নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখ
(৪০)
‘শোনা যায় প্রায় দুশ বছর আগে মঙ্গোল রাজত্বের শেষের দিকে,তৈমুর লং এর উত্তরসুরীদের রাজত্বকালে,হেরাতের এক বুড়ো ওস্তাদ তুলির আঁচড়ে তুলে ধরে সুন্দর এক ঘোড়া,যার নাকটা কাটা ছিল অদ্ভুত ভাবে-হয়তো কোন শিল্পীর আঁকা মঙ্গোলীয় ঘোড়া দেখে নকল করা ছবিটা।তবে কারও জানা ছিল না,কোন শাহের নির্দেশে,আর কোন বই এর ছবির অংশ ছিল ঘোড়াটা।অনেকেই ঐ ছবিটার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল,শোনা যায় কোন এক সুলতানও ছিল ভক্তদের দলে,কারণটা নাকি সুলতানের হারেমে খুবই প্রিয় ছিল ছবিটা।আমার দৃঢ় বিশ্বাস,এ কারণেই হয়তো অনেক মাঝারিদরের শিল্পীর হাতে ছবিটা নকল হয়ে আরও বড় করে আঁকা আছে কোথাও।এ ভাবেই হয়তো নাক কাটা ঘোড়াটা শিল্পিদের কাছে একটা আর্দশ ঘোড়া হয়ে যায়।কিছুদিম পরে ঐ সুলতান যুদ্ধে যখন হেরে যায়,হারেমের মেয়েদের মত শিল্পীরাও চলে যায় নতুন জায়গায়,নতুন শাহ,নতুন শাহজাদার কাছে,তবে নাক কাটা ঘোড়ার স্মৃতি তাদের ছেড়ে যায়নি।একেক সময় একেক পদ্ধতির প্রভাবে অনেকেই ভুলে গেল ঐ ঘোড়ার কথা,অনেক শিল্পী আবার নতুন সুলতানের কাছে শুধু অপূর্ব সুন্দর ঘোড়াই আঁকেনি,তার শিষ্যদেরও শেখায়,শিষ্যরা যেন জানে ওটাই ছিল পুরোনো ওস্তাদদের পদ্ধতি।ও ভাবেই প্রায় শ খানেক বছর পরেও মঙ্গোলদের লুটপাটের পরেও,পারস্যে,আরবে,শিল্পীরা ঐ ভাবেই ঘোড়ার ছবি এঁকে যাচ্ছিল,একটা আর্দশ ঘোড়ার ছবি।আমার মনে হয় অনেক শিল্পীরা তাদের অজান্তেই ওভাবে ঘোড়ার ছবি এঁকে যাচ্ছে’।
আমি কিছুটা আনন্দের সাথে বললাম,‘ওস্তাদ আপনার পর্যবেক্ষনের জন্যেই আমরা জানতে পারলাম,প্রতিটা শিল্পীর ছবিতে একটা বিশেষত্ব আছে’।
ওস্তাদ ওসমান বললো, ‘না কথাটা ঠিক না,শিল্পীর না,বলতে পার প্রতিটা সুলতান বা শাহদের অধীনস্থ শিল্প একাডেমীর ছবির একটা বিশেষত্ব আছে।না তবুও ঠিক হলো না, বলা যায় অনেক সময় একই একাডেমীর শিল্পীরা বিভিন্ন ভাবে আঁকার চেষ্টা করে,ওরা ভুলে যায় একাত্মতায় আছে আনন্দ,আনন্দ থেকে একাত্মতা।কোন শিল্পী আঁকা আরম্ভ করে চীনা পদ্ধতিতে,কেউ তুর্কী কায়দায়,কেউ আবার যে ভাবে আঁকা হয় সিরাজে,নিজেদের মধ্যে একটা যুদ্ধের মনোভাব,সবাই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করার জন্যে অস্থির হয়ে যায়-মানসিক একাত্মতা হারানো কটা মানুষ,অনেকটা অসুখী স্বামী স্ত্রীর মত’।
দেখলাম ওস্তাদের চোখে মুখে একটা গর্বের ছোঁয়া,বুড়ো বয়সে ভেঙ্গে পড়া মানুষের অভিব্যাক্তির সাথে মেশানো আরেক চেহারা।
