নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১২:১০

ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা


(১২) আমি একটা সোনার মোহর

তোমরা হয়তো জান না,আমি ওটোমান সাম্রাজ্যের ২২ কারাতের সুলতানী মোহর,আমার শরীরে আছে পৃথিবীর শাসন কর্তা,মহামান্য সুলতানের ছাপ।কফির দোকানে জানাজার শেষে লেইলেক(বক)বসে বসে আমার ছবি আঁকছিল,যদিও এখনও সোনা দিয়ে ধোঁয়ানো হয়নি আমাকে,তবে একটুঁ কল্পনায় কারও তেমন একটা বুঝতে কষ্ট হবে না।আমার ছবিটা এখন সকলের চোখের সামনে,আর লেইলেক(বক)নামকরা একজন শিল্পী তার পকেটেও পাবে আমাকে।লেইলেক পকেট থেকে বের করে সবাইকে দেখাচ্ছিল আমার চেহারা,
চারপাশের উপস্থিত শিল্পী আর ছাত্র,বন্ধুরা উপস্থিত সব লোকজনকে।বাতির আলোয় আমার ঝকঝকে চেহারা দেখে,নিশ্চয় সকলের চোখ জ্বলজ্বল করছে,হয়তো অনেকের মন ঈর্ষায় ভঁরে গেছে আমার মালিক লেইলেককে দেখে।

তিনমাসে ওস্তাদ লেইলেকের উর্পাজন,আমার মত চেহারার প্রায় ৪৭টা সোনার মোহর।
ওস্তাদ লেইলেকে পকেটে আমরা সব মোহর একসাথেই আছি,ওস্তাদ কোন জায়গায় বা অন্য কোনভাবে কোথাও লুকিয়ে রাখেনি কাউকে।ওস্তাদ লেইলেক জানে তার মত প্রতিভাবান শিল্পী ইস্তাম্বুলে আর কেউ নাই,নিঃসন্দেহে তার চেয়ে বেশী আর কোন শিল্পী উর্পাজনও করে ন্স।আমার বিরাট একটা গর্ব যে শিল্পীদের প্রতিভার মাপকাঠি আমাকে দিয়েই বিচার করা হ্য়।পুরোনো দিনে সংকীর্নমনা শিল্পীরা কফির দোকানে বসে নিজেদের প্রতিভা,ছবি আঁকার পদ্ধতি,তুলির ছোঁয়া,রং এর ব্যাবহার,সব কিছুই নিয়ে বাদানুবাদ,
এমন কি মারামারিও করতো।এখন অবশ্য সবকিছু বদলে গেছে,প্রতিভা মাপা হয় আমার ঝকঝকে চেহারা দিয়ে,তাই তেমন একটা হৈচৈ গোলমাল আর হয় না,মোটামুটি একটা শান্তিকর পরিস্থিতি।

শিল্পীদের ছবি ছাড়াও,আমাকে দিয়ে কিনতে পারবে এক ক্রীতদাসীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ,মেহগিনি কাঠের সুন্দর আয়না,রুপার কাজ করা সুন্দর আলমিরাহ,১২০টা রুটি,তিনজনের কবরের খরচ,একটা ঘোড়ার দশ ভাগের এক ভাগ,একটা গরুর পা,এমন কি তাব্রিজের শিল্পী মেহমেত,দরবেশ হিসাবেও যার নাম ডাক তার এক মাসের বেতন,হয়তো সুলতানের অন্যান্য অনেক শিল্পীদের বেতনটাও।

এখানে আসার আগে আমি এক মুচির পুরোনো মোজায় প্রায় দশ দিন কাটালাম।
প্রতিদিন রাতে হতভাগা লোকটা হিসেব করতো কত কিছু সে কিনতে পারে আমাকে দিয়ে,অনেকটা মহাকাব্যের একটা অংশের মত,এমন কোথাও নেই যেখানে আমাকে খুঁজে পাবে না।

