নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১৯ শে অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১:৩৮

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা

(২৬)


হয়তো সিয়াহর কথা ভেবে বাবার আত্মা খুবই অস্বস্তিতে আছে,এই বিয়েটায় তো বাবার মত ছিল না কোন সময়।বাবার আত্মা কি সিয়াহর কোন ক্ষতি করতে পারে?সিয়াহ এখন কোথায়?অবাক হয়ে দেখলাম সিয়াহ বাইরে দাড়িয়ে আছে,আর কেউ একজন গাছে বসে তার সাথে কথা বলছে।যে ঘর্ঘর শব্দটা কানে আসছিল,সেটা ঐ মানুষটার কাছ থেকেই,
আমার মনে হয় ওটা হাসান।হাসানের কথায় ছিল অদ্ভুত এক যন্ত্রনা আর কান্নার সুর,তবুও ধমক লুকানো ছিল কোথাও।দূর থেকে ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো,
দুজনের সাথে তর্ক বিতর্ক চলছে।

এই পৃথিবীতে ছেলেদের নিয়ে আমি বড়ই একা।আমি সিয়াহকে ভালবাসি,কিন্ত হাসানের গলার সুর শুনে মনটা কেমন জানি আবার নাড়া দিয়ে উঠলো।
‘কালকে আমি সাক্ষী,হাকিম আর লোকজন নিয়ে আসবো,যারা জানে আমার ভাই এখনও বেঁচে আছে আর পারস্যের পাহাড়ে যুদ্ধ করছে’,হাসান বললো, ‘তোমার বিয়ে বেআইনী এটা জান?তুমি অন্য একজনের বৌ এর সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়াচ্ছ,তার শাস্তি তোমার জানা আছে তো’?
‘সেকুরে,তোমার বৌ না,তোমার ভাই এর বৌ’,সিয়াহ বললো।
‘আমার বড় ভাই এখনও বেঁচে আছে’,বেশ জোর গলায় বললো হাসান, ‘আমার কাছে সাক্ষী আছে যারা কদিন আগেই আমার ভাই এর সাথে দেখা করে আসলো’।
‘চার চারটা বছর ধরে তোমার ভাই এর কোন খোঁজখবর না থাকার জন্যেই,হাকিম সেকুরের তালাকনামা মঞ্জুর করলো।তোমার ভাই যদি বেঁচে আছে,তা হলে ঐ সাক্ষীদেরকে বলে দাও তোমার ভাইকে জানাতে,তার তালাক হয়ে গেছে’।
‘সেকুরে একমাস বিয়ে করতে পারে না,সেটা জান নিশ্চয়’?হাসান বললো, ‘না হলে ওটা পবিত্র কোরানের বিরুদ্ধে,আমাদের ধর্ম বিরোধী কাজ হবে।কি ভাবে সেকুরের বাবা এ ধরণের একটা অসামাজিক কাজে রাজী হলো’?
‘এনিষ্টে এফেন্দী’,সিয়াহ বলল, ‘খুবই অসুস্থ।বলা যায় প্রায় তার মৃত্যু সজ্জায়...এজন্যেই কাজী আমাদের বিয়ে মঞ্জুর করলো’।
‘তোমরা দুজনে বিয়ে করার জন্যে,এনিষ্টেকে বিষ খাইয়ে মারলে নাকি কে জানে’?হাসান বললো, ‘জানি হাইরিয়ে আছে এই চক্রান্তে’?
‘আমার শ্বশুর সেকুরের সাথে তোমার ব্যাবহারে খুবই বিচলিত,মনে হয় সেটা তোমার জানাই আছে?এমন কি তোমার ভাই যদি বেঁচে থাকে তারও সহ্য হবে না,তোমার হাতে সেকুরের অসম্মানের কথা’।
‘ওগুলো সব বানোয়াট কথা’,হাসান বললো, ‘সব সেকুরের বানানো,সংসার ফেলে প্রেমিকের সাথে পালানোর জন্যে বানোয়াট গল্প’।

