সাজানো নিষিব্ধ।বললাম, ‘এখন ওটোমান সামাজ্রের শিল্পীরা যুদ্ধের ছবি আঁকবে,আমার চোখে দেখা যুদ্ধের ছবি,ঘোড়া,বর্ম,রক্তাত্ত সৈন্যদের মুখ’।
কিছুটা ঈর্ষার সুরেই কেলেবেক বললো, ‘শিল্পীরা ছবি আঁকে,যা তারা দেখে সেটা না বরং অর্ন্তনিহিত এক উপলদ্ধি থেকে,আল্লাহ যা দেখে সেটা’।
‘সেটা ঠিকই,তবে আমরা যা কিছু দেখি,মহান আল্লাহতালা তার সব কিছুই দেখে’।
কেলেবেক বললো, ‘অবশ্যই আমরা যা দেখি আল্লাহ দেখে,তবে তার উপলদ্ধির ধরন্টা ভিন্ন’।
‘যুদ্ধের ছবিটা আমরা উৎসাহিত হয়ে দেখি বিজয়ের আর পরাজয়ের,মহান আল্লাহর কাছে সেটা শুধুই দুটা সৈন্যদল’।
আমার বলার ইচ্ছা ছিল,‘ আল্লাহ আমাদেরকে সেটাই উপলদ্ধি করতে দেয় যা আমরা ছবিতে তুলে ধরতে পারি,তার বেশী কিছু না’।তবে কোন উত্তর দেইনি আমি,চুপচাপ ছিলাম না হলে হয়তো কেলেবেক আমাকে দোষী করতো,ইউরোপীয়ান শিল্পীদের অনুকরণ করার জন্যে,যে ভাবে ও চাকু ধরে ছিল আমার গ্লায়।যদি কোন ভাবে আমি সিয়াহর মনে বিশ্বাস আনতে পারি,তা হলে জেইতিনের এই চক্রান্ত থেকে আমার উদ্ধার হবে।
সিয়াহ আর কেলেবেক তো খুঁজে পাবে না ওরা যা খুজছে।একটা ছবি খুঁজছিল তারা যার জন্যে ওরা আমার ঘর তছনছ করে দিল।চালাক খুনী(আমি জেইতিনের কথা ভাবছিলাম)
নিশ্চয় ছবিটা যেখানে সেখানে ফেলে রাখবে না,তোমার আমার কথা কি আর ওরা শুনে?
সিয়াহ আমাকে ঘোড়ার নাকের কথাটা বুঝিয়ে বললো,আর সুলতানের ওস্তাদ ওসমান,সিয়াহকে
দেয়া তিনদিন শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই রাত্রেই।আমি যখন ঘোড়ার নাকের সমন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলাম,সিয়াহ আমার চোখে চোখ রেখে বলছিল,কি ভাবে ওস্তাদ ওসমান ঘোড়ার নাকের সাথে জেইতিন খুঁজে পেল।
প্রথম দিকে আমি ভাবছিলাম,ওরা ভাবছে আমিই খুনী,তবে শুধু খুনের প্রমান খুঁজতে ওরা আমার বাড়ীতে আসেনি,অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে ওদের।ওদের মনে ছিল একাকীত্ব আর হতাশা।আমি যখন দরজা খুললাম,লেইলেক যে চাকু গলায় ধরে ছিল,তার হাতে কাঁপছিল সে।খুনীকে সামনা সামনি দেখে তারা ভাবছিল,অন্ধকারে যে কোন সময় তাদের গলায় চাকু ধরতে পারি আমি।তাদের হয়তো ঘুম হচ্ছিল না ভেবে ওস্তাদ ওসমান মহামান্য সুলতান আর প্রধান খাজাঞ্চীর সাথে আলাপ করে,তাদেরকে যে কোন সময় তুলে দিতে পারে জল্লাদের হাতে।রাস্তার ইরজুরিমিদের লোকজনদের কথাও ওরা ভুলে যায়নি।অন্য কথায় বলা যায় তারা একটা আশ্রয় খুঁজছিল,বন্ধুত্ব খুঁজছিল।কিন্ত কোন এক কারনে ওস্তাদ ওসমানের কথায় তাদের ছিল অন্য কোন বিশ্বাস।এখন এটা আমার সায়িত্ব সিয়াহ আর কেলেবেককে বোঝানো, ওস্তাদ ওসমানের ভুল ধারণার কথা।
ওস্তাদ ওসমানকে সোজাসুজি বুড়ো পাগল বললে,একেবারেই ক্ষেপে যাবে কেলেবেক।আমার
গলায় সুন্দর চেহারার কেলেবেক কান্নায় ভঁরা চোখে যখন চাকু ধরে ছিল,তার চোখের পাতা কাঁপছিল প্রজাপতির মত,যে ভাবে তার নাম কেলেবেক।আমি অনুভব করছিলাম ওস্তাদ ওসমানের জন্যে কেলেবেকের মনের ঝড়,কেন না ও তো সব সময় ওস্তাদের প্রিয় ছাত্র ছিল।
