নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

০১ লা জুলাই, ২০২৪ রাত ১:০৫

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখ


(৪১)

এটা ইসথারের সৌভাগ্য যে সে লেখাপড়া জানে না,তাই খুব সহজেই বলতে পারে,
‘মুখের ভাব ভঙ্গী দেখেই অনেক কিছু বোঝা যায়’।
‘সেকুরের মুখ দেখে তুমি কি বুঝলে’?
‘সেকুরে,অসহায় একটা মেয়ে’।
বেশ কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ বসে ছিলাম,রাতের অপেক্ষায় একটা পেঁচা বসে ছিল গ্রীক চার্চের একপাশে,পাড়ার শয়তান ছেলেরা আমার পোষাক দেখে ঠাট্টা করছিল,কবব্রস্থানের বাইরে বসা কুকুরটা গাঁ চুলকাতে ব্যাস্ত।
‘দৌড়াচ্ছ কেন,একটু আস্তে আস্তে হাট’,চীৎকার করে সিয়াহকে বললাম, ‘আমি তোমার মত দৌড়াতে পারবো না,আর এই টুপলি টোপলা সাথে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে’?
‘হাসানের বাড়ীতে যাওয়ার আগে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি কয়েকটা ছেলের কাছে নিয়ে যাচ্ছি ওদের প্রেমিকার জন্যে রুমাল,ব্যাগ এটা সেটা বিক্রি করতে পারবে’।
সিয়াহর এটা একটা বিরাট গুন,হাসিঠাট্টা করে সে অনেককিছুই হাল্কা করতে পারে।
‘তোমার যদি লোকজন জোগাড় করে গণ্ডগোল করার ইচ্ছা থাকে তা হলে তোমার সাথে আমার হাসানের বাড়ীতে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নাই’,আমি বললাম, ‘ঝগড়াঝাটি,মারামারি থেকে আমি দশহাত দূরে থাকি’।
‘তুমি যদি আমার চেনা চালাক এসথার হও তা হলে ঝগড়াও হবে না,মারামারিও হবে না’।
আক্সারা পার হয়ে আমরা তখন লাঙ্গা বাগানের দিকে যাচ্ছি,কাদামাটির রাস্তা পার হয়ে সিয়াহ গেল এক নাপিতের দোকানে।দেখলাম সিয়াহ দোকানের মালিক নাপিতের সাথে কথা বলছে যার দাঁড়ি কাটছিল এক কমবয়সী ছেলে,হয়তো বা তার শিষ্য।একটু পরেই,শিষ্য,ওস্তাদ নাপিত আরও বেশ কয়েকজন লোক আমাদের সাথে আক্সারার রাস্তায় জমা হলো,হাতে কুড়াল,তলোয়ার।আমার বিশ্বাস হয়নি,একপাশে তলোয়ার হাতে ছিল মাদ্রাসার ছাত্র সেহাবজাদাও।
‘তুমি কি দিনে দুপুরে একটা বাড়ীতে হানা দিতে চাচ্ছ’,আমি বললাম।
‘চারপাশে অন্ধকার হয়ে গেছে অনেক আগেই,এটাকে দিন বলা যায় না’,সিয়াহ উত্তর দিল।
‘তুমি কি ভাবছো তোমার গুণ্ডার দল থাকলেই সবকিছু সহজ হয়ে যাবে?জানিসারিরা (পুলিশ)যদি খোঁজ পায়,তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এ ভাবে ছুটে যাওয়ার কথা,তা হলে জানই কপালে কি আছে?’আমি বললাম।
‘কেউ আমাদের খোঁজ পাবে না’।
‘তুমি মনে হয় খবরটা জান না,গতকাল এরজুরুমি লোকজন নিয়ে প্রথমে সুড়িখানায় হামলা করে,পরে আবার সাকারকাপের দরবেশের বাড়ীতেও হামলা করে।একজন বুড়ো মানুষ গতকালকে মারা গেছে,এই অন্ধকারে লোকজন ভাবতে পারে তুমি ঐ দলের একজন’।
‘শুনলাম এ্নিষ্টে এফেন্দী্র বাড়ীতে তোমার খুব যাতায়াত ছিল,কথাবার্তায় মনে হচ্ছে তুমিই যেন এনিষ্টে এফেন্দীর বৌ।এনিষ্টে এফেন্দীর ও কি ইরজুরুমের ঐ শয়তান মোল্লাদের সাথে ওঠা বসা ছিল নাকি’?
‘আমার কথা এনিষ্টে এফেন্দীর বৌ এর মত যদি শোনায়,তার একটাই কারণ আমি সেকুরেকে আমি খুব পচ্ছন্দ করি,ওর ভাল চাই,ওকে সাহায্য করতে চাই’,আমি বললাম।
রাস্তায় বের হয়ে ভঁয়ে বুকটা ধুকধুক করছিল,বাদাম আর জামের গাছ চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে তখন।মনে হচ্ছিল,জিন,অশরীরি আত্মারা আমার ব্যাগটার পাশ দিয়ে ছুটে খবরটা পৌছে দিল শুয়ে থাকা কুকুরদের কাছে,আর কুকুরের দল এক এক করে চীৎকার করা আরম্ভ করলো।সিয়াহকে আঙ্গুল দিয়ে হাসানের বাড়ীটা দেখালাম,অন্ধকারে বাড়ীর ছাঁদ আর জানালার দিকে দেখছিলাম,সিয়াহর সাথে আসা লোকজন বাড়ী ঘেরাও করে চারপাশে দাঁড়িয়েছিল।
‘যেখানে তাতার ফকিরটা ভিক্ষা করছে ও পাশেই বাড়ীতে ঢোকার রাস্তা’,আমি বললাম, ‘লোকটা অন্ধ হলে কি হবে,ও কিন্ত ঠিক বুঝতে পারে কে আসছে আর কে যাচ্ছে,যদিও সব সময় এমন একটা ভাব দেখায় যেন ও সুলতানের খেলার বাদর।ওর হাত ধরে গোটা দশেক রুপার মোহর দিলে ওর কাছে অনেক খবর পাবে’।

