নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

৩০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১:০৬

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা

(৩১)
‘তুমি হয়তো ভাবছো এটা বানানো গল্প,না একেবারেই সত্যি একটা ঘটনা’,আমি বললাম, ‘তবে অবাক ঘটনা,শিল্পী শাহের মেয়েকে শিরিন হিসাবে আঁকেনি,বরং শাহজাদী সেখানে একজন বাঈজী যে বাশী বাজাচ্ছিল।কেন না ঐ শিল্পীর দায়িত্ব ছিল বাঈজীর ছবিটা আঁকার জন্যে।বাঈজীর সৌন্দর্যের কাছে শিরিনের সৌন্দর্য,চমৎকারিত্ব বেশ ম্লান হয়ে গেছে,আর তাতে ছবির বিষয়বস্তটা একেবারেই বদলে গেছে,বেশ একটা জগাখিচুড়ি।যেখানে সবকিছুর প্রাধান্য শিরিনকে নিয়ে,সেখানে বাঈজী হয়ে গেল মুখ্য চরিত্র,আর শিরিন হয়ে গেল গৌন।শাহ নিজের মেয়ের ছবি দেখে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল শিল্পীর পরিচয়।তবে দক্ষ শিল্পীর আগে ভাগে সবকিছু চিন্তা করে ছবি আঁকার কায়দাটা বদলে দেওয়ায়,যে বোঝার উপায় ছিল না ছবির কোন বিশেষত্ব,যাতে চেনা যায় শিল্পীকেমতা ছাড়া আরও কজন শিল্পীর তুলির ছোঁয়া ছিল ছবিটায়’।

‘তা হলে শাহ কি ভাবে খুঁজে বের করলো শিল্পীর পরিচয়টা,কে তার মেয়ের ছবি আঁকলো’?
‘কান দেখে’!
‘কার কান?ছবিতে শাহজাদীর কান দেখে’?
‘ঠিক সে ভাবে না।শাহ বইগুলো টেবিলে রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল ছবিগুলো,তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ও ভাবেই জানা যাবে শিল্পীর পরিচয়।শাহের বিশ্বাস ছিল,প্রতিটা শিল্পীই তাদের নিজেদের বিশেষ কায়দায় মানুষের কান আঁকে,কেন না কান নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না কেউ।মুখটা যারই হোক না কেন,সুলতানের বা কোন বাচ্চা ছেলের,হয়তো কোন যোদ্ধার,আর খোদা না খাস্তা কেউ যদি আমাদের পয়গম্বরের পর্দার আড়ালের মুখ আঁকে,বা শয়তানের চেহারাও আঁকে,তবে শিল্পীরা সব সময় কানটা আঁকতো তাদের নিজস্ব কায়দায়,ও ভাবেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব শিল্পীর পরিচয়।
‘কেন’?
‘ওস্তাদ শিল্পীরা কারও ছবি আঁকলে,মনোযোগ দেয় মুখের সৌন্দর্যে,ছবি আঁকা হতো হয়তো পুরোনো কোন ছবি দেখে তার ধাঁচে,বা কারও চেহারার সাথে মিলিয়ে।কিন্ত কান আঁকার সময় অতসব ভাবনা চিন্তা করতো না কেউ,নিজেদের তৈরী কোন এক ধাঁচেই কান আঁকতো শিল্পীরা’।
‘ওস্তাদ শিল্পীরা তো ঘোড়া,মানুষ,এমন কি গাছের ছবিও আঁকে তাদের স্মৃতি থেকে’,সিয়াহ (ব্ল্যাক)উত্তর দিল।
‘কথাটা ঠিকই’,আমি বললা, ‘কিন্ত স্মৃতি বলতে আমরা যা বুঝি,সেটা বছরের পর বছরের জড় হওয়া অভিজ্ঞতা।জীবন্ত ঘোড়া দেখতে দেখতে,তাদের ছবি আঁকতে আঁকতে,তারা তুলে ধরতে চায় নিখুঁত একটা ঘোড়ার ছবি,কিন্ত নিখুঁত ঘোড়া সেটাতো আল্লাহর সৃষ্টি।তা কি আর সম্ভব,হাজার হাজার বার ঘোড়ার ছবি আঁকতে আঁকতে তারা এক সময় পৌঁছায় তাদের নিখুঁত ঘোড়ার ছবিতে,আল্লাহর তৈরী নিখুঁত ঘোড়ার কাছাকাছি,তবে ঐ টুকুই।একই ভাবে শাহজাদীর ছবি আঁকতে গিয়ে শিল্পীর মনোযোগ ছিল মুখের দিকে,কানের দিকে খুব একটা নজর দেয়নি সেও।আর কানের এই রকমফের তো একেক শিল্পীর হাতে একেকরকম’।

