নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(২৭) আমাকে সবাই ডাকে সিয়াহ নামে
ঘরের দরজা বন্ধ করে সেকুরে ছেলেদের সাথে বসে ছিল,বাইরের বাতাসের কান্না আর আঙ্গিনার দরজা খোলা বন্ধ হওয়ার শব্দ বেশ করছিল তাকে,তবে কিইবা করার আছে।সেভকেত একেক সময় ঘুরে ঘুরে মাকে এটা ওটা প্রশ্ন করছিল, সেকুরে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে থাকতে্ বলছিল।আঙ্গিনার কূয়ার পাশ থেকে একটা শব্দ যেন ছুটে গিয়ে এক সময় থেমে গেল,ছাদের কটা শঙ্খচিলের চীৎকার সেটাও থেমে গেল,তারপর বেশ একটা নিস্তবদ্ধতা।তারপর আরম্ভ হলো বারান্দার একপাশ থেকে ফোপানো কান্নার শব্দ,হয়তো হাইরিয়ের ঘুমের অজান্তে কান্না।কান্নাটা একসময় থেমে গেল,আরম্ভ জোরে জোরে কাশি,আবার চারপাশটা চুপচাপ,সেই বরফের শীতল নিস্তব্ধতা।কেউ একজন যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ীতে,ঘুরে বেড়াচ্ছে ঐ ঘরটাতে যেখানে এনিষ্টে ঘুমিয়ে আছে চিরশান্তির রাজ্যে।
চুপচাপ আমি ছবির পাতাগুলো দেখছিলাম যেখানে, জেইতিন(জলপাই) ,সুপুরুষ কেলেবেক
(প্রজাপতি) আর ঐ খুন হয়ে যাওয়া শিল্পীর আবেগ,দক্ষতার সুরের ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে।কেন
জানি ইচ্ছা হচ্ছিল ছবিটার দিকে চীৎকার করে বলতে, ‘ইবলিশ’, না , ‘ওলুম(মৃত্যু) বললেই হয়তো ভাল হয়’, এনিষ্টে যে ভাবে মাঝে মাঝে বলতো,কিন্ত ভয়ে তখন আমার জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেছে,কিছু বলা তো দূরের কথা,গো গো ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেখানে।
ছবিগুলোর প্রভাবে আমি এতই মুগ্ধ হয়ে ছিলাম,হয়তো কোন কথা ছিল না বলার।কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল,নিঃসন্দেহে ছবিগুলোর সাথেই জড়ানো এনিষ্টের মৃত্যুর রহস্য,তবে অযথার ধারণায় কিইবা যায় আসে,তাই বেশ হতাশা আর নিরাশায় স্তব্ধ হয়ে ছিলাম।নানান অছিলায় যখন সেকুরের সাথে দেখা করতে আসতাময়,এনিষ্টের সাথে বসে গল্প শুনতে শুনতে ছবিগুলোকে তো আমি কম নাড়াচাড়া করিনি।সেকুরে তো এখন আমার আইনত স্ত্রী,এগুলো নিয়ে এত নাড়াচাড়া করার কি আছে?কেউ একজন যেন হঠাৎ আমাকে বললো, ‘সেকুরে তোমার বৌ!তাতে কি যায় আসে,সেকুরে তো তোমাকে ছাড়া বাচ্চা নিয়ে অন্য ঘরে আছে?ওর সাথে একই বিছানায় যাওয়ার সুযোগটা তো তোমার হয়নি?তা ছাড়া তুমি তো ভুলে যাওনি সেকুরের শর্তগুলো’? ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম,এই বুঝি ছুটে আসছে আমার সুন্দরী প্রেয়সী,
হতাশ হয়ে একসময় ছুটে গেলাম স্বপ্নের দেশে।
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙ্গলো হাইরিয়ের চীৎকারে,মোমবাতিদানী হাতে ছুটে গেলাম বারান্দার দিকে।ভাবলাম হাসান হয়তো লোকজন নিয়ে বাড়ীতে গোলমাল করার জন্যে এসে গেছে,তাড়াতাড়ি ছবিগুলো লুকিয়ে রাখলাম একপাশে।পরে বুঝতে পারলাম হাইরিয়ের চীৎকারটা সেকুরের কথামত যাতে পাড়াপড়শী,ছেলেরা সবাই যাতে জানতে পারে এনিষ্টের মৃত্যুর কথা।