কৈশোরে ওস্তাদ ওসমান আর কেলেবেকের অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা দেখে আমরা অন্য ছাত্ররা প্রায়ই কটূক্তি করে হাসাহাসি করতাম।ওস্তাদ আর কেলেবেক সব কিছু উপেক্ষা করে,সকলের সামনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো।শুধু তাই না ওস্তাদ ওসমান একসময় অনেকটা র্নিলজ্জের মত ঘোষনা করলো,শিষ্যদের মধ্যে কালিগ্রাফি আর তুলিয়ে কেলেবেক অতুলনীয়,তার সমকক্ষ আর কেউ নাই।যদিও সত্যি,তবে এই কথাটা তো আর অন্যান্য শিল্পী,কালিগ্রাফাররা খুব একটা খোলা মনে মেনে নেয়নি,খারাপ গালাগালি কানাঘুষা লেগেই ছিল।আমার ধারণা ওস্তাদ ওসমানের ইচ্ছা কেলেবেকেই হবে তার উত্তরাধিজারী।তা ছাড়া কেলেবেকের অন্যান্যদেরকে যে ভাবে হেনস্থা করতো সেটা ছিল অবিশ্বাস্য।হয়তো ওস্তাদ ওসমানের ধারণা ছিল জেইতিন,লেইলেক ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ছবি আঁকা বেশী পচ্ছন্দ করে
(একেবারে অস্বীকার করা যায় না),আর আমাদের সুলতাঙ্কে হয়তো বারেবারে বলতো, ‘পুরোনো দিনে ওস্তাদেরা এই ভাবে ছবি কোনদিন আঁকতো না;।
আমার ইচ্ছা সিয়াহর সাথে যতদূর সম্ভব সহযোগিতা করার,সিয়াহর ইচ্ছা সুলতানের মনের ইচ্ছা পূরন করা,এনিষ্টের বইটা শেষ করে নতুন বৌ সেকুরের মন জয় করা।হঠাৎ আমি মন্তব্য করলাম,এনিষ্টের বই নিঃসন্দেহে হবে ওটোমান সাম্রাজের অভাবনীয় একটা নতুন অধ্যায়।সুলতানের আদেশে আর প্রয়াত এনিষ্টের ইচ্ছার দেখাবে সারা বিশ্বকে ওটোমান সাম্রাজের প্রতাপ,শিল্পী,কালিগ্রাফারদের নিপুনতা।বইটা অবাক হয়ে দেখে সবাই জানতে পারবে সুলতানের শিল্পীরা শুধু শুধু পাশ্চাত্য পদ্ধতি অনুকরণ করেনি সেটাকে নিজের ছাঁচে এনে,রং
এর চমকে তাদের তৈরী করা নতুন একটা পৃথিবী।আমরা পুরোনোর থেকে ছবি আঁকার জগতে দিয়ে যাচ্ছি অভাবনীয় নতুন এক আকাশ।
কেলেবেক মাঝে মাঝেই আমাকে মারছিল,অনেকটা যেন একটা বাচ্চা ছেলের মত জানা দরকার আমার মনের সত্যি কথাটা,কোন সময় বন্ধুর মত,কোন সময় এক শত্রুর মত যে আমার ক্ষতি করার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে আছে।কেলেবেক জানতো যে আমি তার চেয়ে অনেক গুনান্বিত,হয়তো এটাও সে ভাবছিল ওস্যাদ ওসমানেরও জানা সেটা।কেলেবেকের বিষাতার দেয়া ক্ষমতার কোন তুলনা নাই,তার ঈর্ষায় আমি আরও গর্বিত হচ্ছিলাম।‘আমার দক্ষতা মিজের পরিশ্রমে,কোন ওস্তাদকে খুশি করে না’,এজন্যে আমার শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চয় তার ইর্ষার ব্যাপার।
বেশ উঁচু স্বরেই বললাম,অন্যান্য শিল্পীরা যখন মহামান্য আর এনিষ্টের বই নিয়ে নানা রকম কটূক্তি করতো,সেটা ছিল আমার কাছে একেবারেই অসহনীয়।ওস্তাদ আমাদের সকলের শ্রদ্ধার মানুষ,অথচ সেই ওস্তাদ সুলতানের খাজাঞ্চীখানায় সমস্যার উৎস খুঁজে পাওয়ার পরও জেইতিনকে কেন খুনী বলে দাবী করলো,সেটা চিন্তার বাইরে।আমি বললাম,জেইতিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,কারণ ও হয়তো ফানার গেটের কাছে কালান্দারী দরবেশের ওখানে গা ঢাকা দিয়ে আছে।ঐ দরবেশের আস্থানা আমাদের মহামান্য সুলতানের দাদার রাজত্বকালে বন্ধ হয়ে যায়,কোন কুকর্মের জন্যে না,বরং পারসীদের ঘনঘন যুদ্ধে,আমি এটাও বললাম জেইতিন মাঝে মাঝে গর্ব কর বলতো,দরবেশের বাড়ীর সামনে সে প্রায়ই পাহারা দেয়।আর সিয়াহ,কেলেবেক যদি আমাকে অবিশ্বাস করে,হাতের চাকু দিয়ে শোধ নিতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না।
কেলেবেক চাকু দিয়ে আমার বর্মে আরও কয়েকনার জোরে জোরে মারলো,ভাগ্য ভাল বর্মটা বেশ উন্নত মানের ছিল বলেই রক্ষা।সিয়াহ আমাকে অবিশ্বাস ক্রেনি,তাই সে কেলেবেক উপর ক্ষেপে গিয়ে চীৎকার করা আরম্ভ করলো।এ ফাঁকে আমি কেলেবেকের পেছনে গিয়ে ওর গলা একহাতে চেপে ধরে আরেকহাতে ওর হাতটা বাঁকা করে চাকুটা মাটিতে ফে্লতে বাধ্য করলাম।এটা ঠিক খেলা করা বলা যাবে আবার বলা যাবে না যুদ্ধ করা,অনেকটা যেন, ‘শাহনামার’,একটা ছবি।
০০০০০০
©somewhere in net ltd.