বাইরে কেন জানি একটু হৈচৈ হচ্ছিল,প্রধান সুবাদার শিল্পীদের,কালিগ্রাফারদের বাড়ি থেকে,
তাদের সম্পূর্ন অসম্পুর্ন কাজ নিয়ে ফিরে গেছে সুলতানের প্রাসাদে।

‘এটা তো সবাই জানে,মানুষের কানই,শরীরের সব চেয়ে বড় খুঁত,কেন জানি একটা অসামঞ্জস্য আছে কোথাও কানের সাথে মুখের,মানুষের শরীরে কানই একটা কদর্য রুপ’,ভাবছিলাম কথাটা শুনে সিয়াহ(ব্ল্যাক)হয়তো হাসবে।

তবে না হেসে সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো,‘তা শেষমেষ কি হলো শিল্পীর,সে ধরা পড়লো কি ভাবে’?
আমি অবশ্য সত্যি কথাটা বললাম না, ‘তাকে অন্ধ করে দেয়া হলো’,যাতে সিয়াহ আরও ভঁয় না পেয়ে যায়,বরং বললাম,‘সে শাহের মেয়েকে বিয়ে করলো,আর এই যে ছবি আঁকার কায়দা এটা অনেক সুলতান,শাহের শিল্পীরা আজও ব্যাবহার করে যাচ্ছে,আর এই ছবি আঁকার কায়দাকেই বলে বাইজী পদ্ধতি।আর এটা একটা গোপন সূত্র,নিষিদ্ধ কোন ছবি আঁকা হলেও,সহজে না হলেও বের করা যায় শিল্পীর পরিচয়।শিল্পীর আঁকা কান,ঘাস,হাত,ঘোড়া,
ঘোড়ার পা,খুর,এগুলো একটু ভালমত পরখ করে দেখলেই জানা সম্ভব শিল্পীর পরিচয়।অবশ্য এটা ঠিক মোচ দেখে সেটা বোঝা যায় না,তবে চোখের ভুরু দিয়ে বলা যায় অনেক সময়।দেখ দেখি বলতে পার নাকি,এনিষ্টের বই এর কোন ছবিটা কার আঁকা’?

টেবিলে পাশাপাশি বই দুটো সাজালাম-একটা যেটা গোপনীয় ভাবে করা হচ্ছিল আরেকটা যেটা জানা ছিল সবার।বই দুটোর ছবির ধরণ সম্পুর্ন আলাদা,সালতানাতের আনুষ্ঠিনকতা নিয়ে যে বইটা সেটার দায়িত্ব আমার,শাহজাদার মুসলমানি ছিল সেই বই এর একটা অংশ।সিয়াহ(ব্ল্যাক)আর আমি,আমরা দুজনে আতস কাঁচ দিয়ে ছবিগুলো পরখ করছিলাম।

১)সুলতানের অনুষ্ঠানের বইটাতে একটা ছবি ছিল-একজন চামড়ার ব্যাবসায়ী লাল পোশাক,বেগুনী হাতটা, খোলা মুখ দাঁত বের করা চামড়াসহ অপূর্ব সুন্দর একটা শেয়ালের মাথা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সুলতানের সামনে দিয়ে সাথে আরও অন্যান্য ব্যাবসায়ীরা।কোন সন্দেহ নাই সুলতানের অনুষ্ঠানের শেয়ালের ছবিটা জেইতিন (জলপাই)এর তুলিতে আঁকা,আর এনিষ্টের ছবির শয়তানের দাঁত,যেটা অর্ধেক দানব আর অর্ধেক দৈত্য,দেখে মনে হয় সেটা সমরখন্দের কোন শিল্পীর হাতের কাজ।

