নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১১ ই জুলাই, ২০২৩ রাত ১১:৫০

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা




১৪)

কিছুক্ষন পরে এনিষ্টে নতুন একটা ছবি দেখানো আরম্ভ করলো,সাথে রজনীগন্ধার সুবাসে মোড়ানো ছোট্ট একটা কাগজ,খুলে দেখি শুধু সাদা একটা কাগজ।কিছুটা হতভম্ব,বারবার কাগজটা ঘুরিয়ে দেখছিলাম কাগজটা।‘একটা জানালা’,এনিষ্টে বললো, ‘একেকটা দৃষ্টিকোন থেকে পৃথিবীকে একেকভাবে দেখা যায়,তোমার হাতে তুমি যা ধরে আছ সেটা একটা জানালা’।‘এটা তো কিছুই না এনিষ্টে এফেন্দী’,আমি বললাম,দোমড়ানো কাগজটা নাকের কাছে নিয়ে আমি তার গন্ধটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম।
দুপুরের খাবারের পর ঘরের পেশাবের গামলা ব্যাবহার না করে আঙ্গিনার বাইরের গামলাটা ব্যাবহার করতে গেলাম,শীতের ধাক্কায় আমি জড়সড় তখন,দেখি সেভকেত তার দাদুর গরম পেশাবের গামলাটা পাশে রেখে সে চলে গেল।
‘তুমি কি কোন দিন মরা বিড়াল দেখেছ’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো,তার নাকটা মায়ের মতই টিকোলো।দোতলার যাদু রাজ্যের ঘরটার দরজাটা বন্ধ যেখানে সেদিন সেকুরেকে
দেখলাম এতগুলো বছর পরে।
‘না’।
‘চল দেখবে ইহুদী বাড়ীতে ঝুলানো বিড়ালটা’?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে রাস্তায় চলে গেল সেভকেত,বরফ কাদামাটি দিয়ে আমরা
পৌছালাম জঙ্গল ভঁরা একটা বাগানে,ভেজা পচা পাতা ছড়ানো ছিটানো চারপাশে,জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে আছে কিছুটা,কাজুবাদামের কটা গাছের পেছনে ছিল পুরোনো ভেঙ্গে পড়া একটা বাড়ী।হলুদ দরজা দিয়ে সেভকেত ভেতরে ঢুকলো,ভাবভঙ্গীতে বোঝা গেল তার বেশ যাতায়াত আছে সেখানে।
একেবারেই খালি বাড়ীটা,তবে ভেতরে বেশ গরম,মনে হয় হয়তো যেন কেউ না কেউ সেখানে থাকে।
‘কার বাড়ী’?আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ইহুদীদের।বুড়ো ইহুদী মারা যাওয়ার পর,ছেলেমেয়ে বৌ সবাই চলে গেছে,বাড়ীটা ফল ব্যাবসায়ী ইহুদীদের পাড়ায়,বিক্রি করার দায়িত্ব দিয়ে গেছে এসথার ফেরীওয়ালাকে’,বলে সেভকেত ভেতরে ঢুকে দেখে বললো, ‘বিড়ালটা দেখছি না’।
‘মরা বিড়াল যাবেই বা কোথায়’?
‘তুমি জান না,দাদু বলে মরা মানুষ ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায়’।
‘না মৃতেরা নিজেরা না,তাদের আত্মা হয়তো বা’,আমি বললাম।
‘তুমি কি ভাবে জান’?সেভকেতের হাতে ছিল পেশাবের গামলাটা।
‘আমি জানি।তুমি কি প্রতিদিন এখানে আস’?
‘আমার মা আসে এসথারের সাথে।মরা মানুষেরা কবর থেকে উঠে আসে রাতের বেলায়,আমি অবশ্য ভঁয় পাই না।তুমি কি কোনদিন মানুষ খুন করেছ’?
‘হ্যা’।
‘কয়জন’?
‘বেশী না,দুজন’?
‘তলোয়ার দিয়ে’?
‘হ্যা,তলোয়ার দিয়েই’।
‘তাদের আত্মা কি ঘুরে বেড়াচ্ছে’?
‘ঠিক জানি না,তবে বই এ যে ভাবে লেখা আছে,তাতে মনে হয় তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে’।
‘হাসান চাচার একটা লাল তলোয়ার আছে,এত ধার যে সেটাতে ছুলেই আঙ্গুল কেটে যায়।তার একটা চাকুও আছে,হাতলটায় রুবী লাগানো কয়েকটা।তুমিই কি আমার বাবাকে খুন করেছ’?
আমি মাথা নাড়ালাম,সেটায় হ্যা বা না যে কোন কিছু একটা ভেবে নেয়া যায়।‘তুমি কি ভাবে জান তোমার বাবা মারা গেছে’?
‘আমার মা গতকাল বললো,বাবা আর ফিরে আসবে না।মা নাকি স্বপ্নে দেখেছে’।
আমাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে সুযোগ পেলে আমরা যে কোন কিছু করতে পারি,আর তার জন্যে যুক্তি দাঁড় করানোও তেমন একটা অসম্ভব কিছু না।এনিষ্টের বাড়ীতে ফিরে ছবিগুলো আবার মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম।
এনিষ্টে আমাকে যে ছবিগুলো দেখালো সেগুলো নিয়ে কিছু বলি,যেমন ঘোড়ার ছবিটায় আশেপাশে কোন মানুষ নাই,চারপাশটা একেবারেই ফাঁকা।তবুও কেন জানি মনে হলো ওটা শুধু একটা ঘোড়ার ছবি না।হ্যা,ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে,হয়তো সহিস পাশের ঝোপে ঘোড়াতে ওঠার জন্যে প্রস্তত হয়ে আছে।এজন্যেই মনে হলো কথাটা যে ঘোড়ার পিঠে বেশ দামী চামড়ার একটা জিন সাজানো,যা আবার এমন ভাবে চিহ্নিত যেন কোন নামীদামী কেউ রেখে গেছে।