ভাবছিলাম পুরোনো দিনের কথা,অবশ্য সেগুলো বলতে গেলে কটা বই যে লেখা হবে কে জানে?এখানে আমরা তো সবাই একে অন্যের বন্ধু,আর যদি ওস্তাদ লেইলেক এফেন্দী এ ব্যাপারে যদি রেগে না যায়,আমি একটা গোপনীয় কথা বলছি,অবশ্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমাদের কেউ যেন কথাগুলো ফাঁস না করে দেয়।

বলেই ফেলি আমি কিন্ত সুলতানের চেম্বারলিতাসের টাকশালের আসল সোনার মোহর না,একটা নকল মোহর।ভেনিসের লোকজনের হাতে আমার সৃষ্টি,নকল সোনা দিয়ে আর এখানে আমাকে ওটোমান সুলতানের ২২ কারাতের সোমার মোহর হিসাবে চালানোর চেষ্টা চলছে।

ভেনিসের নকল মোহর তৈরীর কারখানায় জানলাম,নকল করার ব্যাবসাটা চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে।ভেনিসের কাফেরের দল ভেনিসের একই টাকশালে তৈরী ডুকাট যাতে সোনার সাথে মেশানো তামা,ওটোমান ডুকাতের সোনার পরিমান নিয়ে কেউ কোনদিন মাথা ঘামাইনি,মোহরের লেখাটাই ছিল যথেষ্ট,তবে দিন কাল বদলে গেল,এখন এই নকল মোহরে ইস্তাম্বুল ছেয়ে গেছে।তামা মেশানো সোনার মোহর অনেক বেশী শক্ত,তাই লোকজন দাঁত দিয়ে মোহর পরীক্ষা করা আরম্ভ করলো।

ধর ভালবাসায় পাগল কেউ একজন ছুটে গেল মাহমুতের কাছে মোহর নিয়ে,মাহমুত দাঁতে কামড়ে বলে দিবে ওটা মোহর না নকল কিছু।নকল আর আসলের পার্থক্যে তুমি বেহেশত পৌছাতে পারবে আধঘন্টা না হয় একঘন্টায়।কাফেররা বেশী ঝামেলায় না গিয়ে সোজাসুজি ওটোমান সোনার মোহর নকল করা আরম্ভ করলো,তাদের ধারণা ওটোমানদের বোকা বানানো খুব একটা কঠিন কিছু না।

মজার কথাটা এই যে,ভেনিসিয়ান কাফের শিল্পীরা ছবি আঁকে যখন,তখন তারা শুধু ছবি আঁকে না,একটা কিছু তৈরী করে,ওটা অনুকরন না ওটা সৃষ্টি।তবে মোহরের ব্যাপারে আবার ঐ ভেনিসিয়ানরাই নকল করায় বিশ্বাসী।ভেনিস থেকে ইস্তাম্বুলে আসা জাহাজের লোহার সিন্ধুক থেকে,আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম,রসুনের গন্ধে ভঁরা মোহর বদল করার দোকানে।কদিন পরে সরল মনের এক চাষী দোকানে তার সোনার মোহর বদল করতে ঢুকলো,মালিক বললো,পরখ করা ছাড়া কোন কিছু করা সম্ভব হবে না।দোকানদার চাষীর মোহরটা মুখে দেয়ার পর যখন আমাদের দেখা হলো,আমার কোন সন্দেহ ছিল না ওটা একটা আসল ওটোমান সুলতানের সোনার মোহর।রসুনের গন্ধ মুখে,বললো, ‘তুমি একটা নকল সোনার মোহর আমার দোকানে আনলে কোন সাহসে’।

চাষীটা জোর দিয়ে বললো, ‘আমার মোহর নকল হতেই পারে না।এটা তো প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমার বাড়ীতে পোঁতা ছিল,তখন তো নকল মোহরের কোন প্রচলন ছিল না’
ভাবছিলাম কি হবে যখন মোহর বদলের দোকানদার,মুখ থেকে আমাকে বের করে আসল মোহরটা রেখে চাষীটাকে দেখাবে।