২)এক অনুষ্ঠানে মরুভূমির তাঁবুতে সুলতান বসে আছে-হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে ছেঁড়া কাপড়ে সৈন্যরা (যদিও সেটা নাটকীয়তা ভাবে সাজানো),একজন সৈন্য সুলতানের কাছে অনুযোগ করছে,কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করতে তাদের বন্দী অবস্থার।
‘আমরা বেশীর ভাগ সবাই কোনরকম ভাবে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসলাম,কিন্ত আমাদের অনেক ভায়েরা এখনও কাফেরদের হাতে বন্দী হয়ে আছে।কাফেররা তাদের ছাড়ার জন্যে মোহর দাবী করছে,আমাদের অনেক চেষ্টার পরেও ইস্তাম্বুলে মুক্তির পন এখনও জোগাড় হয়নি,আর কাফেরদের হাতে যন্ত্রনা সহ্য করে যাচ্ছে আমাদের ভায়েরা।আমরা আপনার কাছে কিছু অনুদানের আশায় আছি আমাদের বন্ধুদের মুক্তির জন্যে-সোনা বা ক্রীতদাস,যেটাই হোক পণ হিসাবে ব্যাবহার করা সম্ভব’।
আলসে কুকুরটা একচোখে সুলতান,হতভাগা সৈন্য,পারস্য,তাতারের রাষ্ট্রদূতকে দেখছিল-তার নখগুলো আর এনিষ্টের ছবির কুকুরের নখ দুটোই লেইলেক(বক) এর তুলির ছোঁয়ায় আঁকা।

৩)বাজীকর কাঠের উপরে ডিম ঘুরাচ্ছে,আর মাঝে মাঝে ডিগবাজী দিচ্ছিল সুলতানের সামনে,জুতাছাড়া টাকমাথার একজন অন্ধ,সুলতানের লাল গালিচার কোনায় বসে খঞ্জনী বাজাচ্ছিল একই সময়ে।পেতলের থালা ধরে বসে ছিল একটা মেয়ে,এনিষ্টের বইটাতেঃনিঃসন্দেহে দুটাই জেইতিন(জলপাই)এর আঁকা।

৪)বাবুর্চিরা সুলতানের পাশ দিয়ে বাঁধাকপি মাংসের কিমা আর পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা খাবারের গাড়ী নিয়ে যাচ্ছে।প্রধান বাবুর্চির সাথে ছিল মাটির হাড়িতে গরুর মাংসের
তরকারী-হাড়িটা বসানো ছিল নীল একটা পাত্রে।এনিষ্টের বই এর গাঢ় নীল মাটিতে ভেসে যাওয়া আজরাইল,আর সুলতানের অনুষ্ঠানের ছবি দুটোই কেলেবেক(প্রজাপতি)এর আঁকা।

৫)তাতারের দূতরা খবর দিচ্ছে-পারস্যের সৈন্যরা জমায়েত হচ্ছে ওটোমান সাম্রাজ্য আক্রমন করার জন্যে,সুলতানের রাষ্ট্রদূতেরও একই সন্দেহ ছিল।তবে সুলতান একেবারেই দ্বিমত,তার্ বিশ্বাস পারস্যের শাহ তার ভাই এর মত,এটা সকলের বোঝার ভুল।এই ছবিতে যখন ধুলার ঝড়ে পানি দেয়ার জন্যে লোকজন ছুটে যাচ্ছিল-একদল বর্বর লোক সুলতানের রাষ্ট্রদূতের মাথায় মশক খুলে তিসির তেল ঢেলে দিচ্ছে।পানি আনতে যাওয়ার লোকদের পা,এমন কি তিসি তেল ঢেলে দেয়া লোকদের পা-আর এনিষ্টের ছবির ছুটে যাওয়া সৈন্যদের পা,দেখে যাচ্ছে এটা কেলেবেকের (প্রজাপতির) হাতের কাজ।

দেখলাম সিয়াহ(ব্ল্যাক)কোন একটা খেই বের করার চেষ্টা করছে,বাড়ীতে নতুন বৌ অপেক্ষা করছে,যত তাড়াতাড়ি সমাধান হয়।মনে মনে বললাম‘বেচারার সারাটা দিন কেটে গেল ঐ বাঈজী পদ্ধতিতে শিল্পীদের খুঁজে বের করতে,একপাশে এনিষ্টের বই এর ছবি,আরেক পাশে আমার সুলতানের অনুষ্ঠানের বই’।