বারান্দায় সেকুরের সাথে দেখা হলে,তাকে আদর করে জড়িয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
ছেলেরা হাইরিয়ের চীৎকার শুনে বারান্দায় হতবুদ্ধি হয়ে দাড়িয়ে ছিল,কি হলো প্রশ্ন ছিল তাদের চোখে মুখে। ‘তোমার নানা আর নাই,মারা গেছে তোমার নানা আর নাই’,কাঁদতে কাঁদতে সেকুরে বললো, ‘মনে রাখবে এখন কোন সময় ঐ ঘরে ঢুকবে না,নানাকে আল্লাহর কাছে পাঠানোর প্রস্ততি আছে’।
আমার কাছ থেকে সরে বাবার ঘরে গিয়ে সেকুরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদভহিল তখন,ছেলেদের হাত ধরে ঘরে নিয়ে বললাম, ‘ কাপড় বদলে নাও,ঠান্ডা লেগে যাবে’।
সেভকেত বললো, ‘নানা আজকে সকালে মারা যায় নি,মারা গেছে,গতকাল রাতে,আমি জানি’।
সেকুরের একটা চুল,আরবী শব্দ , ‘ভাভ’,এর মত বালিশে পড়ে ছিল,কম্বলে লুকানো তার শরীরের উত্তাপ ভেসে আসছিল আমার কাছে, শুনতে পাচ্ছিলাম হাইরিয়ে আর সেকুরের কান্না।সেকুরের চীৎকার করে কান্নার ভঙ্গীটা এমনই ছিল, জানা না থাকলে আমিও ভাবতাম এনিষ্টে মারা গেছে মৃত্য কিছুক্ষন আগে,আর সেকুরের উপরে কোন একটা জিনের ভর ছিল।
‘আমার খুব ভঁয় লাগছে’, অর্হান বললো,তার চাহনি দেখে মনে হচ্ছিল,কাঁদতে চায় অর্হান।
‘ভঁয় পাওয়ার কিছু নাই,তোমার মা কাঁদছে যাতে আশেপাশের লোক জানতে পারে তোমার নানার মরার খবর আর যথাযথ সম্মানও দেখাতে পারে’,আমি বললাম।
‘কে আসলো কি আসলো না তাতে কি যায় আসে’,সেভকেত উত্তর দিল
‘কেউ যদি আসে ,তাদের সাথে আমাদের দুঃখ কিছুটা ভাগ বাটোয়ারা করতে পারি,তা ছাড়া ওটা আমাদের ধর্মের নিয়ম’।
‘তুমিই কি আমার নানাকে খুন করলে’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো।
বেশ চীৎকার করেই বললাম, ‘যদি তোমার মাকে অযথা রাগাতে চাও,তাহলে আমার বলার কিছু নাই,তবে মারধর করলে আমার কাছ থেকে কোন সহানুভুতি আশা করো না’।
আমরা সৎ ছেলে, বাবার মত চীৎকার করে বাদানুবাদ করিনি,যেন দুজন বয়স্ক লোক নদীর স্রোতের পাশে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম।সেভকেতের সাথে কথা শেষ করে গেলাম সেকুরে আর হাইরিয়ের ঘরে।জানালাটা কোন ভাবেই খোলা যাচ্ছিল না,শেষ পর্যন্ত জোর করে খুলতে গিয়ে জানালাটা খুলে আঙ্গিনায় পড়ে গেল।বাতাস আর সূর্যের আলোয় ঘরটা ভঁরে গেল,সেকুরে আটকে থাকা কান্নার স্রোতে ভেসে গেছে তখন।
কান্না আর চীৎকারে আশেপাশের লোকজন সবাই জেনে গেছে এনিষ্টের মৃত্যুর কথা,সেকুরের কান্না দেখে আমিও আর থেমে থাকতে পারিন্ আমিও কাঁদছিলাম।জানিনা কান্নাটা ছিল কি এনিষ্টে কে হারানোর দূখে, নাকি ভঁয়ে কেউ যদি কোনভাবে আমাকে জড়িয়ে ফেলে এনিষ্টের খুনী হিসাবে।
সেকুরে চীৎকার করে বলছিল, ‘আমার বাবা নাই,আমার বাবা আর নাই’,আর আমার কান্না ছিল সেকুরের কান্নার প্রতিচ্ছবি তবে তার লুকানো ভাষাটা ছিল অন্য কিছু।ভাবছিলাম প্রতিবেশীরা যারা জানালার ফাঁক দিয়ে,দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে,না জানি কি ভাবছে তারা? ভাবছিলাম কখন যে হাসান লোকজন নিয়ে আমাকে খুনের অপবাদ দিয়ে হৈচৈ আরম্ভ করবে?
