নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৫৪

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা

(৩২)
কেলেবেকের অন্য মানুষদের খুশী করার ইচ্ছাটা এত প্রচন্ড ছিল,যে সময়ে সে অনেকটা যেন প্রশংসার দাস হয়ে গেছে।তাই এটাই স্বাভাবিক যে কেলেবেক সুলতানের শিল্পীদের প্রধান হতে চায়,এই মন্তব্যটা করলো সিয়াহ।
আমি বললাম, ‘জানি ও পরিকল্পনা চালাচ্ছে,প্রস্ততি নিচ্ছে আমার জায়গা নেয়ার জন্যে’।
‘আপনার কি মনে হয়,ও এত বেশী উচ্চাকাঙ্খী যে খুন করতেও কোন দ্বিধা হবে না ওর’।
‘হতে পারে।ও নিঃসন্দেহে একজন প্রতিভাবান শিল্পী,তবে ও এখনও আটকে আছে ওর পুরোনোতে,তার প্রভাবটা দেখাই যায় ওর ছবিতে’।

আমি বললাম,এটাও সত্যি কথা,আমার বিশ্বাস সুলতানের শিল্পীদের নেতৃত্বটা কেলেবেকের হাতেই যাওয়া উচিতে।আমি জেইতিনকে কোন সময় বিশ্বাস করতে পারিনি,আর আমি জানি লেইলেকের খুব পচ্ছন্দ ভেনিসিয়ান কায়দার ছবি,সময়ে ও ঐ ভেনিসিয়ান পদ্ধতিতে আত্মসর্মপন করবে।কেলেবেক নিঃসন্দেহে চরম সম্মানের যোগ্য-তবে এটা ভেবে আমার চরম অস্বস্তি লাগছে সে একটা মানুষ খুন করতে পারে।একমাত্র কেলেবেকের প্রতিভা,আত্মবিশ্বাস তার ছবি,তুলির ছোঁয়া থামাতে পারে ভেনিসের শিল্পীদের ঐ মাদকতা,যা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরেঃছবি,ছায়াসহমোল্লারা,ব্রিজ,নৌকার বহর,মোমবাতীদানী,গির্জা,আস্তাবল,চাকাওয়ালা গরুর গাড়ী,যার সব কিছুরই একটা প্রাধান্য আছে আল্লাহর পৃথিবীতে।

‘আপনি না বলে হঠাৎ করে কি কেলেবেকের বাসায় গেছেন,কখনও’?
‘কেলেবেকের কাজ দেখলেই বোঝা যায়,সে ভালবাসার মূল্য জানে,জানে মনভরা আনন্দ কাকে বলে,দুঃখটা কি জিনিষ।তবে রং এ মাতাল অন্যান্য শিল্পীদের মত,সে খুবই আবেগপ্রবন,আর কোন ব্যাপারেই মনস্থির করতে পারে না।আমি ওর আল্লাহর দেয়া অবিশ্বাস্য রং ব্যাবহার করার প্রতিভায় এতই মুগ্ধ ছিলাম যে ওর কৈশোরে সবচেয়ে বেশী খেয়াল রাখতাম ওর দিকে,ওকে হয়তো আমার চেয়ে বেশী আর কেউ জানে না।অবশ্য অনেক সময় শিল্পীর হিংসা বিদ্বেষ যখন জায়গা করে নেয়-তখন ওস্তাদ শিষ্য সম্পর্ক ও সব জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় সবাই।বেশীর ভাগ সময়ই কেলেবেক চিন্তা করতো না কে কি বলছে?এর মধ্যে ও আবার পাড়ার ফল ব্যাবসায়ীকে বাড়ী বিক্রি করলো,আমার যাওয়া হয়নি আর সূযোগটাও হয়নি’।

‘লোকজন বলে কেলেবেকের সাথে নাকি হুজরামের হোজার শিষ্যদের সাথে বেশ দহরম আছে’,সিয়াহ বললো,‘হোজা যদি এনিষ্টের বই এর ছবিগুলো দেখে থাকে–যেখানে আছে যুদ্ধ,রক্তাত্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রের দৃশ্য,শোভাযাত্রা,বাবুর্চি,যাদুকর,কাবাবের বাবুর্চি এগুলো সব ঈমানবিরোধী বলে দাবী করলে-সুবিধা হবে তার হেরাতের ওস্তাদদের পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরে যেতে’।