‘প্রিয় ওস্তাদ’,আমি বললাম,‘আপনি প্রায় কুঁড়ি বছর ধরে সুলতানের শিল্প একাডেমীতে আছেন,পৃথিবির নানান দেশের শিল্পীরা আসে এখানে,একেক জনের একেক ধরণের প্রতিভা, তাদের অনেকেই ওটোমান কায়দায় ছবি আঁকে না,তবে তাদের ছবির সৌর্ন্দয অতুলনীয়’।
কিছুক্ষন আগে আমার অবাক হওয়াটা অযথার প্রশংসা মনে হচ্ছিল,যে লোকটার প্রতিভা,
জ্ঞানে অবাক হয়ে সব সময় প্রশংসা করে গেছি,তাকে মনে হচ্ছিল খুবই সাধারণ একটা মানুষ যার চোখটা সীমিত হয়ে আছে তার গলির আঙ্গিনায়।
‘কোথায় গেল ঐ খাজাঞ্চী বামনটা’,ওস্তাদ ওসমান জিজ্ঞাসা করলো।
ক্ষমতাশালী এক মানুষ,চাটুকারিতায় যার মন ভঁরে থাকে সবসময়,সমালোচনা সহ্য করার ক্ষ্মতা কোথায় তার,বিষয়টা বদলানোর চেষ্টা করছে তখন ওস্তাদ।
ঠান্ডা খাজাঞ্চীখানায় যে ভাবে ফিসফিস করে কথা বলছিলাম,যেন শীতের রক্তাক্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈনিকদের একাত্মতার সুর।ঠিক যে ভাবে অন্ধ মানুষের মনের অভিব্যাক্তি মুখে দেখা যায় না,ওস্তাদ ওসমানের চোখ দুটোতে ছড়ানো ছিল আকাশ ভঁরা আনন্দ।আমি ওস্তাদকে অযথাই প্রশংসা করছিলাম,একজন অন্ধের জন্যে আমার অর্ন্তনিহিত সহানুনুভুতি নিয়ে।
ওস্তাদ ঠান্ডা হাতটা দিয়ে আদর করে আমার মুখটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল,তার হাতের ছোঁয়ায় তার মানসিক শক্তি আর বয়সটাও ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাকে,মন বলে দিল আমাকে,‘সেকুরে অপেক্ষা করে আছে,তোমার জন্যে,ভুলে যেও না’।
সামনে বইএর খোলা পাতা,অনেকটা যেন আমার প্রশংসার জোয়ারের প্রতিফলন,ওস্তাদের নিজের দুঃখানুভুতিতে,তার আত্মবিশ্বাস থমকে গেছে তখন।একে অন্যের উপস্থিতিতে বিব্রত হয়ে ছিলাম,আমরা।
‘কোথায় গেল,বামন খাজাঞ্চীটা’?ওস্তাদ ওসমান বললো।
কোন সন্দেহ ছিল না যে চালাক বামনটা কোন এক কোনায় বসে আমাদের ওপর নজর রাখছে,তাকে খোঁজার ভান করে বামে,ডানে দেখার ভান করলাম,আমার চোখটা তবুও ছিল ওস্তাদ ওসমানের দিকে।ওস্তাদ ওসমান কি সত্যি সত্যি অন্ধ হয়ে গেছে,না অন্ধ হওয়ার ভান করছে?শোনা যায় সিরাজের অনেক ওস্তাদ বয়সকালে তাদের অক্ষমতা লুকানোর জন্যে অন্ধত্বের ভান করতো।
‘আমি এখানেই মারা যেতে চাই’,ওস্তাদ ওসমান বললো।
‘আমার ওস্তাদ,প্রিয় ওস্তাদ’,শিষ্যের মত বললাম, ‘আজকের যুগে শিল্পীর মর্যাদা তার ছবির দামে,কত মোহর তার ছবির দাম তাতে,সেটাই শিল্পীর প্রতিভার প্রকাশ,পুরোনো ওস্তাদদের আর দাম কোথায়,শিল্পীরা পশ্চিমী কায়দায় ছবি আঁকে।আপনার কথা শুনে আমার চোখে কান্না আসছে,তবে এটাও ঠিক আপনি তো শিল্প একাডেমীর প্রধান,আপনার দায়িত্ব নীচের শিল্পীদের রক্ষা করা।এখন এই ছবিগুলো দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে?কোন শিল্পীর হাতে আঁকা এই ঘোড়াটা’?