দূর থেকে দেখে মনে হলো সিয়াহ অন্ধ ফকিরটার হাতে কিছু পয়সা দিয়ে তলোয়ারটা তার গলায় ধরে প্রশ্ন করছে।তবে হঠাৎ কি যে হলো,জানি না, দেখি নাপিতের শিষ্য তাতার ফকিরটাকে ধরে বেশ মারধর করা আরম্ভ করলো।ভাবলাম হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যে ঐ মারধর থেমে যাবে,তবে দেখলাম সেটা আমার বোঝার ভুল।বাধ্য হয়েই ছুটে তাতার ফকিরটাকে টেনে অন্য দিকে নিয়ে গেলাম।
‘ও আমার মাকে গালাগালি দিচ্ছিল’,নাপিতের শিষ্যটা বললো।
‘হাসান বাড়ীতে নাই’,সিয়াহ বললো, ‘তবে আমরা কি ঐ অন্ধ মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারি’?
সিয়াহ হাতে লেখা চিরকুটটা দিয়ে বললো, ‘ভেতরে হাসানকে দিবে,আর হাসান না থাকলে তাহলে ওর বাবাকে দিও’।
‘সেকুরেকে কিছু বলার নাই’?চিরকুটটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘সেকুরের সাথে পরে আলাপ আলোচনা হবে,এখন কিছু লিখলে বাড়ীর ভেতরের অযথাই লাফালাফি করবে।তবে সেকুরেকে বলো,ওর বাবার খুনীকে খুঁজে পাওয়া গেছে’।
‘সত্যি’?
‘তোমাকে বলতে বললাম,বলো’।
তাতার ফকিরটা তখনও হাউমাউ করে কাঁদছিল,ওকে সান্তনার দু একটা কথা বলে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করলাম।
‘ভুলে যেও না,আমি তোমার জন্যে কত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে আমাকে’,সিয়াহকে বললাম,এক সময় মনে হলো এই গোলমালের সুত্র আমার কাছ থেকেই।
কেন যে আমি এ ব্যাপারে নাক গলাতে গেলাম?বছর দুয়েক আগে ইদিমে গেটে পাড়ার লোকজন এক ফেরীওয়ালাকে ক্ত অত্যাচার করে যে মারলো,অমানুষিক ভাবে-প্রথমে ওরা কানটা কাটে-ফেরীওয়ালা যে মেয়েটার ঘটকালি করছিল তার পালিয়ে বিয়ে করে আরেকজনের সাথে,সব দোষ তখন ফেরীওয়ালার উপরে।আমার দাদী বলতো তুর্কীদের মেজাজ ঝড়ো বাতাসের মত,কখন যে কোনদিকে ছুটে যাবে,ওরা যে কোন কারণেই মানুষকে খুন করতে পারে।এ সব ঝামেলা ফেলে বাড়ীতে আমার প্রিয় স্বামী নেসিমের সাথে মসুরের ডালের সুপ খেলেই মজা হতো।যদিও ইচ্ছে হচ্ছিল না,তবু সেকুরের কথা ভেবে বাড়ীর ভেতরে ঢুকলামম,অবশ্য আমার কৌতুহলও খুব একটা কম ছিল না।