‘আমরা যদি ফিরে যাই বিজয়ী তৈমুর লং এর সময়ে,ফিরে যাই ঐ জগতে,ঐ জীবনে-লেইলেক মনে হয় সেই শিল্পী যে ছবিটা আঁকতে পারবে সময়ের সুরে,আর ভুলে যাব আমরা সব কিছু’,অনেকটা নিষ্ঠুর ভাবে বললাম আমি, ‘কেন না সবাই ছবিটা আঁকবে
ইউরোপিয়ানদের মত’।
আমি কি নিজে বিশ্বাস করছিলাম,যা বললাম আমি?
‘এনিষ্টেরও বিশ্বাস ছিল তাই’,সিয়াহ মিনমিন করে বললো, ‘তবুও তার আশা ছিল অন্য কিছু’।



লেইলেক(বক)কে নিয়ে কটা কথা

ও মাঝে মাঝে ওর ছবিতে নাম সই করতো,পাপী শিল্পী মুস্তাফা চেলেবী হিসাবে।তার নিজের কোন পদ্ধতি থাকবে কি থাকবে না,ছবিতে নাম থাকবে কি থাকবে না,নাকি পুরোনো ওস্তাদদের মত নামটা অজানা থাকবে,অত চিন্তা না করে একটা বিজয়ের হাসি দিয়ে সে তার নামটা সই করে দিত।
আমার শেখানো পদ্ধতিতে সে এগিয়ে যাচ্ছিল আর তার ছবি আঁকার ধরণ এমনই ছিল যা আগে কেউ করতে পারেনি।আমার মতই সে দেখতো যেত কাঁচের কারিগরদের কাজ,যখন গলানো কাঁচে ফু দিয়ে সবুজ,নীল জগ বানাতো তারা,চামড়া,সুই,দেখতো কাঠের ছাঁচ দিয়ে মুচির জুতা বানানো,ঘোড়ার দৌড়ানোর অনুষ্ঠান,ঘানিতে পিশে তেল বের করার দৃশ্য,
শত্রুদের দিকে যখন আমাদের সৈন্যরা কামান দাগছিল,বন্দুকের নল,স্ক্রু।

কোন অজুহাত দেখাতো না লেইলেক কোনসময়ই ছবিগুলো আঁকার জন্যে,কোনদিন অজুহাত দেখায়নি তৈমুর লং এর সময়ের বা তাব্রিজ আর কাভিনের পুরোনো ওস্তাদের কায়দায় ছবি আঁকতে।ঐ প্রথম মুসলমান যে যুদ্ধে যায় আবার ঠিকমত ফিরেও আসে,ওর হাতেও সুলতানের জয়ের কাহিনীর বইটা ছবির সম্পূর্ন করে।লেইলেক,প্রথম শিল্পী যে ছবি আঁকার জন্যে শত্রুদের কেল্লা,কামান,ঘোড়া,রক্তাক্ত সৈন্য এমনকি মৃতদেহও পরখ করতে দ্বিধা করেনি।

ওর ছবি বুঝতে গেলে আঁকার পদ্ধতি শুধু না বিষয়বস্ত এর দিকেও খেয়াল করতে হবে।
আমি নিশ্চিন্ত মনের শান্তিতে যে কোন ছবি তাকে আঁকতে দিতে পারতাম-স্কেচ থেকে শুরু করে,রং দেয়া থেকে,বই এর পাতা সাজানো কোনটাতেই লেইলেকের দক্ষতার অভাব ছিল ন।একভাবে ভেবে দেখলে দক্ষতা,গভীরতায় ওর দেয়ে ভাল শিল্পী আর কে হতে পারে, সুলতানের শিল্পীদের প্রধানের দায়িত্বটা ভবিষ্যতে ওর হাতেই যাওয়া উচিত।তবে ওর দোষগ্যলো ওকে অনেক খাট করে দেয়,আকাঙ্খা আকাশ ছোঁয়া,অসম্ভব দাম্ভিক,আর অন্যান্য শিল্পীদের প্রতি ওর ঘৃনা,অবজ্ঞা এত বেশী যে ওর পক্ষে কোনদিন সম্ভব হবে না এতজন শিল্পীকে নিয়ে কাজ করা।পারলে সে নিজেই একা সব ছবিগুলো আঁকতো।ও একজন দক্ষ শিল্পী,কি ভাবে কোনটা করা দরকার জানা আছে লেইলেকের আর ও সবসময় নিজের প্রশংসায় নিজেই পঞ্চমুখ।