হওয়ার কথা।হতে পারে বিরাট এক তলোয়ার নিয়ে পাশের থেকে কেউ আসবে।
বোঝাই যাচ্ছে কোন এক নামকরা ওস্তাদের গোপনে তুলিতে ছবিটা এনিষ্টের জন্যে করা।রাতের অন্ধকারে শিল্পী এসে যখন ছবিটা আঁকলো,তখন তার কাছে ঘোড়াটা অন্য কোন গল্পের একটা অংশ মাত্র।হয়তো শিল্পীর কাছে এনিষ্টের নির্দেশ ছিল ছবিটা ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরনে আঁকার জন্যে, ‘আরোহী কে সেটা ভুলে যাও,ঘোড়াটার পাশে একটা গাছ বা ঝোপ কিছু একটা এঁকে দাও,তবে হিসেক করে আঁকবে’।
শিল্পী তার যথাযথ নিয়মে যে ভাবে আঁকে সেটা ভুলে গিয়ে মোমবাতির আলোয় একটা ঘোড়ার ছবি এঁকে গেছে।এনিষ্টে তাকে টাকাপয়সা দিতে কার্পন্য করেনি নিঃসন্দেহে,তা ছাড়া এ ধরণের ছবির নতুন একটা চমৎকারিত্বও আছে।শিল্পীর জানার উপায় ছিল না কোন গল্পের জন্যে ছবিটা,তুলির আঁচড়ের ঝড় শেষ করে সে ফিরে গেছে।এনিষ্টের দেখানো ছবিগুলো কিছুটা ভেনিসিয়ান কিছুটা পারসী পদ্ধতিতে আঁকা,ও গুলো নিয়ে আমাকে গল্প লিখতে হবে।সেকুরেকে পেতে হলে গল্পগুলো আমাকে লিখতেই হবে,তবে এখন আমার মনে যা আসছে আর কিছু না কফির দোকানের গল্পকথকের কথাগুলো শুধু।


জানি আমাকে সবাই খুনী বলবে

ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ করে জানান দিল,সন্ধ্যা হয়ে গেছে।নামজের আজান তখনও হয়নি,টেবিলের পাশের মোমবাতিটা জ্বেলে দিলাম।স্মৃতির পাতা থেকে হাসান পাশার উপহারের কালি আর কাগজে আফিমখোরের ছবি আঁকছিলাম,অন্যান্য দিনের মত রাস্তাই থেকে কেউ আমাকে ডাকছিল।কোন না কোন ভাবে ওদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি,
এমন কি দরজা জানালায় পেরেক দিয়ে বন্ধ করতেও কার্পন্য করিনি।

এই যে বইটা শেষ করছি,সেটা গালাতা থেকে আসা এক আর্মেনিয়ানের জন্য,ভোর বেলায় কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই এসে আমাকে কাজটা দিয়ে গেছে।মানুষটা দোভাষী আবার গাইড,তার দরকার ভেনিসিয়ান ষ্টাইলে বিভিন্ন ধরণের পোষাকের একটা বই,লোকটা মাছের বাজারের মত দরদাম করতে ছাড়েনি।শেষে ২০ রুপোর মোহরে নিম্নমানের একটা বই করে দিতে রাজী হলাম।মাগরেবের নামাজের আগে একবারে বসেই ইস্তাম্বুলের লোকজনের প্রায় কুড়িটা ছবি আঁকলাম,যার বিষয়বস্তর প্রাধান্য ছিল পোষাক।আঁকলাম প্রতিপত্তিশালী শেখ,প্রাসাদের কুলি,মোল্লাদের ছবি,জমাদার,দরবেশ,ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া সৈন্য,কাজী,
কসাই,জল্লাদ কোনটাই বাদ পড়েনি-জল্লাদদের ফাঁসি দেয়ার ছবি্র বরাবরই ভাল কাটতি-একটা ছবি ছিল ফকিরের,হাম্মামের পথের এক মহিলার,আবার এক আফিমখোরের।এ ধরণের বই এর ছবি আঁকতে আঁকতে,বেশ একঘেয়েমী হয়ে গেছে বলা যায় অনেকটা একটা খেলার মত,কাজীর ছবিটা আমি কাগজ থেকে কলম না তুলেই আঁকলাম,ফকিরের ছবিটা আঁকলাম চোখ বন্ধ করে।

শিল্পী,কবি,বিদ্রোহী,দুঃখে ভঁরা মনের মানুষদের এটা জানাই যে মাগরেবের নামাজের সময়,জিন পরীরা সবাই উত্তেজিত ডাক দেয়,ভেতর থেকে কেউ যেন ডাক দিয়ে বলে ‘বের হয়ে যাও।ছুটে যাও,ঐ অন্ধকারে,দুঃখ,কান্নার রাজ্যে’।আমার অনেক ছবি আঁকাই হয়তো ঐ সব অশরীরী শয়তানেরা কম সাহায্য করেনি।ঐ জঘন্য চরিত্রটাকে খুন করার সাতদিন পরে আমি এখন আমার মাঝের শয়তানদের আর আটকে রাখতে পারছি না,তাদের রাগ আর ক্ষমতা এখন আমার দখলের বাইরে,ভাবছি বাইরে গেলে হয়তো তাদের মনটা ঠান্ডা হতে পারে।
এটা ভেবে রাতের অন্ধকারে আমি অযথাই নির্জন রাতে হেঁটে বেড়াই যেখানে সেখানে,বরফ,কাদামাটিতে ঢাকা,পাহাড়ী পিছল রাস্তায়।রাতের অন্ধকারে নিঝুম শহরে যখন একা ঘুরে বেড়াই,আমার আত্মাটা যেন পড়ে থাকে পেছনে,পাশের দেয়ালগুলোতে পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি আমাকে ভঁয়ের রাজ্য থেকে বাইরে টেনে নিয়ে আসে।

