নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(৩৪)
কোথা থেকে একটা ঘোড়া ছুটে এসে ছেয়ে ফেললো আমার ভাবনার আকাশ,হাতটা চলে গেছে সাদা কাগজটাতে,অভাবনীয় একটা ছবি ভাসছিল চোখে,যা অন্য কারও কল্পনার বাইরে।ঘোড়ার সামনের পা দুটো তুলে ধরা,তুলির টানে পেছনের পা জুড়ে দিলাম শরীরে,
আমার যাদুর তুলির ছোঁয়ায় বদলে গেছে ছবিটা,তবে ওটা শিল্পীর তুলির টান না,বরং কালিগ্রাফারের কলমের টান।আমার আঁকা ছবি দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম,মনে হচ্ছিল ওটা আমার হাত না,কোন এক অজানা যাদুকরের মায়াজালে ব্দলে গেছে সবকিছু,
আমার হাতটা সম্পূর্ন ঐ অচেনা যাদুকরের দখলে।বাঁকানো লাইনগুলো অদ্ভুত এক খেলায় হয়ে গেল ঘোড়ার পেটের অংশ,রাজহাঁসের ছন্দে সাজানো গলা।ছবিটা কি সর্ম্পূন হয়ে গেছে,
কি অবিশ্বাস্য প্রতিভাধারী আমি!আমার হাতের কলমের টানে,নাক,আনন্দ ছড়ানো ঘোড়াটার খোলা মুখ,কপাল,কান,এক এক করে ছুটে আসছিল।
মা দেখে যাও,চিঠি লেখার মত,আমি আরেকটা নতুন বৃত্ত এঁকে দিলাম হাসতে হাসতে!কোন সন্দেহ নাই,যে দেখবে এই ছবিটা,অবাক হবে এই অসাধারণ ঘোড়াকে দেখে।ভাবছিলাম মহামান্য সুলতানের কথা আর হাসি ভঁরা মুখ,আমার নামে পুরস্কার ঘোষনা করার সময়।
সুন্দর সাজানো একটা ব্যাগে একগাদা মোহর নিয়ে হাসি মুখে গুনতে গুনতে বাড়ী ফিরে যাব,আমি।চোখের পলকেই ঘোড়ার জিনটা এঁকে ফেললাম,ঘোড়ার মুখে দিলাম হাসির ছোঁয়া,যেন কোন একটা হাসির গল্প বের হবে ঘোড়ার মুখ দিয়ে।আলতো করে লেজটাও আঁকলাম,সুর আর ছন্দে সাজানো ঘোড়ার নিতম্ব,অজানা কোন এক কিশোরের সাথে অবৈধ সর্ম্পকের প্রথম পর্ব।
ঠোটের মুচকি হাসির ফাঁকে,আমার যাদুর হাত ঘোড়ার পেছনের পা দুটো আঁকা শেষ করলো।এটা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়া,দেখে কে না অবাক হবে,সবাই বলবে, ‘শিল্পীদের ঐ সবচেয়ে সেরা শিল্পী,একমাত্র ওর যোগ্যতা আছে প্রধান শিল্পীর দায়িত্ব নেওয়ার’।
ভাবছিলাম বেকুবরা যারা নিজেদের খুব সমজদার মনে করে বলবে, ‘এ তো তাড়াহুড়া করে খেলার ছলে আঁকা একটা ছবি,এটা তেমন কি আর’।হয়তো ওদের চোখে পড়বে না,ছবির সৌন্দর্য,অনেক ধৈর্য ধরে আঁকা ঘোড়ার কেশর,দাঁত,লেজের চুল,নাক-যাতে কারও সন্দেহ না থাকে,আমার দক্ষতা আর অনুভুতি ছড়ানো তুলির টান।এ দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে ঘোড়ার লিঙ্গ,বিচিটা দেখার কথা কিন্ত মেয়েদের কথা ভেবে আমি ও গুলো বাদ দিলাম।বেশ অহংকার নিয়েই দেখছিলাম নিজের আঁকা ঘোড়ার ছবি,শক্তির প্রতীক,একটা ঝড়ো বাতাস!এক মায়াবী ঝড়ো সুর করে তুলি দিয়ে এঁকে গেছে ছবিটা,যেন কবিতার কটা লাইন,তবুও দাঁড়িয়ে আছে বলিষ্ঠ সুরে।সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে শিল্পীর,বলবে বিহজাদ,মীর মুসাভিরের এমন কি কম,আমার মন ভঁরে যাবে আনন্দে।