‘জেইতিন’।
ওস্তাদ এমন ভাবে উত্তরটা দিল,যে অবাক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না,ওস্তাদ একেবারে চুপ হয়ে গেছে তখন।
‘তবে এটাও জানি,জেইতিন এনিষ্টেকে খুন করেনি,বলা যায় হতভাগা এনিষ্টে বললেই মানায় হয়তো’,শান্ত গলায় বললো ওস্তাদ ওসমান, ‘আমার বিশ্বাস জেইতিনের হাতেই আঁকা ঘোড়াটা,ওর ছবিতেই পুরোনো ওস্তাদের প্রভাবটা বেশী।তা ছাড়া ব্যাক্তিগত ভাবেও জেইতিনের যোগাযোগ ছিল হেরাতের পুরোনো ওস্তাদদের সাথে,যাদের প্রভাব দেখা যায় সেই সমরখন্দ পর্যন্ত।মনে আছে তোমাকে বললাম,পাখীর পাখা,গাছের পাতা-যেটা ওস্তাদ থেকে গেছে শিষ্যের মনে,কিন্ত ওস্তাদের কঠোরতার ভঁয়ে দেখা যায়নি কোন ছবিতে,হতে পারে সেই পুরোনো ওস্তাদের আখড়া বাইরে দেখা দেয় অন্য ছবিতে।জেইতিনের আঁকা এই ঘোড়াটা তার ছোটবেলায় পারস্যের ওস্তাদদের শেখানো স্মৃতির ছোঁয়া,ঘোড়াটা হঠাৎ যে দেখা গেল এনিষ্টের বই এ,বলতে পার এটাতে মহান আল্লাহর হাত আছে।ওটোমান সাম্রাজ্যের এমন কোন শিল্পী আছে যে হেরাতের ওস্তাদদের মত করে ছবি আঁকার চেষ্টা করিনি।যেমন তুর্কমেনী শিল্পীদের কাছে সুন্দরীর ছবি মানেই সেটা চীনা প্রভাবে আঁকা,আর সুন্দর একটা ছবি মানেই সেটাতে আছে হেরাতের ছোঁয়া।আমরা সবাই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ,হেরাতের ওস্তাদ বিহজাদের ছবি আঁকার ধরণকে লালন পালন করে যাচ্ছি,আর হেরাতের ছবি আঁকার ধরণ থেকে আসছে মঙ্গোলীয় ঘোড়া আর চীনা কায়দায় ছবি আঁকা।তাহলে চিন্তা করে দেখ,জেইতিন যে জড়িয়ে আছে হেরাতের সাথে,কেন সে খুন করবে হতভাগা এনিষ্টে এফেন্দীকে,আর এটা তো সবাই জানে এনিষ্টে নিজেই হেরাতের ছবির গুনে মুগ্ধ হয়ে ছিল সব সময়’।
‘তা হলে অন্য কে হতে পারে,কেলেবেক’?
‘লেইলেক’,আমার মন বলছে,লোভ আর খ্যাতির জন্যে মানুষ খুন যে করতে পারে,সেটা ভাল করেই জানি।মনে হয় এনিষ্টে বই এর ছবির বর্ডারের লেইলেকের কাঁচা হাতে পশ্চিমের ছোঁয়াচ দেখে এনিষ্টে বুঝতে পারে,সেটা খুব একটা ভাল সিদ্ধান্ত হয় নি,সবকিছু শুনে এমনই নিরেট লেইলেক,যে এরযুরামের মত একটা শয়তান মোল্লার কথা শুনে ছুটে বেড়ায়,হয়তো এই কাজটা করে।আর বর্ডারের কাজের শিল্পীরা নিজেকে মনে করে আল্লাহর কাছাকাছি,
সেখানে মোল্লা এরযুরামের শিক্ষার সাথে সুলতানের,এনিষ্টের বই এর কাজে ছিল বিরাট একটা সংঘাত।অন্য যে কোন সময় এই হতভাগা ছেলেটা হয়তো ছুটে আসতো আমার কাছে,তবে এবার সে সেটাকে দরকার মনে করেনি।তবে ঐ পাখীর মগজের ছেলেটাও যার কাজ ছবির বর্ডার করা,তার সহ্য হয়নি,একাডেমীর ঐতিহ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পশ্চিমা নিয়মে ছবি আঁকা।তাই সে চালাক,চতুর লেইলেকের সাথে বুদ্ধি করে হয়তো খুনটা ওদের হাতেই হয়।