‘ফেরীওয়ালা নতুন নতুন সিল্কের রুমাল,ওড়না আছে’।
মনে হলো জানালার পর্দার পেছনে একটা বাতি নড়ে গেল,দরজা খুলে হাসানের বাবা আমাকে ভেতরে ঢুকতে বললো।বাড়ীর ভেতরটা বেশ গরম,সেকুরে খাবার টেবিলে ছেলেদের সাথে বসে ছিল।
‘সেকুরে তোমার স্বামী দেখা করতে চায়’,আমি বললাম।
‘কোন স্বামী’?
‘কেন সিয়াহ,তোমার নতুন স্বামী’,আমি বললাম, ‘ও লোকজন সাথে নিয়ে বাড়ীর চারপাশ ঘেরাও করে বাইড়ে দাঁড়িয়ে আছে,সবাই হাসানের সাথে মারমারি করার জন্যে তৈরী হয়ে আছে’।
‘হাসান এখানে নাই’,সেকুরের শ্বশুর বেশ নরম সুরে উত্তর দিল।
‘ওর ভাগ্যটা ভাল,এই চিরকুটটা দেখ’,আমি একজন বিচক্ষন দূতের মত সিয়াহর চিঠিটা সেকুরের শ্বশুরের হাতে দিলাম।
সেকুরে আমাকে ডেকে বললো, ‘এসথার এ ঘরে আস,মসুরের ডালের সুপ আছে,শরীরটা একটু গরম করে নাও’।
‘আমি মসুরের ডালের সুপ পচ্ছন্দ করি না’।সেকুরের কথা বলার ধরণটা আমার পচ্ছন্দ হয় নি,তার ভাবটা ছিল এমন যেন সেই বাড়ীর গিন্নী।তবে বুঝতে পারলাম ওটা আমার সাথে একা হওয়ার একটা সূযোগ শুধু।
‘সিয়াহকে বলো,এ সব ঝামেলা হলো শুধু সেভকেতের গোয়ার্তুমির কারণে,’ফিসফিস করে সেকুরে বললো।‘খুনীর ভঁয় থাকলেও সারাটা রাত্রি আমি আর ওহান অপেক্ষা করছিলাম সিয়াহর জন্যে।ওহান ভঁয়ে কাঁপছিল সবসময়,আমি যে কি ঝামেলায় আছি শুধু মহান আল্লাহই জানে,আমার ছেলেরাও দুই দলে ভাগাভাগি হয়ে গেছে।এমন কোন মা আছে যে ছেলেকে ফেলে থাকতে পারে?সিয়াহ যখন আসেনি,হাসানরা আমাকে বললো সুলতানের লোকজনের কাছে মার খাওয়ার পর সিয়াহর খুন করার কথা সব জানা গেছে’।
‘তোমার বাবা যখন খুন হয়,সিয়াহ তো তোমার সাথেই ছিল’।
সেকুরে তার সুন্দর বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে মিনতি করলো, ‘এসথার,আমাকে একটু সাহায্য কর’।
‘আমি জানতে চাই তুমি হাসানদের কথায় কেন চলে আসলে,সাহায্য করার কথা না হয় পরে ভাবা যাবে’।