হাঁটতে হাঁটতে শহরের একটা পরিত্যাক্ত এলাকায় পৌছালাম,খুব একটা কারও আসা যাওয়া নেই সেখানে,এমনকি জিন ভূতেরাও হয়তো ভঁয়ে যায় না সেখানে।শোনা যায়,এই এলাকার অর্ধেক লোক মারা গেছে পারস্যের সাথে যুদ্ধে আর বাকীরা চলে গেছে অন্য এলাকায়,এখন অনেকের কাছে এটা একটা অভিশপ্ত এলাকা,আমি অবশ্য এ ধরণের কুসংষ্কারে বিশ্বাস করি না।যে অভিশাপের কারণে এই এলাকার লোকজন সাফাভিদ যুদ্ধে মারা গেছে,সেটা বছর চল্লিশ কালেন্দার দরবেশের আখড়া বন্ধ করে দেয়ার জন্যে।
আমি ব্লুবেরী,তেজপাতার গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম,ওদের গন্ধে সুন্দর একটা আমেজ আছে।ভেঙ্গে পড়া চিমনী আর জানালার খিড়কির মাঝের দেয়ালের বোর্ডটা সোজা করে দিয়ে এগিয়ে গেলাম।একশ পুরোনো আগরবাতি,শেওলার গন্ধ আমাকে টেনে নিয়ে গেল কোন সে পুরোনোয়,কান্না ভঁরে ছিল আমার চোখ দুটো।

জোর গলায় বলছি আমি আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভঁয় করিনা,যা বিচার হবে সেটা আল্লাহর কাছে,এই পৃথিবীর বিচারের কোন দাম নাই।আমি ভঁয় পাই কেয়ামতের দিনের কথা ভেবে যে অত্যাচার আর যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে পাপীদেরকে,পবিত্র কোরানে
বলা আছে সবকিছু।পুরোনো বইগুলো যা খুব একটা আমার হাতে পড়ে না,বিভিন্ন রং এ সাজানো দোজখের অতাচারের দৃশ্যগুলো,সহজ,শিশুসুলভ কৃতজ্ঞতায় গরুর চামড়ায় আরবীয় শিল্পীদের হাতে আঁকা,আর যে কারণেই হোক চীনা আর মঙ্গোলীয়ান শিল্পীদের হাতের আঁকা দানবদের অত্যাচারের দৃশ্য,আঁকতে চাই নি আমি,রাতের যাত্রা সেই ৩৩ নম্বর সুরায় কি বলে?এটা তো আল্লাহর আদেশ কোন কারণ ছাড়া আরেকজনের জীবন কেউ নিতে পারে না।ঠিক আছে তাহলে বলেই ফেলিঃএই শয়তান যাকে আমি দোজখে পাঠালাম,একজন কাফের,যার হত্যা যুক্তিযুক্ত,আর পাথর দিয়ে তার মাথা চুরমার করে দেয়াও ছিল ঠিক সে হিসাবে।
ঐ লোকটা সুলতানের যে বইটা নিয়ে আমরা গোপনে কাজ করে যাচ্ছিলাম,তার রীতিমত বদনাম করতে ছাড়েনি।আমি যদি তার মুখ বন্ধ না করতাম,তা হলে সে এনিষ্টে এফেন্দী,অন্যান্য শিল্পীদের,এমন কি ওস্তাদ ওসমানকেও কাফের প্রমান করার জন্যে না জানি কি করতো,আর ইরজুরুমের হোজা যা করতো সেটা বলার অপেক্ষাই রাখে না।অযথাই এরা অপবাদ দিচ্ছে শিল্পীরা ইসলাম বিরোধী কাজ করছে,সেটা মিথ্যা হলেও ইরুজুরুমের এই শয়তানের শিষ্যরা শুধু শিল্পীদের কাজ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করবে না,হয়তো সুলতানকেও বাধ্য করবে এই ছবি আঁকা,কালিগ্রাফীর ষ্টুডিও বন্ধ করতে।অন্যান্য দিনের মত ঝাড়ু দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করলাম,আজকে মনে হলো আমি সত্যিই আল্লাহর এক বিশ্বাসী ভক্ত।আমার বিশ্বাস আল্লাহ আমাকে এতদিনের নামাজ রোজার সওয়াব থেকে বঞ্চিত করবে না।এতই শীত ছিল সেদিন যে বরফের শেয়ালগুলোও ভঁয়ে পায়খানা করে ফেলবে,আর সেটা যেন আমার হাড়ে হাড়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করছিলাম।

এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নতুন আরেক এলাকায়,জানি না আমার মনে কি সব চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে,নির্জন দরবেশের আখড়া,ছেড়ে আমি তখন পাইন গাছ সাজানো শহরের আরেক এলাকায়।
যতই যেখানেই যাই না কেন,অদ্ভুত চিন্তাগুলো আমাকে ছেড়ে যায়নি,পোকার মত ভেতর থেকে আমাকে কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে।হয়তো আমি যদি এই কথাগুলো বলি তবে অনেকের মনটা হাল্কা হতে পারেঃওকে বলা যায়, ‘দুশ্চরিত্র অপবাদী’, ‘হতভাগা জায়িফ এফেন্দী’-যাই হউক না কেন পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানুষটার মুখোশ খুলে দেয়ার দায়িত্ব আমার।লোকটা এনিষ্টের সমন্ধে যা তা বলছিল,শুধু তাই না সে এটাও বলতে ছাড়েনি এনিষ্টে একজন কাফের,না হলে কেন সে কাফেরদের পদ্ধতিতে কেন ছবি আঁকবে,তা ছাড়াও এনিষ্টে নাকি ইসলাম ধর্মবিরোধী ছবি এঁকে সমগ্র মুসলমান সমাজের অপমান করছে।সপ্তাহ তিনেক পরে এনিষ্টে এফেন্দী আমাকে একটা ঘোড়া,মোহর,আর ফেরেশতা আজরাইলকে নিয়ে,বিশেষ কোন মাপ ছাড়া ছবিগুলো আঁকতে বললো,বলা যায় যে ভাবে ভেনিসের শিল্পীরা ছবি আঁকে।