আমার নিজের চোখে দেখা লেইলেক কি ভাবে চাটুকারিতা করে এনিষ্টেকে বারে বারে বোকা বানাতো,যাই হোক আমার মনে হয় কথা কাটাকাটিতে শেষে লেইলেকের হাতেই খুন হয় এনিষ্টে এফেন্দী।বেশ কিছুদিন আগে এনিষ্টে এফেন্দী বই এর কথা মোল্লা এরযুরিমির সাথে আলোচনা করে,সব কিছু শোনার পর এরযুরিমির সিদ্ধান্ত ছিল ওটা কাফেরী কাজ,হতে পারে হয়তো এরযুরিমি প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তোমার প্রিয় এনিষ্টেকে খুন করার আয়োজন করে।তবে এ ব্যাপারে আমার কোন অনুশোচনা নাই,তোমার এনিষ্টে আমাদের সুলতানকে কুবুদ্ধি দিয়ে ভেনিস থেকে একজন শিল্পীও এখানে আনে।তুমি কি জান আমার আদর্শের বিরুদ্ধে ঐ কাফের এর ছবি আমি সুলতানের জন্যে নকল করি।যদি বাধ্য না হতাম ঐ ছবিটা নকল করার জন্যে আমিও হয়তো অনুশোচনা করতাম তোমার এনিষ্টের জন্যে,হয়তো সাহায্য করতাম তার খুনীকে খুঁজে বের করতে।তবে আমার চিন্তা তোমার এনিষ্টের জন্যে না,বরং আমার শিল্পীদের জন্যে।তোমার এনিষ্টেই দায়ী শিল্পীরা যারা বছরের পর বছর আমার কাছ থেকে নানান পদ্ধতি শিখে বিশ্বাসঘাতকতা করলো আমার সাথে।তার প্রভাবেই সবাই চেষ্টা করছিল ইউরোপীয়ান কায়দায় ছবি আঁকতে,ভুলে যাচ্ছিল সবাই নিজেদের ঐতিহ্য,ওটাই নাকি আমাদের সুলতানের ইচ্ছা।
ঐ সব শিল্পীদের উপরে অত্যাচার করা উচিত,ওরা নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে খুঁজে নিচ্ছে বিপথ,আল্লাহর পথ ছেড়ে বিপথে যাচ্ছে সবাই।সুলতান অন্নদাতা,কিন্ত মহান আল্লাহর কাছে আমাদের একটা কর্তব্য আছে,সেটা আমরা ভুলে যেতে পারি না,ঠিক আছে সরে যাও বইটা আমাকে দেখতে দাও’।
ওস্তাদ ওসমানের শেষের কথাগুলো ছিল যুদ্ধে হেরে যাওয়া একজন পাশার,কিছুক্ষনের মধ্যেই যাকে শিরচ্ছেদ করা হবে।ওস্তাদ ওসমান জেজমি আগার বইটা খুলে বামন খাজাঞ্চীকে বেশ রেগেই পাতাগুলো উল্টাতে বললো,ওস্তাদ সেই মুহুর্তে বদলে হয়ে গেছে সুলতানের রাজত্বের প্রধান শিল্পী।
খাজাঞ্চীখানার এক কোনায় মুক্তায় সাজানো একটা বালিশের বসে ছিলাম,পাশে জং ধরা কটা রাইফেল,কটা আলমারী,তবে আমার চোখ ছিল ওস্তাদ্ ওসমানের উপরে।মন ভঁরা সন্দেহ,ওস্তাদ ওসমান যদি এনিষ্টের বই,চিন্তাধারার সম্পূর্ন বিপক্ষেই হয়,তা হলে এই সব ঘটনার উদোক্তা তারই হওয়ার কথা।তবে নিজের উপর রাগও হচ্ছিল,কি ভাবে এত সহজেই ওস্তাদ ওসমানের মত একজন সম্মানী,জ্ঞানী লোককে দোষী করে ফেললাম।শ্রদ্ধায় আমার মাথাটাও নত হয়ে ছিল,ঐ প্রায় অন্ধ বা অন্ধ মানুষটা,হাজারো কুচকানো চামড়ায় গভীর ভাবে দেখছে ছবিগুলো।এটাও মনে হচ্ছিল,এই মানুষটার পক্ষে কি না সম্ভব,তার ঐতিহ্য,ছবি আঁকার পদ্ধতির জন্যে সে তার যে কোন শিষ্যকে,এমন কি দরকার হলে আমাকেও ছুঁড়ে দিতে পারে সুলতানের আক্রোশের তলোয়ারে।