একবার আগে ভাগে না বলে ওর বাড়ীতে গিয়ে দেখি,কাজের ঘরটায় ভাজ করা কাজের টেবিল,চেয়ারের গদি,টেবিলের উপর ছিল সুলতানের বই এর পাতা,এক পাশে রাখা ইউরোপের পর্যটকদের জন্যে আঁকা ছবি যাতে তারা আমাদেরকে খাট করে দেখাতে পারে,পাশাপাশি কটা ছবি কোন এক শাহের জন্যে,আর তার নিজের জন্যে আঁকা যৌনসঙ্গমের ছবির পাতা।

লম্বা,পাতলা লেইলেক এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে যেন লাফ দিয়ে দিয়ে এঁকে এঁকে যাচ্ছিল,মৌমাছির মত ফুলের মেলায়,গান গেয়ে বেড়াচ্ছিল আপন মনে,আর মাঝে মাঝে শিষ্যের গালে চিমটিও কাটছিল।আর কজন শিল্পীর মত আমাকে দেখে থমকে যায়নি, সুলতানের নানান অনুষ্ঠানের ছবি এঁকে যাচ্ছিল আপনমনে।এখন মনে হচ্ছে আমার শিল্পীদের মধ্যে কেঊ যদি সত্যিই খুনী হয় তবে লেইলেকের হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশী।ও যখন আমার শিষ্য ছিল কেলেবেককে শুক্রুবারে দরজায় দেখে যে আনন্দটা হতো,লেইলেককে দেখে সেটা হয়নি কোনদিন।

ছবি আঁকার সময় খুটিনাটি দেখা নিয়ে সে কোনদিন কার্পন্য করেনি,তার আঁকার পদ্ধতিটা ভেনিসের ঐ ওস্তাদদের মত।তবে লেইলেক ভেনিসের শিল্পীদের মত মানুষের চেহারায় ব্যাক্তি বিশেষে বিশেষত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করে না।লেইলেক সবসময়ই অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে নিজেকে বেশী প্রতিভাবান মনে করতো,কোন মুখের বিশেষত্ব তার কাছে তেমন একটা দরকারী মনে হয়নি।আমি নিশ্চিন্ত এনিষ্টে তাকে সুলতানের ছবি আঁকতে দেয়নি।

কোন অনুষ্ঠানের ছবি আঁকার সময় অনুষ্ঠানে একটা কুকুরকে ছবির পাতায় আনতে,ছেঁড়া নোংরা কাপড়ের ফকিরকে অনুষ্ঠানের মাঝে আনতে কোনদিন দ্বিধা করে নি,লেইলেক।তার বিশ্বাস যে কোন বিষয়ে,যে কোন ছবিতে কৌতুক যোগ দিলে ছবির বিশেষত্ব,সৌন্দর্য আরও বেড়ে যায়।

‘জায়িফ এফেন্দীর খুন অনেকটা যেন নবী ইউসুফের ভায়েরা হিংসা করে তাকে যে ভাবে কূয়াতে ফেলে দেয়,ঠিক সেই রকম’,সিয়াহ বললো, ‘আর এনিষ্টের মৃত্যু,অনেকটা হুসরেভের নিজের ছেলের হাতে খুন হওয়ার দৃশ্য,যে নিজেই হুসরেভের বৌ শিরিনের প্রেমে পাগল।সবাই বলে লেইলেক নাকি যুদ্ধ আর ভয়াবহ মৃত্যুর দৃশ্য আঁকতে খুবই ভালবাসে’।