ঠিক সে সময় বাড়ীর ভেতর থেকে হাইরিয়ের চীৎকার শোনা যাচ্ছিল,সাথে সেভকেতের চীৎকার।দুজনে দুজনের সাথে চীৎকার করে ঝগড়া করছে,আমি দৌড়ে বাড়ীর ভেতরে গেলাম,জানি না কি যে সব হচ্ছে?সেভকেত আঙ্গিনায় ছুটে গেছে তখন।
‘নানা,বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে’,সেভকেত বললো, ‘নানা আর বেঁচে নাই,মারা গেছে নানা’।
আমি সেভকেতকে জড়িয়ে ধরলাম,হাইরিয়ে তখনও চীৎকার করছিল।সিয়াহ আর হাসানের ঐ চীৎকার,কথাবার্তা শুনতে কোন কষ্ট হওয়ার কথা না।
‘মা,ওরা নানাকে মেরে ফেললো’,সেভকেত বললো।
সবাই শুনতে পেল কথাটা।হাসান কি শুনলো কিছু?কোন কথা না বলে,আমি সেভকেতকে সাথে নিয়ে ভেতরে গেলাম।হাইরিয়ে তখনও সিড়িতে বসে ভাবছে,কি ভাবে সেভকেত ঘরের বাইরে গেল।
‘তুমি বললে,আমাদের ছেড়ে বাইরে যাবে না’,বলেই সেভকেত কান্না আরম্ভ করলো।
ভাবছিলাম সিয়াহর কথা,সিয়াহ হাসানের সাথে তখন বাদানুবাদে ব্যাস্ত,এমন কি বাড়ীর গেটটাও বন্ধ করেনি।সেভকেতকে চুমু দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলাম,আর হাইরিয়েকে বললাম,‘ওকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যাও’।
ওরা উপরে চলে গেল,আমি একপাশে দাড়িয়েছিলাম,হাসান হয়তো আমাকে দেখতে পায়নি।ঠিক বুঝতে পারলাম না,হাসান কি অন্ধকারে অন্য দিকে সরে গেল,নাকি নিজেকে আড়াল করে নিয়ে গেল গাছের দিকে?তবে বুঝতে পারলাম হাসান আমাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে,কেন না আমাকে উদ্দেশ্য করে যে ভাবে কথা বললো।চেহারা দেখা না গেলে,যে কারও কথা রহস্যময়,ভঁয়ের হয়ে দাঁড়ায়।ভঁয় হচ্ছিল তার মিথ্যা অপবাদ নিয়ে,কেন না আমরা যে পরিস্থিতিতে ছিলাম,তাতে বিপদ ছুটে আসতে খুব একটা সময় লাগবে না।বাবা,হাসান,ওদের কাছে আমি সবসময় সব ব্যাপারেই দোষী।
মনটা দুঃখে ভঁরা যে ঐ অপবাদ দেয়া লোকটার প্রতি আমার বেশ দূর্বলতা ছিল একসময়, হয়তো ভালবাসতাম লোকটাকে,আল্লাহ,আমাকে সাহায্য কর।হাসান অপবাদ দিচ্ছিল চক্রান্ত করে বাবা,সিয়াহ আর আমার হাতে খুন হয়ে গেছে।এটাও বললো হাসান,সেভকেত কিছুক্ষন আগে বলে গেল এই প্রচন্ড শীতে বাবা নাকি খালি গায়ে শুয়ে আছে,বাবাকে মারার জন্যে নানান ব্যাবস্থা করতে আমরা কোন কার্পন্য করিনি।হাসান এটাও বললো,তার কোন সন্দেহ নাই বুড়ো বাবার সাথে এ ভাবে ব্যাবহার করার জন্য,দোজখেও জায়গা হবে না আমাদের।
হাসান বেশ জোর দিয়ে বললো,সকালে সে হাকিমের কাছে নালিশ করবে,আমি যদি খুনী না হই,ছেলেদের সাথে আমাকে তাদের বাড়ীতে তার বড় ভাই ফিরে না আসা তত্বাবধান করবে।আর আমি যদি দোষী সাব্যস্ত তবে আইনমত যা শাস্তি প্রাপ্য,সেটার জন্যেই সে সুপারিশ করবে।
