নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
(১৯)
আমাকে সবাই খুনী বলে
এ ব্যাপারে আমার কেন জানি সন্দেহ নাই,তোমরা হয়তো জান,আমি কি বলবো।রেস্তোরায় সবজী তরকারী রুটি খেয়ে ইস্তাম্বুলের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল যদিও আমি বর্তমান সময়ে জীবনটা কাটাচ্ছি,তবে আমার মনটা পড়ে আছে পুরোনো অচেনা কোথাও।হেঁটে যাচ্ছিলাম বরফ ঢাকা সাদা রাস্তা দিয়ে আর নানান চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল আমার মনে।
যা বলছি,সেটা শুধু আজকের একটা ঘটনা না,ঘটে গেছে অতীতেও।গোধুলির সোনালী আকাশটা তখন ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে সন্ধ্যার অন্ধকারে,হাল্কা একটু বরফ পড়ছিল,হেঁটে যাচ্ছিলাম এনিষ্টে এফেন্দীর বাড়ীর রাস্তায়।আজকে অবশ্য এ রাস্তায় আসার একটা বিশেষ কারণ ছিল,অন্যান্য অনেকদিনই আমার পা দুটো আমাকে ঠেলে দিতো এখানে আমার অজান্তেই।একটা বই এর জন্যে ৭০০ রুপার মোহর দেয় আমাকে,হেরাতের তৈমুর লঙ্গ এর সময়ের আমার গোলাপের কুড়ি দিয়ে সাজানো পরিচ্ছদটার চমৎকারিত্বে,অবাক হই ঐ ছবিগুলো নকল করে অন্যান্য লোকজন ভন্ডামি করে আমার নামে ছবিগুলো চালিয়ে যাচ্ছে।তবে এ বার আমি এখানে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি।
জানতাম না বাড়ীর গেটটা কেউ খুলে দিবে কি না,কিন্ত আল্লাহর দোয়ায় গেটটা যেন নিজেই খুলে গেল।এনিষ্টে বই এর ছবি দেয়ার জন্যে পাথর দিয়ে সাজানো আঙ্গিনা দিয়ে হেঁটে যেতাম,আজকে কেউ ছিল না সেখানে।ডানদিকে কূয়ার ধারে একটা খালি বালতি পড়ে আছে,পাশে একটা চড়ুই পাখী শীতে জড়সড় হয়ে বসে আছে,দূরে পাথরের চূলা,কিন্ত কোন আগুন নাই এই প্রচন্ড শীতেও,একপাশে মেহমানদের ঘোড়ার আস্তাবল,সবমিলিয়ে এটাই আঙ্গিনার চেহারা।আস্তাবলের পাশের খোলা দরজাটা দিয়ে চোরের মতই চুপচাপ বাড়ীতে ঢুকলাম,জুতা থেকে বরফ ঝেড়ে গলা খাঁকারি দিয়ে সিড়িতে হেঁটে গেলাম দোতলায়।
গলা খাঁকারির শব্দ শুনে কেউ বের হয়ে আসেনি,এমন কি জুতা পরিষ্কার শব্দটাতেও,জুতাটা সাজানো জুতা রাখার জায়গায় রেখে ঘরের দিকে গেলাম।অন্যান্য দিনের মত সেকুরের সবুজ জুতাটা ছিল না,বোঝা যাচ্ছিল বাড়ীতে হয়তো কেউ নাই।কে জানে এমনও হতে পারে ভেতরে হয়তো সেকুরে ছেলেদের নিয়ে বিছানায় জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে,কিন্ত কেউ ছিল না।সেকুরের শোয়া বিছানার চাঁদর তোষককে আদর করে দেয়ালের একটা আলমারী খুললাম।মনে হলো ছুটে আসা মিষ্টি গন্ধটা হয়তো সেকুরের শরীরের,সে সময় একটা বালিশ সরে গিয়ে তামার একটা গেলাস আর গামলা আমার মাথার উপর এসে পড়লো।কোন একটা শব্দ শুনলে মনে হয় যেন ঘরটা অন্ধকাঁর কিন্ত আমার মনে হলো ঘরটা বেশ ঠান্ডা।
‘হাইরিয়ে’,এনিষ্টে এফেন্দী অন্য ঘর থেকে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘সেকুরে,কে ওখানে’?
তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে এনিষ্টে এফেন্দীর নীল দরজাওয়ালা ঘরটাতে গেলাম,বই এর ছবি,বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনায় অনেক সময় কেটে গেছে এই ঘরটাতে।
‘আমি,এনিষ্টে এফেন্দী’,উত্তর দিলাম।
‘আমি,আমি কে’?
বুঝতে পারলাম যে এনিষ্টে এফেন্দীর ঘরটা বই এর গোপনীয়তার নামে ব্যাবহার করা হলেও,সেটা আর কিছু না আমাদের নিয়ে মশকরা করা।আমার নাম,ঠিকানা,বাবার নাম,একটা ছবির সাজানো বিবৃতির মত,সবকিছু বললাম এনিষ্টে এফেন্দীকে যাতে তার আমাকে চিনতে কোন কষ্ট না হয়।
‘ও’,এনিষ্টে বললো,একটুঁ থেমে আবার বললো, ‘ও”।ছোট বেলার আসিরিয়ান গল্পের বুড়োটার মত মৃত্যুর নিস্তব্ধতায় যেন ভেসে গেল এনিষ্টে এফেন্দী।এখন যদি কেউ ভাবে আমার আসাটা আজরাইলের দূত হিসাবে তা হলে সে অবশ্যই ভুল করবে।খুনী কি কোন সময় জুতা পরিষ্কার করে বাইরে রেখে ঘরে ঢোকে?খুনী কি কোন সময় দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিজেকে জানান দিবে?খুনী কি চাকু ছাড়া খুন করতে যাবে?
‘ও তুমি’?ছেলেবেলার বূড়ো লোকটার মতই এনিষ্টে উত্তর দিল।একসময় তার স্বরটা বদলে গেল, ‘কি খবর বাবা,সব ভাল তো?তা হঠাৎ কি মনে করে আসা হলো এ সময়’?
বাইরে তখন বেশ অন্ধকার,জানালার পর্দা দিয়ে হাল্কা আলো ভেসে আসছিল,কিছুটা যদিও। এনিষ্টেকে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলাম না,মুখ নীচু করে যথারীতি কাজের টেবিলে বসে ছিল বুড়ো।চেষ্টা করছিলাম পুরোনো ঘনিষ্ঠতাকে ঝালাই করার জন্যে,যখন এখানে বসে তুলির পোঁচে,রং এর ছোয়ায়,মোমবাতীর হাল্কা আলোয়,ছবিতে প্রান দিতে কার্পন্য করিনি,।
যে কোন কারণেই হোক আমি এনিষ্টে এফেন্দীকে আমার অপরাধের কথা বলতে এসেও বলতে পারলাম না,ভাবলাম একটা গল্পের ছলে বললে হয়তো কিছুটা সহজ হবে।
ইস্পাহানের খ্যাতনামা চারুশিল্পী শেখ মোহাম্মদের নাম,কে না জানে,?রং এর ব্যাবহার,পর্যবেক্ষনে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল বলে মনে হয় না,বিশেষ কারও ছবি,জন্ত জানোয়ার,প্রাকৃতিক পরিবেশ সবকিছুতেই তার তুলির ছোঁয়া ছিল অতুলনীয়।তার ছবি ছিল তুলির ছোঁয়ায় কবিতার আবেগের সাথে মেশানো গনিতের পরিমাপ।খুব অল্প বয়সেই খ্যাতি আর সার্থকতার চরমে পৌছে যান শেখ মোহাম্মদ,প্রথম তিরিশটা বছর ছবি আঁকায় কাটালেও,পরের তিরিশটা বছর তার কেটে বিষয়,সৌন্দর্য আর নতুন পদ্ধতি খুঁজতে খুঁজতে।মঙ্গোলদের সাথে আসা চীনের চারুশিল্পীদের অনুকরণে তার কালি আর কলমের ছোঁয়ায় আঁকা ভয়ঙ্কর রাক্ষস,শিংওয়ালা জিন,বড় বিচিওয়ালা ঘোড়া,অর্ধেক দানব অর্ধেক মানুষ,মেশানো হেরাতের ছবি আঁকার পদ্ধতির সাথে।শেখ মোহাম্মদ প্রথম চারুশিল্পী যে পর্তুগালের জাহাজে আসা পোট্রেট আঁকার পদ্ধতির সাথে চালু করে,মেশানো পুরোনো,ভুলে যাওয়া চেংগিজ খানের সময়ের আঁকার পদ্ধতির।