‘কেউ যদি শিল্পীর আঁকা ছবিতে তার মানসিকতার প্রভাব খোঁজে,মনে হয়না ও ভাবে কোন শিল্পী বা ওস্তাদ শিল্পীদের বোঝা যায়।যা ওস্তাদ শিল্পীদের নাড়া দেয়,সেটা বিষয় না-বরং ছবিতে শিল্পীর মনের প্রচ্ছন্ন আবেগ।ছবি থেকে আলো বের হয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে-নতুন একটা কিছু ছুঁয়ে যায় মানুষের মন,যা আছে ঘোড়ায়,আছে আকাঙ্খা দুঃখ সাজানো ইউক্যালিপটাসের গাছটাতে যেটা ছুটে যাচ্ছে বেহেশতের দিকে,মনের আবেগ নিয়ে আমরা দেয়ালের টাইলগুলোকে অলঙ্কার করি আর ওর মধ্যে গোপন করা থাকে…আমাদের রহস্য,দলের ঘোড়াগুলো না।শিল্পী যখন ঘোড়ার বাতাসের গতিতে ছুটে যাওয়ার ছবিটা তুলে ধরে সে কখনও নিজের মনের রাগ আর গতি তুলে ধরে না,আদর্শ ঘোড়াটা আঁকতে গিয়ে,তুলে ধরে দুনিয়ার সৌন্দর্য আর সৃষ্টিকর্তার মহত্ব,জীবনের মাধুর্য,এ ছাড়া আর কিছু না’।


আমাকে সবাই সিয়াহ(ব্ল্যাক)বলে ডাকে

বই এর পাতা,ওস্তাদ ওসমান আর আমার সামনে রাখা ছিল-কোন কোন পাতায় কালিগ্রাফিতে লেখা গল্পের অংশ,কোন কোন বই বাধানোর জন্যে প্রস্তত,কোন কোনটা শেষ হয়নি এমন কি ছবিতে রংটাও করা হয়নি,বা অন্য যে কারণেই হোক-সারাটা বিকাল আমরা এমিষ্টের বই এর পাতা পরখ করে আমাদের বিশ্লেষনটা লিখে রাখলাম।ভাবলাম পেয়াদাদের প্রধান আর তার লোকজনদের সাথে আমাদের আর দেখা হবে না,কিন্ত ঐ গোঁয়ার লোকেরা যারা শিল্পী,কালিগ্রাফারদের বাসা থেকে বই এর পাতাগুলো এনে দিল(কতগুলো পাতা যা সুলতানের অনুষ্ঠানের বই,এনিষ্টের বই এর সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না,আর বোঝাই যাচ্ছিল অনেক শিল্পী,কালিগ্রাফাররা কটা মোহরের জন্যে প্রাসাদের বাইরের কাজ করতো,পেয়াদারা এসে বেশ কিছু কাগজ নিয়ে গেল।

প্রথমে তেমন একটা প্রাধান্য দেয়নি,ভাবলাম হয়তো পেয়াদাদের প্রধানের কাছে কারও আর্জো,তার ছেলের কাজের জন্যে।সকালের সূর্যটা সরে গিয়ে রাতের অন্ধকার চারপাশে তখন।আমি তখন একটা চোখের ব্যায়াম করছিলাম,সিরাজের পুরোনো ওস্তাদ শিল্পীদের মত,
চোখের অসুখ থেকে দূরে থাকার জন্যে তখন ঝকঝকে নীল আকাশ দেখছিলাম।হঠাৎ অদ্ভুত রং এর সৌন্দর্যে সাজানো একটা ছবি,ওস্তাদ আমার দিকে তুলে ধরলো,অনেকটা যেন এসথারের হাতে পাঠানো সেকুরের চিঠির মত।আমি বোকার মত বলতে চাচ্ছিলাম, ‘কি অদ্ভুত মিল’,যখন দেখলাম সেকুরের প্রথম চিঠিটার মতই মোটা কাগজে আঁকা ছবিটা।