‘ঐ সব কাফের ভেনিসিয়ানদের সোনার মোহর আমার দোকান সাহস করে কি ভাবে আনলে তুমি?কোন লজ্জা নেই তোমার’?দোকানদার বললো।চাষীটাও রাগারাগি করে,
আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।আরও কয়েকটা মোহর বদলের দোকানে একই কথা শুনে শেষ পর্যন্ত সে আমাকে দিয়ে মাত্র ৯০টা রুপোর মোহর নিয়ে ফিরে গেল।এ ভাবেই শেষ হলো আমার একজায়গা থেকে আরেক জায়গা যাওয়ার গল্প।

কিছুটা গর্বেই ইস্তাম্বুলে আমার সময়গুলো কাটছে এক পকেট থেকে আরেক পকেটে,একটা বুদ্ধিমান বস্তর মত।আমার কাছে ওটা একটা দুঃস্বপ্নের মত,কোন একটা বোতলের মধ্যে মাটির নীচে লুকানো অবস্থায়,এটা যে ঘটেনি তা না।বেশীর ভাগ লোকই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে অন্যের হাতে তুলে দেয়,যখন দেখে আমি একটা নকল মোহর।

একজন মোহর বদলের দোকানদার অনেকসময় ভুল করে আমার বদলে ১২০টা রুপার মোহর দেয়,তারপর যখন নিজের ভুল ধরতে পারে মাথার চুল ধরে টানাটানি করে।এর মাঝে সে প্রায়ই চেষ্টা করে আমাকে কারও হাতে তুলে দিতে,অসার্থক হয়ে দোষ সে শয়তান মানুষটাকে যে ঠকাতে দ্বিধা করেনি।

গত সাত বছরে ইস্তাম্বুলে আমি প্রায় ৫৬০ বার হাত বদল হলাম,আর এই শহরের এমন কোন মসজিদ,বাড়ী,বাজার,গির্জা নাই যেখানে আমি যাইনি।হাতে হাতে কত ধরনের গুজব,গল্প,আর মিথ্যা আমার নামে জড়ানো।আমার কাছে আমি ছাড়া আর কিছুই মূল্যবান না,আর এটাতো সত্যি যে এই অভাগা দুনিয়া নির্ভর করে আছে আমার উপরে আল্লাহর দিকে তাকিয়ে না।যারা জানে আমি একটা নকল মোহর,আমার সাথে তাদের
ব্যাবহারটা তখন হয়ে উঠে আরও জঘন্য।যদিও আমার দামটা কমে যায়,তবে
নতুন নতুন উপমা আসে মাকে নিয়ে,এটাই বলতে চাই জীবনের যন্ত্রনায় কবিতা একটা সান্তনা।এই সব নিষ্ঠুর উপমা,অপবাদ থাকা সত্বেও আমি অনেকের কাছেই প্রিয়।

ইস্তাম্বুলের সবকিছুই আমার চেনা,রাস্তার পর রাস্তা,পাড়ার পর পাড়া,এক এলাকা ছেড়ে আরেক এলাকা।ইহুদী থেকে আজারবাইজানী সব ধরণের মানুষের সাথে আমার পরিচইছয়।একবার এক মোল্লার পকেটে এর্ডিনে থেকে মানিসায় যাচ্ছিলাম,রাস্তায় ডাকাতের হাতে পড়লাম আমরা,একজন ডাকাত চীৎকার করে বললো, ‘মোহর না জীবন কোনটা চাও’?ভঁয়ে মোল্লা আমাদেরকে তার পায়খানার রাস্তায় লুকিয়ে রাখলো।ওটাই ছিল সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা,মোহর বদলানো দোকানদারের রসুন ভঁরা মুখের দূর্গন্ধের চেয়েও খারাপ।তবে কিছুক্ষন পর ডাকাতদের আরেকজন বললো, ‘তোমরা জীবনকে যদি ভালবাস,তা হলে যা মোহর আছে বের কর’।তারপর এক এক করে সবাইকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খোঁজা চললো,এর মধ্যে ঐ ছোট গর্তটায় আটকে থাকার যন্ত্রনা নিয়ে আর কি বলবো?এই জন্যেই আমি ইস্তাম্বুল ছেড়ে যাওয়া পচ্ছন্দ করি না আর।