আমি যখন একটা ছবি আঁকি,এমন কি এই যে ঘোড়ার ছবিটা আঁকলাম,তখন আমি কেলেবেক না,আমি বিহজাদ,আমি মীর মুসাভির,আমি অনন্য এক শিল্পী।
আমাকে সবাই বলে লেইলেক(বক)
মাগরেবের নামাজের পর ভাবছিলাম,কিছুটা সময় কাটাবো কফির দোকানে বসে গল্প গুজব করবো,কেউ একজন বললো,আমার বাসার দরজায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।দেখি সুলতানের প্রাসাদের পেয়াদা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল,পেয়াদা সুলতানের ছবি আঁকার প্রতিযোগীতার কথা বিস্তারিত সবকিছু বললো।ভাবলাম বলবো,ঠিক আছে,পাঁচ ছয়টা ঘোড়ার ছবি এঁকে দিচ্ছি,কত মজুরী পাবো?তবে বোকার মত ও সব কথা না বলে আমি পেয়াদাকে ভেতরে আসতে বললাম।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়া,যার কোন অস্তিত্ব নাই,তার ছবি আমাকে আঁকতে হবে,কিন্ত তা কি সম্ভব?আমি আঁকতে পারি যুদ্ধের ঘোড়ার ছবি,বিশাল মঙ্গোলিয়ান ঘোড়ার ছবি,
আরবের নামকরা ঘোড়ার ছবি যে ঘামে,রক্তে পাথর টানছে,কিন্ত ঐ ছবির কোন একটা দেখে কেউ বলবে না ওটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়া।বোঝাই যাচ্ছে,পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়া বলতে, ‘আমাদের সুলতানের মতে পারস্যে আঁকা হাজার হাজার ঘোড়ার একটা না,এমন একটা ঘোড়া যা কেউ দেখেনি,চিন্তা করতে পারে না,সেই বিশেষ একটা চেহারা আঁকতে হবে।তবে কেন’?
জানি অন্যান্য শিল্পীরা কেউ চায় না মোহরের থলিটা আমার হাতে আসে,তবে আমি তো জানি অন্য কারও আঁকা ছবি,আমার ছবির সৌন্দর্যের ধারে কাছে পৌঁছাতে পারবে না।কে আমাদের সুলতানের মাথাটা খারাপ করলো?ঈর্ষায় ভঁরা ঐ সব ছোটদরের শিল্পীদের কানাঘুষা শুনলেও আমাদের মহামান্য সুলতানের জানে-তার এলাকায় আমার চেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী আর কেউ নাই।আমার ছবির প্রশংসায় সুলতান সবসময় পঞ্চমুখ।বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে ছিলাম,হঠাৎ এক সময় আমার হাত যেন রেগে ছুটে গেল একটা ঘোড়ার ছবি আঁকতে,খুর থেকে শুরু করে মনের ছন্দে সাজানো অভাবনীয় বিশেষ একটা ঘোড়া।এ ধরণের একটা ঘোড়া দেখা যেতে পারে,রাস্তায় বা হয়তো কোন যুদ্ধে,একই আবেগে আমি আঁকলাম,একজন সিপাহীর ঘোড়া,ওটা ছিল আরও সুন্দর।