এক সময় ওস্তাদ ওসমান ছবিটা রেখে দিয়ে চিঠিটা দিল আমার হাতে,সেকুরের লেখা,
‘আমার প্রিয় স্বামী,সিয়াহ,এসথারকে পাঠালাম জায়িফ এফেন্দীর,বিধবা কালবিয়ের সাথে দেখা করার জন্যে।ওখানে কালবিয়ে এসথারকে এই ছবিটা দেখালো,পরে আমি গিয়ে কালবিয়েকে অনেক অনুরোধ করলাম,ছবিটা আমার হাতে দেওয়ার জন্যে,বুঝিয়ে বললাম হয়তো ছবির সাথে খুনীর কোন যোগাযোগ থাকতেও পারে,আর সেও তো চায় তার স্বামীর খুনীকে খুঁজে বের করতে,চিঠির সাথে ছবিটা পাঠালাম।।ছবিটা হতভাগা জায়িফ এফেন্দীর কূয়া থেকে তাকে তুলে আনা লাশের সাথে ছিল।কালবিয়ে ধর্মের নামে কসম খেয়ে বললো,সে জানে জায়িফকে কেউ ঘোড়া আঁকতে দেয়নি,বা কারও জন্যে সে ঘোড়া আঁকেনি।তাহলে কে আঁকলো ছবিটা?পেয়াদাদের সর্দার ওদের বাড়ী তল্লাশী করে গেছে।আমার কেন জানি মনে হচ্ছে,ছবিটা তোমাদের সম্পূর্ন ঘটনার রহস্য বের করতে সাহায্য করবে।ছেলেদের ভালবাসা রইলো তোমার জন্যে।তোমার আদরের বৌ,সেকুরে’।

চিঠিটার শেষ কটা লাইন বারবার পড়ছিলাম,যেন গোলাপের বাগানে সুন্দর গোলাপ মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।আতস কাঁচ নিয়ে ছবিটা দেখছিলাম,ওস্তাদ ওসমানও পরখ করছিল ছবিটা।সাথে সাথেই খেয়াল করলাম ঘোড়ার ছবিটার কালি বেশ ছড়ানো ছিল,অনেকটা পুরোনো ওস্তাদদের হাতের ছোঁয়া যেন।

ওস্তাদ ওসমান সেকুরের চিঠি পড়ে কোন মন্তব্য করেনি,শুধু প্রশ্ন করলো, ‘কার আঁকা ছবি?
তারপর নিজে নিজেই উত্তর দিল,কোন সন্দেহ নাই একই শিল্পী যার হাতে আঁকা এনিষ্টের ঘোড়ার ছবিটা’।এত নিশ্চিত ভাবে কি করে বললো,ওস্তাদ ওসমান?তা ছাড়া আমরা তো জানি না,ঘোড়ার ছবিটা কার হাতে আঁকা,ঘোড়ার ছবিটা নিয়ে আবার দেখছিলাম আমরা।
খুব সাধারণ ভাবে আঁকা বাদামী রং এর একটা ঘোড়া,তবে তার দিকে তাকালে চোখটা সরানোই যায় না।আমি কি সত্যি কথা বলছিলাম?এনিষ্টের ঘোড়ার ছবিটা এর আগেও বেশ কবার দেখা ছিল আমার,তবে কোন সময়ই মনে তেমন ধাক্কা দেয়নি,সুন্দর একটা ঘোড়ার ছবি,তবে ওটুকুই।এত সাধারণ,সহজভাবে আঁকা যে বলা সম্ভব না কার হাতে আঁকা ছবিটা।রংটা ঠিক বাদামী রংও বলা যাবে না,বরং হাল্কা কালো সবুজ মেশানো,আর লাল রং কিছুটা ছড়ানো সেখানে।এ ধরনের ঘোড়া অন্যান্য বই এ এত দেখা যে কোন পার্থক্য বোঝার উপায় নাই,ছবিটা কার আঁকা।

আমরা ঘোড়াটার দিকে বার বার তাকানোর পর লুকানো একটা রহস্য খুঁজে বের করলাম।
দেখতে পাচ্ছিলাম,ঐ সাধারণ ঘোড়াটার ছবি থেকে অদ্ভুত ভেসে আসছিল একটা মনছোঁয়া উত্তাপ,আর তার মাঝের অদ্ভুত একটা শক্তি নতুন জীবন নিয়ে,নতুন আলোতে পৃথিবীটাকে জড়িয়ে ধরলো।কে ঐ যাদুকর শিল্পী যে ঘোড়াটাকে এমন ভাবে আঁকলো,আল্লাহ যে ভাবে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে?কিছু সময়ের জন্যে ভুলে গেলাম হয়তো ঐ শিল্পী যতই প্রতিভাবান হোক না কেন,একজন খুনী।ঘোড়াটা তখন যেন জীবন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে,কিন্ত ওটা তো একটা ছবি,এই দুই চিন্তার মধ্যে ভেসে গেছি আমি।