এনিষ্টে ছবিগুলো,বই এর পাতার অন্যান্য অংশগুলো ঢাকা থাকতো এমন ভাবে,অনেকটা যেন শিল্পীদের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখা।আমি জানার ইচ্ছা শেষ ছবিটায় এনিষ্টে এফেন্দীর বিষয়টা কি ছিল?অবশ্য সেটা জিজ্ঞাসা করলে,এনিষ্টের সন্দেহ হতে পারে যে আমিই জারিফ এফেন্দীর সেই খুনী।অবশ্য এটাও হতে পারে যে এনিষ্টে বলতে পারে,জারিফ এফেন্দীর এফেন্দীর সন্দেহটা ছিল যথাযথ।মাঝে মাঝে মনে হয় আমি এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করবো,যেন সেটা আমার মনের প্রশ্ন,জারিফ এফেন্দীর সন্দেহের কোন কথা না।সে যাই হউক এটা কোন সান্তনা না।আমার পা দুটো যা আমার বুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি জোরে দৌড়ায়,আমাকে নিয়ে গেল এনিষ্টের বাড়ীর রাস্তায়।আমি হাঁটু গেড়ে বসে দূরের থেকে বাড়ীটা দেখছিলাম।
গাছপালার মাঝে ধনীলোকের একটা দোতলা বাড়ী।আমার জানা নাই সেকুরের ঘরটা ঠিক কোন দিকে।অনেকটা যেন তাব্রিজে শাহ তামাসাপের ছবি আঁকার মত,ভাগ ভাগ করে তুলে ধরা।বাড়ীটাকে চাকু দিয়ে দুই ভাগ করলে,কোথায় খুঁজে পাব আমার সেকুরেকে?
বাড়ীর দরজা খুলে সিয়াহ বের হয়ে গেল,মনে হলো এনিষ্টে স্নেহের চোখে দেখছিল সিয়াহর চলে যাওয়া।এমন কি আমার বোকা মনটাও যা নানান আকাশ ছোঁয়ায় চিন্তায় ভেসে যায় আমার দেখার তিনটা বিশ্লেষন করলোঃ

প্রথমঃসিয়াহ একজন সস্তা দরের শিল্পী তার কাছে ভঁয় পাওয়ার তেমন কারণ নাই,হয়তো তাই সিয়াহকে দিয়েই এনিষ্টে তার বইটা শেষ করবে।
দ্বিতীয়ঃসুন্দরী সেকুরে শেষে বিয়ে করবে সিয়াহকে।
তৃতীয়ঃ ঐ হতভাগা জারিফ এফেন্দীর কথা যদি সত্যি হয়,তা হলে তো আমি তাকে কারণ ছাড়াই খুন করলাম।
এ ধরনের অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্ক যা বলে দেয় অবুঝ মনটা কোন ভাবেই সেটা মেনে নিতে চায় না,আর সারা শরীর বিদ্রোহ করে মনের বিরুদ্ধে।প্রথমে আমার মন বিদ্রোহ করে বললো,আমার বিশ্লেষনেই আমি অযথাই একজনের খুনী।আমার পা দুটো যা আমার মস্তিষ্কের আগে ছুটে যায়,ছুটে গেল সিয়াহর পেছন পেছন।
কয়েকটা গলির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবছিলাম,কত সহজেই না সিয়াহকে খুন করা যায়,আমার সামনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে,আর সিয়াহকে খুন করলে,আমার প্রথম দুটো বিশ্লেষন ছুড়ে দেলা যাবে।তা হলে আমি জারিফ এফেন্দীর মাথাটা অযথাই চুরমার করে দেইনি।যদি গোটা পাঁচ দশ পা ছূটে সিয়াহর কাছে পৌঁছে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করি,সব কিছু বদলে যাবে,এনিষ্টে এফেন্দী আমাকে ডেকে বইটা শেষ করতে বলবে।কিন্ত আমার মনের বদ্ধ সুর আমাকে বলে যাচ্ছিল,জারিফ এফেন্দী যাকে আমি খুন করেছি সত্যিই একজন মিথ্যে অপবাদী।তাই যদি হয় তবে আমি তাকে কারণ ছাড়া মেরে ফেলিনি,
এনিষ্টেরও আমার কাছে লুকানোর কিছু থাকবে না।
এখন আমি সিয়াহকে আমার সামনে হেঁটে যেতে দেখে যা বুঝলাম,কোন কিছুই ঘটবে না,আর।সিয়াহ এফেন্দী আমার স্বপ্নের সুন্দরী সেকুরেকে সামনে দিয়ে সুন্দর পোষাকে সরিয়া মতে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।

আমি সিয়াহর হাঁটা দেখছিলাম,তার কাধ দুটো একটা ছন্দে বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘আমাকে দেখ,আমাকে দেখ’,আর সেটাতে আমার মনে তার জন্যে অদ্ভুত একটা ঘৃনার পর্ব তৈরী হলো।সিয়াহর মত মানুষ যারা কোন মানসিক যন্রনায় ভোগে না,ভাবে সারা পৃথিবী তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে,অনেকটা যেন সুলতানের প্রতিটা দরজা খুলে ঢোকার সময় মাথায় শিরস্ত্রান পরা সবাইকে মাথা নীচু করে বসে থাকতে হয়।আমরা দুজন একই মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি,সে আমার সামনে,আমরা যখন ইস্তাম্বুলের এই পেচানো ঘোরানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।হেঁটে গেলাম দুই ভাই এর মত নেড়ী কুত্তাদের পাশ দিয়ে,পরিত্যাক্ত বাড়ী ঘর ফেলে,যেখানে হয়তো জিন পরীরা থাকে,মসজিদ যেখানে ফেরেশতারা আছে,পাশে পাইন গাছ শব্দ করে যেন মৃত আত্মাদের সাথে কথা বলছে।কবরস্থান যেখানে ভুতে ভর্তি,দূরে শয়তান মানুষেরা বসে আছে,সারির পর সারি দোকান,আস্তাবল,দরবেশের বাড়ী,মোমবাতির কারখানা,চামড়ার কারখানা,পাথরের দেয়াল,মনে হলো আমি তো তার পেছন পেছন যাচ্ছি না,আমি তাকে অনুকরণ করছি।

(১৪)