ইস্তাম্বুলে সবাই আমাকে বেশ ভালবাসে,মেয়েরা আমাকে চুমু খায় এমন ভাবে আমি যেন তাদের স্বপ্নের শাহজাদা,বালিশের নীচে,স্তনের মাঝে,এমন কি অর্ন্তবাসেও লুকিয়ে রাখে আমাকে,ঘুমেও আমাকে আদর করতে ভুলে না।হাম্মামের পানি গরম করার চূলার পাশে,জূতার মধ্যে,গোপন পকেটে,ডালের বস্তায়ও অনেকে লুকিয়ে রাখে আমাকে।অনেকের বেল্টে,এমনকি মিসরীয় কাপড়ে মোড়া কোটের ভেতরের পকেটে,খড়ে তৈরী বসার তোষক,এমন কি মেয়েদের সালোওয়ারের পকেটেও ইস্তাম্বুলের নানান জায়গায় ঘোরার সূযোগ হয় আমার।ঘড়ি মেরামতের দোকানদার আমাকে লুকিয়ে রেখেছিল বড় দেয়াল ঘড়িতে,গ্রীক মুদির দোকানে একদলা পনিরের মধ্যে।গহনার সাথে,সিলের সাথে চিমনীর মধ্যেও সময় কাটানোর সূযোগ হয়েছিল আমার।দেখেছি বাবারা ছেলেমেয়েকে খাবারের টেবিলে রেখে আমাকে দেখতে গিয়েছে,একজন সার্কিসিয়ান মহিলা সারাদিন কাজ করার পর আমাদেরকে তারের ব্রাশ দিয়ে ঘষামাজা করতে ভুলতো না।অনেক জায়গায় ঘোরার সূযোগ হয় আমার,সুলতানের প্রাসাদ,হেরাতের বাঁধানো বই এ,গোলাপের গন্ধ ছাড়ানো জুতায়,ঘোড়ার পিঠের জিনে।অনেক ধরণের হাতেই ঘোরা ফেরার সূযোগ হয় আমার,
ময়লা,লোমে ভঁরা,মোটাসোটা,তেলে ভঁরা,বুড়ো আর কাঁপা।

আফিমের আড্ডায়,মোমবাতির কারখানায়,শুটকি মাছের গুদামে,আর ইস্তাম্বুলের ঘামের গন্ধে কোন জায়গা বাদ পড়েনি আমার ঘোরা ফেরায়।ডাকাতরা যখন দেখলো এত কিছু বলার পরও যখন ক্কিছু হলো না,তখন তাদের সর্দার চাকু দিয়ে একজনের গলা কেটে ফেললো,তখন ভঁয়ে এক এক করে সবাই যা ছিল বের করে ডাকাতদের হাতে তুলে দিল।একজন ডাকাত ব্যাগে ভঁরে রাখার আগে আমার মুখে থুতু দিয়ে বললো, ‘সবকিছু তোমার জন্যে,এত অপকর্ম শুধু ঐ একটা কারণেই’,লজ্জায় দুঃখে আমি লুকানোর জায়গা খুঁজছিলাম।আমি যদি না থাকতাম,শিল্পীর মাপকাঠি যাচাই করার কোন উপায় থাকতো না,
আর তা হলে শিল্পীদের মধ্যে হৈচৈ গোলমাল যা হতো সেটা চিন্তাই করা যায় না।আমার অস্তিত্বের এটা একটা বিরাট কারণ,আর তাই আমি ঘুরে বেড়াই প্রতিভাবান শিল্পীদের পকেটে।তোমাদের কারও যদি মনে হয়,তোমরা লেইলেকের চেয়ে বেশী প্রতিভাবান,তা হলে আমাকে খুঁজে নিও।