আমি জানি সুলতানের শিল্পীদের কারও এমন প্রতিভা নাই যে আমার এই ঘোড়ার মত সুন্দর একটা্ ঘোড়া আঁকতে পারবে।যখন আরও কয়েকটা ঘোড়ার ছবি আঁকতে যাচ্ছিলাম,দরজার দাঁড়ানো সিপাহী বললো, ‘একটাই যথেষ্ট,আর লাগবে না’।ছেলেটা ছবিটা নিয়ে যাবে,অনেক কিছু ভেবে সিপাহী ছেলেটাকে একটু বসতে বললাম,এটা আমার ভালই জানা আছে,ঐ গর্দভরা নিঃসন্দেহে এই ছবির জন্য সোনার মোহর আমাকেই দিবে।
আমি যদি আমার মনের মত এঁকে দেই ছবিটা তবে পুরস্কারের মোহর না পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না,আর যদি মোহরটা আমার ভাগ্যে না আসে তবে আমার প্রতিভায় লেগে থাকবে একটা কলঙ্কের দাগ।সিপাহীকে বললাম, ‘একটু অপেক্ষা কর’,তারপর ঘরে ঢুকে ছেলেটার হাতে দুটা ভেনিসের সোনার মোহর দিলাম,অবাক হয়ে গেল ছেলেটা, ‘তোমার সাহস সিংহের চেয়েও বেশী’,আমি বললাম।
বের করলাম,লুকানো একটা খাতা,যেখানে আমার দেখা সুন্দর ছবিগুলোর একটা করে নকল আঁকা আছে।বামনদের নেতা-জাফের,পাখী,শিকারী,যোদ্ধা,যা হয়তো সুলতানের খাজাঞ্চীর কাছে তালা চাবি দিয়ে আটকানো ছিল।খাতাটা তাদের জন্যে না যারা ছবির মধ্যে বাস্তবতা খোঁজে,বরং তাদের জন্য যারা খোঁজে পুরোনো একটা স্বাদ।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে ছেলেটাকে ছবিগুলো দেখাচ্ছিলাম,সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়াটা বেছে নিয়ে,সূচ দিয়ে সুন্দর করে ছবিটাতে ছিদ্র করে সাদা কাগজের উপর রেখে কয়লার গুড়ো ছড়ালাম,আর কয়লার গুড়া দিয়ে আঁকলাম ঘোড়ার শরীর,চোখ থমকানো একটা ছবি।আমার হাতের কলমে তখন ছিল অভাবনীয় এক প্রেরনা,এক এক করে আঁকলাম,ঘোড়ার পিঠ,ঘাড়,
সৌন্দর্যের আরেক নতুন চেহারা,আমিই যেন ঘোড়াটা,সাজানো আমাতেই।
‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়া।আর যে সব গাধা নিজেদের শিল্পী বলে তারা কেউ পারবে এই ঘোড়া আঁকতে’।সিপাহী ছেলেটা যেন সুলতানকে আমার ছবি আঁকার গল্পটা বলে,সেই জন্যে তার হাতে দিলাম আরও তিনটা সোনার মোহর।বললাম,আমার এই ঘোড়াটা যদি পুরস্কার পায়,আরও কয়েকটা মোহর দিব তাকে।অনেকেই আঁকতে পারে সুন্দর ঘোড়ার ছবি,তবে সেটাই সেখানে শেষ না,ছবিটা যাতে মুগ্ধ করে,মহামান্য সুলতান আর তার ওস্তাদ শিল্পীদের,ছবির বোঝানো্,বিশেষত্ব করানোর দায়িত্বটাও তাদের অনুপস্থিত থেকেও।
আমি যখন একটা ঘোড়ার ছবি আঁকি,তখন আমিই হয়ে যাই সে ঘোড়াটা,আর কিছু না।
আমাকে সবাই বলবে,খুনী