‘জানি না আমি কেন যে চলে আসলাম’?সেকুরের কান্না ভঁরা চোখে উত্ত্র দিল,‘আমার আর সেভকেতের সাথে সিয়াহ খুব একটা ভাল ব্যাবহার করেনি।আর হাসান যখন বললো ছেলেদের বাবা বাড়ীতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে,কেন জানি আমার বিশ্বাস হলো হাসানের কথায়’।
সেকুরের চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সে মিথ্যা কথা বলছে,মনে হয় সেকুরেও সেটা জানতো। ‘হাসানের মিষ্টি মিথ্যা কথা আমি বুঝতে পারিনি’,আবার ফিসফিস করে বললো সেকুরে।তবে ওর কথানার্তায় বোঝা যাচ্ছিল হাসানের প্রতি সেকুরের দূর্বলতা,হাসানের জন্যে লুকোনো ভালবাসার ছোয়াচ।অবাক হচ্ছিলাম ভেবে,সেকুরে কি বুঝতে পারছে না সিয়াহকে বিয়ে করার পর এখন হাসানকে নিয়ে তার এত চিন্তাভাবনা আর মানায় না?

দরজা খুলে হায়রিয়ে গরম রুটি নিয়ে ঢুকলো,রুটির সুন্দর গন্ধে ঘরটা ভঁরে গেছে,তখন।
হায়রিয়ের চোখে মুখের ভাব দেখে বুঝলাম এনিষ্টে মারা যাওয়ার পর সে সেকুরের জন্যে একটা বোঝা।রুটির গন্ধের সাথে সাথে ভাবছিলাম ছেলেদের নিয়ে সেকুরের সমস্যাটা,স্বামীর ভালবাসার প্রাধান্য সেখানে তেমন কিছু না।তার দরকার একজন স্বামী যাকে ছেলেরা পচ্ছন্দ করবে,সেটাই গৌন,ভালবাসা থাক বা না থাক।

‘তুমি আবেগের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছো,তবে আবেগের সাথে সাথে বুদ্ধিটাও মাঝেসাঝে একটু ব্যাবহার করা দরকার’,আমি কিছু না ভেবেই বললাম।
‘ছেলেদের নিয়ে আমি এই মুহুর্তেই সিয়াহর সাথে যেতে রাজী আছি।তবে আমার কয়েকটা সর্ত আছে’,কিছুক্ষণ কিছু না বলে আবার আরম্ভ করলো সেকুরে, ‘সেভকেত আর অহানের সাথে সিয়াহর ব্যাবহারটা আরও ভাল করতে হবে।তা ছাড়া আমার এখানে আসার কারণ নিয়ে সিয়াহ যেন বেশী বাড়াবাড়ি না করে,আর সবচেয়ে বড় কথা হলো বিয়ের আগে দেয়া শর্ত সেটা তাকে পূরণ করতে হবে।সিয়াহ জানে আমি কি বলছি?আমার এখনও অবাক লাগছে ও আমাকে একা ফেলে গেল খুনী,চোর আর হাসানের হাতে’।
‘ও এখনও জানে না তোমার বাবার খুনী কে,যদিও সিয়াহ আমাকে বললো ওরা জানে তোমার বাবার খুনী কে’।
‘আমি কি ওর সাথে যাব’?
আমি কিছু বলার আগে সেকুরের শ্বশুর চিঠিটা পড়ে বললো,তার ছেলে না আসা পর্যন্ত সে সেকুরেকে সিয়াহর হাতে তুলে দিতে পারবে না।
‘কোন ছেলে’,আমি একটু চালাকী করে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘হাসান’,সেকুরের শ্বশুরের চোখমুখ একটু লাল হয়ে গেছে তখন, ‘আমার বড় ছেলে ফিরে আসছে,লোকজন সাক্ষী আছে সে ব্যাপারে’।
দু চামচ মসুরের ডালের সুপ মুখে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাসান এখন কোথায়’?
‘ও ওর কাজের কুলি,কেরানী আর অন্যান্য লোকদের জড় করে আনতে গেছে’,বুড়ো অবুঝের মত সত্যি কথাটাই বললো।
‘গতকালকে এরজুরিমিরা যা গণ্ডগোল করলো,রাস্তাঘাট পুলিশে নিশ্চয় ভর্তি হয়ে আছে,সিয়াহ বেশী বাড়াবাড়ি করতে পারবে না’,সেকুরের শ্বশুর বললো।
‘বাইরে তেমন কাউকে দেখলাম না,এ ছাড়া স্বামী স্রীসের ব্যাপারে তোমার খুব একটা বলার কিছু নাই’,আমি বললাম সেকুরের শ্বশুরকে,অবশ্য এ প্রশ্নটা ছিল সেকুরের জন্যে সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।সেকুরের মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি সেকুরে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে?সেকুরে কি অপেক্ষা করছে হাসান,লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফেরার অপেক্ষায় আছে?তবে সেকুরের কথাগুলো একেবারেই যে অবুঝের মত তা না।

