নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২০ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ১:১৬

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(৪৩)

মেয়েদের মত দেখতে মুখটাতে রক্তের দাগ ছিল না কোথাও,তবে থুঁতনি,রং মাখানো ভুরুতে মারধরের চিহ্ন স্পষ্ট দেখাই যাচ্ছিল।হাত দুটো ছিল মাথার পেছনে,বোঝাই যাচ্ছিল,কেউ তার হাত দুটো মাথার পেছনে ধরে ছিল আর অন্যান্যরা তাকে ইচ্ছেমত মুখে,শরীরে মারধর করে গেছে।জানি না ওরা কি মারার সময় বলছিল,‘ওর জিভ কেটে ফেল,ও যাতে কোনদিন হুযুর মোল্লা এফেন্দীর নামে বদনাম না করতে পারে’,এমনও হতে পারে হয়তো জিভটা কেটে নিয়ে গেছে।

‘বাতিটা এদিকে আনো’,সিয়াহ বললো।চুলার কাছে পড়ে ছিল ভাঙ্গা কাপ,কাদামাটিতে কফি,কফির গুড়া,গল্পকথকের ছবির দেয়ালের আশেপাশে সিয়াহ খুঁজছিল গল্পকারের জিনিষপত্র, রুমাল।কথায় কথায় সিয়াহ বললো,সে ছবিগুলো খুজছে,তার মধ্যে আমারও দুটো ছবি ছিল। তবে মৃত গল্পকারের পাশে পারসী টুপি ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু না পেয়ে কফি দোকানের পেছন দরজা দিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম,গোলমালের সময় লোকজন,আসরে বসে থাকা শিল্পীরাও হয়তো ছুটে গেছে ঐ দরজা দিয়ে।তবে একপাশে পড়ে থাকা গাছ,কফির ব্যাগ দেখে বোঝা গেল দোকানের পেছনটাও মারামারির হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
কফির দোকানের গোলমাল,গল্পকারের খুন-সবকিছু দেখে আমি,সিয়াহ আর বেশ কিছুটা আপন হয়ে গেছি তখন,তবে খুব একটা কথা হচ্ছিল না বেশ চুপচাপ ছিলাম,দুজনেই। একসাথে হেঁটে যাচ্ছিলাম,সিয়াহ আমার হাতে বাতিটা দিয়ে,গলায় চাকু ধরে বললো,‘এখন তোমার বাড়ীতে যাব,তোমার বাড়ী তল্লাশী করতে চাই,না হলে আমি শান্তি পাব না’।

‘লোকজন এসে আমার বাড়ী তল্লাশী করে গেছে’।

সিয়াহর কথায় আমি রাগ করিনি,তবে একটু কৌতুক করার সূযোগ চাড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না।
এত সহজেই গুজবে বিশ্বাস করে সিয়াহ আমাকে সন্দেহ করলো,তাতে এটাই প্রমান হয় যে ও আমাকে হিংসা করে।চাকুটা তখনও ছিল হাল্কা ভাবে আমার গলায়,তবে সিয়াহর চোখে মুখের আগের সেই দৃঢ়তা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