অন্য কোন শিল্পীর সাহস হওয়ার আগে কামদ ছবির আঁকাটাও তার প্রথম,আলেকজান্দারের উঁকি দিয়ে নগ্ন যুবতীদের স্নানের দৃশ্য দেখা,চাঁদের আলোয় শিরিনের নগ্ন স্নান,শুধু তাই না পাখাওয়ালা ঘোড়া বোরাকে সম্মানিত পয়গম্বরের আকাশের দিকে যাওয়া,ক্ষমতাশালী শাহদের পিঠ চুলকানোর ছবি,কুকুরের যৌনসঙ্গমের দৃশ্য,মাতাল শেখদের উন্মাদ চেহারা,কোন কিছুই তুলিতে আনতে ভয় পায় নি,শিল্পী শেখ মোহাম্মদ।ছবিগুলো আঁকা কখনও গোপনে আবার কখনও প্রকাশ্যে,মদ না হয় আফিমের নেশায়,উৎসাহ,উচ্ছাসের স্রোতে ভেসে গেছে তার তিরিশটা বছর।সেই শেখ মোহাম্মদ পরিনত বয়সে এক ধার্মিক সুফী শেখের শিষ্য হয়ে একেবারেই বদলে গেল,এমন কি নিজের আঁকা ছবিগুলোও তার কাছে মনে হতো,অশ্লীল,জঘন্য,অপরাধ বোধে মন ছেয়ে গেছে তখন তার।বাকী সময়টা শেখ মোহাম্মদের কাটে প্রাসাদ থেকে প্রাসাদে,সুলতানদের লাইব্রেরীতে ঘুরে ঘুরে নিজের আঁকা ছবিগুলো কেটে নষ্ট করে ফেলার জন্যে।ঐ ছবিগুলো নষ্ট করার জন্যে যে কোন কৌশলের সাহায্য নিতে দ্বিধা করে নি শেখ মোহাম্মদ,তার ধর্ম বিশ্বাসের সুর তখন তাকে নিয়ে গেছে আরেক পৃথিবীতে।এই ভাবে শেখ মোহাম্মদের লাগানো আগুনে শাহজাদা ইসমাইল মির্জার লাইব্রেরী পুড়ে তছনছ গেল,শুধু তার আঁকা ছবির বইগুলো পুড়ে যায়নি,হারালো আরও হাজারো খ্যাতনামা শিল্পীদের বই,ছবি।এ ভাবেই একজন নামকরা শিল্পী অর্ন্তদন্দে হারিয়ে গেল ধর্মান্ধতার আগুনে।
‘মনে হচ্ছে, অনেক ভঁয়,অনেক যুদ্ধ তোমার মনে আমাদের আঁকা ছবি নিয়ে’,এনিষ্টে জিজ্ঞাসা করলো।
ঘরটা অন্ধকাঁর হয়ে গেছে তখন,যদিও এনিষ্টের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না,তবে মনে হলো কথা বলার সময় তার মুখে লুকানো ছিল হাসি।
‘আমাদের বইটা এখন আর গোপন নাই,মোটামুটি বেশ জানাজানি হয়ে গেছে’,বললাম, বল্যাবলি করছে আমরা ইসলাম ধর্মের অবমাননা করছি।লোকজন এটাও বলছে বইটা সুলতানের নির্দেশে বের হচ্ছে না,বরং হচ্ছে কিছু শিল্পীর আত্মসন্তষ্টির জন্যে,মহামান্য পয়গম্বরকে আমরা অপমান করছি ঐ সব কাফেরদের কথাবার্তা শুনে।এমন কি লোকজন এটাও বলতে ছাড়ে নি এর চেয়ে ঐ সব শিল্পীদের শয়তানের সুন্দর চেহারার ছবি এঁকে বই করাটা বরং ভাল ছিল।অনেকে বলছে আমাদের উড়ে যাওয়া ঘোড়া বোরাকের ছবি রাস্তার কুকুরের মত,মসজিদের ছবি এঁকে এ ভাবে আমরা নাকি বিশ্বাসীদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করছি।ঘুমোতে পারিনি কত রাত্রি শুধু এই কথা ভেবে’।
‘তুমি,আমি তো একসাথেই বইএর অনেক ছবিগুলো আঁকলাম,তোমার কি মনে হয় এ ধরণের চিন্তা,ছবি আঁকা তো দূরের কথা আমাদের মনে আনা সম্ভব’?এনিষ্টে এফেন্দী জিজ্ঞাসা করলো।
‘অবশ্যই না’,আমি বললাম, ‘কিন্ত জানি না লোকজন কেন এই সব কোথা থেকে বলছে?অযথা সব বানিয়ে বলছে!লোকজন এটাও বলছে শেষের দিকে একটা ছবি আছে,যা আমাদের ধর্মকে এত নোংরা ভাবে দেখানো,যা নাকি অচিন্তনীয়,কেন লোকেরা এ সব কথা বল্যাবলি করছে’।
‘শেষ ছবিটাও তুমি তো দেখলে,বির্তকিত কোন কিছু দেখলে?জানি না,কি তোমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে?এনিষ্টে বললো, ‘বলো কি কষ্ট দিচ্ছে তোমাকে?কেন তোমার মনে এই সন্দেহ’?