চেষ্টা করছিলাম,সেই ভালবাসার শেকলটা ছিঁড়ে ফেলতে,দুটো দিন ধরে আমি আঁটকে আছি,আমি তখনও কিছুটা দিশেহারা,জানি না কি করা উচিত,কি করবো ভেবে ভেবে।বাক্স থেকে বইটার ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনের দানব,জীনদের সরানোর চেষ্টা করছিলাম।
ছবিতে কজন পুরুষ,কজন মেয়েমানুষের মুখে আঙ্গুল দিয়ে কিছু একটা বলছিল?ওটা অবাক হওয়ার চিহ্ন হিসেবে ব্যাবহার করা হতো প্রায় দুশ বছর সমরখন্দ থেকে সেই সূদূর বোখারা পর্যন্ত।
নদীর ধারে ঘোড়ায় ছুটে যাচ্ছে বীর গিয়াসুদ্দীন হুসরেভ,পেছনে ছুটে যাচ্ছে শত্রু পক্ষের সৈন্যরা,যাওয়ার কোন জায়গা নাই,দুরন্ত আমু নদীর স্রোত পার হয়ে যাচ্ছে,আল্লাহর সহায়তায় আর তার কালো ঘোড়ার সাহায্যে,যদিও নদীর মাঝি তাকে কোন রকম সাহায্য করতে অস্বীকার করে,নৌকার সকলের মুখে আঙ্গুল।ঠিক একই ভাবে অবাক হয়ে প্রথম বারের মত হুসরেভ দেখলো শিরিনকে,চেহারায় জ্যোৎস্নার সোনালী আভা,গোসল করছে লেকের পানিতে।অগম্য প্রাসাদের পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আধা খোলা প্রাসাদের দরজায় আঙ্গুল মুখে হারেমের সুন্দরীরা।তেজাভ পারস্যের সৈন্যদের কাছে যুদ্ধে হেরে যখন পালাচ্ছে,সুন্দরী এস্পেনই মুখে আঙ্গুল দিয়ে কান্না ভঁরা চোখে তেজাভকে বলছে,শত্রুদের হাতে তাকে ফেলে না যায় যেন।
জুলেখার মিথ্যা ধর্ষনের অভিযোগে ইউসুফ যখন জেলে যাচ্ছে,জুলেখা মুখে আঙ্গুল দিয়ে অবাক হয়ে দেখছে,আর হাসছে নিষ্ঠুর উল্লাসে আর আনন্দে।আর প্রেমের উচ্ছাসের কবিতায়,
প্রেমিকদের মদের ছোঁয়ায় খুশী,অস্থির চেহারা আর এক শয়তান চাকরানী চুপ করে মুখে আঙ্গুল দিয়ে তাদের উপর খবরদারি করছিল।ছবিগুলোতে তেমন একটা বিশেষত্ব ছিল না,তবে মুখের আঙ্গুল দেয়ার ভঙ্গীটা ছিল একেক জনের একেক রকম।এই ছবিগুলো কি আমাকে কোন সান্তনা দিচ্ছে?ওস্তাদ ওসমানকে বললাম, ‘ওস্তাদ এবার,আপনার অনুমতি নিয়ে বাড়ী যেতে চাই’।
‘কি বলতে চাচ্ছ তুমি?জান এখন একটা রাত্রি মাত্র বাকী আছে?ভেবে দেখ তোমার দেখার সুযোগ হলো অভাবনীয় কতগুলো ছবি’,ওস্তাদ ওসমান বললো।
কথাগুলো বলতে বলতেও ওস্তাদের চোখটা ছিল ছবির পাতার দিকে,তবে তার চোখই বলে দিচ্ছিল সম্ভাব্য অন্ধত্বের কথা।
‘ঘোড়ার নাকের কথা তো আমরা জানতে পারলাম’,আমি বেশ জোর দিয়েই বললাম।
‘আহ!হ্যা,এখন বাকীটা সুলতান আর প্রধান খাজাঞ্চীর হাতে,হয়তো তারা আমাদেরকে ক্ষমা করতেও পারে’।
ওস্তাদ কি লেইলেককে খুনী হিসেবে চিহ্নিত করবে?আমি ভঁয়ে জিজ্ঞাসাও করতে পারছিলাম না,যদি ওস্তাদ আমাকে অযথা আঁটকে রাখে।এমনও হতে পারে যে ওস্তাদ আমাকেই দোষী সাবস্ত্য করলো!