সিয়াহ(ব্ল্যাক)র এনিষ্টের বই এর কথায় আসতে হয় এবার,তার বই এর কোন ছবিতেই শুধু একজন শিল্পী কাজ করেনি,প্রতিটা পাতায় ছিল কমপক্ষে জন তিনেক শিম্পীর তুলির ছোঁয়া।এটাতে বোঝাই যাচ্ছে ছবিগুলো কম ঘোরাঘুরি করেনি একহাত থেকে গেছে আরেকহাতে,এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে।তা ছাড়াও আমার চোখে পড়লো একজন নবীশ শিল্পীর তুলির ছোঁয়া,সন্দেহজনক মনে হলেও,সিয়াহ(ব্ল্যাক)র কাছে শুনলাম সেটা এনিষ্টের কাজ,অন্য কারও না।জারিফ(এলেগান্ট) এফেন্দীকে বাদ দিলে,মোটামুটি প্রতিটা বই এর পাতার অলঙ্কারের কাজটা সিয়াহর হাতের কাজ-এনিষ্টের বইটাতে তো ছিলই,ছিল সুলতানের অনুষ্ঠানের বইটাতেও।দেখলাম আমার তিন শিষ্য-জেইতিন(জলপাই),কেলেবেক
(প্রজাপতি),লেইলেক (বক) এর তুলির আঁচড় আছে প্রতিটা ছবিতে।তাদের প্রতিভা,দক্ষতা আর মেজাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম, খুনের সমাধান করতে গেলে কিছু একটা যোগাযোগ (খেই) খুঁজে বের করতে হবে,কথায় কথায় শুধু আমার নিজের কথা এসে যাচ্ছে,সব জায়াগায় তো আমিই জড়ানো।



জেইতিন(জলপাই)কে নিয়ে কিছু কথা

ওর নাম ছিল ভেলিজান।আমার দেয়া ডাক নাম ছাড়া ওর যদি আর অন্য কোন নাম থাকে জানা নাই সেটা,কোন ছবিতেই আমি ওকে নাম সই করতে দেখিনি।ও যখন আমার ছাত্র ছিল,মঙ্গলবার সকালে,সুলতানের ছবি আঁকার দপ্তরে আমার সাথেই ও যেত বাড়ী থেকে।প্রচন্ড অহংকার ছিল ওর,তাই আমার বিশ্বাস নিজেকে নাম সই করার পর্যায়ে ও নিয়ে যাবে না কোনদিন,কোন চিহ্নও লুকানো থাকবে না কোথাও,যাতে বোঝা যায় ছবিতে জেইতিনের তুলির ছোঁয়া।আল্লাহ নিঃসন্দেহে প্রতিভা,দক্ষতা কম দেয়নি জেইতিনকে,ছবি আঁকার এমন কিছু ছিল না যাতে ওর দক্ষতা ছিল না,স্কেচ আঁকা থেকে শুরু করে বই এর পা্তার অলঙ্কারে সাজানো,যেটাই বলা যাক।আমার শিল্পীদের মধ্যে মানুষের মুখ,গাছপালা,
জীবজন্ত আঁকার দক্ষতা,মনে হয় না তার চেয়ে বেশী আর কারও ছিল।ভেলিজানের বাবা তাকে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যায় যখন তার বয়স বছর দশেক,সে ছবি আঁকা শিখতো তাব্রিজের পারসী শাহের নামকরা শিল্পী সিয়াভুষের কাছে।তাদের বংশে অনেক নাম করা শিল্পীই ছিল যাদের সাথে ছিল মঙ্গোলিয়ার সাথে যোগাযোগ,আর অন্যান্য চীনা-মঙ্গোল শিল্পীরা তাদের বংশে যারা ১৫০ বছর আগে সমরখন্দ,বোখারা আর হেরাতে চলে আসে।চাঁদের মত গোল করে মুখটা আঁকতো তারা যেন সবাই চীন দেশ থেকে আসা লোকজন।তাকে শেখানোর সময়,এমন কি আমার সাথে কাজ করার সময়ও আমি তাকে ঐ গোয়াতুর্মি ভাব থেকে সরাতে পারিনি।আমার সবসময়ই ইচ্ছা ছিল,যদি কোনভাবে ঐ মঙ্গোল,চীনা ছবি আঁকার কায়দাগুলো তার মনের এক কোনে ঠেলে দিতে পারতাম,জেইতিনের প্রতিভা আরও ফুটে উঠতো।