কিছুটা সময় আমরা খসড়া কাগজে আঁকা ঘোড়ার ছবির সাথে এনিষ্টের বই এর ঘোড়ার ছবির তুলনা করছিলাম,অনেক খুঁটিনাটি দেখে বোঝা গেল দুটো ছবি একই শিল্পীর আঁকা।আমি অনেকটা ভঁয়ে ভঁয়ে দেখছিলাম এনিষ্টের বই এর ঘোড়াটাকে।

‘অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘোড়া’,আমি বললাম, ‘দেখেই ইচ্ছা করছে,কাগজ নিয়ে ছবিটা নকল করে রাখতে,আর যা যা আছে সব কিছুকে একইভাবে তুলে ধরতে’।
‘একজন ওস্তাদের কাছে ওটা অনেক বড় সম্মান,যখন আরেকজন শিল্পী উদ্বুদ্ধ হয়ে তার ছবি নকল করতে চায়’,ওস্তাদ ওসমান বললো, ‘কিন্ত এখন ঐ শয়তানের প্রতিভার কথা ভুলে,ওর আসল চেহারাটা আমাদের জানা দরকার।এনিষ্টে এফেন্দী-আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করে,তার কাছ থেকে কি শুনলে বইটার কি গল্পের কথা’?

‘না এনিষ্টে যা বললো এই ঘোড়াটা এক সময় আমাদের সুলতানের রাজত্বে ছিল,সুন্দর একটা ঘোড়া যা অটোমান সাম্রাজের প্রতীক।আমাদের সুলতানের ক্ষমতা,প্রতিপত্তির সোচ্চার একটা চেহারা যা ভেনিসের শাসনকর্তাদের মুগ্ধ করবে।আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে যে ভাবে ভেনিসের শিল্পীরা আঁকে,এ ঘোড়াটা যেন আল্লাহর উপলদ্ধিতে সৃষ্টি একটা ঘোড়া,ভেনিসের শাসনকর্তা নিজেকে বলবে ইস্তাম্বুলের আস্তাবলের কোন ঘোড়া যেটা’।