সেকুরে,আমি,হাইরিয়ে,কান্না আর চীৎকার করে জানান দিলাম ,এনিষ্টে এফেন্দী ছেড়ে গেছে এই পাপে ভঁরা পৃথীবি।সেকুরেকে জড়িয়ে চুমু খেলাম,খুঁজছিলাম আমার পুরোনো সেই কাজুবাদামের গাছটা,কিন্ত সবকিছু বদলে গেছে,কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই পুরোনো দেশটা,ওটা আর ফিরে আসবে না,হারিয়ে গেছে ভালবাসার স্বাদ,জীবনের সাধারণ ছবিতে।
ছেলেদেরকে নিয়ে লাশের কাছে,চীৎকার করে বললাম, ‘লা ইলাহা ইল্লাহা মাহমুদুর রাসুল্লাহ,আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আর মুহাম্মদ(রাঃ),তার প্রেরিত পুরুষ’,কথাগুলো আমরা বলছিলাম একজন মৃত্যুপথযাত্রী এনিষ্টেকে উদ্দেশ্য করে,তার লাশকে না।আমি চাই যে আমার এনিষ্টে যেন বেহেশতে যায়,তাই কথাগুলো তার ঠোঁটে সাজিয়ে দিচ্ছিলাম,যাতে ওপারের পাহারদারদের কাছে নিজের পরইছয় দিতে তার কোন অসুবিধা না হয়।
এক সময় মনে হলো কথাগুলো পৌঁছে গেছে এনিষ্টের ঠোঁটে,বেশ একটা স্বস্তি ছিল মনে তখন। বেহেশতের দিকে হাত তুলে সুরা ইয়াসিন পড়া আরম্ভ করলাম,সেকুরে কাপড় এনে এনিষ্টের চোখ,মুখ বেঁধে শরীরটাকে কাবা শরীফের দিকে দিয়ে,একটা পরিষ্কার সাদা কাপড় দিয়ে শরীরটা জড়িয়ে দিল।
ছেলেরা সবকিছু দাঁড়িয়ে দেখছিল, আমিও নির্বাক নতুন এক সংসারী মানুষ,ছেলে বৌ নিয়ে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করছি।এক সময় এনিষ্টের ছবি এক এক করে ব্যাগে নিয়ে লম্বা আল্লাখাল্লাতে পরে তাড়াতাড়ি বাড়ী ছেড়ে পালালাম।পাশের বাড়ীর বিধবা বুড়ী যে তার নাতিকে নিয়ে সেকুরের কান্নার কারণ দেখতে যাচ্ছিল ,তাকে যেন আমার চোখে পড়লোই না।
মসজিদের পাশের ছোট্ট ঘরটা ছিল মসজিদের ইমাম সাহেবের থাকার ঘর,মসজিদের বিশাল প্রাসাদের সৌন্দর্যের পাশে ছোট্ট একটা ইদুরের ঘর।অবশ্য ইমাম আর তার বৌ ধীরে ধীরে তাদের থাকার সুব্যাবস্থার জন্যে মসজিদের বেশ কিছুটা জায়গা ইমামের থাকার এলাকায় নিয়ে গেছে।মস দেখলাম ইমামেরা ছেলেরা দুটা লাওয়ারিশ কুকুরকে তাড়াতে ব্যাস্ত, আমি ইমামের সাথে আলাদা একটা ঘরে বসে আমাদের আলাপ আলোচনা আরম্ভ করলাম।
দেখলাম গতকাল তালাকের,বিয়ের মোহরের সময় ইমাম এফেন্দীকে না ডাকার জন্যে,ইমাম বেশ রেগেই ছিল,,একটু ভারিক্কী গলায় প্রশ্ন করলো ইমাম সাহেব, ‘তা কি করতে পারি আপনার জন্যে ’?