‘...মনে একটা সন্দেহ ঘুরে বেড়াচ্ছে,সারাটা জীবন যা পবিত্র বলে জানলাম,আমার বিশ্বাস,আমার ধর্ম নষ্ট করে দিচ্ছে একটা বই...বেঁচে থাকা অবস্থায় নরকের আগুনে পুড়ছি আমি...শেষ ছবিটা যদি আরেকবার দেখতে পারতাম,যদি আমার সন্দেহটা দূর করতে পারতাম’।
‘ওটাই তোমাকে কষ্টের কারণ?এই জন্যে এখানে আসলে’?এনিষ্টে বললো।
ভঁয়ে সারা শরীর কাঁপছিল,আমার।এনিষ্টে কি খারাপ কিছু ভাবছে,সে কি জানে আমিই জারিফ এফেন্দীর খুনী?
‘যারা আমাদের সুলতানকে সরাতে চায় আর শাহজাদাকে সিংহাসনে বসাতে চায়,তারাই ঐ সব গুজব ছড়াচ্ছে,ওরাই বলে বেড়াচ্ছে এটা শাহজাদার খরচের বই’,আমি বললাম।
‘কয়জন কথাটা বিশ্বাস করে’,একটুঁ উদ্বিগ্ন হয়েই জিজ্ঞাসা করলো এনিষ্টে, ‘তুমি তো জানই প্রতিটা মোল্লা যারা উচুতে উঠতে চায় তারা খুঁত বের করার মত অযথাই বলে বেড়াচ্ছে ধর্মের অবমাননার কথা।এর চেয়ে সহজ ভাবে খ্যাতি উপার্জনের উপায় আর কি আছে’?
জানি না,এনিষ্টে কি ভাবছে গুজবের গল্প বলার জন্যে তার কাছে ছুটে আসলাম।
‘হতভাগা জারিফ এফেন্দী,আল্লাহ যেন তার আত্মাকে শান্তি দেয়’,আমি বললাম,গলাটা আমার কাঁপছিল যদিও,‘সুলতানের প্রাসাদের এক দপ্তর প্রধান বললো,জারিফ এফেন্দী বলে বেড়াচ্ছিল,বই এর শেষ ছবিটাতে ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা আর সেই কারণেই খুন হলো,সে।তোমার তো জানাই আছে প্রাসাদের মানুষেরা কি ভাবে কানাঘুষা করে’।
এ ভাবেই যুক্তি কথাবার্তা চললো বেশ কিছুটা সময়।জানিনা এনিষ্টে এফেন্দী আমার কথা কতটুকু বিশ্বাস করলো,ভাবলো কতটুকু আমার বানানো।আমার ধারণা ছিল এ ভাবে চাটুকারিতা করলে এনিষ্টে এফেন্দী ঐ দুই পাতার ছবি আমাকে দেখাতে আর কোন দ্বিধা করবে না।কেন এনিষ্টে বুঝতে পারছে না,ওটাই যে আমার গুনাহ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়?