আমি জিজ্ঞাসা করলেই তার উত্তরটা ছিল-ও সব পুরোনো নিয়ম কায়দা অনেক আগেই ভুলে গেছে সে।শিল্পীদের কাজের অনেক কিছুই ধরা থাকে তাদের মনের খাতায়-ভেলাজুন যদি ভুলে যেত তার স্মৃতির মুখগুলো সে নিঃসন্দেহে একজন নামকরা শিল্পী হতো।তবে ওস্তাদ শিল্পীদের কাছ থেকে শেখাটা তার মনের এক কোনে অজানা এক পাপের মত আটকে আছেঃ

১)প্রতিভাবান দক্ষ শিল্পীদের পুরোনো নিয়ম,কানুন অপরাধবোধ জেগে উঠে মনে আর তাদের নিজস্ব প্রতিভা সজাগ হয়ে দেখা দেয় তখন।

২)দুঃসময়ে কোন কষ্ট হয় না তাদের খুঁজে নিতে ভুলে যাওয়া পথটা।খুব সহজেই তারা যে কোন নতুন বিষয়,ইতিহাস,দৃশ্য যেটাই খুঁজে নিতে পারে হেরাতের শেখার পাতায়।জেইতিন
জানতো পুরোনো কায়দার সাথে শাহ তামাসাপের পুরোনো ওস্তাদদের পুরোনো পদ্ধতি মেশাতে।জেইতিন জানতো ইস্তাম্বুলের অলঙ্কার করার ষ্টাইল আর হেরাতের ছবি আঁকার কায়দাটাও।

একবার কয়েকজন শিল্পীদের নিয়ে তার বাসায় যখন গেলাম,ঘরের চারপাশটা ছিল একেবারেই অগোছালো,নোংরা,এখানে ওখানে রং,ব্রাশ ছড়ানো ছিটানো,ভাঁজ করা কাজের টেবিল,তবে বিব্রত হয়নি জেয়তিন তবুও,সে যেন অন্য কোন এক জগতের মানুষ।অন্যান্য আর দু চারজন শিল্পীর মত,দুটো রুপার মোহরের জন্যে বাইরের কাজ করা জন্যে ছুটে যাত না জেইতিন।সব কিছু শুনে সিয়াহ(ব্ল্যাক)বললো,এনিষ্টের ভেনিসের নতুন কায়দায় ছবি আঁকার জন্যে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ ছিল জেইতিন(জলপাই)এর।সিয়াহর কথা শুনে বুঝতে পারলাম এটা ঐ মৃত,বোকা,এনিষ্টের মন্তব্য।যদিও আমি একেবারেই জোর গলায় বলতে পারি না, জেইতিন হেরাতের কায়দা এত বেশী পচ্ছন্দ করতো সেটা অভাবনীয়-তার বাবার ওস্তাদ সিয়াভুস,সিয়াভুসের ওস্তাদ মুজাফফর থেকে তাদের যোগাযোগ একেবারে সেই ওস্তাদ বিহজাদের কাছে,তবে কে জানে হতেও পারে জেইতিনের লুকানো কোন ইচ্ছা থাকতে পারে ভেনিসের শিল্পীদের কায়দায় ছবি আঁকার জন্যে।আমার শিল্পীদের মধ্যে,ঐ তো ছিল সবচেয়ে চুপচাপ আর আবেগপ্রবন,আবার সবচেয়ে বেশী অপরাধী,বিশ্বাসঘাতক আর ধোকাবাজ।যখন সুবাদারের ঘরের অত্যাচারের কথা ভাবছিলাম,জেইতিনের কথাটাই আমার মনে ভাসছিল
(তাকে অত্যাচার করা,না করা দুটোতেই সম্মতি আছে আমার)।জেইতিনের চোখ দুটো ছিল জিনের মত খুব সহজেই মানুষের একেবারে ভেতরটা দেখে ফেলতো,এমন কি আমার ভুলটাও তুলে ধরতে দ্বিধা করেনি কখনও।বেশ চুপচাপ তবে নিঃসন্দেহে বেশ চালাক চতুর,তবে খুনী না(সিয়াহকে আমি এটা বলিনি যদিও),কাউকে বিশ্বাস করতো না জেইতিন।টাকাপয়সার প্রতি খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও খুব সবকিছুই জমা করে রাখতো সে।আসলে মানুষে যা আপাতদৃষ্টিতে যা বিশ্বাস করে তার উল্টোটাই সত্যি,সব খুনীরাই কিন্ত বিশ্বাসে অন্ধ মানুষ।বই লেখা থেকে ছবি আঁকা,আর ছবি আঁকা থেকে-আল্লাহ না করুক-আল্লাহর সাথে যুদ্ধে নামা।