‘এনিষ্টে এফেন্দী আজকাল সকালে ইন্তেকাল করেছেন’।
‘আল্লাহ তার আত্মাকে শান্তি দিবেন,আল্লাহ তাকে অবশ্যই বেহেশত নাজিল করবেন’,অনেকটা দোয়া করার মত করেই কথাগুলো বলা ছিল ইমাম এফেন্দীর।‘আজ সকাল’,কথাটা জুড়ে দেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না,তবে নিজেক কেন জানি বেস নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল। ইমাম সাহেবের হাতে আরেকটা সোনার মোহর দিয়ে অনুরোধ করলাম আজানের আগে জানাজার প্রস্ততি করার জন্যে,আর তার ভাই যেন পাড়াপড়শী সকলের কাছে খবরটা পৌছে দেয়।
‘চিন্তা করবেন না,সব ব্যাবস্থাই হয়ে যাবে ঠিকমত,আমার ভায়ের এক বন্ধু যে খুব ভাল একটা দেখতে পায় না,আমরা দুজনে মিলে লাশের গোসল অন্যান্য যা কিছু কৃতকর্ম আছে সব সেরে ফেলবো’।এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে,একজন অন্ধলোক এনিষ্টের গোসল করাবে?আমি ইমাম সাহেবকে জানালাম আসরের নামাজের পর জানাজা হবে,অনেক গন্যমান্য লোক উপস্থিত থাকবে,এমন কি সুলতানের প্রাসাদ থেকেও লোকজন আসবে।অবশ্য আমি ইমাম সাহেবের সাথে এনিষ্টের শরীরের অবস্থা নিয়ে কোন কিছু আলোচনা করলাম না,সেটা উর্ধতন কর্মকর্তাদের আলোচনার ব্যাপার।
বই প্রকাশ করার বরাদ্দ খরচ সুলতানের খাজাঞ্চীর কাছে ছিল,বই করার দায়িত্ব যেহেতু এনিষ্টের হাতে ছিল,তার মৃত্যুর খবরটা প্রথমে সুলতানের খাজাঞ্চীকেই জানাতে হবে।সেটা খুব একটা সহজ কাজ না,তাই বাবার এক দূর সম্পর্কের ভাই এর সরনাপন্ন হতে হলো,চাচা সুলতানের দর্জিখানায় কাজ করতো,তাকে সালাম দিয়ে অনুরোধ করলাম,কোন ভাবে সুলতানের খাজাঞ্চীর সাথে দেখা করানোর একটা উপায় বের করতে। চাচা বয়স্ক কর্মচারীদের হাতে কাজের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে নিয়ে প্রাসাদের দিকে রওনা দিল। হাগিয়া সোফিয়ার পাশের শিল্পীদের কাজের জায়গাটা একপাশে ছেড়ে আমরা যাচ্ছিলাম প্রাসাদে,যাতে অন্যান্য শিল্পীদের হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে হয় ।
প্রাসাদের ঢোকার আঙ্গিনায় তখন বেশ হৈচৈ চলছে যাদিও সাধারণতঃ ও জায়গাটা বেশ চুপচাপই থাকে।অন্যান্য সময় সুলতানের কাছে আবেদন নিয়ে অভিযোগকারীরা সবাই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো,এমন কি দানশালার পাশে খাবার নেয়ার জন্যে গরীব দুঃখীরাও কেউ নাই,যেন হাহুতাশ শুনতে পাচ্ছিলাম হাসপাতাল এলাকার অসুস্থ লোকদের ঘর থেকে,শব্দ আসছিল ময়রার ঘর থেকে,আস্থাবল থেকে।বুঝলাম প্রাসাদের দ্বিতীয় গেট দিয়ে যাওয়ার ভঁয়ে মনটা নানান দিকে ছুটে নিয়ে গেছে।দ্বিতীয় গেটে ঢোকার পর কোনদিকে চোখ দেয়া সম্ভব ছিল না আর ,মনে হচ্ছিল গেটের প্রহরীরা জল্লাদের মত দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্ন করার জন্যে।হয়তো তাদের সবকিছুই বেখাপ্পা মনে হবে,আমি জানালার পর্দা নিয়ে যাচ্ছি চাচার সাথে।