এনিষ্টের কথা কিছুটা অবজ্ঞা করেই বললাম, ‘এমনও হতে পারে কেউ তার অজান্তেই হয়তো ধর্মবিরোধী একটা ছবি এঁকে ফেলেছে,যা অন্য শিল্পীদের জানা ছিল না’।উত্তর না দিয়ে এনিষ্টে হাতের আকারে ইঙ্গিতে বোঝালো,পাশের ঘরে বাচ্চারা শুয়ে আছে,তারপর আর কোন কথা নেই,চুপচাপ।ঘরটা বেশ অন্ধকাঁর হয়ে গেছে, ‘মোমবাতিটা জ্বালাও’, সে বললো।
ঘর গরম করার কয়লায় মোমবাতি জ্বালানোর পর এনিষ্টের মুখটা দেখলাম,গর্ব আর অহঙ্কার উপচে পড়া একটা মুখ,আগে এ চেহারাটা কখনও চোখে পড়েনি আমার।না কি ভুল হচ্ছে কোথাও,হয়তো ওটা দয়া দেখানো একটা মুখ?এনিষ্টের কাছে আমার মনোভাব কি একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে এর মধ্যে?সে কি ভাবছে এনিষ্টে,আমি একটা জাত খুনী, ভঁয় পাচ্ছে আমাকে?সহজেই নানান চিন্তার স্রোতে ভেসে যাচ্ছিলাম,বোকার মত নিজের কথায় আমি নিজেই হতমুগ্ধ।আমার পায়ের নীচের গালিচায় একপাশে ফুল,এটা আগে দেখিনি,আমি।
‘সুলতান,খান,শাহদের ছবি,বই এর জন্য ভালবাসাকে তিনটা ঝতুতে ভাগ করা’।এনিষ্টে এফেন্দী বললো, ‘প্রথমে তারা সবাই আত্মবিশ্বাস,কৌতুহল আর উচ্ছাসে ভঁরা।শাসকেরা ছবিকে ব্যাবহার করতে চায় আত্মসন্তষ্টির জন্যে,যার মাধ্যমে তাদের খ্যাতি হবে চিরন্তন।এর মাঝে ওরা নিজেরাও বোঝার চেষ্টা করে-না জানা জানাগুলো,খ্যাতি সম্মান অর্জন করে,আবার প্রচুর বইপত্র জোগাড়ও করে জ্ঞানের জন্য,যেন তাদের মৃত্যুর পরেও অক্ষত থাকে যেন তাদের খ্যাতি,জাগতিক খ্যাতি বলতে বোঝায় যেন সামনের প্রজন্মের কেউ যেন না ভুলে যায় তার কথা।শাসকেরা যারা লেখা আর ছবির মাধুর্য উপলদ্ধি করতে জানে,তারা নিজেদের নাম বই এর পাতায় ছবিতে দিয়ে ইতিহাসে অমরত্ব খুঁজে নিয়েছে।পরে আবার তাদের মনে হয় ওপারের পৃথিবীতে এই খ্যাতি দিয়ে কোন লাভ নাই,এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশী বিচলিত করে।শাহ তামাসপ যে নিজেই যৌবনে ছিল একজন নামকরা চারুশিল্পী,সেই সময়টার বেশীর ভাগটাই কেটেছে তার প্রাসাদের ছবি আঁকার ঘরে,বদলে গেল সেই মানুষটা একেবারেই মৃত্যুর কাছাকছি পৌঁছে,তাব্রিজের সব নামকরা চারুশিল্পীদের তাড়িয়ে দিল,যত বইপত্র ছবি যা ছিল সবকিছু নষ্ট করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।জানি না এটা কি ধরণের ছবি তাদের আটকে ফেলবে বেহেশতে যাওয়ায়’।
‘কেন তুমি হয়তো ভুলে গেছ,আমাদের পয়গম্বরের বলা,তা ছাড়া কেতাবেও বলা আছে শেষ বিচারের দিন আল্লাহর চরম শাস্তি পাবে চারুশিল্পীরা’।
‘কথাটা সম্পুর্ন ঠিক না,চরম শাস্তি যারা মুর্তি তৈরী করে পূজার জন্যে,সেটাই আমাদের মহামান্য পয়গম্বরের ভাষ্য,তুমি যা বলছো সেটা ঐ মোল্লাদের কথা’,এনিষ্টে এফেন্দী বললো, ‘আর ওটা কোরআন শরীফে লেখা না,বুখারীর হাদিসের কথা’।
‘শেষ বিচারের দিন যারা মুর্তি করে তাদের বলা হবে মুর্তিগুলোতে জীবন দেয়ার জন্যে,আর তাদের অক্ষমতার শাস্তি সেটা হবে অচিন্তনীয়,দোজখের আগুনে পুড়ে কয়লা হবে তারা।আমরা যেন ভুলে না যাই আল্লাহ সেই মহান শক্তি,একমাত্র শক্তি যার কথায় অনস্তিত্বতে আসে অস্তিত্ব,এক মাত্র ক্ষমতা যেখানে জীবনে নেই সেখানে জীবন আনার ক্ষমতা আছে যার।সবচেয়ে বড় অপরাধ চারুশিল্পীদের তারা ভাবে কোন কিছু একটা মহান সৃষ্টি করছে,ওটা তো বিরাট একটা গুনাহ’,আমি উত্তর দিলাম।
আমার কথা বলার ধরণটা হয়তো এমনই ছিল,যেন আমি এনিষ্টে এফেন্দীকে অভিযুক্ত করছি।
‘তোমার কি মনে হয়,আমরা সে ধরণের একটা অপকর্ম করছিলাম’?