‘তবে তুমি যদি নিজের ইচ্ছায় তোমার আসল স্বামীর বাড়ীতে ফিরে যাও’,হাসানের গলার স্বর কিছুটা নরম তখন, ‘কোন হৈচৈ না করে ফিরে যাও,তাহলে আমি এসব বিয়ের নাটক্ খেলার কথা ভুলে যাব।তোমাদের ঐ সব অপকর্ম নিয়েও কোন কিছু বলবো না,আর সেকুরে,বড় ভাই এর জন্যে অপেক্ষা করবো,তারপর যা সিদ্ধান্ত হবে সেটাই হবে’।
হাসান কি মাতাল হয়ে আছে নাকি?ওর ভাবভঙ্গী আমার স্বামী সিয়াহর সামনে এতই জঘন্য,অবিশ্বাস্য ছিল যে সেটা যে কোন লোকের কাছেই অসহনীয় হবে।
‘আমার কথা বুঝতে নিশ্চয় কোন অসুবিধা হচ্ছে না,অসুবিধা হওয়ার কথা না’,গাছের কোন এক ফাঁক দিয়ে হাসান বললো।অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না হাসান কোথায় লুকিয়ে আছে,আল্লাহ এই বিপদে তোমার পাপী বান্দাদের সাহায্য কর।
‘সেকুরে আমি জানি,তুমি ঐ লোকটার সাথে জীবন কাটানোর কথা ভাবছো না, ঐ লোকটা তোমার বাবার খুনী,আমি জানি এটা তোমার সাময়িক ভুল’।
হাসানের ভাব ভঙ্গী দেখে সন্দেহ হচ্ছিল,হাসানই কি বাবাকে খুন করলো নাকি?আর এখন আমাদের সাথে ঠাট্টা করছে,হাসান হয়তো শয়তানের আরেক রুপ,জানি না কি যে ঠিক,কোন কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।
‘শোন হাসান এফেন্দী’,সিয়াহ চীৎকার করে বললো, ‘এটা সত্যি,আমার শ্বশুর কারও হাতে খুন হয়ে গেছে,নিঃসন্দেহে চরম জঘন্য কোন এক শয়তানের কাজ,সেটার তো যথাযথ বিচার হবেই’।
‘এনিষ্টের খুন হয়ে গেছে তোমাদের বিয়ের আগে,ঠিক কি না’?হাসান বললো,‘তোমরা দুজনে মিলে তাকে খুন করলে,এ বিয়েতে তার মত ছিল না বলে।এ সব মিথ্যা তালাক,
সাক্ষী সব কিছুর বিরুদ্ধে ছিল তোমার বাবা।সিয়াহকে তোমার বাবার পচ্ছন্দ হলে,
আগেই তার সাথে বিয়ে দিতে আপত্তি করতো না’।
আমার মৃত স্বামী,হাসান আমরা এক বাড়ীতেই থাকতাম,বলে মোটামুটি সব কিছুই জানতো হাসান।হতাশ প্রেমিকের মত,আমার স্বামীর অনেক কথাবার্তা সব কিছুই হয়তো মনে আছে হাসানের,যদিও আমি ভুলে গেছি।অনেকগুলো বছর হাসান,আমি,তার ভাই একসাথে ছিলাম,সেই পুরোনো আকাশে সিয়া ছিল অনেক দূরের একটা মানুষ।
‘আমরা ভাবছি,হয়তো তুমিই খুন করেছ,আমার শ্বশুরকে’,সিয়াহ বললো।
‘যতই যা বল,বিয়ে করার জন্যে তোমরা এনিষ্টে এফেন্দীকে খুন করতে লজ্জা করনি।আর আমার তো তাকে খুন করার কোন কারণ ছিল না’,হাসান বললো।
‘তোমার খুন করার বিরাট একটা কারণ যে কোনভাবে আমাদের বিয়ে ভন্ডুল করার চেষ্টা’,সিয়াহ বললো, ‘তুমি যখন শুনলে এনিষ্টে আমাদের বিয়ের জন্যে তালাক মঞ্জুর করার কথা বললো,তোমার মাথা ঠিক রাখতে পারনি,ঐ কথা শোনার পর,তুমি এনিষ্টে এফেন্দীকে খুন করে বসলে রাগের চোটে।প্রতিশোধ বা তোমার সুপ্ত লালসা পূরণ করার জন্যে এ ছাড়া আর উপায় ছিল না কোন।তুমি জানতে এনিষ্টে এফেন্দী বেঁচে থাকা অবস্থায়,সেকুরের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না’।
‘অনেক শুনলাম তোমার যুক্তি তর্ক’,হাসান বললো, ‘তবে এই গালগল্প শোনার আর সময় নাই,আমার।খুবই ঠান্ডা এখানে,আমি ঢিল ছুড়ে তোমার দৃষ্টি আর্কষনের চেষ্টা করছিলাম,আমার যা বলার বললাম’।