সবাই আমাকে ডাকে সিয়াহ নামে

ভাবছিলাম,সেকুরের বাবা কি জানে সেকুরের সাথে আমার চিঠি দেয়া নেয়ার কথা।চিঠির ভাষামত,সেটা স্বামী হারানো এক নারীর বাবাকে ভঁয়ের কথা।তবে অনেকটা নিশ্চিতের সাথে বলতে পারি,মনে হয় আমার কথাগুলো তার বাবা জানে না।নিঃসন্দেহে এসাথারের চালাক হাতটা আছে সেখানে-জানালায় সেকুরের মায়াবী চেহারা,যে বিশ্বাসে এনিষ্টে আমাকে শিল্পীদের কাছে পাঠালো,ফিরে আসার পর তার হতাশ চেহারাটা সব মিলিয়ে বেশ একটা অস্বস্তিতে ভঁরে ছিল আমার মনে।

সকালে এনিষ্টে আমাকে ভেনিসের শিল্পিদের আঁকা ছবির বর্ননা শোনাচ্ছিল।আমাদের সুলতান যাকে বলা যায় পৃথিবীর শাসনকর্তা,রাষ্ট্রদূত হিসাবে এনিষ্টে বেশ কবার ভেনিসে ছিল,
সেখানকার প্রাসাদ,গির্জা,মানুষদের দেখার সূযোগ এনিষ্টের খুব একটা কম হয়নি।ভেনিসে থাকার সময় হাজার হাজার ছবি দেখার সূযোগ হয় তার,ক্যানভাসে,কাঠের উপরে,এমন কি দেয়ালেও।একটার সাথে আরেকটার কোন মিল নাই,মানুষের চেহারা তাদের বিশেষত্ব নিয়ে নিপুণ দক্ষতায় আঁকা।ছবিগুলোর রং,ভিন্নতায়,চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যে এনিষ্টের অভিভুত না হয়ে উপায় ছিল না-শুধু তাই না আলোর ছটায় চমৎকার একটা আকাশ ছোঁয়া অনুভুতি ছুটে আসতো তার মনে।
‘তুলির ছোঁয়ার রং এর বাহার ছিল অনেকটা যেন প্ল্যাগের,ছড়ানো সারা শহরে-সবাই নিজেদের পোট্রেট করার আগ্রহে পাগল।ধনী,ক্ষমতাশালী সকলের ইচ্ছা নিজেদের পোট্রেট করার জন্যে-ওটা যেন বিরাট একটা চিহ্ন,তাদের ক্ষমতা,প্রতাপের,প্রভাবের-দেখার চোখ যেন দেখায় অভিভুত হয়ে উঠে’।
এনিষ্টের কথায় ছিল অদ্ভুত এক হীনমন্যতা,ঈর্ষা,লোভ আর আকাঙ্খা লুকানো সেখানে,যদিও ভেনিসে দেখা পোট্রেটের কথা বলতে গিয়ে আনন্দে উল্লাসে হারিয়ে যাচ্ছিল এনিষ্টে।পোট্রেট এর সংক্রামক ব্যাধি এমনই ছড়ানো ছিল যে প্রতিপত্তিশালী মানুষ,শাহজাদারা,নাম করা পরিবারের লোকজন সবাই গির্জার দেয়ালে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় দৃশ্যের ফ্রেসকো এঁকে দেয়ার জন্যে শিল্পীদের যথেষ্ট টাকাপয়সা দিতো,আশা কোনভাবে তাদের ছবিটা থাকবে সেখানে।যেমন সেইন্ট ষ্টেপানের কবর দেয়ার সময় কান্নায় ভঁরা শোকাহত মানুষদের মধ্যে শাহজাদার মুখ,কদিন আগের প্রাসাদের দেয়ালে ঝুলানো হাসি ভঁরা চেহারাটা।আবার একটা ফ্রেসকোতে,সেইন্ট পিটার অসুস্থ যন্ত্রনায় কাতর একটা লোককে সান্তনা দিচ্ছিল,ছবিটা আর কারও না,অনুরোধ করা পৃষ্ঠপোষকের ভাই,যার বাসায় আমার দাওয়াত ছিল।পরের দিন মৃত থেকে জীবিত হওয়ার ছবিটাতে দেখা গেল যে অতিথি পাশে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল,তার ছবিটা।