সেভকেত বেশ জোর গলায় আমাকে বললো,‘আমরা সিয়াহকে বাবা হিসাবে চাই না,আর তোমার এ ব্যাপারে নাক গলানোর কোন দরকার নাই,তুমি এখানে আর আসবে না’।
‘ঠিক আছে,তা হলে কে আনবে সিল্কের রুমাল,ওড়না,জরি দিয়ে কাজ করা ফুল,পাখীর ছবি দেয়া তোমার পচ্ছন্দের লাল সার্ট,কে আনবে’?
ব্যাগটা ঘরের মাঝখানে রেখে বললাম, ‘যা পচ্ছন্দ হয় দেখ,আমি ঘুরে আসছি’।
মনটা বেশ খারাপ হয়ে ছিল,এ ভাবে কখনো সেকুরের চোখে কান্না দেখিনি।বাইরের ঠান্ডার ধাক্কা গায়ে লাগার সাথে সাথে তলোয়ার হাতে কাদা রাস্তায় রসিয়াহ আমাকে থামালো, ‘হাসান বাড়ীতে নাই’,আমি বললাম,‘মনে হয় বাজারে গেছে মদ কিনতে,সেকুরের ফিরে আসার জন্যে মজলিস হবে।হাসান যদি লোকজন নিয়ে ফিরে আসে,গণ্ডগোল আরম্ভ হবে, মারামারি খুনাখুনি কোনটাই বাদ পড়বে না,হাসান কি ধরণের লোক তুমি জানই।হাসান,তার সাঙ্গপাঙ্গরা যদি তলোয়ার হাতে নেয়,তবে এটা কোথায় গড়াবে কে জানে’?
‘সেকুরে কি বললো’?
‘তেমন কিছু না,তবে ওর শ্বশুর কোনভাবেই সেকুরেকে তোমার হাতে তুলে দিবে না।আমি তোমার অবস্থানে থাকলে সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু ভাবতাম কি ভাবে সেকুরেকে উদ্ধার করা যায়।অবশ্য সেকুরেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিত,বাবা মারা যাওয়ার দুদিন পরে খুনী আর হাসানের ভঁয়েই ও এখানে আসে।তা ছাড়া ওর সন্দেহ তার বাবার খুনে তোমার হাত আছে,এটা সরাসরি বলতে ও দ্বিধা করলো না।তবে ওর আগের স্বামী ফিরে আসার গল্পটা একেবারেই বানোয়াট।তবে বুঝতে পারলাম,সেভকেত আর সেকুরের শ্বশুর দুজনেই হাসানের বানানো কথা বিশ্বাস করে।হ্যা,সেকুরে তোমার কাছে ফিরে যেতে চায় তবে ওর কয়েকটা শর্ত আছে’।
সিয়াহর চোখে চোখ রেখে সেকুরের কথাগুলো সিয়াহকে বললাম।
‘আমারও একটা শর্ত আছে,শোন’,আমি বললাম, ‘একটু পরে আমি আবার বাড়ীর ভেতরে ঢুকবো,আর তখন তুমি সামনের দরজা দিয়ে ঢুকবে,আমার চীৎকার শুনলে থেমে যাবে,
হাসানকে দেখলে ভঁয় করো না,কিন্ত’।চেষ্টা করলেও কথাগুলো একজন কূটনীতিবিদের মত ঠিক যথাযথ সাজিয়ে বলতে পারলাম না।
যখন,‘ফেরীওয়ালা,ফেরীওয়ালা’,বলে ডাক দিলাম,বাড়ীর দরজাটা খুলে গেল,আর আমি সোজা গেলাম সেকুরের শ্বশুরের কাছে।