বাড়ীর উল্টা দিকের,পেছনের গলি দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে অর্ধেক রাস্তা পার হওয়ার পর সিয়াহ বললো,‘গত দুদিন ধরে আমি আর ওস্তাদ ওসমান সুলতানের খাজাঞ্চীখানার ছবিগুলো দেখছিলাম,খুনী বের করার জন্যে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি’।
কিছুক্ষণ পর সিয়াহকে বললাম,‘না বলে পারলাম না, শেখার একটা বয়স আছে,তার পরে সাধারণ শিল্পী যদি ওস্তাদ বিহজাদের সাথে একই টেবিলে বসে ছবিও আঁকে,তবুও তার কোন উন্নতি হবে না,কেন না শিল্পী ছবি আঁকে হাত দিয়ে চোখ দিয়ে না,আর ওস্তাদ ওসমানের এখন আর শেখার কিছু নাই’।
গলার স্বর উঁচু করে বললাম,আমার সুন্দরী বৌ নিশ্চয় অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে,
যাতে তার বুঝতে কষ্ট না হয় কেউ আসছে আমার সাথে,আর নিজেকে সামলে নিয়ে যেন অন্য কোথাও যেতে পারে,তা ছাড়া বেকুফ সিয়াহর এই চাকু ধরার জঘন্য ব্যাবহারটা আমার বৌ এর চোখে না পড়লেই ভাল।
আঙ্গিনা পার হয়ে ঘরের দিকে যাওয়ার সময় দেখলাম,বাড়িতে কেউ বাতি নিয়ে একপাশে সরে গেল,তবে ঐ সময় সব কিছুই অন্ধকার হয়ে ছিল।জানোয়ার সিয়াহ আমার গলায় চাকু ধরে বাড়ীতে এসে সব ছবিগুলো পরখ করে যাবে,এটা একেবারেই অসহনীয় ছিল।এই বাড়ীতে আল্লাহর দোয়ায় আমি কম ছবি আঁকিনি,এঁকে গেছি ছবির পর ছবি,ক্লান্তিতে ঘুমে না ঢুলে যাওয়া পর্যন্ত।তুলির ছোঁয়ায় আমার আঁকা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা,অপরুপ বাগান,মেঘ,বৃষ্টি কি না ছিল আমার তুলিতে-আর সেই পবিত্র জায়গায় সিয়াহ আমাকে অপমান করছে,এর প্রতিশোধ না নিয়ে আমি ছাড়বো না।