‘নিজেকে ছবিতে দেখার জন্যে মানুষ কি করতে ছাড়ে নি’,দুঃখ করে বললো এনিষ্টে শয়তানের প্ররোচনায় ভেসে গেল সবাই, ‘চাকর হয়ে গ্লাসে মদ ঢালার চেহারাটা,ঢিল ছেড়ে রক্তাক্ত করা মানুষটা,খুনী,এমন কি পরকীয়া প্রেমের জঘন্য একটা চরিত্র হতেও বাঁধা ছিল না কারও’।
না বোঝার ভান করে,আমি বললাম, ‘যে ভাবে আমরা পারস্যের ইতিহাসের বইগুলোতে দেখি শাহ ইসমাইলের সিংহাসনে আরোহণের দৃশ্যটা।তৈমুর লং এর ছবি,যার রাজত্বকাল ছিল হুসরেভ আর শিরিনের কাহিনীর অনেক পরে’।
বাড়ীতে কোথাও কি কোন গন্ডগোলের শব্দ আসছে?
‘অনেকটা যেন ভেনিসের ঐ ছবিগুলো আমাদের ভঁয় দেখানোর জন্য তৈরী করা’,এনিষ্টে বললো, ‘যদিও এই সব শিল্পীদের টাকাপয়সা,নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে,তারাও আমাদেরকে জানান দিতে চায় এ পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বটাও একটা রহস্যময় বিশেষ ঘটনা।প্রতিটা মুখ,চোখ,পোষাক একটা বিশেষ পরিস্থিতির ছবি তুলে ধরে আমদের চোখে।রহস্যময় চেহারাগুলো আমাদের মনে একটা ভঁয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে’।
এনিষ্টে বলছিল,একবার ঘুরতে ঘুরতে ভেনিসের,এক ধনী উন্নাসিক সংগ্রাহকের গ্যালারী ঢুকে তার চোখে পড়লো,সব নামকরা লোকজনের পোট্রেট,সুলতান থেকে শুরু সাধারণ মোল্লা,কবি,এমন কি সাধারণ সৈনিক।‘বাড়ীর মালিক আমাকে ছবিগুলো দেখার সূযোগ দিয়ে কোন একটা বিশেষ কাজের জন্য চলে গেলে,মনে হলো অবিশ্বাসীদের পোট্রেটের,চোখগুলো যেন সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে আছে,আর সার্থক ভাবে ঐ পোট্রেটে সাজানো তাদের জীবনের চেহারাটা।ছবিগুলো এত নিখুঁতভাবে আঁকা যে তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে হচ্ছিল খুঁতে ভঁরা অসহায় এক চরিত্র।মনে হলো যদি নিজের ছবিটাকে ওভাবে দেখার সূযোগ হলে জীবনটা সার্থক হতো’।