‘যে সূচটা দিয়ে ওস্তাদ বিহজাদ নিজের চোখ অন্ধ করে সেটা পাওয়া যাচ্ছে না’,ওস্তাদ বললো।
‘হয়তো বামন খাজাঞ্চীর কাছে আছে কোথাও,ওস্তাদ বই এর এই ছবিটা দেখার মত,সত্যিই অভাবনীয়’,আমি বললাম।
ওস্তাদের মুখটা শিশুর মত আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো,‘ভালবাসার আগুনে অস্থির হুসরেভ যখন মাঝরাতে অপেক্ষা করছিল শিরিনের জন্যে,হেরাতের ওস্তাদদের কায়দায় আঁকা ছবিটা’,
ওস্তাদ ওসমান বললো।
এমন ভাব ছিল ওস্তাদের চোখে,যেন ছবিটা ভাসছে তার চোখে,হাতে আতস কাঁচটা ছিল না,তখন।
‘তুমি কি অনুভব করতে পারছো গাছের সৌর্ন্দয,দেখ রাতের অন্ধকারে গাছের পাতাগুলো কি ভাবে জ্বলজ্বল করছে তারার আলোতে, ধৈর্য ধরে এক এক করে সোনালী পাতা দিয়ে শিল্পীর ছোঁয়ায় গাছগুলো সাজানো।
সুপুরুষ হুসরেভের ছন্দে ভরা তরুণীর মত সৌর্ন্দয নিয়ে দাঁড়ানো ঘোড়া আর,জানালায় প্রেমিকা শিরিন গর্বে ঘাড় বাঁকা করে দাড়িয়েছিল।ছবির সৌর্ন্দয আর রং এর বাহারে প্রেমের জুটি থাকবে সেখানে জন্ম জন্মাতরের জন্যে।তাদের শরীরের অর্ধেকটা আছে আর মুখসহ বাকী অংশটা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে যেন ভালবাসার দুজন হঠাৎ ছবিতে আঁটকে আছে।এ জন্যেই কোন মিল নাই চারপাশের পরিবেশের সাথে দুই প্রেমিকের চেহারার, বরং বলতে পার তাদের ছবিটা আঁকা আল্লাহর স্মৃতি থেকে,এ জন্যেই সময়টা আঁটকে আছে ছবিতে,কোন পরিবর্ত্ন নেই।গল্পের কাহিনীটা যত দ্রুত গতিতেই ছুটে যাক,তারা একই থাকবে পৃথিবীর শেষ দিনটা পর্যন্ত।
সুন্দর পোষাকে লজ্জায় রাঙানো সুন্দরীরা থমকে আছে ছবির পাতায়,বিশেষ কোন ভঙ্গী নেই, কোন অস্থিরতা নেই,তবুও জীবন্ত আপন সুরে।পাখী ছূটে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে,তারার রাজ্য দিয়ে,পাখা নড়াচড়া করছিল ভালবাসায় অস্থির প্রেমিকদের মত,ওরাও আঁটকে আছে আঁকাশে অনন্তকালের জন্যে।হেরাতের পুরোনো ওস্তাদেরা জানতো,আল্লাহর কাল পর্দা ধীরে ঘীরে নেমে আসছে তাদের চোখে আর এ ধরনের অসাধারণ একটা ছবি দেখতে দেখতে যদি তারা মারা যায়,চিরজীবী ঐ ছবির সাথে চিরজীবী হয়ে থাকবে তারাও’।
মাগরেবের নামাজের সময় আবার আনুষ্ঠানিকভাবে খাজাঞ্চীখানার দরজা খোলা হলো ওস্তাদ ওসমানের নিষ্প্রভ চোখটা তখনও আঁটকে আছে ছবিটাতে,যেন অন্ধ এক মানুষ খাবারের দিকে তাকাচ্ছে।
খাজাঞ্চীখানার প্রহরীরা জানতো ওস্তাদ ভেতরে আছে আর জেজমি আগা পাহারা ছিল দরজায়,তাই কেউ আমাকে তেমন একটা তল্লাসী করে দেখলো না,যদিও আমার কাপড়ে লুকানো ছিল দামী সূচটা।ইস্তাম্বুলের রাস্তায়,সূচটা বের করলাম যেটা দিয়ে ওস্তাদ বিহজাদ নিজের চোখ অন্ধ করে,আমি ছুটছিলাম রাস্তা দিয়ে।
যদিও বসন্তের হাসি চারপাশে কিন্ত আমি তখনও যেন খাজাঞ্চীখানার ঠান্ডায় জড়সড়,
কাফেলার বাজারের মুদি,নাপিত,হেকিম,ফলের দোকান এক এক করে বন্ধ হচ্ছিল,একটু থেমে কাপড়,গাজর আর বোয়ামের দোকানের আলোতে দাঁড়িয়ে ছিলাম।দু দিনে আমার এনিষ্টের বাড়ীর রাস্তাটা(এখনও বলিনি সেকুরের রাস্তা বা আমার রাস্তা)দেখে অবাক লাগছিল,অনেক কিছুই বদলে গেছে যেন।তবে আনন্দে ভঁরে ছিল আমার মনটা,শেষ পর্যন্ত প্রিয়া সেকুরের সাথে দেখা হবে বিছানায়,ডালিম গাছ,ঠিক করা জানালা সবাই আমার আনন্দের অংশীদার হয়ে অপেক্ষা করছিল।সেকুরের সাথে দেখা হলে বলবো, ‘সেকুরে আমরা জানি,খুনী কে’?