কিছুক্ষন পরে এনিষ্টে নতুন একটা ছবি দেখানো আরম্ভ করলো,সাথে রজনীগন্ধার সুবাসে মোড়ানো ছোট্ট একটা কাগজ,খুলে দেখি শুধু সাদা একটা কাগজ।কিছুটা হতভম্ব,বারবার কাগজটা ঘুরিয়ে দেখছিলাম কাগজটা।‘একটা জানালা’,এনিষ্টে বললো, ‘একেকটা দৃষ্টিকোন থেকে পৃথিবীকে একেকভাবে দেখা যায়,তোমার হাতে তুমি যা ধরে আছ সেটা একটা জানালা’।‘এটা তো কিছুই না এনিষ্টে এফেন্দী’,আমি বললাম,দোমড়ানো কাগজটা নাকের কাছে নিয়ে আমি তার গন্ধটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম।
দুপুরের খাবারের পর ঘরের পেশাবের গামলা ব্যাবহার না করে আঙ্গিনার বাইরের গামলাটা ব্যাবহার করতে গেলাম,শীতের ধাক্কায় আমি জড়সড় তখন,দেখি সেভকেত তার দাদুর গরম পেশাবের গামলাটা পাশে রেখে সে চলে গেল।
‘তুমি কি কোন দিন মরা বিড়াল দেখেছ’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো,তার নাকটা মায়ের মতই টিকোলো।দোতলার যাদু রাজ্যের ঘরটার দরজাটা বন্ধ যেখানে সেদিন সেকুরেকে
দেখলাম এতগুলো বছর পরে।
‘না’।
‘চল দেখবে ইহুদী বাড়ীতে ঝুলানো বিড়ালটা’?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে রাস্তায় চলে গেল সেভকেত,বরফ কাদামাটি দিয়ে আমরা
পৌছালাম জঙ্গল ভঁরা একটা বাগানে,ভেজা পচা পাতা ছড়ানো ছিটানো চারপাশে,জায়গায় জায়গায় শ্যাওলা জমে আছে কিছুটা,কাজুবাদামের কটা গাছের পেছনে ছিল পুরোনো ভেঙ্গে পড়া একটা বাড়ী।হলুদ দরজা দিয়ে সেভকেত ভেতরে ঢুকলো,ভাবভঙ্গীতে বোঝা গেল তার বেশ যাতায়াত আছে সেখানে।
একেবারেই খালি বাড়ীটা,তবে ভেতরে বেশ গরম,মনে হয় হয়তো যেন কেউ না কেউ সেখানে থাকে।
‘কার বাড়ী’?আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ইহুদীদের।বুড়ো ইহুদী মারা যাওয়ার পর,ছেলেমেয়ে বৌ সবাই চলে গেছে,বাড়ীটা ফল ব্যাবসায়ী ইহুদীদের পাড়ায়,বিক্রি করার দায়িত্ব দিয়ে গেছে এসথার ফেরীওয়ালাকে’,বলে সেভকেত ভেতরে ঢুকে দেখে বললো, ‘বিড়ালটা দেখছি না’।
‘মরা বিড়াল যাবেই বা কোথায়’?
‘তুমি জান না,দাদু বলে মরা মানুষ ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায়’।
‘না মৃতেরা নিজেরা না,তাদের আত্মা হয়তো বা’,আমি বললাম।
‘তুমি কি ভাবে জান’?সেভকেতের হাতে ছিল পেশাবের গামলাটা।
‘আমি জানি।তুমি কি প্রতিদিন এখানে আস’?
‘আমার মা আসে এসথারের সাথে।মরা মানুষেরা কবর থেকে উঠে আসে রাতের বেলায়,আমি অবশ্য ভঁয় পাই না।তুমি কি কোনদিন মানুষ খুন করেছ’?
‘হ্যা’।
‘কয়জন’?
‘বেশী না,দুজন’?
‘তলোয়ার দিয়ে’?
‘হ্যা,তলোয়ার দিয়েই’।
‘তাদের আত্মা কি ঘুরে বেড়াচ্ছে’?
‘ঠিক জানি না,তবে বই এ যে ভাবে লেখা আছে,তাতে মনে হয় তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে’।
‘হাসান চাচার একটা লাল তলোয়ার আছে,এত ধার যে সেটাতে ছুলেই আঙ্গুল কেটে যায়।তার একটা চাকুও আছে,হাতলটায় রুবী লাগানো কয়েকটা।তুমিই কি আমার বাবাকে খুন করেছ’?
আমি মাথা নাড়ালাম,সেটায় হ্যা বা না যে কোন কিছু একটা ভেবে নেয়া যায়।‘তুমি কি ভাবে জান তোমার বাবা মারা গেছে’?
‘আমার মা গতকাল বললো,বাবা আর ফিরে আসবে না।মা নাকি স্বপ্নে দেখেছে’।
আমাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে সুযোগ পেলে আমরা যে কোন কিছু করতে পারি,আর তার জন্যে যুক্তি দাঁড় করানোও তেমন একটা অসম্ভব কিছু না।এনিষ্টের বাড়ীতে ফিরে ছবিগুলো আবার মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম।
এনিষ্টে আমাকে যে ছবিগুলো দেখালো সেগুলো নিয়ে কিছু বলি,যেমন ঘোড়ার ছবিটায় আশেপাশে কোন মানুষ নাই,চারপাশটা একেবারেই ফাঁকা।তবুও কেন জানি মনে হলো ওটা শুধু একটা ঘোড়ার ছবি না।হ্যা,ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে,হয়তো সহিস পাশের ঝোপে ঘোড়াতে ওঠার জন্যে প্রস্তত হয়ে আছে।এজন্যেই মনে হলো কথাটা যে ঘোড়ার পিঠে বেশ দামী চামড়ার একটা জিন সাজানো,যা আবার এমন ভাবে চিহ্নিত যেন কোন নামীদামী কেউ রেখে গেছে।

হওয়ার কথা।হতে পারে বিরাট এক তলোয়ার নিয়ে পাশের থেকে কেউ আসবে।
বোঝাই যাচ্ছে কোন এক নামকরা ওস্তাদের গোপনে তুলিতে ছবিটা এনিষ্টের জন্যে করা।রাতের অন্ধকারে শিল্পী এসে যখন ছবিটা আঁকলো,তখন তার কাছে ঘোড়াটা অন্য কোন গল্পের একটা অংশ মাত্র।হয়তো শিল্পীর কাছে এনিষ্টের নির্দেশ ছিল ছবিটা ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরনে আঁকার জন্যে, ‘আরোহী কে সেটা ভুলে যাও,ঘোড়াটার পাশে একটা গাছ বা ঝোপ কিছু একটা এঁকে দাও,তবে হিসেক করে আঁকবে’।
শিল্পী তার যথাযথ নিয়মে যে ভাবে আঁকে সেটা ভুলে গিয়ে মোমবাতির আলোয় একটা ঘোড়ার ছবি এঁকে গেছে।এনিষ্টে তাকে টাকাপয়সা দিতে কার্পন্য করেনি নিঃসন্দেহে,তা ছাড়া এ ধরণের ছবির নতুন একটা চমৎকারিত্বও আছে।শিল্পীর জানার উপায় ছিল না কোন গল্পের জন্যে ছবিটা,তুলির আঁচড়ের ঝড় শেষ করে সে ফিরে গেছে।এনিষ্টের দেখানো ছবিগুলো কিছুটা ভেনিসিয়ান কিছুটা পারসী পদ্ধতিতে আঁকা,ও গুলো নিয়ে আমাকে গল্প লিখতে হবে।সেকুরেকে পেতে হলে গল্পগুলো আমাকে লিখতেই হবে,তবে এখন আমার মনে যা আসছে আর কিছু না কফির দোকানের গল্পকথকের কথাগুলো শুধু।