প্রাসাদে ঢোকার পর চারপাশের নিস্তব্ধতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো আমাকে,শিরা উপশিরা ছিড়ে যেন রক্ত বের হয়ে আসবে।এনিষ্টে,অন্যান্যদের কাছে শোনা গল্পের সুলতানের প্রাসাদ সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিল।অবশ্য ঐ অভাবনীয় স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপভোগ করার মানসিকতা ছিল না আমার,আমি একজন সাধারণ কর্মচারী,আমার চোখের সামনে শক্তিশালী সুলতানের ক্ষমতা জ্বলজ্বল করছে,কিন্ত তার চেয়েও বড় সমস্যা এনিষ্টের মৃত্যু আর সুলতানের বই হিস্র দাঁত বের করে আমাকে পরিহাস করছিল।
ময়ুর নাচছিল পাখা মেলে, পানি খাওয়ার সোনার গ্লাস রাখা ছিল ফোয়ারার এক পাশে,
উজিরদের সিল্কের পোষাক (বাতাসের চুমুতে কোন সময় মাটির ছোঁয়া পায় না),উত্তেজনার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল আমার মন।কোন সন্দেহ ছিল না সুলতানের গোপন বইটা আমাকেই শেষ করতে হবে,আলখেল্লায় লুকানো ছবি নিয়ে অন্ধের মতই দর্জি চাচার পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছিলাম,চোখটা আটকে ছিল সুলতানের প্রাসাদে,মন ভঁরা ভঁয়ে, আনন্দ উচ্ছাস ছিল না আশেপাশে।
প্রাসাদের বিরাট এক দরজা দিয়ে প্রহরী আমাদেরকে নিয়ে গেল সুলতানের দরবারে,কেন জানি মনে হচ্ছিল জায়গাটা বেশ চেনা।সুলতানের বিশাল ঘরটার সামনে খাজাঞ্চীর জন্যে অপেক্ষা করছিল,ভেলভেটের পোষাক বানানোর দর্জি,হাতীর দাঁতের কারিগর।কেউ কেউ অপেক্ষা করছিল কাজ শেষ করা মজুরির জন্যে,আর কেউ বসে ছিল কাজের জিনিষপত্র কেনা পয়সার জন্যে,আবার কেউ অন্য কোন কাজের জন্য,আমরাও একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার কাতারে যোগ দিলাম।মাঝে মাঝে হিসাবের গরমিলের জন্যে খাজাঞ্চীর কেরানী গলার চীৎকার শোনা যাচ্ছিল,তবে বেশীর ভাগ কথাবার্তাই হচ্ছিল বেশ নীচু স্বরে।
আমাদের ডাক আসার পরে খাজাঞ্চীর ঘরে ঢুকে দেখলাম, কোনে শুধু একজন কেরানী আর কেউ নাই, তাকে বুঝিয়ে বললাম বিশেষ এক কাজের জন্য স্বয়ং খাজাঞ্চীর সাথে আমার দেখা করা দরকারঃএকটা বই এর কাজ নিয়ে যেটা সুলতানের আদেশ,সেটার সম্পূর্ন করার দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ আলাপ আলোচনা আছে।হাতের এনিষ্টের ছবিগুলো খাজাঞ্চীর কেরানীকে দেখালাম,ছবিগুলোর বিচিত্র আঁকার ধরণে অভিভুত হয়ে গেল কেরানী সাহেব।এনিষ্টের নাম,তার পদমর্যাদা,বলে তাকে জানালাম যে এই ছবিগুলোর কারণেই এনিষ্টে খুন হয়ে গেছে।বললাম, সুলতানের সাথে যোগাযোগ না করে ফিরে গেলে, নিঃসন্দেহে এনিষ্টের খুনে জড়িত শয়তানেরা কোন না কোন চক্রান্ত করে আমার কাঁধেই চাপাবে।
সবকিছু শোনার পর কেরানী খাজাঞ্চীকে জানাতে গেল,কিছুটা হাল্কা হয়ে গেছি তখন ,বুকের ভারী পাথরটা নেমে গেছে ।এনিষ্টে বলতো,খাজাঞ্চী কোন সময় সুলতানকে ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না,এমন কি নামাজের সময় সুলতানের জায়নামাজটার ও পেতে দেয়ার দায়িত্বটাও ছিল তার,
ভাবছিলাম খাজাঞ্চী কি দেখা করতে আসবে,নাকি অযথার এই যাত্রা?অবাক লাগছিল আমার জন্যে সুলতানের দরবারে কেউ একজন খবর পৌঁছে দিতে গেছে?