‘সিয়াহ,আমার বাবার আঁকা ছবি মগ্ন হয়ে দেখছিল’,আমি বললাম।
জানি না ওটা বলে ভুল করলাম কি,নাকি?
হাসান কথা বলছিল অনেক ভনিতা করে,অনেকটা আমি যে ভাবে বলতাম সিয়াহর সাথে, ‘সেকুরে তুমি আমার ভাই এর বৌ,তোমার জন্যে এটাই ভাল যে,ফিরে যাবে স্বামীর বাসায়,যে ভাবে বলা আছে আমাদের ধর্মে,কোরান শরীফে’।
‘বানিয়ে বানিয়ে যা তা বকছো কেন’,আমি ফিসফিস করে বললাম,‘আমি ঐ বাড়ীতে ফিরে যাচ্ছি না,হাসান।আমার ফিরে যাওয়ার কোন কারণ দেখছি না,আর’।
‘তাহলে আমাকে কাজ হলো,হাকিমের কাছে সকালে সবকিছু বিস্তারিত খুলে বলতে হবে।
তারপর হাকিমের দপ্তর থেকেই তোমাকে হাজির হতে বলবে,ওরাই বলে দিবে তোমাকে কি করতে হবে’।
‘হাকিম তোমাকে অবশ্যই ডেকে পাঠাবে’,সিয়াহ বললো, ‘যখনই তুমি হাকিমের কাছে যাবে,আমি হাকিমকে জানাবো,এনিষ্টেকে তুমিই খুন করেছ,আমাদের সুলতানের একজন খ্যাতনামা রাষ্ট্রদূত’।
‘খুব ভাল কথা’,হাসান বললো, ‘ তোমার যা ইচ্ছা,হাকিমকে বলতে পার,হাকিমের নিজের বিচার করার ক্ষমতা আছে’।
আমি বললাম, ‘তোমার উপর যা অত্যাচার হবে সেটা আমার চিন্তা ধারণের বাইরে,
তোমার হাকিমের কাছে যাওয়ার কোন দরকার নাই,একটু অপেক্ষা করলেই জানতে পারবে,সর্ম্পূণ ঘটনা,কি ব্যাপার’?
‘অত্যাচারের ভঁয় নাই,আমার’,হাসান বললো, ‘আমি তো এ ধরণের অত্যাচার বেশ কবার দেখলাম,আর জানি ও ভাবেই বোঝা যায় অপরাধী আর নির্দোষীর তফাৎ।যারা বানোয়াট কথা বলে তারাই ভঁয় করে অত্যাচার।আমি হাকিম,ইসলামের শেখ সবাইকে বলবো হতভাগা এনিষ্টে এফেন্দীর ঘটনা।তার বই,ছবির কথা।চারপাশে সবার মুখে ঐ একটাই আলোচনা বই এর ছবিগুলো নিয়ে।কিন্ত রহস্যটা বোধগম্য হচ্ছে না কোনভাবে?কি আছে ঐ ছবিগুলোতে’?
‘কি থাকবে,কিছুই নাই,শুধু ছবি,বই এর সাজানো কথার সাথে শিল্পীর তুলিতে আঁকা দৃশ্য’,সিয়াহ বললো।
‘তার মানে ছবিগুলো সব দেখা হয়ে গেছে,তোমার’।
‘তুমি জান কি না,এনিষ্টে এফেন্দীর ইচ্ছা ছিল,বইটা আমিই যেন শেষ করি’।
‘ঠিক আছে,আল্লাহর ইচ্ছা যদি তাই হয়,আমাদের দুজনকেই অত্যাচার করবে,হাকিম।করুক না,তাতে অন্ততঃ জানা যাবে খুনীটা কে,কে ঐ শয়তান’?
হাসান,সিয়াহ দুজনেই চুপ করে ছিল কিছুক্ষন।পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল আঙ্গিনায়,
ওরা কি চলে যাচ্ছে না,এদিকে আসছে?বলা যাচ্ছিল না,হাসান কি করছে?জঙ্গল,কাঁটা গাছের ফাঁক দিয়ে এদিকে আসা তার জন্যে বোকামীই হবে।ওদিক দিয়ে আসলে দেখা যাবে সবকিছুই,আমি একটু জোরে ডাক দিলাম, ‘হাসান’।
‘চুপ কর’সিয়াহ বললো।
দুজনেই ঠান্ডায় কাঁপছিলাম,দেরী না করে আঙ্গিনার গেটটা বন্ধ করে বাড়ীর ভেতরে ঢুকলাম।ছেলেদের সাথে গরম বিছানায় ঘুমানোর আগে,বাবাকে আবার দেখে আসলাম।
সিয়াহ আবার ছবিগুলোর সামনে বসে ছিল।