ওটোমান শিল্পীরা পৃথিবীটাকে আমাদের মত করেই দেখতো,ওটোমান শিল্পীরা অনেকটা আমাদের মতই,আর আমাদের সুলতানের ক্ষমতা আর বন্ধুত্বকে বরণ করেই তাদের ছবি।তুলির ছোয়ায় কোন ঘোড়াকে শিল্পী যখন অন্যভাবে তুলে ধরে তার কাছে সারা পৃথিবীটাই তখন অন্যরকম।যত বিচিত্রই এই ঘোড়াটা ওটা আঁকা পুরোনো ওস্তাদদের পদ্ধতিতে আঁকা।যতই আমরা ঐ ঘোড়াটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম,ততই আমি অবাক,হতবাক হয়ে দেখছিলাম তার সৌন্দর্য।একটু খোলা ঘোড়ার মুখটা,জিভটা দেখা যাচ্ছিল দাঁতের ফাঁক দিয়ে,
ঝকঝকে উজ্জল চোখ,পা দুটো যেন ছুটে যাওয়ার জন্যে প্রস্তত হয়ে আছে।একটা ছবি কিংবদন্তী হয়ে যায়,সেটা কি তার বিষয়ের জন্যে নাকি বিশ্লেষনে?ওস্তাদ ওসমান তখনও ঘোড়াটাকে আতস নিয়ে পরখ করছিল।
‘ঘোড়াটা কি বলতে চাচ্ছে’?আমি বেশ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
‘কেন এই ঘোড়াটার ছবি আঁকা হলো?কেন?কি আছে এই ঘোড়ার ছবিটাতে?কেন এই ঘোড়ার ছবিটা আমাকে এত উদ্বুদ্ধ করছে’?
‘ছবি,এমন কি বই,যা সুলতান,শাহ বা পাশারা বানানোর আদেশ দেয়’,ওস্তাদ ওসমান, ‘ছবি দেখে,বই পড়ে সবাই অবাক হয় সৌন্দর্য ছড়ানো রং এর বাহারে,সোনার পাতায় মোড়ানো প্রাচুর্যতায়।ছবিটার সৌন্দর্যটাও গুরুত্বপূর্ন কেননা সেটা সোনার পাতার জৌলুষের চেয়ে কোন অংশে কম না।অনেকে ছবিটা পচ্ছন্দ করবে ওটা দেখতে জীবন্ত একটা ঘোড়ার মত,একটা ঘোড়া যেটা আল্লাহর মনের তৈরী,হয়তো বা একটা কাল্পনিক ঘোড়া;ছবির বাস্তবতাকে বলা হয় শিল্পীর প্রতিভা,শিল্পীদের কাছে ছবির সুক্ষতা আর মাধুর্যতাই প্রধান।অবশ্য এই ঘোড়াটায় শুধু একটা শিল্পীর হাতের ছোঁয়া নাই,আছে একটা খুনীর হাত,শয়তানের উপস্থিতি,এ জন্যেই ছবিটা অনেক বেশী জটিল,এটাও ঠিক যে এটা শুধু একটা ঘোড়ার ছবি না,এটা একটা জীবন্ত ঘোড়ার ছবি’।
‘এই ঘোড়ার ছবির দিকে তাকালে,কি মনে হবে তোমার’?
‘ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা বাচ্চা ঘোড়া না,কেশরের আঁকাবাঁকা ভাব দেখে বরং মনে হচ্ছে দূরন্ত,ছূটে যাওয়ার প্রস্তত একটা রেসের ঘোড়া,আর এর পিঠের ধরণটা বোঝা যাচ্ছে দূরের কোন এক যাত্রার জন্যে প্রস্তত হয়ে আছে,ঘোড়াটা।ওর পা আর চলার ধরণ দেখে মনে হয় ঘোড়াটা হয়তো আরব দেশের,তবে ওর ঐ বিশাল শরীরটা দেখলে মনে হয় আসলে তা না।বুখারার পন্ডিত ফাদিয়ানের ‘ঘোড়া কাহিনী’,বইটা পড়ে বলা যায়,ওর পা দুটো দেখে মনে হয়,ঘোড়াটা যদি নদীর ধারে থাকে ও ভঁয় না পেয়ে নিঃসন্দেহে নদীটা পার হয়ে যাবে।