জানি আমাকে সবাই খুনী বলবে

ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ করে জানান দিল,সন্ধ্যা হয়ে গেছে।নামজের আজান তখনও হয়নি,টেবিলের পাশের মোমবাতিটা জ্বেলে দিলাম।স্মৃতির পাতা থেকে হাসান পাশার উপহারের কালি আর কাগজে আফিমখোরের ছবি আঁকছিলাম,অন্যান্য দিনের মত রাস্তাই থেকে কেউ আমাকে ডাকছিল।কোন না কোন ভাবে ওদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি,
এমন কি দরজা জানালায় পেরেক দিয়ে বন্ধ করতেও কার্পন্য করিনি।

এই যে বইটা শেষ করছি,সেটা গালাতা থেকে আসা এক আর্মেনিয়ানের জন্য,ভোর বেলায় কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই এসে আমাকে কাজটা দিয়ে গেছে।মানুষটা দোভাষী আবার গাইড,তার দরকার ভেনিসিয়ান ষ্টাইলে বিভিন্ন ধরণের পোষাকের একটা বই,লোকটা মাছের বাজারের মত দরদাম করতে ছাড়েনি।শেষে ২০ রুপোর মোহরে নিম্নমানের একটা বই করে দিতে রাজী হলাম।মাগরেবের নামাজের আগে একবারে বসেই ইস্তাম্বুলের লোকজনের প্রায় কুড়িটা ছবি আঁকলাম,যার বিষয়বস্তর প্রাধান্য ছিল পোষাক।আঁকলাম প্রতিপত্তিশালী শেখ,প্রাসাদের কুলি,মোল্লাদের ছবি,জমাদার,দরবেশ,ঘোড়ায় চড়ে যাওয়া সৈন্য,কাজী,
কসাই,জল্লাদ কোনটাই বাদ পড়েনি-জল্লাদদের ফাঁসি দেয়ার ছবি্র বরাবরই ভাল কাটতি-একটা ছবি ছিল ফকিরের,হাম্মামের পথের এক মহিলার,আবার এক আফিমখোরের।এ ধরণের বই এর ছবি আঁকতে আঁকতে,বেশ একঘেয়েমী হয়ে গেছে বলা যায় অনেকটা একটা খেলার মত,কাজীর ছবিটা আমি কাগজ থেকে কলম না তুলেই আঁকলাম,ফকিরের ছবিটা আঁকলাম চোখ বন্ধ করে।

শিল্পী,কবি,বিদ্রোহী,দুঃখে ভঁরা মনের মানুষদের এটা জানাই যে মাগরেবের নামাজের সময়,জিন পরীরা সবাই উত্তেজিত ডাক দেয়,ভেতর থেকে কেউ যেন ডাক দিয়ে বলে ‘বের হয়ে যাও।ছুটে যাও,ঐ অন্ধকারে,দুঃখ,কান্নার রাজ্যে’।আমার অনেক ছবি আঁকাই হয়তো ঐ সব অশরীরী শয়তানেরা কম সাহায্য করেনি।ঐ জঘন্য চরিত্রটাকে খুন করার সাতদিন পরে আমি এখন আমার মাঝের শয়তানদের আর আটকে রাখতে পারছি না,তাদের রাগ আর ক্ষমতা এখন আমার দখলের বাইরে,ভাবছি বাইরে গেলে হয়তো তাদের মনটা ঠান্ডা হতে পারে।
এটা ভেবে রাতের অন্ধকারে আমি অযথাই নির্জন রাতে হেঁটে বেড়াই যেখানে সেখানে,বরফ,কাদামাটিতে ঢাকা,পাহাড়ী পিছল রাস্তায়।রাতের অন্ধকারে নিঝুম শহরে যখন একা ঘুরে বেড়াই,আমার আত্মাটা যেন পড়ে থাকে পেছনে,পাশের দেয়ালগুলোতে পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি আমাকে ভঁয়ের রাজ্য থেকে বাইরে টেনে নিয়ে আসে।

হাঁটতে হাঁটতে শহরের একটা পরিত্যাক্ত এলাকায় পৌছালাম,খুব একটা কারও আসা যাওয়া নেই সেখানে,এমনকি জিন ভূতেরাও হয়তো ভঁয়ে যায় না সেখানে।শোনা যায়,এই এলাকার অর্ধেক লোক মারা গেছে পারস্যের সাথে যুদ্ধে আর বাকীরা চলে গেছে অন্য এলাকায়,এখন অনেকের কাছে এটা একটা অভিশপ্ত এলাকা,আমি অবশ্য এ ধরণের কুসংষ্কারে বিশ্বাস করি না।যে অভিশাপের কারণে এই এলাকার লোকজন সাফাভিদ যুদ্ধে মারা গেছে,সেটা বছর চল্লিশ কালেন্দার দরবেশের আখড়া বন্ধ করে দেয়ার জন্যে।
আমি ব্লুবেরী,তেজপাতার গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম,ওদের গন্ধে সুন্দর একটা আমেজ আছে।ভেঙ্গে পড়া চিমনী আর জানালার খিড়কির মাঝের দেয়ালের বোর্ডটা সোজা করে দিয়ে এগিয়ে গেলাম।একশ পুরোনো আগরবাতি,শেওলার গন্ধ আমাকে টেনে নিয়ে গেল কোন সে পুরোনোয়,কান্না ভঁরে ছিল আমার চোখ দুটো।