আমাদের সুলতান এখন কোথায়ঃহয়তো সমুদ্রের ধারে ছোট্ট কোন এলাকায়?এমনও হতে পারে,হয়তো সুলতান হারেমে,খাজাঞ্চীও কি আছে তার সাথে?তা হলে খাজাঞ্চীর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা কি আছে”চিন্তার ঝড়ে টালমাতাল হয়ে ভাবছিলাম না জানি কি হবে,সে সময় ডাক আসলো খাজাঞ্চীর সাথে দেখার জন্যে।শেষে খাজাঞ্চীর সাথে দেখা হচ্ছে জানতে পেরে এতই অভিভুত হয়ে গেলাম,যে ভঁয় পাওয়ার সময়টাও ছিল না।ভেলভেটের প্রধান দর্জি অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল ,ভেতরে ঢুকে ভঁয়ে হতবাক্ হয়ে গেলাম,কথা ছিল না মুখে।খাজাঞ্চী বসে ছিল,মাথায় সোনার কাজ করা পাগড়ী,যা উজিরে আযম(প্রধান মন্ত্রী) আর খাজাঞ্চী ছাড়া আর কার ও পরার নিয়ম নাইঃতা হলে সৌভাগ্য বা র্দূভাগ্যে আমি খাজাঞ্চীর সামনে দাড়িয়েছিলাম।খাজাঞ্চী টেবিলের আমার দেয়া ছবিগুলো দেখছিল,কিছুক্ষন আগে কেরানী যেটা রেখে গেছে।মনে হচ্ছিল ছবিগুলো যেন আমারই আঁকা,নিয়মমত আমি শ্রদ্ধায় খাজাঞ্চীর আলখেল্লার কোনায় চুমু খেলাম।‘আমি ভুল বুঝিনি,নাকি ভুল বুঝলাম,এনিষ্টে এফেন্দী নাকি মারা গেছে’?খাজাঞ্চী প্রশ্ন করলো।
মুখে কোন কথা ছিল না আমার,উত্তেজনায় নাকি অপরাধ বোধে ,জানি না -মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম।খাজাঞ্চীর কাছ থেকে কোন সহানুভুতির কথা শোনার আগেই ক ফোঁটা কান্না নেমে গেল গালে।অভিভুত হয়ে গেছি সুলতানের খাজাঞ্চীর সহানুভুতিতে।
‘কাঁদ,প্রান ভঁরে কাঁদ,মনটা হাল্কা করে নাও’।
ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম,বার বছরে দেশেবিদেশ ঘুরে কম অভিজ্ঞতা কম হয়নি,যদিও ছোট্ট ছেলেটা না আমি,তবুও বার বছরের আটকে থাকা আবেগে ভেসে গেলাম।থালা বাসনের কারিগর,
ভেলভেটের দর্জি কি কে ভাবছিল তা নিয়ে কোন চিন্তা করিনি,খাজাঞ্চীকে পুরো ঘটনাটা সাজিয়ে বলতে হবে।
,যা যা মনে ছিল,সব কিছুই গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম,এক এক করে ফিরে গেলাম পুরোনোয়,এনিষ্টের মৃত্যু,সেকুরে আমার বিয়ে,হাসানের ধমক,এনিষ্টের ছবিগুলোর লুকানো রহস্য,কোনকিছু যেন না বাদ পড়ে।সবকিছু বলার পর বুঝতে পারলাম,ফাঁদটা তৈরী হয়ে গেছে,সেটার থেকে একমাত্র রক্ষা পেতে পারি,মহামান্য সুলতানের কৃপায়।এমনও হতে পারে সুলতান হয়তো আমাকে জল্লাদের কাছে পাঠাবে,নাকি পাহারাদের হাতে ঠেলে দিবে।খাজাঞ্চী কি সব কথা মহামান্য সুলতানকে জানাবে?