জানি আমার ঘোড়ার ছবি দেখে কেউ বলতে পারবে না,আমি কে?যখন শুনলাম সুলতানের কথায় ঘোড়া আঁকার প্রতিযোগীতা হচ্ছে,আমার বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি,ওটা আর কিছু না,একটা অজুহাতে আমাকে খুঁজে বের করা,আমাকে ধরার চেষ্টা।আমি জানি আমার আঁকা ঘোড়ার ছবি,জারিফের লাশ থেকে কারও হাতে পৌঁছে গেছে তখন।আমি এ ও জানি,আমার আঁকা ঐ ঘোড়ায় এমন কোন খুঁত নাই,এমন কোন বিশেষত্ব নাই,যা দেখে কেউ খুঁজে বের করতে পারবে আমাকে।যদিও আমি নিশ্চিত,তবে তাড়াহুড়া করে ছবি আঁকতে গিয়ে কোন ভুল করলাম নাকি কে জানে?নতুন একটা ঘোড়া আঁকতে হলো আমাকে,অন্য কিছু ভেবে ছবিটা আঁকলাম,আমি হয়ে গেলাম আরেকজন।
কিন্ত কে এই আমি?আমি কি একজন শিল্পী আটকে আছে যার অনুভুতির উচ্ছাস,অন্য কোন শিল্পীকে অনুকরণ করার জন্যে,নাকি আমি এক শিল্পী যে তুলির টানে এঁকে দেয় মনের গভীরে লুকানো ছবিটা?বেশ ভঁয় লাগছিল,আমার ভেতরের ঐ জেগে ওঠা শিল্পীর অস্তিত্বের কথা ভেবে,অন্য আরেকজন কেউ যেন দেখছে আমাকে,আর লজ্জায় মাথা নত হয়ে আছে আমার।জানি দরজা বন্ধ করে সব সময় ঘরে একা এভাবে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব না,তাই অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম।শেখ ওসমান বাবার লেখা, ‘সুফীদের জীবন কথায়’,
আছে প্রতিটা মানুষকে তার মাঝের লুকানো শয়তানকে এড়ানোর জন্যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত খোঁজা উচিত চরম সত্যকে,স্থবির হয়ে সে যেন নিজেকে সপে না দেয় শয়তানের হাতে।তবে শেখ ওসমান সুফী বাবা,৬৭ বছরে নিজেই ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মসর্মপন করলো শয়তানের কাছে,আর ঐ বয়সেই শিল্পীরা অন্ধ হয়ে যায় বা হারায় আল্লাহর অন্ধকার দেশে,নতুন আরেকটা ছবি আঁকার কায়দা খুঁজে বের করে,খুঁজে নেয় বাঁধনহারা নতুন এক আকাশ।
বায়াজিদের মুরগীর বাজার,ক্রীতদাস বিক্রির খালি মাঠ,ছেড়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম সুপ আর পুডিং এর দোকানের সুবাস নিতে নিতে।জানি না কি যেন একটা খুঁজছিলাম আমি,ছেড়ে গেলাম নাপিতের বন্ধ দোকান,ধোপার দোকান,দেখলাম বুড়ো ময়রা বসে বসে মোহর গুনছে আমাকে দেখে,অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সে।একটা মুদির দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গন্ধ পেলাম আঁচারের,মাছের শুটকির।এক মশলার দোকানে ঢুকে দেখি,বাতির আলোতে রং ছড়ানো,সাজানো সে এক আরেক পৃথিবী নতুন আরেক রুপ রং-বস্তায়
কফি,আদা,জাফরান,দারুচিনি,জওয়াইন,কালো,বাদামী জিরা।অনেক ঐ রং এর রাজ্যে মুগদ্ধ হয়ে ইচ্ছা করে এক এক করে সবগুলো মুখে দিতে,আবার কোন সময় ইচ্ছা হয় ছবিটা ধরে রাখতে ক্যানভাসে।