বাতিটা নীচু করে সব কাগজপত্র,ছবি এক এক করে দেখছিল,সিয়াহ।শেষ না হওয়া একটা ছবি রাখা ছিল কাজের টেবিলে,যেখানে দোষী বন্দীরা দয়ালু সুলতানের কাছে আবেদন জানাচ্ছে,তাদের শেকল খুলে মুক্তি দেয়ার জন্যে-রং,কাজের টেবিল,কাগজ,কাগজ কাঁটার বোর্ড,ছোট্ট চাকু, বসার আসনের নীচে,আলমিরা,বাক্সগুলো,বারে বারে পরখ করে দেখছিল,
সিয়াহ।যদিও সিয়াহ শুধু কাজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যাবে না,তবে এখন হঠাৎ তার আসার কারণটা আমার বৌ এর কাছে আর লুকানো হয়তো সম্ভব হবে না।
‘এনিষ্টের বই এর শেষ অংশের একটা ছবি ছিল,এনিষ্টেকে খুন করে,খুনী ঐ ছবিটা নিয়ে গেছে’।
‘ঐ ছবিটার সাথে অন্যান্য ছবির নিশ্চয় একটা পার্থক্য ছিল’,আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘এনিষ্টে,আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করবে,ছবিটার এক কোনায় আমাকে একটা গাছ আঁকতে বলে…আর গাছের পাতার সামনে কারও একজনের ছবি থাকার কথা ছিল,যতদূর মনে পড়ে আমাদের সুলতানের।বেশ বড়সড় একটা বাগানের ছবি,আর এনিষ্টে ঐ ছবিটার অপেক্ষায় ছিল।সবকিছু ইউরোপের কায়দায় আঁকা ছোট ছোট করে,এনিষ্টে আমাকে বলেই দেয় গাছটে বেশ ছোট করার জন্যে।ছবিটা আমি এমন ভাবে আঁকি যেন উপরের জানালা থেকে মনে হয় একটা দৃশ্য যেখানে ছড়ানো ছিটানো আছে অনেক কিছুই,সাধারণ একটা ছবির মত না,পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে আর বর্ডার দেয়া,ফ্রেমে সাজানো’।
‘জারিফ এফেন্দীর দায়িত্ব ছিল বর্ডার দেয়া আর ফ্রেম সাজানোর’।
‘ওটার কথা যদি তুমি বলছো,তা হলে আমি তাকে খুন করিনি’।
‘খুনী কোনদিন তার খুন স্বীকার করে না’,বলে,সিয়াহ আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,গোলমালের সময় আমি কফির দোকানে কি করছিলাম?
বাতিটা পাশে রেখে আর এমন ভাবে সিয়াহ অন্ধকারে বসে ছিল যাতে আলো সম্পূর্ন আমার মুখে ছড়ায়,আর আমার চোখে মুখের প্রতিক্রিয়া খুব সহজেই তার চোখে পড়ে।
সিয়াহকে যা বললাম সেটা তোমাদেরকেও বলছি,আড্ডা দেয়ার জন্যে মাঝে মাঝে আমি কফির দোকানে যেতাম,ঘটনাচক্রে গণ্ডগোলের সময় আমি ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম।এটাও সত্যি কথা যে যদিও কফির দোকানে আমার গোটা দুয়েক ছবি ঝুলানো ছিল গল্পকারের জন্যে,তবে কফির দোকান আমার খুব পচ্ছন্দের জায়গা না।
সিয়াহকে বললাম, ‘তা ছাড়া,এক্টা ছবির উদ্দেশ্য যদি কাউকে নিন্দা করা বা বিকৃত করা হয় তাতে ছবিরই বদনাম হয়,আর ওটার উদ্ভব তো শিল্পীর তুলিতে না বরং মানুষের মাঝে ছড়ানো বদনাম থেকে।ও ধরণের ছবিতে আল্লাহর দেয়া শিল্পীর প্রতিভার কোন প্রকাশ নাই…সে যারই বদনাম করুক শয়তান হোক আর ইরযুরুমির মোল্লাই হোক…আর এটাতো সত্যি কথা যে কফির দোকানে ইরসুরুমির মোল্লাদের বদনাম করে কাদামাটি না ছড়ালে, এখানে কোন গোলমালই হতো না’।
‘সবকিছু জেনেশুনেও তুমি ওখানে গেলে’,শয়তান সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো?
‘কেন যাব না,আমি তো বলিনি একেবারেই আমার অপচ্ছন্দের জায়গা ছিল কফির দোকানটা’,সিয়াহ কি ভাবছে আমার কথাগুলো শুনে কে জানে।
আবার বললাম, ‘যদিও জানি নোংরা আর দৃষ্টিকটু তবুও আমরা আদমের তো বংশধর ঐ ধরণের পথটাই আমাদের বেশী পচ্ছন্দের।ভাল লাগতো সোনার মোহর,কুকুর,শয়তানের ঐ সস্তাদরের ছবি দিয়ে বানানো গল্পগুলো শুনতে’।
‘কিন্ত বল,কেন যাবে ঐ কাফেরদের আড্ডায়’?
‘ঠিক আছে,একটা পোকা আমাকে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছে।তুমি কি জান যখন ওস্তাদ ওসমান,এমন কি স্বয়ং মহামান্য সুলতান আমাকে সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী হিসাবে ঘোষনা করলো,এতই ভঁয়ে ভঁয়ে ছিলাম যে বেশীর ভাগ সময়টাই অন্য শিল্পীদের সাথে কাটাতাম,
তাদের মত হওয়ার চেষ্টা করতাম,যাতে তারা আমাকে একপাশে না ঠেলে দেয়।এখন কি কিছু বুঝতে পারছো?তখন থেকেই ওরা আমাকে ইরুযুমির একজন ভাবা আরম্ভ করলো,এ জন্যেই ঐ আড্ডায় যেতাম যাতে নতুন করে আরেকটা গুজব না চালু হয়’।
‘জান ওস্তাদ ওসমান কথায় কথায় এটাও বললো যে তুমি অনেক সময় তোমার প্রতিভা আর দক্ষতার জন্যে ক্ষমা চাইতে’।
‘ওস্তাদ ওসমান আমার সমন্ধে আর কি বললো’?
‘তোমার আঁকা ছবিগুলো ছিল অস্বাভাবিক সুন্দর,এমন দক্ষ যে তুমি ছবি আঁকতে পার এক দানা চালে,গমে,নখে যাতে সবাই ভাবে তুমি ছবি আঁকার জন্যে জীবনের অন্যান্য সবকিছু বির্সজন দিতে দ্বিধা করনি।আর তুমি আল্লাহর দেয়া এই প্রতিভা নিয়ে শুধু অন্যান্য সবাইকে খুশী করায় ব্যাস্ত হয়ে আছ’।