‘একটুও দেরী না করে এনিষ্টে এফেন্দীর মৃত্যুর খবর এখনই শিল্পীদের সবাইকে জানাবে’,খাজাঞ্চী লোকজনকে ডেকে বললো, ‘আর হ্যা এটাও ঘোষনা করে দাও,সব শিল্পী,কালিওগ্রাফী শিল্পী,বই বাঁধাই এর লোকজন ,সবাই যেন তার জানাজায় উপস্থিত থাকে’।খাজাঞ্চী আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কোন আপত্তি থাকলে আমি নির্ভয়ে তাকে বলতে পারি।আমি এনিষ্টে এফেন্দী আর জারিফ(এলেগান্ট) এফেন্দীর খুনীদের খুঁজে য্থাযথ বিচারের কথাটা যোগ করতে ভুলিনি।
কিছুটা ইঙ্গিতে এটাও বললাম,যে সব বাসায় নাচগান হয় তাদেরকে ইরুজুমের হোজার শিষ্যরা খুঁজে খুঁজে ইচ্ছামত আক্রমন করে বেড়াচ্ছে তাদের হাতেই এনিষ্টে এফেন্দী আর জারিফ এফেন্দীর খুন হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশী।
খাজাঞ্চীর চোখে মুখে সন্দেহের আভাস দেখে,ভাষা বদলে বললাম,এমনও হতে পারেঃএনিষ্টের বই এর ছবি আঁকার মজুরি এত বেশী ছিল যে ছবি আঁকা নিয়ে শিল্পীদের মধ্যে ঝগড়াঝাটির ফলে,এনিষ্টে আর জারিফ(এলিগান্টের) খুন হলো।হতে পারে বই এর গোপনীয়তা রক্ষা করে নিয়েও শুরু এই রেষারেষি,টানাটানি,ঝগড়াঝাটি।কথাগুলো বলার সময় কেন জানি মনে হচ্ছিল,খাজাঞ্চী আমাকেই সন্দেহ করছে,আল্লাহ আমি তো চাই খুনী,অপরাধীর যেন যথাযথ শাস্তি হয়।দেখলাম খাজাঞ্চী টেবিলে রাখা ছবিগুলো ঘুরে ফিরে দেখছে বারে বারে।‘এখানে নয়টা ছবি আছে’,খাজাঞ্চী প্রশ্ন করলো, ‘যতদূর জানি বইটার জন্যে দশটা ছবি ছিল।এনিষ্টে এফেন্দী যতটুকু সোনা নিয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে যতটুকু সোনা নিয়ে গেছে তার সব তো এই ছবিগুলোতে নাই’।
‘ঐ খুনী ধর্মান্ধ পাষন্ডের দল হয়তো চুরি করে নিয়ে গেছে আরেকটা ছবি,ওটাতেই সব চেয়ে বেশী সোনার পাতা লাগানো ছিল,মনে হয়’,আমি বললাম।
‘কালিগ্রাফী,লেখার দায়িত্বটা কার হাতে ছিল’?
‘এনিষ্টে এফেন্দী বইটা শেষ করতে পারেনি,আমার সাথে আলাপ আলোচনা করছিল বইটা শেষ করার জন্যে’।
‘খুব ভাল কথা,তোমার ইস্তাম্বুলে আসার ঘটনা তো শুনলাম ’।
‘আমার আসার তিনদিন হলো, এর মধ্যেই এনিষ্টে মারা গেল’।
‘তুমি কি বলতে চাচ্ছ,এনিষ্টে এফেন্দী এক বছর ধরে কোন লেখার প্রস্ততি ছাড়াই শুধু ছবিগুলো এঁকে যাচ্ছে’?
‘ওটাই ঠিক কথা’।
‘তুমি কি জান বইটা কি নিয়ে লেখা হচ্ছে’?