সবাই এটা জানে,বিশ্বাস অবিশ্বাসের হিসাব না করে সহজেই বলা যায়,জেইতিন হলো একজন সত্যিকারের শিল্পী।এটাও বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে না,জেইতিনের আল্লাহর দেয়া প্রতিভার কাছে লেইলেক(বক),এমন কি কেলেবেকের(প্রজাপতির)প্রতিভার কোন তুলনা হয় না।আমার যদি একটা ছেলে থাকতো,আমি চাইতাম সে যেন জেইতিন এর মত হয়।জানি না কথাগুলো কি বললাম,সিয়াহের হিংসা বাড়ানোর জন্যে,অবশ্য কোন কথা না বলে সে বাচ্চা ছেলের মত আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।আমি বললাম,জেইতিন কালি কলম দিয়ে আঁকা ছবি,কোন জায়গায় যোদ্ধা,কোন সময় শিকারের দৃশ্য,চীনা পদ্ধতি আঁকা বাগান-বক আর রাজহাঁসে ভঁরা,গাছের নীচে বসে ছেলেদের বাশী বাজানো,কবিতা পড়ার দৃশয়,কিংবদন্তীর প্রেমিকদের দুঃখী চেহারা,রাগে পাগল শাহের তলোয়ার নিয়ে ছোটাছুটি,এমন কি ভঁয়ে চুপসে পড়া বীরের চেহারা,একেবারেই অতুলনীয়।

‘হয়তো এনিষ্টের ইচ্ছা ছিল জেইতিন আঁকবে শেষ ছবিটা,যেখানে থাকবে ইউরোপিয়ান
পদ্ধতিতে আমাদের সুলতানের চেহারা,এক অনন্য ছবি যা দেখে সবাই হতবাক হয়ে থাকবে’,সিয়াহ বললো।
সিয়াহ কি আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে?
‘ওটাই যদি সত্যি হয়,তা হলে যে ছবিটা জেইতিনের নিজের আঁকা,সে ছবিটাই সে চুরি করে নিয়ে যাবে কেন’?আমি বললাম, ‘আবার ভেবে দেখ,এনিষ্টেকে সে খুনই বা করবে কেন,ঐ ছবিটার জন্যে’?
আমরা দুজনেই নানান চিন্তা ভাবনা ছোটাছুটি করছিলাম,তবে কোন সমাধান ছিল না কোথাও।
‘ঐ ছবিটাতে তো কিছুই ছিল না’,সিয়াহ বললো, ‘হয়তো এমনও… ভঁয় পেয়ে গেছে সে ছবিটা আঁকার পর।এমনও হতে পারে এনিষ্টেকে খুন করার পর আরও কিছু ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে সে,,ছবিটা ও ভাবে চুপ করে আনার জন্যে বেসামাল হয়ে গেছে কিছু।
আমি জানি জেইতিন একজন প্রতিভাবান শিল্পী,যে জানে শিল্পের মর্যাদাটা,তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না’।
আমি বেশ রেগেই বললাম, ‘আমরা তো আলোচনা করলামই জেইতিনের প্রতিভা নিয়ে।তবে এটুকু বলতে পারি এনিষ্টের বই এর কোন ছবিই তেমন একটা মুগ্ধ করার মত না’।
‘আমরা শেষ ছবিটা এখনও দেখিনি’,একটু জোর গলায় বললো সিয়াহ।