বাড়ীর গেটটা খোলার পর গেটের শব্দে,অন্ধকারের কালো চেহারায়,না হয় নেকড়ে বাঘের মত মানুষের ছায়ায় হোক,বুঝতে পারলাম বাড়ীতে কেউ নাই।যদিপ জানা ছিল আমি একা,তবুও ঘরের দরজা,আলমিরা এক এক করে খুলে পরখ করে দেখছিলাম,কেউ কোথাও লুকিয়ে থাকে যদি।
কোথাও কোন শব্দ ছিল না ঐ নিস্তব্ধতায়,শুধু আমার হ্রদয়ের ছোটার শব্দ।একটা বুড়ো মানুষের মত নিজেকে খুঁজছিলাম ঐ নিস্তব্ধতায়,খুঁজে পেলাম আমার সান্তনা,হাতীর দাঁতের কাজকরা চাকুটা।আমরা ভাবি বই আমাদের মনে শান্তি আনে,তবে সেটা ভুল,ওটা বরং বাড়ায় মনের দুঃখটা।
আঙ্গিনায় দেখি তখন যে চড়ুই পাখীটা পানি খাচ্ছিল কখন যে উড়ে গেছে,নাবিকের মত অন্ধকারে ঢাকা বাড়ীটা ডোবা জাহাজের মত ছেড়ে গেলাম।
মন বলছিল, ‘ছুটে যাও,খুঁজে আনো সেকুরেদের’।ছুটে বেড়াচ্ছিলাম যদিও,তবে লোকের ভিড়ে অত ছুটে যাওয়া কি সম্ভব,শুধু ঘেউ ঘেউ করা ইস্তাম্বুলের কুকুরের দলেরা ছুটে আসছিল,
আমার পেছনে পেছনে।
আমি এসথার
মসুরের ডালের সুপ তৈরী করার জন্যে পানি ফুটাচ্ছিলাম,নেসিম বললো, ‘দরজায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে’।বললাম, ‘খেয়াল রাখ সুপটা যেন পুড়ে না যায়’,নেসিমের বুড়ো হাতে চামচটা দিয়ে দরজার দিকে গেলাম,কোন কিছু না বললে লোকটা তো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে।সিয়াহকে দরজায় দেখে দুঃখই হচ্ছিল,চোখে মুখের অবস্থা দেখে ভঁয়ে তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস ছিল না আমার।
‘ভেতর ঢোকার দরকার নাই,কাপড়চোপড় পরছি একটু পরেই বের হবো’।গোলাপী হলুদ পোষাক সাধারণতঃ যেটা রমজান মাস,বিয়ের অনুষ্ঠানে পরি,সাথে জরির কাজ করা হাতব্যাগ নিয়ে বের হওয়ার আগে নেসিমকে বললাম, ‘সুপটা ফিরে আসার পরেই খাব’।সিয়াহ আর আমি দুজনে ইহুদী এলাকা ছেড়ে যাচ্ছিলাম,কটা ঘরের চি্মনী বেশ ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।
‘শুনলাম সেকুরের স্বামী ফিরে এসেছে’,আমি বললাম।
বাড়ী ঘর পার না হওয়া পর্যন্ত একটা কথাও সিয়াহ বলেনি,যদিও তার মুখটা একেবারেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে,‘এখন কোথায় আছে ওরা’?
সিয়াহের প্রশ্নে বুঝতে পারলাম সেকুরে আর ছেলেরা কেউ বাসায় নেই।
‘এখন সবাই সেকুরের স্বামীর বাড়ীতে আছে’,বুঝতে পারলাম কথাগুলো শুনে সিয়াহের মনটা একেবারেই ভেঙ্গে গেছে।তবুও সিয়াহের মনে একটু আশা দেয়ার জন্যে বললাম, ‘তুমি কি সেকুরের স্বামীকে চেন’?