বললাম সেকুরের শ্বশুরকে ‘পাড়াপড়শী,এ এলাকার হাকিম পর্যন্ত জানে কোরানের আইনকানুন মেনে সেকুরের তালাক দিয়ে বিয়ের কথা।এখন যদি আপনার মরা ছেলে জীবিত হয়ে হজরত মুসার সাথে ফিরে আসে,তাতেও কোন লাভ হবে না,সেকুরের বিয়েটা তো হলো তালাক দেয়ার পর,কোন বেআইনী ভাবে না।একটা বিবাহিতা মেয়েকে বেআইনি ভাবে আঁটকে রাখা
সুলতানের আইন বিরোধী কাজ,সিয়াহ আমাকে এটাও বলে দিল আপনার যথাযথ শাস্তি যাতে হয় তার বন্দোবস্ত হবে’।
‘তা হলে সিয়াহ একটা বিরাট ভুল করবে’,সেকুরের শ্বশুর বললো, ‘আমি কাউকে জোর করে ধরে রাখিনি,আমি এই ছেলেদের দাদা,হাসান ওদের চাচা।সেকুরে যখন বাড়ীতে একলা ভঁয়ে অস্থির হয়ে ছিল,কোন যাওয়ার জায়গা ছিল না,এখানে আসা ছাড়া আর ওর কোন উপায় ছিল না।সেকুরে যদি চায় ছেলেদের নিয়ে চলে যেতে পারে,আমার কোন আপত্তি নাই।তবে ভুলে যাবে না এটাও সেকুরের বাড়ী,এখানেই তার ছেলেদের জন্ম হয়’।
কিছু না ভেবেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেকুরে তুমি কি বাবার বাড়ীতে ফিরতে চাও’?
সব কথা শুনে সেকুরে আবেগে কেঁদে কেঁদে বললো,‘আমার বাবা কোথায়?আমার বাবা তো আর নাই’,অন্ততঃ সেটাই আমার মনে হলো।
ছেলেরাও সেকুরেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে তখন,কিন্ত আমি,এসথার তো বোকা মেয়ে না,আমি জানি সেকুরের কান্নাটা লোক দেখানো,মন ভোলানো কান্না,দুই দিককেই খুশী রাখার জন্যে।
একটু পরে শয়তান হায়রিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আরম্ভ করলো,ঐ ঘরে তখন শুধু সেকুরের শ্বশুরের চোখটাই শুকনা ছিল।
সিয়াহ লোকজন নিয়ে তখন বাড়ীর মধ্যে ঢুকে গেছে,দুজন লোক ছিল সামনের দরজা কুড়াল দিয়ে খোলার চেষ্টা করছিল,কুড়ালের শব্দ হচ্ছিল কামানের গোলার মত।
‘তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ,দরজা খুলে ঐ লোকজনকে বলে দাও সেকুরে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে’,আমি হাসানের বাবাকে বললাম।
‘শুধু অসহায় একজন মেয়ে না,আমার ছেলের বৌ,তাকে আমি কিভাবে গুন্ডাদের সাথে পাঠাতে পারি’?
‘সেকুরে নিজেই ওদের সাথে যেতে যাচ্ছে’,বেগুনী রুমালটা হাতে নিয়ে বললাম।
‘তা হলে আমার কোন আপত্তি নাই,ও দরজা খুলে চলে যেতে পারে’।
সেকুরে আর তার ছেলেদের পাশে গিয়ে বসলাম,দরজায় ধাক্কার পর ধাক্কায় তখন কান্নাকাঁটি বেড়ে গেছে,সেকুরে,ছেলেরা,এমন কি আমি ও তখন চীৎকার করে কাঁদছি।