সুলতানের পশুর ডাক্তার ফায়ুজীর ঘোড়া কাহিনীতে বলা,যা যা গুন আছেস সবই এ ঘোড়ার জন্যে প্রযোজ্য।একটা ভাল ঘোড়ার মুখটা হবে সুন্দর,চোখগুলো হবে হরিনের মত;কানগুলো হবে লম্বা,দাতগুলো ছোট ছোট,টানা ভুরু,বেশ লম্বা হবে ঘোড়াটা,থাকবে লম্বা লম্বা কেশর,কোমরটা হবে ছোট,ছোট্ট নাক,ছোট্ট কাঁধ।অলস ভাবে ঘুরে বেড়ালেও,তার সৌন্দর্যে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে সবাই’।
‘ঠিক যেন আমাদের বাতামী রং এর ঘোড়াটাই’,আমি ছবিটার দিকে অবাক চোখে দেখে বললাম।
‘ঘোড়াকে খুঁজে পেলেও’,ওস্তাদ ওসমান বললো অদ্ভুত একটা হাসি মুখে,‘আমরা কিন্ত জানি না শিল্পীটা কে,আমার মনে কোন শিল্পী জীবন্ত ঘোড়াকে দেখে তার ছবি আঁকবে।শিল্পীরা ঘোড়ার ছবি আঁকে তাদের স্মৃতির পাতা থেকে,তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয় সেটা।উদহারণে বলা যায়,আমার শিল্পীরা ঘোড়ার ছবি আঁকা আরম্ভ করে তার খুর থেকে’।
‘তার কারণ তো যাতে মনে হয় ঘোড়াটা মাটিতে দাঁড়ানো ছুটে যাওয়ার জন্যে’,আমি বললাম।
‘কাজভিনের জামালউদ্দীনের ঘোড়ার ছবি আঁকার নিয়মে লেখা আছে,স্মৃতির থেকে কেউ যদি ঘোড়া আঁকতে চায় তা হলে শিল্পীকে শুরু করতে হবে ঘোড়ার খুর থেকে।অবশ্য এটা বলা যায়,বেশী চিন্তা করে একটা ঘোড়ার ছবি আঁকতে গেলে,বা হাস্যকর একটা ঘোড়া দেখে যদি তার ছবি আঁকা হয়,শিল্পীকে মাথা থেকে কাঁধে,কাঁধ থেকে শরীরে ছোটাছুটি করতে হবে।আমার শোনা,ভেনিসের কিছু কিছু শিল্পী দর্জি,কসাইদের কাছে ইচ্ছামত আঁকা ছবি বিক্রি করে,তার পর এক সময় সেই ছবি ঠিক করে আবার নতুন করে আঁকতো।আমি এটা জোর দিয়ে বলতে পারি,একজন মাঝারী ধরণের শিল্পীও জানে বিশেষ মুহুর্তের জীবন্ত কিছু একটা দেখে ছবি আঁকা যায় না,ছবি আঁকা হয় স্মৃতির পাতা থেকে।একজন শিল্পী,ছবির পাতায় সবসময়ই একা,তখন স্মৃতিই তার একমাত্র সঙ্গী।এখন আমাদের হাতে আর খুঁজে দেখার মত তেমন কিছু নাই,ফিরে যেতে হবে ঐ বাঈজী পদ্ধতিতে,হয়তো পাওয়া যাবে শিল্পীর লুকানো চিহ্ন’।
ওস্তাদ ওসমান আতস কাঁচ নিয়ে ছবিটা দেখছিল,যেন ম্যাপ থেকে গুপ্তধনের লুকানো জায়গাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

‘হ্যা,তবে আমার মনে হয়’,একজন প্রতিভাবান শিষ্যের মত মন্তব্য করলাম, ‘যদি ঘোড়ার জিনটার রং আর নক্সা,অন্যান্য ছবির সাথে তুলনা করে দেখা যায়,কোন একটা কিছু খুঁজে পাওয়া যেতেও পারে’।
‘ওস্তাদ শিল্পীরা কোনদিন এত নীচে নামবে না,যে এত নিম্নমানের নক্সা আকবে।ওগুলো ছাত্রদের কাজ পোশাক,কার্পেট,কম্বল ঐ সব।হতে পারে জায়িফ এফেন্দীর হাতে আঁকা,ওটা।
যাক ঐ সব কথা ভুলে যাও’।
‘ঘোড়ার কান দেখলে কেমন হয়’,বেশ উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘ঘোড়ার কান দেখে হয়তো কিছু বোঝা সম্ভব’।
‘না,ঘোড়ার কানের আঁকার চেহারা বদলায়নি সেই তৈমুর লং এর সময় থেকে,অনেকটা গাছের পাতার মত,এটা কে না জানে’?
আমার বলার ইচ্ছা ছিল, ‘ঘোড়ার ঘাড়ের কেশর,চুলের বিনুনীও দেখে কোন সুত্র পাওয়া সম্ভব’?কিন্ত কিছু বলিনি,শিষ্য হিসাবে আমার অবস্থানটা জানা উচিত।
‘এখানে দেখ’,ওস্তাদ ওসমান বললো,অনেকটা যেন একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার তার সহকর্মীকে একটা ক্ষতের বর্ননা দিয়ে দেখাচ্ছিল, ‘দেখতে পাচ্ছ’?

০০০০০০০০০০



(

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:১৪

বিজন রয় বলেছেন: আপনি কি সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন?

১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৪৮

ইল্লু বলেছেন: মাঝে মাঝে দু একটা বি পড়ি,এ টুকুই।ধন্যবাদ

২| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:২৭

রাজীব নুর বলেছেন: আজকের পর্বটা জব্বর হয়েছে।

১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৫০

ইল্লু বলেছেন: আপনার কথা বলায় নিজেকে ধাক্কা দেয়ার সুযোগ করে নেই।ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.