আমি একটা ঘোড়া

ভুলে যাও আমি এখানে একটা ছবি,প্রানহীন,স্থবিরঃযুগযুগ ধরে আমি তো ছুটে বেড়াচ্ছি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে।আমি ছিলাম না জানি কত যুদ্ধের মাঠে,রাস্তা মাটিতে আমার পিঠে লোকজন গেছে শাহদের মেয়েদের বিয়েতেঃআমি ছিলাম ইতিহাসের এক পাতা থেকে আরেক পাতায়,আমাকে পাবে এক কিংবদন্তী থেকে আরেক কিংবদন্তীতেঃআমাকে পাবে অনেক গল্পে,অনেক যুদ্ধে,আমার পিঠে পাবে কত নামকরা যোদ্ধাদের,ভালবাসায় অন্তপ্রান প্রেমিক প্রেমিকাদের,আমিই তো ছিলাম সুলতানের সাথে জয়ের পর জয়ের পর্বে,এ ভাবে ছবি থেকে ছবিতে আছি আমি,আমি আছি জীবন্ত এক সুরে।

অনেকে জিজ্ঞাসা করতে পারে,কেমন লাগে তোমার ছবিতে নিজেকে দেখতে?
নিঃসন্দেহে এটা আমার গর্বের বিষয়,একেক ছবিতে আমার একেক রুপ,তবে এটুকু বলতে পারি সব ছবিগুলো দেখলে,বুঝতে পারবে কেমন একটা একাত্মতা ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে,ঐ ছবিগুলোতে।আমার কজন শিল্পী বন্ধু কদিন আগে বেশ বাদানুবাদ করছিল,যা বুঝলামঃবিষয়টা ছিল ভেনিসের এক পুরোহিতের মেয়ের সাথে কাফেরদের রাজার বিয়ের কথাবার্তা।রাজা ভাবছিল পুরোহিতটা তো গরীব আর তার মেয়ে দেখতে যদি তেমন যদি সুন্দর না হয়?ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্যে রাজা তার দক্ষ শিল্পীদের ভেনিসের পুরোহিতের মেয়ের ছবি,বাড়ীঘর আসবাবপত্রসহ একটা ছবি আঁকতে পাঠালো।ভেনিসের শিল্পীরা নগ্নতা বা অশালীনতা নিয়ে কোন সময়ই তেমন একটা উদ্বিগ্ন ছিল নাঃভেনিসের শিল্পীরা শ্যেন দৃষ্টিতে শুধু মেয়েরা না,ঘোড়া বাড়ীঘর কোন কিছুই বাদ পড়েনি।শিল্পীর ছোঁয়ায় একগাদা লোকের মধ্যে চরিত্রগুলোকে খুঁজে নিতে কোন কষ্ট হবে না কারও।আর রাজ্যসভায় বসে কাফের রাজা যখন ভাবছিল মেয়েটাকে বিয়ে করা ঠিক হবে কি না,তার চোখ এড়ায়নি দাঁড়ানো ঘোড়াটার সৌন্দর্য।ছবিটা ছিল যেন হঠাৎ যৌন কাতর ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে ঘোটকীর দিকে্‌,আর শিল্পীরা তাকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছে।

অনেকে বলে,শুধু ঘোটকীর সৌন্দর্য না যা ঘোড়াকে উন্মাদ করেনি যৌনতা্‌য়,যদিও নিঃসন্দেহে তার সৌন্দর্য চোখ ছোয়া-তবে শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় সবকিছু আরও জীবন্ত হয়ে গেছে।এখন প্রশ্নটা হলোঃঘোটকীকে এত জীবন্ত আর সৌন্দর্যের সুরে তুলে ধরা সেটা কি অন্যায়?আমি মনে করি ছবি আর বাস্তবতার মধ্যে,বা একটা ঘোড়ার সাথে অন্য কোন ঘোড়ার তেমন একটা পার্থক্য নাই।