‘না,না;,আমি হেসে বললাম, ‘যদিও ঐ জারিফ এফেন্দী,আল্লাহ তার আত্মাকে যেন শান্তি দেয়,তার অভিযোগ ছিল সেটাই।এটাও ছিল তার অভিযোগ,তোমার বিজ্ঞানের মাপের ছবিগুলো ভেনিসের চারুশিল্পীদের পদ্ধতিতে ছবি আঁকা আর কিছু না,সেটা শয়তানের প্ররোচনা,প্রলোভন।জারিফ এফেন্দীর বলা তোমার শেষ ছবিটায় নাকি এমন বাস্তব একটা রুপ আছে,সেটাতে মুগ্ধ হয়ে মানুষ সহজেই ভক্তিতে মাথা নত করবে,যেন সর্বশক্তিমানের সামনে মাথা নত করছে তারা।জারিফ এফেন্দীর মতে এটা শয়তানের কাজ,আর তোমার আমাদের সনাতন ছবি আঁকার নিয়মকে ছুঁড়ে ফেলে ঐ অবিশ্বাসী কাফেরদের মতে ছবি আঁকতে গিয়ে আমরা হারাবো আমাদের মনের পবিত্রতা আর শেষে হবো ঐ কাফেরদের ক্রীতদাস’।
‘পবিত্রতা ওটা শুধু কথার কথা,তুমি কি মনে কর বিশ্বাস,আস্থা কি এতই ঠুনকো’,এনিষ্টে এফেন্দী বললো, ‘বই বা ছবির জগতে,যখনই আমরা একটা যুগোত্তীর্ন কিছু একটা চোখ ভঁরে যায় কান্নার আনন্দে,অদ্ভুত এক শিহরন ছূটে যায় শরীরের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে।আমি বিশ্বাস করি নিঃসন্দেহে,এই দুটো ভিন্ন পদ্ধতির সংমিশ্রন চারুশিল্পকে তার সৌন্দর্যের চরমে নিয়ে যাবে।আমরা ওস্তাদ চারুশিল্পী বিহজাদের কাছে ঋনী,আরব চারু শিল্পের আন্তরিক উপলদ্ধির সাথে,মঙ্গোলীয় নিপুণ শিল্পের সংমিশ্রণ।শাহ তামাসপ সবচেয়ে নামকরা ছবি আঁকা পারস্যের পদ্ধতির সাথে তুর্কমেন পদ্ধতির মিশ্রনে।আমরা যদি উপলদ্ধি না করতে পারি হিন্দুস্থানের বাদশাহ আকবরের চারুশিল্পীদের ছবির সৌন্দর্য সেটা ভেনিসের পোট্রেট পদ্ধতির অনুকরণে করা বলে,তবে সেটা শুধু শিল্পের না আমাদের ধর্মেরও অবমাননা করা হবে।পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিন সবই তো আল্লাহর হাতের মুঠোয়,আল্লাহ যেন আমাদের রক্ষা করে এই পবিত্রতা আর নিখুঁত মানুষদের পাগলামি থেকে।আমরা আল্লাহর সৃষ্টি,তার করুণার ক্রীতদাস,প্রতি মূহুর্তে তার কাছে কৃতজ্ঞ।আমরা ছবি আঁকি আল্লাহর দেয়া প্রতিভায়,কোনভাবেই ধর্মকে অবমাননা করার জন্যে না’।
এনিষ্টের চেহারাটা মোমবাতির আলোতে যতই উজ্জল আর নম্র মনে হোক না কেন,
দেয়ালের ছায়াটা ছিল তেমনই কালো আর ভয়াবহ।যদিও তার কথাগুলো ছিল যুক্তিযুক্ত,তবে কেন জানি সেটা যথাযথ মনে হয়নি,তার কথাগুলো একেবারেই বিশ্বাস হয়নি,আমার,সবকিছুই যেন আমাকে খুশী করার জন্যে বলা।কেন জানি মনে হচ্ছিল এনিষ্টে সন্দেহ করছে আমাকে,আমারও তাকে আর বিশ্বাস হচ্ছিল না।মনে হচ্ছিল এনিষ্টে কান পেতে আছে দরজার দিকে,যেন কেউ এসে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাবে এই আলোচনা থেকে।