‘তুমি হয়তো বলতে পার ওস্তাদ ওসমানের দক্ষতা ওস্তাদ বিহজাদের চেয়ে কোন অংশে কম না,তা ছাড়া আর কি বলবে’,আমি বললাম।
‘ওস্তাদ ওসমান তোমার দোষগুলো খুব সহজেই তুলে ধরলো’,শয়তানটা বললো।
‘ঠিক আছে আমার দোষ কি কি বল দেখি’।
‘ওস্তাদ ওস্মানের একটা মন্তব্য হলো তুমি ছবি আঁক শিল্পের ভালবাসায় না,শুধু অন্যের অনুগ্রহের জন্যে,খ্যাতির জন্যে।তোমার মনে সবসময় একই কথা,একই চিন্তা ছবিটা দেখে কে কি ভাববে,সেখানে ছবি আঁকার আনন্দ কিছুই না’।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল,ভেবে কি ভাবে ওস্তাদ ওসমান যার কাজ ছিল একজন সাধারণ কেরানীর মত শুধু চিঠি লেখা,সেই ওস্তাদ সিয়াহকে আমার সমন্ধে এই সব কথা বললো।

সিয়াহ আরও বললো, ‘জান ওস্তাদ ওসমানের কথায় পুরোনো দিনের ওস্তাদেরা ছবি আঁকার ধরণ কায়দা সারা জীবন ধরে রাখে,সেটা ছেড়ে দেয় না কখনও।তারা কখনও ভুলে যায় না তাদের ছবি আঁকার নিয়ম,কোন সুলতান,পাশা বা শাহজাদার জন্যে তাদের সারা জীবনের শিক্ষাটা।আর তুমি উৎসাহ নিয়ে সুলতানের দোহাই দিয়ে এনিষ্টের বই এর জন্যে ইউরোপীয়ান কায়দায় ছবি আঁকলে’।

আমি বললাম, ‘নামকরা ওস্তাদ শিল্পী ওসমানের কোন বদ ইচ্ছা ছিল ঐ কথাগুলোতে,দাঁড়াও তোমার জন্যে একটু চা আনি’।
পাশের ঘরে গেলাম,তখন আমার প্রিয়া এসথারের কাছ থেকে কেনা রাতের পোষাকটা খুলে আমার মাথায় ছুঁড়ে দিল,তার ছলনার খেলায় আমি রখন অস্থির হয়ে আছি।
‘দাড়াও তোমার জন্যে আমি চা নিয়ে আসি’,বলে গেলাম সিয়াহকে আর এদিকে আমার বৌ লিঙ্গ নিয়ে খেলা করছে তখন।
বাক্সে লুকানো তলোয়ারটা বের করলাম,এতই ধারালো ছিল অস্ত্রটা যে ওটাতে একটা রুমাল ছুঁড়ে মারলেও সেটা কেটে যাবে,একটা সোনার পাতা যদি ধরা হয় ওটা এত সুন্দর ভাবে কাটা হবে যে একেবারেই অবিশ্বাস্য।
যাকগে এক্সময় তলোয়ারটা রেখে ফিরে গেলাম,সিয়াহ আমার প্রশ্নোত্তরে এতই সন্তষ্ট ছিল যে হাতের চাকুটা নিয়ে সে তখন লাল গদিটার পাশে হাটাহাটি করছিল।আমি একটা অসম্পূর্ন ছবি গদিতে রেখে বললাম, ‘এই ছবিটা দেখ’,আর সিয়াহ হাঁটু গেড়ে ছবিটা বোঝার চেষ্টা করছিল।সিয়াহর তলোয়ারটা নিয়ে পেছনে গিয়ে সিয়াহকে মাটিতে ফেলে হাঁটু গেড়ে চেপে বসলাম,চাকুটা তখন পড়ে গেছে তার হাত থেকে।চুল টেনে তলোয়ারের মাথাটা ওর গলায় চেপে ধরলাম,ও অবশ্য নড়াচড়া না করে একেবারেই চুপচাপ ছিল,না হলে ঐ মুহুর্তেই ওকে শেষ করে ফেলতাম।
‘ফেরদুন শাহ ভুলে তার রাজত্ব ভাগ করে দিল তিন ছেলের মধ্যে এমন ভাবে,বড় দুই ছেলেকে রাজত্বের অংশগুলো যেখানে তেমন কোন ফসল হতো না,তবে ছোট ছেলে ইরাজের ভাগে পড়লো পারস্য।তুর ভায়ের উপরে প্রতিশোধ নেয়ার কায়দা করে কাছে ডেকে নিয়ে যায় আর তার গলা কাটার আগে শরীরের উপর ভঁর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “এখন বুঝতে পারছো আমি কে”?
সিয়াহর অবস্থাটা তখন অনেকটা কোরবানীর ভেড়ার মত বলার কিছু নাই,শুধু দেখে যাওয়া আর কিছু করার ছিল না তার।সিয়াহ কোন কিছু না বলে শুনে যাচ্ছে,আর সেটা আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছিল।
‘আমি শুধু পারসী ছবি আঁকার পদ্ধতির ভক্ত না,আমি ওদের খুন করার পদ্ধতির ভক্তও।
তুমি জান কি না জানি না,শাহ সিভায়ুসের মৃত্যুর অন্য ভাবে আঁকা ছবিটাও আমার দেখা আছে’।