এনিষ্টের ভঁয় পাওয়ার কারণ হয়তো আর কিছু না,যে হেরাতের ওস্তাদদের এই ইসলামিক ছবি আঁকার পদ্ধতি অচল হয়ে যাবে কিছুদিনেই।‘কিন্ত এটাও আমি অস্বীকার করতে চাই না,আমার ইচ্ছা ছিল ঐ ধরণের একটা ছবি হওয়ার’,যেন শয়তান টেনে নিয়ে গেছে ঐ প্রলোভনে, ‘কি ভাবে বলবো,আল্লাহর সামনে নিজেকে বড় করার একটা জগন্য অপরাধ’।
তারপরই ভাবলাম,এই ছবি আঁকার পদ্ধতি যদিও অনেকটা একটা শিশুর খেলার মতই,তবে এটাকে শুধু আমাদের সুলতানের মনোরঞ্জন ছাড়াও ধর্মীয় বই এর কাজেও ব্যাবহার করা সম্ভব।
এ ভাবেই এনিষ্টের আলোকিত বই এর পরিকল্পনাটা তার মাথায় আসে,আর আমাদের সুলতানকে নিয়ে ঐ ধরণের একটা বই এর চিন্তাটা বেশ মানানসই।সুলতান রাজী হওয়ার পর ঠিক হলো সুলতানের ছবি,পারিপার্শিকতা নিয়ে হবে বইঁটা ‘এটর খুবই গুরুত্বপূর্ন’,আমাদের জ্ঞানী সুলতানের মন্তব্য, ‘চমৎকার একটা ছবি বই এর গল্পতে সম্পূর্নতা আনবে।ছবি যখন গল্পের সাথে হেঁটে না যায়,সেটা একটা ছবির মুর্তি হয়ে দাঁড়ায়।গল্পটায় যখন আমাদের বিশ্বাস না থাকে,তখন ছবিটাতে বিশ্বাস করা আরম্ভ করি,আমরা।অনেটা কাবাশরীফে পুতুল পূজার থেকে খুব একটা আলাদা কিছু একটা না।যদি গল্পের অংশ না হয় তাহলে ঐ লাল গোলাপ বা ঐ দাম্ভিক বামনটাকে কি ভাবে তুলে ধরা হবে’?
‘গোলাপের সৌন্দর্য আর বিশেষত্বে’।
‘তাহলে ফুলটা কোথায় থাকবে,পাতার মাঝখানে না অন্য কোথাও’।
‘সুলতানের প্রশ্নে ভঁয়ে আমি কিছুটা বিচলিত হয়ে ছিলাম তখন,যখন বুঝতে পারলাম তার প্রশ্নের ধারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে’,এনিষ্টে বললো।
এনিষ্টের ভঁয় ছিল যে বই এর পাতার মাঝখানে আল্লাহর বানী ছাড়া অন্য কিছু তুলে ধরার কথায় সুলতানের প্রতিক্রিয়াটা কি হবে।
‘তাহলে তুমি বলতে চাও’,আমাদের সুলতান বললো, ‘তুমি একটা ছবি আঁকবে যার কেন্দ্র হলো একটা দাম্ভিক বামন।তবে যা দাঁড়াবে কিছুদিন পর আর ঐ ছবিটা কোন দেয়ালে থাকবে না,মানুষ তার পূজা করা আরম্ভ করবে না,যে মানসিকতা নিয়েই তোমার ছবি আঁকা হয়ে থাকুক।আমি মনে করি এইভাবেই কাফেরের দল পয়গম্বর ঈসাকে,স্বয়ং আল্লাহর রুপ দিয়ে পূজা করে,বুঝতেই পারছো এ ভাবেই শুরু হয় পুতুল পূজা’।
এনিষ্টে বললো, ‘আমি বুঝি খুব ভালভাবেই বুঝি,আমিও ঠিক সেটাই ভাবছিলাম’।
‘এই কারণেই আর যাই হউক,আমি আমার ছবি ওভাবে আঁকার অনুমতি দিতে পারি না’,
সুলতান বললো।
যদিও তার বিপরীতটাই ছিল তার মনের কথা,এনিষ্টে বললো।
এবার আমার ভঁয় পাওয়ার কথা।

‘তবু যাই হউক এটা আমার ইচ্ছা,আমার একটা পোট্রেট আঁকবে ভেনিসের ষ্টাইলে’,সুলতান বললো, ‘তবে ঐ পোট্রেট বই এর কোন পাতায় লুকানো থাকবে,যেই বই হউক না কেন তুমি আমাকে সেটা বলে দিও’।

০০০০০০০০০

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ১:১২

রাজীব নুর বলেছেন: গল্প উপন্যাসে, সিনেমাতে ইস্তাম্বুল শহরের কথা অনেকবার এসেছে। ইস্তাম্বুল শহরে অবশ্যই বেড়াতে যাবো।

২| ২৬ শে জুন, ২০২৩ রাত ২:২৯

ইল্লু বলেছেন: ইস্তাম্বুল নিঃসন্দেহে দেখার মত একটা শহর।পুরোনো,নতুন পাশাপাশি এত সুন্দর করে সাজানো খুব কম শহরেই আছে।সুলতান হামেত,হাগিয়া সোফিয়া,blue mosque,grand bazaar, বসফরাস নদীর সফরটা ভুলবেন না।water chestnut নিয়ে পার্কে ঘুরতে ভালই লাগে।জানাবেন কেমন লাগলো ইস্তাম্বুল?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.