‘তুমি তো নিজেই বললে ওস্তাদ চারুশিল্পী শেখ মোহাম্মদ,তার পাগলামিতে কি ভাবে শাহজাদার লাইব্রেরী পুড়িয়ে ছারখার করে দিল’,এনিষ্টে বললো, ‘এখন সেই ঘটনার সাথের আরেকটা গল্প তোমাকে বলি,যেটা মনে হয় তোমার জানা নাই।এটা সত্যি শেখ মোহাম্মদ তার জীবনের শেষ তিরিশটা বছর ঐ ধ্বংসের কাজেই লিপ্ত ছিল,তবে বইগুলো খুঁজতে এটাও দেখলো সে তার অনেক ছবিই অন্য পদ্ধতিতে আকা।দুই যুগ ধরে যে সব চারুশিল্পীরা তাকে অনুকরণ করতো,তারা অনেকের শেখ মোহাম্মদের ছবি মনের খাতায় নিয়ে নিজের উপলদ্ধিতে নতুন ভাবে এঁকে গেছে।একজন চারুশিল্পী শুধু ছবি আঁকে না,তাদের আঁকা ছবিতে আমাদের উপলদ্ধিটাও বদলে যায়।একজন চারুশিল্পী অন্তরের সুরে যখন একটা ছবি আঁকে,সেটা হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীতে ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের একটা অংশ।
ইস্পাহানের চারুশিল্পী ওস্তাদ শেখ মোহাম্মদ তার ছবিগুলো পোড়াতে গিয়ে দেখলো,তার ছবিগুলো কমে যায়নি,বরং সংখ্যায় সৌন্দর্যে বেড়ে গিয়ে আরো ছড়ানো।লোকজন দেখার চোখটা বদলে গেছে শেখ মোহাম্মদের চোখ’।
আমার মনের ঝড় আর এনিষ্টে এফেন্দীকে খুশী করার ইচ্ছায় তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম।হাতটায় চুমু দিতে দেখি আমার চোখ কান্নায় ভঁরা,আর আমার মনে ওস্তাদ ওসমানের জায়গাটায় তখন এনিষ্টে বসে আছে।
‘একজন চারুশিল্পী’,এনিষ্টে বললো,গলায় সন্তষ্টির স্রোত, ‘কোন কিছু ভঁয় না করে,এঁকে যায় তার মনের ছবিটা,উপলদ্ধির চোখে।কে কি বললো,কি ভাবে সমালোচনা করলো তাকে,তাতে কিছুই যায় আসে না’।
এনিষ্টের হাতে চুমু দিতে গিয়ে মনে হলো আমার কান্নায় ভিজে যাওয়া বুড়ো হাতটা কোন দক্ষ চারুশিল্পীর হাত না।কেন যে এই ধরণের শয়তানী চিন্তা আমার মনে ভেসে বেড়াচ্ছিল জানি না।
‘আমি ওদেরকে ভঁয় পাই না’,এনিষ্টে বললো, ‘মৃত্যুর ভঁয় নাই আমার,আর।বয়স তো কম হয়নি,সময় তো একদিন আসবেই কোন না কোন ভাবে’।
‘কে ঐ সব লোকজন’,এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম যেন সেটা জানার্ অসহিষ্ণুতায় মনটা উদ্বেগে ভঁরা।দেখলাম এনিষ্টের পাশে রাখা পুরোনো একটা বই আল জেজভিয়ের আত্মা কাহিনী,বুড়ো মানুষ যারা মৃত্যু নিয়ে প্রায়ই ভাবে,এই বইটা তাদের খুব পচ্ছন্দ,ওপারের পৃথিবীর সবকিছুই যেন বলা আছে বইটাতে।সিন্দুকের উপরে ট্রেতে রাখা ছিল শুধু একটাই নতুন জিনিষ দেখলাম,কলম,চাকু,কাগজ কাটা বোর্ডের পাশে,পেতলের কালির একটা দোয়াত।
‘একটা জিনিষ আমি প্রমান করতে চাই আমরা ওদেরকে ভঁয় করি না’,বেশ জোর গলায় কথাটা বললাম, ‘ঐ শেষ ছবিটা বের করে আমরা ওদের দেখাবো,আমাদের কোন কিছুতেই ভঁয় নাই’।
‘কিন্ত সেটা তো এটাই প্রমান করবে ওদের গুজবে ভঁয় পেয়েই আমরা সেটা করছি?আমরা তো এমন কিছু করিনি,যে আমাদের কাউকে ভঁয় করতে হবে।আমি ঠিক তোমার ভঁয় পাওয়ার কাঁরণটা এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না’।
এনিষ্টে অনেকটা আমার বাবার মতই চুলে বিলি কেটে দিল।মনে হচ্ছিল আমি কেঁদে ফেলবো,না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