হেঁটে গেলাম একটা রেস্তোরার পাশ দিয়ে,সপ্তাহ দুয়েক ওখানেই খাওয়াদাওয়া হচ্ছে আমার, ‘নিপীড়িত নির্যাতিতের আস্থাবল’,নামটা আমারই দেয়া,বরং,‘অবহেলিত’,বললেই হয়তো মানাতো ভাল।মাঝরাত্রি পর্যন্ত খোলা থাকে,অবশ্য সেটা কজনই বা জানে।ভেতরে বসে আছে হতভাগাদের দল দেখতে ঘোড়া চোরদের মত,না হয় যারা ফাঁসির কাঠগড়াটা কোনভাবে এড়িয়ে এখন বাইরে স্বাধীন।হতভাগা কিছু মানুষ দুঃখ,হতাশা যাদেরকে নিয়ে গেছে অজানার দুঃস্বপ্নে,,আফিমে আসক্ত কতগুলো চেহারা।বসে ছিল দুজন ফকির,ধর্মে উন্নাসিক ওদের সাধারণ ভদ্রতাও জানা নাই,আরেক কোনায় বসে ছিল বেশ সুন্দর চেহারার এক যুবক।বাবুর্চিকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিলাম,মাংস ভঁরা একটা দোলমার প্লেটে,দই আর লাল মরিচের গুড়া নিয়ে যুবকের টেবিলে বসলাম।প্রতি রাত্রে দুঃখ এসে ভঁর করে আমাকে,
আর হতাশার জালটা টেনে যায় আরও যন্ত্রনার গভীরে।
আমার ভায়েরা,আমার মোল্লা ভাই এর দল আমাদের মনকে কলুষিত করছে,পচে যাচ্ছি আমরা,পচে পচে মরছি আমরা…অনেক রাতেই স্বপ্ন দেখি,ও কুয়া থেকে ছুটে আসছে আমার দিকে,যদিও জানি ওখান থেকে উঠে আসা ওর পক্ষে সম্ভব না,ও তো আর কবর থেকে উঠে আসতে পারবে না্ তবু কেন জানি ভয় হয় আমার।
যে লোকটা এতক্ষন শুধু তার খাবার নিয়ে ব্যাস্ত ছিল,হঠাৎ আলাপ আরম্ভ করলো,ওটা কি আল্লাহর দেয়া একটা সংকেত?আমি বললাম,‘হ্যা,কিমাটা,তার সাথে বাঁধাকপি,সত্যিই চমৎকার’।আলাপে জানা গেল ছোটখাট একটা কলেজ থেকে পাশ করে আরিফি পাশার কেরানী হিসাবে কাজ করে,জিজ্ঞাসা করলাম না,রাতের এ সময়টায়,পাশার তহশীল,বা মসজিদে,বা বৌ এর সাথে না থেকে এই রেস্তোরায় বসে বসে সে কি করছে?লোকটা জিজ্ঞাসা করলো,কি করি আমি,আমিই বা এ সময় কেন রেস্তোরায় বসে আছি?
‘আমি বিহজাদ,তাব্রিজের হেরাতের মানুষ।শিল্পী হিসাবে আমার অনেক নামডাক আছে,অনেক সুন্দর,অসাধারণ ছবি আঁকা আমার হাতে।পারস্য,আরব দেশ,বলা যায় যে সব দেশে বই এর চলন আছে,সেখানেই আমার ছবি আছে,কয়েকশ বছর ধরে আমাকে নিয়ে আলাপ আলোচনা করে যাচ্ছে,কে না করে।শুধু তাই না,আমার ছবি মনের কথা বলে,চোখের দেখাটা শুধুই দেখা,কিন্ত ছবি শুধু উপলদ্ধির না,দেখার জন্যেও।ও দুটোকে যদি যোগ দিতে পারলে,আমাকে চিনতে পারবে।
আলিফঃ ছবির ক্যানভাসে ফুটে উঠে,আমাদের মনে ধরে থাকা রুপটা,সেটা কম আনন্দ আনে না মানুষের চোখে।
লামঃ বলা যায় চোখ যা দেখে চারপাশে,যা ছুঁয়ে যায় মন,সেটাই ধরা পড়ে ক্যানভাসে।
মিমঃ আবার এটাও বলা যায়,সৌন্দর্য যা আমাদের চোখ খুঁজে সেটাই তো মানুষ ধরা আছে মনের খাতায়,আর শিল্পীরা সেটা তুলে ধরে তুলির টানে।