‘না সেকুরের স্বামীকে আমি দেখিনি আর সেকুরে হঠাৎ করে বাড়ী থেকে চলে যাবে এটাও কোনদিন ভাবিনি,কি ভাবে জানলে ওরা চলে গেছে’?
‘তোমার চোখ মুখ দেখে’।
‘আমাকে সব কিছু একটু খুলে বল’,সিয়াহ বললো।
সিয়াহ এতই অস্থির হয়ে ছিল যে খেয়ালই করেনি,ইসথার চোখটা সব সময় খেয়াল ছিল জানালার দিকে,এসথার যদি আগের এসথার হতো তার পক্ষে এ ধরণের সমস্যার সমাধান করা খুব একটা দুরুহ কিছু না।
‘যা শুনলাম,সেকুরের দেবর হাসান তোমার বাড়ীতে গিয়ে প্রথমে সেভকেতের সাথে কথা বলে’,তোমার বাড়ী কথাটা সিয়াহর নিশ্চয় খুব একটা ভাল লাগেনি।‘হাসান সেভকেতকে বলে,যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তার বাবা বাড়ী ফিরে আসছে,আর কেউ একজন জানিয়ে গেছে দুপুরেই তার ফিরে আসার কথা।সেভকেত আর তার মাকে বাসায় না দেখলে তার মনটা খুবই খারাপ হয়ে যাবে।সেকুরে সেভকেতের কাছে সবকিছু শোনার পরও ঠিক করতে পারেনি কি করবে!তবে বাবার সাথে দেখা হবে ভেবে শেষমেষ সেভকেত হাসান আর তার দাদার সাথে চলে গেছে’।
‘কার কাছে শুনলে তুমি খবরটা’?
‘কেন সেকুরে তোমাকে বলেনি,হাসান গত দু বছর ধরে তাকে কি ভাবে জ্বালাতন করছে বিয়ে করার জন্যে?তুমি জান,হাসান একসময় আমার হাতে সেকুরেকে চিঠি পাঠাতো’?
‘কিন্ত সেকুরে কখনও চিঠির উত্তর দেয়নি’।
‘মোটামুটি ইস্তাম্বুলের সব মেয়েদের সমন্ধেই আমার ভাল জানা আছে,সেকুরের মত সংসারী মেয়ে খুব কমই আছে’।
‘এখন আমিই তো সেকুরের স্বামী’।
সিয়াহর কথায় ছিল পুরুষের সেই অনাস্থা যা আমাকে খুবই বিরক্ত করে।সেকুরে যেদিকেই যাক না কেন,যার সাথেই সংসার করুক,আরেকজনের মনটা ভেঙ্গে যাবে,এটাতো জানাই।
‘হাসান আমার হাতে একটা চিঠি পাঠায় যেটাতে লেখা ছিল,সেভকেত দাদার বাড়ীতে তার বাবার জন্যে অপেক্ষা করছে আর সেকুরে বিয়েটা যে অবৈধ ও সমন্ধে তার কোন সন্দেহ নাই।সেভকেত সিয়াহকে খুবই অপচ্ছন্দ করে,হয়তো সেভকেতের ঐ জন্যেই বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নাই’।
‘সেকুরে কি উত্তর দিল’?
‘সেকুরে সারাটা রাত্রি অপেক্ষা করে ছিল তোমার জন্যে,হতভাগা অহানকে নিয়ে’।
‘আর হায়রিয়ে,ও কোথায় ছিল’?
‘হাইয়রিয়ে তো অপেক্ষা করে আছে অনেকদিন ধরে তোমার সুন্দরী বৌকে কাদামাটিতে নোংরা করার জন্যে।এ জন্যেই তো ও তোমার এনিষ্টের সাথে ছেনালী করে বেড়াতো,আল্লাহ তোমার এনিষ্টের আত্মাকে যেন শান্তি দেয়।হাসান যখন দেখলো সেকুরে খুন হওয়া বাড়িতে একলা,তা ছাড়া এমনি তে খারাপ লোকদের ভঁয়েও অস্থির হয়ে ছিল,হাসানের আরেকটা চিঠি পেল সে্কুরে’।
‘কি লেখা ছিল চিঠিটাতে’?
০০০০০০০০০০০০
©somewhere in net ltd.