‘মোটামুটি যা জানিঃমহামান্য সুলতানের ইচ্ছায় ইসলাম ধর্মের হাজার বছর পুর্তির ইতিহাস নিয়ে বইটা,যেখানে থাকবে মুসলমানদের বিজয়ের কীর্তিকাহিনী,বিজ্ঞান,শিক্ষা-মানব সভ্যতার প্রতি অবদান,যা কাফের,বিধর্মী ভেনিসের লোকজনকে ভঁয়ে টলমল করে দিবে।বইটার কেন্দ্র শক্তি আমাদের মহামান্য সুলতান আর তার রাজত্বের গল্পকথাকে ভিত্তি করেই অন্যান্য কীর্তিকাহিনী লেখা হবে। যেহেতু ছবিগুলো আঁকা পশ্চিমা নতুন পদ্ধতিতে সেখানেও দেখা যাবে আমাদের শিল্পীদের দক্ষতা আর পর্যবেক্ষনের চোখ’।
‘কিন্ত আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,এই গাছ,কুকুরের ছবি দিয়ে কি ভাবে বোঝা যাবে আমাদের সুলতানের ক্ষমতা,তার মহত্ব?কি ভাবে বোঝা যাবে ওসমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা,প্রতিপত্তি ’?
‘এনিষ্টে,আল্লাহ তাকে বেহেশত নাজিল করুক-তার মতে বই, ছবিগুলোতে শুধু সুলতানের প্রতিপত্তি ক্ষমতা তুলে ধরছে না,সেখানে আছে তার ধর্মীয়,আধাত্মিক সুরের প্রকাশ’।
‘আর আমাদের সুলতানের ছবি’?
‘আমি সেটা দেখিনি,দেখার সূযোগ হয়নি আমার।হয়তো ঐ ধর্মান্ধ পাষন্ডদের হাতে ছবিটা ’।
সম্মানিত এনিষ্টের খ্যাতি নিশ্চয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়নি,সুলতানের খাজাঞ্চীও তার সমালোচনা করে বলছে, ‘ কতগুলো ফালতু আঁকা ছবি,আর সুলতানের দেয়া সোনা অযথাই পানিতে গেছে’।কে জানে খাজাঞ্চী ভাবছে নাকি,সেকুরেকে বিয়ে করার জন্যে বা অন্য কোন কারণে এনিষ্টেকে খুন করে সোনার পাতাগুলো আমিই নিজের আনন্দের জন্যে বিক্রি করেছি।আমার আবেদন কি কোন জায়গায় পৌঁছায় নি,সবকিছুই কি ব্যার্থতায় গেল নাকি,শেষ বারের মত খাজাঞ্চীকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।এনিষ্টে এফেন্দীর জারিফ(এলেগান্ট) এফেন্দীর খুন হওয়ার মতামতটা বলছিলাম খাজাঞ্চীকে, বললাম,এনিষ্টে এফেন্দীর মতে জারিফ এফেন্দীকে, কেলেবেক (প্রজাপতি),
জেয়তিন(জলপাই) না হয় লেইলেক(বক) তিনজনের মধ্যে কেউ একজন নির্মম ভাবে খুন করেছে।
অবশ্য ওটা শোনা কথা আর আত্মবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই না,কেন না কোন সাক্ষী নাই এ ঘটনায়।
মনে হচ্ছিল খাজাঞ্চী ভাবছে আমি গুজব ছড়ানো একজন ভন্ড ছাড়া আর কিছু না,তবে আনন্দে অবাক হলাম যখন খাজাঞ্চী আদেশ করলো,এনিষ্টের মৃত্যুর বিস্তারিত ঘটনা কোনভাবেই যেন জানাজানি না হয়।মনে হলো,আমার কথাগুলো শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করছে খাজাঞ্চী।ছবিগুলো খাজাঞ্চীর কাছে রেখে আমি অভ্যর্থনার গেট ছেড়ে বের হলাম-যাওয়ার সময় যা মনে হচ্ছিল মরলোকে ঢোকার পর বের হয়ে জীবন্তের দেশে ফিরে যাচ্ছি।বেশ হাল্কা আমি তখন-অনেকটা যেন বছরের পর বছরের যুদ্ধ করে ফিরে আসা এক সৈনিক।
০০০০০০০০০০
২| ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ রাত ২:২৯
ইল্লু বলেছেন: চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১:৪৩
রাজীব নুর বলেছেন: আপনার উচিত অন্যের লেখা পড়া ও মন্তব্য করা।