ছোটখাট কলেজের এই যুবক বা লোক,যাই বলা যায় সে কি উপলদ্ধি করতে পারবে,আমার আত্মার ঝড়ের দাপটে,মনের গভীর থেকে ছুটে আসা কথাগুলো?অবশ্যই না?একজন হোজার সামনে বছরের পর বছর বসে তাদের বিড়বিড় শুনে কতটুকুই বা জানা যায়?বাইশটা রুপার মোহর,বারটা রুটি কিনতেই লাগে বারটা মোহর,সেটাই তো ছিল ঐ হোজাদের বেতন,ঐ মানুষ আর কিইবা জানবে শিল্পী বিহজাদের কথা।
ঠিক আছে আমিই বলছি,‘এমন কিছু নাই যার ছবি আমি আঁকিনি,মনে হয় না সত্যিই তেমন কিছু নাই যা আমার তুলিতে ধরা পড়েনি।আমাদের নবীজী মসজিদে চার খলিফার সাথে আলাপ করছে;আরেকটা বই এ নবী সাহেব,মেরাজের দিনে ফেরেশতার সাথে সশরীরে যাচ্ছে বেহেশতে।আলেকজান্দার চীনে যাওয়ার সময় ড্রামের শব্দ দিয়ে সমুদ্রের দানবদের তাড়াচ্ছে,যাতে তারা আনতে না পারে ঝড়ো হাওয়া; এক সুলতান হস্তমৈথুন করছে বাশীর সুরে হারেমের গোসলের নগ্ন মেয়েদের দেখে;এক কুস্তিগির যে ভাবছিল তার জয় নিশ্চিত অথচ হেরে গেল সুলতানের সামনে,লাইলা আর মেজনুন স্কুলঘরে কোরান তেলায়াত করার সময়ের প্রেম নিবেদন করার দৃশ্য।ভালবাসা মানুষটাকে দেখার জন্যে প্রেমিকের কাতরতা,
পাথরের দেয়াল আঁটকে আছে তাদের দৃষ্টি;দোষীদের শাস্তি দেয়ার দৃশ্য;ছুটে যাওয়া বাজপাখী;
লাফিয়ে বেড়ানো খরগোস;ভয়ংকর বাঘের দল;দেবদারু আর অন্যান্য ধরণের গাছ;মৃত্যু;
খ্যাতির যুদ্ধে ব্যাস্ত কবিরা;দেশ জয় করার পরে সুলতানের ভোজ;আর তোমাদের মত লোক প্লেটে সুপ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না’।লোকটা চুপচাপ বসে আনন্দই পাচ্ছিল সব কথা শুনে।
‘তোমাদের হোজা এফেন্দী নিশ্চয় এটা বলতে ভোলেনি,মনে হয় তুমি নিশ্চয় গল্পটা জান’,আমি বললাম, ‘এটা সাদীর বোস্তানের একটা অংশ।বাদশাহ দারিয়ুস যখন তার শিকারীর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড়ের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল,হঠাৎ ছাগল দাঁড়ি এক লোক এসে দাঁড়ালো,বাদশার সামনে,বিপদের কথা ভেবে দারিয়ুস ছুটে যাচ্ছিল তীর ধনুকের দিকে।লোকটা অনুরোধ করলো, ‘থাক না,আপনার তীর ধনুক একপাশে।তবে এটাও কি সম্ভব আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?আমি তো আপনার কয়েক শ ঘোড়া আর পাখীদের দেখাশোনা করি,আপনার সাথে তো আমার দেখা হয় মাঝে মাঝে!আমি তো আপনার ঘোড়াদের রংটা শুধু জানি না জানি,তাদের স্বভাবও।আমার একটা প্রশণ,জানতে চাই কেন একটু খবরও রাখেন না,আমাদের?এই যে লোকজন যারা কাজ করে যায় আপনার জন্যে,যাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখাও হয়,তাদের একটু খোঁজ রাখলে দোষ কোথায়’?