কেলেবেককে(প্রজাপতি)নিয়ে কটা কথা

অনেকের কাছে ও বারুদের কারখানার হাসান চেলেবী হিসাবে পরিচিত,কিন্ত আমার কাছে ও সবসময় কেলেবেক(প্রজাপতি)।ঐ নামটা উচ্চারন আমার চোখে ভেসে আসে ওর ছেলেবেলার চেহারাটা-দেখতে শুনতে অদ্ভুত সুন্দর ছিল সে,যেন বেহেশত থেকে নেমে আসা কোন ফেরেশতা।আমি অবাক হতাম কেলেবেকের সৌন্দর্যের সাথে সাথে তার প্রতিভার প্রাচুর্যতা দেখে।রং ব্যাবহার করায় তার দক্ষতা ছিল অবিশ্বাস্য-আর তার সবচেয়ে বড় গুন ছিল যা কিছু আঁকতো সে,রং এর সৌন্দর্যে সেটা হয়ে উঠতো বিশেষ কিছু একটা,যা কখনঅ চোখে পড়েনি আগে।
সিয়াহকে বললাম,এটাও ঠিক কেলেবেক ছিল উদ্দেশ্যবিহীন দিকবিদিকে ছুটে বেড়ানো লক্ষ্যহীন,একটা মানুষ।আর এটাও বললাম,কেলেবেক হলো এমন একজন শিল্পী যার যে কোন আঁকা ছবিতেই ছড়ানো আছে তুলির সাথে সাথে তার মনের মাধুর্যতা।বই এর পাতার অলঙ্কার,বুদ্ধিজ্ঞানকে নাড়া না দিয়ে শুধু চোখের সন্তষ্টির জন্যে সুলতানের অহংকারকে দশগুন বাড়ানো,যদি শিল্প হয়,তা হলে কেলেবেক সেই আদর্শ শিল্পী।তার বাঁকানো রেখাগুলো যেন ইচ্ছামত কোন কিছু না ভেবেই টেনে দেয়া,মনে পড়ে বছর চল্লিশের পুরোনো কাজভিনের ওস্তাদদের কথাঃযে বেশ গর্বের সাথে উজ্জল ফুটে ওঠা রংগুলো ঢেলে দেয়,সব সময় একটা গোপনীয় রহস্য আছে তার ছবিতে।কিন্ত আমার হাতেই তো সব কিছু শেখা কেলেবেকের,
কাজভিনের ঐ ওস্তাদদের কাছে না।হয়তো এ কারণেই আমি তাকে ভালবাসি আমার ছেলের মত-ছেলের চেয়েও বেশী,ওর প্রতি কোন রাগ নেই তবু আমার।
অন্যান্য আর সব শিষ্যদের মত কেলেবেককেও আমি ছোট বেলায় বেশ মারধর করিনি তা না,কখনও লাঠি,কখনও ব্রাশ দিয়ে,কিন্ত এ সব কথা বলার মানে এই না যে আমি তাকে শিল্পী হিসাবে অপচ্ছন্দ করি।আমি লেইলেক প্রায়ই পাঠি দিয়ে মারতাম,ওকেও কম সম্মান করি না।অনেকে ভাবে ওস্তাদদের মারপিঠে ছাত্রদের তেমন একটা উপকার হয় না,সাময়িক ভাবে বদভ্যাসগুলো লুকিয়ে থাকে শুধু।তবে আমি মনে করি বুঝেসুঝে মারধর করলে, পুরোনো খারাপ স্বভাবগুলো যদি ফিরেও আসে,তারা কোন ক্ষতি করে না,বরং সাহায্য করে।আমার মনে হয় ওকে মারধরে কম উপকার হয়নি,কেলেবেক নিঃসন্দেহে একজন সৎ,পরোপকারী মানুষ,একজন ভাল শিল্পী।