সিয়াহকে বললাম ‘জান কি ভাবে শাহ সিভায়ুস,ভায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে প্রাসাদ পোড়ালো,সম্পত্তি,বৌ ছেড়ে কি ভাবে ছুটে গেল যুদ্ধে।যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর বিপক্ষ দলের নেতারা ঝগড়া করছিল কি ভাবে তার মাথার চুল টেনে চাকু দিয়ে গলা কাঁটবে।এক ফাঁকে জিরু এসে আমি যে ভাবে তোমার চুল ধরে আছি,সেই ভাবে চুলটা ধরে গলা কেটে দিল।একই ভাবে তোমার রক্ত ছুটে যাবে মাটিতে,হবে কালো ধুলা,হয়তো সেখানে আসবে একটা ফুল গাছ’।
বাইরের রাস্তায় এরজুরুমিদের হৈচৈ গন্ডগোলের শব্দ ভেসে আসছিল,যদিও সিয়াহর গলায় পা দিয়ে বসেছিলাম তবুও কেন জানি মনে হলো আমরা একে অন্যের বেশ ঘনিষ্ঠ।
‘একটা কথা জান,এই দৃশ্যটা তুলে ধরা শিল্পীদের জন্যে কি কষ্টকর সেটা তোমাকে কি ভাবে বোঝাবো?যেখানে জল্লাদ আর চাকুর মানুষ দুজনে এক হয়ে গেছে।যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা,
যুদ্ধ,হিংসা শাহ সিভায়ুসের গলা কাঁটার ঠিক আগের দৃশ্যগুলো অনেকটা যাদুর মত যেন ছবিতে ফুটে উঠে।এমন কি কাজভিনের নামকরা মিশে যাওয়া দুটো শরীর দেখে হতভম্ব হয়ে যাবে,কিন্ত এই যে আমরা দুজন জানি ছবিটার অপূর্ব চেহারা’।
‘চাকুটা এখন আমার গলা কাটছে’,সিয়াহ বললো।
‘তোমার কথা শুনে আমার কোন সহানুভুতি হচ্ছে না।তবে আমি এমন কিছু করতে চাই না যাতে এই সুন্দর দৃশ্যটা তছনছ হয়ে যায়।নাম করা ওস্তাদের প্রেম,যুদ্ধ,মৃত্যুর ছবি দুটো শরীর তুলির আঁচড়ে কবিতার ছন্দে যেন এক হয়ে আছে,ওস্তাদরা হয়তো বুঝতো আমাদের কান্নাটা।এই দেখ না আমার মাথা এখন তোমার কাঁধে যেন একই শরীরের দুটো অংশ,
তোমার চুলের,শরীরের সুবাস ছুটে আসছে আমার নাকে।আমার পা দুটো এমন ভাবে ছড়ানো তোমার পায়ের পাশে অনেকে ভুল করতে পারে চারপেয়ে একটা জন্ত।আমার শরীরের ওজন কি তুমি তোমার পিঠে,উরুতে বুঝতে পারছো’?
কোন উত্তর পেলাম না,অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা,কিন্ত আমি তলোয়ারটা আর নাড়াচাড়া করিনি তাতে সিয়াহর গলাটা কেটে যেতে পারে।
তার কানে ফিসফিস করে বললাম, ‘কিছু না বললে আমি কিন্ত কামড়ে তোমার কান ছিঁড়ে ফেলবো’।
দেখলাম তার চোখ কিছু একটা বলার জন্যে প্রস্ততি নিচ্ছে,একই প্রশ্ন করলাম আবার, ‘আমার শরীরের ওজন অনুভব করছো,এখন’?
‘হ্যা’।
‘আমরা দুজনে ওস্তাদদের আঁকা ছবির মতই সুন্দর,তাই না’?
‘জানি না,কোন আয়না নাই সামনে,যেখানে সবকিছু দেখা যাবে’,সিয়াহ উত্তর দিল।
না জানি,আমার বৌ পাশের ঘরে কি ভাবছে,উত্তেজনায় ইচ্ছা হচ্ছিল সিয়াহর কানে সত্যি সত্যি কামড় দিতে।
‘সিয়াহ এফেন্দী জান,তুমি তলোয়ার নিয়ে জোর করে আমার বাড়ীতে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টা করছিলে,এখন বুঝতে পারছো আমি কি জিনিষ’?
‘হ্যা,আমি এখন বুঝতে পারছি,তুমি অযৌক্তিক কিছু করনি’।
‘ঠিক আছে,তুমি জিজ্ঞাসা করতে পার,কি জানতে চাও’?