এই দৃশ্যটা যখন তুলে ধরার সময়,প্রথমে আঁকলাম,সাদা,কালো আর বাদামী রং এর ঘোড়া,
আয়েসী চেহারার ঘোড়াগুলো,রকমারী ফুলে সাজানো,যাতে সবচেয়ে বোকা পাঠকদেরও বুঝতে কষ্ট না হয়,সাদীর গল্পের মর্মটা।এই পৃথিবীর সৌন্দর্য ফুটে উঠে,ভালবাসায়,মর্যাদায়,মানুষকে যথাযথ সম্মান দেয়ায়।কেউ যদি শান্তির সুখের ঐ ঘোড়াদের দেশে বাস করতে চায়,
চোখ খুলে দেখা উচিত তার সত্যিকারের রংটা,তার দুঃখের চেহারা’।
বাইশ মোহরের ঐ হোজার শিষ্যের চোখে মুখে তখন বেশ ভঁয়,কোন রকমে চামচ আর প্লেটটা তুলে নিয়ে পালাতে পারলেই বাঁচে,তবে আমি তাকে সূযোগ দেয় নি,‘এ ভাবে বিহজাদের ওস্তাদরা ছবি আঁকতো,রাজাদের,সহিসের,ঘোড়ার ছবি’,আমি বললাম, ‘কয়েক শ বছর কেটে গেছে,আজও শিল্পীরা ঐ ছবিগুলোর অনুকরন করে যাচ্ছে।প্রতিটা ঘোড়া তাদের নিজেদের বিশেষত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিহজাদের তুলির ছোঁয়ায়।শুধু আমি না, আরও অনেক শিল্পীই যারা স্মৃতি থেকে আঁকতে ধরতে পারে ঘোড়ার ছবি’।
‘মনে হচ্ছে,ওটা বোধহয় একটা যাদুমন্ত্রের বই,ডানাসহ ঘোড়ার ছবি আছে বইটাতে,আমার বেহেশত নিবাসী ওস্তাদের কাছে ছিল’,লোকটা মন্তব্য করলো।
ইচ্ছা হচ্ছিল বেকুবটার মুখটা সুপের প্লেটে চেপে ধরি,সাথে ওর ওস্তাদের মুখটাও,যদিও লোকটা বেহেশতে চলে গেছে।ওখানে ওকে চুবিয়ে মারা ভাল হবে না,ওর কাছ থেকে শোনা যাবে কোন এক বই এ আঁকা ঘোড়ার করুন একটা ছবি।অবশ্য এটাই ভাল আমার সুপ খাওয়াটা শেষ করে দোকান থেকে বের হলাম,এলেমেলো হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম,আমি একাত্ম হয়ে গেছি তখন রাতের নিস্তবদ্ধায়।
আমার লুকানো আয়না বের করে কাজের টেবিলে রাখলাম,দু পাতার ছবিটা ছিল ড্রয়িং বোর্ড আর আমার কোলে রাখলাম।আয়নায় নিজের চেহারা দেখে কয়লায় ছবিটা আঁকলাম,
অনেক ধৈর্য ধরে যে ছবিটা আঁকলাম,তবে কোন মিল ছিল না আমার চেহারার সাথে।
কান্নায় ভঁরে গেছে আমার চোখ,ভাবছিলাম এনিষ্টের ঐ ভেনিসের শিল্পীরা কি ভাবে অত সহজে আঁকতো মানুষের চেহারা?হয়তো আমি যদি নিজেকে ভেনিসের একজন শিল্পী ভাবি,
আমিও আঁকতে পারবো একটা ছবি,একটা চেহারা,এক্টা মুখ তার বিশেষত্ব নিয়ে।
এনিষ্টে আর ইউরোপের শিল্পীদের গালাগালি দিয়ে আমার ছবিটা নতুন করে আঁকলাম,কিছুই হলো না,হলো একটা জঞ্জাল,তারপ্র রাস্তায় বের হয়ে,কিছুক্ষন এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর পর ঢুকলাম একটা কফির দোকানে,কেন যে হঠাৎ গেলাম ঐ কফির দোকানে,আমি নিজেই জানি না।
দোকানে ঢুকে বসে থাকা,ঐ সব ছোটখাট শিল্পীদের সাথে গল্পগুজব করার কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠলো।মনে হচ্ছিল সবাই আমাকে আড়চোখে দেখছে,আর এঁকে অন্যকে কনুই এ গুতাগুতি করে,আমাকে নিয়ে ফিসফাঁস করছে,লোকজনের হাসাহাসি আমার চোখ এড়ায়নি।