সাথে সাথেই আমি কেলেবেকের ছবির প্রশংসা করছিলামঃ ‘কেলেবেকের ছবির নিপুন দক্ষতা আঁকা দেখলেই বোঝা যায়,বেহেশতের ছবি যা নামকরা কবি মাসনাভীতে অবাক হয়ে ভাবছিল,শুধু আল্লাহর দেয়া প্রতিভা আর যথাযথ রং দিয়েই তুলে ধরা সম্ভব।ছবিটা দেখে আমি বুঝলাম কেলেবেকের দূর্বলতাটা কোথায়,সে জানে না সাময়িক বিশ্বাস হারানোর
কথা,জামির ভাষায় যা, ‘আত্মার অন্ধকার সময়টা’।একজন শিল্পীর মতই বেহেশতের আনন্দ,
সুখ তার সব জানা নিয়ে তুলে ধরতে সে দ্বিধা করেনি।আমাদের সৈন্যেদের দোপ্পিও কেল্লা দখল,হাঙ্গেরীর রাষ্ট্রদূতের সুলতানের পায়ে চুমু দেয়া,আমাদের পয়গম্বরের সশরীরে বেহেশতে যাওয়ার দৃশ্য,এ গুলো সবই সুখের দৃশ্য,কিন্ত কেলেবেকের তুলির ছোঁয়ায় ওগুলো সবই যেন যৌন সীৎকারে চীৎকার করা।
আমার বই এর মৃত্যুর অন্ধকার,সরকারী দপ্তরের দায়িত্ববোধ তুলে ধরার দরকার হলে, কেলেবেককে বলবো, ‘এঁকে দাও ছবিটা যে ভাবে তোমার মনে হয়’,পোশাক আষাক,গাছের পাতা,সমুদ্র,নিস্তব্ধ ভাবে অম্র হয়ে থাকবে বই এর পাতায়।অনেক সময় আমি ভাবি আল্লাহর ইচ্ছাই যেন কেলেবেকের তুলির ছোঁয়ায় দৃশ্যগুলো তুলে ধরা হয়।ওটা এমন একটা জগৎ যেখানে রং গজলের মত সুর করে সবকিছু ছড়িয়ে মুগ্ধ করে রাখে চারপাশ,সময় থমকে থাকে ওখানে,শয়তানের কোন জায়গা নাই সেখানে’।

এটা ঠিক যে কেলেবেক জানে,এ ছবিগুলো তবুও অসম্পূর্ন।তাকে নিশ্চয় কেউ মন্তব্য করেছে-আর যাই থাকুক তার ছবিতে ছিল গভীরতার অভাব।শাহজাদারা,বুড়ী হারেমের মহিলারা তার ছবি অবাক হয়ে দেখে,শয়তানের সাথে যুদ্ধ করা মানুষেরা না।কেলেবেকের জানা আছে এই সমালোচনা-অনেক সময় সে হিংসা করে তার চেয়ে কম প্রতিভাবান শিল্পীদের আটকে আছে তাদের খারাপ স্বভাবে,তবুও তাদের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ।তবে কেলেবেক যা খারাপ স্বভাব,শয়তানের কাজ মনে করে আসলে সেটা শুধু শিল্পীর সরলতা।

এটা ভেবে আমার বেশ খারাপ লাগে,কেলেবেক যখন ছবি আঁকে,সে হারায় না ছবি আঁকার পৃথিবীতে,হারায় হারেমের সৌন্দর্যের রাজ্যে,ছবি আঁকার একটাই কারণ ছিল তার কাছে তা যেন মানুষকে মনমুগ্ধ করে।যা আরও আমাকে বিচলিত করতো ছবি আঁকার সময়, ও সব সময় ভাবতো কত টাকা আসবে তার কাছে,যদিও জীবনে সেটা আরেকটা বড় প্রয়োজনীয়তা।অনেক শিল্পী আছে যাদের প্রতিভা কেলেবেকের ধারে কাছেও না,কিন্ত তাদের ছবি আঁকায় আলাদা একটা সৌন্দর্য ছিল যা সম্ভব শুধু আত্মমগ্ন সম্পুর্নভাবে তাদের কাজে।

অভাবটা প্রমান করার জন্যে কেলেবেক সব সময় ভাব দেখায় সে ডুবে আছে তার কাজে। জ্ঞান বুদ্ধিহীন শিল্পীরা যারা নখ,ছোট্ট চালের কনায় ছবি আঁকে যা খালি চোখে বোঝাই যায় না,কেলেবেক ব্যাস্ত থাকে ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে।একবার আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আল্লাহর দেয়া প্রতিভায় তার আকাঙ্খা কি অনেক বেশী,অনেক সময় অনেক প্রতিভাবান শিল্পীই ধ্বংস হয়ে যায় ও ভাবে।অযোগ্য,দক্ষতা ছাড়া শিল্পীরাই চালের কনায় আর নখে ছবি আকে,সস্তা নাম করার জন্যে,কেলেবেককে সেটা মানায় না।

০০০০০০০০০


(

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:১১

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।

২| ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:০৪

ইল্লু বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.