‘তা হলে বল,ওস্তাদ ওসমান তোমাকে কি ভাবে আদর করতো’?
‘ছোট বেলায় আমি ছোটখাট আর দেখতেও খুব সুন্দর ছিলাম,ওস্তাদ ওসমান আমার উপরে উঠে যেত ঠিক আমি যে ভাবে আছি তোমার উপরে।আমার গালে,হাতে আদর করতো ইচ্ছামত,তার কাছে শেখার জন্যে আমি সবসময় অস্থির হয়ে থাকতাম,তাই কোনকিছুই বিচলিত করেনি আমাকে।ওস্তাদ ওসমানের জন্যে ভালবাসা আমাকে দেখালো শিল্পের,চারুকলার ভালবাসার পথটা।জানা হলো আমার রং এর চমৎকারিত্ব,ওস্তাদ আমার কাছে বাবার চেয়েও বেশী ভালবাসার মানুষ’।
‘ওস্তাদ কি তোমাকে প্রায়ই মারধর করতো’?
‘ওস্তাদ বাবার মত আমাকে মারতো যাতে বুঝতে পারি আমার ভুলত্রুটি,আর ওস্তাদের মত আমাকে মারতো যাতে তার ব্যাথায় আমার শেখায় কোন ভুল না থাকে।ঐ মারে ব্যাথায় আর নখের খোচানীতে,অনেক জিনিষই শেখাটা আমার কাছে সময় লাগেনি।ওস্তাদ কোনদিন আমার চুল ধরে টানেনি,আমার মাথা দেয়ালে ঠুকে দেয়নি কখনও।আমি তার কাছে চিরদিনের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো’।
‘না,তুমি সত্যি কথাটা বললে না’,সিয়াহ উত্তর দিল, ‘তুমি তার উপর রেগে ছিলে এতই যে সেই রাগের প্রতিশোধ নিলে তুমি,আমার এনিষ্টের জন্যে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে ছবি আঁকলে’।
‘তুমি যা বললে তার উল্টাটাই সত্যি,একজন শিষ্য তার গুরুর হাতে মারধর খেলেও গুরুর প্রতি তার রাগ হয় না বরং সম্মান বেড়ে যায়’।
‘নিষ্ঠুর ভাবে চক্রান্ত করে ইয়াজ আর সিয়ায়ুসের পেছন দিক থেকে গলার কাঁটার মত যে ভাবে তুমি আমার গলা কাটতে চাচ্ছ,তার কারণ কিন্ত ভাই ভাই এর ঈর্ষা যার উদ্ভাবনা এক অত্যাচারী বাবার কাছ থেকে’।
‘মেনে নিচ্ছ,কথাটা ঠিক’।
‘তোমাদের শিল্পীদের অত্যাচারী ওস্তাদ,যার কাছ থেকেই তোমাদের শেখা একে অন্যের গলা কাটার পদ্ধতি।সেই ওস্তাদ এখন তোমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে’,বেশ র্নিলজ্জ ভাবেই সিয়াহ বললো, ‘আহ!ব্যাথা লাগছে,গলা কেটে যাচ্ছে’,যন্ত্রনায় বলে উঠলো সিয়াহ।
তারপর আবার বলা আরম্ভ করলো, ‘এটা তো জানাই কথা,আমার গলা কেটে,রক্তের বন্যা ছড়াতো পারো তুমি মূহুর্তেই,তবে আমার কথা যদি শোন,তা হলে তুমি বুঝতে পারবে অনেক কিছুই,আর তোমাকে ভেবে অবাক হতে হবে না যে আমার বলার কি ছিল?তলোয়ারটা একটু সরাবে’?
আমি তলোয়ারটা একপাশে সরালাম।
‘ওস্তাদ ওসমান যাকে তুমি ছোটবেলা থেকে আসছো,যে দেখতো তোমার মধ্যে আল্লাহর দেয়া প্রতিভার বিকাশ অনেকটা বসন্তে ফোঁটা ফুলের মত।সেই ওস্তাদ ওসমানই এখন তোমার বিপক্ষে,শুধু নিজের ছবি আঁকার স্কুলটাকে বাচানোর জন্যে,কেননা ওটাই তো তার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন’।
‘জারিফ এফেন্দীকে কবর দেয়ার কথা মনে পড়ছে,এই যে ষ্টাইল নিয়ে সবাই লাফালাফি করছো,সেটা কত জঘন্য বলার অপেক্ষা রাখে না’।
সিয়াহ বললো, ‘আমরা যা বলছি,সেটা শিল্পীদের আঁকার বিশেষ কায়দা নিয়ে,কিন্ত ওস্তাদ ওসমান অস্থির হয়ে গেছে তার স্কুলের পদ্ধতি রক্ষা করতে’।