‘সেকুরে তুমি যদি তোমার স্বামী সিয়াহর যেতে চাও,তোমার শ্বশুরের কোন আপ্ততি নাই, তা ছাড়া সিয়াহও তোমার সব শর্ত মেনে নিতে রাজী আছে,ও অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে,এ বাড়ীতে এখন আর তোমার করার কিছু নাই।বোরখা পরে,ছেলেদের নিয়ে তোমার বাড়ীতে ফিরে যাও’।
আমার কথায় ছেলেরা আরও জোরে জোরে কান্না আরম্ভ করলো,আর সেকুরের চোখটা অবাক হয়ে আরও বড় হয়ে গেল যেন।
‘আমি হাসানকে খুব ভঁয় করি,ও ভয়ঙ্কর একটা মানুষ,ও না জানি কি না কি করবে’?
‘তোমার বিয়ের কোন বদল হচ্ছে না এ ভাবে,তুমি ভঁয়ে অন্য কারও বাসায় আশ্রয় নিতেই পার।তবে এখন তোমার স্বামী অপেক্ষা করছে,এখন আর এখানে অপেক্ষা করার কোন মানে হয় না’।
‘কিন্ত আমি নিজে দরজা খুলবো না’,সেকুরে বললো।
‘আমার প্রিয় সেকুরে তুমি জান,আমি দরজা খুলতে পারবো না,সেটা তোমাদের ব্যাপারে নাক গলানো হবে।তুমি স্বামীর বাড়িটে ফিরে যাচ্ছ,আর কেউ তার জন্যে প্রতিশোধ নিতে সাহস করবে না’।
সেকুরে বুঝে বললো, ‘ঠিক আছে তাহলে ওরা দরজা ভাঙ্গুক,আমরা কেউ দরজা খুলবো না’।
আমি বুঝলাম সেকুরে আর তার ছেলেদের জন্যে ওটাই একমাত্র উপায়,আমি ভঁয় পাচ্ছিলাম, ‘তাহলে খুনাখুনি আরম্ভ হবে আর হাকিম যদি না আসে,রক্ত বন্যা তো হবেই আর চলবে বছরের পর বছর।কোন মানুষ চুপচাপ থাকবে না যখন বাড়ীর দরজা ভেঙ্গে তার বাড়ী থেকে কেউ একজন মেয়েমানুষকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে’।


০০০০০০০০০০০০০


মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুলাই, ২০২৪ রাত ১২:৪০

শ্রাবণধারা বলেছেন: এই বইটির একটি বাংলা অনুবাদ তো আছেই। আমি বাংলা বইটিই পড়েছিলাম।

বইটির ভুমিকায় পামুকের জীবনের বেশ দীর্ঘ একটি গল্প ছিলো সম্ভবত তার নোবেল বক্তৃতা থেকে নেয়া। তার পিতা তার তরুন বয়সের একটা লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে বলেছিলেন যে তিনি হয়তো কোনদিন এমন লেখা লিখবেন যে তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়ে যেতে পারেন। পামুকের জীবনে সেই দিনটি এসেছিলো, কিন্তু ততদিনে তার পিতা বিগত হয়েছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.