জোর গলায় বলছি আমি আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভঁয় করিনা,যা বিচার হবে সেটা আল্লাহর কাছে,এই পৃথিবীর বিচারের কোন দাম নাই।আমি ভঁয় পাই কেয়ামতের দিনের কথা ভেবে যে অত্যাচার আর যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে পাপীদেরকে,পবিত্র কোরানে
বলা আছে সবকিছু।পুরোনো বইগুলো যা খুব একটা আমার হাতে পড়ে না,বিভিন্ন রং এ সাজানো দোজখের অতাচারের দৃশ্যগুলো,সহজ,শিশুসুলভ কৃতজ্ঞতায় গরুর চামড়ায় আরবীয় শিল্পীদের হাতে আঁকা,আর যে কারণেই হোক চীনা আর মঙ্গোলীয়ান শিল্পীদের হাতের আঁকা দানবদের অত্যাচারের দৃশ্য,আঁকতে চাই নি আমি,রাতের যাত্রা সেই ৩৩ নম্বর সুরায় কি বলে?এটা তো আল্লাহর আদেশ কোন কারণ ছাড়া আরেকজনের জীবন কেউ নিতে পারে না।ঠিক আছে তাহলে বলেই ফেলিঃএই শয়তান যাকে আমি দোজখে পাঠালাম,একজন কাফের,যার হত্যা যুক্তিযুক্ত,আর পাথর দিয়ে তার মাথা চুরমার করে দেয়াও ছিল ঠিক সে হিসাবে।
ঐ লোকটা সুলতানের যে বইটা নিয়ে আমরা গোপনে কাজ করে যাচ্ছিলাম,তার রীতিমত বদনাম করতে ছাড়েনি।আমি যদি তার মুখ বন্ধ না করতাম,তা হলে সে এনিষ্টে এফেন্দী,অন্যান্য শিল্পীদের,এমন কি ওস্তাদ ওসমানকেও কাফের প্রমান করার জন্যে না জানি কি করতো,আর ইরজুরুমের হোজা যা করতো সেটা বলার অপেক্ষাই রাখে না।অযথাই এরা অপবাদ দিচ্ছে শিল্পীরা ইসলাম বিরোধী কাজ করছে,সেটা মিথ্যা হলেও ইরুজুরুমের এই শয়তানের শিষ্যরা শুধু শিল্পীদের কাজ বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করবে না,হয়তো সুলতানকেও বাধ্য করবে এই ছবি আঁকা,কালিগ্রাফীর ষ্টুডিও বন্ধ করতে।অন্যান্য দিনের মত ঝাড়ু দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করলাম,আজকে মনে হলো আমি সত্যিই আল্লাহর এক বিশ্বাসী ভক্ত।আমার বিশ্বাস আল্লাহ আমাকে এতদিনের নামাজ রোজার সওয়াব থেকে বঞ্চিত করবে না।এতই শীত ছিল সেদিন যে বরফের শেয়ালগুলোও ভঁয়ে পায়খানা করে ফেলবে,আর সেটা যেন আমার হাড়ে হাড়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করছিলাম।

এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নতুন আরেক এলাকায়,জানি না আমার মনে কি সব চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে,নির্জন দরবেশের আখড়া,ছেড়ে আমি তখন পাইন গাছ সাজানো শহরের আরেক এলাকায়।
যতই যেখানেই যাই না কেন,অদ্ভুত চিন্তাগুলো আমাকে ছেড়ে যায়নি,পোকার মত ভেতর থেকে আমাকে কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে।হয়তো আমি যদি এই কথাগুলো বলি তবে অনেকের মনটা হাল্কা হতে পারেঃওকে বলা যায়, ‘দুশ্চরিত্র অপবাদী’, ‘হতভাগা জায়িফ এফেন্দী’-যাই হউক না কেন পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানুষটার মুখোশ খুলে দেয়ার দায়িত্ব আমার।লোকটা এনিষ্টের সমন্ধে যা তা বলছিল,শুধু তাই না সে এটাও বলতে ছাড়েনি এনিষ্টে একজন কাফের,না হলে কেন সে কাফেরদের পদ্ধতিতে কেন ছবি আঁকবে,তা ছাড়াও এনিষ্টে নাকি ইসলাম ধর্মবিরোধী ছবি এঁকে সমগ্র মুসলমান সমাজের অপমান করছে।সপ্তাহ তিনেক পরে এনিষ্টে এফেন্দী আমাকে একটা ঘোড়া,মোহর,আর ফেরেশতা আজরাইলকে নিয়ে,বিশেষ কোন মাপ ছাড়া ছবিগুলো আঁকতে বললো,বলা যায় যে ভাবে ভেনিসের শিল্পীরা ছবি আঁকে।

এনিষ্টে ছবিগুলো,বই এর পাতার অন্যান্য অংশগুলো ঢাকা থাকতো এমন ভাবে,অনেকটা যেন শিল্পীদের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখা।আমি জানার ইচ্ছা শেষ ছবিটায় এনিষ্টে এফেন্দীর বিষয়টা কি ছিল?অবশ্য সেটা জিজ্ঞাসা করলে,এনিষ্টের সন্দেহ হতে পারে যে আমিই জারিফ এফেন্দীর সেই খুনী।অবশ্য এটাও হতে পারে যে এনিষ্টে বলতে পারে,জারিফ এফেন্দীর এফেন্দীর সন্দেহটা ছিল যথাযথ।মাঝে মাঝে মনে হয় আমি এমন ভাবে জিজ্ঞাসা করবো,যেন সেটা আমার মনের প্রশ্ন,জারিফ এফেন্দীর সন্দেহের কোন কথা না।সে যাই হউক এটা কোন সান্তনা না।আমার পা দুটো যা আমার বুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি জোরে দৌড়ায়,আমাকে নিয়ে গেল এনিষ্টের বাড়ীর রাস্তায়।আমি হাঁটু গেড়ে বসে দূরের থেকে বাড়ীটা দেখছিলাম।
গাছপালার মাঝে ধনীলোকের একটা দোতলা বাড়ী।আমার জানা নাই সেকুরের ঘরটা ঠিক কোন দিকে।অনেকটা যেন তাব্রিজে শাহ তামাসাপের ছবি আঁকার মত,ভাগ ভাগ করে তুলে ধরা।বাড়ীটাকে চাকু দিয়ে দুই ভাগ করলে,কোথায় খুঁজে পাব আমার সেকুরেকে?
বাড়ীর দরজা খুলে সিয়াহ বের হয়ে গেল,মনে হলো এনিষ্টে স্নেহের চোখে দেখছিল সিয়াহর চলে যাওয়া।এমন কি আমার বোকা মনটাও যা নানান আকাশ ছোঁয়ায় চিন্তায় ভেসে যায় আমার দেখার তিনটা বিশ্লেষন করলোঃ