সিয়াহ আমার কাছে ব্যাখা করলো,সুলতানের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন জারিফ এফেন্দী আর এনিষ্টের খুনীকে খুঁজে বের করা,এ জন্যে সুলতান তাদেরকে নিজের খাজাঞ্চীখানা খুলে তদারক করতে দেয়াতেও দ্বিধা করে নি।তবে এই সূযোগে ওস্তাদ ওসমান চেষ্টা করছে,
এনিষ্টের বইটাকে ধ্বংস করতে,আর ভেনিসিয়ান পদ্ধতির শিল্পীদের উপর প্রতিশোধ নিতে।ছবি আঁকার কায়দা দেখে ওস্তাদ ওসমান বুঝে গেছে যে ছবির ঘোড়া আর নাকটা জেইতিনের তুলিতে আঁকা,কিন্ত ওস্তাদ কেন জানি প্রস্তত হয়ে আছে লেইলেককে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে।
বুঝতে পারলাম,তলোয়ারের ভয় পেয়ে বাচ্চা ছেলের মত সিয়াহ সবকিছু বলে দিল,তবে সিয়াহর কথায় আমি আনন্দে আরও উৎফুল্ল হয়ে গেলাম,লেইলেক সরে গেলে,ওস্তাদ ওসমানের পরে আমিই হবো রাজশিল্পী,আল্লাহ ওস্তাদ ওসমানকে দীর্ঘজীবি করবে।
সিয়াহর কথায় আমার অস্থিরতা যে বেড়ে গেল তা না,ভাবছিলাম যা ভাবছি তা যদি না হয়।সিয়াহর কথায় এটাও বোঝা গেল,ওস্তাদ ওসমান শুধু জেইতিন না,আমাকেও বির্সজন দিতে দ্বিধা করবে না।সবকিছু শুনে তখন বাচ্চা ছেলের মত হয়ে গেছি যে হঠাৎ তার বাবাকে হারালো।সিয়াহর গলা কাটার কথা আমাকে ভুলে যেতে হবে।
কি অদ্ভুত শিল্পীদের মনোভাব,একটা বই এর কটা ছবি ইউরোপিয়ান পদ্ধতিতে আঁকার জন্যে আমরা বিশ্বাসঘাতক হয়ে গেলাম?বুঝতে পারলাম এটা এনিষ্টে এফেন্দীর মৃত্যুর জন্যে দায়ী জেইতিন আর লেইলেকের কাজ,আমার বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত।
‘চলো,জেইতিনের বাসায়,সারা বাড়ী আমরা তন্ন করে খুঁজবো’,আমি বললাম,‘আর শেষ ছবিটা যদি তার বাসায় পাওয়া যায়,তা হলে বুঝতে পারবো কাকে ভঁয় করা দরকার,আর ওখান থেকে আমরা তিনজনে মিলে যাব লেইলেকের বাসায়’।
সিয়াহকে বললাম,আমাকে বিশ্বাস করার জন্যে,ওর চাকুটাই যথেষ্ট,আর কিছু দরকার হবে না,বাড়িতে তাকে এক কাপ চা দিতে না পারার জন্যে মাফ চাইলাম।সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর পর আমরা দেখছিলাম তোষকটার দিকে যেখানে সিয়াহর গলায় তলোয়ার ধরে আমি বসে ছিলাম।বললাম তার গলার তলোয়ারের আঁচড়টা আমাদের বন্ধুত্বের একটা চিহ্ন,একটু একটু রক্ত বের হচ্ছিল সিয়াহর গলার চামড়া দিয়ে।