‘কেন ওরা জারিফ এফেন্দীকে খুন করলো’,কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললাম,‘আপনার নামে,এই বইটাকে আর আমাদের সবাইকে জড়িয়ে নানান ধরণের কেলেঙ্কারী,গুজব ছড়াচ্ছিল জারিফ এফেন্দী যাতে নুসরাত হোজার লোকজন এসে আমাদের উপরে চড়াও হয়।কেন জানি তার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল,আমরা সবাই শয়তানের কথায় উঠছি বসছি।সে চেষ্টা করছিল এসব গুজব দিয়ে অন্যান্য চারুশিল্পীদের আপনার বিরুদ্ধে উসকানোর জন্যে,তবে কেন যে সে হঠাৎ বদলে গেল,আমি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না।হয়তো ঈর্ষায় নাকি শয়তানের প্রভাবে,কে জানে?অন্যান্য চারুশিল্পীরাও জানে যে জারিফ এফেন্দীরা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে ছিল।এঁকে এঁকে সব চারুশিল্পীরাই এমন কি আমিও ভঁয় আর সন্দেহের কাছে হেরে গেলাম,শান্ত মনে কোথাও ঘুরে বেড়াতে পারতাম না,আমরা।আমাদের সকলের বিশ্বাস আপনার উপরে,হয়তো কোন এক শিল্পী ভঁয় পেয়ে ঐ শয়তান জারিফ এফেন্দীকে খুন করে কূয়ায় ফেলে দিছে’।
‘বুদ্ধু’?
‘জারিফ এফেন্দী ছিল খারাপ পরিবেশ থেকে আসা,বদরাগী শয়তান লোক’,আমি চীৎকাঁর করে বললাম,যেন শয়তান লোকটা ঐ ঘরে আমার সামনে বসে আছে।অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা।এনিষ্টে কি আমাকে ভঁয় করছে?আমি তো নিজেকেই ভঁয় পাচ্ছি,যেন অন্য কাঁরও ইচ্ছা আর চিন্তার কাছে হেরে গেছি,তবুও খুব একটা বিচলিত হই নি।
‘তোমার মত আর কে ভঁয়ে আতঙ্কে অতিষ্ঠ?আর ইস্পাহানের চারুশিল্পী তাকে কে খুন করলো’?
‘আমার জানা নেই’,আমি বললাম।
আমি চাচ্ছিলাম এনিষ্টে আমার কথাবার্তায় যেন ভাবে আমি মিথ্যা কথা বলছি।বুঝতে পারলাম যে এখানে আসাটা আমার বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে,তবে অপরাধ আর অনুশোচনায় ভেঙ্গে পড়বো না।বেশ বুঝতে পারছিলাম এনিষ্টে আমাকে সন্দেহ করছে আর এটাও বুঝলাম তার জালটা ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরছে।এনিষ্টে যদি একেবারে নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমিই খুনী,তখন হয়তো সে ভঁয় পেয়ে আমাকে শেষ ছবিটা দেখাতে দ্বিধা করবে না।আমার মনে শুধু ঐ ছবিটার কথা ভেসে বেড়াচ্ছে,দেখতে চাই ছবিটা যার জন্যে হয়তো একজন মানুষকে খুন করলাম,আমি।
‘এটা অবশ্যই জানা দরকার কে খুন করলো জারিফ এফেন্দীকে’?আমি বললাম, ‘খুব একটা খারাপ কাজ করেনি যদিও যেই করে থাকুক,আপনার কি মত’?
০০০০০০০
২| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ২:৫০
ইল্লু বলেছেন: পড়া যে হয় না ,তা না তবে মন্তব্য করা হয়ে উঠে না।বলাটা অনেক সময় বলা হয়ে উঠে না ।
ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৪২
রাজীব নুর বলেছেন: আপনার উচিৎ অন্যের পোস্ট পড়া। মন্তব্য করা।