একপাশে চুপচাপ বসে,আড়চোখে দেখছিলাম উপস্থিত অন্যান্য ওস্তাদ শিল্পীদের,যারা অনেকেই একসময় আমার সাথে কাজ করতো।একসময় আমি ওস্তাদ ওসমানের শিষ্য ছিলাম,কোন সন্দেহ নাই ওদের সবাইকেই ঘোড়া আঁকার কথা জানে,আর এটা তো জানা কথাই ওরা কেউ কম চেষ্টা করেনি সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়াটা আঁকার জন্যে।
গল্পের যাদুকর এফেন্দী তখনও তার অনুষ্ঠানটা আরম্ভ করেনি,নতুন গল্প বলার ছবিটাও ঝোলানো হয়নি,তখনও।আশেপাশের লোকজনদের সাথে গল্পে মত্ত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না,কিছুক্ষন মন খুলেই কথা বললাম না হয়।অন্যান্য আর কজনের মতই আমিও ঠাট্টা করছিলাম,আলতুফালতু নোংরা গল্প,কথা দিয়ে,পুরানো সহকর্মীদের দেখে গালে চুমু দিয়ে অভিনন্দন জানালাম একে অন্যকে।জিজ্ঞাসা করলাম,উঠতি শিল্পীদের কে কেমন আছে,বেশ জমে উঠলো আসর।যদিও হেসে কথা বলছিলাম,তবুও মনে ছিল প্রচন্ড ঝড়।
গল্প আরম্ভ হলো লিঙ্গ নিয়ে,তুলনা করছিল সবাই তাদের জানা লিঙ্গের সাথে।তারপ্র আলাপ আরম্ভ হলো কিশোর ছেলেদের নিতম্ব নিয়ে,কেউ কেউ তুলনা করছিল নরম বালিশ,কমলা লেবু,ডুমুরের সাথে।আমার বয়সী কজন শিল্পী তাদের লিঙ্গ নিয়ে এতই লজ্জায় করছিল,তারা তুলনা করলো ছোট্ট লাঠির সাথে।আমি আবার বুড়ো ওস্তাদদের অকেজো লিঙ্গ এর সাথে তরুন শিল্পীদের ঠোঁটের তুলনা করছিলাম।ঠাট্টা হচ্ছিল বুড়ো শিল্পীদের মোহর লুকানোর গুপ্ত জায়গা নিয়ে,যত সব নোংরা গর্তগুলোর কাহিনী।এর মধ্যে মদে গোলাপ জলের বদলে হয়তো আফিম মেশানো আরম্ভ হয়ে গেছে।
তাব্রিজ আর্ হাফিজের শেষ নামকরা শিল্পীরা কফি আর মদ মিশিয়ে বেসামাল হচ্ছে,
কালিগ্রাফার আর সুন্দর সব কিশোররাও ছিল সেখানে।এক সময় আমার লুকোনো দুই সত্বা বিজয়ী হয়ে বের হলো,পেছনে পড়ে থাকলো অন্যান্যরা সবাই।মনে পড়লো ছোটবেলার ধর্মীয় অনুষ্ঠান,ভাইবোন,বন্ধুদের সাথে কাটানো আনন্দের সময়গুলো,তবুও আমার মন যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে ছিল।কোন এক নিষ্ঠুর,অজানা অশরীরি ক্ষমতা দখল করে আছে আমার মন,হয়তো একটা জিন-প্রলুদ্ধ করে নিয়ে গেছে আমাকে,সব ভাল থেকে নিয়ে গেছে শয়তানীতে।ও কি ইবলিশ,শয়তান,আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে চরম অধঃপতনে?
না,আমার নিস্তব্ধতা তো আসেনি শয়তানের কাছ থেকে বরং বলা যায় ওটার উদ্ভব আমার আত্মার বিশুদ্ধ চেহারায়।মদের নেশায় দূটো গল্প বললাম,আশা ছিল কিছুটা শান্তি ফিরে আসবে মনে।লম্বা,কটা চোখের এক কালিগ্রাফারের শিষ্য খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আমার গল্প।
০০০০০০০
(
২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৩:১৮
ইল্লু বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:৩৯
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর ঝরঝরে লেখা।