রাস্তায় ইরজুমির লোকজনের হৈচৈ আর ছুটে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল,আমাদের দিকে কেউ নজর দিচ্ছিল না,কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম জেইতিনের বাসায়।বাগানের দরজা,বাড়ীর দরজা,এমন কি জানালার খিড়কিতেও ধাক্কা দিলাম,বাড়ীতে কেউ ছিল না।
এত জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছিলাম,নিশ্চিত যে বাড়ীতে কেউ ঘুমাচ্ছিল না।সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো, ‘বাড়ীর ভেতরে যাবে নাকি’?
দরজার খিড়কিটা সিয়াহর চাকুর বাঁকা অংশ দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকলাম।বছরের পর বছরের জমে থাকা ধুলাবালির,একাকীত্বের,স্যাতস্যাতে একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল।বাতির আলোতে দেখলাম অগোছালো বিছানা,ছড়ানো ছিটানো বালিশ,তোষক,পাগড়ী,গেঞ্জি,নিমেতুল্লাহ এফেন্দীর পারসী ডিক্সিনারী,পাগড়ী রাখার আলনা,সূচ,সুতা,একটা পাত্রে আপেলের খোসা,ছবি আঁকার রং,কয়েকটা তুলি।একপাশে রাখা আঁকা ছবিগুলো দেখছিলাম,তবে সিয়াহর উৎসাহ ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশী।জেইতিনকে যত প্রতিভাবান ভাবে সবাই হয় আসলে অত প্রতিভাবান না,সে।তবে তার প্রতিভার অভাব ঢাকা পড়ে যেত,পুরোনো ওস্তাদেরকে নকল করে।পুরোনো ওস্তাদদের ছবি একজন শিল্পীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে,ছবিটা ফুটে শিল্পীর তুলিতে নতুন কায়দায়।

০০০০০০০০০০০০০

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ১:৩৫

শ্রাবণধারা বলেছেন: আমি আপনার আগের পোস্টে একটি ভুল কথা বলেছিলাম। সেটা হল এই বইটির বাংলা অনুবাদ আছে,এবং আমি সেটা পড়েছি।
আসলে পামুকের যে বইয়ের অনুবাদ আমি পড়েছিলাম সেটি "My Name Is Red" নয়, সেটির নাম "Istanbul: Memories of a City" অনুবাদক সৌরিণ নাগ।

তার্কিশ ভাষায় লেখা পামুকের সেই বইটির মূল নামে "শহর" শব্দটি আছে। এই বইটি পড়ার সময় প্রথম জানতে পারি যে শহর শব্দটি তুর্কি ভাষা থেকে এসেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.