প্রথমঃসিয়াহ একজন সস্তা দরের শিল্পী তার কাছে ভঁয় পাওয়ার তেমন কারণ নাই,হয়তো তাই সিয়াহকে দিয়েই এনিষ্টে তার বইটা শেষ করবে।
দ্বিতীয়ঃসুন্দরী সেকুরে শেষে বিয়ে করবে সিয়াহকে।
তৃতীয়ঃ ঐ হতভাগা জারিফ এফেন্দীর কথা যদি সত্যি হয়,তা হলে তো আমি তাকে কারণ ছাড়াই খুন করলাম।
এ ধরনের অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্ক যা বলে দেয় অবুঝ মনটা কোন ভাবেই সেটা মেনে নিতে চায় না,আর সারা শরীর বিদ্রোহ করে মনের বিরুদ্ধে।প্রথমে আমার মন বিদ্রোহ করে বললো,আমার বিশ্লেষনেই আমি অযথাই একজনের খুনী।আমার পা দুটো যা আমার মস্তিষ্কের আগে ছুটে যায়,ছুটে গেল সিয়াহর পেছন পেছন।
কয়েকটা গলির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবছিলাম,কত সহজেই না সিয়াহকে খুন করা যায়,আমার সামনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে,আর সিয়াহকে খুন করলে,আমার প্রথম দুটো বিশ্লেষন ছুড়ে দেলা যাবে।তা হলে আমি জারিফ এফেন্দীর মাথাটা অযথাই চুরমার করে দেইনি।যদি গোটা পাঁচ দশ পা ছূটে সিয়াহর কাছে পৌঁছে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তার মাথায় আঘাত করি,সব কিছু বদলে যাবে,এনিষ্টে এফেন্দী আমাকে ডেকে বইটা শেষ করতে বলবে।কিন্ত আমার মনের বদ্ধ সুর আমাকে বলে যাচ্ছিল,জারিফ এফেন্দী যাকে আমি খুন করেছি সত্যিই একজন মিথ্যে অপবাদী।তাই যদি হয় তবে আমি তাকে কারণ ছাড়া মেরে ফেলিনি,
এনিষ্টেরও আমার কাছে লুকানোর কিছু থাকবে না।
এখন আমি সিয়াহকে আমার সামনে হেঁটে যেতে দেখে যা বুঝলাম,কোন কিছুই ঘটবে না,আর।সিয়াহ এফেন্দী আমার স্বপ্নের সুন্দরী সেকুরেকে সামনে দিয়ে সুন্দর পোষাকে সরিয়া মতে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।

আমি সিয়াহর হাঁটা দেখছিলাম,তার কাধ দুটো একটা ছন্দে বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘আমাকে দেখ,আমাকে দেখ’,আর সেটাতে আমার মনে তার জন্যে অদ্ভুত একটা ঘৃনার পর্ব তৈরী হলো।সিয়াহর মত মানুষ যারা কোন মানসিক যন্রনায় ভোগে না,ভাবে সারা পৃথিবী তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে,অনেকটা যেন সুলতানের প্রতিটা দরজা খুলে ঢোকার সময় মাথায় শিরস্ত্রান পরা সবাইকে মাথা নীচু করে বসে থাকতে হয়।আমরা দুজন একই মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি,সে আমার সামনে,আমরা যখন ইস্তাম্বুলের এই পেচানো ঘোরানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।হেঁটে গেলাম দুই ভাই এর মত নেড়ী কুত্তাদের পাশ দিয়ে,পরিত্যাক্ত বাড়ী ঘর ফেলে,যেখানে হয়তো জিন পরীরা থাকে,মসজিদ যেখানে ফেরেশতারা আছে,পাশে পাইন গাছ শব্দ করে যেন মৃত আত্মাদের সাথে কথা বলছে।কবরস্থান যেখানে ভুতে ভর্তি,দূরে শয়তান মানুষেরা বসে আছে,সারির পর সারি দোকান,আস্তাবল,দরবেশের বাড়ী,মোমবাতির কারখানা,চামড়ার কারখানা,পাথরের দেয়াল,মনে হলো আমি তো তার পেছন পেছন যাচ্ছি না,আমি তাকে অনুকরণ করছি।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুলাই, ২০২৩ সকাল ১০:৫২

শায়মা বলেছেন: অনেকদিন ধরেই দেখছি তুমি অনুবাদ লিখছো?
এই অনুবাদ লেখার পিছে কারণ কি ভাইয়া?

তোমার প্রিয় লেখা সকলের কাছে পৌছুতে চাও?
নাকি
নিজের কোনো কাজেই লাগবে মানে যেমন ধরো বই প্রকাশ......

যেটাই হোক, অনুবাদ লেখাটা আসলেই জরুরী আমরা অনেকেই আছি অনেক কিছু পড়িনি বা জানতে পারিনি তারা জানতে পারি।

অনেক ভালোবাসা।

২৪ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ১:৪৯

ইল্লু বলেছেন: মাঝে মাঝে হিসাব ছাড়াও দু একটা পাগলামি কে না করে।ছোট বেলায় বৃষ্টির কাগজ পাতার নৌকা ভাসানোর কোন কারন যেমন থাকে না,বয়সের অনেক ভাললাগারও অত হিসেব হয় না।হয়তো আমার ভাললাগাকে জানান দেওয়া।আপনার কি মনে হয়?

২| ১৩ ই জুলাই, ২০২৩ দুপুর ২:৪০

রাজীব নুর বলেছেন: মাঝে মাঝে আমার পোষ্টে আসবেন। পড়বেন। মন্তব্য করবেন।

৩| ২৪ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ১:৪৪

ইল্লু বলেছেন: অবশ্যই

৪| ২৭ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ১০:২৬

শায়মা বলেছেন: নিজের ভালোলাগাই আসলে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.