যারা আমার শরীরের মাঝের অংশ,পা আর ছুটে যাওয়ার গতির সৌন্দর্যে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে,তারা জানে আমি দেখতে কত সুন্দর।কিন্ত ঐ সৌন্দর্য শুধু শিল্পীর তুলে ধরা দক্ষতা আর অনুভুতির চমতকারিত্বে না,এটা আমার আল্লাহর দেয়া চমৎকারিত্ব।এটা তো জানাই আমার মত আর কোন ঘোড়া নাই,আমি সেই ঘোড়া যার জন্ম শিল্পীর স্বপ্নরাজ্যে।

আমাকে দেখে সবাই অবাক হয়ে বলে, ‘ও আল্লাহ কি সুন্দর তোমার এই সৃষ্টি,কি সুন্দর একটা ঘোড়া’।কিন্ত আসলে সবাই প্রশংসা করছে শিল্পীর,আমার না।প্রতিটা ঘোড়া তাদের নিজের সৌন্দর্যে বিশেষ হয়ে আছে,আর কেউ জানুক বা না জানুক শিল্পীরা সেটা জানেই।

খুব ভালভাবে পরখ করে দেখলে বোঝাই যায়,একটা ঘোড়ার সাথে আরেকটা ঘোড়ার কোন শারীরিক মিল নাই।কাছের থেকে ছবি হাতে নিয়ে দেখলে যে কেউ বলবেঃআল্লাহর কৃপায় কি সৌন্দর্য ফুটে আছে ঐ ঘোড়ার শরীরে।

শিল্পীরা স্মৃতির পাতা থেকে ঘোড়াকে তুলে ধরে তাদের তুলির ছোঁয়ায়,যদিও আল্লাহর প্রতিটয সৃষ্টিতে আছে বিশেষত্ব।শিল্পীরা হাজার হাজার ঘোড়াকে একই ভাবে এঁকে কৃতিত্ব দাবী করতে চায়,দেখাতে চায় তাদের কাছে অজানা চেহারার বিশেষত্বটা।আসল কথাটা কি জানঃশিল্পীরা চেষ্টা করছে আল্লাহর অনুভুতিটা ছবিতে আঁকতে,তাদের নিজেদের দেখা চেহারাটা না।বলা যায় ওটা অনেকটা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মত-ওটা নিঃসন্দেহে হারাম,ধর্মবিরোধী কাজ-বলার চেষ্টা, ‘আল্লাহ যা করতে পারে আমি তার চেয়ে কম কি’?শিল্পীরা চোখে দেখা ঘোড়াটাকে বারে বারে এঁকেও তৃপ্তি পায় না,তাদের মনে ভেসে আসে বেহেশতী ছোঁয়ায় দেখা ঘোড়াটা।অন্ধ শিল্পীদের তুলিতে আঁকা ছবি তো তার স্মৃতির একটা ছায়া,আসলে সে তো গুনাহ করছে আল্লাহর সাথে প্রতিযোগীতায় নেমে,সে তো বেহেশতী ছোঁয়ায় আনা ঘোড়াকে জীবন্ত করার চেষ্টায় ব্যাস্ত।

ভেনিসের শিল্পীদেরকে কাফের হিসাবে অপবাদ দিয়ে কোন লাভ নাই বরং তার উল্টাটাই সত্যি,তারাই ধর্মের সত্যিকার বিশ্বাসী মানুষ,ইরুজুরুমির ভায়েরা যেন আমাকে আবার ভুল বোঝে।অস্বস্তি হয়,যখন দেখি,ঐ কাফের ভেনিসের লোকজন প্রায় নগ্ন মেয়েদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে,ধর্মবিশ্বাসী লোকদের প্রতি সম্পুর্ন অবজ্ঞা তাদের।তারা জানে না কফি খাওয়ার আনন্দ,মুখে লোম ছাড়া অভাবনীয় সুন্দর চেহারার ছেলেরা,মেয়েদের মত লম্বা লম্বা চুল নিয়ে বলে বেড়ায় হযরত ঈসা নাকি আল্লাহর আরেক রুপ-আল্লাহ আমাদেরকে যেন রক্ষা করে ঐ কাফেরদের হাত থেকে।কাফেরদের উপরে আমার প্রচন্ড রাগ,সুযোগ পেলে ওদেরকে শিক্ষা দিতে আমার একটুও বাঁধবে না।

অস্বস্তি লাগে ভাবতে ঐ সব শিল্পীদের,যারা বাড়ীতে মেয়েদের মত বসে বসে আমাদের ছবিটা আঁকে,একেবারেই অসহনীয় একটা দৃশ্য।এক সময় হয়তো ঐ শিল্পীরা আমার লাফানোর একটা ছবি আঁকবে যেখানে আমার সামনের দুটা পা একসাথে দেখানো,এই পৃথিবিতে কোথাও একটা ঘোড়া নাই,যে খরগোসের মত লাফায়।আমার একটা পা যদি এগিয়ে থাকে,তবে আরেকটা পা নিঃসন্দেহে থাকে পেছনে।

যুদ্ধে যে ভাবে ঘোড়াদের ছবি আঁকা হয়,একটা পা সামনে আগানো,পেছনের পাটা আটকে আছে মাটিতে,একটা কৌতুহলী কুকুরের মত।পৃথিবীতে কোথাও কোন সৈন্যবাহিনী নাই,
যাদের ঘোড়া সমান্তরাল রেখার মত এগিয়ে যায়,বোদ্ধা শিল্পীদের পেন্সিলের ছোঁয়া যে ভাবে দেখায়।ঘোড়ারা তো সূযোগ পেলেই মুখে দেয়ার জন্যে ঘাস খুঁজে বেড়ায়,কিন্ত ছবিতে শিল্পীরা সেটা কোন সময় তুলে ধরতে চায় না।জানি না শিল্পীদের আমাদের খাওয়া,ঘুমানো,মলের দৃশ্য আঁকতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?আমার যে বিশেষত্ব আল্লাহর দেয়া সেটা ছবিতে তুলে ধরতে কারও কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না,কিন্ত শিল্পীদের এ ব্যাপারে কেমন জানি একটা কার্পন্য আছে?আর যাই হোক মেয়েরা আর বাচ্চা ছেলেরা ঐ ছবি দেখে বেশ আনন্দই পায়,কারও কোন ক্ষতি তো নাই।জানি না,ইরুজুমির হোজাও কি
আমাদের ও ধরণের ছবি আঁকার বিরুদ্ধে,নাকি কে জানে?

যত দূর জানা যায় সিরাজ শহরে দূর্বলমনা এক শাহ ছিল,সবসময় ভঁয়ে ভঁয়ে থাকতো শাহ, কোন সময় শত্রুরা তাকে খুন করে,তার ছেলেকে সিংহাসনে বসাবে।ঐ ভঁয়েই শাহ ছেলেকে শেষ পর্যন্ত প্রাসাদের একটা ঘরে গৃহবন্দী করে রাখলো ।ঐ ঘরে শাহজাদা ছোট্ট একটা ছেলে থেকে তিরিশ বছরের যুবক হলো,আর কিছু করার ছিল না শাহজাদার্, বাইরে দেখার মত কোন বাগান ছিল না,কোন নীল আকাশ ছিল না ভেসে যাওয়ার,শুধু বসে বসে বই আর বই এর ছবি দেখা।শাহের মারা যাওয়ার পর শাহজাদা সিংহাসনে বসেই আদেশ দিল তার মন্ত্রীদের, ‘বন্দী অবস্থায় থাকার সময় আমার দেখা ছবির ঘোড়াকে খুঁজে আন যেখান থেকে পার,ওদের সমন্ধে জানার প্রচন্ড ইচ্ছা,আমার’।

সাদা কালোর একটা ঘোড়া লোকজন আনলো প্রাসাদে,কিন্ত ঘোড়ার বিরাট নাকের ছিদ্র,বিশ্রী পাছার চেহারা দেখে শাহজাদা উলটা ক্ষেপে গিয়ে রাজ্যের সব ঘোড়াদের মেরে ফেলার আদেশ দিল।সেই হত্যার যজ্ঞ চললো চল্লিশ দিন ধরে,রাজ্যের নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে গেছে তখন।আল্লাহর বিচার থেকে অবশ্য রেহাই পায়নি ঐ নিষ্ঠুর শাহ , টুর্কমেনিস্থান আর শিয়াদের আক্রমনের সময় শাহজাদার ঘোড়ায় আরোহী কোন সৈন্য ছিল না,তার দেশ আর তাকে প্রতিরক্ষার জন্যে।শুধু রাজ্য দখল না সাথে সাথে শেষ হলো নিষ্ঠূর শাহের জীবন,কি অদ্ভুত ভাবে প্রতিশোধ নিল ঘোড়ারাও।

০০০০০০০০০০০০০০

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.